কী করে ভুলব সেসব স্মৃতি? । খবরের কাগজ
ঢাকা ৬ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১, সোমবার, ২০ মে ২০২৪

কী করে ভুলব সেসব স্মৃতি?

প্রকাশ: ১৬ ডিসেম্বর ২০২৩, ১১:৩১ এএম
কী করে ভুলব সেসব স্মৃতি?

কী করে ভুলব সেসব স্মৃতি? ২৭ মার্চ সকালে কয়েক ঘণ্টার জন্য কারফিউ তুলে নেওয়া হলে আমি খবরাখবর নেওয়ার জন্য বেরিয়ে পড়লাম। বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় ধ্বংসযজ্ঞ সবচেয়ে বেশি চালানো হয়েছে জেনে সেদিকেই গেলাম। জগন্নাথ হলের পাশে বিশ্ববিদ্যালয়ের চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীদের ব্যারাকে গিয়ে দেখি তখনো মৃতদেহ পড়ে আছে। মশারি টানানো, ঘুমন্ত মানুষকে হত্যা করা হয়েছে নির্বিচারে

মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ের ৫২ বছর পর যখন পেছন ফিরে তাকাই, তখন মনের পর্দায় ভেসে ওঠে সেসব দুঃসহ দিনের স্মৃতি। ১৯৭১-এর ২৫ মার্চ রাত ১১টার কিছু পর কোনো সতর্কীকরণ ছাড়াই শুরু হয় পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সশস্ত্র আক্রমণ ও নির্বিচার গণহত্যা। আমরা তখন করাচি থেকে এসে উঠেছি সেন্ট্রাল রোডে ফেরদৌসীদের পৈতৃক বাড়িতে। কাছ থেকেই শোনা গেল গোলাগুলির প্রচণ্ড আওয়াজ। মনে হচ্ছিল আওয়াজটা পিলখানার দিক থেকে আসছিল। একদিকে গুলির শব্দ আরেকদিকে ‘জয় বাংলা’ ধ্বনি। ক্রমশ গুলির শব্দ বাড়তে লাগল আর ‘জয় বাংলা’ ধ্বনি আস্তে আস্তে মিলিয়ে গেল। কামানের গোলায় স্তব্ধ করে দেওয়া হলো স্বাধীনতার আকুতি। মাঝেমধ্যেই অন্ধকার বিদীর্ণ করে আগুনের মতো গুলি (ট্রেসার) আমাদের বাড়ির ওপর দিয়ে এদিক-ওদিক চলে যাচ্ছিল। প্রথম দিকে আমরা সবাই দোতলার ব্যালকনিতে জমা হয়ে ঘটনা বোঝার চেষ্টা করছিলাম। কিন্তু আক্রমণ বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে আমরা নিচতলায় নিরাপদ জায়গায় আশ্রয় নিলাম, যেন গুলি এসে না লাগে। বুঝতে পারলাম, পাকিস্তান সেনাবাহিনী বাঙালিদের স্বাধিকারের আন্দোলন দমন করতে চরমপন্থা গ্রহণ করেছে। চারদিকে আগুনের শিখা দেখতে পেলাম আমরা। কেবল গুলি করেই শান্ত হয়নি পাকিস্তানি বর্বররা, আগুন লাগিয়ে দিয়ে সব ধ্বংস করতে শুরু করেছে। সব টেলিফোন সংযোগ বিচ্ছিন্ন। প্রচণ্ড শঙ্কার মধ্যে নির্ঘুম রাত কাটল। ২৬ মার্চও দিনভর থেমে থেমে গুলিগোলা চলল। শহরে কারফিউ। কোথায় কী ঘটেছে জানার উপায় নেই। রাত ৮টায় প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার বেতার ভাষণ শুনলাম। তিনি পাকিস্তানের শাসনতান্ত্রিক সংকটের জন্য শেখ মুজিবকে দায়ী করলেন, তাকে পাকিস্তানের শত্রু বলে অভিহিত করলেন। আওয়ামী লীগকে বেআইনি ঘোষণা করলেন, রাজনৈতিক কার্যকলাপ নিষিদ্ধ করা হলো। আমরা ইয়াহিয়ার বক্তৃতা শুনে হতাশ হয়ে পড়লাম।

২৭ মার্চ সকালে কয়েক ঘণ্টার জন্য কারফিউ তুলে নেওয়া হলে আমি খবরাখবর নেওয়ার জন্য বেরিয়ে পড়লাম। বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় ধ্বংসযজ্ঞ সবচেয়ে বেশি চালানো হয়েছে জেনে সেদিকেই গেলাম। জগন্নাথ হলের পাশে বিশ্ববিদ্যালয়ের চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীদের ব্যারাকে গিয়ে দেখি তখনো মৃতদেহ পড়ে আছে। মশারি টানানো, ঘুমন্ত মানুষকে হত্যা করা হয়েছে নির্বিচারে। জগন্নাথ হল আর ইকবাল হলের ওপর আক্রোশ ছিল বেশি, তাই আক্রমণের প্রধান লক্ষ্য ছিল এ দুটি ছাত্রাবাস।

আমাদের জগন্নাথ হলের প্রভোস্ট অজাতশত্রু দার্শনিক ড. গোবিন্দ চন্দ্র দেব ও আরও কয়েকজন অধ্যাপককে হত্যা করা হয়েছে শুনলাম। বেশিক্ষণ সেখানে দাঁড়াবার সময় পেলাম না। মুনীর ভাই সপরিবারে বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাস থেকে সেন্ট্রাল রোডের বাড়িতে চলে এলেন। ঢাকা শহরজুড়ে মানুষ যেন কেবল ছুটছে। অনেকেই পরিবার-পরিজন নিয়ে শহর ছেড়ে তার গ্রামের দিকে যাচ্ছেন। অনেকে চলেছেন অজানা গন্তব্যের দিকে। কারণ ঢাকায় থাকা আর নিরাপদ নয়।

প্রতিদিনই নতুন নতুন ধ্বংসযজ্ঞের খবর পাওয়া যাচ্ছে। প্রতিরাতেই গোলাগুলির শব্দ। কর্মহীন বসে আছি আমি। নিরাপত্তার জন্য বিটপির এক আইডেনটিটি কার্ড সঙ্গে রাখি। আমি আর আমার বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের বন্ধু আবু তালেব প্রায় রোজই সকালে একসঙ্গে বেরিয়ে তদানীন্তন জিন্নাহ এভিনিউর রেক্স রেস্তোরাঁয় বসে পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা করি, খবরাখবর সংগ্রহের চেষ্টা করি। রাতে নিচু আওয়াজে আকাশবাণী ও বিবিসি থেকে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের খবর শুনি। পরে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র চালু হলে তার সব অনুষ্ঠান বিপুল আগ্রহের সঙ্গে সবাই মিলে শুনি। এদিকে আমাকে নিয়ে সবাই খুব চিন্তিত। আমার ঢাকায় থাকা মোটেই নিরাপদ নয়। তবে কেন জানি না, আমার কিন্তু তখন ততটা ভয় করত না। হয়তো সব খবর জানতাম না বলে। 

