![শ্রেষ্ঠ রাঁধুনি পুরস্কার](uploads/2024/03/15/1710482356.srestho-radhunir-purushkar.jpg)
গত সংখ্যার পর
বন্ধুকে কৃত্রিম রাগে শাসায় রুকু। কিন্তু পায়েল থামে না। বলে
-ওই দেখ, দুপাশের দোকানির দল দোকানদারি ভুলে কেমন তাকিয়ে আছে।
রুকু সেদিকে তাকায় না। তবে সে জানে বাড়ির রাস্তার মোড় থেকে আদর্শ কলেজ পর্যন্ত রাস্তার পাশের দোকানিরা তাকে চেনে। সে যখন কলেজে যায় অথবা কলেজ থেকে বাড়িতে ফেরে, তারা তার দিকে, তার সৌন্দর্যের দিকে অপলক তাকিয়ে থাকে। তবে তাদের এই সৌন্দর্য দর্শনে ঔৎসুক্য আছে, উত্তেজনা নেই সে বেশ বুঝতে পারে। বুঝতে পারে, এইসব লোক তার সৌন্দর্যের পূজারি। তারা কোনোদিন পূজারির গণ্ডি ছাড়িয়ে তাদের স্পর্ধিত হাত সামনে অগ্রসর করবে না। তাই তাদের এই বিভোল চাওয়া সে উপভোগ করে, উপভোগ করে আপ্লুত হয়।
রাস্তার দুপাশে শিক্ষার্থীরা লাইন ধরে স্কুল-কলেজে যাচ্ছে। তাদের বিচিত্র পোশাক আর বিচিত্রতর কলহাস্যে বোয়ালভাসা নদীর দুই তীর উপচে পড়ছে। দোকানিরা এ সময় বিকিকিনি ভুলে রাস্তার দিকে তাকিয়ে থাকেন। স্থানীয় সুশীল সমাজ এ ব্যাপারে ইভ টিজিংকে সংশ্লিষ্ট করে অনেক বিবৃতি দেয় কিন্তু নিছক সৌন্দর্যের প্রতি পক্ষপাতবিহনে এদের অন্য কোনো উদ্দেশ্য নেই- সাফ রায় দিয়ে বাজার সমিতি তথা আদর্শপাড়ার চেয়ারম্যান দোকানিদের অভিযোগ থেকে বেকসুর খালাস দিয়ে দেন- তিনি নিজেও এ দলের একজন কি না।
রুকু আর পায়েল ধীরে, অতি ধীরে সামনে এগোতে থাকে।
সূর্য পুকুরপাড়ে অর্জুন কি অশোকগাছের সারি বোয়ালভাসা নদীকে রাস্তার আড়ালে নিয়ে গেছে। পথ এখানে নির্জন। মেয়েদের গতি হয় দ্রুত। রুকু এবং পায়েলও জোর কদমে চলতে থাকে। যেন-বা সাফা মারওয়া পাহাড়ের মাঝখানে চলনশীল মা হাজেরার পায়ের গতি জমজম দর্শনে আচম্বিতে বেড়ে গেছে।
বনানীর শেষ প্রান্তে মহাসড়কের বাসগুলো দাঁড়িয়ে থাকে। কিছুটা যাত্রী ধরার আশায় আর বেশির ভাগ সাত সকালে চলাচলরত স্কুল-কলেজের ছাত্রীদের দেখার জন্য।
তাদের সহজ বক্তব্য-
ছাত্রীদের চলাচলের সুবিধার্থে তারা বাসের গতি কমিয়ে দেয় অথবা থেমে যায়। কিন্তু চট্টগ্রাম-রাঙ্গামাটি রোডে চলা বাসের স্বল্পশিক্ষিত ড্রাইভাররা, তাদের হেলপাররা সুবেশী ছাত্রীদের সঞ্চরণ, তাদের কলহাস্য, চোখের অপাঙ্গে জমা ভ্রূকুটি যে নির্মল আনন্দভরে অনুভব করে তা ছাত্রীরা যেমন জানে, রাস্তার প্রতিটি মানুষও জানে। কিন্তু কেউ কিছু বলে না।
