মুক্তিযুদ্ধে বন্ধুদের হারিয়েছি, আমি বেঁচে গেছি । খবরের কাগজ
ঢাকা ৬ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১, সোমবার, ২০ মে ২০২৪

মুক্তিযুদ্ধে বন্ধুদের হারিয়েছি, আমি বেঁচে গেছি

প্রকাশ: ১৬ ডিসেম্বর ২০২৩, ১১:২৬ এএম
মুক্তিযুদ্ধে বন্ধুদের হারিয়েছি, আমি বেঁচে গেছি

মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানের আত্মসমর্পণটা আমার কাছে প্রবলভাবে নাড়া দেওয়া প্রিয় মুহূর্ত। যখন শুনলাম তারা আত্মসমর্পণ করবে, ওই মুহূর্তটা বেশ নাড়া দেয়। আমি তো মনে করি এটা একটা ঐতিহাসিক মুহূর্ত

আমার প্রিয় মানুষ হচ্ছে আমার বাবা-মা, এরা আমার ওপর খুব প্রভাব বিস্তার করেছেন। আমি একটা ছোট বই লিখেছিলাম ‘আমার পিতার মুখ’ নাম দিয়ে। সেখানে পিতার কথাটাই প্রধানত আছে, কিন্তু এটা আমি লেখার সময় অনুভব করেছি এবং অনুভব করি যে, যদিও ওটাকে পিতার মুখ বলেছি কিন্তু পিতার পেছনে মাতাও আছেন এবং আসল কথা হচ্ছে আমার পিতার মধ্যেও মাতৃসুলভ গুণগুলো ছিল এবং স্বভাবও ছিল বলতে পারি। মা যেমন সন্তানকে লালনপালন করেন, আমার পিতাও সেরকম করতেন, ১৯৬৫ সালে আমার বাবা মারা যান, আমি তখন বিদেশে ছিলাম, সেজন্য তাৎক্ষণিকভাবে আমার যে অনুভূতি তৈরি হয়েছিল সেগুলো আমি একটি বড় প্রবন্ধের আকারে লিখেছি এবং সেটা পরে বইয়ের একটি অংশ করে আমার পিতার মুখ নাম দিয়েছি, কিন্তু আমার মা-ও আমার প্রিয় মানুষ। বাবার মৃত্যুর পর দীর্ঘসময় তিনি আমাদের সঙ্গে ছিলেন এবং তার প্রভাবটা খুব বেশি করেই পড়েছে আমার ওপর। আমার বাবা বাইরে থাকতেন সরকারি কর্মোপলক্ষে, অতএব মায়ের প্রভাবটা আরও বেশি ছিল আমাদের ওপর।

আমরা যেহেতু পিতৃতান্ত্রিক ব্যবস্থার মধ্যে বসবাস করি, পিতাই যেহেতু সংসারের প্রধান, সেজন্য বাবার প্রভাবটাকে আমরা মোটামুটি চিহ্নিত করতে পারি, কিন্তু মায়ের প্রভাবটাকে করতে পারি না, তবু আমার কাছে বাবার মতোই সমান প্রিয়।

প্রিয় রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব যদি একজনের কথাই বলি তাহলে আমি বেছে নেব মওলানা ভাসানীকে, তার কিছু দৃষ্টিভঙ্গির সঙ্গে আমি একমত নই, তার বিরুদ্ধে আমার প্রধান অভিযোগ যে, তিনি ধর্ম এবং রাজনীতিকে আলাদা করার ব্যাপারে সাহায্য করেননি, এটা আমাদের দেশের রাজনীতির জন্য, আমাদের সমাজের জন্য খুব ক্ষতিকর বিষয় হয়েছে।

যাকে ধর্মনিরপেক্ষতা বলা হয়, যাকে ইহজাগতিকতা বলা হয়, এটা আমরা সৃষ্টি করতে পারিনি আমাদের রাজনীতিতে, আমাদের সমাজে। মওলানা ভাসানী এই দুটোকে মিশিয়ে ফেলেছিলেন। ধর্ম এবং রাজনীতিকে আলাদা করতে পারেননি, মানে আমাদের সাহায্য করেননি। কিন্তু মওলানার যে গুণটা আমার ভালোলাগে, সেটা হচ্ছে- তিনি সাম্রাজ্যাবাদ-বিরোধী এবং সামন্তবাদ-বিরোধী রাজনীতিক ছিলেন। আমরা তার সময়েও পাইনি তার পরেও পাইনি, অমন রাজনীতিক। এই দুই প্রশ্নে তিনি অনমনীয় ছিলেন, আমরা দেখেছি- কেউ কেউ সামন্তবাদ-বিরোধী হন কিন্তু সাম্রাজ্যবাদ-বিরোধী হন না, আবার কেউ-বা সাম্রাজ্যবাদ-বিরোধী হন কিন্তু সামন্তবাদ-বিরোধী হন না। কিন্তু মওলানা তার যে সংস্কৃতি, তার যে পটভূমি, সেখানে দাঁড়িয়ে তিনি সাম্রাজ্যবাদকে চিনলেন এবং সাম্রাজ্যবাদের সঙ্গে যে পুঁজিবাদ আছে তাকেও তিনি চিহ্নিত করেছেন। অন্যদিকে যে সামন্তবাদী বন্ধনগুলো জমিদারি প্রথা থেকে শুরু করে অর্থাৎ কৃষকদের ওপর যে নানারকম মহাজনী নির্যাতন, এটাও তিনি দেখেছেন, এটাও তার প্রধান গুণ। আর দ্বিতীয় যে গুণটি, সেটা হচ্ছে- মওলানা ক্ষমতার জন্য রাজনীতিটা করেননি, সবাই রাজনীতি করে ক্ষমতার জন্য, ক্ষমতা দখল করার জন্য, অথচ তার মধ্যে আমি দেখেছি যে, তিনি ক্ষমতার জন্য রাজনীতি করেননি, তিনি ক্ষমতায়ন করতে চেয়েছিলেন জনসাধারণকে। জনসাধারণকে ক্ষমতায় নিয়ে যেতে চেয়েছিলেন। সেজন্য তিনি কোনো দলে টিকে থাকতে পারেননি। ক্ষমতার রাজনীতিতে তিনি কখনো বিশ্বাসী ছিলেন না। দেশের বাইরে আমার প্রিয় রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব লেনিন। সমাজ বদলের যে রাজনীতি, তিনি সে রাজনীতি করেছেন। সে রাজনীতি রাষ্ট্রক্ষমতা নেওয়ার জন্য রাজনীতি নয়, সে রাজনীতি সমাজ বদলের রাজনীতি। তার ভেতরে কোনো আপসকামিতা ছিল না, যারা বিপ্লবী রাজনীতি করেন তারা অনেক সময় একপেশে হন। কিন্তু লেনিন সাহিত্যে উৎসাহী ছিলেন, সংগীতে উৎসাহী ছিলেন, অনরবত লিখতেন, পত্রিকা সম্পাদনা করতেন, অসাধারণ সাংগঠনিক ক্ষমতা ছিল, শক্তি ছিল তার। অর্থাৎ লেনিন একজন পরিপূর্ণ মানুষ ছিলেন। সাহিত্যিকদের মধ্যে রবীন্দ্রনাথ আমার খুবই প্রিয়, তার কাছে আমরা সব সময় যেতে পারি, যেকোনো প্রয়োজনে যেতে পারি, যেমন আনন্দের জন্য যেতে পারি।