করাচি ছাড়ার পর থেকে কলকাতায় বাবা-মার সঙ্গে কোনো যোগাযোগ নেই। বাবা-মা হয়তো ভাবছেন আমি করাচিতেই আছি। অসহযোগ আন্দোলনের সময় ডাক যোগাযোগ বন্ধ থাকায় খবর দিতে পারিনি। ভারতে যাওয়ার কোনো সহজ পথও খুঁজে পাচ্ছি না। আমি একা হলে যে কোনোভাবে যেতে পারতাম, কিন্তু ফেরদৌসীকে নিয়ে কীভাবে যাব! তবে আমার নিরাপত্তার কথা ভেবে ফেরদৌসীই জেদ ধরল যেভাবেই হোক সীমান্ত পাড়ি দিতে হবে। বিয়ের পর বাবা-মার সঙ্গে আমাদের দেখা হয়নি। ওর মনে হলো, কিছু একটা ঘটে গেলে বাবা-মা ওকেই দায়ী করবেন। শেষ পর্যন্ত একটা পথ খুঁজে পাওয়া গেল। বিটপির রেজা ভাই-ই ব্যবস্থা করে দিলেন। ৯ মে ভোরে রেজা ভাই তার ভক্সওয়াগন গাড়িতে করে আমাদের পাঁচজনকে দাউদকান্দির কাছে বড় রাস্তার পাশে নামিয়ে দিয়ে এলেন। দলে আমি আর ফেরদৌসী ছাড়া ফেরদৌসীর খালাত ভাই আবদুল হালিম, তার স্ত্রী ও ছোট ছেলে এবং বেনজীর আহমদ (সাংবাদিক)। 

নির্দিষ্ট জায়গায় ছাত্র ইউনিয়নের এক কর্মী ছিলেন, তিনিই আমাদের গাইড। আমরা রাস্তার পাশে খালে এক নৌকায় গিয়ে উঠলাম। ২০ মাইল রাস্তা নৌকা, রিকশা আর পায়ে হেঁটে সন্ধ্যায় চান্দিনার কাছে সীমান্তবর্তী গ্রাম বসন্তপুরে এসে এক বাড়িতে উঠি। গৃহকর্তার নাম মমতাজ, যারা এ পথে সীমান্ত পাড়ি দেন, তাদের আশ্রয় দেন, পরম যত্নে খাওয়ার ব্যবস্থা করেন। এ পরিবারের আন্তরিকতা ও উপকারের প্রতিদান কোনো দিন দিতে পারব না, আর তারা প্রতিদানের অপেক্ষাও করেননি। আমাদের মুক্তিযুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধারা অস্ত্র হাতে লড়াই করেছেন সত্যি, কিন্তু সেই সঙ্গে মমতাজের মতো সাধারণ মানুষরা মুক্তিযোদ্ধাদের নানাভাবে সহায়তা করেছেন। তারাও তো বৃহত্তর অর্থে মুক্তিযোদ্ধা।

আমরা যে সময়ে সীমান্ত পার হচ্ছিলাম, তখনো সব জায়গায় রাজাকার সংগঠিত হয়নি। তাই অনেকটা বাধাহীনভাবে আমরা সীমান্তে পৌঁছাতে পেরেছিলাম। রাতে বসন্তপুর গ্রামে মমতাজের বাড়িতে মাটির ঘরে আমাদের শোবার ব্যবস্থা হয়েছিল। হঠাৎ মাঝরাতে শুরু হলো প্রচণ্ড গোলাগুলি। গোলার শব্দে ঘর কেঁপে উঠছিল। এত কাছ থেকে গুলির শব্দ আগে কোনোদিন শুনিনি। ভাবলাম, এতটা পথ পাড়ি দিয়ে শেষ পর্যন্ত এভাবে বেঘোরে প্রাণ বিসর্জন দিতে হবে! বাড়ির মানুষ অভয় দিলেন, এটা মুক্তিযোদ্ধাদের আক্রমণ শত্রুসেনাদের ওপর। কী যে ভয় পেয়েছিলাম সে রাতে!

ভোরবেলা ধানখেত, বাগান আর গ্রামের পথ দিয়ে দুই মাইল হেঁটে পাকিস্তান সীমান্ত পেরিয়ে ভারতের ত্রিপুরায় পা দিলাম। সবাই নিশ্চিন্ত হলাম, শেষ পর্যন্ত নিরাপদ জায়গায় এসে পৌঁছাতে পেরেছি। সোনামুড়ায় দেখা কলেজে আমার সহপাঠী কুমিল্লার অশোক দাসগুপ্তের (জনা) সঙ্গে। ও মুক্তিবাহিনীতে যোগ দিয়েছে। ওর বাবা-ভাইকে পাকিস্তানিরা হত্যা করেছে। তাই প্রতিশোধের আগুনে ও জ্বলছে। ওর সঙ্গে ছিল ক্যাপ্টেন কবীর, সেনাবাহিনীতে ফেরদৌসীর ছোট ভাই খোকার সমসাময়িক। ওরা জিপে করে আমাদের আগরতলা পৌঁছে দিল। সেখানে দেখা হলো মেজর মীর শওকতের সঙ্গে। কুমিল্লায় থাকাকালীন তাকে দেখেছিলাম। তিনি অবশ্য সঙ্গত কারণেই তার আসল পরিচয় প্রকাশ করলেন না।

আগরতলা এসে প্রচুর চেনা-পরিচিত লোকের দেখা পেলাম। আমরা উঠেছি অঞ্জনা হোটেলে। আমাদের স্নেহভাজন তুহিনের সঙ্গে দেখা হয়ে গেল। দেখা হলো আমার পিসতুতো ভাই শম্ভুর সঙ্গে। শম্ভু ও তার এক বন্ধু মিলে আমাদের জন্য চমৎকার একটা থাকার জায়গার ব্যবস্থা করে দিল। হকার্স কর্নারের ভেতর এক দোকানের ওপর টিনের দোতলায় আমাদের জন্য এই ঘর পাওয়া গেল। সুন্দর পরিষ্কার বিছানা, নতুন মশারি, হোটেলের তুলনায় স্বর্গ বলতে হবে। খেতে যাই সামনের ও. কে. হোটেলে। বাড়িওয়ালার আন্তরিকতা ও সহানুভূতির কথা কখনো ভুলব না। আগরতলা এসেই কলকাতায় বাবা-মাকে টেলিগ্রাম করে জানিয়েছি যে আমরা নিরাপদে আগরতলা এসে পৌঁছেছি। শিগগিরই কলকাতা আসব। বাবা-মা যে কতটা চিন্তামুক্ত হয়েছেন, তা সহজেই অনুমান করতে পারি। কিন্তু আগরতলা থেকে বিমানে কলকাতা যাওয়ার টিকিট পাওয়া ছিল রীতিমতো দুঃসাধ্য ব্যাপার, কারণ ফ্লাইটের তুলনায় যাত্রীর চাপ অনেক বেশি। ক্যাপ্টেন হায়দার সরকারিভাবে আমাদের জন্য চেষ্টা করে অবশেষে ১৩ মে-র দুটো টিকিটের ব্যবস্থা করলেন। আমরা যখন ঢাকা থেকে বেরোই তখন আমাদের সঙ্গে ছিল পাকিস্তানি ৯০০ টাকা, সেটা সীমান্তে বদল করে ভারতীয় টাকায় তার চেয়ে বেশি পাওয়া গিয়েছিল।

১৩ মে রাতে আমরা কালকাতা এসে পৌঁছলাম। বাবা-মা থাকতেন দাদার কাছে কলকাতার উপকণ্ঠে নরেন্দ্রপুর রামকৃষ্ণ মিশন স্টাফ কোয়ার্টার্সে। গড়িয়া থেকে বাসে যেতে মিনিট বিশেক লাগে। এই প্রথম ফেরদৌসীকে নিয়ে বাবা-মার কাছে যাচ্ছি। কেমনভাবে তারা ওকে গ্রহণ করেন, তা নিয়ে একটু ভয়ও ছিল। তাছাড়া এতদিন আমাদের কোনো খবর না পেয়ে তারা যে উৎকণ্ঠায় ছিলেন, আজ সামনে পেয়ে তার প্রকাশ কেমন হবে। বাবা-মা আশাতীত আন্তরিকতার সঙ্গে ফেরদৌসীকে গ্রহণ করলেন। পরদিনই আমি আর ফেরদৌসী গেলাম কলকাতায় বাংলাদেশ মিশনে। ইতোমধ্যে ১৭ এপ্রিল মুজিবনগরে আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলাদেশের অস্থায়ী সরকার গঠিত হয়েছে। সে খবর আমরা ঢাকা থাকতেই বেতারে শুনেছি। সৈয়দ নজরুল ইসলাম হয়েছেন অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি আর তাজউদ্দিন আহমদ প্রধানমন্ত্রী। পরদিন ১৮ এপ্রিল কলকাতাস্থ পাকিস্তান ডেপুটি হাইকমিশনার হোসেন আলীসহ মিশনের ৬৫ জন কর্মকর্তা-কর্মচারী বাংলাদেশের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করে সেখানেই বাংলাদেশ মিশন স্থাপন করেছেন। ফলে প্রথমদিকে পার্ক সার্কাস এলাকায় এ বাংলাদেশ মিশনই মুক্তিযুদ্ধের প্রকাশ্য কর্মকাণ্ডের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছিল।

