ঢাকা ২০ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১, সোমবার, ০৩ জুন ২০২৪

উচ্চশিক্ষায় নারীদের পিছিয়ে থাকার কারণ কী?

প্রকাশ: ২৪ জানুয়ারি ২০২৪, ১২:২৭ পিএম
উচ্চশিক্ষায় নারীদের পিছিয়ে থাকার কারণ কী?
মডেল: ইরা। ছবি: শরিফ মাহমুদ

বর্তমানে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষায় নারীর অংশগ্রহণ পুরুষের চেয়েও বেশি। উভয় পরীক্ষাতেই ছেলেদের চেয়ে মেয়েদের ফল তুলনামূলক ভালো। অথচ স্নাতকোত্তর পর্যায়ে মেয়েদের অংশগ্রহণ নেমে যায় মাত্র ৩০ শতাংশে। মেয়েদের এই বিপুল সম্ভাবনা কয়েক বছরের ব্যবধানে অতলে হারিয়ে যাচ্ছে। উচ্চশিক্ষায় নারীর অধঃপতন কেন, তা নিয়ে আজকের প্রতিবেদন। লিখেছেন মারজান ইমু

বাংলাদেশ শিক্ষা তথ্য ও পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্য অনুযায়ী, গত ১৪ বছর ধরে উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষায় পাসের হারে মেয়েরা এগিয়ে রয়েছে। শুধু যে পাসের হারে মেয়েরা এগিয়ে তা নয়, জিপিএ-৫ অর্থাৎ ভালো ফলাফলের দিক থেকেও ছেলেদের চেয়ে এগিয়ে আছে মেয়েরা। সম্ভাবনাময় এই মেয়েরা কেন ঝরে পড়ছে? উচ্চশিক্ষার অগ্রযাত্রায় মেয়েদের প্রতিবন্ধকতাগুলো কী- প্রশ্ন রেখেছিলাম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. দিল রওশন জিন্নাত আরা নাজনীনের কাছে। তিনি জানান, ‘নারী শিক্ষার্থীদের উচ্চশিক্ষা নামক অগ্রযাত্রায় শামিল হতে না পারার পেছনে বেশকিছু কারণ রয়েছে। আর্থসামাজিক প্রেক্ষাপটে আমাদের নারীরা পুরোপুরি পুরুষের ওপর নির্ভরশীল। ছেলে সন্তান পরিবারের হাল ধরবে, তাই পুত্র সন্তানের উচ্চশিক্ষার বিষয়ে তারা অর্থনৈতিক ও মানসিক সহায়তা দিতে যতটা আগ্রহী, মেয়েদের ক্ষেত্রে ততটা নয়। এ ছাড়া উচ্চ মাধ্যমিক থেকে শুরু করে স্নাতক পর্যায়ে সিংহভাগ মেয়েকে বিয়ে করে সংসারের হাল ধরতে হয়। উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে নারীর সবচেয়ে বড় বাধা হচ্ছে সংসার ও শিশু পালনের দায়িত্ব, সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি এবং আর্থিক সক্ষমতার অভাব।’

‘মূলত পরিবারের অসহযোগিতা এবং সামাজিক পারিপার্শ্বিকতা নারীর উচ্চশিক্ষার প্রধান অন্তরায় বলে আমি মনে করি। জন্মের পর থেকেই মেয়েদের নানা রকম সম্পর্কের দায়বদ্ধতার বোঝা চাপিয়ে বড় করা হয়। মেধা থাকা সত্ত্বেও সাহস করে উচ্চশিক্ষার কথা জোর দিয়ে বলতে পারে না। বেশির ভাগ মেয়েই নিজের সম্ভাবনাকে অকাতরে বিলিয়ে দিয়ে পরিবারের মতে সায় দিয়ে বিয়ে করে। বিয়ের পর আরেক সংসারের শান্তি রক্ষার দায় বর্তায় মেয়েটির ওপর। রান্না, সংসার, বাচ্চার দায়িত্বের জাঁতাকলে হারিয়ে যায় তার উচ্চশিক্ষার আকাঙ্ক্ষা।’ এমনটাই মনে করেন খুলনা নেভি এ্যাংকরেজ স্কুল অ্যান্ড কলেজের শিক্ষক তাহমিনা আফরোজ।

উচ্চশিক্ষায় নারীর অংশগ্রহণের গড় চিত্র 
২০২৩ সালের পরিসংখ্যান থেকে জানা যায়, আমাদের দেশে ১৮ বছর বয়সের আগেই ৫১ শতাংশ মেয়ের বিয়ে হয়ে যায় এবং ১৫ থেকে ১৯ বছর বয়সে মা হন দেশের ২৮ শতাংশ নারী। ফলে সংসার ও সন্তান সামলে ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও মেয়েরা উচ্চশিক্ষা নিতে পারছে না। বর্তমানে উচ্চমাধ্যমিক (একাদশ-দ্বাদশ) পর্যায়ে ছাত্রীর হার ৪৬ দশমিক ৯৭ শতাংশ, ডিগ্রি বা স্নাতকে তা ৪১ দশমিক ৩৯ শতাংশ এবং স্নাতকোত্তর শ্রেণিতে ৩৬ দশমিক শূন্য ৭ শতাংশ।

অন্যদিকে বর্তমানে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষায় মেয়েদের অংশগ্রহণ ছেলেদের চেয়েও বেশি। কিন্তু উচ্চশিক্ষা, গবেষণা ও চাকরিতে অনেক পিছিয়ে নারীরা। দেশে বিভিন্ন বিষয়ে উচ্চশিক্ষিতদের মধ্যে কতজন নারী রয়েছেন সেই সমীক্ষায় দেখা গেছে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে মেয়েদের সংখ্যা তুলনামূলক বেশ কম। বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে বিজ্ঞান বিভাগে নারী শিক্ষার্থী রয়েছেন ৮ দশমিক শূন্য ৬ শতাংশ, প্রকৌশল ও প্রযুক্তিতে ১ দশমিক ৪৬, মেডিসিনে শূন্য দশমিক ১৬ এবং ফার্মেসিতে শূন্য দশমিক শূন্য ৩ শতাংশ।

ইউরোপীয় ইউনিয়ন প্রকাশিত ২০২১ সালের এক জরিপে দেখা গেছে দেশে পিএইচডি ডিগ্রিধারীদের মধ্যে নারীদের সংখ্যা খুবই কম। বিভিন্ন বিষয়ের মধ্যে ভৌতবিজ্ঞানে ৩৮ দশমিক ৪ শতাংশ নারী, গণিত ও পরিসংখ্যান ৩২ দশমিক ৫ শতাংশ, তথ্যপ্রযুক্তিতে মাত্র ২০ দশমিক ৮ শতাংশ, প্রকৌশল ও প্রকৌশল ব্যবসায় ২৭ শতাংশ এবং স্থাপত্য ও নির্মাণে ৩৭ দশমিক ২ শতাংশ নারী উচ্চশিক্ষার সুযোগ পেয়েছেন।

উচ্চশিক্ষায় পিছিয়ে থাকার কারণে স্বাভাবিকভাবেই কর্মক্ষেত্রেও নীতিনির্ধারণী অবস্থানে পিছিয়ে আছেন বাংলার নারীরা। সরকারি চাকরিতে নারীদের অংশগ্রহণ মাত্র ২৮ শতাংশ। বিজ্ঞান ও গবেষণায় নারীর অংশগ্রহণ ২৮ শতাংশ হলেও গবেষণায় নেতৃত্ব দিচ্ছেন মাত্র ১৭ শতাংশ নারী। একটি জরিপে দেখা গেছে, সচিব ও জেলা প্রশাসকদের মধ্যে নারীর সংখ্যা মাত্র ১১ থেকে ১২ শতাংশ।