আমাদের বাংলা গদ্যকে বিদ্যাসাগর প্রাণ দিয়েছেন কিন্তু রবীন্দ্রনাথ সেই প্রাণটাকে আরও বিকশিত করেছেন এবং বহুমাত্রিকতা দিয়েছেন। সেজন্য রবীন্দ্রনাথ বারবার পড়া যায়, বহুভাবে পড়া যায়। এরপর বিশ্বসাহিত্যে আমার সবচেয়ে প্রিয় লেখক শেকসপিয়র। তার প্রিয় লেখক হওয়ার স্থূল কারণ হচ্ছে আমি পেশায় ইংরেজি সাহিত্যের শিক্ষকতা করেছি, কাজেই শেকসপিয়র আমাকে পড়তে হয়েছে ছাত্রজীবনে, পেশাগত জীবনে যদি এ পেশায় জড়িতও না থাকতাম, তাহলেও আমি শেকসপিয়রকে সবচেয়ে প্রিয় লেখক বলতাম, এজন্য যে, তার মধ্যে আমি যে গুণটা দেখি সেটা সর্বজন প্রশংসিত এবং সর্বজন স্বীকৃত। সেটা হচ্ছে তিনি তার কালের মানুষ, তার পরিস্থিতির মানুষ, তার দেশের মানুষ, কিন্তু তিনি সর্বজনীন, তার ভেতরে সর্বজনীনতা ছিল। তিনি এমন সব চরিত্র তৈরি করেছেন যেগুলো চিরকালের মানুষ, একালেরও মানুষ। তার ভেতরে শুধু নাট্যগুণ নয়, কাব্যগুণও দেখি। তার কাব্যগুণও বৈচিত্র্যপূর্ণ। দুই প্রিয় লেখকের কথা বললাম, আরেকজন প্রিয় লেখক টলস্টয়। তিনি আরেক ধরনের লেখক। তিনি সম্পূর্ণ গদ্যের লেখক, উপন্যাসের লেখক, তাকেও আমার ভালো লাগে।

প্রত্যেকটা মানুষ যে অসাধারণ প্রাণী, সেটা টলস্টয় যেভাবে তার লেখায় উপস্থাপিত করেছেন তা কম লেখকই করতে পেরেছেন। হোমারের লেখার মধ্যেও আমরা ওই ব্যাপারটা পাই। কিন্তু তার প্রত্যেকটা চরিত্র স্বতন্ত্র। এটা আমরা টলস্টয়ের মধ্যে দেখি, যেমন তার যুদ্ধ ও শান্তি উপন্যাসের মধ্যে পাঁচ শ-এর মতো চরিত্র আছে, পাঁচ শ চরিত্রকে তিনি স্বতন্ত্রভাবে দেখেছেন, প্রত্যেকটা চরিত্র তার কাছে আলাদা আলাদা মানুষ, এমনকি তার কুকুরটাও আলাদা, তার এই যে একটা পর্যবেক্ষণ ক্ষমতা, দাবির অন্তর্দৃষ্টি ছিল তা অসাধারণ। তার আরেকটি গুণ আমার আরও ভালো লাগে, তা হচ্ছে সাহিত্য সম্পর্কে তার ধারণা, তিনি মনে করেন যে, সাহিত্য হচ্ছে এক ধরনের যোগাযোগ, মানুষের সঙ্গে মানুষের যোগাযোগ করে লেখা তার নিজের অভিজ্ঞতা তার উপলব্ধি এগুলোকে অন্যের মধ্যে সংক্রমিত করতে চান, এটা তিনি স্পষ্ট করেই বলেছেন। তার এই বোধ এবং বিশ্বাসটা আমার কাছে বেশ গ্রহণযোগ্য। সাহিত্যের কাজ হচ্ছে কেবল লেখা নয়, আনন্দ দেওয়া নয়, আনন্দের মধ্যে একটা সংক্রমণ ঘটানো, এই গভীরতা এই ব্যাপকতা আমায় বেশ আলোড়িত করে। আমি বহু লেখকের লেখা পড়ি এবং পড়েছি ওপরে উল্লিখিত তিনজনকে আলাদা করে দেখি এবং তিনজনকে আমি মনে করি আমার প্রিয় লেখক। কবিদের মধ্যে আমার প্রিয় জন কিটস এবং জীবনানন্দ দাশ। কিটস এবং জীবনানন্দের মধ্যে একটা সাযুজ্য আছে। সেটা হচ্ছে তাদের দুজনের মধ্যে একটা রহস্যময়তা আছে। দ্বিতীয়ত, এই দুই কবির মধ্যে একটা সময় এবং ইতিহাস চেতনা আছে।

আমার প্রিয় চলচ্চিত্রকার চার্লি চ্যাপলিন। তার ছবি আমার খুব ভালো লাগে। চ্যাপলিনের কৌতুক ব্যঙ্গবিদ্রূপাত্মক হলেও মানুষের প্রতি তার যে দরদ আছে তা আমার বেশ ভালো লাগে। আমি আইজেনস্টাইনের ছবিগুলোও খুব পছন্দ করি, সত্যজিৎ রায়ের ছবি, মৃণাল সেনের বাংলা ছবি খুব প্রিয়। অভিনেতা অভিনেত্রীদের মধ্যে আমার প্রিয় লরেন্স অলিভিয়ের। 

বাংলা ছবির মধ্যে অনেকেই আমার প্রিয় ছিলেন। ছবি বিশ্বাস, বাল্যকালে খুব পছন্দের ছিলেন। তার বাচনভঙ্গি আমার খুবই প্রিয় ছিল, তারও আগে প্রমথেশ বড়ুয়ার কিছু ছবি আমরা দেখেছি, তাকেও পছন্দ করি। কিন্তু ছবি বিশ্বাস আমাদের খুব পছন্দের ছিলেন। জহর গাঙ্গুলীকে আমরা খুব পছন্দ করতাম তার নিজস্বতার কারণে। কানন দেবীকে ভালো লাগত। উত্তম-সুচিত্রার ছবি আমরা দেখেছি, যখন আমরা কলেজ ইউনিভার্সিটির ছাত্র, তখন তারা খুব জনপ্রিয়। পেইন্টিং-এ আমার প্রিয় পিকাশো। তিনি বৈচিত্র্যপূর্ণ এবং ক্রমাগত নিজেকে পরিবর্তন করেছেন, বলা যায় এটা তার বহুমাত্রিকতা। দ্বিতীয় কথা, তার মধ্যে একটা অঙ্গীকার ছিল। সামাজিক রাজনৈতিক এবং বুদ্ধিবৃত্তিক। যেটা খুব ভালো লাগত। আমার প্রিয় শিল্পী জয়নুল আবেদীন। তার সব ছবির মধ্যেই আমি একটা বলিষ্ঠতা দেখতে পাই। যে বলিষ্ঠতা বাঙালি জীবনের মধ্যে আছে হয়তো কিন্তু সাধারণত এটা চোখে পড়ে না।