বাংলাদেশ মিশনে গিয়ে বাংলাদেশের অনেক বন্ধুবান্ধবের সঙ্গে দেখা হলো। আমাদের বন্ধু আনোয়ারুল করিম চৌধুরী (জয়) তখন কলকাতা মিশনে প্রথম সচিব হিসেবে কর্মরত ছিলেন। তার অফিস ও বাসা হয়ে উঠল আমাদের বন্ধুদের যোগাযোগ কেন্দ্র। দেখা হলো, সৈয়দ হাসান ইমাম, আমিনুল হক বাদশার সঙ্গেও। প্রতিদিনই দেখছি, নতুন কে এলো।

কলকাতা পৌঁছার পর থেকে আমি চেষ্টা করতে থাকি কী করে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের সঙ্গে যুক্ত হতে পারি। আমার পক্ষে সরাসরি যুদ্ধে যাওয়া সম্ভব ছিল না। কারণ আমি সবে ফেরদৌসীকে নিয়ে এখানে এসেছি। নতুন পরিবেশে ওকে একা ফেলে যাওয়ার কথা ভাবতে পারছিলাম না। তাছাড়া মা যেভাবে আমার জন্য সবসময় চিন্তা করেন, তার বন্ধন কাটিয়েও যাওয়া রীতিমতো অসম্ভব। তবে আমি যদি একা থাকতাম, কোনোরকম পারিবারিক পিছুটান না থাকত, তবে নিশ্চয়ই মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে কোনো না কোনোভাবে সরাসরি জড়িত হতাম। মানুষের জীবনে এমন সুযোগ কমই আসে। সে জন্যই হয়তো হেলাল হাফিজ অসাধারণ সেই পঙক্তিটি রচনা করেছিলেন, ‘এখন যৌবন যার যুদ্ধে যাবার তার শ্রেষ্ঠ সময়।’

আমি ভাবলাম, আমার জন্য আদর্শ কাজ হবে স্বাধীন বাংলা বেতারে যোগ দেওয়া। কলকাতা বাংলাদেশ মিশনে বন্ধুবর আমিনুল হক বাদশার সঙ্গে দেখা হতেই আমার আগ্রহের কথা জানালাম। বাদশা চেষ্টা করে দেখবে বলল। তারপর ধরলাম হাসান ভাইকে (সৈয়দ হাসান ইমাম)। হাসান ভাই ইতোমধ্যে অন্য নামে খবর পড়ছেন। আমাকে তিনি জিজ্ঞেস করলেন, আমি নিজের নামে খবর পড়তে পারব কি না। নোয়াখালীতে তখনো আমার কাকা-কাকিমা ছিলেন আর ঢাকায় ফেরদৌসীর সব ভাইবোন। তাদের নিরাপত্তার কথা ভেবে আমি নিজের নামে খবর পড়তে রাজি হলাম না। আমি নিরাপদ জায়গায় এসে পৌঁছেছি। কিন্তু আমার এখনকার কোনো কাজের জন্য আমার স্বজনদের বিপদগ্রস্ত করতে পারি না। আমি বললাম, প্রায় সবাই তো নিজের আসল পরিচয় গোপন করে ভিন্ন নামে অনুষ্ঠান করছে। যাই হোক, স্বাধীন বাংলা বেতারে ঢোকার কোনো পথ করা গেল না। পরে অবশ্য এখানে কয়েকটি অনুষ্ঠানে অংশ নিয়েছি।

আমি আর কী করতে পারি? হঠাৎ মাথায় এলো বঙ্গবন্ধুর বক্তৃতা-বিবৃতির একটা সংকলন করলে কেমন হয়? একটা সময় ধরে তার বক্তৃতা-বিবৃতির মধ্য দিয়ে যদি স্বাধীনতার পথে যাত্রাটা দেখানো যায়, তবে একটা কাজ হয়। কলকাতা বাংলাদেশ মিশনে ঢাকা ও করাচির পুরনো পত্রপত্রিকার ফাইল ছিল। জয় ভাই (আনোয়ারুল করিম চৌধুরী) প্রেস বিভাগের মকসুদ আলী সাহেবকে বলে দিলেন আমাকে পুরনো পত্রপত্রিকা দেখার সুযোগ দেওয়ার জন্য। সঙ্গে সঙ্গে কাজে লেগে পড়লাম। সময় বেছে নিলাম ১৯৭০-এর অক্টোবরে বেতার-টিভিতে নির্বাচনী বক্তৃতা থেকে ১৯৭১-এর ২৬ মার্চের স্বাধীনতা ঘোষণা পর্যন্ত। আমি আর ফেরদৌসী প্রায় রোজই মিশনে এসে পত্রিকার ফাইল দেখে দেখে একই বক্তৃতার উদ্ধৃতি বিভিন্ন কাগজ থেকে সংগ্রহ করে কপি করি। এ কাজে ফেরদৌসী আমাকে অনেক সাহায্য করেছে। সব বক্তৃতা-বিবৃতির আগে ঘটনাপ্রবাহ উল্লেখ করে টীকা সংযোজন করলাম যাতে আন্দোলনের একটা ধারাবাহিক ইতিহাস পাওয়া যায়। বহুল প্রচারের লক্ষ্যে ইংরেজিতেই গ্রন্থটি সংকলন করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম। দিল্লির ওরিয়েন্ট লংম্যান থেকে ‘Bangladesh My Bangladesh’ নামে বইটি প্রকাশিত হয়েছিল।

লেখক: নাট্যব্যক্তিত্ব

গণহত্যার সাক্ষী ভাড়াউড়া বধ্যভূমি

প্রকাশ: ০১ মে ২০২৪, ০৩:১৭ পিএম
গণহত্যার সাক্ষী ভাড়াউড়া বধ্যভূমি
শ্রীমঙ্গলের ভাড়াউড়া বধ্যভূমি। ছবি: খবরের কাগজ

‘১৯৭১ সালের ১ মে অর্থাৎ মে দিবস। শনিবার সকাল, দেশে তখন পাক হানাদারদের বিরুদ্ধে চলছে স্বাধীনতা সংগ্রাম। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী নারকীয় ধ্বংসযজ্ঞ চালাচ্ছে দেশজুড়ে। শ্রীমঙ্গল শহরও বাদ যায়নি সেই নারকীয় বর্বরতা থেকে, এখানেও ঘাঁটি গাড়ে হানাদার বাহিনী ও তাদের দোসররা।

শ্রীমঙ্গল চা বাগান অধ্যুষিত হওয়ায় এদিকেই বেশি নজর ছিল পাকবাহিনী ও তাদের দোসরদের। যুদ্ধ পরিস্থিতির কারণে তখন বন্ধ ছিল চা বাগানের সব কার্যক্রম।

