ঢাকা ১২ শ্রাবণ ১৪৩১, শনিবার, ২৭ জুলাই ২০২৪

শ্রেষ্ঠ রাঁধুনি পুরস্কার

প্রকাশ: ১৫ মার্চ ২০২৪, ১১:৫৯ এএম
আপডেট: ১৫ মার্চ ২০২৪, ১১:৫৯ এএম
শ্রেষ্ঠ রাঁধুনি পুরস্কার
অলংকরণ: মাসুম

গত সংখ্যার পর

বন্ধুকে কৃত্রিম রাগে শাসায় রুকু। কিন্তু পায়েল থামে না। বলে 
-ওই দেখ, দুপাশের দোকানির দল দোকানদারি ভুলে কেমন তাকিয়ে আছে। 
রুকু সেদিকে তাকায় না। তবে সে জানে বাড়ির রাস্তার মোড় থেকে আদর্শ কলেজ পর্যন্ত রাস্তার পাশের দোকানিরা তাকে চেনে। সে যখন কলেজে যায় অথবা কলেজ থেকে বাড়িতে ফেরে, তারা তার দিকে, তার সৌন্দর্যের দিকে অপলক তাকিয়ে থাকে। তবে তাদের এই সৌন্দর্য দর্শনে ঔৎসুক্য আছে, উত্তেজনা নেই সে বেশ বুঝতে পারে। বুঝতে পারে, এইসব লোক তার সৌন্দর্যের পূজারি। তারা কোনোদিন পূজারির গণ্ডি ছাড়িয়ে তাদের স্পর্ধিত হাত সামনে অগ্রসর করবে না। তাই তাদের এই বিভোল চাওয়া সে উপভোগ করে, উপভোগ করে আপ্লুত হয়। 

রাস্তার দুপাশে শিক্ষার্থীরা লাইন ধরে স্কুল-কলেজে যাচ্ছে। তাদের বিচিত্র পোশাক আর বিচিত্রতর কলহাস্যে বোয়ালভাসা নদীর দুই তীর উপচে পড়ছে। দোকানিরা এ সময় বিকিকিনি ভুলে রাস্তার দিকে তাকিয়ে থাকেন। স্থানীয় সুশীল সমাজ এ ব্যাপারে ইভ টিজিংকে সংশ্লিষ্ট করে অনেক বিবৃতি দেয় কিন্তু নিছক সৌন্দর্যের প্রতি পক্ষপাতবিহনে এদের অন্য কোনো উদ্দেশ্য নেই- সাফ রায় দিয়ে বাজার সমিতি তথা আদর্শপাড়ার চেয়ারম্যান দোকানিদের অভিযোগ থেকে বেকসুর খালাস দিয়ে দেন- তিনি নিজেও এ দলের একজন কি না। 
রুকু আর পায়েল ধীরে, অতি ধীরে সামনে এগোতে থাকে। 

সূর্য পুকুরপাড়ে অর্জুন কি অশোকগাছের সারি বোয়ালভাসা নদীকে রাস্তার আড়ালে নিয়ে গেছে। পথ এখানে নির্জন। মেয়েদের গতি হয় দ্রুত। রুকু এবং পায়েলও জোর কদমে চলতে থাকে। যেন-বা সাফা মারওয়া পাহাড়ের মাঝখানে চলনশীল মা হাজেরার পায়ের গতি জমজম দর্শনে আচম্বিতে বেড়ে গেছে। 

বনানীর শেষ প্রান্তে মহাসড়কের বাসগুলো দাঁড়িয়ে থাকে। কিছুটা যাত্রী ধরার আশায় আর বেশির ভাগ সাত সকালে চলাচলরত স্কুল-কলেজের ছাত্রীদের দেখার জন্য। 

তাদের সহজ বক্তব্য- 
ছাত্রীদের চলাচলের সুবিধার্থে তারা বাসের গতি কমিয়ে দেয় অথবা থেমে যায়। কিন্তু চট্টগ্রাম-রাঙ্গামাটি রোডে চলা বাসের স্বল্পশিক্ষিত ড্রাইভাররা, তাদের হেলপাররা সুবেশী ছাত্রীদের সঞ্চরণ, তাদের কলহাস্য, চোখের অপাঙ্গে জমা ভ্রূকুটি যে নির্মল আনন্দভরে অনুভব করে তা ছাত্রীরা যেমন জানে, রাস্তার প্রতিটি মানুষও জানে। কিন্তু কেউ কিছু বলে না। 

দীর্ঘদিনের অভ্যাসে এখানকার ছাত্রীরাও বাংলাদেশের অন্য দশটি এলাকার ছাত্রীদের চেয়ে আলাদা হয়ে উঠেছে। একমাত্র রুকু ছাড়া, যে তার সৌন্দর্যের সুবাদে এমনিতে সর্বপরিচিতা হয়ে গেছে, প্রায় সব ছাত্রী নিজেদের নিত্যনতুন উপস্থাপনায় পারদর্শী হয়ে উঠেছে। প্রথম প্রথম তা ছিল বাড়তি বিড়ম্বনা, নারীত্বের নতুন পরিহাস- কিন্তু কালের বিবর্তনে তা এলাকার রসমে পরিণত হয়েছে। এটাই প্রাত্যহিক ব্যাপার এখন। এজন্য ছাত্রীদের মধ্যে নতুন কোনো আনন্দ কি উত্তেজনা ঝিলিক মেরে ওঠে না আর। যেন এভাবেই সেজে বের হতে হয়, এই র্যাম্পের মডেলের মতো সড়কের পাশ দিয়ে আলস্য বিলাসে চলতে হয় বলেই চলা। 

অবশ্য রাস্তা এবং রাস্তার পাশের দর্শক-শ্রোতা, বাসের ড্রাইভার, কন্ডাক্টর আর দোকানি- তাদের উদ্যমে এতটুকু ভাটার টান লেগেছে বলে মনে হয় না। ছাত্রীদের দেখাদেখি নিজেরাও টেরি কেটে, বডি স্লিম শার্ট গায়ে বাসে কি দোকানে এসে সাতসকালে হাজির হয়ে যায়। তারপর চলতে থাকে অপেক্ষার পালা। 

