রবীন্দ্রনাথের গীতাঞ্জলির কিছু নির্বাচিত কবিতার ইংরেজি অনুবাদ নিয়ে ‘সং অফারিংস (Song-Offerings)’ নাম দিয়ে ইন্ডিয়া সোসাইটি কর্তৃক চিসউইক প্রেস থেকে ছাপা হলো ১৯১২ সালে। কবি ডব্লিউ বি ইয়েটস-এর ভূমিকযুক্ত হয়ে তা প্রকাশিত হলো লন্ডনের সেন্ট মার্টিন্স স্ট্রিটে অবস্থিত ম্যাকমিলান অ্যান্ড কো. লিমিটেড থেকে ১৯১৩ সালে। তার অসাধারণ হৃদয়স্পর্শী, নতুন ও সুন্দর কবিতার জন্য (because of his profoundly sensitive, fresh and beautiful verse) ১৩ নভেম্বর, ১৯১৩ সালে সুইডিশ একাডেমি এই প্রথম ইউরোপিয়ান নন এমন একজন অর্থাৎ তাকে নোবেল পুরস্কার প্রদান করল। এর আগে ভারতবর্ষ থেকে আরেকজন লেখক সাহিত্যের জন্য নোবেল পুরস্কার পেয়েছিলেন। তিনি রুডিয়ার্ড কিপলিং। ১৯০৭ সালে তাকে এ পুরস্কার দেওয়া হয়। তবে তিনি ছিলেন ইংরেজ। রবীন্দ্রনাথের জন্য সুপারিশ করেছিলেন ব্রিটিশ কবি থমাস স্টার্জ মুর ও কবি ইয়েটস। রেডিওযোগে এ খবর প্রচারিত হলো।
২৩ নভেম্বর ১৯১৩ (৭ অগ্রহায়ণ, ১৩২০) বোলপুরে শান্তিনিকেতনের আম্রকুঞ্জে আয়োজন করা হলো এক বিশাল সংবর্ধনা সভার। কবিকে দেওয়া হলো মানপত্র। কিন্তু ভানুসিংহ ঠাকুর (ভণিতা) ওরফে রবি ঠাকুরের মনে উচ্ছ্বাস নেই। আয়োজক ও উপস্থিত সবার এ উদ্যোগে কোনো কৃত্রিমতা নেই। তাহলে কবির চেহারায় এ বিষাদ কেন?
কবির তখন মনে পড়ছে এতকাল ধরে যারা তাকে অপমান করেছে তাদের কথা। তিনি লিখেছিলেনও গীতাঞ্জলিতে:
হে মোর দুর্ভাগা দেশ, যাদের করেছ অপমান
অপমানে হতে হবে তাহাদের সবার সমান।
কিন্তু কিছুতে কিছু হয়নি। তাকে নিন্দা করার লোকের অভাব ছিল না। কালীপ্রসন্ন কাব্য বিশারদ স্বদেশি আন্দোলন করে শ্রদ্ধা অর্জন করেছিলেন। ব্রিটিশ সরকার এজন্য তাকে রেঙ্গুনে নির্বাসন দিয়েছিল। সেই তিনি রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে লিখেছিলেন:
আয় তোরা দেখতে যাবি
ঠাকুর বাড়ির মস্ত কবি!!
হায় রে কপাল। হায় রে অর্থ!
যার নাই তার সকল ব্যর্থ।
উড়িস নে রে পায়রা কবি
খোপের ভিতর থাক ঢাকা,
তোর বকবকম আর ফোঁসফোঁসানি
তাও কবিত্বের ভাব মাখা
তাও ছাপালি গ্রন্থ হল
নগদ মূল্য এক টাকা (মিঠে কড়া, ১৮৮৮)।
দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের মতো বিখ্যাত কবিও রবীন্দ্রনাথকে একহাত নিতে ছাড়েননি।
‘কেন যামিনী না যেতে জাগালে না, বেলা হল মরি লাজে’ কবি গুরুর এ গানে শালীনতার অভাব পেয়েছিলেন অনেকে। দ্বিজেন্দ্রলাল লিখলেন: ‘এই গানটি যদি গৃহস্ত ঘরের কোন কুমারীর মুখে শোনা যায় তাহা হইলে কি মনে করিতে হইবে?’ ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের দৌহিত্র সুরেশচন্দ্র ছিলেন একজন সমাজপতি। তিনিও একজন ঘোর রবীন্দ্রবিরোধী ছিলেন। তার মতে, কবিরা সাধারণত উচ্চশিক্ষিত হবেন, হবেন হেকিম (নবীনচন্দ্র) বা উকিল (হেমচন্দ্র), কিন্তু তিনি তা নন, তিনি জমিদার হয়েও কবিতা লেখেন। এটা ছিল কবির অপরাধ।
রবীন্দ্রনাথ যে সময়ে লিখতে শুরু করেন সে সময় সাধারণত পৌরাণিক কাহিনি নিয়েই কবিতা লেখার চল ছিল। কিন্তু তিনি সে পথে হাঁটলেন না, এটাও তার দোষ ছিল সমালোচকদের চোখে। তারা প্রচার করত তার কবিতা অস্পষ্ট। ওটা নাকি তার একটা ঢং। এ সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথ নিজেই তার জীবন স্মৃতিতে লিখেছেন:
‘সমালোচকদের মধ্যে আমার সম্বন্ধে এই কথাটা রব উঠিতেছিল যে, আমি ভাঙা ভাঙা ছন্দ ও আধো আধো ভাষার কবি। সমস্তই আমার ধোঁওয়া ধোঁওয়া, ছায়া ছায়া।’ এমনকি বাঙালিদের দ্বারা অলংকৃত কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত রবীন্দ্রনাথের ইংরেজি জ্ঞান তো দূরে থাকুক, বাংলা জ্ঞান পর্যন্ত স্বীকার করতে প্রস্তুত ছিল না।