সম্ভাবনা ও সুযোগের সমন্বয় হচ্ছে না কেন?
বিভিন্ন জরিপে দেখা গেছে, দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় মেয়েদের সংখ্যা তুলনামূলক কম। অথচ উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ে মেয়েদের অংশগ্রহণ এবং পাসের হার বেশ আশাব্যঞ্জক। এর কারণ উচ্চমাধ্যমিক ও স্নাতক পর্যায়ের গ্রাম, উপজেলায় এবং জেলা পর্যায়ে যথেষ্ট কলেজ রয়েছে। ফলে বাড়ির কাছে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পাওয়ায় অভিভাবকরা মেয়েদের পড়াশোনায় অমত করছেন না। কিন্তু পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে গেলে বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই বাড়ির বাইরে নতুন শহরে গিয়ে থাকতে হয় মেয়েদের। বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলোতেও সব শিক্ষার্থীর থাকার ব্যবস্থা নিশ্চিত করা যাচ্ছে না।

শিক্ষার্থীরা কী ভাবছেন 
জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কম্পিউটার সায়েন্স ও ইঞ্জিনিয়ারিং বিষয়ে বিএসসি শেষ করে উচ্চশিক্ষার জন্য প্রাগ ইউনিভার্সিটি অব লাইফ সায়েন্সে পড়তে গেছেন নারায়ণগঞ্জের লামিয়া আক্তার। লামিয়া জানান, তার উচ্চশিক্ষার পথ মোটেই সহজ ছিল না। অনেক কাঠ-খড় পুড়িয়ে পরিবারকে রাজি করাতে হয়েছে। এমনকি পড়ার খরচ জোগাতে পৈতৃক সম্পত্তি বিক্রি করেছেন। এই সুযোগ এ দেশের মেয়েদের খুব কমই আছে। বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব প্রফেশনালস থেকে এলএলএম পাস করে জার্মানির সারল্যান্ড ইউনিভার্সিটিতে পড়ছেন ঢাকার ইসরাত ইভা। ইভা জানান, ‘দেশের পড়াশোনা শেষ করে পছন্দের পাত্রকে বিয়ে করে দুজনে একসঙ্গে উচ্চশিক্ষার জন্য জার্মানি এসেছি। উচ্চশিক্ষায় পরিবারের তেমন বাধা ছিল না। তবে একা এতদূর আসতে দিয়ে খানিকটা নিমরাজি ছিল সবাই। তাই পছন্দের পাত্রকে বিয়ে করে দুজন একসঙ্গে এসেছি।

ইউনিভার্সিটি কেবাংসান মালয়েশিয়াতে মিডিয়া অ্যান্ড কমিউনিকেশন বিষয়ে পিএইচডি করছেন ফারহানা জামিল তিন্নী। তিন্নী জানান, ‘প্রথমবার মাস্টার্স করতে মালয়েশিয়া এসেছিলাম। মাস্টার্স শেষ করে সেই ইউনিভার্সিটিতেই শিক্ষক হিসেবে জয়েন করি। শিক্ষক এবং ছাত্র হিসেবে বেশ সাফল্যের সঙ্গে উতরে যাওয়ায় এবং ইউনিভার্সিটির প্রফেসরদের দেওয়া উৎসাহে, উচ্চতর পড়াশোনা ও গবেষণায় আগ্রহ জন্মায়। এরপর পিএইচডি শুরু করি। মূলত অ্যাডভান্সড রিসার্চ আর শিক্ষকতার প্রতি আগ্রহই বিদেশে পড়তে যাওয়ায় আগ্রহ জন্মেছে। বাবা-মা পড়াশোনার ব্যাপারে বরাবরই বেশ সহযোগী ছিল এবং এখনো আছে। বিশেষ করে পরিবারের প্রথম পিএইচডিপড়ুয়া হিসেবে তারা খুব গর্বিত আমাকে নিয়ে। তবে আত্মীয়স্বজনরা স্বাভাবিকভাবেই নানা মতামত চাপিয়ে দিতে চেষ্টা করেছেন। বয়স হয়ে যাচ্ছে, সংসার ধর্মই আসল ধর্ম, পিএইচডি করে কী হবে... ইত্যাদি ইত্যাদি অনেক তির্যক মন্তব্য শুনেছি আমরা। কিন্তু পরিবার পাশে থাকায় এসব বিষয় পাত্তা দিইনি।’

উত্তরণের উপায় 
বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন বলে গেছেন- ‘উড়তে শেখার আগেই পিঞ্জিরাবদ্ধ এই নারীদের ডানা কেটে দেওয়া হয় এবং তারপর সামাজিক রীতিনীতির জালে আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে রাখা হয় তাদের।’ তার সুর ধরেই বলতে চাই, নারীদের মেধার বিকাশ ঘটেছে, উজ্জ্বল ক্যারিয়ার গড়ায়, বিশ্বের কাছে দেশকে উপস্থাপন করার সব রকম যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও তাদের সেই সুযোগ আমরা দিতে পারছি না। নারীর অগ্রযাত্রার যে সূচনা বেগম রোকেয়া করে গেছেন আমাদের সেই পথ ধরেই এগিয়ে যেতে হবে। পারিবারিক ধ্যান-ধারণা বদলানোর জন্য মেয়েদের জন্য সামাজিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে।

জাহ্নবী

জেরিনের লপলপে কাবাব

প্রকাশ: ২৯ মে ২০২৪, ১২:২২ পিএম
জেরিনের লপলপে কাবাব
লপলপে কাবাব-এর স্বত্বাদিকারী জেরিন রহমান নিজ দোকানে কাবাব তৈরিতে ব্যস্ত

একই সঙ্গে পড়াশোনা, সন্তান, সংসার সবকিছু সামলে রোজ বাইরে বেরিয়ে পড়েন অর্থ উপার্জনের জন্য। সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে হরেক রকম কাবাবের মোবাইল ফুড কার্ট নিয়ে বসেন প্রতিদিন বিকেল থেকে রাত অবধি। ‘জেরিনের লপলপে কাবাব’ ইতোমধ্যে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে আগত দর্শনার্থী ও ভোজনরসিকদের মন জয় করে নিয়েছে। জেরিন রহমানকে নিয়ে বিস্তারিত লিখেছেন মোহনা জাহ্নবী

টিএসসির রাজু ভাস্কর্যের বিপরীত গেট দিয়ে প্রবেশ করলেই দেখা মেলে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে হরেক রকম খাবার আর মনোহারির অস্থায়ী দোকানের পসরা বসেছে। ঢাকার বাসিন্দারা একটু প্রাণভরে নিঃশ্বাস নিতে প্রাকৃতিক জায়গা খুঁজে থাকেন। তাই সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে রোজ বিকেল থেকে রাত পর্যন্ত অনেক মানুষের সমাগম ঘটে থাকে। একে কেন্দ্র করেই গড়ে উঠেছে এসব অস্থায়ী দোকান। গেট দিয়ে প্রবেশ করেই একজনকে জিজ্ঞেস করলাম, জেরিনের লপলপে কাবাবটা কোথায়? তিনি পথ দেখিয়ে দিলেন এবং এও জানিয়ে দিলেন জেরিন এখনো আসেননি। বুঝতে পারলাম, জেরিনকে এখানের সবাই এক নামে চেনেন। চেনারই তো কথা, একজন নারী হয়েও তিনি যেই দুঃসাহস দেখিয়েছেন, তা তো আর সবাই দেখাতে পারেন না। কিছুক্ষণ গাছের ছায়ায় বেঞ্চে বসে অপেক্ষা করার পর দেখলাম, দুই হাতে ভারী ব্যাগ নিয়ে এসে হাঁপিয়ে গেছেন জেরিন। কাছে গিয়ে পরিচয় দিয়ে বললাম, আপনার সঙ্গে একটু কথা বলতে চাই। তবে তার আগে আপনি একটু জিরিয়ে নিন। হাস্যোজ্জ্বল মুখে সম্মতি জানিয়ে জেরিন বেঞ্চে বসে পড়লেন। খানিক বাদে আমার দিকে এগিয়ে এসে পাশে বসলেন। শুরু হলো আমাদের কথোপকথন।

