আসন্ন উপজেলা নির্বাচনকে কেন্দ্র করে সারা দেশে নির্বাচনি উৎসব শুরু হয়েছে। বিএনপি-জামায়াত জাতীয় নির্বাচনের মতো উপজেলা নির্বাচনেও আনুষ্ঠানিকভাবে যাচ্ছে না বলে জানিয়েছে। অনেক নেতা-কর্মী দলের হাইকমান্ডের সিদ্ধান্ত মেনে মনোনয়নপত্র প্রত্যাহার করেছেন এবং অনেকেই হইকমান্ডকে অমান্য করেছেন। যারা হাইকমান্ডের সিদ্ধান্ত মানেননি তাদের কাউকে কাউকে দল থেকে বহিষ্কার করার ঘোষণা এসেছে। মাঠপর্যায়ে বিএনপি-জামায়াতের অসংখ্য নেতা-কর্মী রয়েছেন, যারা নির্বাচন থেকে এখনো সরে যাননি। দলীয় ব্যানারে কিংবা দলীয় প্রতীকে নির্বাচন না হওয়ায় এ বিষয়ে সুনির্দিষ্ট করে বলা মুশকিল কতজন বিএনপি-জামায়াতের প্রার্থী নির্বাচনে অংশ নিচ্ছেন। তবে খুব সচেতনভাবে সংশ্লিষ্ট স্থানীয় পর্যায়ের জনগণ এ বিষয়ে সুস্পষ্ট অনুমান করতে পারবেন। যারা নির্বাচনে যাচ্ছেন তাদের অনেকেই আওয়ামী-বিরোধী রাজনীতির সঙ্গে দীর্ঘদিন থেকে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত। তারা একসময় বিএনপি-জামায়াতের পদধারী ছিলেন, কিংবা এখনো অনেকেই বিভিন্ন স্থানীয় ইউনিটের পদে রয়েছেন।
গত ২৪ এপ্রিল প্রকাশিত একাধিক জাতীয় দৈনিকের খবর থেকে জানলাম, বিএনপি আগামী ৮ মে অনুষ্ঠেয় প্রথম ধাপের উপজেলা পরিষদের নির্বাচন বর্জনের ঘোষণা দিলেও দলটির অন্তত ৩৮ জন সাবেক-বর্তমান নেতা এবং তাদের স্বজন চেয়ারম্যান পদে নির্বাচন করছেন। এমন অসংখ্য নেতা-কর্মী রয়েছেন যারা নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়াননি। আগামী ৮ মে প্রথম দফায় ১৫০ উপজেলায় এবং ২১ মে দ্বিতীয় ধাপে সারা দেশে ১৬০ উপজেলায় নির্বাচন হবে। দ্বিতীয় ধাপে বিএনপি-জামায়াতের অসংখ্য নেতা মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছেন বলে গণমাধ্যম সূত্রে জানতে পারলাম।
এবার উপজেলা নির্বাচনে অনেকেই অংশ নিচ্ছেন এই বলে যে, তারা দলীয় কোনো পদে নেই। মূলত দীর্ঘদিন বিএনপির সাংগঠনিক কার্যক্রম না থাকায় তাদের দলের পদ-পদবি তৃণমূল পর্যায়ে নেই বললেই চলে। তবে এখানে উল্লেখ না করলেই নয়, বার কাউন্সিল এবং বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে বিএনপি-জামায়াত স্পষ্টভাবে নিয়মিত নির্বাচনে অংশ নিয়ে চলেছে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে জানা গেছে, তাদের হাইকমান্ডের নির্দেশ অমান্য করেও কোনো কোনো সময় তারা দলীয় ব্যানারে নির্বাচনে অংশ নিচ্ছে। মোটা দাগে বলা যায়, প্রায় সব ক্ষেত্রেই তাদের নির্বাচনি অংশগ্রহণ রয়েছে। কোনো ক্ষেত্রে আনুষ্ঠানিক আবার কোনো ক্ষেত্রে অনানুষ্ঠানিক।
