![শ্রেষ্ঠ রাঁধুনি পুরস্কার](uploads/2024/02/16/1708063268.shresto.jpg)
গত সংখ্যার পর
সকালেই বেশ লম্বা লাইন পড়ে গেছে। ক্যাম্পাসের কোলঘেঁষে শিউলি আচ্ছাদিত এক গ্রাম্য রাস্তার ধারে বেলী’স ক্যাফেটেরিয়া। শহরের হাঁকডাক এদিকে অবসিত। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের হইচইয়ে মুখর থাকে এমনিতে নীরব পরিবেশটি।
মৃদুল লাইনের একেবারে শেষ প্রান্তে এসে একটি শিশিরঝরা বকুলগাছের নিচে দাঁড়িয়েছিল। বাইরে শেষ রাত্রির কুয়াশা জেঁকে বসেছে। বিদ্যুতের তারে দুটি ফিঙে পাখি একঠায় বসে আছে। তাদের মাঝখান দিয়ে বকুলের পাতাঘেঁষে সূর্যের প্রথম রশ্মিটুকু একেবারে মৃদুলের পায়ে এসে পড়েছে। যেন-বা শীতের প্রকৃতিকে পশ্চাৎপটে নিয়ে লিওনার্দো ভিঞ্চি এইমাত্র মৃদুলের এক পোর্ট্রেট অঙ্কন সমাপ্ত করলেন।
ভাবনায় নিমজ্জিত ছিল মৃদুল। তখনই টের পেল, পেছন থেকে কেউ তাকে বলছে, একটু সামনে যাবেন প্লিজ, সামনের জায়গা তো খালি দেখছি।
মৃদুল টের পায়নি, তার ভাবনায় নিমজ্জনের কোনো অবসরে ভাঁপা পিঠার লম্বা লাইন ছোট হয়ে এসেছে।
সে সামনে এগিয়ে গেল। কিন্তু এ কী বিড়ম্বনা! যে তাকে সামনে যেতে বলল, তার কণ্ঠ এত পরিচিত মনে হলো কেন? কে কী ভাববে মনে করে প্রথমে নির্বাক দাঁড়িয়ে রইল সে। তারপর কোত্থেকে কী সাহস পেয়ে পেছন ফিরে তাকাল। এ তো সেই মুখ! কেমন করে ভোলে মৃদুল বহুল চর্চিত সেই মুখচ্ছবি। থতমতো খেয়ে দাঁড়িয়ে থাকল সে। ‘কী দেখছেন অমন করে’, বলল মেয়েটি।
-সেই কণ্ঠ! অপার বিস্ময়ে বেহুঁশ হওয়ার জোগাড় হলো মৃদুলের। একসময় বিস্ময়াবিভূত মৃদুলকে চন্দ্রাহত কেরানির মতো পেছনে ফেলে লাইনে এগিয়ে গেল মেয়েটি এবং অন্যরা। একটি ভাঁপা পিঠা কিনে মেয়েটি ফিরে চলল নিজের বাড়িতে। রাস্তার মোড়ে এসে এই প্রথম পেছন ফিরে তাকাল সে। সে-ও মেয়েটিও এমন মোহন মুখটি অনেক অনেকবার স্বপ্নে দেখেছে কি না।
এমন সময় সংবিৎ ফিরল মৃদুলের। ভাঁপা পিঠা কেনা, খেজুর রসে তা চুবিয়ে খাওয়ার বহুদিনের লালিত স্বপ্ন আবারও পিছিয়ে গেল। স্বপ্নের এ মেয়েটি কোথায় থাকে জানা চাই। মেয়েটি হেঁটে যাচ্ছে। মৃদুল ভাবল, হেঁটেই যেহেতু যাচ্ছে, বোধ করি কাছেপিঠে কোথাও তার বাড়ি হবে। কিন্তু এক মাইল হেঁটেও মেয়েটি কোথাও থামল না। অগত্যা দূর থেকে ফলো করার জন্য রিকশা নিল সে। শহুরে ছেলে মৃদুল, তার পায়ে একজন গ্রামীণ মানুষের তাকদ থাকবে কীভাবে।
এদিকে হরিতে হিরণে আচ্ছন্ন প্রকৃতি। মৃদুল কোনো দিন বোয়াল ভাসা নদী পেরিয়ে এদিকে ঘুরতে আসেনি। প্রকৃতির এত কাছে থাকে অথচ আসা হয়নি কোনো দিন। মনে মনে গুনগুন করল সে, দেখা হয় নাই চক্ষু মেলিয়া, ঘর হইতে শুধু দুই পা ফেলিয়া...
রিকশাওয়ালা বলল, ভাইজান, কিছু বললেন?
মৃদুল কিছু বলতে চাইল না। পরে কী জানি কী ভেবে বলল, এদিকে প্রকৃতি কতই-না সুন্দর!
