কী করে ভুলব সেসব স্মৃতি? ২৭ মার্চ সকালে কয়েক ঘণ্টার জন্য কারফিউ তুলে নেওয়া হলে আমি খবরাখবর নেওয়ার জন্য বেরিয়ে পড়লাম। বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় ধ্বংসযজ্ঞ সবচেয়ে বেশি চালানো হয়েছে জেনে সেদিকেই গেলাম। জগন্নাথ হলের পাশে বিশ্ববিদ্যালয়ের চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীদের ব্যারাকে গিয়ে দেখি তখনো মৃতদেহ পড়ে আছে। মশারি টানানো, ঘুমন্ত মানুষকে হত্যা করা হয়েছে নির্বিচারে
মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ের ৫২ বছর পর যখন পেছন ফিরে তাকাই, তখন মনের পর্দায় ভেসে ওঠে সেসব দুঃসহ দিনের স্মৃতি। ১৯৭১-এর ২৫ মার্চ রাত ১১টার কিছু পর কোনো সতর্কীকরণ ছাড়াই শুরু হয় পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সশস্ত্র আক্রমণ ও নির্বিচার গণহত্যা। আমরা তখন করাচি থেকে এসে উঠেছি সেন্ট্রাল রোডে ফেরদৌসীদের পৈতৃক বাড়িতে। কাছ থেকেই শোনা গেল গোলাগুলির প্রচণ্ড আওয়াজ। মনে হচ্ছিল আওয়াজটা পিলখানার দিক থেকে আসছিল। একদিকে গুলির শব্দ আরেকদিকে ‘জয় বাংলা’ ধ্বনি। ক্রমশ গুলির শব্দ বাড়তে লাগল আর ‘জয় বাংলা’ ধ্বনি আস্তে আস্তে মিলিয়ে গেল। কামানের গোলায় স্তব্ধ করে দেওয়া হলো স্বাধীনতার আকুতি। মাঝেমধ্যেই অন্ধকার বিদীর্ণ করে আগুনের মতো গুলি (ট্রেসার) আমাদের বাড়ির ওপর দিয়ে এদিক-ওদিক চলে যাচ্ছিল। প্রথম দিকে আমরা সবাই দোতলার ব্যালকনিতে জমা হয়ে ঘটনা বোঝার চেষ্টা করছিলাম। কিন্তু আক্রমণ বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে আমরা নিচতলায় নিরাপদ জায়গায় আশ্রয় নিলাম, যেন গুলি এসে না লাগে। বুঝতে পারলাম, পাকিস্তান সেনাবাহিনী বাঙালিদের স্বাধিকারের আন্দোলন দমন করতে চরমপন্থা গ্রহণ করেছে। চারদিকে আগুনের শিখা দেখতে পেলাম আমরা। কেবল গুলি করেই শান্ত হয়নি পাকিস্তানি বর্বররা, আগুন লাগিয়ে দিয়ে সব ধ্বংস করতে শুরু করেছে। সব টেলিফোন সংযোগ বিচ্ছিন্ন। প্রচণ্ড শঙ্কার মধ্যে নির্ঘুম রাত কাটল। ২৬ মার্চও দিনভর থেমে থেমে গুলিগোলা চলল। শহরে কারফিউ। কোথায় কী ঘটেছে জানার উপায় নেই। রাত ৮টায় প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার বেতার ভাষণ শুনলাম। তিনি পাকিস্তানের শাসনতান্ত্রিক সংকটের জন্য শেখ মুজিবকে দায়ী করলেন, তাকে পাকিস্তানের শত্রু বলে অভিহিত করলেন। আওয়ামী লীগকে বেআইনি ঘোষণা করলেন, রাজনৈতিক কার্যকলাপ নিষিদ্ধ করা হলো। আমরা ইয়াহিয়ার বক্তৃতা শুনে হতাশ হয়ে পড়লাম।