বাংলাদেশের রাজনীতিতে একটা লম্বা সময় ধরে দুই বন্ধুর মতো ছিল জামায়াতে ইসলামী ও বিএনপি। সাম্প্রতিক সময়ে তারা নির্বাচনকেন্দ্রিক কৌশলগত অবস্থানে রয়েছে। দলীয় প্রতীকে প্রতিদ্বন্দ্বিতার বিধান শিথিল হওয়ায় উপজেলা পরিষদসহ স্থানীয় সরকারের বিভিন্ন নির্বাচনে অনানুষ্ঠানিকভাবে অংশগ্রহণ না করলেও গোপনে (ওপেন সিক্রেট) অংশ নিচ্ছে বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামী। একদিকে বেশ লম্বা সময় ধরে নির্বাচন বয়কটের খেলায় মত্ত রয়েছে, আবার নির্বাচনেও অংশ নিচ্ছে।
নির্বাচন বর্জন নিয়ে বিএনপির শীর্ষ পর্যায়ে ব্যাপক মতবিরোধ রয়েছে। এ নিয়ে দলের ভেতরে বিভিন্ন রকমের মতামত তৈরি হয়েছে। দলের অনেক নেতা মনে করছেন, নির্বাচন বয়কট করার যে সিদ্ধান্ত, তা কোনোভাবেই ঠিক হয়নি। গত উপজেলা পরিষদ নির্বাচনেও দলীয়ভাবে অংশ না নিলেও প্রার্থী হিসেবে অংশ নিয়েছিল। আসন্ন উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে বিএনপি অংশ নেবে কি না, তা নিয়ে দলের সুস্পষ্ট সিদ্ধান্ত থাকলেও মাঠপর্যায়ে সেটি মোটেও শতভাগ বাস্তবায়ন হচ্ছে না।
উপজেলা পরিষদে বিএনপি নেতাদের অংশ নেওয়া প্রসঙ্গে কোনো কোনো শীর্ষ নেতা জানিয়েছেন, যারা ভোটে রয়ে গেছেন তাদের বেশির ভাগই একসময় বিএনপির রাজনীতিতে সম্পৃক্ত থাকলেও দীর্ঘদিন ধরে নিষ্ক্রিয় ছিলেন। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে প্রায় ১৭ বছর ক্ষমতার বাইরে থেকে তৃণমূল পর্যায়ে বিএনপি প্রায় শতভাগ নিষ্ক্রিয়। কাজেই নিষ্ক্রিয়ের অজুহাত কোনোভাবেই প্রাসঙ্গিক নয়। তারা মূলত নিষ্ক্রিয় হলেও মনেপ্রাণে বিএনপি-জামায়াতেরই নেতা-কর্মী।
নিজ দায়িত্বে এবং দলের কমান্ড না মেনে নির্বাচনে অংশ নেওয়া নেতাদের ধারণা, স্থানীয় সরকার নির্বাচনও ধারাবাহিকভাবে বর্জন করতে থাকলে তৃণমূলে দলীয় নেতাদের প্রভাব কমে যাবে। এতে ব্যক্তির পাশাপাশি দলও অস্তিত্ব সংকটে পড়বে। এ জন্য তৃণমূল পর্যায়ে যেসব বিএনপি-জামায়াতের কর্মী-সমর্থক রয়েছেন তারা সবাই কোনো না কোনো প্রার্থীর পক্ষে নির্বাচনের প্রচারে অংশ নিচ্ছেন। কোনো কোনো স্থানে তাদের সুনির্দিষ্ট দলীয় প্রার্থী না পেলেও তারা নির্বাচনকে বয়কট করে ঘরে বসে নেই। আগামী ৮ তারিখে যে প্রথম দফার নির্বাচন হতে যাচ্ছে তাতে স্থানীয় বিএনপি-জামায়াতের বেশির ভাগ নেতা-কর্মীই মাঠে রয়েছেন প্রচার-প্রচারণায়।
