শ্রমিকদের কর্মপরিবেশের পাশাপাশি স্বার্থের বিষয়টিও গুরুত্বপূর্ণ । খবরের কাগজ
ঢাকা ৬ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১, সোমবার, ২০ মে ২০২৪

শ্রমিকদের কর্মপরিবেশের পাশাপাশি স্বার্থের বিষয়টিও গুরুত্বপূর্ণ

প্রকাশ: ০৬ মে ২০২৪, ১১:০৯ এএম
শ্রমিকদের কর্মপরিবেশের পাশাপাশি স্বার্থের বিষয়টিও গুরুত্বপূর্ণ
ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য

বাংলাদেশের তৈরি পোশাকের সবচেয়ে বড় বাজার ইউরোপ। পোশাকশিল্পে সংকটের শঙ্কা কারখানাসহ পণ্য সরবরাহ ও বিপণনের সার্বিক প্রক্রিয়ায় মানবাধিকার লঙ্ঘন ও পরিবেশের ক্ষতি বন্ধে ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানগুলোর পদক্ষেপ গ্রহণের বাধ্যবাধকতা আরোপ করে নতুন একটি বিধান পাস করেছে ইউরোপীয় পার্লামেন্ট। ইউরোপীয় পার্লামেন্টের নতুন এই বিধিবিধান পাস হওয়ার ফলে সংকটে পড়বেন দেশের অন্তত অর্ধেক গার্মেন্ট মালিক। তারা বলছেন, এই শর্তগুলো পূরণ করতে অনেক টাকার প্রয়োজন। এখন তারা যদি আর্থিকভাবে সহযোগিতায় এগিয়ে আসে তাহলে দ্রুতই পরিস্থিতির উত্তরণ ঘটবে। ইইউ পার্লামেন্টে নতুন এই ‘অবশ্যপালনীয়’ নির্দেশনার ওপর ভোটাভুটি হয়। ফলে ইউরোপীয় কোম্পানিগুলোর পাশাপাশি তারা যেসব প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে অংশীদারি ভিত্তিতে ব্যবসা পরিচালনা করে, সবার জন্য নতুন বাধ্যবাধকতা তৈরি হয়েছে। এর ফলে কোম্পানিগুলোকে তাদের কার্যক্রমের মাধ্যমে মানবাধিকার লঙ্ঘন ও পরিবেশের ক্ষতি প্রতিরোধ, নির্মূল ও প্রশমনে ব্যবস্থা নিতে হবে। এর মধ্যে রয়েছে দাসত্ব, শিশুশ্রম, শ্রমশোষণ, জীববৈচিত্র্যের ক্ষতি, দূষণ এবং প্রাকৃতিক ঐতিহ্যের ক্ষতি প্রতিরোধ, বন্ধ ও কমানোর ব্যবস্থা গ্রহণ।

ইইউ পার্লামেন্টে নতুন বিধান পাস হয়েছে, এটা সবার জন্যই ভালো। কিন্তু প্রশ্ন হলো- এই কাজগুলো করতে গেলে প্রচুর টাকার প্রয়োজন। তারা আর্থিকভাবে আমাদের কোনো সহযোগিতা করে না। মাঝেমধ্যেই নতুন বিধিবিধান নিয়ে হাজির হয়। সেগুলো বাস্তবায়ন করতে আমাদের প্রচুর টাকা খরচ করতে হয়। রানা প্লাজার ঘটনার পর তারা আমাদের যে সংস্কারের রূপরেখা দিয়েছিল, সেটা করতে ছোট ফ্যাক্টরিরও ৫-৭ কোটি টাকা খরচ হয়েছে। এখন তারা যদি আর্থিক সহযোগিতা নিয়ে এগিয়ে আসে, তাহলে ভালো। সরকারকেও এগিয়ে আসতে হবে। না হলে অর্ধেক ফ্যাক্টরি ভয়াবহ সংকটে পড়বে।

আমরা জানি, ইইউর এই বিধানের ইতিবাচক ও নেতিবাচক দুই দিকই আছে। ইতিবাচক দিক হচ্ছে ইইউর সব দেশের ব্র্যান্ডগুলো উন্নত কর্মপরিবেশের দিকে নজর দেবে। মানবাধিকার ও শ্রমিকের অধিকারের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ চীন ও ভিয়েতনামের তুলনায় ভালো অবস্থানে থাকায় খুব বেশি চ্যালেঞ্জ হবে না। আর নেতিবাচক দিক হচ্ছে ক্ষুদ্র ও অতি ক্ষুদ্র পণ্য সরবরাহকারীরা ব্যবসা থেকে ছিটকে যেতে পারে। এই ধরনের ফ্যাক্টরির সংখ্যাও কম নয়।