২৭ মার্চ সকালে কয়েক ঘণ্টার জন্য কারফিউ তুলে নেওয়া হলে আমি খবরাখবর নেওয়ার জন্য বেরিয়ে পড়লাম। বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় ধ্বংসযজ্ঞ সবচেয়ে বেশি চালানো হয়েছে জেনে সেদিকেই গেলাম। জগন্নাথ হলের পাশে বিশ্ববিদ্যালয়ের চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীদের ব্যারাকে গিয়ে দেখি তখনো মৃতদেহ পড়ে আছে। মশারি টানানো, ঘুমন্ত মানুষকে হত্যা করা হয়েছে নির্বিচারে। জগন্নাথ হল আর ইকবাল হলের ওপর আক্রোশ ছিল বেশি, তাই আক্রমণের প্রধান লক্ষ্য ছিল এ দুটি ছাত্রাবাস।
আমাদের জগন্নাথ হলের প্রভোস্ট অজাতশত্রু দার্শনিক ড. গোবিন্দ চন্দ্র দেব ও আরও কয়েকজন অধ্যাপককে হত্যা করা হয়েছে শুনলাম। বেশিক্ষণ সেখানে দাঁড়াবার সময় পেলাম না। মুনীর ভাই সপরিবারে বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাস থেকে সেন্ট্রাল রোডের বাড়িতে চলে এলেন। ঢাকা শহরজুড়ে মানুষ যেন কেবল ছুটছে। অনেকেই পরিবার-পরিজন নিয়ে শহর ছেড়ে তার গ্রামের দিকে যাচ্ছেন। অনেকে চলেছেন অজানা গন্তব্যের দিকে। কারণ ঢাকায় থাকা আর নিরাপদ নয়।
প্রতিদিনই নতুন নতুন ধ্বংসযজ্ঞের খবর পাওয়া যাচ্ছে। প্রতিরাতেই গোলাগুলির শব্দ। কর্মহীন বসে আছি আমি। নিরাপত্তার জন্য বিটপির এক আইডেনটিটি কার্ড সঙ্গে রাখি। আমি আর আমার বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের বন্ধু আবু তালেব প্রায় রোজই সকালে একসঙ্গে বেরিয়ে তদানীন্তন জিন্নাহ এভিনিউর রেক্স রেস্তোরাঁয় বসে পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা করি, খবরাখবর সংগ্রহের চেষ্টা করি। রাতে নিচু আওয়াজে আকাশবাণী ও বিবিসি থেকে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের খবর শুনি। পরে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র চালু হলে তার সব অনুষ্ঠান বিপুল আগ্রহের সঙ্গে সবাই মিলে শুনি। এদিকে আমাকে নিয়ে সবাই খুব চিন্তিত। আমার ঢাকায় থাকা মোটেই নিরাপদ নয়। তবে কেন জানি না, আমার কিন্তু তখন ততটা ভয় করত না। হয়তো সব খবর জানতাম না বলে।
করাচি ছাড়ার পর থেকে কলকাতায় বাবা-মার সঙ্গে কোনো যোগাযোগ নেই। বাবা-মা হয়তো ভাবছেন আমি করাচিতেই আছি। অসহযোগ আন্দোলনের সময় ডাক যোগাযোগ বন্ধ থাকায় খবর দিতে পারিনি। ভারতে যাওয়ার কোনো সহজ পথও খুঁজে পাচ্ছি না। আমি একা হলে যে কোনোভাবে যেতে পারতাম, কিন্তু ফেরদৌসীকে নিয়ে কীভাবে যাব! তবে আমার নিরাপত্তার কথা ভেবে ফেরদৌসীই জেদ ধরল যেভাবেই হোক সীমান্ত পাড়ি দিতে হবে। বিয়ের পর বাবা-মার সঙ্গে আমাদের দেখা হয়নি। ওর মনে হলো, কিছু একটা ঘটে গেলে বাবা-মা ওকেই দায়ী করবেন। শেষ পর্যন্ত একটা পথ খুঁজে পাওয়া গেল। বিটপির রেজা ভাই-ই ব্যবস্থা করে দিলেন। ৯ মে ভোরে রেজা ভাই তার ভক্সওয়াগন গাড়িতে করে আমাদের পাঁচজনকে দাউদকান্দির কাছে বড় রাস্তার পাশে নামিয়ে দিয়ে এলেন। দলে আমি আর ফেরদৌসী ছাড়া ফেরদৌসীর খালাত ভাই আবদুল হালিম, তার স্ত্রী ও ছোট ছেলে এবং বেনজীর আহমদ (সাংবাদিক)।
