‘ভাদ্র মাসে বড় একটি নৌকায় করে জগন্নাথপুর গ্রামের প্রায় এক শর ওপরে মানুষ অন্য এক জায়গায় (সম্ভবত বাল্লা এলাকায়) যাচ্ছিলেন। এ সময় পথে আমাদের নৌকা আটকায় পাকিস্তানি মিলিটারিরা। প্রথমে তারা নৌকার মাঝিকে গুলি করে মেরে ফেলে। পরে আমার স্বামী নরেশ দাশকে গুলি করে। একপর্যায়ে পাকিস্তানি মিলিটারি আমাদের নৌকায় উঠে আরও বেশ কয়েকজনকে মেরে ফেলে। এ সময় আমার কোল থেকে ৮ মাসের ছেলেসন্তানকে কেড়ে নিয়ে নদীতে ফেলে দেয় হানাদার বাহিনী।
‘এভাবেই জীবনের দুর্বিষহ সেই দিনের কথা মনে করেন হবিগঞ্জের নবীগঞ্জ উপজেলার বাল্লা-জগন্নাথপুর গ্রামের মেয়ে লক্ষ্মীপ্রিয়া বৈষ্ণবী। অথচ বিজয়ের ৫৩ বছরেও বীরাঙ্গনা হিসেবে স্বীকৃতি মেলেনি তার।’
‘কুড়িগ্রাম সদরের বেলগাছা ইউনিয়নের আছমা বেগম। যাকে পাকসেনারা একবার নির্যাতন করে ছেড়ে দেয়। তারা চলে গেলে দেখতে পান তার বাম পায়ের কেনি আঙুল ছিঁড়ে যাওয়ার মতো। রক্ত ঝরছে টপটপ করে! সেখান থেকে দৌড়ে পালানোর চেষ্টা করেন। পাশের এক বাড়িতে গিয়ে কাপড় সেলাইয়ের সুঁই নিয়ে পাটের আঁশ দিয়ে পায়ের আঙুল সেলাই করে আবার পথচলা শুরু করেন তিনি। কিন্তু পথে সেনারা ধাওয়া করে ধরে নিয়ে গিয়ে আবারও নির্যাতন করে। সেখান থেকে শুরু পাকিস্তানি সেনাদের ধারাবাহিক নির্যাতন। যার পুরোটা এখন আর বলতে চান না তিনি।’ তবে খবরের কাগজকে প্রশ্ন করেন, ‘এসব বলে কী হবে? এই খাতায় নাম দিয়ে এখন পরিবার, সমাজে হয়েছি ঘৃণার পাত্র। আবেদনের ১৪ বছরেও বীরাঙ্গনার তালিকায় নাম ওঠেনি তার। পান না সরকারি কোনো সুযোগ-সুবিধা।’
মুক্তিযুদ্ধের সময় ১৮ বছর বয়স ছিল ময়মনসিংহের ফুলপুর উপজেলার ছনধারা ইউনিয়নের লাউয়ারী গ্রামের মেয়ে শহর বানু। এ সময় আব্দুল খালেক নামে তার ৭ বছরের এক সন্তান ছিল তার। যুদ্ধ শুরু হয়েছে। একদিন গ্রামে প্রবেশ করে পাকিস্তানি বাহিনী। চারদিকে ছোটাছুটি করতে থাকে লোকজন। তবে শহর বানু ঘর থেকে বের হওয়ার আগেই চারপাশ ঘিরে ফেলে হানাদার বাহিনী। এ সময় পাশবিক নির্যাতন করা হয় তাকে। এরপর থেকে শহর বানুকে অনেকে বাঁকা চোখে দেখতে শুরু করেন। আর এ কলঙ্কের বোঝা নিয়েই আজও চলছেন তিনি। বলেন, ‘মুক্তিযুদ্ধের সময় আমি নির্যাতিত হয়েছি। বয়সের ভারে এখন কোনো অফিসে গিয়ে যোগাযোগ করার মতো শক্তি আমার নেই। জীবনের এই শেষবেলায় বীরাঙ্গনা হিসেবে রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি চাই।’