আগেই জেনেছিলাম, এই সাহসী নারীর বয়স মাত্র ২৩ বছর। জিজ্ঞেস করলাম, কতদিন ধরে এই কাবাবের ব্যবসা করছেন এবং এই ব্যবসার পরিকল্পনা কীভাবে মাথায় এল? উত্তরে তিনি বললেন, “ব্যবসা করছি পাঁচ মাস ধরে। বাসাতেই তো থাকি। সংসারের কাজ করা, সন্তান লালনপালন করা ছাড়াও নিজের একটা উপার্জনের উৎস থাকা প্রয়োজন মনে করেছি। তখন এই কাবাবের ব্যবসা করার পরিকল্পনা মাথায় আসে। ফেসবুকে ‘জেরিনের লপলপে কাবাব’ নামে একটা পেজ খুলি। কিন্তু পেজে রেসপন্স পাচ্ছিলাম না ঠিকমতো। তখন ভাবলাম, বাইরে গিয়েই এই ব্যবসা করব। যেই ভাবা সেই কাজ। প্রথমে আমি একটা কাঠের ভ্যান নিই। ভ্যানে করেই বিক্রি করতে শুরু করি। তারপর এখন একটা ফুড কার্ট হয়েছে আমার।”

জেরিনের কাছে আরও জানতে চাইলাম, কয়টা থেকে কয়টা পর্যন্ত রোজ কাবাব বিক্রি করেন? তিনি জানান, বিকেল ৪টা বা ৫টার দিকে এসে রাত ১০-১১টা পর্যন্ত বিক্রি করেন।

দোকান দেওয়ার জন্য সোহরাওয়ার্দী উদ্যানকে বেছে নিলেন কেন, জানতে চাইলে তিনি বললেন, ‘আমি আগে যখন সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে ঘুরতে আসতাম, দেখতাম এখানে বিভিন্ন ধরনের স্ট্রিট ফুড পাওয়া যায়। এ ছাড়া অনেক মানুষ ঘুরতে আসেন এখানে। তাই যখন কাবাবের ব্যবসা করার পরিকল্পনা মাথায় এল, বিশেষ করে যখন বাইরে গিয়ে কাবাব বিক্রি করব ভাবলাম, তখনই মনে হলো এই জায়গায় দোকান দিলে ভালো সাড়া পাব’।

‘জেরিনের লপলপে কাবাব’-এর নামের রহস্যের ব্যাপারে তিনি জানান, ‘এ নামটা দিয়েছে আমার ছোট বোন। বোনদের কাছে ব্যবসার আইডিয়া শেয়ার করে একটা ইউনিক নাম চেয়েছিলাম। তখন আমার ছোট বোন এই নামটা দিয়েছে।’

আপনার এখানে কী কী পাওয়া যায় এবং খাবারগুলোর মূল্য কেমন জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘এখানে পাওয়া যায় রেশমি মালাই কাবাব, হারিয়ালি কাবাব, শিক কাবাব, তান্দুরি, চাপ, গিলা কলিজা, উইংস ফ্রাই, লুচি, পরোটা, আলুর দম ইত্যাদি। লুচির দাম ৫ টাকা, পরোটা ১০ টাকা, হারিয়ালি কাবাব ৮০ টাকা, মালাই কাবাব ১০০ টাকা, তান্দুরি ৮০ টাকা, চাপ ৮০ টাকা, শিক কাবাব ৮০ টাকা, বটি কাবাব ৭০ টাকা, গিলা কলিজা ৫০ টাকা, উইংস ফ্রাই ৫০ টাকা।’ এসব আইটেমের ভেতর কোনটা বেশি জনপ্রিয় জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘এখানের শিক কাবাবটা মানুষ বেশি পছন্দ করেন। শিক কাবাবটা অনেক বেশি চলে।’

কথা প্রসঙ্গে জেরিনের কাছে জানতে চাইলাম সেই শুরুর গল্পটা। অমায়িক হেসে জেরিন বলতে শুরু করলেন, ‘আসলে ওই যে প্রথমদিকে বললাম, সংসার আর সন্তান সামলিয়েও নারীদের কিছু করা উচিত অর্থ উপার্জনের জন্য। যেখানে আমাদের প্রধানমন্ত্রী একজন নারী, সেখানে নারী হয়ে আমাদেরও তো কিছু করা উচিত। সত্যি বলতে আমার অনুপ্রেরণা তিনিই। তাকে দেখেই আমি শিখেছি। আমার মনে হয়েছে, প্রতিটা নারীর সাবলম্বী হওয়া উচিত। যাই হোক, এই পরিকল্পনা করার পর আমার ফুপিকে যখন আমি বলেছি, তখন তিনিও আমাকে সমর্থন জুগিয়েছেন। দুজন মিলে শেয়ারে ব্যবসা করছি। প্রথমে ছবির হাট থেকে শুরু করেছিলাম। পরে এখানে আসি।’

জানতে চাইলাম, কাস্টমারদের মতামত কী আপনার কাবাব খেয়ে? জেরিন খুব সহজভাবেই উত্তর দিলেন, ‘আসলে কাস্টমাররা ভালো-মন্দ উভয় মতামতই দিয়ে থাকেন। যেদিন ভালো হয়, সেদিন ভালো বলেন। যেদিন লবণ কম বা বেশি হয়, সেটাও সুন্দর করে বলেন। ঝাল কমবেশি হলে জানান। আসলে হোমমেড তো, আমি নিজে হাতে করি, কখনো ভালো হয়, কখনো একটু খারাপ হয়। তবু চেষ্টা করি, নিজের মতো করে সেরাটা দেওয়ার।’

কৌতূহলবশতই জিজ্ঞাসা করলাম, রোজ কত টাকার কাবাব বিক্রি করেন, মাস শেষে লাভ কেমন থাকে? তিনি জানান, রোজ গড়ে ৫-৬ হাজার টাকার কাবাব বিক্রি করা হয় এবং মাসে তার একার লাভ থাকে ২০-৩০ হাজার টাকার মতো। যেহেতু তার ফুপিও তার সঙ্গে শেয়ারে আছেন, তাই তাকেও দিতে হয় সমান ভাগ।

স্বভাবতই জেরিনের কাছে প্রশ্ন রাখলাম, নারী হয়েও যে এমন একটা পাবলিক প্লেসে এই ব্যবসা করছেন, এর জন্য কোনো সমস্যার মুখোমুখি হতে হয় না? ছোট্ট একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে তিনি বললেন, ‘হ্যাঁ, অনেক সমস্যাই হয়। বিভিন্ন ভাইয়া-আপু কটু কথা শোনান। অনেকের সঙ্গে ঝগড়া হয়, বকাঝকা করে। কিন্তু সেগুলো মাথায় নিই না। বোরখা পরে কাজ করি, তারপরও ইভটিজিংয়ের শিকার হতে হয়। পরিচিত-অপরিচিত অনেকে বলেন, নারী হয়েও ব্যবসা করলে তো পরিবারকে তোয়াক্কা করবে না, স্বামীর বাধ্যগত হয়ে চলবে না।’

জানতে চাইলাম, আপনার স্বপ্নপূরণের পথে কাদের অবদানের কথা আপনি বলতে চান? উত্তরে জেরিন খুব আত্মতৃপ্তি নিয়ে বলেন, ‘প্রথমত এর পেছনে আমার আম্মুর অনেক বড় অবদান আছে। আম্মু আমাকে শুরু থেকে এখন পর্যন্ত সবকিছুতে সহযোগিতা করছেন। দ্বিতীয়ত, আমার শাশুড়ির কিছু অবদান আছে। আমি এখানে আসতে পারি, কাজ করতে পারি, কারণ তিনি আমার আড়াই বছরের ছোট্ট শিশুটাকে রাখেন। আমার বাবুটা কখনো কখনো আমার মায়ের কাছেও থাকে। তাই আমি নিশ্চিন্তে এদিকটা সামলাতে পারি। তৃতীয়ত, আমার ফুপি, যে আমার পার্টনার, তিনি খুব সহযোগিতা করেন। এ ছাড়া খালামণি আছে। সবচেয়ে বড় কথা, আমার স্বামী। তার সমর্থন না থাকলে হয়তো কখনোই শ্বশুরবাড়ি থেকে এই কাজ করতে পারতাম না। এরজন্য আমার স্বামীকে অনেক ধন্যবাদ।’