এর মধ্যেই সকাল ১০টার দিকে শহরতলীর আউট সিগন্যালের দিক থেকে ভাড়াউড়া চা বাগানের দক্ষিণ দিকে প্রবেশ করে ৫-৬ জন পাক সেনা, তাদের সঙ্গে ছিল এলাকার দফাদার (গ্রাম পুলিশ)। তারা এসেই বাগানের সব পুরুষকে একটি স্থানে মিলিত হতে বলে। পাক সেনারা আমাদের সঙ্গে কথা বলবে বলে জানায়। গ্রাম পুলিশরা জোর করে বাগানের পশ্চিম দিকের একটি স্থানে সবাইকে জড়ো করে। চা শ্রমিকরা কিছু বুঝে ওঠার আগেই ব্রাশফায়ার করে পাক সেনারা। গুলি থামলে বাগানের অন্যরাসহ আমরা সেখানে যাই, গিয়ে দেখি পুরো এলাকা রক্তে লাল হয়ে আছে। একজনের ওপর আরেকজনের লাশ, আমার বাবাও ছিলেন সেই লাশের কাতারে। আমি আর মা মিলে বাবাকে লাশের স্তূপ থেকে টেনে বের করি। তখনো তিনি বেঁচে ছিলেন। কোনো রকমে তাকে বাড়িতে নিয়ে আসি। বাড়িতে নিয়ে আসার পর তিনি মারা যান। সেদিন আমার বাবার সঙ্গে আরও প্রায় ৫০ জন চা-শ্রমিক নিহত হন এই ভাড়াউড়া বধ্যভূমিতে।

আজও যখন এই বধ্যভূমির সামনে দিয়ে যখন যাই তখন একাত্তরের সেই রক্তাক্ত স্মৃতিগুলো চোখের সামনে ভেসে ওঠে। কত লাশ! কত রক্তের সাক্ষী এই বধ্যভূমি, একটি স্বাধীন দেশমাতৃকার আশায় কত ত্যাগ আমাদের স্বীকার করতে হয়েছে।’

মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গলের ভাড়াউড়া বধ্যভূমির সামনে দাঁড়িয়ে কথাগুলো বলছিলেন ভাড়াউড়া চা বাগানের বাসিন্দা ভানু হাজরা।


১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের সময় ভানু হাজরা ১৩ বছর বয়সী কিশোরী। আজো চোখের সামনে দগদগে সেইসব স্মৃতি ভেসে উঠে তার।

তিনি বলেন, ‘সেদিন চা বাগানের প্রবেশপথে আরও দুইজনকে গুলি করে হত্যা করেছিল পাক সেনারা, কিন্তু বাগানের কেউ সেটা আগে জানতে পারেনি। আগে জানতে পারলে মাত্র ৫-৬ জন পাকিস্তানি সেনা একসঙ্গে এতগুলো নিরপরাধ শ্রমিককে মারতে পারতো না।’

ভাড়াউড়া বধ্যভূমিতে গিয়ে দেখা যায়, সেখানে শহিদদের স্মৃতির রক্ষার্থে নির্মাণ করা হয়েছে স্মৃতিস্তম্ভ, পাশেই একটি নামফলকে লেখা আছে শহিদ চা-শ্রমিকদের নাম।

সেদিন পাকবাহিনীর গুলিতে মারা যান- হুসেনিয়া হাজরা, মাংগুয়া হাজরা, ফাগু হাজরা, হিংরাজ হাজরা, কৃষ্ণ হাজরা, চিনিলাল হাজরা, শরজুয়া হাজরা, টিমা হাজরা, শানিচড়া হাজরা, মহারাজ হাজরা, নুনু লাল হাজরা, নকুলা হাজরা, রামলাল হাজারা, জগো হাজরা, বিশ্বম্বর হাজরা, হিরচুয়া হাজরা, শিবমুরা হাজরা, জুহিয়া হাজরা, চুন্মি হাজরা, অমৃত হাজরা, বিরবলি হাজরা, রামদেও হাজরা, হরপুয়া হাজরা, জোচনা হাজরা, রাজকুমার মাল, হরিকুমার হাজরা, রামছুরক হাজরা, গুরুয়া হাজরা, ফেরচুয়া গৌড় , রামকৃষ্ণ গৌড়, রামচরন গৌড়, গবিনা গৌড়, ইন্দ্র ভূঁইয়া, চৈতু ভূইয়া, আগ্না ভূঁইয়া, ডমরুচান্দ তুরিয়া, মাংরা তুরিয়া, ব্রজ নারায়ন গোয়ালা, হোল্লা গোয়ালা, রামলাল মাল, খুদিরাম হাজরা, রাজকুমার মাল, ডুকুয়া তেলি, গংগা বারই, জগদেও কাহার, গংগা কুর্মী, সম মাঝি, কালাচান্দ ঘাটুয়ার, সুখনন্দন রিকিয়াসন, বকই রেলী, শিব মুন্ডা।

আহত হয়েছিলেন কেদার লাল হাজরা, গোলাপ চান্দ হাজরা, রামদাড়ী হাজরা, জুবায়ের হাজরা, চিনিয়া হাজরা, কর্মা হাজরা, ডিকুয়া হাজরা, কাইলা হাজরা, বাংসিং তুরিয়াসহ অনেকে।

শ্রীমঙ্গল ভিক্টোরিয়া উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রাক্তন শিক্ষক কবি ও লেখক দ্বীপেন্দ্র ভট্টাচার্যের লেখা ‘ফিরে দেখা’ বইয়ে এই বধ্যভূমিতে চা-শ্রমিকদের নির্মমভাবে হত্যার ঘটনা তুলে ধরা হয়েছে।

সেখানে তিনি লিখেছেন, পাকবাহিনীর শ্রীমঙ্গল দখল, ১৯৭১ সালের ২৭ এপ্রিল পাক বিমান বাহিনী শ্রীমঙ্গলে শেলিং করে। পরে ৩০ এপ্রিল দুপুর ১১টা-১২টার দিকে পাক বিমানবাহিনী শ্রীমঙ্গলে প্রবেশ করে। ২৭ এপ্রিলের শেলিং এ শ্রীমঙ্গলের দুইজন নিহত ও একজন আহত হন। নিহত দুইজনের একজন গৌরাঙ্গ মল্লিক ও অপরজন বাসাবাড়িতে কাজ করার এক নারী। ৩০ এপ্রিল শ্রীমঙ্গলে আস্তানা করার পর প্রবেশের পরদিন পহেলা মে পাকবাহিনী তাদের তাণ্ডবলীলা শুরু করে। শহরের পার্শ্ববর্তী ভাড়াউড়া চা বাগানে বহু চা-শ্রমিককে একসঙ্গে দাঁড় করিয়ে গুলি করে হত্যা করে। এ নির্মম হত্যাকাণ্ড স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে শ্রীমঙ্গলের এক মর্মান্তিক ঘটনা।

বাংলাদেশ চা শ্রমিক ইউনিয়নের সাংগঠনিক সম্পাদক ও ভাড়াউড়া বধ্যভূমিতে নিহত হওয়া ফাগু হাজরার ছেলে বিজয় হাজরা বলেন, ‘ওইদিনের ঘটনার পর সব লাশ একসঙ্গে জড়ো করে মাটিচাপা দেওয়া হয় এবং আমরা চা বাগান ছেড়ে প্রাণ বাঁচাতে পালিয়ে যাই। মুক্তিযুদ্ধের পর মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের কর্মকর্তারা এসে এখানের মাটি খুঁড়ে মাথার খুলি গণনা করেন।’

তিনি আক্ষেপ করে বলেন, ‘চা-শ্রমিকদের ওপর পাক হানাদার বাহিনীর এই নির্মম গণহত্যাকাণ্ডের জায়গাটি এক প্রকার অবহেলিতই বলা চলে। এখানে যারা মারা গিয়েছিলেন তাদের নাম উল্লেখ করে আমি নিজ উদ্যোগে এখানে একটি নামফলক করেছি। সরকারের কাছে আবেদন এই বধ্যভূমির মর্মান্তিক ঘটনা তুলে ধরে এখানে একটি ভাস্কর্য করে দেওয়া হোক। যাতে এই প্রজন্মের সবাই জানতে পারে আমরা সেদিন কতটুকু নির্মমতার শিকার হয়েছিলাম পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর দ্বারা।’

হৃদয় শুভ/ইসরাত চৈতী/

আজ ঐতিহাসিক মুজিবনগর দিবস

প্রকাশ: ১৭ এপ্রিল ২০২৪, ০৮:১৯ এএম
আজ ঐতিহাসিক মুজিবনগর দিবস
ঐতিহাসিক মুজিবনগর

আজ ১৭ এপ্রিল ঐতিহাসিক মুজিবনগর দিবস। ১৯৭১ সালের এই দিনে বাংলাদেশের প্রথম সরকারের শপথ গ্রহণের মাধ্যমে শুরু হয় স্বাধীন বাংলাদেশের আনুষ্ঠানিক যাত্রা। ১০ এপ্রিল গঠিত সরকারের শপথ অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয় ১৭ এপ্রিল তৎকালীন মেহেরপুর মহকুমার  বৈদ্যনাথতলার আম্রকাননে। নতুন অস্থায়ী সরকারের উপস্থিতিতে পাঠ করা হয় স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র। স্বাধীনতার সূতিকাগার হিসেবে ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে যায় আম্রকাননটি। পরে বৈদ্যনাথতলাকে নামকরণ করা হয় মুজিবনগর। 

সৈয়দ নজরুল ইসলামকে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি ও তাজউদ্দীন আহমদকে প্রধানমন্ত্রী করা হয়। মন্ত্রিসভায় স্থান পান এম মনসুর আলী অর্থ, বাণিজ্য ও শিল্পমন্ত্রী হিসেবে। এ এইচ এম কামারুজ্জামানকে দেওয়া হয় স্বরাষ্ট্র, সরবরাহ, ত্রাণ, পুনর্বাসন ও কৃষি মন্ত্রণালয়। খন্দকার মোস্তাক পান পররাষ্ট্র, আইন ও সংসদবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব। জেনারেল আতাউল গনি ওসমানীকে দায়িত্ব দেওয়া হয় মুক্তিবাহিনীর প্রধান কমান্ডার হিসেবে। এ ছাড়া সরকারের ১৫টি মন্ত্রণালয় ও বিভিন্ন বিভাগের পাশাপাশি মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন ১১টি সেক্টরে কমান্ডার নিয়োগ দেওয়া হয় ওই শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানে। 

আব্দুল মান্নান এমএনওর পরিচালনায় স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র পাঠ করেন অধ্যাপক ইউসুফ আলী। পরে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলামকে প্রদান করা হয় গার্ড অব অনার। আনুষ্ঠানিকতায় মিষ্টি বিতরণ শেষে ভারতের উদ্দেশে যাত্রা করেন নবগঠিত সরকারের নেতারা। এ ঘটনার সাক্ষী হিসেবে মুজিবনগরের আম্রকাননে উপস্থিত ছিলেন ভারত থেকে আগত দেশি-বিদেশি সাংবাদিক,  ভারতীয় সৈনিক ও মুজিবনগরের স্থানীয় ব্যক্তিরা। 

বর্তমানে স্বাধীনতার সূতিকাগার এই আম্রকাননকে ঘিরে তৈরি করা হয়েছে মুজিবনগর মুক্তিযুদ্ধ স্মৃতি কমপ্লেক্স। তৈরি করা হয়েছে স্মৃতিসৌধ, মানচিত্র, মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিময় নানা স্থাপনা। দিবসটি উপলক্ষে নানা আয়োজনের ব্যবস্থা করা হয়েছে। মূল অনুষ্ঠান হবে মুজিবনগর স্মৃতি কমপ্লেক্সে। দিনটিকে ঘিরে মেহেরপুরজুড়ে এখন সাজ সাজ রব। দিবসটি পালন উপলক্ষে মুজিবনগর আম্রকাননে মন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের বেশ কয়েকজন জ্যেষ্ঠ নেতা আসবেন। জনপ্রশাসনমন্ত্রী ফরহাদ হোসেন বলেছেন, সমাবেশস্থলে অর্ধলক্ষাধিক মানুষের সমাগম ঘটবে। পুলিশ সুপার এস এম নাজমুল হক জানান, পুরো মুজিবনগর কমপ্লেক্স নিরাপত্তার চাদরে ঢেকে দেওয়া হবে। থাকবে তিন স্তরবিশিষ্ট নিরাপত্তাবলয়। সিসি ক্যামেরার মাধ্যমে পুরো সমাবেশস্থল নিয়ন্ত্রণ করা হবে। এ ছাড়া সাদাপোশাকে কাজ করবে পুলিশ। থাকবে বোমা নিষ্ক্রিয়করণ ইউনিট। কোনোভাবেই যাতে ছোটখাটো কোনো অপরাধ সংঘটিত না হয়, সেই লক্ষ্যে কাজ করবে পুলিশ।

ঐতিহাসিক মুজিবনগর দিবসে কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের কর্মসূচি
ঐতিহাসিক মুজিবনগর দিবস উপলক্ষে আওয়ামী লীগ ও দলের সহযোগী সংগঠনগুলো গুরুত্বের সঙ্গে বিভিন্ন কর্মসূচি হাতে নিয়েছে। এসব কর্মসূচির মধ্যে রয়েছে ভোর ৬টায় বঙ্গবন্ধু ভবন, কেন্দ্রীয় কার্যালয় এবং সারা দেশে সংগঠনের সব কার্যালয়ে জাতীয় ও দলীয় পতাকা উত্তোলন। সকাল ৭টায় বঙ্গবন্ধু ভবন প্রাঙ্গণে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতিকৃতিতে শ্রদ্ধা নিবেদন।

এদিকে মুজিবনগরের কর্মসূচির মধ্যে রয়েছে ভোর ৬টায় জাতীয় ও দলীয় পতাকা উত্তোলন। সকাল সাড়ে ৯টায় স্মৃতিসৌধে শ্রদ্ধা নিবেদন। সকাল ৯টা ৪৫ মিনিটে গার্ড অব অনার। সকাল ১০টায় শেখ হাসিনা মঞ্চে মুজিবনগর দিবসের জনসভা অনুষ্ঠিত হবে।

জনসভায় প্রধান অতিথি হিসেবে থাকবেন আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য কাজী জাফর উল্লাহ, বিশেষ অতিথি হিসেবে থাকবেন আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য এবং মহিলা ও শিশুবিষয়ক প্রতিমন্ত্রী সিমিন হোসেন রিমি, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুবউল আলম হানিফ এমপি, সাংগঠনিক সম্পাদক এস এম কামাল হোসেন এমপি, অ্যাডভোকেট আফজাল হোসেন, সম্মানিত অতিথি হিসেবে থাকবেন মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক। জনসভায় সভাপতিত্ব করবেন আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম এমপি। সঞ্চালনা করবেন দলের সাংগঠনিক সম্পাদক বি এম মোজাম্মেল হক।

ঐতিহাসিক তেলিয়াপাড়া দিবস ৪ এপ্রিল

প্রকাশ: ০৪ এপ্রিল ২০২৪, ০৩:০৩ পিএম
ঐতিহাসিক তেলিয়াপাড়া দিবস ৪ এপ্রিল
তেলিয়াপাড়া চা বাগানের ম্যানেজার বাংলোর পাশে নির্মিত বুলেট আকৃতির মুক্তিযুদ্ধের প্রথম স্মৃতিসৌধ। ছবি: খবরের কাগজ

