বাংলাদেশে নির্ভয়ে সত্য উচ্চারণের মতো বুদ্ধিজীবী খুব কম লেখকই আছেন। হুমায়ুন আজাদ ছিলেন নির্ভয়ে সত্য উচ্চারণ করার মতো সাহসী বুদ্ধিজীবী। মননশীল ও সৃষ্টিশীল লেখক তিনি। লিখেছেন প্রবন্ধ, কলাম, গল্প, কবিতা, উপন্যাস ও প্রবচনগুচ্ছ, নারীবিষয়ক এবং ভাষাবিজ্ঞানের ওপর চমৎকার বই। ধর্মান্ধ সমাজ, অপশাসন, দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি, অবৈজ্ঞানিক চিন্তাধারা, অসততা ও অন্যায়ের বিরুদ্ধে ন্যায় ও যুক্তিসঙ্গত কথা বলেছেন। তিনি সত্য উচ্চারণ করেছেন বলেই পদে পদে বিভিন্ন বাধা-বিপত্তির শিকার হয়েছেন। মুক্তচিন্তার কবি ও লেখকদের ওপর অনেক আঘাত করা হয়েছে। অধ্যাপক আহমদ শরীফ, দাউদ হায়দার, শামসুর রাহমানকেও হুমকি দেওয়াসহ আঘাত করা হয়েছে। তবে সবচেয়ে বেশি আঘাত এসেছে হুমায়ুন আজাদের ওপর। তার বই যেমন বারবার নিষিদ্ধ করা হয়েছে, তেমনি তাকে গালাগাল, মানসিক আঘাতও সইতে হয়েছে। সর্বশেষ তাকে শারীরিকভাবে আঘাত করে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিয়েছে উগ্রবাদীরা।…
হুমায়ুন আজাদের জন্ম ২৮ এপ্রিল ১৯৪৭, মুন্সীগঞ্জের বিক্রমপুরের কামারগাঁয়ে নানা বাড়িতে। তার জন্মনাম ছিল হুমায়ুন কবীর। তার বাবা আবদুর রাশেদ শিক্ষকতা করতেন, পরে পোস্টমাস্টার এবং অবশেষে ব্যবসায়ী হয়েছিলেন। মা জোবেদা খাতুন ছিলেন গৃহিণী। হুমায়ুন আজাদের বেড়ে ওঠা তাদের গ্রামের বাড়ি রাড়িখালে। রাড়িখাল ছিল বাবার বুকের মধ্যে। রাড়িখালের অপার সৌন্দর্য তিনি তুলে ধরেছেন ‘ফুলের গন্ধে ঘুম আসে না’ বইতে। ছত্রে ছত্রে রাড়িখালের সৌন্দর্যের বর্ণনা করেছেন তিনি ‘ঘুমের ভেতর নিবিড় শ্রাবণ ধারা’ প্রবন্ধটিতে। তার শৈশব ছিল অসম্ভব সুন্দর ও প্রাণবন্ত। রাড়িখাল গ্রামে বহমান পদ্মা নদী। রাতের বেলায় নদীতে স্টিমার চলত, তখন তিনি তন্ময় হয়ে শুনতেন স্টিমার চলার শব্দ।
ছেলেবেলা থেকেই প্রচণ্ড মেধাবী ছিলেন হুমায়ুন আজাদ। জেসি বোস ইনস্টিটিউট থেকে ১৯৬২ সালে ম্যাট্রিক পরীক্ষায় তিনি মেধাতালিকায় উত্তীর্ণ হয়েছিলেন। ঢাকা কলেজ থেকে ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষাতেও তিনি মেধাতালিকায় স্থান করে নিয়েছিলেন। ১৯৬৪ সালে ভর্তি হলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে। বাংলা বিভাগ থেকে ১৯৬৭ ও ১৯৬৮ সালে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে স্নাতকোত্তর পড়ার সময় লতিফা কোহিনুরের প্রতি তার ভালোলাগা এবং প্রচলিত নিয়মের বাইরে গিয়েই টেলিফোনে তাদের বিয়ে হয়। ১৯৬৯ সালে মাত্র ২২ বছর বয়সে চট্টগ্রাম কলেজে প্রভাষক হিসেবে শিক্ষকতা জীবন শুরু করেন। তারপর তিনি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা বিভাগে প্রভাষক হিসেবে শিক্ষকতা করেন। হুমায়ুন আজাদ যখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা বিভাগের ছাত্র ছিলেন তখন ভাষাবিজ্ঞানী নওম চমস্কির উদ্ভাবিত রূপান্তরমূলক সৃষ্টিশীল ব্যাকরণ তত্ত্বটি আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল। হুমায়ুন আজাদ স্কটল্যান্ডে এডিনবরা বিশ্ববিদ্যালয়ে পিএইচডি ডিগ্রির জন্য এই তত্ত্বের কাঠামোর ওপর ভিত্তি করে বাংলা ভাষার রূপমূলতত্ত্ব তথা বাক্যতত্ত্ব নিয়ে গবেষণা করেছিলেন। এই গবেষণার মধ্য দিয়েই বাংলার ভাষাবিষয়ক গবেষণায় আধুনিক ভাষাবৈজ্ঞানিক পদ্ধতির সূত্রপাত ঘটে।
হুমায়ুন আজাদ ১৯৯০-এর দশকে প্রতিভাবান ঔপন্যাসিক হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন। তার প্রকাশিত উপন্যাসের সংখ্যা ১৩। তার ভাষাবুনন দৃঢ়, কাহিনির গঠন সংহতিপূর্ণ এবং রাজনৈতিক দর্শন স্বতঃস্ফূর্ত। তার বিখ্যাত উপন্যাস ছাপ্পান্নো হাজার বর্গমাইল, সব কিছু ভেঙে পড়ে, যাদুকরের মৃত্যু, কবি অথবা দণ্ডিত অপুরুষ, নিজের সঙ্গে নিজের জীবনের মধু, ফালি ফালি করে কাটা চাঁদ, একটি খুনের স্বপ্ন এবং পাক সার জমিন সাদ বাদ।
আশির দশকের শেষে হুমায়ুন আজাদ বাংলাদেশের সমসাময়িক ও রাজনীতি নিয়ে লিখতে শুরু করেন। তার প্রকাশিত ‘আমরা কি এই বাংলাদেশ চেয়েছিলাম’ গ্রন্থটি মূলত রাষ্ট্রযন্ত্রের ধারাবাহিক সমালোচনা ছিল। তার বিখ্যাত প্রবন্ধগ্রন্থগুলো হচ্ছে শিল্পকলার বিমানবিকীকরণ ও অন্যান্যপ্রবন্ধ, ভাষা-আন্দোলন: সাহিত্যিক পটভূমি, নারী, জলপাই রঙের অন্ধকার, আমার অবিশ্বাস, দ্বিতীয় লিঙ্গ ইত্যাদি। তবে ‘নারী’, ‘দ্বিতীয় লিঙ্গ’ এবং ‘পাক সার জমিন সাদ বাদ’ বেশ আলোচনার জন্ম দেয়।
ভাষাবিজ্ঞানী ও গদ্যের জন্য জনপ্রিয় হলেও আমৃত্যু কাব্যচর্চা করে গেছেন হুমায়ুন আজাদ। সমসাময়িক কালের হতাশা, প্রেম, দ্রোহ, ঘৃণা ইত্যাদি তার কবিতার মূল উপাদান। তার প্রথম লেখা ছাপা হয়েছিল দৈনিক ইত্তেফাক-এর শিশুপাতা কচিকাঁচার আসরে। হুমায়ুন আজাদের বিখ্যাত কাব্যগ্রন্থ অলৌকিক ইস্টিমার, সবকিছু নষ্টদের অধিকারে যাবে, যতোই গভীরে যাই মধু যতোই ওপরে যাই নীল, আমি বেঁচে ছিলাম অন্যদের সময়ে, কাফনে মোড়া অশ্রুবিন্দু ও পেরোনোর কিছু নেই।
আমার বাবাকে প্রায় ২৭ বছরের মতো আমি পেয়েছি। আমি মাস্টার্স পাস করার পর তিনি মারা যান। বাবার মতো এমন আদর্শবান মানুষ বর্তমানে দেখা যায় না। দেশে যে সময় বয়ে যাচ্ছে, তার মতো মুক্তমনা লোকের খুবই দরকার ছিল। এখন যারা কথা বলেন সবাই যার যার স্বার্থের চিন্তা করে কথা বলেন। আব্বা সবচেয়ে বেশি পছন্দ করতেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা, তার ছাত্রছাত্রী এবং বই ও বইমেলা। তিনি বিদেশে যেতে খুব বেশি পছন্দ করতেন না। তিনি এডিনবরা বিশ্ববিদ্যালয়ে পিএইচডি করে আসার পর বিদেশে যেতে চাইতেন না। অন্যদের মধ্যে বিদেশে থাকার যে আকাঙ্ক্ষা ছিল, উনার মধ্যে সেটা কখনো ছিল না। তিনি সবসময় দেশে থাকতে পছন্দ করতেন এবং বাংলাদেশকে অনেক বেশি ভালোবাসতেন। যদি কোথাও ঘুরতে যেতে ভালো লাগে তাহলে তুমি রাড়িখালে চলে যেতেন।