নির্দিষ্ট জায়গায় ছাত্র ইউনিয়নের এক কর্মী ছিলেন, তিনিই আমাদের গাইড। আমরা রাস্তার পাশে খালে এক নৌকায় গিয়ে উঠলাম। ২০ মাইল রাস্তা নৌকা, রিকশা আর পায়ে হেঁটে সন্ধ্যায় চান্দিনার কাছে সীমান্তবর্তী গ্রাম বসন্তপুরে এসে এক বাড়িতে উঠি। গৃহকর্তার নাম মমতাজ, যারা এ পথে সীমান্ত পাড়ি দেন, তাদের আশ্রয় দেন, পরম যত্নে খাওয়ার ব্যবস্থা করেন। এ পরিবারের আন্তরিকতা ও উপকারের প্রতিদান কোনো দিন দিতে পারব না, আর তারা প্রতিদানের অপেক্ষাও করেননি। আমাদের মুক্তিযুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধারা অস্ত্র হাতে লড়াই করেছেন সত্যি, কিন্তু সেই সঙ্গে মমতাজের মতো সাধারণ মানুষরা মুক্তিযোদ্ধাদের নানাভাবে সহায়তা করেছেন। তারাও তো বৃহত্তর অর্থে মুক্তিযোদ্ধা।
আমরা যে সময়ে সীমান্ত পার হচ্ছিলাম, তখনো সব জায়গায় রাজাকার সংগঠিত হয়নি। তাই অনেকটা বাধাহীনভাবে আমরা সীমান্তে পৌঁছাতে পেরেছিলাম। রাতে বসন্তপুর গ্রামে মমতাজের বাড়িতে মাটির ঘরে আমাদের শোবার ব্যবস্থা হয়েছিল। হঠাৎ মাঝরাতে শুরু হলো প্রচণ্ড গোলাগুলি। গোলার শব্দে ঘর কেঁপে উঠছিল। এত কাছ থেকে গুলির শব্দ আগে কোনোদিন শুনিনি। ভাবলাম, এতটা পথ পাড়ি দিয়ে শেষ পর্যন্ত এভাবে বেঘোরে প্রাণ বিসর্জন দিতে হবে! বাড়ির মানুষ অভয় দিলেন, এটা মুক্তিযোদ্ধাদের আক্রমণ শত্রুসেনাদের ওপর। কী যে ভয় পেয়েছিলাম সে রাতে!
ভোরবেলা ধানখেত, বাগান আর গ্রামের পথ দিয়ে দুই মাইল হেঁটে পাকিস্তান সীমান্ত পেরিয়ে ভারতের ত্রিপুরায় পা দিলাম। সবাই নিশ্চিন্ত হলাম, শেষ পর্যন্ত নিরাপদ জায়গায় এসে পৌঁছাতে পেরেছি। সোনামুড়ায় দেখা কলেজে আমার সহপাঠী কুমিল্লার অশোক দাসগুপ্তের (জনা) সঙ্গে। ও মুক্তিবাহিনীতে যোগ দিয়েছে। ওর বাবা-ভাইকে পাকিস্তানিরা হত্যা করেছে। তাই প্রতিশোধের আগুনে ও জ্বলছে। ওর সঙ্গে ছিল ক্যাপ্টেন কবীর, সেনাবাহিনীতে ফেরদৌসীর ছোট ভাই খোকার সমসাময়িক। ওরা জিপে করে আমাদের আগরতলা পৌঁছে দিল। সেখানে দেখা হলো মেজর মীর শওকতের সঙ্গে। কুমিল্লায় থাকাকালীন তাকে দেখেছিলাম। তিনি অবশ্য সঙ্গত কারণেই তার আসল পরিচয় প্রকাশ করলেন না।
আগরতলা এসে প্রচুর চেনা-পরিচিত লোকের দেখা পেলাম। আমরা উঠেছি অঞ্জনা হোটেলে। আমাদের স্নেহভাজন তুহিনের সঙ্গে দেখা হয়ে গেল। দেখা হলো আমার পিসতুতো ভাই শম্ভুর সঙ্গে। শম্ভু ও তার এক বন্ধু মিলে আমাদের জন্য চমৎকার একটা থাকার জায়গার ব্যবস্থা করে দিল। হকার্স কর্নারের ভেতর এক দোকানের ওপর টিনের দোতলায় আমাদের জন্য এই ঘর পাওয়া গেল। সুন্দর পরিষ্কার বিছানা, নতুন মশারি, হোটেলের তুলনায় স্বর্গ বলতে হবে। খেতে যাই সামনের ও. কে. হোটেলে। বাড়িওয়ালার আন্তরিকতা ও সহানুভূতির কথা কখনো ভুলব না। আগরতলা এসেই কলকাতায় বাবা-মাকে টেলিগ্রাম করে জানিয়েছি যে আমরা নিরাপদে আগরতলা এসে পৌঁছেছি। শিগগিরই কলকাতা আসব। বাবা-মা যে কতটা চিন্তামুক্ত হয়েছেন, তা সহজেই অনুমান করতে পারি। কিন্তু আগরতলা থেকে বিমানে কলকাতা যাওয়ার টিকিট পাওয়া ছিল রীতিমতো দুঃসাধ্য ব্যাপার, কারণ ফ্লাইটের তুলনায় যাত্রীর চাপ অনেক বেশি। ক্যাপ্টেন হায়দার সরকারিভাবে আমাদের জন্য চেষ্টা করে অবশেষে ১৩ মে-র দুটো টিকিটের ব্যবস্থা করলেন। আমরা যখন ঢাকা থেকে বেরোই তখন আমাদের সঙ্গে ছিল পাকিস্তানি ৯০০ টাকা, সেটা সীমান্তে বদল করে ভারতীয় টাকায় তার চেয়ে বেশি পাওয়া গিয়েছিল।
১৩ মে রাতে আমরা কালকাতা এসে পৌঁছলাম। বাবা-মা থাকতেন দাদার কাছে কলকাতার উপকণ্ঠে নরেন্দ্রপুর রামকৃষ্ণ মিশন স্টাফ কোয়ার্টার্সে। গড়িয়া থেকে বাসে যেতে মিনিট বিশেক লাগে। এই প্রথম ফেরদৌসীকে নিয়ে বাবা-মার কাছে যাচ্ছি। কেমনভাবে তারা ওকে গ্রহণ করেন, তা নিয়ে একটু ভয়ও ছিল। তাছাড়া এতদিন আমাদের কোনো খবর না পেয়ে তারা যে উৎকণ্ঠায় ছিলেন, আজ সামনে পেয়ে তার প্রকাশ কেমন হবে। বাবা-মা আশাতীত আন্তরিকতার সঙ্গে ফেরদৌসীকে গ্রহণ করলেন। পরদিনই আমি আর ফেরদৌসী গেলাম কলকাতায় বাংলাদেশ মিশনে। ইতোমধ্যে ১৭ এপ্রিল মুজিবনগরে আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলাদেশের অস্থায়ী সরকার গঠিত হয়েছে। সে খবর আমরা ঢাকা থাকতেই বেতারে শুনেছি। সৈয়দ নজরুল ইসলাম হয়েছেন অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি আর তাজউদ্দিন আহমদ প্রধানমন্ত্রী। পরদিন ১৮ এপ্রিল কলকাতাস্থ পাকিস্তান ডেপুটি হাইকমিশনার হোসেন আলীসহ মিশনের ৬৫ জন কর্মকর্তা-কর্মচারী বাংলাদেশের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করে সেখানেই বাংলাদেশ মিশন স্থাপন করেছেন। ফলে প্রথমদিকে পার্ক সার্কাস এলাকায় এ বাংলাদেশ মিশনই মুক্তিযুদ্ধের প্রকাশ্য কর্মকাণ্ডের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছিল।
বাংলাদেশ মিশনে গিয়ে বাংলাদেশের অনেক বন্ধুবান্ধবের সঙ্গে দেখা হলো। আমাদের বন্ধু আনোয়ারুল করিম চৌধুরী (জয়) তখন কলকাতা মিশনে প্রথম সচিব হিসেবে কর্মরত ছিলেন। তার অফিস ও বাসা হয়ে উঠল আমাদের বন্ধুদের যোগাযোগ কেন্দ্র। দেখা হলো, সৈয়দ হাসান ইমাম, আমিনুল হক বাদশার সঙ্গেও। প্রতিদিনই দেখছি, নতুন কে এলো।