বলা হয় মুক্তিযুদ্ধে ৩০ লাখ মানুষের শহিদ হওয়া ও লাখ লাখ নারীর সম্ভ্রম বিসর্জনের বিনিময়ে এসেছে বাংলাদেশের স্বাধীনতা। যদিও এ নিয়ে উঠেছিল বিতর্ক। কিন্তু একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারে গঠিত আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল ২২ অক্টোবর ২০২১ সালে এক রায়ে বলেন, ‘মুক্তিযুদ্ধে ৩০ লাখ মানুষের শহিদ হওয়া ও লাখ লাখ নারীর সম্ভ্রম বিসর্জন প্রতিষ্ঠিত ইতিহাস। এই ইতিহাস মুক্তিযুদ্ধের পবিত্র আবেগ ও গৌরবের মধ্যে মিশে আছে।’ এখানে সংখ্যা উল্লেখ না থাকলেও লাখ লাখ নারীর সম্ভ্রম বিসর্জনের কথা বলা হয়েছে। অন্যদিকে সর্বশেষ ২০২১ সালের তথ্য অনুযায়ী সরকারের গেজেট আকারে প্রকাশ করা বীরাঙ্গনাদের সংখ্যা ৪৩৮ জন।
অন্যদিকে ‘মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের ম্যানেজমেন্ট ইনফরমেশন সিস্টেমের (এমআইএস) গেজেটভুক্ত বীরাঙ্গনার সংখ্যা হালনাগাদ নয়। সরকারি তালিকায় এখন পর্যন্ত মোট বীরাঙ্গনা মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা ৪৪৮ হলেও লিপিবদ্ধ করা হয়েছে ৪০২ জনের নাম। এর মধ্যে ৮৯ জন বীরাঙ্গনারই নামে রয়েছে বানানসহ বিভিন্ন ধরনের ভুল। পিতা বা স্বামীর নামের ক্ষেত্রে বানান ও পদবির ভুল, এমনকি ভিন্ন ভিন্ন নাম রয়েছে ২০৭ জনের। বিভিন্ন আমলাতান্ত্রিক জটিলতার সঙ্গে এমন তথ্যগত ভুল বীরাঙ্গনাদের অধিকার আদায়ের ক্ষেত্রে বিড়ম্বনা তৈরি করছে।’
এমন তথ্য উঠে এসেছে গত বছরের ১৬ জুন ট্র্যান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবির) ‘বীরাঙ্গনাদের রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি ও অধিকার: সুশাসনের চ্যালেঞ্জ এবং উত্তরণের উপায়’ শীর্ষক গবেষণা প্রতিবেদনে।
কিন্তু তাহলে প্রশ্ন ওঠে বাকি বীরাঙ্গনাদের কী হলো? কোথায় আছেন? কেমন আছেন তারা? এখনো দেশের আনাচে-কানাচে অনেক বীরাঙ্গনার কান্না শোনা যায় স্বীকৃতি না পাওয়ার কষ্টে। একটি বাংলাদেশের জন্ম দিতে লক্ষ্মীপ্রিয়া, আছমা বেগম, শহর বানুর মতো ত্যাগ স্বীকার করেছেন অনেক নারী। তবে স্বীকৃতি মেলেনি এখনো।
এ বিষয়ে টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান বলেন, ‘স্বাধীনতার এত বছর পরে এসে সরকারিভাবে বীরাঙ্গনাদের স্বীকৃতি আমাদের জন্য অনেক আনন্দের ছিল। কিন্তু এ ক্ষেত্রে প্রত্যাশার তুলনায় এখন অনেক বেশি অপ্রাপ্তি রয়েছে। জাতীয়ভাবে গুরুত্বপূর্ণ বলা হলেও, তুলনামূলক কম আলোচিত প্রসঙ্গ হচ্ছে বীরাঙ্গনাদের রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি ও অধিকার।’
বীরাঙ্গনাদের চিহ্নিত করা থেকে শুরু করে রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি ও সুযোগ-সুবিধা প্রদানের পুরো প্রক্রিয়ায় নানা ঘাটতির বিভিন্ন দিক উঠে এসেছে, যখন আমরা কাজ করতে গিয়েছি তখন। এর মধ্যে বীরাঙ্গনাদের আবেদন নিষ্পত্তির সময়সীমা নির্ধারণ না থাকা, পরিকল্পনাহীনতা, প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতার ঘাটতি, অনিয়ম-দুর্নীতির সঙ্গে রয়েছে স্থানীয় পর্যায়ে সামাজিক-সাংস্কৃতিক নেতিবাচক মনোভাব। পাশাপাশি এখন একটি বড় সিন্ডিকেট গড়ে উঠেছে, যেখানে বীরাঙ্গনার স্বীকৃতি পেতে হলে টাকা দিতে হবে একটি মহলকে। এ ছাড়া বীরাঙ্গনাদের পরিবারও অনেক সময় সহযোগিতা করছে না তাদের পরিচয় প্রকাশে। আবার যেসব পরিবার সহযোগিতা করছে তারা ওই বীরাঙ্গনার প্রাপ্য সুবিধা নিজেরা ভোগ করছেন বলেও অভিযোগ আছে।