জেরিন রহমান আরও জানান, তিনি বোরহানউদ্দীন কলেজে রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগে অনার্স দ্বিতীয় বর্ষে পড়াশোনা করছেন। অবাক হয়ে জানতে চাইলাম, পড়াশোনা, সংসার, সন্তান সবকিছু একসঙ্গে সামাল দিতে কষ্ট হয় না? তিনি খুব দৃঢ়চিত্তে বললেন, ‘কষ্ট তো হবেই। কষ্ট করলেই তো কেষ্ট মিলবে। প্রতিটা মাকেই তার সন্তানের ভবিষ্যতের জন্য কিছু করা উচিত। আমার শ্বশুরবাড়ির মানুষ কিংবা স্বামী তো আমার সন্তানের জন্য করবেই। কিন্তু মা হিসেবে তো আমারও কিছু করা উচিত। শুধু আমার নয়, প্রতিটা মায়েরই যদি সন্তান আর সংসার সামলে কিছুটা সময় হাতে থাকে তাকে সন্তানের নিরাপদ ভবিষ্যতের কথা ভেবে হলেও উপার্জন করা উচিত।’

‘জেরিনের লপলপে কাবাব’ নিয়ে জেরিন রহমানের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা জানতে চাইলে তিনি এক বুক আশা আর আত্মবিশ্বাস নিয়ে বলেন, ‘সবার সহযোগিতা আর সমর্থন থাকলে আমি একটা রেস্টুরেন্ট দেব এবং তখনো এই নামটাই থাকবে। এই নামটা কখনো পরিবর্তন করব না। আমার জন্য সবাই দোয়া করবেন।’

জাহ্নবী

প্রথম নারী ইতিহাসবিদ বান জ

প্রকাশ: ২৯ মে ২০২৪, ১২:১৯ পিএম
প্রথম নারী ইতিহাসবিদ বান জ

ধারণা করা হয়ে থাকে বিশ্বের প্রথম নারী ইতিহাসবিদ ছিলেন বান জ। যার অন্য নাম হুইবান। তিনি কেবল ইতিহাসবিদই নন, বরং দার্শনিক এবং কবিও ছিলেন। এই বিদূষী নারী পূর্ব হান রাজবংশের সময়কালে (৪৫-১১৭ খ্রিষ্টাব্দ) বসবাস করতেন। তিনি একদিকে যেমন ছিলেন প্রথম পরিচিত নারী চীনা ইতিহাসবিদ এবং অন্যদিকে এপিডাউরাসের প্যামফিলের সঙ্গে  নারী ইতিহাসবিদদের একজন।

বান জ একটি শিক্ষিত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবা বান বিয়াও ছিলেন একজন ইতিহাসবিদ। পরিবারে বিদ্যাচর্চার পরিবেশের মধ্যেই তিনি বড় হন এবং প্রাথমিকভাবে লেখাপড়া শিখেছিলেন। বান জ তার ভাই বান গু-এর অসমাপ্ত গ্রন্থ ‘হানশু’ সম্পন্ন করেন। এই গ্রন্থটি পূর্ব হান রাজবংশের প্রথম ৫০ বছরের ইতিহাস বর্ণনা করে এবং এটি চীনের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহাসিক দলিল হিসেবে পরিগণিত হয়। এ ছাড়া তিনি ‘লেসনস ফর উইমেন’ নামে গ্রন্থও লিখেছিলেন, যেখানে নারীদের জন্য আদর্শ এবং আচরণের নিয়মাবলি রয়েছে। এই গ্রন্থটি চীনা সমাজে নারীদের শিক্ষা ও আদর্শ নিয়ে গভীর চিন্তাভাবনার প্রতিফলন। গ্রন্থটি চীনের পিতৃতান্ত্রিক সমাজে নারীদের ভূমিকা এবং দায়িত্ব সম্পর্কে নির্দেশনা দেয়। গ্রন্থটিতে বান ঝাও নারীদের বিনয়ী ও আজ্ঞাপালনশীল হতে উৎসাহী করেছেন, পাশাপাশি পরিবারে নারীদের দায়িত্ব ও কর্তব্য নিয়ে কথা বলেছেন, তুলে ধরেছেন নারীদের শিক্ষা লাভের গুরুত্বও। এ ছাড়া তিনি ‘নুভে চিয়’ নামে আরেকটি গ্রন্থ লিখেছিলেন নারীদের আচরণ ও গৃহস্থালির কাজকর্মের নিয়মাবলি নিয়ে। এটি চীনা সমাজে নারীদের ভূমিকা ও দায়িত্ব সম্পর্কে গভীর অন্তর্দৃষ্টি প্রদান করে। মূলত বান জ ছিলেন নারীদের অগ্রগমনের প্রচেষ্টায় নিবেদিতপ্রাণ। বান জ তার এই স্পৃহা থেকেই তৎকালীন চীনা রাজপ্রাসাদে, রাজপরিবারের নারীদের শিক্ষা দান করতেন। ইতিহাসে অবদানের জন্য তিনি বিশ্বের ইতিহাসের প্রথম ইতিহাসবিদ হিসেবে নিজের অবস্থান করে নিতে পেরেছিলেন অনায়াসেই। তিনি নারী হিসেবে একটি বিশেষ স্থানে অধিষ্ঠিত, তার কর্মের কারণে তাকে দেওয়া হয় একজন প্রভাবশালী নারীর মর্যাদাও।

এ ছাড়া তার সময়ে এবং পরেও দীর্ঘকাল ধরে নারীর অবদানকে প্রায়শই উপেক্ষা করা হয়েছে। তাই বান জ-এর পরে একটা দীর্ঘ সময় ধরে ইতিহাস কিংবা সমাজের পরিবর্তনে নারীর উল্লেখ নেই বললেই চলে। তার এই অসামান্য কর্ম সত্যিই প্রশংসার দাবি রাখে। তার সম্পন্ন করা ‘হানশু’ বা ‘হান রাজবংশের ইতিহাস’ গ্রন্থটি ইতিহাসের এক গুরুত্বপূর্ণ সংযোজন। কারণ এটি হান রাজত্ব চলাকালীন প্রথম ৫০ বছর সময়ের ধর্মীয়, সামাজিক এবং সাংস্কৃতিক প্রেক্ষাপট সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য দেয়। বান জ-এর ইতিহাস গ্রন্থ এবং নারীর আচরণ সংস্করণের অবদান আজও স্মরণীয়। তার কাজের মাধ্যমে তিনি তৎকালীন সভ্যতার একটি উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন এবং ইতিহাসে একজন অগ্রগণ্য নারী হিসেবে স্থান পেয়েছেন। যেখানে কালে কালে নারী অবহেলিত এবং অবদমিতই হয়ে এসেছে, সেখানে বান জ-এর মতো একজন নারী যে কিনা নিজের মেধাকে কাজে লাগিয়ে অর্জন করে নিয়েছিলেন ইতিহাসবিদের মর্যাদা এবং তৎকালীন চীনা সমাজে বিস্তার করেছিলেন বিপুল প্রভাব। তার এই অসামান্য কর্ম সত্যিই প্রশংসার দাবি রাখে।

জাহ্নবী

প্যারেন্টিং নিয়ে কাজ করছেন সোনিয়া রিফাত

প্রকাশ: ২৯ মে ২০২৪, ১২:১৮ পিএম
প্যারেন্টিং নিয়ে কাজ করছেন সোনিয়া রিফাত

সোনিয়া রিফাত পেশায় একজন টেলিভিশন উপস্থাপক। উপস্থাপনার পাশাপাশি তিনি কাজ শুরু করেছেন প্যারেন্টিং নিয়ে। ফেসবুকে ‘Smart Parenting’ নামে একটি পেজ খুলে সেখানে প্যারেন্টিংয়ের নানান বিষয় নিয়ে ভিডিও তৈরি করে পোস্ট করেন তিনি।