ধান কাটা হয়ে গেছে। দিগন্তছাওয়া বীতশস্য মাঠ আশ্বিনের সোনার আলোয় আচ্ছন্ন। গ্রামীণ রিকশাওয়ালার চোখে গ্রাম্য চারণভূমির এ নিত্যদিনের চিত্র- এখানে কোথায় সৌন্দর্য লুকিয়ে আছে তার স্বশিক্ষিত মস্তিষ্ক অনেক খুঁজেও বের করতে পারল না। তবে শহুরে বাবুর মনে কষ্ট হয়, এমন কিছুও বলল না সে।
রিকশা আরও সামনে এগিয়ে গেল। এখানে বোয়ালভাসা নদী আদর্শ কলেজের মোড়ে নিপুণ বাঁক নিয়েছে।
এক ভাঙা মসজিদের চবুতরায় কিছুক্ষণ থামল মেয়েটি। ওখানে গ্রামের কতিপয় প্রবীণ শীতের সকালে রোদ ‘পোহাইতে’ বসেছেন। মেয়েটি তাদের কানে কী বলল দূর থেকে বোঝা গেল না। আবার নিজের পথে হাঁটা ধরল সে। মৃদুল দেখল, সামনে পদ্মফোটা পুষ্করিণীর পাশে গ্রামীণ রাস্তায় হারিয়ে গেল মেয়েটি। এখানেই তার বাড়ি হবে, সিদ্ধান্তে আসল মৃদুল।
ইংরেজি সাহিত্যের ছাত্র সে। একবার তার বন্ধু সানিয়ার কথা ভাবল সে। প্রেমিকার উপস্থিতিতে অন্য একজনকে স্বপ্নে দেখা প্রতিদিন, আজ বাস্তবে তার সাথে দেখা-তারপর তার সন্ধানে শীতার্ত গ্রামের পথে এত দূর আসা- সে কোনো অপরাধ করছে না তো!
আবার সমস্ত চিন্তা-ভাবনার ঊর্ধ্বে উঠে এখনো নাম-না-জানা সেই মেয়েটির পেছনে তার মনপ্রাণ কাজী বিলের দিকে উড়ে চলা বলাকার মতো পাখা মেলে দিল। ‘তেলেনাপোতা আবিষ্কার’ নামে কল্পিত এক ভবিষ্যৎকালের গল্পের কথা মনে পড়ল তার। পদ্মফোটা পুষ্করিণী পার হলে একটি বাঁকানো পথ পড়বে। পথটির আকাশ গগনশিরীষে ঢাকা পড়েছে আর তার জমিন শরতের শিউলি ফুলে আচ্ছন্ন। আরও এগিয়ে গেলে ডানে মনু মিয়ার দোকান পড়বে আর বাঁয়ে শুয়ে থাকবে বুড়ো-বুড়ির পুকুর। সেই পুকুরে আবার কলমির দামে সরালী দম্পতি বাসা বেঁধেছে, বাড়িতে যাওয়ার পথে মেয়েটি সরালী বউয়ের দিকে ক্ষণিক তাকাবে। তার ফোঁপানো ঠোঁটে একটু স্মিত হাসি জমাট বাঁধবে কি বাঁধবে না। আবার হেঁটে চলবে সে তার কোকিল কূজিত কুঞ্জের দিকে।
মৃদুল বলতে পারে না, কতক্ষণ সে অমনতর ভাবনায় নিমজ্জিত ছিল। তার মগ্ন চৈতন্যে শিস দিয়ে গেল রিকশাওয়ালার কণ্ঠ,
-ভাইজান, সামনে যামু নাকি ফেরত যাবেন।
বাড়ি ফিরে আসল মৃদুল। চিন্তিত। সময়ের তাড়া ছিল তার, আজ ‘বাংলা টিভি’তে আসন্ন ঈদুল আজহা উপলক্ষে নতুন অনুষ্ঠানের জন্য মিটিং ডাকা হয়েছে। নতুন চাকরি। মুখে কিছু দিয়েই ছুটল মৃদুল। তবে তার মন, ‘বাংলা টিভি’তে নতুন অনুষ্ঠানের আয়োজন, তার মেয়ে বন্ধু সানিয়া- সবকিছু ছাপিয়ে দিনমান তার চোখের আকাশে ভেসে রইল এক অপরিচিতা মেয়ের অতি পরিচিত মুখচ্ছবি।
দশটা নাগাদ ‘বাংলা টিভি’র হলরুমে প্রোগ্রামার, পরিচালক, নির্বাহীরা একে একে জড়ো হতে লাগলেন। মৃদুল যখন পৌঁছাল ততক্ষণে হল ভর্তি হয়ে গেছে। কিছুক্ষণ পর অনুষ্ঠান সম্পাদক বক্তব্য শুরু করলেন,
-আপনারা জানেন, ঈদ আসন্ন। এও জানেন, প্রতি বছরের মতো চ্যানেলগুলো নতুন নতুন আইটেম নিয়ে হাজির হবে, কাজেই ঈদের দিন আমাদের এমন কিছু করা চাই, যাতে অন্যদের চেয়ে এগিয়ে যেতে না পারি, কিন্তু পিছিয়ে যেন না পড়ি।
অনেকক্ষণ কেউ কিছু বলল না। তারপর শুরু হলো গুঞ্জন। অনুষ্ঠান সম্পাদক আবারও হাতে মাইক নিলেন,
-আপনাদের কার কী প্রস্তাবনা আছে, অনুগ্রহ করে বলুন।
মৃদুল সবচেয়ে নবীন সাংবাদিকদের একজন, সে আর কী বলবে। তবে কেউ কিছু না বললে, সাহস করে একটি প্রোগ্রাম সম্পর্কে বলার মানসিক প্রস্ততি আছে তার, আগে দেখা যাক, অন্যরা কী বলেন।
চলবে...