চলছে পবিত্র মাস রমজান। এ সময় ছোট-বড় সবাই উৎসাহ উদ্দীপনার মধ্য দিয়ে রোজা পালন করে থাকেন। তবে হৃদরোগীরা রোজা রাখতে পারবেন কি না, এ নিয়ে অনেকের মনে নানা প্রশ্ন দেখা দেয়। তবে রোজা নিয়ে যত গবেষণা হয়েছে, তাতে বলা হয়েছে, একেবারে খারাপ রোগী ছাড়া অন্য হৃদরোগীদের জন্য রোজা বেশ উপকারী। লিখেছেন ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের হৃদরোগ বিভাগের বিভাগীয় প্রধান অধ্যাপক ডা. আব্দুল ওয়াদুদ চৌধুরী
রক্তচাপের রোগী
উচ্চ রক্তচাপের রোগীদের বেশির ভাগ ওষুধ সকালে বা রাতে খেতে হয়। সে ক্ষেত্রে রমজানে সাহরি ও ইফতারিতে মিলিয়ে ওষুধ খেতে পারেন সহজেই। তাছাড়া রোজায় বেশির ভাগ রক্তচাপের রোগী একটা নিয়মের মধ্যে থাকে বলে তাদের রক্তচাপ বেশ ভালো নিয়ন্ত্রণে থাকে। অনেক ক্ষেত্রে ওষুধের মাত্রাও কমাতে হয়। তাদের ক্ষেত্রে রোজা রাখতে কোনো অসুবিধাই নেই; বরং উপকারী।
তবে রক্তচাপের রোগীদের লবণ, তেল-চর্বিযুক্ত বা ভাজাপোড়া খাবার কম খেতে হবে। ইফতারে এক বা দুটি পিঁয়াজু, একমুঠো ছোলা খেতে পারেন। তবে রান্না করা ছোলার পরিবর্তে ভেজানো কাঁচা ছোলা, পেঁয়াজ, মরিচ, আদা দিয়ে খেতে পারলে ভালো, পেটের জন্যও উপকারী। এর ভিটামিন, মিনারেলস, অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট, পটাসিয়াম রক্তচাপ বা হার্টের জন্য ভালো। আবার সর বাদ দিয়ে দই বা টকদই খেলে ফ্যাটের মাত্রাও কমিয়ে দেয়, এতে থাকা ব্যাকটেরিয়াগুলোও উপকারী।
যাদের জন্য রোজা নয়: যদি কারও রক্তচাপ খুব বেশি থাকে বা যাদের রক্তচাপ কন্ট্রোলে থাকে না, যেমন কারও ওপরেরটা ২০০ বা নিচেরটা ১১০ মি.মি মারকারি রয়েছে, এমন রোগীর ক্ষেত্রে রক্তচাপ কন্ট্রোলে না আসা পর্যন্ত রোজা না রাখাই শ্রেয়। চিকিৎসকের পরামর্শে ওষুধগুলো অ্যাডজাস্ট করে নিলে ভালো হয়।
হার্টের সমস্যা যাদের
হার্ট অ্যাটাক বা স্কিমিক হার্টের রোগীদের বেশির ভাগ ক্ষেত্রে দুই বেলা ওষুধ খেতে হয়। তাই সাহরি ও ইফতারিতে ওষুধ খেয়ে তারা দিব্যি রোজা রাখতে পারেন।
যারা রাখতে পারবেন না: যখন আন-কন্ট্রোল্ড অ্যানজাইনা বা নিয়মিত বুকের ব্যথা থাকে ও যেকোনো সময় অ্যাটাক হতে পারে—এমন অবস্থায় তিন বেলা ওষুধ খেতে হয়। তখন ওই সময় রোজা রাখা অবশ্য উচিত নয়। চিকিৎসার পর একটু সুস্থ হলে আবার রোজা রাখা যাবে।
আবার যাদের হার্ট ফেইলিওর হয়েছে বা খুব আনসেটেল্ট রোগী, তাদের হার্ট ফেইলিওর বাড়তে পারে রোজা রাখলে, তাদের ক্ষেত্রে হার্ট ফেইলিওর কন্ট্রোল হয়ে গেলে দুই বেলা ওষুধ খেয়ে রোজা রাখা যাবে। তবে রোজা রাখা অবস্থায় যদি দেখা যায় শরীর খুব খারাপ লাগছে, তখন রোজা ভেঙে আগে ওষুধ খেয়ে নিতে হবে। আবার যারা অ্যাকুইট হার্ট ফেইলিওরের রোগী, যাদের অনেক ইনজেকশন নিতে হচ্ছে তাদের রোজা রাখা অবশ্যই উচিত না। অসুস্থতার কারণে না রাখতে পারলে পরে কাফফারা বা বদলি রোজা তো করাই যাবে।
খাবার-দাবার
রোজার মাসে ভাজাপোড়া বেশি খাওয়া হয়। হয়তো কেউ হালিম খাবেন কিন্তু তাকে খেয়াল রাখতে হবে এতে লবণ ও ফ্যাট অনেক বেশি রয়েছে। আবার অধিক পরিমাণে পিঁয়াজু, বেগুনি খেলেও তাতে অধিক পরিমাণে তেল বা চর্বি খাওয়া হয়ে যায়। এর পরিবর্তে প্রতিদিন বেশি বেশি ফলমূল, কাঁচা ছোলা ভিজিয়ে, দুটি মাত্র পিঁয়াজু, অল্প একটু ছোলা খেলে তেমন সমস্যা হয় না। আবার সাহরি, ইফতারি বা তারাবির পর যা খাওয়া হয় তাতে একসঙ্গে বেশি খাওয়া ঠিক নয়।