আমার খুব দুঃখ হয়, কারণ তখন মানুষের আর্থিক অবস্থা খুব একটা ভালো ছিল না। আমার বাবার খুব শখ ছিল ছবি তোলা। তিনি সময় পেলেই ক্যামেরা দিয়ে ছবি তুলতেন। কষ্ট লাগে যে, আমার বাবার ক্যামেরা ছিল না। তিনি কারও কাছ থেকে ধার করে ক্যামেরা নিয়ে আসতেন। এখন কারও ছবি তোলা দেখলেই আমার বাবার কথা মনে পড়ে এবং খারাপ লাগে। তিনি স্বাধীনচেতা মানুষ হওয়ায় সব মানুষের মুখের সামনেই সঠিক জবাব দিয়ে দিতেন। মানুষ হিসেবে কে উঁচু, কে নিচু তা তিনি ভাবতেন না। আমি তাকে একবার বলেছিলাম, এটা কীভাবে আপনি পারেন। তিনি বলেছিলেন, আমি যা করব তা আমার নিজের যোগ্যতাই করব। আমি কাউকে পরোয়া করি না।
বর্তমানে পুরস্কারের বিষয়ে সমালোচনা হয়। আমার আব্বাকে পুরস্কার পাওয়ার জন্য কখনো ব্যতিব্যস্ত হতে দেখিনি। তিনি নামমাত্র কয়েকটি পুরস্কার পেয়েছেন- শিশু একাডেমি, বাংলা একাডেমি ও একুশে পদক পেয়েছেন। তিনি সবসময় বলতেন, একবার, দুবার পুরস্কার পাওয়া ভালো। বেশি পুরস্কার পেলে তা হাস্যকর হয়ে যায়। বাবার সঙ্গে খুব বেশি মানুষের সম্পর্ক দেখিনি। কারণ হচ্ছে, তিনি মুখের ওপর অনেক কথাই বলে দিতেন। সে কারণেই তার অনেক শত্রু ছিল। তার লেখা ও কথার জন্য তিনি মানুষের শত্রু হয়ে উঠতেন। তবে তিনি সাংবাদিকদের খুব পছন্দ করতেন।
নারীবাদ বাবার সবসময় পছন্দের বিষয় ছিল। নারীবাদ বিষয়ে সিম্যান দ্য বিভ্যুয়ার থেকে শুরু করে হাজার লেখকের বই তার সংগ্রহে ছিল। এরপর তিনি যখন নারী বইটি লিখতে বসলেন তখন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ছুটি নিয়েছিলেন। তার অসাধ্য শ্রমের ‘নারী’ বইটি তুমুল জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। এই বইকে পুঁজি করে বাবাকে কখনো ব্যবসা করতে দেখিনি। পরে বইটি যখন সরকার নিষিদ্ধ করে দেয়, তখন বাবাকে খুব বিক্ষুব্ধ দেখেছি। তবে তিনি দমে যাননি। তিনি দ্বিতীয় লিঙ্গ নামে আরেকটি বই লিখেছেন। ১৯৯৯ সালে তার নিষিদ্ধ বই ‘নারী’ যখন কোর্ট নিষিদ্ধমুক্ত করে, সেদিন বাবার চোখে জয়ের ঝিলিক দেখেছিলাম।
আমার বাবা বাংলাদেশকে যেমন ভালোবাসতেন, তেমনিভাবে বাংলা ভাষাকে অনেক ভালোবাসতেন। আমি কখনো তাকে বাংলা ও ইংরেজি ভাষা মিশিয়ে কথা বলতে দেখিনি। তিনি বাংলার ছাত্র হয়েও বিজ্ঞানমনস্ক ছিলেন। কোনো কুসংস্কারচ্ছন্ন বিষয় তার মাথায় থাকত না এবং তিনি কখনো তা প্রশ্রয় দেননি। আমরা যখন ছোট ছিলাম তখন তিনি কখনোই ভূতের গল্প শোনাতেন না। কারণ তিনি বিজ্ঞান বিশ্বাস করতেন বলেই আমাদের বিজ্ঞানভিত্তিক শিক্ষা দিতেন। তিনি শিশুতোষ জাতীয় বই পড়তে দিতেন- যেমন ঠাকুরমার ঝুলি, ক্রিস্টিয়ানের বই পড়তে দিতেন। বাবা সবসময় আমাকে স্বাধীনভাবে নিজের সিদ্ধান্ত নেওয়ার পরামর্শ দিতেন। এজন্য আমি কৃতজ্ঞ।
অনুলিখন: সানজিদ সকাল