রেসকোর্সের মাঠে বসে ৭ মার্চের বঙ্গবন্ধুর ১৮ মিনিটের অবিস্মরণীয় বক্তৃতা শোনার সৌভাগ্য আমার হয়েছিল। বক্তৃতাটি আমার প্রায় মুখস্থ হয়ে গেছে, যা হৃদয়ে আজও ধারণ করে রেখেছি। এই প্রবীণত্বের দুয়ারে দাঁড়িয়েও আমি গর্বিত যে, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে কথা বলেছি এবং তাকে আমি প্রায় প্রতিদিনই দেখতাম। কারণ আমি সপরিবারে একসময় ধানমন্ডি ৩২ নম্বর রোডের বাসিন্দা ছিলাম
বাংলাদেশ বিশ্ব মানচিত্রে একটি স্বাধীন-সার্বভৌম জাতিরাষ্ট্র হিসেবে উৎকীর্ণ হয় ২৫ মার্চ ১৯৭১ সালে। বাংলাদেশের জন্ম হয়েছিল অনেক বেদনা, দুঃখ ও ৩০ লাখ প্রাণের বিনিময়ে। দুই লাখ মা-বোনদের নারীত্বের সম্মান লুণ্ঠিত হয়েছিল পাকিস্তানি সৈনিকদের লোভাতুর দৃষ্টির করাল গ্রাসে। ১৯৭০ সালে পাকিস্তানে নতুন সরকার গঠনের জন্য সাধারণ নির্বাচন সংঘটিত হয়েছিল। দ্বিজাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে অর্থাৎ কেবলমাত্র ধর্মের ভিত্তিতে ১ হাজার ২০০ মাইল দূরে পশ্চিম পাকিস্তানের সঙ্গে আমাদের দেশকে জুড়ে দেওয়া হয়েছিল। সত্যিকার অর্থে পশ্চিম পাকিস্তানিদের সঙ্গে আমাদের খাদ্যাভ্যাস, সংস্কৃতি ও জীবন দর্শনের কোনো মিল ছিল না। যদিও ব্রিটিশ ভারতে আমার জন্ম, তবুও আমি দেখেছি যে, বিশেষ করে পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ জীবনের সব ক্ষেত্রে বঞ্চিত হতো। ১৯৭০ সালের নির্বাচনে বাঙালি জাতির পিতা এবং অবিসংবাদিত নেতা শেখ মুজিবুর রহমানকে সরকার গঠন করতে দিল না পাকিস্তানি কুচক্রী মহল, যার অগ্রভাগে ছিল জুলফিকার আলী ভুট্টো এবং পাকিস্তানের সেনাপ্রধান ইয়াহিয়া খান।
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে পাকিস্তানি শাসকদের এই ঘোরতর অন্যায় সিদ্ধান্ত বাঙালিরা মেনে নিতে পারল না। ১৯৭১-সালের ২৬ মার্চ বঙ্গবন্ধু কর্তৃক বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষিত হলো। শুরু হলো বঙ্গবন্ধু ও জাতীয় নেতাদের নেতৃত্বে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ ও মুক্তির সংগ্রাম।
আমার দুই ভাই মুজিবুর রহমান দিলু এবং সাজেদুর রহমান মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিল। আমি ছিলাম আট ভাইবোনের মধ্যে জ্যেষ্ঠ এবং সে কারণে বাবা-মাকে ছেড়ে আমি মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করতে পারিনি। আমাদের বাসা ছিল অধ্যাপক মুনীর চৌধুরীর পৈতৃক বাড়ি সংলগ্ন ভূতের গলি। আমি তখন একটা বিদেশি কোম্পানিতে চাকরি করি। ১৪ ডিসেম্বর রাস্তায় বেরিয়ে আমি জিপে-আসীন পাকিস্তানি মিলিটারি সৈন্যদের দ্বারা ধৃত হয়ে নিগৃহীত হই। আমার বাবা-মা, ভাইবোনেরা পাকিস্তানি মিলিটারিদের জিপ ঘিরে ফেলে। ওরা কী মনে করে রাস্তার ওপর আমাকে ছুড়ে ফেলে দিয়ে চলে গিয়েছিল।