সাড়ে আটটা নাগাদ ছাত্রীদের পথচলা শুরু হয়। নয়টা বাজতে না বাজতে তাদের কলহাস্যে মহাসড়কের দু-কূল উদ্বেলিয়া ওঠে। নতুন ছাত্রীরা নবরসের নতুন আনন্দে বরষার প্রথম বৃষ্টিপাতে উচ্ছল মরালীর মতো গ্রীবা উন্নত করে বিলম্বিত লয়ে মঞ্চে হাঁটার মতো পথ চলতে থাকে। পুরনোরা মুখস্থ গতিতে পথটুকু পার হয় নির্বিকার। কিন্তু দর্শকরা বরাবরের মতো অটল একাগ্রতায় তাদের পথচলা আবিরল অবলোকন করতে থাকে।

তারা শত মেয়েদের মধ্যে কয়েক জনকে অবশ্য আলাদা করতে পারে। আলাদা করেছেও। নাম জানা নেই কারও। তবে তাতে তাদের থোড়াই আসে-যায়। যেমন প্রত্যেকে চেনে কাজী বিলের মাঝামাঝি ধূর দিয়ে যে মেয়েটি বোয়ালভাসার পূর্ব তীরে ওঠে আসে, ‘মালকা বানু’র মতো চেহারা তার আর হাঁটে ‘আনোয়ারা’র মতো। মহাকবি আলাওলের সোনার প্রতিম মেয়ে মালকা বানু আর নজিবুর রহমান সাহিত্যরত্নের ‘আনোয়ারা’ উপন্যাসের নায়িকার বাইরে তাদের কল্পনা বিস্তৃত হতে পারে না। আরেকজনের কথা ইদানীং তারা বলে, ব্রাহ্মণবাড়ি থেকে ঠিক আটটার সময় উঠে আসে সে। লম্বা, বিলোল চাহনি। একেবারে মাটির দিকে তাকিয়ে অহল্যার মতো পথ চলে। তারা তার নাম দিয়েছে সাবিত্রী। 

অবশ্য রুকু এসবের মধ্যে আলাদা। তারা তার সঙ্গে অন্য কারও তুলনা করে না। বাছাই করা সুন্দরীদের প্রত্যেকের জন্য তাদের নিজস্ব সাংকেতিক নাম আছে; যেমন আনোয়ারা, জুলেখা, সাত ভাই চম্পা ইত্যাদি। কিন্তু রুকুকে ওরা নাম দিয়েছে ‘সেই মেয়েটি’। অবশ্য যাকে ঘিরে এ আনন্দ উল্লাস চলে, নিত্য রচিত হয় প্রেমোপাখ্যান, বিংশতি বর্ষীয়া রুকু নামের মেয়েটি আনন্দ-বেদনার এ কাব্যের কিছুই জানতে পারে না। তার দিন যায় দিন যাপনের দায় মেটাতে। 

অশোকবাগানের পর খাঁ সাহেবের বাড়ি। বেড়া দেওয়া উপবনের পেছনে প্রাচীন দোতলা বাড়ি। বনে বিলিম্বি আর বহেরা ধরে থাকে সারা বছর। তার চেয়েও বড় ব্যাপার, বহেরাবৃক্ষ তলে খাঁ সাহেব আরাম চেয়ারে বসে থাকেন দিনের পর দিন। তাঁর কী রোগ- বাত না প্যারালাইসিস- পড়ুয়ারা ঠাহর করতে পারে না। রুকু জানত না, যদি না নিম্নলিখিত কাহিনি ঘটত একদিন : 

এসএসসি পরীক্ষার পর দীর্ঘ বিরতি চলছে। রুকুদের এমন কোনো আত্মীয় নেই যে অন্য সবার মতো সে বেড়াতে যাবে। তা ছাড়া বৃদ্ধ পিতাকে একলা ফেলে সে কোথায় যায়। অগত্যা বাড়িতেই দিন কাটছিল তার। তবে শুধু শুধু দিন কাটানোর মেয়ে রুকু কোনো দিন ছিল না। তার দিন কাটছে সীমিত সাধ্যের মধ্যে যতটুকু সম্ভব সেরা রাঁধুনি হওয়ার স্বপ্নে বিভিন্ন রেসিপির অনুশীলনে আর অতি অবশ্যই কবি পিতার লেখা নতুন নতুন গানে কণ্ঠ দেওয়াতে। 

সেরকম একদিন ভোরবেলা। রাগ খামাজের ওপর পিতার লেখা অসাধারণ এক গানে কণ্ঠ দিচ্ছিল রুকু-
-যারে ভালোবাসি আমি
কেমনে বোঝাই তাহারে-
ভালোবাসা যায় শুধু, 
বলা যায় না রে-
প্রথম অন্তরাতে গিয়ে কবি হাসান আলী টের পেলেন তিন তালে গানটি জমবে ভালো। মেয়ে বলল, কাহারবাতে গাই বাবা? গানের তাল কি সুর পিতা পুত্রীর আবদারের বিষয় কি না ভাবছেন কবি। পাশে নোরা নামের বিড়ালকে জিজ্ঞেস করলেন- 

-তুই কী বলিস? গান কি এভাবে বাপ-বেটির ইচ্ছাতে চলে? 
বিড়াল কী একটা অব্যক্ত আওয়াজ তোলে রুকুর কোলঘেঁষে আরও জাঁকিয়ে বসল। ডানাভাঙা কাকটি গুটিপায়ে এগিয়ে আসে। বোদ্ধা শ্রোতার মতো বসে থাকে লেঝঝোলা পাখিটি। কবি পশু-পাখিদের ভাষা বোঝেন না, তবুও আবেগের বসে বলেন, কী বলিস তোরা? তারপর নিজেই কাহারবা তালে অন্তরা আর সঞ্চারীটুকু দোতারায় ফুটিয়ে তোলেন-