যাদের হার্টের অসুখের সঙ্গে ডায়াবেটিসের সমস্যা রয়েছে, তাদের একটি কথা খেয়াল রাখতে হবে যে, ডায়াবেটিস বা হার্টের রোগীদের মূল ওষুধটা কিন্তু ইফতারেই খেতে হবে। সাহরির সময় যদি ডায়াবেটিসের বেশির ভাগ ওষুধ খাওয়া হয়, তবে সারা দিন না খেয়ে থাকায় হাইপোগ্লাইসেমিয়া হতে পারে বা হার্টের সমস্যা বাড়তে পারে। তা ছাড়া সাহরি মিস হতে পারে সময়মতো ঘুম না ভেঙে গেলে, কিন্তু ইফতারি মিস হওয়ার সম্ভাবনা একেবারেই নেই। কাজেই সাহরির সময় ওষুধ মিস হতে পারে কিন্তু ইফতারের সময় ওষুধ মিস হবে না।
যাদের হার্টের অ্যাবনরমাল বিট হচ্ছে, তাদের ক্ষেত্রে খেয়াল রাখতে হবে, রোজা রাখলে সেই বিট বাড়ছে না কমছে। যদি বাড়ে, তবে সে সমস্যা সমাধান না হওয়া পর্যন্ত রোজা রাখা ঠিক হবে না।
ইফতারের সময় একটু দই-চিড়া, তারাবির পর একটু মুরগির মাংস, সবজি-ডাল খেতে সমস্যা নেই। সাহরিতে একইভাবে সাদা ভাত, মাছ, ডাল, পরিমিত মুরগির মাংস দিয়ে খাওয়াই ভালো। তবে রেড মিট যথাসম্ভব এড়িয়ে চলা বা পরিমাণে অল্প খাওয়া যেতে পারে।
ব্যায়াম কতটা গুরুত্বপূর্ণ?
অনেকেই জানতে চান, রোজা রাখার সময় হার্টের বা ডায়াবেটিক রোগী হাঁটাহাঁটি করবে কি না। তাদের ক্ষেত্রে বক্তব্য হলো, প্রতিদিন ২০ রাকাত তারাবির নামাজে কিন্তু যথেষ্ট ব্যায়াম হয়। তাই এ সময় হাঁটা অত বেশি জরুরি নয়। এতে মনের প্রশান্তিই নয়, শরীরের প্রশান্তিও আসে। রোজা মেটাবলিজম বাড়ার সুযোগ করে দেয়। এ জন্য পরিমিত খেয়ে রোজা রাখলে না হাঁটলেও চলবে। তবে রোজার পর আবার আগের মতো হাঁটার অভ্যাসে ফিরে যেতে হবে।
কিছু দরকারি তথ্য
রোজা রাখলে বা দীর্ঘক্ষণ না খেয়ে থাকলে কোলেস্টেরলের মাত্রা, রক্তচাপ কমে আসে। কিন্তু সমস্যা হলো, একদিকে না খেয়ে থাকা হয়, অন্যদিকে এত পরিমাণ ভাজাপোড়া খাওয়া হয় যে উল্টো এসবের মাত্রা বেড়েও যেতে পারে। এ জন্য অনেকেরই দেখা যায়, এসব খাবার খেয়ে রোজার সময় ওজন বেড়ে গেছে।
যারা বাইপাস সার্জারি করা রোগী, তারা যেহেতু চিকিৎসা পেয়ে গেছেন, তারা ওষুধ খেয়ে নিশ্চিন্তে রোজা রাখতে পারেন। তবে অল্প কিছুদিন আগে যাদের অপারেশন হয়েছে, রিং (স্টেন্ট) লাগানো হয়েছে তাদের অন্তত এক মাস পর্যন্ত রোজা না রাখা উত্তম। চিকিৎসা নিয়ে সুস্থ থাকলে দুই সপ্তাহ পর রোজা রাখতে পারেন।
যাদের বড় হার্ট অ্যাটাক হয়েছে ও চিকিৎসা নিয়ে বাসায় রয়েছেন, তাদের কমপক্ষে অ্যাটাকের মাসখানেকের মধ্যে রোজা রাখা যাবে না। কেননা অ্যাটাক হওয়ার ফলে হার্টের যে মাসলগুলো ড্যামেজ হয়, তা ঠিক হতে সময় লাগে চার থেকে ছয় সপ্তাহ।
অনেকে রোজার সময় বেশি ওষুধ খেতে চান না। সে ক্ষেত্রে নিজে নিজে সিদ্ধান্ত না নিয়ে চিকিৎসকের পরামর্শে ওষুধের মাত্রা পরিবর্তন করা যেতে পারে।
সবশেষে এটা মনে রাখবেন, যখন আপনার শরীর বলবে যে তার কষ্ট হচ্ছে, রোজা রাখা সম্ভব নয়- তখন মনে করবেন আল্লাহ মেহেরবান, তিনি গাফুরুর রাহিম। তখন রোজা ভেঙে ওষুধ খেয়ে নিন।
অনুলিখন: হৃদয় জাহান