সম্প্রতি কথা হয় সোনিয়ার সঙ্গে। তার কাছে জানতে চাইলাম, প্যারেন্টিং নিয়ে কাজ করার ভাবনা কেন মাথায় এল? উত্তরে তিনি বললেন, সমাজের প্রতি দায়িত্ববোধ থেকেই আসলে এ ধরনের একটি কাজ করার ভাবনা মাথায় এসেছে। খুব কাছ থেকে শিক্ষিত মানুষের ব্যক্তিত্ববোধ, মূল্যবোধের অবক্ষয় দেখতে দেখতে ভাবতাম মানুষ এমন কেন? কোথায় গলদ? তখন খুঁজতে খুঁজতে একটা উত্তরই পেলাম। মানুষের ছোটবেলাটা আসলে খুব গুরুত্বপূর্ণ। সেই সময়টা যদি সঠিকভাবে, সুন্দর পরিবেশে বেড়ে উঠতে পারে তবেই সুন্দর মানুষ হওয়া সম্ভব। তখন থেকেই এরকম একটি প্রজেক্ট নিয়ে ভেবেছি।

যখন প্যারেন্টিং নিয়ে কাজ করার ভাবনা তার মাথায় এল, তখন তিনি A2i ভুক্ত ‘ব্লাডম্যান’-এর সঙ্গে আইডিয়াটা শেয়ার করেন। ব্লাডম্যান সারা বাংলাদেশে ইনস্ট্যান্ট ব্লাড ডোনার খুঁজে দিতে সহযোগিতা করে। পাশাপাশি বিভিন্ন প্রত্যন্ত অঞ্চলে মেডিকেল ক্যাম্প করে থাকে। আইডিয়া শোনার পর তারা সোনিয়ার এই প্রজেক্টে সহযোগিতা করতে রাজি হন।

সোনিয়া রিফাত বলেন, ‘আমরা বিশ্বাস করি আমাদের বিশ্বের ভবিষ্যৎ-পরবর্তী প্রজন্মের ওপর নির্ভর করে। বর্তমান সময়ে প্রাচীন যুগের শাসন-চিন্তাভাবনা দিয়ে শিশুদের পর্যাপ্ত মানসিক বিকাশ সম্ভব নয়। যেখানে বাবা-মা দুজনেই প্রায় ব্যস্ত থাকেন। সবার হাতে স্মার্টফোন এবং সবাই প্রায় ক্ষুদ্র পরিবারে বিভক্ত। ছোটবেলা থেক শিশুদের মধ্যে সম্মানবোধ, ব্যক্তিত্ববোধ তৈরির জন্য এখন জরুরি হয়ে পড়েছে সঠিক প্যারেন্টিংয়ের। সন্তানের সঙ্গে বাবা-মায়ের সুন্দর সম্পর্ক বজায় রেখে সন্তানকে সঠিকভাবে মানুষ করার জন্য এখন প্রয়োজন হয় নতুন নতুন পদ্ধতি। সেই পদ্ধতি অনুসন্ধান, বিশ্লেষণ এবং বেশ কয়েকজন প্রফেশনালের সাহায্য নিয়েই আমাদের স্মার্ট প্যারেন্টিং প্রকল্পের কাজ শুরু। এখানে  প্রফেশনাল কনসালটেন্টের পরামর্শ নিয়ে, শিশু সন্তানের সঙ্গে বাবা-মায়ের সুন্দর কমিউনিকেশন বিষয়ে ইন্টারন্যাশনাল গবেষণা এবং আর্টিকেল থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে আমরা ছোট ছোট ভিডিও তৈরি করে থাকি; যেগুলো সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রচার করে সচেতনতা তৈরির কাজ করছি।’

স্মার্ট প্যারেন্টিং নিয়ে ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা সম্পর্কে জানতে চাইলে সোনিয়া বলেন, ‘ইচ্ছা আছে স্কুলে স্কুলে বাবা-মায়েদের সঙ্গে একজন প্রফেশনাল কনসালটেন্ট নিয়ে গিয়ে আলোচনা করা। শিশুর সঙ্গে কমিউনিকেশনে বাবা-মায়েরা কী কী সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছে সেগুলো জানা এবং সেসব বিষয়ে সুন্দর পরামর্শ দেওয়া’।

বর্তমান সময়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলোয় বেশির ভাগই নেতিবাচক কনটেন্ট তৈরি করা হয়। এর প্রভাব খুব সুদূরপ্রসারী এবং ভয়ানক। আগামী প্রজন্মকে একটা সুন্দর ভবিষ্যৎ দেওয়ার জন্য, তাদের প্রকৃত মানুষ হিসেবে বেড়ে ওঠা এবং সুস্থ সমাজ গড়ে তোলার জন্য সোনিয়া রিফাতের এই উদ্যেগ সত্যিই খুব প্রশংসনীয়।

জাহ্নবী

খেলাধুলায় সৌদি নারীদের অগ্রযাত্রা

প্রকাশ: ২৯ মে ২০২৪, ১২:১৬ পিএম
খেলাধুলায় সৌদি নারীদের অগ্রযাত্রা

সৌদি আরব বরাবরই একটি রক্ষণশীল দেশ ও জাতি হিসেবে পরিচিত। রক্ষণশীল কর্তৃপক্ষের কারণে এই দেশে নারীদের খেলাধুলা নিষিদ্ধ ছিল। ধীরে ধীরে এই অবস্থার পরিবর্তন হচ্ছে। সৌদি নারীরা ঘর থেকে বের হচ্ছেন, তারা বিভিন্ন খেলাধুলায় অংশ নিচ্ছেন। এমনকি সৌদি নারী ফুটবলারদের দল একটি আন্তর্জাতিক ম্যাচও জিতে নিয়েছে। এ ছাড়া দেশটির প্রধান বর্তমানে নারীদের স্টেডিয়ামে গিয়ে সরাসরি খেলা দেখার অনুমতি দিয়েছেন। যদিও সেখানে তাদের জন্য আলাদা বসার ব্যবস্থা থাকবে। 

সৌদি আরবে মেয়েদের জন্য প্রথম ডেডিকেটেড স্পোর্টস সেন্টার খোলা হয়েছিল ২০১৩ সালে; যেখানে বিভিন্ন প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছিল। এখানে শারীরিক ফিটনেস, ক্যারাটে এবং ওজন কমানোর পাশাপাশি শিশুদের জন্য বিশেষ ক্রিয়াকলাপও অন্তর্ভুক্ত ছিল। বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে নারী শিক্ষার্থীদের আনুষ্ঠানিকভাবে শারীরিক কসরত কিংবা খেলাধুলার অনুমতিও দেওয়া হয়েছে এখন। সৌদি নারীরা এখন ক্রিকেট, ফুটবলের পাশাপাশি গলফ, টেনিসের মতো খেলায়ও অংশ নিচ্ছেন।

ক্রিকেট: সৌদি নারীরা ক্রিকেটে বেশ ভালো অবদান রাখছেন। ২০১৮ সালের এপ্রিলে তারা আন্তর্জাতিক ক্রিকেট কাউন্সিল (ICC)-এর সদস্যপদ লাভ করে। সৌদি নারী ক্রিকেট দল তাদের প্রথম অফিসিয়াল ম্যাচ খেলে ২০২২ সালের মার্চ মাসে, ওমানের বিরুদ্ধে।

ফুটবল: সৌদি নারীরা ফুটবল খেলায় বেশ এগিয়ে গেছে। সৌদি আরব ২০১৭ সালে মহিলাদের ফুটবল খেলার অনুমতি দেয়। ২০১৯-এর ডিসেম্বরে মহিলা ফুটবল দলের একটি অনানুষ্ঠানিক প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হয়। সৌদি নারী ফুটবল দল ২০২২ এর ফেব্রুয়ারিতে তাদের প্রথম ম্যাচ খেলে এবং প্রথম ম্যাচেই দক্ষিণ আফ্রিকার দেশ সিসিলসকে ২-০ গোলে হারিয়ে ইতিহাস রচনা করে।