আমি গাইতে পারি মুখের কথা
সইতে পারি বুকের ব্যথা 
কইতে নারি ভালোবাসি রে...
রাতে বন্ধু জাগি একা 
ভাবি যদি হয় গো দেখা 
সকল কিছু দিতাম তাহারে। 
জানি সেও আমারে ভাবে 
ভালোবাসি কে বলিবে 
এমন দ্বন্দ্বে জীবন গেল রে। 

রুকুর মুখ খুশিতে উদ্ভাসিত হয়। অন্তরাটুকু পিতার মনের মতো করে গেয়ে ফেলে। কিন্তু যেই সঞ্চারীতে নামল, গেটে কড়া নাড়ল কেউ। 
পিতা-পুত্রী দুজনই ব্যাকুল আগ্রহে বাড়ির গেটের দিকে তাকিয়ে থাকে। আজ এই অবেলায় কে আসতে পারেন? ওর তো পরীক্ষা কেবল শেষ হলো। এক মাস আগে ফল ঘোষণার কথা নয়। কে হতে পারেন? কী সংবাদই-বা তিনি বহন করে নিয়ে এসেছেন? 

গেট খুলে আবাক হয়ে গেলেন কবি হাসান আলী। হুইলচেয়ারে বসে আছেন খাঁ বাড়ির ইবরাহিম খাঁ। কবি সালাম দেওয়ার আগেই প্রশ্নের মুখোমুখি হলেন-

-আপনার মেয়ে কোথায়? তার কী হয়েছে? 
কবি প্রথমে ভয় পেয়ে গেলেন। মেয়ের কোনো বিপদ হয়নি তো! পরে সাহস সঞ্চয় করে বললেন-ওই তো, আমারা দুজন মিলে একটা গান তুলছিলাম, বলতে বলতে লজ্জায় তার কণ্ঠ খাদে নেমে আসে। 

খাঁ সাহেব বললেন, আলহামদুলিল্লাহ, আল্লাহ বাঁচানেওয়ালা। 
বাপ-বেটি দুজনই দুই আগন্তুকের দিকে অদ্ভুত তাকিয়েছিল। তারপর আগন্তুক হাসিতে ভেঙে পড়লেন। তাঁর মেয়েই কাহিনি সবিস্তারে বলল- 
-ক্লাস সিক্স থেকে ক্লাস টেন পর্যন্ত টানা ছয় বছর প্রতি দিন একই সময়ে ঠিক সাড়ে আটটার সময় তাদের বাড়ির সামনে দিয়ে স্কুলে গেছে রুকু। পক্ষাঘাতগ্রস্ত খাঁ সাহেব বাড়ির সামনে ভোরের রোদে অপেক্ষা করতেন প্রতিদিন আর রুকুকে দেখলে হাঁক দিয়ে বলতেন, মেয়েটি গেল, আমার ওষুধ নিয়ে আয় মা। 

রুকু আর তার পিতা হাসান আলী তন্ময় হয়ে শুনছিল- 
রুকু ছিল খাঁ সাহেবের কাছে ঘণ্টার মতো। দিনের পর দিন, বছরের পর বছর এ ঘণ্টায় অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছিলেন তিনি। অথচ তার পরিচয় পর্যন্ত তিনি জানতেন না অথবা জানার তাগিদ বোধ করেননি কোনো দিন। তাঁর নিশ্চিত বিশ্বাস ছিল, সে যুগ যুগ ধরে এভাবে প্রতিদিন ঠিক সাড়ে আটটার সময় স্কুলে যেতে থাকবে আর তিনি তার আগমনের ঘণ্টা ধরে সকালের ওষুধ খেতে থাকবেন। মেয়েটি যে একদিন বড় হবে, তার স্কুলের পড়াশোনার একদিন হবে সমাপ্তি অথবা বিয়ে থা হয়ে অন্যত্র সে করবে ঘরবসতি- এসব তাঁর চিন্তাতেই ছিল না। 

চলবে...

প্রথম পর্ব

দ্বিতীয় পর্ব

তৃতীয় পর্ব

চতুর্থ পর্ব

পঞ্চম পর্ব

ষষ্ঠ পর্ব

সপ্তম পর্ব

অষ্টম পর্ব

নবম পর্ব

দশম পর্ব

বাংলাদেশ

প্রকাশ: ২৬ জুলাই ২০২৪, ০১:৪৫ পিএম
আপডেট: ২৬ জুলাই ২০২৪, ০১:৪৬ পিএম
বাংলাদেশ

তোমার দুচোখ ক্লান্ত ভারী, চুলও এলোমেলো
হাওয়ায় হাওয়ায় উড়ে উড়ে মেঘের দেশে গেল
ঘুমাওনি কি কাল সারা রাত চোখের কোনে কালি
অনাদরে কাটছে সময়? দেয়ালজোড়া বালি?

দণ্ড

প্রকাশ: ২৬ জুলাই ২০২৪, ০১:৪৩ পিএম
আপডেট: ২৬ জুলাই ২০২৪, ০১:৪৬ পিএম
দণ্ড

ডাকলে যদি ফিরলে কেন তবে?
স-ব দ্বিধা মেঘ ঝেড়ে ফেলে
              দাঁড়িয়েছিলাম সবে।

যেই মেলেছি আলোকিত ভোরের দিকে চোখ,
কিন্তু কেন আকাশজুড়ে নামল ব্যাকুল শোক?
সেই শোকেতে জীবনভরা নিমজ্জিত রই,
দিয়েছিলাম কবে তোমার পাকা ধানে মই?

দণ্ড দিলে দণ্ড নিলাম দু’হাত পেতে আমি,
তার বদলে সারা জীবন সুখে থেকো তুমি!