এ ছাড়া বীরাঙ্গনাদের নিয়ে কাজ করছে বেসরকারি প্রতিষ্ঠান নারীপক্ষ। সরকারি তালিকার বাইরে এ পর্যন্ত ৯৯ জনের তালিকা করেছিল প্রতিষ্ঠানটি। এর মধ্যে মারা গেছেন ১৬ জন। আর ৫১ জনকে মাসিক ভাতা দেওয়া হচ্ছে নারীপক্ষের পক্ষ থেকে। আর তাদের তালিকায় থাকা ৩২ জনের নাম উঠেছে সরকারি তালিকায়।
কেন বীরাঙ্গনারা দ্রুত তালিকাভুক্ত হচ্ছে না জানতে চাইলে নারীপক্ষের সদস্য নাজনীন সুলতানা রত্না খবরের কাগজকে বলেন, ‘মাঠপর্যায়ে বীরাঙ্গনাদের সঙ্গে আমরা কাজ করতে গেলে অনেকেই অভিযোগ করেন সরকারের পক্ষে কেউ এসে তাদের খোঁজ নেয়নি। আবার অনেকের ভ্যারিফিকেশন হয়েছে কিন্তু এখনো গেজেটে নাম আসেনি। অনেকে আবার আবেদন করে রেখেছেন কিন্তু তার পরে আর কিছুই এগোয়নি। কারও কারও অভিযোগ আছে, একটি চক্র তাদের কাছে তালিকায় নাম তুলে দেওয়ার জন্য টাকা চেয়েছেন। টাকা না দেওয়ায় কাজ আটকে আছে। যে বীরাঙ্গনাদের সম্ভ্রমের বিনিময়ে আমরা আজ স্বাধীনতা পেয়েছি, স্বাধীন দেশে বাস করছি তাদের কী এমন অবহেলায় থাকার কথা? এ প্রশ্ন করে নাজনীন সুলতানা রত্না বলেন, বীরাঙ্গনাদের তাদের প্রাপ্য মর্যাদা দেওয়া উচিত। একজন মুক্তিযোদ্ধা যে সম্মান, সুযোগ-সুবিধা নিয়ে বেঁচে আছেন বীরাঙ্গনাদেরও সে মর্যাদা যত দ্রুত সম্ভব দেওয়া উচিত। কারণ তাদের বয়স হয়েছে। অনেকে তো মারাও গেছেন। কিন্তু যারা বেঁচে আছেন তাদের মধ্যে অনেকে মানবেতর জীবনযাপন করছেন। অনেকে ভিক্ষাও করছেন।
এ সমস্যার সমাধান কী জানতে চাইলে নাজনীন সুলতানা রত্না বলেন, সরকারের সদিচ্ছা প্রয়োজন। কাজগুলোকে দ্রুত এগিয়ে নিতে হবে। যেন তারা বেঁচে থাকতে থাকতে অন্তত স্বীকৃতি পান। একটু ভালোভাবে মর্যাদার সঙ্গে বাঁচতে পারেন।
এ সমস্যা সমাধানের বিষয়ে ইফতেখারুজ্জামান খবরের কাগজকে বলেন, ‘বীরাঙ্গনারা যে বীর, সে বিষয়টি বেশি বেশি প্রচার করা দরকার। এ জন্য রাষ্ট্রীয়ভাবে উদ্যোগ নেওয়া দরকার। পাশাপাশি তাদের তালিকায় আনার জন্য কাজ করার সরকারি সংস্থা জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিলকে (জামুকা) আরও তৎপর হতে হবে। কাজটি দ্রুত করার ব্যবস্থা করতে হবে। যারা সিন্ডিকেট করে বীরাঙ্গনাদের তালিকায় আনার জন্য অর্থ নিচ্ছেন ও কার্যক্রমটি দীর্ঘ করছেন তাদের চিহ্নিত করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তিরও ব্যবস্থা করতে হবে।’