আমার ফরাসি ভাষার একজন শিক্ষক ছিলেন। তার নাম ছিল মাদাম হুক। উনি আমাকে খুবই স্নেহ করতেন। সেদিন তিনি আমাকে সান্ত্বনা দেন। তার কথায় আমি একটি বিষয় উপলব্ধি করি যে, মানুষ কাউকে না কাউকে পাবেই তাকে ভালোবাসার জন্য। দুঃসময়ে সান্ত্বনা দেওয়ার জন্য। উনি আমাকে বললেন যে, তুমি অস্থির হচ্ছ কেন? ভেঙে পড়ো না। আমি প্রশ্ন করলাম, মুনীর চৌধুরীকে কেন নিয়ে গেল? রামেন্দু মজুমদার আমাকে বললেন, ওনাদের মতো মানুষদের নিয়ে যাবে, একটি দেশকে খোঁড়া করে দেওয়ার জন্য বুদ্ধিজীবীদের তো নিতে হবেই
১৯৭১-এর ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশ স্বাধীন হয়। তার মাত্র দুই দিন আগে অর্থাৎ ১৪ ডিসেম্বর আমার ভাই মুনীর চৌধুরীকে ধরে নিয়ে নিয়ে যায় পাক হানাদার বাহিনী। আমি তখন ছিলাম দিল্লিতে। সেখান থেকেই খবরটি আমি পাই। দূরে থাকলে যেমনটি হয়, ব্যাপারটি সত্যি না মিথ্যা, বুঝতে পারি না। নানারকম উড়ো খবর আসে। কবির চৌধুরী, মুনীর চৌধুরীসহ কয়েকজনকে ধরে নিয়ে যাওয়ার আশঙ্কা আমরা করেছিলাম। যখন আমার কানে খবরটি পৌঁছায় যে, মুনীর চৌধুরীকে ধরে নিয়ে গেছে, আমি অস্থির হয়ে উঠি! এদিকে খবর আসছে দেশ স্বাধীন হয়ে আসছে!
সেদিনটির কথা মনে পড়ে। আমি খুব আনন্দিত এই ভেবে যে, দেশে ফিরছি। আমি আমার স্বামী রামেন্দু মজুমদারকে খাবার দিব। উনি স্বাধারণত খাওয়া-দাওয়ার পরে শুয়ে পড়েন। কিন্তু সেদিন তিনি ঘুমাচ্ছেন না। আমি তাকে বললাম, তুমি খেয়ে শুয়ে পড়। আজ দেরি করছ কেন? তখন উনি আমাকে বললেন, তুমি এদিকে এসো। আমি বুঝতে পারছি কিছু একটা হয়েছে! কেমন যেন একটু খটকা লাগছে সবকিছু। আমি তার পাশে বসতেই তিনি বললেন, দেখো, তোমাদের পরিবারের সবাই খুব ধৈর্যশীল এবং সচেতন। তারা খুবই সংযত। সহজেই ভেঙে পড়েন না। এসব কথার মাঝেই আমার বুকের ভেতর কিছু একটা হচ্ছে ! আমি বললাম, কী হয়েছে? তখন উনি বললেন, দেখ, মুনীর ভাইকে ধরে নিয়ে গেছে!
সেই মুহূর্তটি আমি বর্ণনা করতে পারি না। মুনীর ভাইকে ধরে নিয়ে গেছে, আরও অনেককেই ধরে নিয়ে গেছে। আমি সে রাতে ঘুমাতে পারিনি। আমার কোনো অনুভূতি ছিল না। আমি একদম চুপচাপ হয়ে গিয়েছিলাম। আমার ফরাসি ভাষার একজন শিক্ষক ছিলেন। তার নাম ছিল মাদাম হুক। উনি আমাকে খুবই স্নেহ করতেন। সেদিন তিনি আমাকে সান্ত্বনা দেন। তার কথায় আমি একটি বিষয় উপলব্ধি করি যে, মানুষ কাউকে না কাউকে পাবেই তাকে ভালোবাসার জন্য। দুঃসময়ে সান্ত্বনা দেওয়ার জন্য। উনি আমাকে বললেন যে, তুমি অস্থির হচ্ছ কেন? ভেঙে পড়ো না। আমি প্রশ্ন করলাম, মুনীর চৌধুরীকে কেন নিয়ে গেল? রামেন্দু মজুমদার আমাকে বললেন, ওনাদের মতো মানুষদের নিয়ে যাবে, একটি দেশকে খোঁড়া করে দেওয়ার জন্য বুদ্ধিজীবীদের তো নিতে হবেই। তুমি মন খারাপ করো না। ধৈর্য ধরো। তিনি আমাকে ঘুমের ওষুধ দিয়ে ঘুম পাড়িয়ে দিলেন।
১৬ ডিসেম্বর আমাদের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ দিন। বাংলাদেশের বিজয়ের দিন। কিন্তু বিজয়ের প্রাক্কালে আমাদের পরিবারের দুঃখের দিন মুনীর চৌধুরীকে ধরে নিয়ে যাওয়া। মুনীর চৌধুরী সবসময় গোসল করে এসে মা দুপুরের খাবার দিলে তখন খেতে বসতেন। মা খাবার বেড়ে না দিলে উনি বসতেন না। সেদিন মা বললেন যে, মুনীর তুমি একটু বসো। আমি জোহরের নামাজটি পড়ে নিই। তারপর ভাত দিব। আমার মা নামাজ পড়তে চলে গেলেন। মুনীর চৌধুরী বসে রইলেন। সেদিন তিনি আর