গরমের সময় কী করলে শিশুরা ভালো থাকবে এ নিয়ে মা-বাবা কিংবা অভিভাবকদের দুশ্চিন্তার শেষ নেই। তবে কিছু নিয়মকানুন ও স্বাস্থ্যকর পদ্ধতি মেনে চললে গরমেও ভালোভাবে শিশুর যত্ন নেওয়ার পাশাপাশি জটিলতা এড়ানো যায়। লিখেছেন চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের শিশু স্বাস্থ্য বিভাগের সাবেক প্রধান অধ্যাপক ডা. প্রণব কুমার চৌধুরী
শিশুদের রোগ প্রতিরোধক্ষমতা কম থাকে বলে তারা সহজেই মৌসুমি নানা রোগে আক্রান্ত হয়। এখন প্রচণ্ড গরমের সময়। এ সময় শিশুদের মধ্যে সচরাচর দেখা দেওয়া অসুখগুলোর মধ্যে পানিস্বল্পতা, জ্বর, সর্দি-কাশি-নিউমোনিয়া, ঘামাচি, ডায়পার র্যাশ, মূর্ছা যাওয়া, হিটস্ট্রোক ইত্যাদি অন্যতম।
পানিস্বল্পতা
প্রচণ্ড গরমে প্রয়োজনমতো তরল বা পানি পান না করলে শিশু ডিহাইড্রেশন বা পানিস্বল্পতায় ভুগতে পারে। বমি, ডায়রিয়া বা দুটিতেই আক্রান্ত হলেও শিশুর পানিস্বল্পতা হতে পারে। মৃদু বা মাঝারি ধরনের পানিশূন্যতায় জিভ শুষ্ক হয়, কাঁদলে চোখ দিয়ে সামান্য পানি পড়ে, হৃৎস্পন্দন বেড়ে যায়, ছয় থেকে আট ঘণ্টায় একবারও প্রস্রাব হয় না, অস্থিরতা বেড়ে যাওয়া ইত্যাদি উপসর্গ দেখা দেয়।
আবার মারাত্মক পানিস্বল্পতা হলে মুখগহ্বর খুব শুকনো হয়, পেটের চামড়া, বাহু, পায়ের চামড়া শুকনো ও ঢিলা হয়ে যায়, শরীর নিস্তেজ ও ঘুম ঘুম ভাব থাকে, চোখ গর্তে ঢুকে যায়, মাথার তালু (ইনফ্যান্ট বয়সে) ভেতরে বসে যায়, দ্রুত ও গভীর শ্বাস-প্রশ্বাস নেয়, দ্রুত ও দুর্বল পালস হয় ইত্যাদি।
পানিস্বল্পতা হলে করণীয়-
অল্প পানিশূন্যতা দেখা দিলে বাসাবাড়িতে রেখেই পানিশূন্যতা সারিয়ে তোলা যায়। এ জন্য বারবার অল্পস্বল্প তরল খাবার বা পানীয় খাইয়ে যেতে হবে।
প্রতি ১৫ থেকে ২০ মিনিট অন্তর বয়স অনুযায়ী পরিমাণমতো দু-এক চামচ করে খাবার স্যালাইন খাওয়াতে হবে।
জ্বর
গরমের সময় শিশুদের জ্বরের হার বাড়ে। তবে শিশু যদি খেলাধুলা করে, ভালোভাবে খেতে পারে, পানীয় বা মায়ের দুধ পান করতে সক্ষম হয়, ত্বকের রং স্বাভাবিক থাকে, যদি হাসি-খুশি ভাব থাকে এবং জ্বর কেটে গেলে তাকে স্বাভাবিক দেখায়- তবে বুঝতে হবে, এ জ্বর তেমন মারাত্মক নয়।
জ্বর হলে করণীয়-
জ্বরের শুরুতেই প্যারাসিটামল খাওয়ানোর প্রয়োজন নেই। দুই মাসের কম বয়সী শিশুদের জ্বরের সিরাপ না দিয়ে চিকিৎসকের পরামর্শ নিন। দুই বছরের বেশি হলে জ্বরের সাসপেনশন (এসিটামিনোফোন) খাওয়ানো যেতে পারে। তিন মাস থেকে তিন বছর বয়সে যদি জ্বর ১০২ ডিগ্রি ফারেনহাইটের বেশি থাকে এবং এর চেয়ে বড় শিশুর ক্ষেত্রে শিশুর আচরণে কষ্ট পাচ্ছে মনে হয়, তবে প্যারাসিটামল শুরু করা উচিত।
জ্বর কমাতে গরম পানিতে নরম কাপড় ভিজিয়ে শিশুর পুরো শরীর স্পঞ্জ করে দিন। আইসপ্যাক, ঠাণ্ডা পানি বা অ্যালকোহল ব্যবহার করা উচিত নয়। এতে পরবর্তী সময়ে জ্বর বেড়ে যায়।
পাতলা ও ঢিলেঢালা পোশাক পরান। খেয়াল রাখতে হবে, ঘরের তাপমাত্রা যেন অধিক উত্তপ্ত বা শীতল না হয়।