রেসকোর্সের মাঠে বসে ৭ মার্চের বঙ্গবন্ধুর ১৮ মিনিটের অবিস্মরণীয় বক্তৃতা শোনার সৌভাগ্য আমার হয়েছিল। বক্তৃতাটি আমার প্রায় মুখস্থ হয়ে গেছে, যা হৃদয়ে আজও ধারণ করে রেখেছি। এই প্রবীণত্বের দুয়ারে দাঁড়িয়েও আমি গর্বিত যে, বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে কথা বলেছি। কারণ আমি সপরিবারে একসময় ধানমন্ডি ৩২ নম্বর রোডের বাসিন্দা ছিলাম। আমি তখন আমার পরিবারসহ ৩২ নম্বর রোডে সর্বজন শ্রদ্ধেয় বেগম সুফিয়া কামালের (সুফিয়া খালার) বাসার পাশে বসবাস করতাম।
বঙ্গবন্ধু প্রায়ই প্রতি সকালে সুফিয়া কামালের বাসায় যেতেন চেক লুঙ্গি ও হাতাওয়ালা গেঞ্জি পরিধান করে। তাঁর ৩২ নম্বর বাসায় আমার দুবার তাঁর সঙ্গে সামনা-সামনি বসে কথা বলার সৌভাগ্য হয়েছিল। এমন বাঙালি বীরপুত্র আমি জীবনে আর দেখিনি। মৃত্যুভয় বলে তাঁর কিছু ছিল না। সর্বপরি বাংলাদেশের জনগণই ছিল তাঁর হৃদয়ের সম্পদ। তাদের সুখ-শান্তির জন্য জাতির পিতা যেকোনো কাজ করতে প্রস্তুত ছিলেন। এমনকি জীবন বিসর্জন দিতেও তাঁর কুণ্ঠাবোধ ছিল না। পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্ত হয়ে উনি বিলেত এবং ভারত হয়ে তেজগাঁও পুরনো বিমানবন্দরে অবতরণ করেছিলেন। তার সেই ‘মহামানব’ সুলভ চেহারাটা আমার হৃদয়ে আজও গাঁথা হয়ে আছে। তিনি বিমান থেকে অবতরণ করে তাঁর সহকর্মীদের জড়িয়ে ধরে রবীন্দ্রনাথের বিখ্যাত কবিতা ‘দুই বিঘা জমি’ থেকে দুটি লাইন আবৃত্তি করেছিলেন, যা আমার বুকে আজও গেঁথে আছে।
সবশেষে, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কেবলমাত্র বাঙালি ও বাংলাদেশের গৌরব ছিলেন না, তিনি ছিলেন সমগ্র বিশ্বের গৌরব। তার মতো গণমানুষের নেতা বিশ্বে আর কোনো দিন জন্মগ্রহণ করবে কি না আমার সে বিষয়ে সন্দেহ আছে। হে বঙ্গবন্ধু, তুমি চিরঞ্জীব, বাঙালির চিরসখা এবং পথ-প্রদর্শক। তোমার লয় নেই, নেই তোমার ক্ষয়। জয় তোমারই হয়েছে এবং জয় হয়েছে আপামর বাঙালিদের। বঙ্গবন্ধুর কন্যা, আমাদের বর্তমান মাননীয় প্রধানমন্ত্রী দেশরত্ন শেখ হাসিনার হাত ধরে এখন আমরা উন্নতির সড়কে ক্রমাগত এগিয়ে চলেছি।
লেখক: অভিনেতা, নাট্যনির্দেশক, লেখক ও কবি
একুশে পদক ও স্বাধীনতা পুরস্কারপ্রাপ্ত