বিজ্ঞানীরা বর্তমান সময়ে বিশ্বের পরিবেশদূষণ নিয়ে সবচেয়ে বেশি উদ্বেগে রয়েছেন। একদিকে দ্রুতহারে নগরায়ণ বৃদ্ধি, অপরদিকে ক্রমশ বনায়ন কমতে থাকায় সরাসরি প্রভাব পড়ছে পরিবেশে। পরিবর্তন হচ্ছে পৃথিবীর জলবায়ুর, প্রভাব পড়ছে বাস্তুতন্ত্রে। সবুজের পরিমাণ রক্ষা করে, সভ্যতার চলমান অগ্রগতির চাকা সচল রাখতে হবে। এই দুইয়ের ভারসাম্য কীভাবে আসবে তা নিয়ে নিরন্তর গবেষণা করছেন বিজ্ঞানীরা। এর মধ্যেই চমক দিয়েছেন সার্বিয়ার বিজ্ঞানীরা। তৈরি করেছেন তরল উদ্ভিদ বা লিকুইড ট্রি।
পূর্ব ইউরোপের দেশ সার্বিয়ার রাজধানী বেলগ্রেড অন্যতম বায়ুদূষিত একটি শহর। বায়ুদূষণ মানবস্বাস্থ্যের জন্য একটি মারাত্মক হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। এ কারণে প্রতি বছর প্রায় ৪ দশমিক ২ মিলিয়ন মানুষ মৃত্যুবরণ করেন। এই সমস্যাটি সার্বিয়াকে বিশেষভাবে ভাবিয়ে তোলে। বিভিন্ন পর্যবেক্ষণে দেখা যায়, সার্বিয়ার কমপক্ষে ৭৫ শতাংশ নাগরিক দূষিত বাতাসে শ্বাস নিয়ে থাকেন। অফিসিয়াল ওয়ার্ল্ড এয়ার কোয়ালিটি রিপোর্টগুলোয় কিছু শহরে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সুপারিশকৃত বাতাসে উপাদানের তুলনায় সাত গুণ বেশি বলে চিহ্নিত করেছে। বায়ুদূষণের মোকাবিলা করতে গিয়ে সে দেশের বিজ্ঞানীরা আবিষ্কার করেছেন তরল উদ্ভিদ। বেলগ্রেড বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউট অব মাল্টি ডিসিপ্লিন রিসার্চের গবেষক ড. ইভান প্যাসোজেভিক ও তার সহকর্মীরা ‘লিকুইড থ্রি’ উদ্ভাবন করেছেন।
ইভান প্যাসোজেভিক ও তার দল লিকুইড থ্রি এমনভাবে নকশা করেছেন, যা আধুনিক অবকাঠামোর সঙ্গে ফটোবায়োরিয়াক্টর সিস্টেমকে অনন্যভাবে একীভূত করে। এটি বেলগ্রেডের মেকডনস্কা স্ট্রিটে স্থাপন করা হয়েছে। বিভিন্ন রিপোর্ট অনুযায়ী, এটিই প্রথম আরবান ফটোবায়োরিক্টর। গ্রিনহাউস গ্যাস তৈরিতে লাগাম টেনে ধরতে ও শহরের আবহাওয়া আরও ভালো করার জন্য এটি ব্যবহার করা হচ্ছে।