আজ ৪ এপ্রিল, ঐতিহাসিক তেলিয়াপাড়া দিবস। ১৯৭১ সালের এই দিনে হবিগঞ্জের মাধবপুর উপজেলার তেলিয়াপাড়া চা বাগান ম্যানেজার বাংলোতে মুক্তিযুদ্ধের প্রথম বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়েছিল।

এ বৈঠকেই দেশকে স্বাধীন করার শপথ ও রণকৌশল তৈরি হয়। এ বৈঠকেই অস্ত্রের জোগান ও আন্তর্জাতিক সমর্থনসহ গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেওয়া এবং মুক্তিযুদ্ধের রণাঙ্গনকে ভাগ করা হয় ১১টি সেক্টর ও তিনটি ব্রিগেডে। 

ওই দিনের বৈঠকে ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের ঊর্ধ্বতন ২৭ সেনা কর্মকর্তার মধ্যে উপস্থিত ছিলেন- মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক আতাউল গণি ওসমানী, তৎকালীন মেজর সি আর দত্ত, মেজর জিয়াউর রহামন, কর্নেল এম এ রব, রব্বানী, ক্যাপ্টেন নাসিম, আব্দুল মতিন, মেজর খালেদ মোশাররফ, কমান্ডেন্ট মানিক চৌধুরী, ভারতের ব্রিগেডিয়ার শুভ্রমানিয়ম ও মেজর কে এম শফিউল্লাহ প্রমুখ।

শপথগ্রহণের পর এম এ জি ওসমানী নিজের পিস্তল থেকে ফাঁকা গুলি ছুড়ে যুদ্ধের আনুষ্ঠানিকতা করেন।

দেশ স্বাধীন হওয়ার পর শহিদ মুক্তিযোদ্ধাদের স্মরণে তেলিয়াপাড়া চা বাগানের ম্যানেজার বাংলোর পাশে নির্মিত হয় বুলেট আকৃতির মুক্তিযুদ্ধের প্রথম স্মৃতিসৌধ। ১৯৭৫ সালের জুন মাসে এ স্মৃতিসৌধের উদ্বোধন করেন সেনাপ্রধান (অব.) মেজর জেনারেল শফিউল্লাহ বীর উত্তম।

দীর্ঘদিন ধরে ওই স্থানটিকে সংরক্ষণ ও চা বাগান বাংলোতে মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি জাদুঘর নির্মাণের দাবি জানিয়ে আসছেন মুক্তিযোদ্ধা ও সুশীল সমাজের প্রতিনিধিরা। এমনকি ২০১১ সালের ৭ মে মুক্তিযোদ্ধাদের এক সমাবেশে সেখানে ১০ কোটি টাকা ব্যয়ে মুক্তিযোদ্ধা কমপ্লেক্স করার সিদ্ধান্তও নেওয়া হয়। কিন্তু এখনো এই প্রকল্প আলোর মুখ না দেখায় হতাশ মুক্তিযোদ্ধারা।

এ ব্যাপারে বীর মুক্তিযোদ্ধা গোলাম মোস্তফা রফিক বলেন, ‘তেলিয়াপাড়া চা বাগান বাংলো মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম ঐতিহাসিক স্থান। এখান থেকে মূলত মুক্তিযুদ্ধের সূচনা হয়। কিন্তু স্বাধীনতার এত বছর পরও ওই স্থানটিকে সংরক্ষণ করা হয়নি। বিষয়টি আমাদের জন্য খুবই দুঃখজনক বিষয়।’

পরিবেশ ও সংস্কৃতিকর্মী তোফাজ্জল সোহেল বলেন, ‘বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে তেলিয়াপাড়া চা বাগানের বাংলোটি একটি অন্যতম ঐতিহাসিক স্থান। কিন্তু দুঃখের বিষয়, স্বাধীনতার পর ৫৩ বছর পেরিয়ে গেলেও বাংলোটিকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠেনি কোনো স্মৃতি জাদুঘর।’

তিনি বলেন, ‘ওই সময়ে বাংলোতে ব্যবহৃত আসবাবপত্র, ফাইলপত্র এবং অন্যান্য সামগ্রী যথাযথ সংরক্ষণ/ সংগ্রহ করে তেলিয়াপাড়া বাংলোটিকে এখনো মুক্তিযুদ্ধ স্মৃতি জাদুঘরে পরিণত করা সম্ভব। এর মাধ্যমে আগামী প্রজন্ম মুক্তিযুদ্ধের এক গৌরবতম ইতিহাস সম্পর্কে জানার সুযোগ পাবে।’

কাজল সরকার/ইসরাত চৈতী/অমিয়/

হোমনা মুক্ত দিবস ২৩ ডিসেম্বর

প্রকাশ: ২৩ ডিসেম্বর ২০২৩, ০৩:৩৬ পিএম
হোমনা মুক্ত দিবস ২৩ ডিসেম্বর
ছবি-খবরের কাগজ

আজ ২৩ ডিসেম্বর, কুমিল্লা জেলার হোমনা উপজেলা মুক্ত দিবস। ১৬ ডিসেম্বর যখন সারা দেশ বিজয়ের আনন্দে উদ্বেলিত তখনো শক্রমুক্ত হতে পারেনি হোমনাবাসী। ২২ ডিসেম্বর পর্যন্ত উপজেলার ঘাগুটিয়া গ্রামে পাকিস্তানি বাহিনীর সঙ্গে তুমুল যুদ্ধে লিপ্ত হন এই অঞ্চলের মানুষ। অবশেষে ১৯৭১ সালের ২৩ ডিসেম্বর বাঞ্ছারামপুর, দাউদকান্দি, মুরাদনগর ও কুমিল্লার ময়নামতি ক্যান্টনমেন্ট থেকে মুক্তিযোদ্ধা ও যৌথ বাহিনীর ট্যাংক আক্রমণের পর সম্পূর্ণরূপে শক্রমুক্ত হয় ঘাগুটিয়া গ্রাম তথা কুমিল্লার হোমনা থানা। 

ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী ঘাগুটিয়া গ্রামের বীর মুক্তিযোদ্ধা সোবহান মিয়া জানান, বিজয়ের প্রাক্কালে ১৪ ডিসেম্বর সকালে সূর্যোদয়ের সময় ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বাঞ্ছারামপুর ক্যাম্প থেকে লঞ্চযোগে পালিয়ে যাচ্ছিল পাকিস্তানি শতাধিক সেনার একটি দল। পালিয়ে হোমনার ঘাগুটিয়া লঞ্চঘাটের অদূরে আসা মাত্রই বাঞ্ছারামপুর ও হোমনার মুক্তিসেনারা একযোগে আক্রমণ করে। নিরুপায় হয়ে ঘাগুটিয়া পাকা মসজিদে আশ্রয় নেয়। 

পাকিস্তানি বাহিনী গ্রামে ঢুকেই মসজিদের পাশে দারোগা সিদ্দিকুর রহমান ও ভূঁইয়া বাড়িসহ আশপাশের ৪০-৫০টি বাড়িতে আগুন দেয় এবং উপর্যুপরি গুলি চালায়।

এ সময় ঘাগুটিয়া ও ভবানীপুর গ্রামের অধিবাসীরা বাড়িঘর, সহায় সম্পত্তির মায়া ত্যাগ করে পার্শ্ববর্তী মাধবপুর, রামপুর ও নালাদক্ষিণ গ্রামে আশ্রয় নেয়। 

এ খবর মুরাদনগর ও দাউদকান্দির মুক্তিসেনাদের কাছে পৌঁছালে শতাধিক মুক্তিসেনা ঘাগুটিয়া যুদ্ধে অংশ নেয়। পরে ময়নামতি ক্যান্টনমেন্ট থেকে ট্যাংক নিয়ে আসা মিত্র বাহিনীর সহায়তায় ঘাগুটিয়া মুক্ত হয়।