কলকাতা পৌঁছার পর থেকে আমি চেষ্টা করতে থাকি কী করে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের সঙ্গে যুক্ত হতে পারি। আমার পক্ষে সরাসরি যুদ্ধে যাওয়া সম্ভব ছিল না। কারণ আমি সবে ফেরদৌসীকে নিয়ে এখানে এসেছি। নতুন পরিবেশে ওকে একা ফেলে যাওয়ার কথা ভাবতে পারছিলাম না। তাছাড়া মা যেভাবে আমার জন্য সবসময় চিন্তা করেন, তার বন্ধন কাটিয়েও যাওয়া রীতিমতো অসম্ভব। তবে আমি যদি একা থাকতাম, কোনোরকম পারিবারিক পিছুটান না থাকত, তবে নিশ্চয়ই মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে কোনো না কোনোভাবে সরাসরি জড়িত হতাম। মানুষের জীবনে এমন সুযোগ কমই আসে। সে জন্যই হয়তো হেলাল হাফিজ অসাধারণ সেই পঙক্তিটি রচনা করেছিলেন, ‘এখন যৌবন যার যুদ্ধে যাবার তার শ্রেষ্ঠ সময়।’
আমি ভাবলাম, আমার জন্য আদর্শ কাজ হবে স্বাধীন বাংলা বেতারে যোগ দেওয়া। কলকাতা বাংলাদেশ মিশনে বন্ধুবর আমিনুল হক বাদশার সঙ্গে দেখা হতেই আমার আগ্রহের কথা জানালাম। বাদশা চেষ্টা করে দেখবে বলল। তারপর ধরলাম হাসান ভাইকে (সৈয়দ হাসান ইমাম)। হাসান ভাই ইতোমধ্যে অন্য নামে খবর পড়ছেন। আমাকে তিনি জিজ্ঞেস করলেন, আমি নিজের নামে খবর পড়তে পারব কি না। নোয়াখালীতে তখনো আমার কাকা-কাকিমা ছিলেন আর ঢাকায় ফেরদৌসীর সব ভাইবোন। তাদের নিরাপত্তার কথা ভেবে আমি নিজের নামে খবর পড়তে রাজি হলাম না। আমি নিরাপদ জায়গায় এসে পৌঁছেছি। কিন্তু আমার এখনকার কোনো কাজের জন্য আমার স্বজনদের বিপদগ্রস্ত করতে পারি না। আমি বললাম, প্রায় সবাই তো নিজের আসল পরিচয় গোপন করে ভিন্ন নামে অনুষ্ঠান করছে। যাই হোক, স্বাধীন বাংলা বেতারে ঢোকার কোনো পথ করা গেল না। পরে অবশ্য এখানে কয়েকটি অনুষ্ঠানে অংশ নিয়েছি।
আমি আর কী করতে পারি? হঠাৎ মাথায় এলো বঙ্গবন্ধুর বক্তৃতা-বিবৃতির একটা সংকলন করলে কেমন হয়? একটা সময় ধরে তার বক্তৃতা-বিবৃতির মধ্য দিয়ে যদি স্বাধীনতার পথে যাত্রাটা দেখানো যায়, তবে একটা কাজ হয়। কলকাতা বাংলাদেশ মিশনে ঢাকা ও করাচির পুরনো পত্রপত্রিকার ফাইল ছিল। জয় ভাই (আনোয়ারুল করিম চৌধুরী) প্রেস বিভাগের মকসুদ আলী সাহেবকে বলে দিলেন আমাকে পুরনো পত্রপত্রিকা দেখার সুযোগ দেওয়ার জন্য। সঙ্গে সঙ্গে কাজে লেগে পড়লাম। সময় বেছে নিলাম ১৯৭০-এর অক্টোবরে বেতার-টিভিতে নির্বাচনী বক্তৃতা থেকে ১৯৭১-এর ২৬ মার্চের স্বাধীনতা ঘোষণা পর্যন্ত। আমি আর ফেরদৌসী প্রায় রোজই মিশনে এসে পত্রিকার ফাইল দেখে দেখে একই বক্তৃতার উদ্ধৃতি বিভিন্ন কাগজ থেকে সংগ্রহ করে কপি করি। এ কাজে ফেরদৌসী আমাকে অনেক সাহায্য করেছে। সব বক্তৃতা-বিবৃতির আগে ঘটনাপ্রবাহ উল্লেখ করে টীকা সংযোজন করলাম যাতে আন্দোলনের একটা ধারাবাহিক ইতিহাস পাওয়া যায়। বহুল প্রচারের লক্ষ্যে ইংরেজিতেই গ্রন্থটি সংকলন করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম। দিল্লির ওরিয়েন্ট লংম্যান থেকে ‘Bangladesh My Bangladesh’ নামে বইটি প্রকাশিত হয়েছিল।
লেখক: নাট্যব্যক্তিত্ব