আমি সঙ্গপ্রিয়, কিন্তু বেশি লোকের আড্ডা পছন্দ করি না। ঘনিষ্ঠ লোকদের মধ্যে আলাপ-আলোচনাটুকু আমি খুব উপভোগ করি। অনেক মানুষের হইচই এসব আমার ভালো লাগে না। আড্ডা কথাটা আমার কাছে খুব অপ্রয়োজনীয় মনে হয়, আমি বিশেষ করে যাদের সঙ্গে রুচিতে মেলে, দৃষ্টিভঙ্গিতে মেলে তাদের সঙ্গে সময় কাটাতে পছন্দ করি। কিন্তু আড্ডা কথাটা আমার কাছে আলস্য মনে হয়, তবে যারা লেখেন, যারা চিন্তা করেন তাদের মধ্যে পারস্পরিক যোগাযোগটা খুবই জরুরি, বিশেষ করে সমমনাদের মধ্যে।

মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানের আত্মসমর্পণটা আমার কাছে প্রবলভাবে নাড়া দেওয়া প্রিয় মুহূর্ত। আমার কাছে মনে হতো এটা অনেকদিনের একটা কঠিন রোগ, একটা দুঃসহ রোগ, সেটা কেটে গেল। যখন শুনলাম তারা আত্মসমর্পণ করবে, ওই মুহূর্তটা বেশ নাড়া দেয়। আমি তো মনে করি এটা একটা ঐতিহাসিক মুহূর্ত। এবং ওই মুহূর্তে আমি জড়িতও ছিলাম, এই অর্থে যে, আমরা দেশের ভিতর অবরুদ্ধ ছিলাম এবং আমি নিজে জানতাম যে আমার দুই রকমের বিপদ, একটা বিপদ হচ্ছে আমি নাগরিক হিসেবে বাঙালি, আরেকটা বিপদ হচ্ছে চিহ্নিত লোক হিসেবে টিক্কা খানের সমন বার্তা পেয়েছি এবং তারা খুঁজছে এবং এটা পরে প্রমাণিতও হয়েছে যে, ১৪ ডিসেম্বর আমার অনেক সহকর্মী বন্ধু শহীদ হয়েছেন। কিন্তু আমি বেঁচে গেছি, সেটা এই জন্যই যে আমার ঠিকানা তাদের জানা ছিল না, কাজেই আমি জানতাম যে, আমি দুভাবে বিপন্ন।

খেলার মধ্যে ফুটবল খেলা আমার প্রিয় এই কারণে যে, খুবই নাটকীয় এবং দ্রুত হয়। দ্বিতীয়ত, এই খেলা অল্প সময়ের জন্য। এই নাটকীয়তার মধ্যে বহুলোক একসঙ্গে উত্তেজিত হচ্ছে। উত্তেজনার প্রকাশ ঘটছে। আমার মনে হয় এটা একটা সামাজিক খেলা, যেটার মধ্যে মানুষ নিজেদের অনুভূতিগুলো খুব উচ্চকণ্ঠে প্রকাশ করে। এই খেলা ধীরে ধীরে চলে না। এটাতে কোনো অপচয় নেই। তাই ফুটবলই আমার প্রিয় খেলা। আমার প্রিয় ঋতু শীত। এই ঋতুটা খুব উপভোগ্য। খেয়ে-দেয়ে মজা পাই। আমাদের ছেলেবেলায় পিঠা খাওয়ার স্মৃতি, পায়েস খাওয়ার স্মৃতি, আমরা এগুলো শীত এলে খুব উপভোগ করি এখনো। মিষ্টি-ঝাল আমি খুব পছন্দ করি। চিতই পিঠা এখনো আমি পছন্দ করি। ছেলেবেলায়ও এটা আমার খুব পছন্দের ছিল।

লেখক: ইমেরিটাস অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

গণহত্যার সাক্ষী ভাড়াউড়া বধ্যভূমি

প্রকাশ: ০১ মে ২০২৪, ০৩:১৭ পিএম
গণহত্যার সাক্ষী ভাড়াউড়া বধ্যভূমি
শ্রীমঙ্গলের ভাড়াউড়া বধ্যভূমি। ছবি: খবরের কাগজ

‘১৯৭১ সালের ১ মে অর্থাৎ মে দিবস। শনিবার সকাল, দেশে তখন পাক হানাদারদের বিরুদ্ধে চলছে স্বাধীনতা সংগ্রাম। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী নারকীয় ধ্বংসযজ্ঞ চালাচ্ছে দেশজুড়ে। শ্রীমঙ্গল শহরও বাদ যায়নি সেই নারকীয় বর্বরতা থেকে, এখানেও ঘাঁটি গাড়ে হানাদার বাহিনী ও তাদের দোসররা।

শ্রীমঙ্গল চা বাগান অধ্যুষিত হওয়ায় এদিকেই বেশি নজর ছিল পাকবাহিনী ও তাদের দোসরদের। যুদ্ধ পরিস্থিতির কারণে তখন বন্ধ ছিল চা বাগানের সব কার্যক্রম।

এর মধ্যেই সকাল ১০টার দিকে শহরতলীর আউট সিগন্যালের দিক থেকে ভাড়াউড়া চা বাগানের দক্ষিণ দিকে প্রবেশ করে ৫-৬ জন পাক সেনা, তাদের সঙ্গে ছিল এলাকার দফাদার (গ্রাম পুলিশ)। তারা এসেই বাগানের সব পুরুষকে একটি স্থানে মিলিত হতে বলে। পাক সেনারা আমাদের সঙ্গে কথা বলবে বলে জানায়। গ্রাম পুলিশরা জোর করে বাগানের পশ্চিম দিকের একটি স্থানে সবাইকে জড়ো করে। চা শ্রমিকরা কিছু বুঝে ওঠার আগেই ব্রাশফায়ার করে পাক সেনারা। গুলি থামলে বাগানের অন্যরাসহ আমরা সেখানে যাই, গিয়ে দেখি পুরো এলাকা রক্তে লাল হয়ে আছে। একজনের ওপর আরেকজনের লাশ, আমার বাবাও ছিলেন সেই লাশের কাতারে। আমি আর মা মিলে বাবাকে লাশের স্তূপ থেকে টেনে বের করি। তখনো তিনি বেঁচে ছিলেন। কোনো রকমে তাকে বাড়িতে নিয়ে আসি। বাড়িতে নিয়ে আসার পর তিনি মারা যান। সেদিন আমার বাবার সঙ্গে আরও প্রায় ৫০ জন চা-শ্রমিক নিহত হন এই ভাড়াউড়া বধ্যভূমিতে।

আজও যখন এই বধ্যভূমির সামনে দিয়ে যখন যাই তখন একাত্তরের সেই রক্তাক্ত স্মৃতিগুলো চোখের সামনে ভেসে ওঠে। কত লাশ! কত রক্তের সাক্ষী এই বধ্যভূমি, একটি স্বাধীন দেশমাতৃকার আশায় কত ত্যাগ আমাদের স্বীকার করতে হয়েছে।’

মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গলের ভাড়াউড়া বধ্যভূমির সামনে দাঁড়িয়ে কথাগুলো বলছিলেন ভাড়াউড়া চা বাগানের বাসিন্দা ভানু হাজরা।


১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের সময় ভানু হাজরা ১৩ বছর বয়সী কিশোরী। আজো চোখের সামনে দগদগে সেইসব স্মৃতি ভেসে উঠে তার।

