![রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা অপরিহার্য](uploads/2024/02/13/1707798185.AB-Mirzza-Azizul-Islam.jpg)
বর্তমানে দেশের অর্থনীতি পরীক্ষামূলক অবস্থানে রয়েছে। যদিও নানারকম উত্থান-পতনের মধ্য দিয়ে অর্থনীতিতে ইতোমধ্যে বাংলাদেশ একটা সন্তোষজনক পর্যায়ে পৌঁছেছে। তবে এখানে বহুবিধ রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জ বিদ্যমান আছে। বেশ কতগুলো ক্ষেত্রে আমাদের অর্থনৈতিক অর্জন বিশ্বের বিভিন্ন দেশের নজর কেড়েছে। আমরা এখন যে অবস্থা দেখতে পাচ্ছি, সেটাতে বেশকিছু বিষয় খুব স্পষ্ট। বিভিন্নমুখী চ্যালেঞ্জ অর্থাৎ নানারকম রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক সমস্যা এখন আমাদের সামনে আছে। সেগুলো মোকাবিলা করা আমাদের জন্য অপরিহার্য।
ভবিষ্যৎ অর্থনৈতিক অবস্থা কেমন হবে তা নিয়েও একটা অনিশ্চয়তা সর্বত্র বিরাজ করছে। যেটা সম্ভবত সঠিকভাবে শতভাগ নিশ্চয়তা দিয়ে কেউ কিছু বলতে পারবে না। তবে কিছুটা সম্যক ধারণা বা আন্দাজ করা যেতে পারে। এসব নিয়ে ধনী-দরিদ্র-নির্বিশেষে সব শ্রেণির মানুষের মধ্যে একটা অস্বস্তিকর অবস্থা বিরাজ করছে। দেশের ভবিষ্যৎ কী হবে- সবার মনে হয়তো এই প্রশ্ন আছে। তবে শঙ্কাটা খুব ভালোভাবেই দেখা দিয়েছে। যে চ্যালেঞ্জ এবং অনিশ্চয়তাগুলো রয়েছে সেগুলোর জন্যই এসব প্রশ্ন দেখা দিয়েছে জনমনে।
দেশের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক এই সংকটমুহূর্তে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক- এই তিনটি বিষয়ের ওপর সবার দৃষ্টি নিবদ্ধ করতে হবে। সবাইকে একতাবদ্ধ হয়ে এই সমস্যাগুলোর সমাধান করতে হবে। সেখানে আমাদের বর্তমান অবস্থা সম্পর্কে কী বলা যেতে পারে! এখন এই অবস্থায় যদি কেউ প্রশ্ন করে, তখন আমরা বলতে পারি যে, এখানে অর্থনৈতিক অস্থিতিশীলতা বিরাজ করছে। তার ওপর রাজনৈতিক প্রভাবটা পড়বে সেটা বলাবাহুল্য।
সাধারণভাবে কতগুলো বিষয় যদি আমরা দেখি, আমাদের প্রবৃদ্ধি ভালো হয়েছে। গত তিন বা চার দশকের কাছাকাছি সময় ধরে আমরা প্রবৃদ্ধিতে মোটামুটি একটা সন্তোষজনক অবস্থানে আছি। আমরা ৫-৬-এর বৃত্ত থেকে ৭ শতাংশে উপনীত হয়েছি। আমাদের প্রবৃদ্ধির গ্রোথের ফলে যেটা হয়েছে, আমাদের মাথাপিছু আয় বেড়েছে। মাথাপিছু আয় বর্তমানে পাশের দেশ ভারত ও পাকিস্তানের চেয়ে বেশি। অতএব, সামষ্টিক দিক দিয়ে একটা অর্জন আমরা দেখতে পাচ্ছি। কিন্তু মানুষের জীবনযাপনের গুণগতমান, মানুষের বিভিন্ন সেবা, বিভিন্ন দ্রব্য কেনার ক্ষমতা, মানুষের জীবনযাপন ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতা কতটুকু উন্নত হতে পেরেছে সেটা বিবেচনায় রাখতে হবে।
মানুষের অর্থনৈতিক আয়ের বৈষম্য এবং সম্পদের বৈষম্য দিন দিন বেড়ে যাচ্ছে। যারা ধনী, তারা আরও ধনী হচ্ছে। যারা দরিদ্র, তারা দারিদ্র্যের ওপরে কিছুটা উঠছে। কিন্তু সেটা সন্তোষজনক নয়। যেকোনো সময় একজন দরিদ্র মানুষ কোনো দুর্যোগ এলে বা পরিবারে অসুখ হলে, কর্ম বা চাকরি হারিয়ে ফেললে তখন দারিদ্র্যসীমার নিচে চলে যায়। কোভিডের সময় থেকে অনেকেই দারিদ্র্যসীমার নিচে চলে গেছে। মূল্যস্ফীতির কারণে এখনো অনেকে বেঁচে থাকার সংগ্রাম করছে।