ভাত খেতে পারেননি। পাকিস্তানি আলবদর তাকে ধরে নিয়ে গেল। সেদিনের কথা মনে হলে আজও চোখের পানি ধরে রাখতে পারি না। মুনীর চৌধুরীর কাছে অনেকেই আসতেন। তিনি বাসায় বলে রেখেছিলেন যে, কেউ যদি বলে যে, স্যার আছেন? তাহলে দরোজা খুলে দেবে। কিন্তু যারা সেদিন এসেছিল ওরা ছিল আলবদর। স্যার আছেন? বলাতে আমার ইমিডিয়েট বড় ভাই দরোজা খুলে দিয়েছিলেন। মুনীর ভাই তখনো শার্ট পড়েননি। পাঞ্জাবি আর লুঙ্গি পরা। দরোজা খুলে দেওয়ার পরেই তার পিঠে বন্দুক রাখা হলো। আমার ভাই তখন বুঝতে পেরেছেন। উনি তখন বললেন যে, আমি শার্ট পরে আসি। উনি জামা পরে এলেন। চোখ বন্ধ করে উনাকে নিয়ে যাওয়া হলো।
মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরী স্যার আমার সরাসরি শিক্ষক ছিলেন। স্যার অত্যন্ত জ্ঞানী, শান্ত প্রকৃতির, অমায়িক। জীবনে এত লেখাপড়া, এত ভালো ফলাফল স্যারের, যেটি না বললেই নয়। স্যারকেও নিয়ে যাওয়া হয়েছে। এ রকম অনেক গুণী মানুষকে ধরে নিয়ে যাওয়া হয়েছে।
যারা সমাজের মাথা ছিলেন তাদের বেছে বেছে নিয়েছে এবং তাদের প্রতি অত্যাচারের মাত্রাও ছিল নৃশংস, একই সঙ্গে বর্ণনাতীত। যেমন ডা. রাব্বী হার্ট স্পেশালিস্ট ছিলেন। উনার হার্ট কেটে নেওয়া হয়েছে। ডা. আলীম চোখের ডাক্তার ছিলেন। তার চোখ উপড়ে নেওয়া হয়েছে। এভাবে যন্ত্রণা দিয়ে উনাদের হত্যা করা হয়েছে। ভাগ্যের কী নির্মম পরিহাস! তারা এই কষ্ট পাওয়ার মতো লোক ছিলেন না! তারা ছিলেন দেশের চালিকাশক্তি। যাই হোক, আমরা অনেকদিন আশা করেছিলাম যে, উনাকে পাওয়া যাবে। আমরা তার লাশ পর্যন্ত পাইনি। অনেকেরই কোনো খোঁজ মেলেনি। কাজেই আমি বলব, যে বিজয়ের গল্প আমরা করি, স্বাধীন সার্বভৌম দেশের নাগরিক হিসেবে আজ বিশ্ব দরবারে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারি, সেই বিজয় একদিনে আসেনি।
বঙ্গবন্ধুর কারণে আমরা যেভাবে মাত্র নয় মাস যুদ্ধ করে একটি স্বাধীন দেশ পেয়েছি। কিন্তু মনে রাখা দরকার যে, একটি দেশ পাওয়া যত কষ্টকর, সেটি রক্ষা করা আরও বেশি কষ্টকর। এই দেশটিকে আমাদের পরিচর্যা করা উচিত ছিল। আমরা সেটি করতে পারিনি। আমরা যদি দেশটিকে ভালো না বাসি, দেশ থেকে সাম্প্রদায়িকতা দূর করতে না পারি, আমাদের স্বাধীনতা ব্যর্থ হবে। দেশে ষড়যন্ত্র, সাম্প্রদায়িকতা, লুটপাট, নির্যাতন, সবই চলছে। আমার শঙ্কা এটিই যে, আমরা যদি নিজেদের মনকে পরিশুদ্ধ না করি, তাহলে বোধহয় এ দুঃখ আর কখনো ঘুচবে না।
আরেকটি বিষয় হচ্ছে, বিজয় দিবস, স্বাধীনতা দিবস, তখনই কেবল আমরা কথা বলি অথবা স্মরণ করি। আমি বলব, যারা দেশের জন্য অমূল্য জীবন দিয়ে গেছেন আমরা যেন তাদের স্মরণ করি অন্য সময়েও। আমরা যেন তাদের প্রাপ্য সম্মানটুকু করতে পারি শ্রদ্ধার সঙ্গে। বাংলাদেশের মানুষ এমন নৃশংসতা ভুলে সুখে কালাতিপাত করতে পারে না। এর প্রতিদান আমাদের দিতেই হবে। আমি শুধু এটুকুই বলব যে, আমার মতো অনেক পরিবারই তাদের স্বজন হারিয়েছেন। স্বজন হারানোর বেদনাটুকু হয়তো তারাও মাঝেমাঝে ভুলে যান। কারণ জীবনে চলতে হবে। কিন্তু আমি মনে করি এই দুঃখগুলো আমাদের ভুলে যাওয়া উচিত নয়।
বঙ্গবন্ধুর চরিত্রের দৃঢ়তা এবং সংকল্পের জোরে আমরা বাংলাদেশ লাভ করেছি। তা না হলে আমাদের কী অবস্থা হতো সেটা কল্পনা করাও কঠিন! বিজয় দিবসে সব শহিদকে সশ্রদ্ধ চিত্তে স্মরণ করি ও তাদের আত্মার প্রতি গভীর শ্রদ্ধা জানাই।
লেখক: নাট্যব্যক্তিত্ব