এসো তবে রাগ-বেহাগে

প্রকাশ: ২৬ জুলাই ২০২৪, ০১:৪০ পিএম
আপডেট: ২৬ জুলাই ২০২৪, ০১:৪০ পিএম
এসো তবে রাগ-বেহাগে

আমায় নিয়ে চলছে এখন দয়াল রসের খেলা…
তোমার সঙ্গে মেলে না আর রৌদ্র-বৃষ্টির কোনো একটি বেলা?
তুমি থাকো সোমেশ্বরী কিংবা ধরো কংস পরপারে
যমনগরে তোমার পাশে, থাকি আমি- ডাকি বারে বারে।

যখনই আমি দেখব বলে মুখটি বাড়াই ধীরে
তুমি তখন বিরল-পাখি যাও চলে যাও আরও দূরে 

মৃত্যুরূপে আসো যদি, প্রণয়বিধুর, বন্ধু তো হও আগে!
যখনই হোক- এসো তবে মাতৃরূপেন রাগ-বেহাগে…

বহুমূত্র

প্রকাশ: ২৬ জুলাই ২০২৪, ০১:২৪ পিএম
আপডেট: ২৬ জুলাই ২০২৪, ০১:২৪ পিএম
বহুমূত্র
অলংকরণ: নিয়াজ চৌধুরী তুলি

পিঠ চুলকাচ্ছে, কিন্তু হাত পেছনে নিতে পারছিল না ফজর আলি। এতটাই চুলকাচ্ছে, কোথাও দাঁড়িয়ে-বসিয়েও থাকতে পারছিল না সে। অগত্যা সরু এবং কিছুটা মসৃণ একটা আমগাছের সঙ্গে পিঠ ঠেকিয়ে ঘষতে লাগল। এতটাই ঘষাঘষি করল পিঠের ছাল-চামড়া উঠে প্রায় রক্তাক্ত; যা দেখে আমগাছও বেকুব।

তখন প্রায় দুপুর। চোত মাসের ঠা ঠা গরম। তবুও তার ঘন ঘন হিসু চাপছিল। লুঙ্গির কাছা তুলে আমগাছের গোড়াতেই সোঁ সোঁ করে বদনাখানেক হিসু করল সে; যা দেখে আমগাছ আরও বেকুব। আমগাছের মতো সে নিজেকে বেকুব ভাবল  না; বরং মজাই পাচ্ছিল; কারণ, দেখতে না দেখতে পিঁপড়েরা সারি বেঁধে তার হিসুর আশপাশ জড়ো হচ্ছিল। প্রায় দেড় যুগ ধরে খেয়াল করছে বিষয়টা; তবে আজকের মতো নয়। কোত্থেকে এত এত পিঁপড়ে এসে হাজির! তার হিসুতে চিনি আছে নাকি, মনে মনে হাসল সে। 

বয়স প্রায় চল্লিশের কাছাকাছি, এখনো বিয়ে থা করেনি। শরীর ঝিমঝিম করা, হাত-পা জ্বালা, ঘাড় টনটন করা, মাথাঘোরা, চোখে অন্ধকার দেখা, ঘন ঘন হিসু- এগুলো দীর্ঘদিন ধরে, কিন্তু ডাক্তারের কাছে কখনো যায়নি সে। যাওয়ার প্রয়োজনও বোধ করেনি। খুব বেশি কাবু মনে করলে পাড়ার হাতুড়ে ডাক্তারের শরণাপন্ন হতো। ডাক্তার তাকে তার নিজস্ব উদ্ভাবনী বটিকা সেবনের পরামর্শ প্রদানের পর খাদ্যতালিকাও ধরিয়ে দিত; যেখানে বেশি বেশি ভাত খাওয়ার কথা থাকত এবং শারীরিক দৌর্বল্য কাটাতে ইচ্ছেমতো আখের রস, গুড়ের সরবত কিংবা গ্লুকোজ।

তাতেও স্বাস্থ্য ফিরছিল না; বরং দিনকে দিন তালপাতার সেপাই বনে যাচ্ছিল। বাড়ির সবাই চিন্তায় পড়ল। বিশেষ করে তার মা। সবাই বলাবলি করল বিয়ে না দিলে তার স্বাস্থ্য ফিরবে না। কিন্তু যে বেটা বিয়ে করবে তার মধ্যে তো জোশ থাকতে হবে? তার মধ্যেই জোশ নেই। বিয়ের কথা শুনলে কেমন যেন গুটিয়ে যেত সে! ভয়ে বাড়ি ছেড়ে পালাতে চাইত। চক্ষুলজ্জার ভয়ে পালাত না ঠিকই, বিয়ের সম্বন্ধ এলেই দূরে দূরে থাকত। কিন্তু এভাবে বেশি দিন দূরে দূরে থাকতে পারল না আর। পাশের গ্রাম থেকে সম্বন্ধ এলে পরিবারের সবাই জোর করে বিয়ের কড়া পরিয়ে দিল তার হাতে।

পাত্রী বেশ নাদুসনুদুস এবং খাটো। বেঢ়পও বটে; ছোটখাটো হস্তির মানুষরূপী সংস্করণ। গুনে গুনে ধাপ ফেলত; এবং যেখানে ফেলত সেখানকার মাটি আধা ইঞ্চি দেবে যেত। মাংসজাত খাবার এবং কুম্ভকর্ণের ঘুম তার পছন্দের তালিকায়। স্বামীগৃহে পা ফেলেই রান্নাঘরে ঢুকল সে। থালায় ভাত নিলে পোষায় না; তাই গামলায় ভাত নিয়ে শক্ত চেয়ারে বসে কাঁচালঙ্কাসহকারে জাবর কাটতে লাগল। নতুন বউ দেখার জন্য বাড়িতে মানুষের ঢল; সেদিকে ভ্রূক্ষেপ না করে হাতিমার্কা পা দু-খানা দোলাতে দোলাতে জাবর কাটার কাজ শেষ করল; তার পর হাই তুলতে তুলতে, এ-বাড়ির ঘর-দরজা তার আগে থেকেই পরিচিত এরকম ভাব করে, ঘুমুতে গেল। 

বউমার এহেন আচরণে হতভম্ব শাশুড়ি দৌড়ে গেলেন রান্নাঘরে। ভাতের হাঁড়ির ঢাকনা তোলার পর তার চক্ষুচড়ক। হাঁড়ির তলানিতে যে কটা ভাত পড়ে আছে তা চশমা ছাড়াই গোনা যায়। মাথায় হাত তুলে ছেলেকে উদ্দেশ করে বললেন, ‘ওরে ফজর আলি, দে হাত তালি। এরকম বউমাই তো চেয়েছিলাম রে। এতদিন খেয়ে খেয়ে শুকেছিস, এবার না খেয়ে খেয়ে শুকাবি। বউমার পেট ভরানোর মতো ধান গোলায় আছে তো?’