অতএব, সার্বিক উন্নয়ন যদি আমরা না করি, যেখানে বেশি উপাদান হলো- শিক্ষা, স্বাস্থ্য, বাসস্থান, যাতায়াত এবং স্বাধীন হয়ে চলাফেলা করা, স্বাধীনভাবে মত প্রকাশ করা- এগুলো হলো সার্বিক উপাদানের একটা অংশ। পৃথিবীর যেকোনো গণতান্ত্রিক দেশে এগুলো আমরা স্পষ্ট দেখতে পাই। সেখানেও অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক কিছুটা টানাপোড়েন হয়। কিন্তু মানুষের এই চাহিদাগুলোকে নিশ্চিত করা যায়।
আমাদের দেশে যেকোনো কাজে, বিশেষ করে সরকারি কাজে প্রশাসনের স্বচ্ছতা এবং জবাবদিহি আছে কি না, সেটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি না থাকলে সরকারি যেকোনো ব্যয়, যেকোনো কর্মকাণ্ড অনেক প্রশ্নের সম্মুখীন হয়, সেটা আমরা দেখতে পাচ্ছি। স্বচ্ছতা, জবাবদিহি না থাকলে সরকারি কর্মচারী, বেসরকারি প্রতিষ্ঠান, বেসরকারি ব্যবসাবাণিজ্য, সেবা বা পণ্য কোনোটাই সাধারণ মানুষের কাছে সন্তোষজনক হয় না। মানুষের মধ্যে হতাশা বাড়তে থাকে।
অনেক বড় ব্যবসা, অনেক বড় শিল্প, অনেক বড় ভৌত অবকাঠামো হয়েছে, সেতু নির্মিত হয়েছে, টানেল হয়েছে কিন্তু এগুলো যথেষ্ট নয়। অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য এই ভৌত অবকাঠামোর প্রয়োজন আছে। কিন্তু সেগুলো প্রত্যক্ষভাবে মানুষের উন্নত জীবন নিশ্চিত করে না; সেটা পরোক্ষভাবে করে থাকে। বর্তমান সরকার উন্নয়ন আখ্যান দিয়ে বলছে উন্নয়ন হচ্ছে। অতএব, উন্নয়নের জন্য সবকিছু করতে হবে। কিন্তু অন্য যে দিকগুলো আমরা দেখতে পাচ্ছি না, যেটা সার্বিক উন্নয়ন বলতে আমি বোঝাতে চাইছি, অর্থাৎ একটা কল্যাণকামী রাষ্ট্র- বাংলাদেশেরও সে পথে যাওয়া উচিত।
সর্বোতভাবে আমাদের আইনের শাসন সুনিশ্চিত করা উচিত। যাতে সবাই সমানভাবে সব সুযোগ-সুবিধা পায়। কারও প্রতি কোনো অন্যায় হলে যেন দ্রুত প্রতিকার পাওয়া যায়। আইনের শাসন এবং স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি না থাকলে দুর্নীতি হবে। অর্থ পাচার, সম্পদের অপচয় হবে। সরকারের বিভিন্ন প্রকল্পে প্রয়োজনের চেয়ে বেশি বা যুক্তিসংগত টাকার চেয়ে অনেক বেশি খরচ হবে। এগুলো নিয়ে অনেক প্রশ্ন এরই মধ্যে উঠেছে। আমাদের এখানে রাস্তা, রেলপথ নির্মাণে বেশি খরচ হয়- এগুলোর কোনো জবাবদিহি নেই। স্বচ্ছতা নেই। এসব অন্যায় ও দুর্নীতির প্রতিকার হচ্ছে না।
এখন আমাদের দেশে এই ক্রান্তিলগ্নে নির্বাচন-পরবর্তী রাজনীতি, কূটনীতি এবং অর্থনীতির ক্ষেত্রে তাদের কাছে সরকারের জবাবদিহি থাকতে হবে। এ জন্য প্রয়োজন একটা রাজনৈতিক সংস্কার। অতএব, গণতন্ত্র উন্নয়ন করতে হলে দুই পায়ের ওপর সমানভাবে চলা তথা গণতন্ত্র এবং উন্নয়ন, এই দুটির ওপর সমানভাবে গুরুত্ব দিতে হবে। তাহলে দেশ একটা সুষ্ঠু, সবল এবং কল্যাণকামী অর্থনীতির দেশে রূপান্তরিত হবে।
লেখক: সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা