বর্তমানে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষায় নারীর অংশগ্রহণ পুরুষের চেয়েও বেশি। উভয় পরীক্ষাতেই ছেলেদের চেয়ে মেয়েদের ফল তুলনামূলক ভালো। অথচ স্নাতকোত্তর পর্যায়ে মেয়েদের অংশগ্রহণ নেমে যায় মাত্র ৩০ শতাংশে। মেয়েদের এই বিপুল সম্ভাবনা কয়েক বছরের ব্যবধানে অতলে হারিয়ে যাচ্ছে। উচ্চশিক্ষায় নারীর অধঃপতন কেন, তা নিয়ে আজকের প্রতিবেদন। লিখেছেন মারজান ইমু
বাংলাদেশ শিক্ষা তথ্য ও পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্য অনুযায়ী, গত ১৪ বছর ধরে উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষায় পাসের হারে মেয়েরা এগিয়ে রয়েছে। শুধু যে পাসের হারে মেয়েরা এগিয়ে তা নয়, জিপিএ-৫ অর্থাৎ ভালো ফলাফলের দিক থেকেও ছেলেদের চেয়ে এগিয়ে আছে মেয়েরা। সম্ভাবনাময় এই মেয়েরা কেন ঝরে পড়ছে? উচ্চশিক্ষার অগ্রযাত্রায় মেয়েদের প্রতিবন্ধকতাগুলো কী- প্রশ্ন রেখেছিলাম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. দিল রওশন জিন্নাত আরা নাজনীনের কাছে। তিনি জানান, ‘নারী শিক্ষার্থীদের উচ্চশিক্ষা নামক অগ্রযাত্রায় শামিল হতে না পারার পেছনে বেশকিছু কারণ রয়েছে। আর্থসামাজিক প্রেক্ষাপটে আমাদের নারীরা পুরোপুরি পুরুষের ওপর নির্ভরশীল। ছেলে সন্তান পরিবারের হাল ধরবে, তাই পুত্র সন্তানের উচ্চশিক্ষার বিষয়ে তারা অর্থনৈতিক ও মানসিক সহায়তা দিতে যতটা আগ্রহী, মেয়েদের ক্ষেত্রে ততটা নয়। এ ছাড়া উচ্চ মাধ্যমিক থেকে শুরু করে স্নাতক পর্যায়ে সিংহভাগ মেয়েকে বিয়ে করে সংসারের হাল ধরতে হয়। উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে নারীর সবচেয়ে বড় বাধা হচ্ছে সংসার ও শিশু পালনের দায়িত্ব, সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি এবং আর্থিক সক্ষমতার অভাব।’
‘মূলত পরিবারের অসহযোগিতা এবং সামাজিক পারিপার্শ্বিকতা নারীর উচ্চশিক্ষার প্রধান অন্তরায় বলে আমি মনে করি। জন্মের পর থেকেই মেয়েদের নানা রকম সম্পর্কের দায়বদ্ধতার বোঝা চাপিয়ে বড় করা হয়। মেধা থাকা সত্ত্বেও সাহস করে উচ্চশিক্ষার কথা জোর দিয়ে বলতে পারে না। বেশির ভাগ মেয়েই নিজের সম্ভাবনাকে অকাতরে বিলিয়ে দিয়ে পরিবারের মতে সায় দিয়ে বিয়ে করে। বিয়ের পর আরেক সংসারের শান্তি রক্ষার দায় বর্তায় মেয়েটির ওপর। রান্না, সংসার, বাচ্চার দায়িত্বের জাঁতাকলে হারিয়ে যায় তার উচ্চশিক্ষার আকাঙ্ক্ষা।’ এমনটাই মনে করেন খুলনা নেভি এ্যাংকরেজ স্কুল অ্যান্ড কলেজের শিক্ষক তাহমিনা আফরোজ।