তিনি যতটা হতভম্ব তার চেয়ে ফজর আলি অনেক বেশি তার নবোঢ়ার ঘুমানো দেখে। শোয়ামাত্রই তার নাকের সরব গর্জনে পুরো ঘরটাই যেন কাঁপছিল। থেকে থেকে মুখ হা করে সাইলেন্সার পাইপের মতো ভোঁস ভোঁস করে বাতাস ছাড়ছিল; ফলে খাটের ওপর মশারির যে ছাদ বেশরমভাবে নাচানাচি করছিল। মাকে ডেকে এনে উঠোনের দিকে হা করা জানালার পাশে দাঁড়াল যেন ঘরের ভেতর মজাদার কৌতুক পরিবেশিত হচ্ছে। তারা তাদের চোখ সরাতে পারছিল না; কারণ, শুধু মশারির ছাদ নাচানাচি করছিল তা না, আলনায় রাখা কাপড়-চোপড়ও। হঠাৎ বউ তাদের দিকে পাশ ফিরাল এবং নাক দিয়ে শুশুকের মতো ভোঁস করে বাতাস ছাড়ল। সেই বাতাসের ঝাপ্টা বদ্ধ ঘরের দূষিত বাতাস ঘর ছেড়ে পালানোর মতো ছুটে এল জানালার দিকে;  আর তাতেই মা-ছেলের ঝড়ের কবলে পড়ার মতো অবস্থা হলো।

সেখান থেকে সরে এসে ফজর আলি মায়ের হাত ধরে বলল, ‘আম্মা, তুমি তোমার বউমা নিয়ে থাকো, আমি পালাই।’ বলতে বলতে সে এমন ভাব করছিল যেন সে এক্ষুনি পালাবে। ছেলের হাত খপ করে টেনে ধরে মা বললেন, ‘কোথায় যাবি রে বাপ? আজ তোর বাসররাত না!’

তখন বিকেলের শেষ আলো ইতিউতি তাকাচ্ছিল, কখন অন্ধকারের সহিস ফিরে আসে! অবশেষে ফিরে এসে গাঢ় কণ্ঠে তাদের ডেকে নিয়ে গেল বাসরঘরে। বাপ-দাদার আমলের ঢাউস খাট। তোষকের ওপরে নতুন চাদর বিছিয়ে দিয়েছেন মা। হাজার হলেও তার একটামাত্র ছেলে। হাত-পা জ্বালা করে, তাই ছেলের জন্য গ্লুকোজের ঘন সরবত আর বউমার জন্য গরম দুধের গ্লাস তেপায়ার ওপর রেখে দিয়েছেন তিনি। সঙ্গে কিছু ফলফলাদি।

‘আমাকে পেয়ে তুমি খুশি?’
‘খুব খুশি। তোমার মতো স্লিম ফিগারের বউ কজনার ভাগ্যে জোটে?’
‘আর কোনো গুণ নাই?’
‘গুণের শেষ নাই তোমার। মুখে দুটো দাঁত 
থাকলে সার্কাস পার্টি থেকে ভালোই আয় করতে পারতাম। নাক ডাকলে পাখার বাতাসের দরকার পড়বে না। আর হ্যাঁ, বেশি দিন বাঁচলে দেশে দুর্ভিক্ষ আসতেও সময় নেবে না।’
মন খারাপ করলে ফজর আলি তার গালে টোকা দিয়ে আবার বলল, ‘মন খারাপ করছ কেন, লক্ষ্মীটি? আমি তো তোমার প্রশংসাই করছি। তোমার নামটাও অনেক সুন্দর; থত্থরি বেগম।’
থত্থরি বেগম একটু আহাল্লাদি হলো বটে; তবে অভিমানও ঝরাল, ‘শুধু নামটাই; আমার হাসিটা?’
‘আহারে! হাসিতে অমাবস্যার চন্দ্রযোগ।’
‘গায়ের ত্বক? মা বলে দুধেআলতা।’
‘তোমার মায়ের চোখ না চুলা?’
থত্থরি বেগম হেসে উঠে স্বামীর দিকে পাশ ফেরাল। তার বুকে হাত রেখে প্রসঙ্গ পাল্টাল, ‘তোমার বুকের পাটা দেখে আমার নানার কথা মনে পড়ছে।’
‘তোমার নানা কি আমার মতন?’
‘হ্যাঁ গো। দুপুরবেলা নানা শীতলপাটিতে চিৎ হয়ে শুলে আমরা নাতি-নাতিনরা তার পাটার মতো বুকের ওপর শোয়ার জন্য ঝাঁপিয়ে পড়তাম। কী বাহাদুর ছিলেন! বুঝতেই দিতেন না তিনি কষ্ট পাচ্ছেন। 
নানার কথা মনে পড়ায় তোমার বুকের ওপর শুতে 
ইচ্ছা করছে।’
‘সে আর কি! শোও। তোমার ইচ্ছা পূরণ করি।’