দীর্ঘদিনের অভ্যাসে এখানকার ছাত্রীরাও বাংলাদেশের অন্য দশটি এলাকার ছাত্রীদের চেয়ে আলাদা হয়ে উঠেছে। একমাত্র রুকু ছাড়া, যে তার সৌন্দর্যের সুবাদে এমনিতে সর্বপরিচিতা হয়ে গেছে, প্রায় সব ছাত্রী নিজেদের নিত্যনতুন উপস্থাপনায় পারদর্শী হয়ে উঠেছে। প্রথম প্রথম তা ছিল বাড়তি বিড়ম্বনা, নারীত্বের নতুন পরিহাস- কিন্তু কালের বিবর্তনে তা এলাকার রসমে পরিণত হয়েছে। এটাই প্রাত্যহিক ব্যাপার এখন। এজন্য ছাত্রীদের মধ্যে নতুন কোনো আনন্দ কি উত্তেজনা ঝিলিক মেরে ওঠে না আর। যেন এভাবেই সেজে বের হতে হয়, এই র্যাম্পের মডেলের মতো সড়কের পাশ দিয়ে আলস্য বিলাসে চলতে হয় বলেই চলা।
অবশ্য রাস্তা এবং রাস্তার পাশের দর্শক-শ্রোতা, বাসের ড্রাইভার, কন্ডাক্টর আর দোকানি- তাদের উদ্যমে এতটুকু ভাটার টান লেগেছে বলে মনে হয় না। ছাত্রীদের দেখাদেখি নিজেরাও টেরি কেটে, বডি স্লিম শার্ট গায়ে বাসে কি দোকানে এসে সাতসকালে হাজির হয়ে যায়। তারপর চলতে থাকে অপেক্ষার পালা।
সাড়ে আটটা নাগাদ ছাত্রীদের পথচলা শুরু হয়। নয়টা বাজতে না বাজতে তাদের কলহাস্যে মহাসড়কের দু-কূল উদ্বেলিয়া ওঠে। নতুন ছাত্রীরা নবরসের নতুন আনন্দে বরষার প্রথম বৃষ্টিপাতে উচ্ছল মরালীর মতো গ্রীবা উন্নত করে বিলম্বিত লয়ে মঞ্চে হাঁটার মতো পথ চলতে থাকে। পুরনোরা মুখস্থ গতিতে পথটুকু পার হয় নির্বিকার। কিন্তু দর্শকরা বরাবরের মতো অটল একাগ্রতায় তাদের পথচলা আবিরল অবলোকন করতে থাকে।
তারা শত মেয়েদের মধ্যে কয়েক জনকে অবশ্য আলাদা করতে পারে। আলাদা করেছেও। নাম জানা নেই কারও। তবে তাতে তাদের থোড়াই আসে-যায়। যেমন প্রত্যেকে চেনে কাজী বিলের মাঝামাঝি ধূর দিয়ে যে মেয়েটি বোয়ালভাসার পূর্ব তীরে ওঠে আসে, ‘মালকা বানু’র মতো চেহারা তার আর হাঁটে ‘আনোয়ারা’র মতো। মহাকবি আলাওলের সোনার প্রতিম মেয়ে মালকা বানু আর নজিবুর রহমান সাহিত্যরত্নের ‘আনোয়ারা’ উপন্যাসের নায়িকার বাইরে তাদের কল্পনা বিস্তৃত হতে পারে না। আরেকজনের কথা ইদানীং তারা বলে, ব্রাহ্মণবাড়ি থেকে ঠিক আটটার সময় উঠে আসে সে। লম্বা, বিলোল চাহনি। একেবারে মাটির দিকে তাকিয়ে অহল্যার মতো পথ চলে। তারা তার নাম দিয়েছে সাবিত্রী।