তিনি বলেন, ‘সেদিন চা বাগানের প্রবেশপথে আরও দুইজনকে গুলি করে হত্যা করেছিল পাক সেনারা, কিন্তু বাগানের কেউ সেটা আগে জানতে পারেনি। আগে জানতে পারলে মাত্র ৫-৬ জন পাকিস্তানি সেনা একসঙ্গে এতগুলো নিরপরাধ শ্রমিককে মারতে পারতো না।’

ভাড়াউড়া বধ্যভূমিতে গিয়ে দেখা যায়, সেখানে শহিদদের স্মৃতির রক্ষার্থে নির্মাণ করা হয়েছে স্মৃতিস্তম্ভ, পাশেই একটি নামফলকে লেখা আছে শহিদ চা-শ্রমিকদের নাম।

সেদিন পাকবাহিনীর গুলিতে মারা যান- হুসেনিয়া হাজরা, মাংগুয়া হাজরা, ফাগু হাজরা, হিংরাজ হাজরা, কৃষ্ণ হাজরা, চিনিলাল হাজরা, শরজুয়া হাজরা, টিমা হাজরা, শানিচড়া হাজরা, মহারাজ হাজরা, নুনু লাল হাজরা, নকুলা হাজরা, রামলাল হাজারা, জগো হাজরা, বিশ্বম্বর হাজরা, হিরচুয়া হাজরা, শিবমুরা হাজরা, জুহিয়া হাজরা, চুন্মি হাজরা, অমৃত হাজরা, বিরবলি হাজরা, রামদেও হাজরা, হরপুয়া হাজরা, জোচনা হাজরা, রাজকুমার মাল, হরিকুমার হাজরা, রামছুরক হাজরা, গুরুয়া হাজরা, ফেরচুয়া গৌড় , রামকৃষ্ণ গৌড়, রামচরন গৌড়, গবিনা গৌড়, ইন্দ্র ভূঁইয়া, চৈতু ভূইয়া, আগ্না ভূঁইয়া, ডমরুচান্দ তুরিয়া, মাংরা তুরিয়া, ব্রজ নারায়ন গোয়ালা, হোল্লা গোয়ালা, রামলাল মাল, খুদিরাম হাজরা, রাজকুমার মাল, ডুকুয়া তেলি, গংগা বারই, জগদেও কাহার, গংগা কুর্মী, সম মাঝি, কালাচান্দ ঘাটুয়ার, সুখনন্দন রিকিয়াসন, বকই রেলী, শিব মুন্ডা।

আহত হয়েছিলেন কেদার লাল হাজরা, গোলাপ চান্দ হাজরা, রামদাড়ী হাজরা, জুবায়ের হাজরা, চিনিয়া হাজরা, কর্মা হাজরা, ডিকুয়া হাজরা, কাইলা হাজরা, বাংসিং তুরিয়াসহ অনেকে।

শ্রীমঙ্গল ভিক্টোরিয়া উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রাক্তন শিক্ষক কবি ও লেখক দ্বীপেন্দ্র ভট্টাচার্যের লেখা ‘ফিরে দেখা’ বইয়ে এই বধ্যভূমিতে চা-শ্রমিকদের নির্মমভাবে হত্যার ঘটনা তুলে ধরা হয়েছে।

সেখানে তিনি লিখেছেন, পাকবাহিনীর শ্রীমঙ্গল দখল, ১৯৭১ সালের ২৭ এপ্রিল পাক বিমান বাহিনী শ্রীমঙ্গলে শেলিং করে। পরে ৩০ এপ্রিল দুপুর ১১টা-১২টার দিকে পাক বিমানবাহিনী শ্রীমঙ্গলে প্রবেশ করে। ২৭ এপ্রিলের শেলিং এ শ্রীমঙ্গলের দুইজন নিহত ও একজন আহত হন। নিহত দুইজনের একজন গৌরাঙ্গ মল্লিক ও অপরজন বাসাবাড়িতে কাজ করার এক নারী। ৩০ এপ্রিল শ্রীমঙ্গলে আস্তানা করার পর প্রবেশের পরদিন পহেলা মে পাকবাহিনী তাদের তাণ্ডবলীলা শুরু করে। শহরের পার্শ্ববর্তী ভাড়াউড়া চা বাগানে বহু চা-শ্রমিককে একসঙ্গে দাঁড় করিয়ে গুলি করে হত্যা করে। এ নির্মম হত্যাকাণ্ড স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে শ্রীমঙ্গলের এক মর্মান্তিক ঘটনা।

বাংলাদেশ চা শ্রমিক ইউনিয়নের সাংগঠনিক সম্পাদক ও ভাড়াউড়া বধ্যভূমিতে নিহত হওয়া ফাগু হাজরার ছেলে বিজয় হাজরা বলেন, ‘ওইদিনের ঘটনার পর সব লাশ একসঙ্গে জড়ো করে মাটিচাপা দেওয়া হয় এবং আমরা চা বাগান ছেড়ে প্রাণ বাঁচাতে পালিয়ে যাই। মুক্তিযুদ্ধের পর মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের কর্মকর্তারা এসে এখানের মাটি খুঁড়ে মাথার খুলি গণনা করেন।’

তিনি আক্ষেপ করে বলেন, ‘চা-শ্রমিকদের ওপর পাক হানাদার বাহিনীর এই নির্মম গণহত্যাকাণ্ডের জায়গাটি এক প্রকার অবহেলিতই বলা চলে। এখানে যারা মারা গিয়েছিলেন তাদের নাম উল্লেখ করে আমি নিজ উদ্যোগে এখানে একটি নামফলক করেছি। সরকারের কাছে আবেদন এই বধ্যভূমির মর্মান্তিক ঘটনা তুলে ধরে এখানে একটি ভাস্কর্য করে দেওয়া হোক। যাতে এই প্রজন্মের সবাই জানতে পারে আমরা সেদিন কতটুকু নির্মমতার শিকার হয়েছিলাম পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর দ্বারা।’

হৃদয় শুভ/ইসরাত চৈতী/

আজ ঐতিহাসিক মুজিবনগর দিবস

প্রকাশ: ১৭ এপ্রিল ২০২৪, ০৮:১৯ এএম
আজ ঐতিহাসিক মুজিবনগর দিবস
ঐতিহাসিক মুজিবনগর

আজ ১৭ এপ্রিল ঐতিহাসিক মুজিবনগর দিবস। ১৯৭১ সালের এই দিনে বাংলাদেশের প্রথম সরকারের শপথ গ্রহণের মাধ্যমে শুরু হয় স্বাধীন বাংলাদেশের আনুষ্ঠানিক যাত্রা। ১০ এপ্রিল গঠিত সরকারের শপথ অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয় ১৭ এপ্রিল তৎকালীন মেহেরপুর মহকুমার  বৈদ্যনাথতলার আম্রকাননে। নতুন অস্থায়ী সরকারের উপস্থিতিতে পাঠ করা হয় স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র। স্বাধীনতার সূতিকাগার হিসেবে ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে যায় আম্রকাননটি। পরে বৈদ্যনাথতলাকে নামকরণ করা হয় মুজিবনগর। 