কষ্টেসৃষ্টে তার বুকের ওপর উঠে শুয়ে পড়ল থত্থরি বেগম। যেন কোনো দরবেশ তাকে ঘুম পাড়িয়ে দেওয়ার জন্য আগে থেকেই প্রস্তুত ছিলেন; তার ওপর কুদরতি ফুঁ দিলেন। আশ্চর্যজনকভাবে সঙ্গে সঙ্গে ঘুমিয়ে গেল সে। এদিকে ফজর আলির অবস্থা চিড়েচ্যাপ্টা। যেন দেয়ালচাপায় পড়েছে সে। দম বন্ধ হয়ে আসছিল তার, শ্বাসকষ্ট হচ্ছিল। দুহাতে দেয়াল ওপরের দিকে ঠেলছিল, কিন্তু ঠেলতে পারলে তো? গড়ানি দিয়ে কোনোরকমে বুকের ওপর থেকে দেয়ালটা নামাতে সক্ষম হলো সে; তারপর ঢকঢক করে সরবতটা গলায় ঢেলে হাঁপাতে হাঁপাতে বাইরে এল। পিঠ চুলকাচ্ছিল; উঠোনের কোণায় আমগাছ, তার বাকলে পিঠ ঘষতে লাগল। 

সপ্তাখানেক পরেই কুরবানির ঈদ এসে হাজির। শ্বশুরবাড়ির পক্ষ থেকে লোকজন এসে জামাই ও তাদের মেয়েকে সঙ্গে নিয়ে গেল। ফজর আলির শাশুড়ি মাশআল্লাহ! কুমায়ন অঞ্চলে চড়ে বেড়ানো হস্তিনীর মতো দেখতে। নিজে সামনে যা পান তাই খান, অন্যকেও সেভাবে খাওয়াতে চান। নতুন জামাইকে গণ্ডেপিণ্ডে খাওয়াচ্ছিলেন; জামাই বাধা দিলে বললেন তিনি, ‘কোরবানির গোশত খেলে কিচ্ছু হয় নারে বাবা। আল্লার বরকত আছে। পেট ঠ্যাসে খাও। হকনল্লি পর্যন্ত ডুবে খাও।’ পরক্ষণে হাসলেন, ‘তোমার শ্বশুর হরিপদ গোয়ালার কাছ থেকে মিষ্টি দই আর লক্ষণের দোকান থেকে রসগোল্লা এনেছে। গোশতে বেশি বেশি ঝাল-মসল্লা দিয়েছি, যাতে দই-মিষ্টি খাইতে মজা পাও।’ শ্লেষ্মা ঝেড়ে এবার কণ্ঠ ভেজালেন অহংবোধে, ‘আমাদের সবাই হাতির বংশধর রে বাবা। কয়েকদিন এই শাশুড়ির হাতের রান্না খাও, দেখবে তোমার পাতলাপুতলা শরীর কেমন মোটাতাজা হয়।’

কেন সে পাতলাপুতলা, তার ভেতরে কী সমস্যা, একমাত্র ফজর আলির দেহের কলকব্জারা তা ভালো জানে। এমনিতে মিতবাক সে। কথার পিঠে কথা বলা অনাবশ্যক মনে করল; তবে তার ঠোঁটের কোণে এক চিলতে রহস্যময় হাসি ফুটল।

চিলমচিতে হাত ধুয়ে উঠে দাঁড়াল সে। তার পর কাঁচা সুপারি দিয়ে মুখভর্তি পান চিবাতে চিবাতে শোবার ঘরে এল। তার খুব ঘুম পাচ্ছিল; যাকে বলে মরণঘুম। পিঠও চুলকাচ্ছিল। চন্দ্রকলার চক্রে তখন অমাবস্যা। ঘুরঘুট্টি অন্ধকারে বাইরে যেতে মন সায় দিল না। বিছানায় এসে বুকের নিচে বালিশ দিয়ে উপুড় হয়ে শুয়ে পড়ল; তার পর বউকে ইঙ্গিত করল তার পিঠ চুলকে দিতে। তার পাশে আসনপিঁড়ি হয়ে বসতে থত্থরি বেগমের কষ্ট হচ্ছিল; তবুও তার পিঠ চুলকে দিচ্ছিল সে। ফজর আলির চুলকানির অত্যাচারের অসহনীয় মাত্রা কমছিল না তো বটেই; বরং বেড়ে যাচ্ছিল। অসন্তুষ্ট চিত্তে শরীর ঝাঁকাল সে, ‘হাতির মতো শরীর; হাতে কি জোর নাই?’

থত্থরি বেগমও রেগে ফায়ার; কড়া জবাব তার, ‘তিন ইঞ্চি করে লম্বা নখ দিয়ে চুলকে দিচ্ছি তা-ও হচ্ছে না! কোদাল আনব?’

‘কোদাল দিয়ে তো কবর খোঁড়ে,’ শীতল কণ্ঠে জবাব দিল ফজর আলি।

সকালবেলা ঘুম থেকে উঠছিল না সে। চারদিকে বলাবলি শুরু হলো ফজর আলি মানুষটা অনেক ভালো মানুষ ছিল। ঘুমের মধ্যে আল্লাহ তাকে তার কাছে নিয়ে গেছেন।

ধারাবাহিক উপন্যাস ত্রিপুরা উপাখ্যান ও সাবিনার কথা

প্রকাশ: ২৬ জুলাই ২০২৪, ০১:১৬ পিএম
আপডেট: ২৬ জুলাই ২০২৪, ০১:২০ পিএম
ত্রিপুরা উপাখ্যান ও সাবিনার কথা

গত সংখ্যার পর

তোমরা আজ হয়তো ভাবতে পারবে না- এ সময় দিনেরাতে নদীর স্রোতের মতো ছিন্নমূল মানুষ প্রবেশ করতে থাকে ত্রিপুরার নানা অঞ্চল দিয়ে। এত বড় শরণার্থী বিপর্যয় আগে কোথাও ঘটেনি পৃথিবীতে! একটি হিসাব থেকে বুঝতে পারবে ত্রিপুরার মানুষ বাংলাদেশের যুদ্ধের দাহন কতটা ভোগ করেছে। ১৯৭১ সালে রাজ্যের মোট লোকসংখ্যা যেখানে ১৫.৫৬ লাখ, সেখানে বাংলাদেশ থেকে শরণার্থীর সংখ্যা দাঁড়ায় ১৩.৪২ লাখ বা প্রায় ১৪ লাখ। পরের দিকে এই সংখ্যা আরও বেড়েছে। ফলে ত্রিপুরার জনজীবন ও অর্থনীতিতে প্রচণ্ড চাপের সৃষ্টি হয়। কী করবে মানুষ বুঝে উঠতে পারে না। 

মল্লিকা সেনগুপ্ত: স্যার, একটি প্রশ্ন করি। সমাজ, অর্থনীতিতে এই যে ভয়ংকর রকম চাপ, সাধারণ মানুষের এত যে কষ্ট, এর পরও কেন সবকিছু মেনে নেয় ত্রিপুরার মানুষ? 