ইউরোপীয় কোম্পানির পাশাপাশি ওই সব দেশে ব্যবসা করা বাইরের কোম্পানিগুলোর ওপরও এই বিধান কার্যকর হবে। কোম্পানিগুলোকে অবশ্যপালনীয় বিষয়গুলোকে তাদের নীতিতে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। বাধ্যবাধকতার বিষয়গুলো প্রতিপালনে বিনিয়োগ করতে হবে। ইউরোপীয় কোম্পানিগুলোর ব্যবসায়িক অংশীদারদের সঙ্গে চুক্তি করার ক্ষেত্রে এসব বিষয় মেনে চলা হচ্ছে কি না, তার নিশ্চয়তা চাইতে হবে। ক্ষুদ্র ও মাঝারি আকারের ব্যবসায়িক অংশীদাররা যাতে নতুন বাধ্যবাধকতাগুলো মেনে চলতে পারে, সে জন্য তাদের সহায়তায় ব্যবসা পরিকল্পনা নতুন করে সাজাতে হবে। ব্যবসা মডেল যেন বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধি ১ দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে রাখার প্যারিস চুক্তির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ হয়, সেদিকে কর্যক্রম নিয়ে যাওয়ার জন্য একটি পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে।

আমাদের বুঝতে হবে, আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে পরিবর্তন আসছে। এর অন্যতম হলো- আগে আমরা পণ্যের মান নির্ণয় করতাম, এখন পণ্য থেকে প্রক্রিয়ার দিকে মনোযোগ দেওয়া হচ্ছে। অর্থাৎ, পণ্য উৎপাদন যে প্রক্রিয়ায় হচ্ছে তার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সবকিছু। একেবারে উৎসমুখে যেতে হচ্ছে। এই আইনটা হচ্ছে সেটাই। উৎপাদনের ক্ষেত্রে মনোভাবের যে পরিবর্তন সেদিকেই নজর দেওয়া হয়েছে। এখন আমাদের উৎস থেকে উৎপাদন পর্যন্ত সব জায়গাতেই তাদের দেওয়া মানদণ্ড মেনে চলতে হবে। পণ্যের মানের পাশাপাশি এর সঙ্গে যে মানুষগুলো জড়িত, তাদের যে অধিকার আছে, সে বিষয়ে শক্তভাবে নজর দিতে হবে।’

ইইউর নতুন বিধান কোম্পানিগুলো মানছে কি না, তা খতিয়ে দেখা এবং বিধান লঙ্ঘনের জন্য কোম্পানিকে দণ্ড দেওয়ার জন্য একটি কর্তৃপক্ষ গঠন করবে ইউরোপীয় ইউনিয়নের সদস্য দেশগুলো। যেসব কোম্পানি বিধান লঙ্ঘন করবে, তাদের নাম-পরিচয় প্রকাশের পাশাপাশি বিশ্বব্যাপী ওই কোম্পানির মোট লেনদেনের ৫ শতাংশ পর্যন্ত জরিমানা করা হবে। এ বিষয়গুলোতে সহযোগিতা ও সর্বোত্তম চর্চা ছড়িয়ে দেওয়ার লক্ষ্যে ইউরোপীয় কমিশনও একটি কর্তৃপক্ষ গঠন করবে। অবশ্য পালনীয় বাধ্যবাধকতা পূরণে ব্যর্থ হলে যে ক্ষতি হবে, তার দায় কোম্পানিকে নিতে হবে এবং ক্ষতিগ্রস্তকে পূর্ণ ক্ষতিপূরণ দিতে হবে।

আমরা বলতে চাই, বাংলাদেশে শ্রমিকদের কর্মপরিবেশ অনেক ভালো। আমরা তাদের শর্তগুলো মেনেই ফ্যাক্টরিকে নতুনভাবে সাজিয়েছি। এখন এই বিধিবিধানের ফলে যেটা হবে, বেশ কিছু ছোট গার্মেন্ট ক্ষতিগ্রস্ত হবে। এমনকি বন্ধও হয়ে যেতে পারে। আমাদের যে এক্সপোর্ট তার অর্ধেকের বেশি করে ২৫ ভাগ ফ্যাক্টরি। বাকি অর্ধেক করে ৭৫ ভাগ ফ্যাক্টরি। এই ৭৫ ভাগই বেকায়দায় পড়বে। এ থেকে পরিত্রাণের পথ যদি বলেন, তাহলে বায়ারদের এগিয়ে আসতে হবে। পাশাপাশি আমাদের সরকারকেও ভূমিকা নিতে হবে।’