অলিম্পিক: সৌদি আরব ২০১২ গ্রীষ্মকালীন অলিম্পিকে প্রথমবারের মতো মহিলা ক্রীড়াবিদদের অন্তর্ভুক্ত করে। এবং এর ধারাবাহিকতায় তারা ২০১৬ সালেও অলিম্পিকে পুনরায় নারী ক্রীড়াবিদ পাঠায়।

সৌদি নারীদের ঘোড়দৌড় প্রতিযোগিতা
তেলসমৃদ্ধ দেশ সৌদি আরবের সবচেয়ে জনপ্রিয় খেলা ঘোড়দৌড়। এটি অত্যন্ত ব্যয়বহুল খেলা। প্রতিযোগিতাটি তিন দিনব্যাপী হয়ে থাকে। এখানে সৌদি আরব ছাড়াও মধ্যপ্রাচ্যের অন্যান্য দেশের নারীরাও অংশ নিয়ে থাকেন। সৌদি আরবে নারীদের জন্য ঘোড়দৌড়ের প্রতিযোগিতা একটি অনুষ্ঠান। নারীদের জন্য এ ধরনের প্রতিযোগিতা ব্যবসায়িকভাবে ও শারীরিক স্বাস্থ্য উন্নতির দিকে মূল লক্ষ্য রাখে। এই প্রতিযোগিতার মাধ্যমে সৌদি নারীদের স্বাধীনতা এবং সামাজিক অংশগ্রহণের সুযোগ বৃদ্ধি পেয়েছে। এটি উদার পরিবেশ সৃষ্টি করে এবং নারীদের প্রতিষ্ঠানিক প্রতিবেদনগুলো উন্নত করে। এই প্রতিযোগিতা সৌদি নারীদের স্বাধীনতা এবং সম্মান অর্জনে সাহায্য করে এবং তাদের মধ্যে একত্রিত হতে সাহায্য করে। ২০২০-এর ২৯ ফেব্রুয়ারিতে সৌদি আরবের রাজধানী রিয়াদে হয়েছিল বিশ্বের সবচেয়ে দামি ঘোড়দৌড় প্রতিযোগিতা। ‘দ্য সৌদি কাপ’ নামের এই আসরে পুরস্কারের মূল্যমান ২৭ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। তবে আশ্চর্যের বিষয় হলো রক্ষণশীল এই দেশটিতে যেখানে কালো বোরখা ছাড়া নারীদের বাইরে চলাচল করা নিষেধ, সেখানে ‘নিকোলা কারি’ নামে এক নারী জকি ঘোড়দৌড় প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়ে বেশ আলোচনায় আসেন। যদিও অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল ‘সৌদিতে নারীদের অধিকার ভয়ংকর রকম ক্ষুণ্ণ করা হচ্ছে’ বলে অভিযোগ করে। তারা আরও জানায়, ‘খেলাধুলায় সুযোগ করে দেওয়ার কথা বলে বিশ্বের চোখে ধুলো দিচ্ছে সৌদি কর্তৃপক্ষ’। কিন্তু সৌদি যুবরাজ এই মানবাধিকার সংস্থাটির কথা কানে না নিয়ে সেই নারী জকিকে সুন্দরভাবে গ্রহণ করেন। সৌদি আরবের রক্ষণশীল সমাজে নারীদের ক্ষেত্রে অনেক বিধিনিষেধ থাকলেও সম্প্রতি দেশটির সরকার কিছু কিছু ক্ষেত্রে পরিবর্তন আনার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। পশ্চিমা বিশ্বের অব্যাহত সমালোচনার মুখে দেশটির নারীরা এখন সীমিত পরিসরে স্বাধীনতা ভোগ করতে পারছেন। যার সর্বশেষ নজির ঘোড়দৌড়ে নারী জকি রাখার সিদ্ধান্ত।

কয়েকটি স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক টুর্নামেন্টে সৌদি নারী ঘোড় সওয়ারিরা অশ্বারোহণে অসাধারণ দক্ষতার স্বাক্ষর রেখেছেন। ২০১৮ সালে ‘সামা আল খলিল টিম’ ঘোড়দৌড় প্রতিযোগিতায় অংশ নেয়, যার নেতৃত্বে ছিলেন সামা হুসেইন। ৮৮তম জাতীয় দিবসে এই দলটি প্রথমবারের মতো ঘোড়দৌড়ে অংশ নিয়েছিল। টুর্নামেন্টে সৌদি আরবের নারী ঘোড় সওয়ারিরা ১৪ মিনিটের মধ্যে ঘোড়দৌড় প্রদর্শন, প্রতিবন্ধকতা লাফিয়ে পার হওয়াসহ আরও কয়েকটি ইভেন্টে অংশ নেন।

জাহ্নবী

কাজী নজরুল ইসলাম এখনো আমাদের কাছে পুরোটা অনাবিষ্কৃত

প্রকাশ: ২২ মে ২০২৪, ১২:১০ পিএম
কাজী নজরুল ইসলাম এখনো আমাদের কাছে পুরোটা অনাবিষ্কৃত
নজরুলসংগীতশিল্পী রত্না দাস ও সম্পা দাস। ছবি: শরিফ মাহমুদ

আগামী ২৫ মে বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের ১২৫তম জন্মজয়ন্তী। কবির প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে দৈনিক খবরের কাগজ-এর নারীবিষয়ক ফিচার পেজ ‘মমতাময়ী’র জন্য আমরা নজরুলপ্রেমী দুই বোনকে নিয়ে জ্যৈষ্ঠের এক বিকেলে ধানমন্ডির স্নিগ্ধ লেকের পাশে আয়োজন করেছিলাম এক আনন্দ আড্ডার। সেখানে অংশ নিয়েছিলেন বড় বোন নজরুলসংগীতশিল্পী ও শিক্ষক রত্না দাস এবং ছোট বোন শিক্ষক, নজরুল গবেষক ও নজরুলসংগীতশিল্পী ড. সম্পা দাস। সেই আড্ডার আলাপচারিতায় উঠে এসেছে তাদের নজরুল ভাবনা, সংগীতচর্চা ও নতুন প্রজন্মের কাছে নজরুলকে প্রচারের দিকনির্দেশনা। এর চুম্বকীয় অংশ তুলে ধরছেন ফিচার সম্পাদক খালেদ আহমেদ