এই প্রকল্পের উদ্দেশ্য হলো দূষিত শহর এলাকায় গাছের প্রতিস্থাপন করা, যেখানে সত্যিকারের সবুজ গাছ লাগানো এবং বাড়ানো সম্ভব নয়। লিকুইড থ্রি আরবান ফটোবায়োরিয়াক্টর একটি কাচের ট্যাংকে মাইক্রো এলজিতে ভরা। কাচের ট্যাংকটি একটি কাঠামোর সঙ্গে এমনভাবে যুক্ত, যা বেঞ্চ হিসেবে ব্যবহার করা যায়। এই যন্ত্রে রয়েছে ৬০০ লিটার পানি এবং বিশেষ ধরনের মাইক্রো এলজি যেটি কার্বন-ডাই-অক্সাইড বিশ্লেষণ করে অক্সিজেন উৎপাদন করে। আর এই কাজটি করে সালোকসংশ্লেষণের মাধ্যমে। ড. ইভান প্যাসোজেভিক জানিয়েছেন, এই মাইক্রো এলজি কার্বন-ডাই-অক্সাইড শোষণের ক্ষেত্রে সাধারণত ১০ থেকে ৫০ শতাংশ বেশি কার্যকর। এই সিস্টেম দুটি ১০ বছরের পুরোনো বা ২০০ বর্গমিটার ঘাসের পরিমাণ কার্বন-ডাই-অক্সাইড শুষে নিতে পারে। ফটোবায়োরিয়াক্টরগুলো দ্রুত নির্মাণ এবং ইনস্টল করা যায়। দ্রুততমভাবে দূষিত বায়ু পরিষ্কার করতে করতে পারে।
তাহলে কি লিকুইড থ্রি উদ্ভিদের জায়গা নেবে? বিজ্ঞানীরা জানাচ্ছেন এমনটা নয়, শহরে দূষিত এলাকায় যেখানে উদ্ভিদ সৃজন করা যাবে না, সেখানে কাজে আসতে পারে এই প্রকল্প।
অণুজীবগুলো বাতাস থেকে ভারী বিষাক্ত ধাতুগুলোকে ফিল্টার করার ক্ষেত্রে গাছের তুলনায় অনেক ভালো। অণুজীব সালোকসংশ্লেষণের মাধ্যমে জৈববস্তু তৈরি করে, যা বিভিন্ন ব্যবহারের জন্য পুনরায় ব্যবহার করা যেতে পারে।
লিকুইড থ্রির প্রতি ইউনিট রক্ষণাবেক্ষণের খরচ প্রতি মাসে প্রায় ৭০ ডলার। বর্তমান মডেলের সঙ্গে কয়েক বছর পরপর প্রতিস্থাপনের প্রয়োজন হতে পারে। যেহেতু ফটোবায়োরিয়াক্টরে মাইক্রো এলজি এমন একটি তাপমাত্রা পরিসীমা রয়েছে, যেখানে তারা বেঁচে থাকতে পারে। যদি খুব গরম বা খুব ঠান্ডা হয় তবে তাদের সংরক্ষণের জন্য আরও বেশি অর্থ এবং শক্তির প্রয়োজন হবে।
বেলগ্রেডের বাতাসে উপাদানের মান অত্যন্ত খারাপ। কারণ শহরের কাছে রয়েছে দুটি কয়লাচালিত শক্তি উৎপাদনকেন্দ্র। এনজিও হেলথ অ্যান্ড ইনভারমেন্ট এলায়েন্সের দাবি অনুসারে, ইউরোপের প্রথম দশটি দূষণ ছড়ানো বিদ্যুৎকেন্দ্রের মধ্যে এই দুইটি। ফলে তার প্রভাবে বায়ুদূষণ হয়েছে এই শহরে। শরৎ ও শীতকালে এই দূষণের মাত্রা ভয়াবহ হয়ে ওঠে। বিশ্বজুড়েই এই সমস্যা রয়েছে। ইনভারমেন্টাল প্যানেল অন ক্লাইমেট চেঞ্জের রিপোর্ট অনুযায়ী, ২০৩৫ সালের মধ্যে অন্তত ৬০ শতাংশ কমাতে হবে গ্রিন হাউস গ্যাস উৎপাদন।
সেই লক্ষ্যে কাজ করতে গেলে একদিকে যেমন জীবাশ্ম জ্বালানির ওপর ভরসা কমিয়ে আনতে হবে, তেমনি বন সৃজনকে গুরুত্ব দিতেই হবে। বিজ্ঞানীরা মনে করছেন এর পাশাপাশি অন্তত শহর এলাকায় দূষণমাত্রা কমাতে কাজে লাগতে পারে এমন ধরনের তরল উদ্ভিদের আবিষ্কার।
জাহ্নবী