ইইউর এই উদ্যোগকে আমরা সাধুবাদ জানাই। কারণ, এতে আমাদের শ্রমিকদের কর্মপরিবেশ যেমন ভালো হবে, তেমনি তাদের স্বার্থের বিষয়টি নিশ্চিত হবে। পাশাপাশি আমরা এটাও বলতে চাই, এই উদ্যোগগুলো বাস্তবায়ন করতে গেলে অনেক টাকার প্রয়োজন। সেই টাকা যেন বায়াররাও দেন। আমাদের মালিকদের এটা নিয়ে কথা বলতে হবে। সরকারকে ভূমিকা নিতে হবে। কিছু ফ্যাক্টরি হয়তো নিজেদের উদ্যোগেই করতে পারবে। কিন্তু অনেক ফ্যাক্টরি সংকটে পড়বে। আমাদের ফ্যাক্টরি যদি ৩ হাজার হয়, তাহলে অর্ধেক অর্থাৎ দেড় হাজার ফ্যাক্টরির এসব শর্ত পূরণের সামর্থ্য নেই। তাদের সহযোগিতা দিয়ে কাজগুলো করতে হবে। তাহলেই মূল উদ্দেশ্য বাস্তবায়ন হবে। উৎস: ডয়েচে ভেলে

লেখক: অর্থনীতিবিদ

মেয়েরা আগে আগে ছেলেরা পিছে, তাতে হলোটা কী?

প্রকাশ: ১৯ মে ২০২৪, ১০:২৩ এএম
মেয়েরা আগে আগে ছেলেরা পিছে, তাতে হলোটা কী?
ড. তোফায়েল আহমেদ

প্রসঙ্গ মাধ্যমিক পরীক্ষার ফলাফল। প্রতিবছরই মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশের পর অনেক রকমের বিশ্লেষণ হয়। কিন্তু দুঃখের বিষয় হচ্ছে, এসব বিশ্লেষণ কোনো নীতিকাঠামোয় কার্যকরভাবে প্রতিফলিত হয় না। বিশ্লেষণগুলো বুদ্বুদের মতো বাতাসে মিলিয়ে যায়। কোন বছর বিশ্লেষণে কোন বিষয়টা প্রাধান্য পাবে তা আগে থেকে বলা যায় না। যেমন এ বছরের বিশ্লেষণে প্রাধান্য পাচ্ছে, মেয়েদের তুলনায় ছেলেরা পিছিয়ে পড়েছে। এখানে কেন এত মনোযোগ ও এত বিস্ময়! কারণ পুরুষশাসিত সমাজের মনস্তত্ত্ব হচ্ছে, ছেলেরাই সামনে থাকবে এবং মেয়েরা সব সময় ছেলেদের পেছনে থাকবে। ২০১৮ থেকে ২০২৪ সাল- সাত বছরের মাধ্যমিকের ফলাফলে দেখা যাচ্ছে, মেয়েরা প্রতিবছর পাসের হারে ছেলেদের চেয়ে ২-৩% এগিয়ে যাচ্ছে। এতে দেশের কোনো ক্ষতি হয়নি। ছেলে এবং মেয়ে একই ক্লাসে পড়েছে এবং একই সমাজের বাসিন্দা। ছেলে ও মেয়ে যারাই পাস করল, তারা এ দেশেরই ছেলে বা মেয়ে।

 এখানে আলোচনার বিষয় হতে পারে, যারা পাস করল তাদের সবাই কলেজে যাবে কি না। একটা বড় অংশ শিক্ষাব্যবস্থা থেকে ঝরে যাবে। গ্রামের মেয়েদের অনেকের বিয়ে হয়ে যাবে। অনেক গরিব ঘরের ছেলে বেকার থাকলেও কলেজে যাওয়ার সুযোগ পাবে না পরিবারের আর্থিক অসচ্ছলতার করণে। অনেকে ভর্তি হওয়ার মতো কলেজে স্থান পাবে না। সম্মিলিতভাবে ৮৩.০৪% মাধ্যমিক পরীক্ষায় সফল হলো, বাকিদের ভাগ্যে কী আছে? তাদের স্থান কোথায় হবে? শতকরা হারে ১৭ হলেও মোট সংখ্যা কয়েক লাখ। প্রতিবছরই এই একই ঘটনা ঘটছে, কিন্তু কোনো প্রতিকারমূলক পদক্ষেপের বিষয় আলোচিত হয় না। লাখ লাখ ছেলেমেয়ে এভাবে প্রতিবছর হারিয়ে যায়!