সৈয়দ নজরুল ইসলামকে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি ও তাজউদ্দীন আহমদকে প্রধানমন্ত্রী করা হয়। মন্ত্রিসভায় স্থান পান এম মনসুর আলী অর্থ, বাণিজ্য ও শিল্পমন্ত্রী হিসেবে। এ এইচ এম কামারুজ্জামানকে দেওয়া হয় স্বরাষ্ট্র, সরবরাহ, ত্রাণ, পুনর্বাসন ও কৃষি মন্ত্রণালয়। খন্দকার মোস্তাক পান পররাষ্ট্র, আইন ও সংসদবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব। জেনারেল আতাউল গনি ওসমানীকে দায়িত্ব দেওয়া হয় মুক্তিবাহিনীর প্রধান কমান্ডার হিসেবে। এ ছাড়া সরকারের ১৫টি মন্ত্রণালয় ও বিভিন্ন বিভাগের পাশাপাশি মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন ১১টি সেক্টরে কমান্ডার নিয়োগ দেওয়া হয় ওই শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানে। 

আব্দুল মান্নান এমএনওর পরিচালনায় স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র পাঠ করেন অধ্যাপক ইউসুফ আলী। পরে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলামকে প্রদান করা হয় গার্ড অব অনার। আনুষ্ঠানিকতায় মিষ্টি বিতরণ শেষে ভারতের উদ্দেশে যাত্রা করেন নবগঠিত সরকারের নেতারা। এ ঘটনার সাক্ষী হিসেবে মুজিবনগরের আম্রকাননে উপস্থিত ছিলেন ভারত থেকে আগত দেশি-বিদেশি সাংবাদিক,  ভারতীয় সৈনিক ও মুজিবনগরের স্থানীয় ব্যক্তিরা। 

বর্তমানে স্বাধীনতার সূতিকাগার এই আম্রকাননকে ঘিরে তৈরি করা হয়েছে মুজিবনগর মুক্তিযুদ্ধ স্মৃতি কমপ্লেক্স। তৈরি করা হয়েছে স্মৃতিসৌধ, মানচিত্র, মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিময় নানা স্থাপনা। দিবসটি উপলক্ষে নানা আয়োজনের ব্যবস্থা করা হয়েছে। মূল অনুষ্ঠান হবে মুজিবনগর স্মৃতি কমপ্লেক্সে। দিনটিকে ঘিরে মেহেরপুরজুড়ে এখন সাজ সাজ রব। দিবসটি পালন উপলক্ষে মুজিবনগর আম্রকাননে মন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের বেশ কয়েকজন জ্যেষ্ঠ নেতা আসবেন। জনপ্রশাসনমন্ত্রী ফরহাদ হোসেন বলেছেন, সমাবেশস্থলে অর্ধলক্ষাধিক মানুষের সমাগম ঘটবে। পুলিশ সুপার এস এম নাজমুল হক জানান, পুরো মুজিবনগর কমপ্লেক্স নিরাপত্তার চাদরে ঢেকে দেওয়া হবে। থাকবে তিন স্তরবিশিষ্ট নিরাপত্তাবলয়। সিসি ক্যামেরার মাধ্যমে পুরো সমাবেশস্থল নিয়ন্ত্রণ করা হবে। এ ছাড়া সাদাপোশাকে কাজ করবে পুলিশ। থাকবে বোমা নিষ্ক্রিয়করণ ইউনিট। কোনোভাবেই যাতে ছোটখাটো কোনো অপরাধ সংঘটিত না হয়, সেই লক্ষ্যে কাজ করবে পুলিশ।

ঐতিহাসিক মুজিবনগর দিবসে কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের কর্মসূচি
ঐতিহাসিক মুজিবনগর দিবস উপলক্ষে আওয়ামী লীগ ও দলের সহযোগী সংগঠনগুলো গুরুত্বের সঙ্গে বিভিন্ন কর্মসূচি হাতে নিয়েছে। এসব কর্মসূচির মধ্যে রয়েছে ভোর ৬টায় বঙ্গবন্ধু ভবন, কেন্দ্রীয় কার্যালয় এবং সারা দেশে সংগঠনের সব কার্যালয়ে জাতীয় ও দলীয় পতাকা উত্তোলন। সকাল ৭টায় বঙ্গবন্ধু ভবন প্রাঙ্গণে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতিকৃতিতে শ্রদ্ধা নিবেদন।

এদিকে মুজিবনগরের কর্মসূচির মধ্যে রয়েছে ভোর ৬টায় জাতীয় ও দলীয় পতাকা উত্তোলন। সকাল সাড়ে ৯টায় স্মৃতিসৌধে শ্রদ্ধা নিবেদন। সকাল ৯টা ৪৫ মিনিটে গার্ড অব অনার। সকাল ১০টায় শেখ হাসিনা মঞ্চে মুজিবনগর দিবসের জনসভা অনুষ্ঠিত হবে।

জনসভায় প্রধান অতিথি হিসেবে থাকবেন আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য কাজী জাফর উল্লাহ, বিশেষ অতিথি হিসেবে থাকবেন আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য এবং মহিলা ও শিশুবিষয়ক প্রতিমন্ত্রী সিমিন হোসেন রিমি, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুবউল আলম হানিফ এমপি, সাংগঠনিক সম্পাদক এস এম কামাল হোসেন এমপি, অ্যাডভোকেট আফজাল হোসেন, সম্মানিত অতিথি হিসেবে থাকবেন মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক। জনসভায় সভাপতিত্ব করবেন আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম এমপি। সঞ্চালনা করবেন দলের সাংগঠনিক সম্পাদক বি এম মোজাম্মেল হক।

ঐতিহাসিক তেলিয়াপাড়া দিবস ৪ এপ্রিল

প্রকাশ: ০৪ এপ্রিল ২০২৪, ০৩:০৩ পিএম
ঐতিহাসিক তেলিয়াপাড়া দিবস ৪ এপ্রিল
তেলিয়াপাড়া চা বাগানের ম্যানেজার বাংলোর পাশে নির্মিত বুলেট আকৃতির মুক্তিযুদ্ধের প্রথম স্মৃতিসৌধ। ছবি: খবরের কাগজ

আজ ৪ এপ্রিল, ঐতিহাসিক তেলিয়াপাড়া দিবস। ১৯৭১ সালের এই দিনে হবিগঞ্জের মাধবপুর উপজেলার তেলিয়াপাড়া চা বাগান ম্যানেজার বাংলোতে মুক্তিযুদ্ধের প্রথম বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়েছিল।

এ বৈঠকেই দেশকে স্বাধীন করার শপথ ও রণকৌশল তৈরি হয়। এ বৈঠকেই অস্ত্রের জোগান ও আন্তর্জাতিক সমর্থনসহ গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেওয়া এবং মুক্তিযুদ্ধের রণাঙ্গনকে ভাগ করা হয় ১১টি সেক্টর ও তিনটি ব্রিগেডে। 

ওই দিনের বৈঠকে ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের ঊর্ধ্বতন ২৭ সেনা কর্মকর্তার মধ্যে উপস্থিত ছিলেন- মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক আতাউল গণি ওসমানী, তৎকালীন মেজর সি আর দত্ত, মেজর জিয়াউর রহামন, কর্নেল এম এ রব, রব্বানী, ক্যাপ্টেন নাসিম, আব্দুল মতিন, মেজর খালেদ মোশাররফ, কমান্ডেন্ট মানিক চৌধুরী, ভারতের ব্রিগেডিয়ার শুভ্রমানিয়ম ও মেজর কে এম শফিউল্লাহ প্রমুখ।

