‘১৯৭১ সালের ১ মে অর্থাৎ মে দিবস। শনিবার সকাল, দেশে তখন পাক হানাদারদের বিরুদ্ধে চলছে স্বাধীনতা সংগ্রাম। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী নারকীয় ধ্বংসযজ্ঞ চালাচ্ছে দেশজুড়ে। শ্রীমঙ্গল শহরও বাদ যায়নি সেই নারকীয় বর্বরতা থেকে, এখানেও ঘাঁটি গাড়ে হানাদার বাহিনী ও তাদের দোসররা।
শ্রীমঙ্গল চা বাগান অধ্যুষিত হওয়ায় এদিকেই বেশি নজর ছিল পাকবাহিনী ও তাদের দোসরদের। যুদ্ধ পরিস্থিতির কারণে তখন বন্ধ ছিল চা বাগানের সব কার্যক্রম।
এর মধ্যেই সকাল ১০টার দিকে শহরতলীর আউট সিগন্যালের দিক থেকে ভাড়াউড়া চা বাগানের দক্ষিণ দিকে প্রবেশ করে ৫-৬ জন পাক সেনা, তাদের সঙ্গে ছিল এলাকার দফাদার (গ্রাম পুলিশ)। তারা এসেই বাগানের সব পুরুষকে একটি স্থানে মিলিত হতে বলে। পাক সেনারা আমাদের সঙ্গে কথা বলবে বলে জানায়। গ্রাম পুলিশরা জোর করে বাগানের পশ্চিম দিকের একটি স্থানে সবাইকে জড়ো করে। চা শ্রমিকরা কিছু বুঝে ওঠার আগেই ব্রাশফায়ার করে পাক সেনারা। গুলি থামলে বাগানের অন্যরাসহ আমরা সেখানে যাই, গিয়ে দেখি পুরো এলাকা রক্তে লাল হয়ে আছে। একজনের ওপর আরেকজনের লাশ, আমার বাবাও ছিলেন সেই লাশের কাতারে। আমি আর মা মিলে বাবাকে লাশের স্তূপ থেকে টেনে বের করি। তখনো তিনি বেঁচে ছিলেন। কোনো রকমে তাকে বাড়িতে নিয়ে আসি। বাড়িতে নিয়ে আসার পর তিনি মারা যান। সেদিন আমার বাবার সঙ্গে আরও প্রায় ৫০ জন চা-শ্রমিক নিহত হন এই ভাড়াউড়া বধ্যভূমিতে।
আজও যখন এই বধ্যভূমির সামনে দিয়ে যখন যাই তখন একাত্তরের সেই রক্তাক্ত স্মৃতিগুলো চোখের সামনে ভেসে ওঠে। কত লাশ! কত রক্তের সাক্ষী এই বধ্যভূমি, একটি স্বাধীন দেশমাতৃকার আশায় কত ত্যাগ আমাদের স্বীকার করতে হয়েছে।’
মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গলের ভাড়াউড়া বধ্যভূমির সামনে দাঁড়িয়ে কথাগুলো বলছিলেন ভাড়াউড়া চা বাগানের বাসিন্দা ভানু হাজরা।
১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের সময় ভানু হাজরা ১৩ বছর বয়সী কিশোরী। আজো চোখের সামনে দগদগে সেইসব স্মৃতি ভেসে উঠে তার।
তিনি বলেন, ‘সেদিন চা বাগানের প্রবেশপথে আরও দুইজনকে গুলি করে হত্যা করেছিল পাক সেনারা, কিন্তু বাগানের কেউ সেটা আগে জানতে পারেনি। আগে জানতে পারলে মাত্র ৫-৬ জন পাকিস্তানি সেনা একসঙ্গে এতগুলো নিরপরাধ শ্রমিককে মারতে পারতো না।’
ভাড়াউড়া বধ্যভূমিতে গিয়ে দেখা যায়, সেখানে শহিদদের স্মৃতির রক্ষার্থে নির্মাণ করা হয়েছে স্মৃতিস্তম্ভ, পাশেই একটি নামফলকে লেখা আছে শহিদ চা-শ্রমিকদের নাম।