বেশি বেশি তরল খাবার ও পানীয় খাওয়ান, যাতে সে পানিস্বল্পতায় না পড়ে। যেমন- স্যুপ। তবে চা, কফি নয়।
জ্বরের সঙ্গে বমি, পাতলা পায়খানা থাকলে খাবার স্যালাইন খাওয়াতে হবে। এই সময় আপেল জুস বা ফলের রস নয়।
সর্দি-কাশি-নিউমোনিয়া
ভাইরাস সংক্রমণ ছাড়াও গরমে শিশুর সর্দি-কাশি ও নিউমোনিয়া হওয়া বেশ স্বাভাবিক ঘটনা। এ জন্য বিশেষভাবে সতর্ক থাকতে হবে।
সর্দিতে নাক বন্ধ হলে ‘নরসল’ জাতীয় ড্রপস নাকে দিয়ে ঘুমানো ও খাওয়ানোর আগে ব্যবহার করা ভালো। অথবা হালকা গরম পানিতে এক চিমটি লবণ মিশিয়ে পরিষ্কার নরম কাপড়ে ভিজিয়ে নাকে দেওয়া যায়।
মৌসুমি ফল, বিশেষ করে তরমুজ, ডাব, আনারস, পেয়ারা, কামরাঙা, কাঁঠাল, আম ইত্যাদি খেতে দিন।
কাশি হলে কাশির সিরাপ খাওয়াবেন না। কারণ এর কোনো উপকারিতা নেই; বরং জটিলতা তৈরি হতে পারে।
কাশি হলে ছোট শিশুদের লেবুর রস মেশানো গরমপানীয়, তুলসীপাতার রস ও একটু বড় শিশুদের লিকার চা দেওয়া ভালো।
ডায়াপার র্যাশ
আগের তুলনায় শিশুদের ডায়াপার র্যাশের সমস্যা বেশি দেখা যাচ্ছে। গরমকালেও এই সমস্যা হতে পারে। শিশুর পরিহিত ভিজে যাওয়া ডায়াপারে থাকা ব্যাকটেরিয়ার সঙ্গে প্রস্রাবের সঙ্গে নির্গত অ্যামোনিয়া মিশে ডায়াপারে পরিহিত অংশে লাল লাল খুব জ্বালাদায়ক গোটা দেখা দেয়। সাধারণভাবে শিশু বেশিক্ষণ সময় ডায়াপার পরা থাকলে মলের জীবাণু অর্থাৎ ব্যাকটেরিয়ার উপস্থিতিতে প্রস্রাবে নির্গত অ্যামোনিয়ার সংস্পর্শের সুযোগ ঘটে। এতে শরীরের ওই অংশে ফুসকুড়ি ওঠে।
ডায়াপার র্যাশ প্রতিরোধে করণীয় হলো-
শিশুর ন্যাপকিন যত্নসহকারে ধুতে হবে। ন্যাপকিন, কাঁথা, কাপড়- এগুলো গরম পানিতে ধুয়ে রোদে শুকাতে দিতে হবে, যাতে জীবাণুমুক্ত হয়।
র্যাশ আক্রান্ত অংশটি গোসলের সাবান ও পরিষ্কার ফোটানো পানি দিয়ে ধুয়ে দিতে হবে। কখনো কখনো মলমের প্রয়োজন হতে পারে।
ব্যাকটেরিয়া বা ছত্রাকজাতীয় জীবাণুর সংক্রমণ ঘটলে বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিতে হবে।
ডায়াপার র্যাশ প্রতিরোধের সবচেয়ে ভালো উপায় হচ্ছে, বেশি সময় শিশুকে প্রস্রাবের মধ্যে ফেলে না রাখা। যথাসম্ভব প্লাস্টিকের ন্যাপকিন ব্যবহার না করে বিশোষক কাপড়ের ন্যাপকিন ব্যবহার করা উচিত। ইদানীং অবশ্য ডিসপোজেবল ডায়াপার ব্যবহার বেশি হচ্ছে, যা অসুখের ঝুঁকি কমিয়ে আনে।
ঘামাচি
গরম ও ভ্যাপসা আবহাওয়ায় শিশুরা প্রায়ই ঘামাচিতে কষ্ট পায়। বেশি ঘেমে সংশ্লিষ্ট গ্ল্যান্ডগুলোর নালিমুখ বন্ধ হওয়ার ফলে ঘামাচির সৃষ্টি হয়। সাধারণ ঘামাচি দেহের বড় অংশজুড়ে থাকে। কখনো-বা ঘামাচি লাল লাল গোটার মতো শিশুর ঘাড়ে, গলায়, পিঠে, বুকে ওঠে, যা কখনো কখনো ছত্রাকজাতীয় জীবাণুর সংক্রমণ বা চামড়ার অন্যান্য কিছু অসুখ বলে ভ্রম হতে পারে। কখনো-বা ঘামাচি পেকে গিয়ে পুঁজের আধার রূপে প্রকাশ পায়।
ঘামাচি প্রতিরোধে করণীয়—
ঘামাচি প্রতিরোধে শিশুকে যতটা সম্ভব ঠাণ্ডার মধ্যে রাখা উচিত।