ঘাগুটিয়া যুদ্ধে দুজন মুক্তিযোদ্ধাসহ গ্রামের ২০ নারী-পুরুষ শহিদ হন এবং শতাধিক গ্রামবাসী ও এফএফ কমান্ডার আব্দুল আউয়ালসহ অনেক মুক্তিযোদ্ধা আহত হন। পাকিস্তানি বাহিনীর হাতে শহিদরা হলেন- সৈয়দ আলী প্রধান, কিসমত আলী প্রধান, আছমত আলী প্রধান, ছন্দু মিয়া, লাল মিয়া (লালা), দেওয়ান আলী ভূঁইয়া, জবা মিয়া, আমজত আলী হাজি (ভবানীপুর), কাশেম মিয়া (কাছম), খোরশেদ পাগলা, আইয়ুবের নেছা, মনজুরের নেছা, কালা মিয়া প্রধানের মা, হাওয়া, লালু মিয়া, গোলবরের নেছা, জাবেদ আলী, মুক্তিযোদ্ধা আলেক মিয়া, মুক্তিযোদ্ধা মতিউর রহমান মতি।

ঘাগুটিয়া গ্রামে ’৭১-এর মুক্তিযুদ্ধে স্বাধীনতা ইতিহাসের কালের সাক্ষী হয়ে আজও দাঁড়িয়ে আছে ঘাগুটিয়া জামে মসজিদটি। পরবর্তী সময়ে ঐতিহাসিক মসজিদ ও স্কুলের পাশে গণকবরটি চিহ্নিত করে তা সংস্কার করা হয়েছে। 

এদিকে প্রতি বছরের মতো এবারও ২৩ ডিসেম্বর হোমনা মুক্ত দিবস উপলক্ষে উপজেলা প্রশাসন ও মুক্তিযোদ্ধাদের সমন্বয়ে ব্যাপক কর্মসূচি পালন করা হচ্ছে।

উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) রুমন দে বলেন, ‘দিবসটি উপলক্ষে শনিবার উপজেলা চত্বর থেকে র‌্যালি এবং ঘাগুটিয়ায় আলোচনা সভা ও মিলাদের আয়োজন করা হয়েছে।’

ইসরাত/অমিয়/

এখনো থামেনি বীরাঙ্গনাদের কান্না

প্রকাশ: ২০ ডিসেম্বর ২০২৩, ০২:৫৩ পিএম
এখনো থামেনি বীরাঙ্গনাদের কান্না
ছবি-সংগৃহীত

‘ভাদ্র মাসে বড় একটি নৌকায় করে জগন্নাথপুর গ্রামের প্রায় এক শর ওপরে মানুষ অন্য এক জায়গায় (সম্ভবত বাল্লা এলাকায়) যাচ্ছিলেন। এ সময় পথে আমাদের নৌকা আটকায় পাকিস্তানি মিলিটারিরা। প্রথমে তারা নৌকার মাঝিকে গুলি করে মেরে ফেলে। পরে আমার স্বামী নরেশ দাশকে গুলি করে। একপর্যায়ে পাকিস্তানি মিলিটারি আমাদের নৌকায় উঠে আরও বেশ কয়েকজনকে মেরে ফেলে। এ সময় আমার কোল থেকে ৮ মাসের ছেলেসন্তানকে কেড়ে নিয়ে নদীতে ফেলে দেয় হানাদার বাহিনী।

‘এভাবেই জীবনের দুর্বিষহ সেই দিনের কথা মনে করেন হবিগঞ্জের নবীগঞ্জ উপজেলার বাল্লা-জগন্নাথপুর গ্রামের মেয়ে লক্ষ্মীপ্রিয়া বৈষ্ণবী। অথচ বিজয়ের ৫৩ বছরেও বীরাঙ্গনা হিসেবে স্বীকৃতি মেলেনি তার।’ 

‘কুড়িগ্রাম সদরের বেলগাছা ইউনিয়নের আছমা বেগম। যাকে পাকসেনারা একবার নির্যাতন করে ছেড়ে দেয়। তারা চলে গেলে দেখতে পান তার বাম পায়ের কেনি আঙুল ছিঁড়ে যাওয়ার মতো। রক্ত ঝরছে টপটপ করে! সেখান থেকে দৌড়ে পালানোর চেষ্টা করেন। পাশের এক বাড়িতে গিয়ে কাপড় সেলাইয়ের সুঁই নিয়ে পাটের আঁশ দিয়ে পায়ের আঙুল সেলাই করে আবার পথচলা শুরু করেন তিনি। কিন্তু পথে সেনারা ধাওয়া করে ধরে নিয়ে গিয়ে আবারও নির্যাতন করে। সেখান থেকে শুরু পাকিস্তানি সেনাদের ধারাবাহিক নির্যাতন। যার পুরোটা এখন আর বলতে চান না তিনি।’ তবে খবরের কাগজকে প্রশ্ন করেন, ‘এসব বলে কী হবে? এই খাতায় নাম দিয়ে এখন পরিবার, সমাজে হয়েছি ঘৃণার পাত্র। আবেদনের ১৪ বছরেও বীরাঙ্গনার তালিকায় নাম ওঠেনি তার। পান না সরকারি কোনো সুযোগ-সুবিধা।’

মুক্তিযুদ্ধের সময় ১৮ বছর বয়স ছিল ময়মনসিংহের ফুলপুর উপজেলার ছনধারা ইউনিয়নের লাউয়ারী গ্রামের মেয়ে শহর বানু। এ সময় আব্দুল খালেক নামে তার ৭ বছরের এক সন্তান ছিল তার। যুদ্ধ শুরু হয়েছে। একদিন গ্রামে প্রবেশ করে পাকিস্তানি বাহিনী। চারদিকে ছোটাছুটি করতে থাকে লোকজন। তবে শহর বানু ঘর থেকে বের হওয়ার আগেই চারপাশ ঘিরে ফেলে হানাদার বাহিনী। এ সময় পাশবিক নির্যাতন করা হয় তাকে। এরপর থেকে শহর বানুকে অনেকে বাঁকা চোখে দেখতে শুরু করেন। আর এ কলঙ্কের বোঝা নিয়েই আজও চলছেন তিনি।  বলেন, ‌‘মুক্তিযুদ্ধের সময় আমি নির্যাতিত হয়েছি। বয়সের ভারে এখন কোনো অফিসে গিয়ে যোগাযোগ করার মতো শক্তি আমার নেই। জীবনের এই শেষবেলায় বীরাঙ্গনা হিসেবে রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি চাই।’

বলা হয় মুক্তিযুদ্ধে ৩০ লাখ মানুষের শহিদ হওয়া ও লাখ লাখ নারীর সম্ভ্রম বিসর্জনের বিনিময়ে এসেছে বাংলাদেশের স্বাধীনতা। যদিও এ নিয়ে উঠেছিল বিতর্ক। কিন্তু একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারে গঠিত আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল ২২ অক্টোবর ২০২১ সালে এক রায়ে বলেন, ‘মুক্তিযুদ্ধে ৩০ লাখ মানুষের শহিদ  হওয়া ও লাখ লাখ নারীর সম্ভ্রম বিসর্জন প্রতিষ্ঠিত ইতিহাস। এই ইতিহাস মুক্তিযুদ্ধের পবিত্র আবেগ ও গৌরবের মধ্যে মিশে আছে।’ এখানে সংখ্যা উল্লেখ না থাকলেও লাখ লাখ নারীর সম্ভ্রম বিসর্জনের কথা বলা হয়েছে। অন্যদিকে সর্বশেষ ২০২১ সালের তথ্য অনুযায়ী সরকারের গেজেট আকারে প্রকাশ করা বীরাঙ্গনাদের সংখ্যা ৪৩৮ জন।