আড্ডার দিন নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে পৌঁছালেন দুই বোন। পরিপাটি সাজে চুলে ফুল লাগিয়ে এসেছেন। এক গাল হেসে তাদের সঙ্গে কুশল বিনিময় শেষে শুরু হলো ফটোসেশন। সবুজের চাদর মোড়ানো লেকের পাশে বেশ খানিকক্ষণ চলল ছবি তোলার কাজ। এরপর শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত লেকের পাশে কাচঘেরা কফিশপে বসলাম আমরা। কফির কাপে চুমুক দিয়ে শুরু হলো আড্ডা। প্রথমেই প্রশ্ন রাখলাম বড় বোন রত্না দাসের কাছে। আপনি তো দীর্ঘদিন নজরুলসংগীত সাধনা করছেন। নজরুলের গানের প্রতি আপনার আগ্রহটা বিশেষ কোন জায়গা থেকে এসেছে? মৃদু হেসে তিনি উত্তরে বললেন, আমি একজন নজরুল গানের শিল্পী। নজরুলের গানের শিল্পী বলতে গেলে যেটি বুঝায়, সেটি আসলে একেবারেই শৈশবে শুরু হয়েছিল। যে বীজ রোপণ করা হয়েছিল, সেটি আমার বাবার হাত ধরে। আমাদের দু-বোনের ক্ষেত্রে, আমি একটু পেছনে ফিরে বলতে চাই। আমার বাবা আমাদের পিঠেপিঠি দু-বোনকে স্থানীয় একাডেমিতে নিয়ে যেতেন। তখন আমরা প্রথমে নাচ শিখি। তবে নাচের সঙ্গে সঙ্গে বাবার স্কুলে যত শিক্ষক ছিলেন, তাদের আগমন ও বিদায় সংবর্ধনায় আমাকে আগের দিন মানপত্র পাঠ করতে হতো। সে মানপত্র পাঠ করার জন্য আমাকে বারবার ডাকা হতো। আমি বেশ কয়েকবার মানপত্র পড়েছি। সেই মানপত্র পাঠ দিয়েই শুরু আমার। সে মানপত্রটা আমার বাবা লিখতেন। আমার বাবা বাংলার শিক্ষক ছিলেন এবং তিনি যা লিখতেন, আমি আজ পর্যন্ত আমার বাবার মতো এখনো কারও লেখা পাই না। এত নান্দনিক, এত আকর্ষণীয় সেই লেখা। সেই মানপত্র পাঠের বিষয়টি আসলে আমার ভেতর রয়ে গিয়েছিল। শুরুটা এভাবেই ছোটবেলা থেকে । তারপর গান শিখেছি। একদিন বাড়িতে এসে বললাম, এখন তো নাচ করি, এবার একটু গানও করতে চাই। বাবা পড়াশোনার ব্যাপারে খুবই কড়া ছিলেন। খুবই কঠিন ছিলেন। বাবা তখন বললেন, যেকোনো একটি করতে হবে। তারপর গানটাকে বেছে নিলাম। সে সময় থেকেই আমাকে বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় নিয়ে যাওয়া হতো। সেখানে সবার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেওয়া হতো, এটা স্যারের  ছোট মেয়ে। আমি হারমোনিয়াম তো বাজাতেই পারতাম না, এমনকি দাঁড়াতেও পারতাম না। আমাকে টুলে দাঁড় করিয়ে দেওয়া হতো। আমাকে কেউ হয়তো হারমোনিয়াম বাজিয়ে দিত। বাজিয়ে দিলে আমি গান গাইতাম এবং সবসময় বই পুরস্কার পেতাম। এভাবেই ছোটবেলার যাত্রা। একটু বড়বেলায় যখন আমরা গ্রাম ছেড়ে ঢাকা এলাম, তখন ছায়ানটে ভর্তি হই। সেখানে আমি উচ্চাঙ্গসংগীত শিখেছি শ্রী সুচিন্ত্য হালদার স্যারের কাছে, আর নজরুলসংগীত শিখেছি আমাদের প্রবাদপ্রতিম শিল্পী শ্রদ্ধেয় নিলুফার ইয়াসমিন, মানস কুমার দাশ, সুধীন দাশ, আমাদের নজরুল ইনস্টিটিউটের চেয়ারম্যান খায়রুল আনাম শাকিল, সুমন চৌধুরী এবং অঞ্জলি রায়ের কাছে। আর একটু যোগ করব আমি, তিন কবির গান শিখেছি কলকাতার শিল্পী সর্বানী ম্যামের কাছে। বিয়ের পর থেকে পারিবারিক সমর্থন তো সম্পূর্ণরূপে পাচ্ছি। এর মধ্যে আমি নেদারল্যান্ডসের একটি সংস্থার সঙ্গে দীর্ঘদিন কাজ করেছি। পরে আমি যেটা দেখলাম- গান করে, সংসার সামলে এবং চাকরি করে আসলে হয় না। তখন চাকরিটা ছেড়ে দিয়ে আমি এই গানটাকে প্রাণের মধ্যে রেখে দিলাম। এখন পর্যন্ত আমি নজরুলকে নিয়ে যে কাজটি করি সেটা হচ্ছে- নজরুলের যে অপ্রকাশিত ও অপ্রচলিত গানগুলো রয়েছে, সেগুলো গাইতে চেষ্টা করি।

ছোট বোন সম্পা দাসের কাছে জানতে চাইলাম নজরুলসংগীত নিয়ে ভাবনার কথা। প্রশ্ন শুনে কফির কাপে ছোট্ট করে চুমুক দিয়ে কাচের দেয়ালের বাইরে স্বচ্ছ লেকের জলের দিকে তাকালেন কয়েক পলক। বুঝতে অসুবিধা হলো না তিনি নজরুল ভাবনায় ডুব দিয়েছেন। হঠাৎই আবার ফিরলেন বাস্তবে। তবে নিমগ্ন হয়ে জবাব দিলেন এভাবে- কাজী নজরুল ইসলামকে জেনারেলাইজ করা হয় আজকে একুশ শতকে দাঁড়িয়েও তিনি কেবলই প্রেমের কবি, দ্রোহের কবি, গানের কবি ইত্যাদি হিসেবে। কাজী নজরুল ইসলামের সৃষ্টিশীল জীবন ২২ বছর, বাকি সময় কবি নির্বাক ছিলেন। এই ২২ বছরের মধ্যে ১৩ বছর তিনি একেবারেই মগ্ন সাধকের মতো আধ্যাত্মিকভাবে সুর সাধনায় মগ্ন ছিলেন এবং ১৭টির মতো রাগ সৃষ্টি করেছেন। শুধু ভারতবর্ষের সংগীতের ইতিহাসে নয়, গোটা পৃথিবীর ইতিহাসে তার মতো এত বেশিসংখ্যক সংগীত কেউ রচনা করেননি। যদিও সংখ্যাধিক্য শিল্পের মানদণ্ড বিচার করার জন্য যথেষ্ট নয়। মানদণ্ড বলতে সাহিত্যের মানদণ্ডের যে জায়গা থেকে তিনি অনেক গান রচনা করেছেন, সে কথা বলতে চাইছি না। কিন্তু তার গান যখন আমরা শুনি, সেখানে দেখা যায় যে সেটি কেবলই বাণী নয়। বাণী এবং সুরের মধ্য দিয়ে বাণী যখন আমরা পড়ি তখন এক রকমের ব্যঞ্জনা পাই। যখন সুর দেখি তখন পাই সুর এবং বাণী মিলিয়ে এক অভিন্ন ব্যঞ্জনা, এক ভিন্ন রকমের অনুভূতি তৈরি হয়। তিনি প্রায় ৫ হাজার গান রচনা করেছেন। ৩ হাজার ৩৭৬টি গান সরকারিভাবে সংরক্ষণ করা হয়েছে। বাদবাকি গান নানান চলচ্চিত্রে পাওয়া যায়, নাটকে পাওয়া যায় বিভিন্ন জায়গায়। যেটি ঘটেছে তা হলো- কবির জীবন বা জীবদ্দশায় তিনি অনেক অর্থকষ্টে ছিলেন। নানাবিধ কারণে কবি খুব চঞ্চল, অস্থির ছিলেন। আসলে অর্থনৈতিক দীনতা একটি মানুষকে ঠিক স্বাভাবিক মস্তিষ্কে, সৃজনশীল মস্তিষ্কে থাকার জন্য যে কতটা বিঘ্ন সৃষ্টি করে, কবি নজরুল সেটির একটি জ্বলন্ত উদাহরণ ছিলেন। তিনি তার প্রথম পুত্রের মৃত্যুর পর কাফনের কাপড় কিনতে পারলেন না। তখন একজন এসে বলল- আপনি যদি গান লিখে দেন তা হলে আমি যে টাকাটা দেব, সে টাকা দিয়ে আপনি তার কাফনের কাপড় কিনতে পারবেন। তখন তিনি লিখেছিলেন, ‘ঘুমিয়ে গেছে শ্রান্ত হয়ে আমার গানের বুলবুলি...।’ অর্থাৎ যখন তার এই প্রথম সন্তানের মৃত্যু হলো, তখন তিনি চিন্তা করলেন যে তিনি আর সাহিত্য রচনায় থাকবেন না। এবং একেবারেই হৃদয়ের অন্তঃস্থল থেকে এই ভাবনা তাকে পরিবর্তন করল এবং কাব্যজগৎ থেকে নিজেকে সম্পূর্ণ নির্বাসন দিয়ে তিনি সুরের জগতে চলে আসেন। এই জগতে তিনি এতটাই মগ্ন ছিলেন, এতটাই ধ্যানস্থ ছিলেন যে অসংখ্য গান লিখেছেন। তার গানের শেষ নেই, যে-ই এসেছে তাকেই দু-হাত ভরে দিয়েছেন। সুরকার কমল দাশগুপ্তকে তিনি বলেছেন, ‘শোনো, যদি একটা সমুদ্র থেকে দুই-চারটা নুড়ি চলে যায়, কিছু পানি চলে যায়, তা হলে কিন্তু সমুদ্রের পানি কখনো কমে না।’ এগুলো তার অনেক দীর্ঘ সুরজীবনের ইতিহাস। আমি যেটি বলতে চাই, যখন তিনি কাব্যজগৎ ছেড়ে দিলেন এবং সুরজগতে এলেন, তখন কিন্তু তার কাব্যের যে মেধাটা, সেটা কিন্তু সম্পূর্ণটাই সুরের ভেতরে প্রয়োগ করতে পারলেন। অর্থাৎ একজন কবি যখন সুরও জানেন, গ্রামার জানেন সংগীতের, সংগীতের রাগরাগিণী জানেন, তখন কিন্তু তার পক্ষে যে ডেলিভারিটা সেটি কিন্তু বিরাট একটি বিষয়। নজরুল যেটি করলেন, তার সেই মেধাটাকে সুরের ভেতরে ইনপুট করলেন এবং অসংখ্য রাগরাগিণী গানের যতগুলো ধারা রয়েছে- কী কাব্যগীতি, কী প্রেমের গান, কী হলি, ভজন, কীর্তন, শ্যামা, মানে বাংলা গানের যতগুলো স্টেশন রয়েছে, যতগুলো ধারা রয়েছে- সব ধারায় তিনি সংগীত সৃষ্টি করেছেন এবং এর পাশাপাশি বিভিন্ন বিদেশি সুর এনেছেন। এই স্বল্প সময়ে তিনি কীভাবে এতকিছু আত্তীকরণ করেছেন, নিজের করে নিয়েছেন, আপন করে নিয়ে সেই মালা  গেঁথেছেন, এটি স্টিল আইডেন্টিফাই। তিনি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বা বব ডিলানের মতো সাহিত্যে বা সুরে সংগীতে নোবেলজয়ী না হলেও, সাধারণ মানুষের জীবনকে আশ্রয় করে তিনি যে সাহিত্য এবং সংগীত রচনা করেছেন, সেটি সব মানুষের জীবনে মহার্ঘ্য হয়ে আছে। তবে সে বিষয়টি মানুষকে জানতে হবে যে, তার কী কী ঐশ্বর্য আছে, তখনই আমরা অনুভব করব আসলে কতটুকু সম্পদ আমাদের রয়েছে। যতক্ষণ পর্যন্ত না আমরা নিজেদের ঐশ্বর্যকে উদ্ঘাটন করতে না পারব, ততদিন পর্যন্ত আমরা নিজেরাও সমৃদ্ধ হব না যে আমরা কাজী নজরুল ইসলামের উত্তরাধিকারী, আমাদের একজন নজরুল রয়েছেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ২৪০০ গান রচনা করেছেন। অনেকে রবীন্দ্রনাথের সাথে নজরুলের বা লালনের তুলনা করেন, আসলে কারও সাথে কারও তুলনা নাই। তারা প্রত্যেকেই স্ব স্ব জায়গায় স্বকীয় মানদণ্ডে, স্বকীয় ব্যক্তিত্বে, স্বকীয় সৃষ্টিতে উজ্জ্বল। একটি শিল্প তখনই চিরকালের হয়, যখন সেটি মানুষের মনোজগতে বা অন্তর্জগতে বিশেষ প্রভাব ফেলে, মানুষ সেটা থেকে বের হতে পারে না। তখনই কিন্তু সেটি শিল্প হয়ে যায়। সেই অর্থেই পৃথিবীতে প্রতিটি মানুষ যেমন আলাদা, তেমনি প্রতিটি সৃজনশীল মানুষ আলাদা, তেমনি নজরুল, রবীন্দ্রনাথ এবং লালনও আলাদা আলাদা স্বকীয় মাধুর্যে, স্বকীয় ব্যঞ্জনায় তারা স্বতন্ত্র ব্যক্তিত্বের মানুষ। তবে কাজী নজরুল ইসলাম এখনো আমাদের কাছে ‍পুরোটা অনাবিষ্কৃত। এবং তার ভেতরে যে ঐশ্বর্য রয়েছে, সেগুলো উদ্ঘাটন হওয়া প্রয়োজন আছে বলে আমি মনে করি।