উচ্চশিক্ষায় নারীর অংশগ্রহণের গড় চিত্র
২০২৩ সালের পরিসংখ্যান থেকে জানা যায়, আমাদের দেশে ১৮ বছর বয়সের আগেই ৫১ শতাংশ মেয়ের বিয়ে হয়ে যায় এবং ১৫ থেকে ১৯ বছর বয়সে মা হন দেশের ২৮ শতাংশ নারী। ফলে সংসার ও সন্তান সামলে ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও মেয়েরা উচ্চশিক্ষা নিতে পারছে না। বর্তমানে উচ্চমাধ্যমিক (একাদশ-দ্বাদশ) পর্যায়ে ছাত্রীর হার ৪৬ দশমিক ৯৭ শতাংশ, ডিগ্রি বা স্নাতকে তা ৪১ দশমিক ৩৯ শতাংশ এবং স্নাতকোত্তর শ্রেণিতে ৩৬ দশমিক শূন্য ৭ শতাংশ।
অন্যদিকে বর্তমানে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষায় মেয়েদের অংশগ্রহণ ছেলেদের চেয়েও বেশি। কিন্তু উচ্চশিক্ষা, গবেষণা ও চাকরিতে অনেক পিছিয়ে নারীরা। দেশে বিভিন্ন বিষয়ে উচ্চশিক্ষিতদের মধ্যে কতজন নারী রয়েছেন সেই সমীক্ষায় দেখা গেছে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে মেয়েদের সংখ্যা তুলনামূলক বেশ কম। বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে বিজ্ঞান বিভাগে নারী শিক্ষার্থী রয়েছেন ৮ দশমিক শূন্য ৬ শতাংশ, প্রকৌশল ও প্রযুক্তিতে ১ দশমিক ৪৬, মেডিসিনে শূন্য দশমিক ১৬ এবং ফার্মেসিতে শূন্য দশমিক শূন্য ৩ শতাংশ।
ইউরোপীয় ইউনিয়ন প্রকাশিত ২০২১ সালের এক জরিপে দেখা গেছে দেশে পিএইচডি ডিগ্রিধারীদের মধ্যে নারীদের সংখ্যা খুবই কম। বিভিন্ন বিষয়ের মধ্যে ভৌতবিজ্ঞানে ৩৮ দশমিক ৪ শতাংশ নারী, গণিত ও পরিসংখ্যান ৩২ দশমিক ৫ শতাংশ, তথ্যপ্রযুক্তিতে মাত্র ২০ দশমিক ৮ শতাংশ, প্রকৌশল ও প্রকৌশল ব্যবসায় ২৭ শতাংশ এবং স্থাপত্য ও নির্মাণে ৩৭ দশমিক ২ শতাংশ নারী উচ্চশিক্ষার সুযোগ পেয়েছেন।
উচ্চশিক্ষায় পিছিয়ে থাকার কারণে স্বাভাবিকভাবেই কর্মক্ষেত্রেও নীতিনির্ধারণী অবস্থানে পিছিয়ে আছেন বাংলার নারীরা। সরকারি চাকরিতে নারীদের অংশগ্রহণ মাত্র ২৮ শতাংশ। বিজ্ঞান ও গবেষণায় নারীর অংশগ্রহণ ২৮ শতাংশ হলেও গবেষণায় নেতৃত্ব দিচ্ছেন মাত্র ১৭ শতাংশ নারী। একটি জরিপে দেখা গেছে, সচিব ও জেলা প্রশাসকদের মধ্যে নারীর সংখ্যা মাত্র ১১ থেকে ১২ শতাংশ।
সম্ভাবনা ও সুযোগের সমন্বয় হচ্ছে না কেন?