অন্যদিকে ‘মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের ম্যানেজমেন্ট ইনফরমেশন সিস্টেমের (এমআইএস) গেজেটভুক্ত বীরাঙ্গনার সংখ্যা হালনাগাদ নয়। সরকারি তালিকায় এখন পর্যন্ত মোট বীরাঙ্গনা মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা ৪৪৮ হলেও লিপিবদ্ধ করা হয়েছে ৪০২ জনের নাম। এর মধ্যে ৮৯ জন বীরাঙ্গনারই নামে রয়েছে বানানসহ বিভিন্ন ধরনের ভুল। পিতা বা স্বামীর নামের ক্ষেত্রে বানান ও পদবির ভুল, এমনকি ভিন্ন ভিন্ন নাম রয়েছে ২০৭ জনের। বিভিন্ন আমলাতান্ত্রিক জটিলতার সঙ্গে এমন তথ্যগত ভুল বীরাঙ্গনাদের অধিকার আদায়ের ক্ষেত্রে বিড়ম্বনা তৈরি করছে।’

এমন তথ্য উঠে এসেছে গত বছরের ১৬ জুন ট্র্যান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবির) ‘বীরাঙ্গনাদের রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি ও অধিকার: সুশাসনের চ্যালেঞ্জ এবং উত্তরণের উপায়’ শীর্ষক গবেষণা প্রতিবেদনে।

কিন্তু তাহলে প্রশ্ন ওঠে বাকি বীরাঙ্গনাদের কী হলো? কোথায় আছেন? কেমন আছেন তারা? এখনো দেশের আনাচে-কানাচে অনেক বীরাঙ্গনার কান্না শোনা যায় স্বীকৃতি না পাওয়ার কষ্টে। একটি বাংলাদেশের জন্ম দিতে লক্ষ্মীপ্রিয়া, আছমা বেগম, শহর বানুর মতো ত্যাগ স্বীকার করেছেন অনেক নারী। তবে স্বীকৃতি মেলেনি এখনো।

এ বিষয়ে টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান বলেন, ‘স্বাধীনতার এত বছর পরে এসে সরকারিভাবে বীরাঙ্গনাদের স্বীকৃতি আমাদের জন্য অনেক আনন্দের ছিল। কিন্তু এ ক্ষেত্রে প্রত্যাশার তুলনায় এখন অনেক বেশি অপ্রাপ্তি রয়েছে। জাতীয়ভাবে গুরুত্বপূর্ণ বলা হলেও, তুলনামূলক কম আলোচিত প্রসঙ্গ হচ্ছে বীরাঙ্গনাদের রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি ও অধিকার।’

বীরাঙ্গনাদের চিহ্নিত করা থেকে শুরু করে রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি ও সুযোগ-সুবিধা প্রদানের পুরো প্রক্রিয়ায় নানা ঘাটতির বিভিন্ন দিক উঠে এসেছে, যখন আমরা কাজ করতে গিয়েছি তখন। এর মধ্যে বীরাঙ্গনাদের আবেদন নিষ্পত্তির সময়সীমা নির্ধারণ না থাকা, পরিকল্পনাহীনতা, প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতার ঘাটতি, অনিয়ম-দুর্নীতির সঙ্গে রয়েছে স্থানীয় পর্যায়ে সামাজিক-সাংস্কৃতিক নেতিবাচক মনোভাব। পাশাপাশি এখন একটি বড় সিন্ডিকেট গড়ে উঠেছে, যেখানে বীরাঙ্গনার স্বীকৃতি পেতে হলে টাকা দিতে হবে একটি মহলকে। এ ছাড়া বীরাঙ্গনাদের পরিবারও অনেক সময় সহযোগিতা করছে না তাদের পরিচয় প্রকাশে। আবার যেসব পরিবার সহযোগিতা করছে তারা ওই বীরাঙ্গনার প্রাপ্য সুবিধা নিজেরা ভোগ করছেন বলেও অভিযোগ আছে।    

এ ছাড়া বীরাঙ্গনাদের নিয়ে কাজ করছে বেসরকারি প্রতিষ্ঠান নারীপক্ষ। সরকারি তালিকার বাইরে এ পর্যন্ত ৯৯ জনের তালিকা করেছিল প্রতিষ্ঠানটি। এর মধ্যে মারা গেছেন ১৬ জন। আর ৫১ জনকে মাসিক ভাতা দেওয়া হচ্ছে নারীপক্ষের পক্ষ থেকে। আর তাদের তালিকায় থাকা ৩২ জনের নাম উঠেছে সরকারি তালিকায়।

কেন বীরাঙ্গনারা দ্রুত তালিকাভুক্ত হচ্ছে না জানতে চাইলে নারীপক্ষের সদস্য নাজনীন সুলতানা রত্না খবরের কাগজকে বলেন, ‘মাঠপর্যায়ে বীরাঙ্গনাদের সঙ্গে আমরা কাজ করতে গেলে অনেকেই অভিযোগ করেন সরকারের পক্ষে কেউ এসে তাদের খোঁজ নেয়নি। আবার অনেকের ভ্যারিফিকেশন হয়েছে কিন্তু এখনো গেজেটে  নাম আসেনি। অনেকে আবার আবেদন করে রেখেছেন কিন্তু তার পরে আর কিছুই এগোয়নি। কারও কারও অভিযোগ আছে, একটি চক্র তাদের কাছে তালিকায় নাম তুলে দেওয়ার জন্য টাকা চেয়েছেন। টাকা না দেওয়ায় কাজ আটকে আছে। যে বীরাঙ্গনাদের সম্ভ্রমের বিনিময়ে আমরা আজ স্বাধীনতা পেয়েছি, স্বাধীন দেশে বাস করছি তাদের কী এমন অবহেলায় থাকার কথা? এ প্রশ্ন করে নাজনীন সুলতানা রত্না বলেন, বীরাঙ্গনাদের তাদের প্রাপ্য মর্যাদা দেওয়া উচিত। একজন মুক্তিযোদ্ধা যে সম্মান, সুযোগ-সুবিধা নিয়ে বেঁচে আছেন বীরাঙ্গনাদেরও সে মর্যাদা যত দ্রুত সম্ভব দেওয়া উচিত। কারণ তাদের বয়স হয়েছে। অনেকে তো মারাও গেছেন। কিন্তু যারা বেঁচে আছেন তাদের মধ্যে অনেকে মানবেতর জীবনযাপন করছেন। অনেকে ভিক্ষাও করছেন। 

এ সমস্যার সমাধান কী জানতে চাইলে নাজনীন সুলতানা রত্না বলেন, সরকারের সদিচ্ছা প্রয়োজন। কাজগুলোকে দ্রুত এগিয়ে নিতে হবে। যেন তারা বেঁচে থাকতে থাকতে অন্তত স্বীকৃতি পান। একটু ভালোভাবে মর্যাদার সঙ্গে বাঁচতে পারেন। 

এ সমস্যা সমাধানের বিষয়ে ইফতেখারুজ্জামান খবরের কাগজকে বলেন, ‘বীরাঙ্গনারা যে বীর, সে বিষয়টি বেশি বেশি প্রচার করা দরকার। এ জন্য রাষ্ট্রীয়ভাবে উদ্যোগ নেওয়া দরকার। পাশাপাশি তাদের তালিকায় আনার জন্য কাজ করার সরকারি সংস্থা জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিলকে (জামুকা) আরও তৎপর হতে হবে। কাজটি দ্রুত করার ব্যবস্থা করতে হবে। যারা সিন্ডিকেট করে বীরাঙ্গনাদের তালিকায় আনার জন্য অর্থ নিচ্ছেন ও কার্যক্রমটি দীর্ঘ করছেন তাদের চিহ্নিত করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তিরও ব্যবস্থা করতে হবে।’