রথীন দত্ত: সঠিক প্রশ্নই করেছ। ব্যাপারটা স্বভাবতই ভাববার। তবে আমার কী মনে হয় জান, প্রকৃতির, মাটির একটা টান আছে, যা ভঙ্গুর নয়, নানা টানাপোড়েনে ভূখণ্ড ভাগ হয়ে গেলেও সেই অবিভাজ্য টান ধরে রাখে প্রকৃতি। এর মধ্যে আছে ভাষা-সংস্কৃতি ও জলবায়ুর এক গন্ধ। হয়তো সে কারণেই কষ্টকে কষ্ট বলে ভাবেনি ত্রিপুরাবাসী। 

ইতিহাসগতভাবে ত্রিপুরায় যে বাঙালি তার ৯৫ ভাগ পূর্ববঙ্গ বা পূর্ব পাকিস্তান থেকে এসেছে- প্রায় সবাই ওপারের মানুষ- বলতে পার দেশ ভাগে বিতাড়িত মানুষ। এই মানুষদের সবাই হিন্দু ধর্মালম্বী, যারা নিজেদের ঘরবাড়ি ছেড়ে নতুন ভারতে পাড়ি দিয়েছে ১৯৪৭-এর দাবানলে পুড়ে। আবার এমন অনেকে আছেন যাদের পূর্বপুরুষ ছিলেন রাজ দরবারের কর্মচারী। কিন্তু এদের সবার আশা-আকাঙ্ক্ষা, রাগ-বিরাগ বৈশিষ্ট্য এক। অতএব, ১৯৪৭-এর আগে-পরের যে বিভেদ তা টিকে থাকেনি- নিমিশে উবে গেছে! হিন্দু, মুসলমান, পাহাড়ি ও নানা ধর্মাবলম্বী অধ্যুষিত জনগোষ্ঠীর ভেতরে বাংলাদেশের বিপুলসংখ্যক মুসলমান এবং হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিষ্টান নির্বিবাদে ঠাঁই করে নিয়েছে- মানুষের ভেতরে মানুষ যেভাবে ঠাঁই করে নেয়! এই আত্মীয়তার ক্ষেত্রে ধর্ম ও কলোনিয়াল লিগেসি বিরোধ টানেনি। ধর্ম যে ব্যক্তির একান্ত আপনার বিষয়, রাষ্ট্র বা সমাজের নয় এবং ধর্ম বিশ্বাস যে ভাষা-সংস্কৃতির বিভাজন মানে না, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ তা নতুন করে শিখিয়ে দিয়েছে। 

মল্লিকা সেনগুপ্ত: হয়তো তাই হবে। কিন্তু এপার ওপারে দুই পারেই যেভাবে উগ্রবাদ ছড়িয়ে পড়ছে, নতুন করে বিভেদ তৈরি হচ্ছে, তাতে কিন্তু শঙ্কার কারণ আছে। 

সার্জন রথীন দত্ত: নিশ্চয়ই, শঙ্কার কারণ তো আছেই। দেখ, ১৯৭১ কেবল বাংলাদেশের নয়, ভারতেরও সমানভাবে। ভারতের সেনাবাহিনী হয়ে উঠেছিল বাংলাদেশের মিত্রবাহিনী। অকাতরে প্রাণ দিয়েছে মুক্তিবাহিনী, রক্ত গেছে মিত্রবাহিনীরও। অতএব, দুই দেশকে এক রক্তের বন্ধনে আবদ্ধ করেছিল ১৯৭১, নতুন ইতিহাস তৈরি করেছিল। সেই ভাতৃত্বকে উগ্র ধর্মবাদ চর্চা দিয়ে বিনষ্ট করা কখনো সমীচীন নয়। 
মল্লিকা সেনগুপ্ত: ঠিক বলেছেন, স্যার। এবার তাহলে আগের প্রসঙ্গে যাই আমরা। 

সার্জন রথীন দত্ত আবারও আগের প্রসঙ্গে ফিরলেন। ফেরার আগে তোয়ালে দিয়ে মুখ মুছে নিলেন। 

বুঝলে, পরিস্থিতি যথেষ্টই ঘোলাটে তখন। কী হবে, কীভাবে পরিস্থিতি সামলানো যাবে? ভারত সরকার শেষ পর্যন্ত কতটা নামবে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে- কিছুই নিশ্চিত নয়। মুজিবকে গ্রেফতার করে পশ্চিম পাকিস্তানে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। তিনি সশরীরে থাকলে পরিস্থিতি একরকম হতো। কিন্তু তিনি তো নেই। এদিকে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক তাজউদ্দীন আহমদ ও দলের হুইপ ব্যারিস্টার আমীর উল ইসলামসহ কয়েকজন শীর্ষ নেতা পশ্চিমবঙ্গে আশ্রয় নিয়েছেন। বর্ডার সিকিউরিটি ফোর্স তাদের দেখাশোনা করছে। অন্য নেতাদের কেউ কেউ গোপন পথে মেঘালয় ও আসামে পাড়ি দিয়েছেন। কে কোথায় উঠেছেন কেউ খবর রাখে না। একটা সুখবর খবর হলো তাজউদ্দীন আহমদ এরই মধ্যে ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছেন। বুঝতেই পার সাক্ষাৎকারটি কতটা গুরুত্বপূর্ণ- ভারতের সমর্থনের প্রশ্নে কত বড় ইতিবাচক ঘটনা। 