তবে নোবেল পাওয়ার পর তারাই রবীন্দ্রনাথকে ডক্টরেট দিয়েছিল, যার কোনো মূল্য ছিল না বিশ্বকবির কাছে।
নোবেল পাওয়ার পরও দুর্মুখেরা বলতে লাগল: গীতাঞ্জলির ইংরেজি আসলে ইংরেজ কবি পিয়ারসনের, রবীন্দ্রনাথের নিজের না। কথিত আছে পুরস্কারটি বিখ্যাত ফরাসি লেখক এমিল ফ্যাগে কে দেওয়ার কথা হচ্ছিল কিন্তু ঘটনাক্রমে তা রবীন্দ্রনাথকে দেওয়া হয়। রবীন্দ্রনাথকে পুরস্কার দেওয়ার ব্যাপারে প্রবল আপত্তি উঠেছিল জার্মানিতে। এরাই যখন অন্যদের সঙ্গে জোট বেঁধে হুল্লোড় করে কবিকে অভিনন্দন জানাতে এল, অসংখ্য টেলিগ্রাম পাঠাতে লাগল রবীন্দ্রনাথের অভিমান তখন উথলে উঠল। তার এ অনুভূতি ও বিরক্তির মনোভাব জানিয়ে উইলিয়াম রোটেনস্টাইনকে একটা পত্র লিখলেন:
‘The perfect whirlwind of public excitement has given rise to is frightful. It is almost as bad as tying a tin can at a dog's tail making it impossible for him to move without creating noise and collecting crowds all along.’ অর্থাৎ মোহিতলাল মজুমদারের ভাষায় বিষণ্ন রবীন্দ্রনাথ বললেন:
‘গ্রাম্য বালকেরা যেমন কুকুরের ল্যাজে টিন বেঁধে হাততালি দিয়ে তাড়া করে বেড়ায়, আপনারা তাই করতে এসেছেন।’
১৮৯৪ সালে রবীন্দ্রনাথ তার ভ্রাতুষ্পুত্রী ইন্দিরা দেবীকে নিন্দুকদের সম্বন্ধে এক চিঠিতে জানিয়েছিলেন: ‘এরা খুব অল্প অনুভব করে, অল্প চিন্তা করে এবং অল্পই কাজ করে, সেজন্য এদের সংসর্গে মনের কোনো দুঃখ নেই।’ আসলে নিন্দুকদের নিয়ে কখনোই মুখ খোলেননি তিনি। সমস্ত মিথ্যা অপবাদ নীরবে সহ্য করেছেন কিন্তু তারাই যখন দলবেঁধে অন্যদের সঙ্গে মিশে মানপত্র, অজস্র ফুলের মালা দিয়ে তাকে ডুবিয়ে দিতে লাগল বোলপুরে অভিমানী রবীন্দ্রনাথ আর নিশ্চুপ থাকতে পারলেন না। এত দিনের পুষে রাখা মনোবেদনার বিস্ফোরণ ঘটালেন তিনি। তার ভাষণ শুরু হলো-
আজ আমাকে সমস্ত দেশের নামে আপনারা যে সম্মান দিতে এখানে উপস্থিত হয়েছেন তা অসংকোচে সম্পূর্ণভাবে গ্রহণ করি এমন সাধ্য আমার নেই। ...দেশের লোকের হাত থেকে যে অপযশ ও অপমান আমার ভাগ্যে পৌঁছেছে তার পরিমাণ নিতান্ত অল্প হয়নি, এবং এতকাল আমি তা নিঃশব্দে বহন করে এসেছি।
...আজ যখন সমস্ত দেশের জনসাধারণের প্রতিনিধিরূপে আপনারা আমাকে সম্মান উপহার দিতে প্রবৃত্ত হয়েছেন, তখন সে সম্মান কেমন করে আমি নির্লজ্জভাবে গ্রহণ করব? ...আজ আপনারা আদর করে সম্মানের যে সুরাপাত্র আমার সম্মুখে ধরেছেন, তা আমি ওষ্ঠের কাছ পর্যন্ত ঠেকাব, কিন্তু এ মদিরা আমি অন্তরে গ্রহণ করতে পারব না। এর মত্ততা থেকে আমি চিত্তকে দূরে রাখতে চাই।’
এ ভাষণ অনেককে দুঃখিত করল, তারা আন্তরিকতা নিয়েই সংবর্ধনা জানাতে এসেছিলেন। কিন্তু রবীন্দ্রনাথের চিত্তে বাজছে তখন বিষাদ আর অভিমানের সুর যা বেশ আগেই তিনি রচনা করে রেখেছিলেন:
এ মণিহার আমায় নাহি সাজে
এরে পরতে গেলে লাগে,
এরে ছিঁড়তে গেলে বাজে।...
তবে সবাই যে তার দুর্নাম করেছিলেন তা নয়। অনেকে প্রশংসা করেছিলেন। ছন্দের রাজা কবি সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত লিখেছিলেন:
জগৎ কবি সভার মাঝে
তোমার করি গর্ব
বাঙালি আজ গানের রাজা
বাঙালি নহে খর্ব।
কবি রবীন্দ্রনাথ গান্ধীকে দিয়েছিলেন ‘মহাত্মা’ উপাধি, বিনিময়ে মহাত্মা গান্ধী তার নাম ‘কবি গুরু’ বলে অলংকৃত করেছিলেন।