অবশ্য রুকু এসবের মধ্যে আলাদা। তারা তার সঙ্গে অন্য কারও তুলনা করে না। বাছাই করা সুন্দরীদের প্রত্যেকের জন্য তাদের নিজস্ব সাংকেতিক নাম আছে; যেমন আনোয়ারা, জুলেখা, সাত ভাই চম্পা ইত্যাদি। কিন্তু রুকুকে ওরা নাম দিয়েছে ‘সেই মেয়েটি’। অবশ্য যাকে ঘিরে এ আনন্দ উল্লাস চলে, নিত্য রচিত হয় প্রেমোপাখ্যান, বিংশতি বর্ষীয়া রুকু নামের মেয়েটি আনন্দ-বেদনার এ কাব্যের কিছুই জানতে পারে না। তার দিন যায় দিন যাপনের দায় মেটাতে।
অশোকবাগানের পর খাঁ সাহেবের বাড়ি। বেড়া দেওয়া উপবনের পেছনে প্রাচীন দোতলা বাড়ি। বনে বিলিম্বি আর বহেরা ধরে থাকে সারা বছর। তার চেয়েও বড় ব্যাপার, বহেরাবৃক্ষ তলে খাঁ সাহেব আরাম চেয়ারে বসে থাকেন দিনের পর দিন। তাঁর কী রোগ- বাত না প্যারালাইসিস- পড়ুয়ারা ঠাহর করতে পারে না। রুকু জানত না, যদি না নিম্নলিখিত কাহিনি ঘটত একদিন :
এসএসসি পরীক্ষার পর দীর্ঘ বিরতি চলছে। রুকুদের এমন কোনো আত্মীয় নেই যে অন্য সবার মতো সে বেড়াতে যাবে। তা ছাড়া বৃদ্ধ পিতাকে একলা ফেলে সে কোথায় যায়। অগত্যা বাড়িতেই দিন কাটছিল তার। তবে শুধু শুধু দিন কাটানোর মেয়ে রুকু কোনো দিন ছিল না। তার দিন কাটছে সীমিত সাধ্যের মধ্যে যতটুকু সম্ভব সেরা রাঁধুনি হওয়ার স্বপ্নে বিভিন্ন রেসিপির অনুশীলনে আর অতি অবশ্যই কবি পিতার লেখা নতুন নতুন গানে কণ্ঠ দেওয়াতে।
সেরকম একদিন ভোরবেলা। রাগ খামাজের ওপর পিতার লেখা অসাধারণ এক গানে কণ্ঠ দিচ্ছিল রুকু-
-যারে ভালোবাসি আমি
কেমনে বোঝাই তাহারে-
ভালোবাসা যায় শুধু,
বলা যায় না রে-
প্রথম অন্তরাতে গিয়ে কবি হাসান আলী টের পেলেন তিন তালে গানটি জমবে ভালো। মেয়ে বলল, কাহারবাতে গাই বাবা? গানের তাল কি সুর পিতা পুত্রীর আবদারের বিষয় কি না ভাবছেন কবি। পাশে নোরা নামের বিড়ালকে জিজ্ঞেস করলেন-
-তুই কী বলিস? গান কি এভাবে বাপ-বেটির ইচ্ছাতে চলে?
বিড়াল কী একটা অব্যক্ত আওয়াজ তোলে রুকুর কোলঘেঁষে আরও জাঁকিয়ে বসল। ডানাভাঙা কাকটি গুটিপায়ে এগিয়ে আসে। বোদ্ধা শ্রোতার মতো বসে থাকে লেঝঝোলা পাখিটি। কবি পশু-পাখিদের ভাষা বোঝেন না, তবুও আবেগের বসে বলেন, কী বলিস তোরা? তারপর নিজেই কাহারবা তালে অন্তরা আর সঞ্চারীটুকু দোতারায় ফুটিয়ে তোলেন-
আমি গাইতে পারি মুখের কথা
সইতে পারি বুকের ব্যথা
কইতে নারি ভালোবাসি রে...