সেদিন পাকবাহিনীর গুলিতে মারা যান- হুসেনিয়া হাজরা, মাংগুয়া হাজরা, ফাগু হাজরা, হিংরাজ হাজরা, কৃষ্ণ হাজরা, চিনিলাল হাজরা, শরজুয়া হাজরা, টিমা হাজরা, শানিচড়া হাজরা, মহারাজ হাজরা, নুনু লাল হাজরা, নকুলা হাজরা, রামলাল হাজারা, জগো হাজরা, বিশ্বম্বর হাজরা, হিরচুয়া হাজরা, শিবমুরা হাজরা, জুহিয়া হাজরা, চুন্মি হাজরা, অমৃত হাজরা, বিরবলি হাজরা, রামদেও হাজরা, হরপুয়া হাজরা, জোচনা হাজরা, রাজকুমার মাল, হরিকুমার হাজরা, রামছুরক হাজরা, গুরুয়া হাজরা, ফেরচুয়া গৌড় , রামকৃষ্ণ গৌড়, রামচরন গৌড়, গবিনা গৌড়, ইন্দ্র ভূঁইয়া, চৈতু ভূইয়া, আগ্না ভূঁইয়া, ডমরুচান্দ তুরিয়া, মাংরা তুরিয়া, ব্রজ নারায়ন গোয়ালা, হোল্লা গোয়ালা, রামলাল মাল, খুদিরাম হাজরা, রাজকুমার মাল, ডুকুয়া তেলি, গংগা বারই, জগদেও কাহার, গংগা কুর্মী, সম মাঝি, কালাচান্দ ঘাটুয়ার, সুখনন্দন রিকিয়াসন, বকই রেলী, শিব মুন্ডা।
আহত হয়েছিলেন কেদার লাল হাজরা, গোলাপ চান্দ হাজরা, রামদাড়ী হাজরা, জুবায়ের হাজরা, চিনিয়া হাজরা, কর্মা হাজরা, ডিকুয়া হাজরা, কাইলা হাজরা, বাংসিং তুরিয়াসহ অনেকে।
শ্রীমঙ্গল ভিক্টোরিয়া উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রাক্তন শিক্ষক কবি ও লেখক দ্বীপেন্দ্র ভট্টাচার্যের লেখা ‘ফিরে দেখা’ বইয়ে এই বধ্যভূমিতে চা-শ্রমিকদের নির্মমভাবে হত্যার ঘটনা তুলে ধরা হয়েছে।
সেখানে তিনি লিখেছেন, পাকবাহিনীর শ্রীমঙ্গল দখল, ১৯৭১ সালের ২৭ এপ্রিল পাক বিমান বাহিনী শ্রীমঙ্গলে শেলিং করে। পরে ৩০ এপ্রিল দুপুর ১১টা-১২টার দিকে পাক বিমানবাহিনী শ্রীমঙ্গলে প্রবেশ করে। ২৭ এপ্রিলের শেলিং এ শ্রীমঙ্গলের দুইজন নিহত ও একজন আহত হন। নিহত দুইজনের একজন গৌরাঙ্গ মল্লিক ও অপরজন বাসাবাড়িতে কাজ করার এক নারী। ৩০ এপ্রিল শ্রীমঙ্গলে আস্তানা করার পর প্রবেশের পরদিন পহেলা মে পাকবাহিনী তাদের তাণ্ডবলীলা শুরু করে। শহরের পার্শ্ববর্তী ভাড়াউড়া চা বাগানে বহু চা-শ্রমিককে একসঙ্গে দাঁড় করিয়ে গুলি করে হত্যা করে। এ নির্মম হত্যাকাণ্ড স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে শ্রীমঙ্গলের এক মর্মান্তিক ঘটনা।
বাংলাদেশ চা শ্রমিক ইউনিয়নের সাংগঠনিক সম্পাদক ও ভাড়াউড়া বধ্যভূমিতে নিহত হওয়া ফাগু হাজরার ছেলে বিজয় হাজরা বলেন, ‘ওইদিনের ঘটনার পর সব লাশ একসঙ্গে জড়ো করে মাটিচাপা দেওয়া হয় এবং আমরা চা বাগান ছেড়ে প্রাণ বাঁচাতে পালিয়ে যাই। মুক্তিযুদ্ধের পর মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের কর্মকর্তারা এসে এখানের মাটি খুঁড়ে মাথার খুলি গণনা করেন।’
তিনি আক্ষেপ করে বলেন, ‘চা-শ্রমিকদের ওপর পাক হানাদার বাহিনীর এই নির্মম গণহত্যাকাণ্ডের জায়গাটি এক প্রকার অবহেলিতই বলা চলে। এখানে যারা মারা গিয়েছিলেন তাদের নাম উল্লেখ করে আমি নিজ উদ্যোগে এখানে একটি নামফলক করেছি। সরকারের কাছে আবেদন এই বধ্যভূমির মর্মান্তিক ঘটনা তুলে ধরে এখানে একটি ভাস্কর্য করে দেওয়া হোক। যাতে এই প্রজন্মের সবাই জানতে পারে আমরা সেদিন কতটুকু নির্মমতার শিকার হয়েছিলাম পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর দ্বারা।’
হৃদয় শুভ/ইসরাত চৈতী/