এ কথা সত্য যে, রাজনৈতিক সংস্কৃতির গুরুত্বপূর্ণ গুণগত পরিবর্তন মোটামুটিভাবে আমাদের একটি জাতীয় অঙ্গীকার ও সময়ের দাবিতে পরিণত হয়েছে। এ কারণে দলীয়ভাবে না হলেও ব্যক্তিগতভাবে বিএনপি-জামায়াতের নির্বাচনে অংশ নেওয়ার বিষয়টি প্রশংসার দাবি রাখে। বিএনপির দীর্ঘদিনের ভুল রাজনীতিতে সর্বসাধারণ এক অশুভ রাজনৈতিক প্রতিযোগিতায় আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে পড়েছে।
বাংলাদেশে নির্বাচনের মাধ্যমে শাসন নির্ধারণ হবে, এটা স্বাভাবিক। স্থানীয় নির্বাচনেও দলীয় হাইকমান্ডের নেতিবাচক কমান্ড বহাল থাকার বিষয়টি প্রশ্নবিদ্ধ হয়। এভাবে যদি স্থানীয় নির্বাচনে প্রভাব বজায় রাখার প্রচেষ্টা থাকে, তাহলে সংশ্লিষ্ট রাজনৈতিক দলগুলোর তৃণমূল কর্মিবাহিনী বহুলাংশে সিন্ডিকেটের কবলে রয়ে যাবে।
গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রেই দলের প্রয়োজন হয়। কিন্তু দল ক্রমাগত দেশের সব নির্বাচন আনুষ্ঠানিকভাবে বর্জনের ঘোষণা দেবে এবং ব্যক্তি নিজ দায়িত্বে নির্বাচনে অংশ নেবে- এমনটি মানানসই নয়। দলের সৃষ্টি নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতায় গিয়ে সুনির্দিষ্ট আদর্শ বা কর্মসূচি বাস্তবায়ন। রাষ্ট্রীয় সম্পদ নিজেদের সমর্থকদের মধ্যে বিতরণের লক্ষ্যে নির্বাচনকে একমাত্র ক্ষমতায় যেতে পারার সিঁড়ি মনে করা ভুল হবে। সত্যিকারের গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে দলবাজি এবং ফায়দাবাজির কোনো অবকাশ নেই। কারণ রাষ্ট্রের সব সম্পদের মালিক জনগণ এবং সরকারের দায়িত্ব ‘রাগ বা বিরাগের বশবর্তী’ না হয়ে দল-মতনির্বিশেষে সব নাগরিকের অধিকার ও স্বার্থ রক্ষার নিমিত্তেই রাজনৈতিক দলগুলোকে নির্বাচনে অংশ নেওয়া উচিত।
এই মুহূর্তে বিএনপি-জামায়াতের নেতাদের বুঝতে হবে, প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রেই তাদের নির্বাচনি আনুষ্ঠানিকতা রয়েছে। কোনো ক্ষেত্রে গোপেন আর কোনো ক্ষেত্রে প্রকাশ্যে। তাহলে কেন জাতীয় এবং স্থানীয় পর্যায়ে থাকবে না?
এসব বিষয় উপলব্ধি করে পরিষ্কারভাবে বলতে চাই, সংশ্লিষ্ট রাজনীতিবিদদের সর্বক্ষেত্রে নৈতিক আচরণ জরুরি। নৈতিকতাবিবর্জিত রাজনীতি ভণ্ডামির শামিল। রাজনীতিতে অনৈতিকতার অবসান ঘটলেই রাজনৈতিক সংস্কৃতি বদলের পথ সুগম হবে। রাজনীতিতে সহিষ্ণুতা ও শিষ্টাচারসহ অনৈতিকতার অবসান, রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় গণতান্ত্রিক ভিত্তি শক্তিশালী হবে।
লেখক: অধ্যাপক, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়
[email protected]