আজ ২০ ডিসেম্বর। ১৯৭১ সালের এই দিনে সারাদেশ যখন বিজয়ের আনন্দে ভাসছিল, তখন মৌলভীবাজার সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ে রহস্যজনকভাবে মাইন বিস্ফোরণে মারা যান অর্ধশতাধিক ঘরে ফেরা মুক্তিযোদ্ধা। এই দিনে মৌলভীবাজারে রচিত হয় এক কালো অধ্যায়। দিনটি স্থানীয় শহীদ দিবস হিসেবে পালন করেন জেলাবাসী।
মাইন বিস্ফোরণে বেঁচে যাওয়া সাবেক জেলা কমান্ডার জামাল উদ্দিন বলেন, ‘দেশ স্বাধীনের মাত্র চার দিন পর যুদ্ধজয়ী মুক্তিযোদ্ধারা সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের ক্যাম্পে জড়ো হন। তখন তারা একে একে নিজেদের ঘরে ফেরার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। এদিকে বিভিন্ন স্থানে পাকিস্তানি বাহিনীর ফেলে যাওয়া ও পুঁতে রাখা মাইন এবং গ্রেনেড উদ্ধার করে বিদ্যালয়ের এক পাশে রাখা হয়। সেদিন ক্যাম্পে অবস্থানরত মুক্তিযোদ্ধারা যখন দুপুরের খাবারের প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন, তখন হঠাৎ বিকট শব্দে কেঁপে ওঠে শহর। রহস্যজনকভাবে পরপর বেশ কয়েকটি মাইন বিস্ফোরণ ঘটে। ক্যাম্পে অবস্থানরত অর্ধশতাধিক মুক্তিযোদ্ধার দেহ ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন হয়ে এদিকে-সেদিক ছিটকে পড়ে।’
স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধাদের কাছ থেকে জানা যায়, সেদিন উপস্থিত মুক্তিযোদ্ধাদের দেহ বিচ্ছিন্ন হয়ে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে পড়লে অজানা আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে আশপাশের এলাকায়। এক পলকেই তছনছ হয়ে যায় পুরো এলাকা। মুক্ত দেশে নিশ্চিত ঘরে ফেরার পূর্বমুহূর্তে তারা হয়ে গেলেন কেবলই স্মৃতি। স্বাধীন দেশে নিজেদের বাড়িতে ফেরা হলো না মুক্তিযোদ্ধাদের। এলাকাবাসী ছিন্নভিন্ন মুক্তিযোদ্ধাদের দেহভস্ম একত্র করে সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ের দক্ষিণ-পূর্ব অংশে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের পাশে সমাধিস্থ করেন।
জানা গেছে, এই ক্যাম্পের অধিকাংশই ছিলেন গেরিলা বাহিনীর সদস্য। তবে কী কারণে বিস্ফোরণ ঘটেছিল এবং কতজন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হয়েছিলেন তা এখনো অজানাই রয়ে গেছে।
পরবর্তী সময়ে জেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ড কাউন্সিল ক্যাম্পে অবস্থানরতদের কিছু নাম উদ্ধার করে একটি তালিকা তৈরি করা হয়। পরে মৌলভীবাজার সরকারি উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে স্মৃতিসৌধ ও শহীদ মিনারের মধ্যখানে একটি স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ করা হয়।
২০ ডিসেম্বর ১৯৭১ সালে মৌলভীবাজারের মাইন বিস্ফোরণে যাদের নাম পাওয়া গেছে স্মৃতিস্তম্ভটিতে তাদের নাম লিখা আছে। তারা হলেন- সুলেমান মিয়া, রহিম বক্স খোকা, ইয়ানূর আলী, আছকর আলী, জহির মিয়া, ইব্রাহিম আলী, আব্দুল আজিজ, প্রদীপ চন্দ্র দাস, শিশির রঞ্জন দেব, সত্যেন্দ্র দাস, অরুণ দত্ত, দিলীপ দেব, সনাতন সিংহ, নন্দলাল বাউরী, সমীর চন্দ্র সোম, কাজল পাল, হিমাংশু কর, জিতেশ চন্দ্র দেব, আব্দুল আলী, নূরুল ইসলাম, মোস্তফা কামাল, আশুতোষ দেব, তরণী দেব ও নরেশ চন্দ্র ধর।
প্রতিবছর ২০ ডিসেম্বরের দিনটি ‘স্থানীয় শহীদ দিবস’ হিসেবে পালন করে জেলার বিভিন্ন রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক সংগঠন ও জেলা প্রশাসন।
পুলক পুরকায়স্থ/ইসরাত/অমিয়/