রাতে বন্ধু জাগি একা
ভাবি যদি হয় গো দেখা
সকল কিছু দিতাম তাহারে।
জানি সেও আমারে ভাবে
ভালোবাসি কে বলিবে
এমন দ্বন্দ্বে জীবন গেল রে।
রুকুর মুখ খুশিতে উদ্ভাসিত হয়। অন্তরাটুকু পিতার মনের মতো করে গেয়ে ফেলে। কিন্তু যেই সঞ্চারীতে নামল, গেটে কড়া নাড়ল কেউ।
পিতা-পুত্রী দুজনই ব্যাকুল আগ্রহে বাড়ির গেটের দিকে তাকিয়ে থাকে। আজ এই অবেলায় কে আসতে পারেন? ওর তো পরীক্ষা কেবল শেষ হলো। এক মাস আগে ফল ঘোষণার কথা নয়। কে হতে পারেন? কী সংবাদই-বা তিনি বহন করে নিয়ে এসেছেন?
গেট খুলে আবাক হয়ে গেলেন কবি হাসান আলী। হুইলচেয়ারে বসে আছেন খাঁ বাড়ির ইবরাহিম খাঁ। কবি সালাম দেওয়ার আগেই প্রশ্নের মুখোমুখি হলেন-
-আপনার মেয়ে কোথায়? তার কী হয়েছে?
কবি প্রথমে ভয় পেয়ে গেলেন। মেয়ের কোনো বিপদ হয়নি তো! পরে সাহস সঞ্চয় করে বললেন-ওই তো, আমারা দুজন মিলে একটা গান তুলছিলাম, বলতে বলতে লজ্জায় তার কণ্ঠ খাদে নেমে আসে।
খাঁ সাহেব বললেন, আলহামদুলিল্লাহ, আল্লাহ বাঁচানেওয়ালা।
বাপ-বেটি দুজনই দুই আগন্তুকের দিকে অদ্ভুত তাকিয়েছিল। তারপর আগন্তুক হাসিতে ভেঙে পড়লেন। তাঁর মেয়েই কাহিনি সবিস্তারে বলল-
-ক্লাস সিক্স থেকে ক্লাস টেন পর্যন্ত টানা ছয় বছর প্রতি দিন একই সময়ে ঠিক সাড়ে আটটার সময় তাদের বাড়ির সামনে দিয়ে স্কুলে গেছে রুকু। পক্ষাঘাতগ্রস্ত খাঁ সাহেব বাড়ির সামনে ভোরের রোদে অপেক্ষা করতেন প্রতিদিন আর রুকুকে দেখলে হাঁক দিয়ে বলতেন, মেয়েটি গেল, আমার ওষুধ নিয়ে আয় মা।
রুকু আর তার পিতা হাসান আলী তন্ময় হয়ে শুনছিল-
রুকু ছিল খাঁ সাহেবের কাছে ঘণ্টার মতো। দিনের পর দিন, বছরের পর বছর এ ঘণ্টায় অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছিলেন তিনি। অথচ তার পরিচয় পর্যন্ত তিনি জানতেন না অথবা জানার তাগিদ বোধ করেননি কোনো দিন। তাঁর নিশ্চিত বিশ্বাস ছিল, সে যুগ যুগ ধরে এভাবে প্রতিদিন ঠিক সাড়ে আটটার সময় স্কুলে যেতে থাকবে আর তিনি তার আগমনের ঘণ্টা ধরে সকালের ওষুধ খেতে থাকবেন। মেয়েটি যে একদিন বড় হবে, তার স্কুলের পড়াশোনার একদিন হবে সমাপ্তি অথবা বিয়ে থা হয়ে অন্যত্র সে করবে ঘরবসতি- এসব তাঁর চিন্তাতেই ছিল না।
চলবে...