বিভিন্ন জরিপে দেখা গেছে, দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় মেয়েদের সংখ্যা তুলনামূলক কম। অথচ উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ে মেয়েদের অংশগ্রহণ এবং পাসের হার বেশ আশাব্যঞ্জক। এর কারণ উচ্চমাধ্যমিক ও স্নাতক পর্যায়ের গ্রাম, উপজেলায় এবং জেলা পর্যায়ে যথেষ্ট কলেজ রয়েছে। ফলে বাড়ির কাছে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পাওয়ায় অভিভাবকরা মেয়েদের পড়াশোনায় অমত করছেন না। কিন্তু পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে গেলে বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই বাড়ির বাইরে নতুন শহরে গিয়ে থাকতে হয় মেয়েদের। বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলোতেও সব শিক্ষার্থীর থাকার ব্যবস্থা নিশ্চিত করা যাচ্ছে না।
শিক্ষার্থীরা কী ভাবছেন
জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কম্পিউটার সায়েন্স ও ইঞ্জিনিয়ারিং বিষয়ে বিএসসি শেষ করে উচ্চশিক্ষার জন্য প্রাগ ইউনিভার্সিটি অব লাইফ সায়েন্সে পড়তে গেছেন নারায়ণগঞ্জের লামিয়া আক্তার। লামিয়া জানান, তার উচ্চশিক্ষার পথ মোটেই সহজ ছিল না। অনেক কাঠ-খড় পুড়িয়ে পরিবারকে রাজি করাতে হয়েছে। এমনকি পড়ার খরচ জোগাতে পৈতৃক সম্পত্তি বিক্রি করেছেন। এই সুযোগ এ দেশের মেয়েদের খুব কমই আছে। বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব প্রফেশনালস থেকে এলএলএম পাস করে জার্মানির সারল্যান্ড ইউনিভার্সিটিতে পড়ছেন ঢাকার ইসরাত ইভা। ইভা জানান, ‘দেশের পড়াশোনা শেষ করে পছন্দের পাত্রকে বিয়ে করে দুজনে একসঙ্গে উচ্চশিক্ষার জন্য জার্মানি এসেছি। উচ্চশিক্ষায় পরিবারের তেমন বাধা ছিল না। তবে একা এতদূর আসতে দিয়ে খানিকটা নিমরাজি ছিল সবাই। তাই পছন্দের পাত্রকে বিয়ে করে দুজন একসঙ্গে এসেছি।
ইউনিভার্সিটি কেবাংসান মালয়েশিয়াতে মিডিয়া অ্যান্ড কমিউনিকেশন বিষয়ে পিএইচডি করছেন ফারহানা জামিল তিন্নী। তিন্নী জানান, ‘প্রথমবার মাস্টার্স করতে মালয়েশিয়া এসেছিলাম। মাস্টার্স শেষ করে সেই ইউনিভার্সিটিতেই শিক্ষক হিসেবে জয়েন করি। শিক্ষক এবং ছাত্র হিসেবে বেশ সাফল্যের সঙ্গে উতরে যাওয়ায় এবং ইউনিভার্সিটির প্রফেসরদের দেওয়া উৎসাহে, উচ্চতর পড়াশোনা ও গবেষণায় আগ্রহ জন্মায়। এরপর পিএইচডি শুরু করি। মূলত অ্যাডভান্সড রিসার্চ আর শিক্ষকতার প্রতি আগ্রহই বিদেশে পড়তে যাওয়ায় আগ্রহ জন্মেছে। বাবা-মা পড়াশোনার ব্যাপারে বরাবরই বেশ সহযোগী ছিল এবং এখনো আছে। বিশেষ করে পরিবারের প্রথম পিএইচডিপড়ুয়া হিসেবে তারা খুব গর্বিত আমাকে নিয়ে। তবে আত্মীয়স্বজনরা স্বাভাবিকভাবেই নানা মতামত চাপিয়ে দিতে চেষ্টা করেছেন। বয়স হয়ে যাচ্ছে, সংসার ধর্মই আসল ধর্ম, পিএইচডি করে কী হবে... ইত্যাদি ইত্যাদি অনেক তির্যক মন্তব্য শুনেছি আমরা। কিন্তু পরিবার পাশে থাকায় এসব বিষয় পাত্তা দিইনি।’
উত্তরণের উপায়
বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন বলে গেছেন- ‘উড়তে শেখার আগেই পিঞ্জিরাবদ্ধ এই নারীদের ডানা কেটে দেওয়া হয় এবং তারপর সামাজিক রীতিনীতির জালে আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে রাখা হয় তাদের।’ তার সুর ধরেই বলতে চাই, নারীদের মেধার বিকাশ ঘটেছে, উজ্জ্বল ক্যারিয়ার গড়ায়, বিশ্বের কাছে দেশকে উপস্থাপন করার সব রকম যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও তাদের সেই সুযোগ আমরা দিতে পারছি না। নারীর অগ্রযাত্রার যে সূচনা বেগম রোকেয়া করে গেছেন আমাদের সেই পথ ধরেই এগিয়ে যেতে হবে। পারিবারিক ধ্যান-ধারণা বদলানোর জন্য মেয়েদের জন্য সামাজিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে।
জাহ্নবী