শপথগ্রহণের পর এম এ জি ওসমানী নিজের পিস্তল থেকে ফাঁকা গুলি ছুড়ে যুদ্ধের আনুষ্ঠানিকতা করেন।

দেশ স্বাধীন হওয়ার পর শহিদ মুক্তিযোদ্ধাদের স্মরণে তেলিয়াপাড়া চা বাগানের ম্যানেজার বাংলোর পাশে নির্মিত হয় বুলেট আকৃতির মুক্তিযুদ্ধের প্রথম স্মৃতিসৌধ। ১৯৭৫ সালের জুন মাসে এ স্মৃতিসৌধের উদ্বোধন করেন সেনাপ্রধান (অব.) মেজর জেনারেল শফিউল্লাহ বীর উত্তম।

দীর্ঘদিন ধরে ওই স্থানটিকে সংরক্ষণ ও চা বাগান বাংলোতে মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি জাদুঘর নির্মাণের দাবি জানিয়ে আসছেন মুক্তিযোদ্ধা ও সুশীল সমাজের প্রতিনিধিরা। এমনকি ২০১১ সালের ৭ মে মুক্তিযোদ্ধাদের এক সমাবেশে সেখানে ১০ কোটি টাকা ব্যয়ে মুক্তিযোদ্ধা কমপ্লেক্স করার সিদ্ধান্তও নেওয়া হয়। কিন্তু এখনো এই প্রকল্প আলোর মুখ না দেখায় হতাশ মুক্তিযোদ্ধারা।

এ ব্যাপারে বীর মুক্তিযোদ্ধা গোলাম মোস্তফা রফিক বলেন, ‘তেলিয়াপাড়া চা বাগান বাংলো মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম ঐতিহাসিক স্থান। এখান থেকে মূলত মুক্তিযুদ্ধের সূচনা হয়। কিন্তু স্বাধীনতার এত বছর পরও ওই স্থানটিকে সংরক্ষণ করা হয়নি। বিষয়টি আমাদের জন্য খুবই দুঃখজনক বিষয়।’

পরিবেশ ও সংস্কৃতিকর্মী তোফাজ্জল সোহেল বলেন, ‘বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে তেলিয়াপাড়া চা বাগানের বাংলোটি একটি অন্যতম ঐতিহাসিক স্থান। কিন্তু দুঃখের বিষয়, স্বাধীনতার পর ৫৩ বছর পেরিয়ে গেলেও বাংলোটিকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠেনি কোনো স্মৃতি জাদুঘর।’

তিনি বলেন, ‘ওই সময়ে বাংলোতে ব্যবহৃত আসবাবপত্র, ফাইলপত্র এবং অন্যান্য সামগ্রী যথাযথ সংরক্ষণ/ সংগ্রহ করে তেলিয়াপাড়া বাংলোটিকে এখনো মুক্তিযুদ্ধ স্মৃতি জাদুঘরে পরিণত করা সম্ভব। এর মাধ্যমে আগামী প্রজন্ম মুক্তিযুদ্ধের এক গৌরবতম ইতিহাস সম্পর্কে জানার সুযোগ পাবে।’

কাজল সরকার/ইসরাত চৈতী/অমিয়/

হোমনা মুক্ত দিবস ২৩ ডিসেম্বর

প্রকাশ: ২৩ ডিসেম্বর ২০২৩, ০৩:৩৬ পিএম
হোমনা মুক্ত দিবস ২৩ ডিসেম্বর
ছবি-খবরের কাগজ

আজ ২৩ ডিসেম্বর, কুমিল্লা জেলার হোমনা উপজেলা মুক্ত দিবস। ১৬ ডিসেম্বর যখন সারা দেশ বিজয়ের আনন্দে উদ্বেলিত তখনো শক্রমুক্ত হতে পারেনি হোমনাবাসী। ২২ ডিসেম্বর পর্যন্ত উপজেলার ঘাগুটিয়া গ্রামে পাকিস্তানি বাহিনীর সঙ্গে তুমুল যুদ্ধে লিপ্ত হন এই অঞ্চলের মানুষ। অবশেষে ১৯৭১ সালের ২৩ ডিসেম্বর বাঞ্ছারামপুর, দাউদকান্দি, মুরাদনগর ও কুমিল্লার ময়নামতি ক্যান্টনমেন্ট থেকে মুক্তিযোদ্ধা ও যৌথ বাহিনীর ট্যাংক আক্রমণের পর সম্পূর্ণরূপে শক্রমুক্ত হয় ঘাগুটিয়া গ্রাম তথা কুমিল্লার হোমনা থানা। 

ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী ঘাগুটিয়া গ্রামের বীর মুক্তিযোদ্ধা সোবহান মিয়া জানান, বিজয়ের প্রাক্কালে ১৪ ডিসেম্বর সকালে সূর্যোদয়ের সময় ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বাঞ্ছারামপুর ক্যাম্প থেকে লঞ্চযোগে পালিয়ে যাচ্ছিল পাকিস্তানি শতাধিক সেনার একটি দল। পালিয়ে হোমনার ঘাগুটিয়া লঞ্চঘাটের অদূরে আসা মাত্রই বাঞ্ছারামপুর ও হোমনার মুক্তিসেনারা একযোগে আক্রমণ করে। নিরুপায় হয়ে ঘাগুটিয়া পাকা মসজিদে আশ্রয় নেয়। 

পাকিস্তানি বাহিনী গ্রামে ঢুকেই মসজিদের পাশে দারোগা সিদ্দিকুর রহমান ও ভূঁইয়া বাড়িসহ আশপাশের ৪০-৫০টি বাড়িতে আগুন দেয় এবং উপর্যুপরি গুলি চালায়।

এ সময় ঘাগুটিয়া ও ভবানীপুর গ্রামের অধিবাসীরা বাড়িঘর, সহায় সম্পত্তির মায়া ত্যাগ করে পার্শ্ববর্তী মাধবপুর, রামপুর ও নালাদক্ষিণ গ্রামে আশ্রয় নেয়। 

এ খবর মুরাদনগর ও দাউদকান্দির মুক্তিসেনাদের কাছে পৌঁছালে শতাধিক মুক্তিসেনা ঘাগুটিয়া যুদ্ধে অংশ নেয়। পরে ময়নামতি ক্যান্টনমেন্ট থেকে ট্যাংক নিয়ে আসা মিত্র বাহিনীর সহায়তায় ঘাগুটিয়া মুক্ত হয়।

ঘাগুটিয়া যুদ্ধে দুজন মুক্তিযোদ্ধাসহ গ্রামের ২০ নারী-পুরুষ শহিদ হন এবং শতাধিক গ্রামবাসী ও এফএফ কমান্ডার আব্দুল আউয়ালসহ অনেক মুক্তিযোদ্ধা আহত হন। পাকিস্তানি বাহিনীর হাতে শহিদরা হলেন- সৈয়দ আলী প্রধান, কিসমত আলী প্রধান, আছমত আলী প্রধান, ছন্দু মিয়া, লাল মিয়া (লালা), দেওয়ান আলী ভূঁইয়া, জবা মিয়া, আমজত আলী হাজি (ভবানীপুর), কাশেম মিয়া (কাছম), খোরশেদ পাগলা, আইয়ুবের নেছা, মনজুরের নেছা, কালা মিয়া প্রধানের মা, হাওয়া, লালু মিয়া, গোলবরের নেছা, জাবেদ আলী, মুক্তিযোদ্ধা আলেক মিয়া, মুক্তিযোদ্ধা মতিউর রহমান মতি।