এবার প্রশ্ন রাখলাম রত্না দাসের কাছে। বিশেষ দিবস ছাড়া নজরুলসংগীতের অনুষ্ঠান কম হওয়াটা আপনি কীভাবে দেখেন? জবাবে তিনি বলেন, শুধু নজরুলের প্রয়াণ আর জন্মদিনেই খোঁজ করে সবাই। কিন্তু নজরুল আসলে কতটা প্রাসঙ্গিক আমাদের জীবনাচরণে- সেই দিক থেকে নজরুলের গানকে প্রসার, সম্প্রসারণ যাই বলেন না কেন যদি সেটি করতে হয়, নজরুলকে ছড়িয়ে দিতে হবে বিশ্বময়। বিশ্বময় ছড়াতে গেলে বিশ্ব যা চায়- নজরুলের গানের আদি সুর, বাণী এগুলো ঠিক রেখে, নতুন করে সংগীত আয়োজনের সিদ্ধান্ত অবশ্যই নিতে হবে। কেননা পরবর্তী সময়ে এই যে আমাদের কবি, এত মেধাসম্পন্ন একজন কবি বাংলা সাহিত্যে আর দ্বিতীয়টি আসবেন কি না, আমার তো মনে হয় না।

ফিরলাম সম্পা দাসের কাছে। প্রশ্ন ছিল- বর্তমান প্রজন্মের মানুষ কি নজরুলের চেতনাকে সঠিকভাবে অনুধাবন করতে পারছে? উত্তরে তিনি বলেন, নজরুলের চেতনাকে বুঝতে হলে আগে নজরুলের চিন্তার প্রক্রিয়া সম্পর্কে জানতে হবে। নজরুলকে তো কেউ চিনলই না। এখন পর্যন্ত বাংলাদেশে যারা বুদ্ধিজীবী রয়েছেন, তারা যখন সাহিত্যিকদের কথা, রবীন্দ্রনাথের কথা, লালনের কথা বলেন, তখন কিন্তু নজরুলের প্রসঙ্গটি ইচ্ছে করেই তাদের কৌলীন্যবোধ থেকে সুকৌশলে এড়িয়ে যান এবং নজরুলকে মর্যাদা দেওয়া তো দূরের কথা, তারা স্বীকৃতিই দিতে চান না।

আরেকটু সংযোজন করতে চাই, নজরুলকে আসলে কেউ হিন্দুর কবি বলেন, কেউ মুসলমানের কবি বলেন, যেটি নিয়ে খুব দ্বন্দ্ব বাঁধে, যুদ্ধ বাঁধে রীতিমতো। নজরুল কিন্তু মানবতার কবি, এই কথাটা কিন্তু কেউ বলে না। নজরুলকে সব সময় দ্রোহ দিয়ে ঢেকে দেওয়া হয়। এক কথায় যদি বলতে চাই, তিনি মানবতার কবি। তিনি বলেছেন- ‘মোরা এক বৃন্তে দুটি কুসুম হিন্দু মুসলমান, মুসলিম তার নয়নমণি, হিন্দু তার প্রাণ...।’ তিনি একাধারে শ্যামাসংগীত লিখেছেন, ইসলামিক গান রচনা করেছেন। ওনার ইসলামি গান ‘ও মোর রমজানেরও রোজার শেষে’ না হলে আমাদের ঈদ সম্পূর্ণ হয় না, পূর্ণতা পায় না। তেমনই করে তার রচিত কালীর যে বন্দনা, প্রচুর শ্যামাসংগীত এসব ছাড়া আমাদের পুজো সম্পূর্ণ হয় না। তারপর তিনি নাটকের জন্য গান লিখেছেন স্বকণ্ঠে এবং ওনার সৃষ্ট রাগরাগিণী প্রচুর আছে। এত সীমাহীন বিস্ময় নজরুলকে কেন্দ্র করে, সারাজীবনেও এই বিস্ময় কাটবে না, ঘোর লাগা থাকবেই।

জাহ্নবী