নাইলনের পোশাক পরানো বা রাবার ও প্লাস্টিকের সিটের ওপর শোয়ানো যথাসম্ভব এড়িয়ে চলতে হবে।
রুমের তাপমাত্রা যাতে বেশি না থাকে, সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে।
বারবার শিশুর গা ঠাণ্ডা পানিতে মুছিয়ে দিলে ঘামাচির বেশ উপকার হয়।
হিটস্ট্রোক
অত্যধিক গরমে শিশু অসুস্থ হয়ে যায়। গরমজনিত ক্লান্তি শুরু হয় ধীরে ধীরে; কিন্তু সময়মতো ব্যবস্থা না নিলে তা স্ট্রোকে পরিণত হয়। হিটস্ট্রোকে শিশুর তাপমাত্রা ১০৫ ডিগ্রি ফারেনহাইট বা তার বেশি ছাড়িয়ে যেতে পারে। এ সময় ত্বরিত মেডিকেল ব্যবস্থাপনা না নিলে হঠাৎ মৃত্যুও ঘটতে পারে।
হিটস্ট্রোকে আক্রান্ত হলে শিশুটির তীব্র মাথাব্যথা, চোখে ঝাপসা দেখা, দ্রুত শ্বাস ও হৃৎস্পন্দন, জ্ঞান হারানো, কোমায় চলে যাওয়া, খিঁচুনি, ত্বক শুকনো, গরম, তাপমাত্রা ১০৫ ডিগ্রি ফারেনহাইট বা তার বেশি হতে পারে।
হিটস্ট্রোক হলে করণীয়—
গরমজনিত কারণে হিটস্ট্রোক হলে তাড়াতাড়ি শীতল স্থানে বা ছায়ায় নিয়ে আসুন।
শরীর থেকে কাপড়-চোপড় খুলে দিন, বাতাস করুন বা ফ্যান ছেড়ে দিন।
পায়ের দিক উঁচু করে রেখে শিশুকে শুইয়ে দিন।
জ্ঞান ঠিক থাকলে ঠাণ্ডা পানিতে শরীর মুছে দিন।
ঠাণ্ডা, পরিষ্কার, তরল বা পানীয় খেতে দিন।
শিশু যদি বমি করতে থাকে, তাকে এক পাশ করে রাখুন, যাতে বমি শ্বাসনালিতে চলে না যায়।
হিটস্ট্রোক প্রতিরোধে তৃষ্ণার্ত না থাকলেও শিশুকে গরমের দিনে প্রচুর পানি, তরল খাবার বারবার খাওয়াতে থাকুন।
শিশুর পরিধেয় বস্ত্র যাতে সুতি কাপড়ের, হালকা ও ঢিলেঢালা ধরনের হয়, সেদিকে খেয়াল রাখুন।
দিনের সবচেয়ে তপ্ত সময়ে শিশু যেন বাইরে বেশি খেলাধুলা না করে, সেটা খেয়াল রাখুন।
গরমে বেশি ক্লান্ত লাগলে ভেতরে বা ছায়ায় যাতে চলে আসে, সেটা শিশুকে শিখিয়ে দিন।
আরও যা করণীয়
গরমের সময় শিশুকে নিয়মিত গোসল করান। গোসল করানোর সময় বগল, গলা, হাঁটুর ভাঁজ ও শরীরের অন্যান্য ভাঁজযুক্ত জায়গা যত্নসহকারে পরিষ্কার করুন।
পাতলা ও সুতি কাপড় ভিজিয়ে মাঝে মধ্যে শিশুর গা মুছে দিতে পারেন।
সবসময় শিশুকে সুতি কাপড়ের জামা পরান, যাতে শরীরে সহজে বাতাস চলাচল করতে পারে।
এ সময় শিশুকে ঘরের বাইরে না নিয়ে যাওয়াই ভালো। বিশেষ করে তীব্র গরমের সময় সকাল ১০টা থেকে বিকেল ৫টা পর্যন্ত। একান্তই যদি বাইরে নিতে হয়, তাহলে মাথায় ক্যাপ পরান বা ছাতার নিচে রেখে বাইরে নিয়ে যান। মুখে সানস্ক্রিনও লাগাতে পারেন।
প্রতিদিন প্রচুর বিশুদ্ধ পানি ও তরলজাতীয় খাবার খাওয়ান। পাশাপাশি স্যালাইনের পানি, ডাবের পানি, লাচ্ছি, শরবত, ফলের রস খেতে দিন।
গরমে শরীরে কোনো প্রকার তেল মালিশ না করাই ভালো। গোসলের সময় হালকাভাবে সাবান ব্যবহার করুন। গোসলের পর হালকা ট্যালকম পাউডার লাগানো যেতে পারে।
গরমের সময় শিশুর চুল কেটে ছোট করে দিন অথবা মাথা ন্যাড়া করে দিন। এতে গরমের মধ্যেও অনেক আরামবোধ করবে।
নখ কেটে ছোট করে দিন, শিশু তাতেও অনেক অসুখ-বিসুখ থেকে রক্ষা পাবে।
অনুলিখন হৃদয় জাহান
কলি