মল্লিকা সেনগুপ্ত: স্যার, পক্ষে-বিপক্ষে নানা কথা আছে, থাকবেও। তবু শ্রীমতি গান্ধী সম্পর্কে আপনার অভিমত কী? 
সার্জন রথীন দত্ত: দেখ, আমি রাজনীতির মানুষ নই। মিসেস গান্ধীর রাজনৈতিক বিরোধীরা যা ইচ্ছে বলতে পারেন। কিন্তু যদি ১৯৭১ সালের কথা বল, তাহলে আমার মতামত খুবই স্পষ্ট। আমার মনে হয় কি জান, ১৯৭১ সালে ইন্দিরা গান্ধী ভারতের প্রধানমন্ত্রী না হয়ে যদি অন্য কেউ থাকতেন, সোভিয়েত ইউনিয়ন যদি ভারতের সঙ্গে মৈত্রী চুক্তির সঠিক রূপয়ানে গুরুত্ব না দিত এবং বাংলাদেশ যুদ্ধের রাজনৈতিক মূল্যায়ন মস্কোর ভূমিকা যথার্থ না হতো, তাহলে নিঃসন্দেহে বলা যায়, বাংলাদেশের স্বাধীনতা বিলম্বিত হওয়ার কারণ ছিল। 

মল্লিকা সেনগুপ্ত: বুঝলাম স্যার, এবার আগের কথায় ফিরি আমরা। 

শোন, তাজউদ্দীনের সঙ্গে শ্রীমতি গান্ধীর পরপর দুটি বৈঠক হয়। বিস্তারিত আলোচনার পর স্থির হয়, অনতিবিলম্বে আওয়ামী লীগের নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের সমন্বয়ে বাংলাদেশের সরকার গঠন করা হবে, যে সরকার যুদ্ধ পরিচালনা করবে। আরও ঠিক হয় ভারত তার ভূমি ব্যবহার করে রেডিওসহ সব ধরনের প্রচার কাজ চালাতে দেবে। আরও বড় সিদ্ধান্ত হয় ভারতের মাটিতে বাংলাদেশের মুক্তিবাহিনী গড়ে উঠবে- যার দেখাশোনা করবে বাংলাদেশ ও ভারত যৌথভাবে। কিন্তু সবচেয়ে বড় সংকট দেখা দিল বিভিন্ন রাজ্যে আশ্রয় নেওয়া নেতৃবৃন্দের মধ্যে কার্যকর যোগাযোগ স্থাপিত না হওয়ায়। এ ক্ষেত্রে বিএসএফ সহায়তা করল। অতি অল্প সময়ের মধ্যে সবাইকে খুঁজে বের করা সম্ভব হলো। 

এদিকে আগরতলায় আওয়ামী লীগের জ্যেষ্ঠ নেতারা, বিশেষ করে যারা ১৯৭০-এর সাধারণ নির্বাচনে এমএনএ বা এমপিএ হয়েছেন তারা পাকিস্তান বাহিনীর নির্বিচার গণহত্যা ও নারী নির্যাতনের চিত্র বিশ্ববাসীর সামনে তুলে ধরার উদ্যোগ নিলেন। ২ এপ্রিল ১৯৭১ তারা একটি গুরুত্বপূর্ণ বৈঠকে বসলেন মেলারমাঠে অনিল ভট্টাচার্যের বাড়িতে। 

সেদিনের বৈঠকটি ছিল পাকিস্তানি গণহত্যার বিরুদ্ধে প্রথম আন্তর্জাতিক প্রতিবাদ, যা এক মাইলফলক। জহুর আহমদ চৌধুরীর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত এই সভা থেকে আওয়ামী লীগের ৩৫ জন এমএনএ, এমএলএ সর্বপ্রথম বিশ্ববাসীর সামনে একটি যৌথ বিবৃতি প্রচার করলেন। বিবৃতিটি পাঠানো হয় জাতিসংঘের মহাসচিব উ থান্ট-এর কাছে। Stop this Genocide- ‘বন্ধ কর এই গণহত্যা’ শিরোনামে ইংরেজিতে তৈরি হয় বাংলাদেশের নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের প্রথম যৌথ বিবৃতিটি।

চট্টগ্রামের আওয়ামী লীগ নেতা আবদুল্লাহ-আল-হারুন, টাইমস অব ইন্ডিয়ার সাংবাদিক সুভাষ চক্রবর্তী এবং পান্নালাল দাশগুপ্ত সম্পাদিত ‘কম্পাস’ সাময়িকীর নিজস্ব প্রতিনিধি অমর রাহা এটি রচনা করতে সহায়তা করেন। এরা সবাই তখন আগরতলায়। প্রেস ট্রাস্ট অব ইন্ডিয়া (পিটিআই) বার্তা সংস্থার অফিসের একটি পুরনো টাইপ রাইটারে এই বিবৃতি টাইপ করা হয়। পিটিআইয়ের বিশেষ প্রতিনিধি মধুসুধন গুহ রায় তখন বাংলাদেশের যুদ্ধ ‘কভার’ করতে আগরতলায় আছেন। মধুবাবু টেলিফোনে কলকাতায় হেয়ার স্ট্রিটের পিটিআই অফিসে খবরটি পাঠিয়ে দিলেন। এটি ছিল তার ‘স্কুপ নিউজ’। কারণ অন্য কাউকেই খবরটি তখনো দেওয়া হয়নি। পরদিন সব জাতীর স্তরের খবরের কাগজে খবরটি ফলাও হয়ে বেরোল। এরপর গোটা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ল। 

চলবে...

১ম পর্ব

২য় পর্ব

৩য় পর্ব

৪র্থ পর্ব

৫ম পর্ব

৬ষ্ঠ পর্ব

৭ম পর্ব

৮ম পর্ব

৯ম পর্ব

১০ম পর্ব

১১তম পর্ব