ঘাগুটিয়া গ্রামে ’৭১-এর মুক্তিযুদ্ধে স্বাধীনতা ইতিহাসের কালের সাক্ষী হয়ে আজও দাঁড়িয়ে আছে ঘাগুটিয়া জামে মসজিদটি। পরবর্তী সময়ে ঐতিহাসিক মসজিদ ও স্কুলের পাশে গণকবরটি চিহ্নিত করে তা সংস্কার করা হয়েছে। 

এদিকে প্রতি বছরের মতো এবারও ২৩ ডিসেম্বর হোমনা মুক্ত দিবস উপলক্ষে উপজেলা প্রশাসন ও মুক্তিযোদ্ধাদের সমন্বয়ে ব্যাপক কর্মসূচি পালন করা হচ্ছে।

উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) রুমন দে বলেন, ‘দিবসটি উপলক্ষে শনিবার উপজেলা চত্বর থেকে র‌্যালি এবং ঘাগুটিয়ায় আলোচনা সভা ও মিলাদের আয়োজন করা হয়েছে।’

ইসরাত/অমিয়/

এখনো থামেনি বীরাঙ্গনাদের কান্না

প্রকাশ: ২০ ডিসেম্বর ২০২৩, ০২:৫৩ পিএম
এখনো থামেনি বীরাঙ্গনাদের কান্না
ছবি-সংগৃহীত

‘ভাদ্র মাসে বড় একটি নৌকায় করে জগন্নাথপুর গ্রামের প্রায় এক শর ওপরে মানুষ অন্য এক জায়গায় (সম্ভবত বাল্লা এলাকায়) যাচ্ছিলেন। এ সময় পথে আমাদের নৌকা আটকায় পাকিস্তানি মিলিটারিরা। প্রথমে তারা নৌকার মাঝিকে গুলি করে মেরে ফেলে। পরে আমার স্বামী নরেশ দাশকে গুলি করে। একপর্যায়ে পাকিস্তানি মিলিটারি আমাদের নৌকায় উঠে আরও বেশ কয়েকজনকে মেরে ফেলে। এ সময় আমার কোল থেকে ৮ মাসের ছেলেসন্তানকে কেড়ে নিয়ে নদীতে ফেলে দেয় হানাদার বাহিনী।

‘এভাবেই জীবনের দুর্বিষহ সেই দিনের কথা মনে করেন হবিগঞ্জের নবীগঞ্জ উপজেলার বাল্লা-জগন্নাথপুর গ্রামের মেয়ে লক্ষ্মীপ্রিয়া বৈষ্ণবী। অথচ বিজয়ের ৫৩ বছরেও বীরাঙ্গনা হিসেবে স্বীকৃতি মেলেনি তার।’ 

‘কুড়িগ্রাম সদরের বেলগাছা ইউনিয়নের আছমা বেগম। যাকে পাকসেনারা একবার নির্যাতন করে ছেড়ে দেয়। তারা চলে গেলে দেখতে পান তার বাম পায়ের কেনি আঙুল ছিঁড়ে যাওয়ার মতো। রক্ত ঝরছে টপটপ করে! সেখান থেকে দৌড়ে পালানোর চেষ্টা করেন। পাশের এক বাড়িতে গিয়ে কাপড় সেলাইয়ের সুঁই নিয়ে পাটের আঁশ দিয়ে পায়ের আঙুল সেলাই করে আবার পথচলা শুরু করেন তিনি। কিন্তু পথে সেনারা ধাওয়া করে ধরে নিয়ে গিয়ে আবারও নির্যাতন করে। সেখান থেকে শুরু পাকিস্তানি সেনাদের ধারাবাহিক নির্যাতন। যার পুরোটা এখন আর বলতে চান না তিনি।’ তবে খবরের কাগজকে প্রশ্ন করেন, ‘এসব বলে কী হবে? এই খাতায় নাম দিয়ে এখন পরিবার, সমাজে হয়েছি ঘৃণার পাত্র। আবেদনের ১৪ বছরেও বীরাঙ্গনার তালিকায় নাম ওঠেনি তার। পান না সরকারি কোনো সুযোগ-সুবিধা।’

মুক্তিযুদ্ধের সময় ১৮ বছর বয়স ছিল ময়মনসিংহের ফুলপুর উপজেলার ছনধারা ইউনিয়নের লাউয়ারী গ্রামের মেয়ে শহর বানু। এ সময় আব্দুল খালেক নামে তার ৭ বছরের এক সন্তান ছিল তার। যুদ্ধ শুরু হয়েছে। একদিন গ্রামে প্রবেশ করে পাকিস্তানি বাহিনী। চারদিকে ছোটাছুটি করতে থাকে লোকজন। তবে শহর বানু ঘর থেকে বের হওয়ার আগেই চারপাশ ঘিরে ফেলে হানাদার বাহিনী। এ সময় পাশবিক নির্যাতন করা হয় তাকে। এরপর থেকে শহর বানুকে অনেকে বাঁকা চোখে দেখতে শুরু করেন। আর এ কলঙ্কের বোঝা নিয়েই আজও চলছেন তিনি।  বলেন, ‌‘মুক্তিযুদ্ধের সময় আমি নির্যাতিত হয়েছি। বয়সের ভারে এখন কোনো অফিসে গিয়ে যোগাযোগ করার মতো শক্তি আমার নেই। জীবনের এই শেষবেলায় বীরাঙ্গনা হিসেবে রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি চাই।’

বলা হয় মুক্তিযুদ্ধে ৩০ লাখ মানুষের শহিদ হওয়া ও লাখ লাখ নারীর সম্ভ্রম বিসর্জনের বিনিময়ে এসেছে বাংলাদেশের স্বাধীনতা। যদিও এ নিয়ে উঠেছিল বিতর্ক। কিন্তু একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারে গঠিত আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল ২২ অক্টোবর ২০২১ সালে এক রায়ে বলেন, ‘মুক্তিযুদ্ধে ৩০ লাখ মানুষের শহিদ  হওয়া ও লাখ লাখ নারীর সম্ভ্রম বিসর্জন প্রতিষ্ঠিত ইতিহাস। এই ইতিহাস মুক্তিযুদ্ধের পবিত্র আবেগ ও গৌরবের মধ্যে মিশে আছে।’ এখানে সংখ্যা উল্লেখ না থাকলেও লাখ লাখ নারীর সম্ভ্রম বিসর্জনের কথা বলা হয়েছে। অন্যদিকে সর্বশেষ ২০২১ সালের তথ্য অনুযায়ী সরকারের গেজেট আকারে প্রকাশ করা বীরাঙ্গনাদের সংখ্যা ৪৩৮ জন।

অন্যদিকে ‘মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের ম্যানেজমেন্ট ইনফরমেশন সিস্টেমের (এমআইএস) গেজেটভুক্ত বীরাঙ্গনার সংখ্যা হালনাগাদ নয়। সরকারি তালিকায় এখন পর্যন্ত মোট বীরাঙ্গনা মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা ৪৪৮ হলেও লিপিবদ্ধ করা হয়েছে ৪০২ জনের নাম। এর মধ্যে ৮৯ জন বীরাঙ্গনারই নামে রয়েছে বানানসহ বিভিন্ন ধরনের ভুল। পিতা বা স্বামীর নামের ক্ষেত্রে বানান ও পদবির ভুল, এমনকি ভিন্ন ভিন্ন নাম রয়েছে ২০৭ জনের। বিভিন্ন আমলাতান্ত্রিক জটিলতার সঙ্গে এমন তথ্যগত ভুল বীরাঙ্গনাদের অধিকার আদায়ের ক্ষেত্রে বিড়ম্বনা তৈরি করছে।’

এমন তথ্য উঠে এসেছে গত বছরের ১৬ জুন ট্র্যান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবির) ‘বীরাঙ্গনাদের রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি ও অধিকার: সুশাসনের চ্যালেঞ্জ এবং উত্তরণের উপায়’ শীর্ষক গবেষণা প্রতিবেদনে।

কিন্তু তাহলে প্রশ্ন ওঠে বাকি বীরাঙ্গনাদের কী হলো? কোথায় আছেন? কেমন আছেন তারা? এখনো দেশের আনাচে-কানাচে অনেক বীরাঙ্গনার কান্না শোনা যায় স্বীকৃতি না পাওয়ার কষ্টে। একটি বাংলাদেশের জন্ম দিতে লক্ষ্মীপ্রিয়া, আছমা বেগম, শহর বানুর মতো ত্যাগ স্বীকার করেছেন অনেক নারী। তবে স্বীকৃতি মেলেনি এখনো।

এ বিষয়ে টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান বলেন, ‘স্বাধীনতার এত বছর পরে এসে সরকারিভাবে বীরাঙ্গনাদের স্বীকৃতি আমাদের জন্য অনেক আনন্দের ছিল। কিন্তু এ ক্ষেত্রে প্রত্যাশার তুলনায় এখন অনেক বেশি অপ্রাপ্তি রয়েছে। জাতীয়ভাবে গুরুত্বপূর্ণ বলা হলেও, তুলনামূলক কম আলোচিত প্রসঙ্গ হচ্ছে বীরাঙ্গনাদের রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি ও অধিকার।’

বীরাঙ্গনাদের চিহ্নিত করা থেকে শুরু করে রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি ও সুযোগ-সুবিধা প্রদানের পুরো প্রক্রিয়ায় নানা ঘাটতির বিভিন্ন দিক উঠে এসেছে, যখন আমরা কাজ করতে গিয়েছি তখন। এর মধ্যে বীরাঙ্গনাদের আবেদন নিষ্পত্তির সময়সীমা নির্ধারণ না থাকা, পরিকল্পনাহীনতা, প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতার ঘাটতি, অনিয়ম-দুর্নীতির সঙ্গে রয়েছে স্থানীয় পর্যায়ে সামাজিক-সাংস্কৃতিক নেতিবাচক মনোভাব। পাশাপাশি এখন একটি বড় সিন্ডিকেট গড়ে উঠেছে, যেখানে বীরাঙ্গনার স্বীকৃতি পেতে হলে টাকা দিতে হবে একটি মহলকে। এ ছাড়া বীরাঙ্গনাদের পরিবারও অনেক সময় সহযোগিতা করছে না তাদের পরিচয় প্রকাশে। আবার যেসব পরিবার সহযোগিতা করছে তারা ওই বীরাঙ্গনার প্রাপ্য সুবিধা নিজেরা ভোগ করছেন বলেও অভিযোগ আছে।    

এ ছাড়া বীরাঙ্গনাদের নিয়ে কাজ করছে বেসরকারি প্রতিষ্ঠান নারীপক্ষ। সরকারি তালিকার বাইরে এ পর্যন্ত ৯৯ জনের তালিকা করেছিল প্রতিষ্ঠানটি। এর মধ্যে মারা গেছেন ১৬ জন। আর ৫১ জনকে মাসিক ভাতা দেওয়া হচ্ছে নারীপক্ষের পক্ষ থেকে। আর তাদের তালিকায় থাকা ৩২ জনের নাম উঠেছে সরকারি তালিকায়।

কেন বীরাঙ্গনারা দ্রুত তালিকাভুক্ত হচ্ছে না জানতে চাইলে নারীপক্ষের সদস্য নাজনীন সুলতানা রত্না খবরের কাগজকে বলেন, ‘মাঠপর্যায়ে বীরাঙ্গনাদের সঙ্গে আমরা কাজ করতে গেলে অনেকেই অভিযোগ করেন সরকারের পক্ষে কেউ এসে তাদের খোঁজ নেয়নি। আবার অনেকের ভ্যারিফিকেশন হয়েছে কিন্তু এখনো গেজেটে  নাম আসেনি। অনেকে আবার আবেদন করে রেখেছেন কিন্তু তার পরে আর কিছুই এগোয়নি। কারও কারও অভিযোগ আছে, একটি চক্র তাদের কাছে তালিকায় নাম তুলে দেওয়ার জন্য টাকা চেয়েছেন। টাকা না দেওয়ায় কাজ আটকে আছে। যে বীরাঙ্গনাদের সম্ভ্রমের বিনিময়ে আমরা আজ স্বাধীনতা পেয়েছি, স্বাধীন দেশে বাস করছি তাদের কী এমন অবহেলায় থাকার কথা? এ প্রশ্ন করে নাজনীন সুলতানা রত্না বলেন, বীরাঙ্গনাদের তাদের প্রাপ্য মর্যাদা দেওয়া উচিত। একজন মুক্তিযোদ্ধা যে সম্মান, সুযোগ-সুবিধা নিয়ে বেঁচে আছেন বীরাঙ্গনাদেরও সে মর্যাদা যত দ্রুত সম্ভব দেওয়া উচিত। কারণ তাদের বয়স হয়েছে। অনেকে তো মারাও গেছেন। কিন্তু যারা বেঁচে আছেন তাদের মধ্যে অনেকে মানবেতর জীবনযাপন করছেন। অনেকে ভিক্ষাও করছেন। 

এ সমস্যার সমাধান কী জানতে চাইলে নাজনীন সুলতানা রত্না বলেন, সরকারের সদিচ্ছা প্রয়োজন। কাজগুলোকে দ্রুত এগিয়ে নিতে হবে। যেন তারা বেঁচে থাকতে থাকতে অন্তত স্বীকৃতি পান। একটু ভালোভাবে মর্যাদার সঙ্গে বাঁচতে পারেন। 

এ সমস্যা সমাধানের বিষয়ে ইফতেখারুজ্জামান খবরের কাগজকে বলেন, ‘বীরাঙ্গনারা যে বীর, সে বিষয়টি বেশি বেশি প্রচার করা দরকার। এ জন্য রাষ্ট্রীয়ভাবে উদ্যোগ নেওয়া দরকার। পাশাপাশি তাদের তালিকায় আনার জন্য কাজ করার সরকারি সংস্থা জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিলকে (জামুকা) আরও তৎপর হতে হবে। কাজটি দ্রুত করার ব্যবস্থা করতে হবে। যারা সিন্ডিকেট করে বীরাঙ্গনাদের তালিকায় আনার জন্য অর্থ নিচ্ছেন ও কার্যক্রমটি দীর্ঘ করছেন তাদের চিহ্নিত করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তিরও ব্যবস্থা করতে হবে।’