শুধু পাসের শতকরা হার শেষ কথা নয়। যারা ফেল করল, তারা কোন কোন বিয়য়ে ফেল করল। সাধারণভাবে ফেলের হার গণিত এবং ইংরেজিতেই বেশি। ওই সব ফেল করা শিক্ষার্থীর স্কুলগুলোতে গণিত এবং ইংরেজির শিক্ষক আছে কি না; ভালো ফল করা বিদ্যায়তনগুলোর ভৌগোলিক অবস্থান কোথায়- প্রায় সব ভালো ফলের  স্কুলগুলো শহরে। আবার শহরেরও সব স্কুল নয়, সারা দেশের বড়জোর ৫০০টা স্কুল গড়পড়তা ফলকে ইতিবাচকভাবে প্রভাবিত করে। মোট কথা, সারা দেশের গড়পড়তা ফলাফল শিক্ষার মান ও বৈষম্যকে আড়াল করে রাখে। 

এখানে শহর-গ্রামের শিক্ষার গুণমানে যে আকাশ-পাতাল ব্যবধান, তার আলোচনা মাঝেমধ্যে হলেও কার্যকর কোনো প্রতিকার হয় না। দেশের মাধ্যমিক শিক্ষার মূল কাঠামোতে বেসরকারি বিদ্যালয়ের প্রাধান্য। দেশের বেসরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের সমস্যা বিস্তর। এসব সমস্যার সমাধানের জন্য এখানে অধিকতর বিনিয়োগ প্রয়োজন। বিনিয়েগের কোনো বিকল্প নেই। বেসরকারি মাধ্যমিকে সরকারি বিনিয়োগ সবচেয়ে কম। শিক্ষাব্যবস্থার ভিত্তি যদি হয় প্রাথমিক শিক্ষা, মাধ্যমিক তার মেরুদণ্ড তথা দেহপিঞ্জরের মূল কাঠামো। কিন্তু মাধ্যমিক শিক্ষা এ দেশে সবচেয়ে অবহেলিত।

মেয়েদের ভালো ফলে সরকারের একটি সহায়তার ইতিবাচক প্রভাব রয়েছে। তা হচ্ছে উপবৃত্তি। মেয়েদের বেশি সংখ্যায় অংশগ্রহণ ও স্কুলে ধরে রাখতে উপবৃত্তির সহায়ক ভূমিকা রয়েছে। গ্রাম ও শহরের দরিদ্র পরিবারগুলোতে স্কুলগামী ছেলেমেয়েরা পড়াশোনার সঙ্গে সঙ্গে পরিবারের নানা কাজে প্রচুর সময় দিয়ে থাকে। তাদের অনেকে নিরবচ্ছিন্নভাবে পড়াশোনায় সময় দিতে পারে না। স্কুলগুলোতে শিক্ষকসংকট না থাকলে এসব শিক্ষার্থী বিশেষ মনোযোগ পেতে পারত। ধনী বা শহুরে মধ্যবিত্ত পরিবারে স্কুলপড়ুয়া ছেলেমেয়েরা শুধু পড়াশোনাই করে। আবার স্কুলের পাঠের অতিরিক্ত হিসেবে প্রাইভেট টিউটরের কাছেও পড়ার সুযোগ পায়। গ্রামের দরিদ্র পরিবারের শিক্ষার্থীদের সে সুযোগ নেই। ভবিষ্যতে দরিদ্র ছেলেদের জন্যও উপবৃত্তি দেওয়া যায় কি না, বিষয়টি ভেবে দেখতে অনুরোধ করি।

কয়েক বছর ধরে কারিকুলাম, প্রশ্ন প্রণয়ন পদ্ধতি ও মূল্যায়নব্যবস্থায় অনেক পরীক্ষা-নিরীক্ষা হয়েছে। এখনো হচ্ছে। গ্রামের অনুন্নত বিদ্যালয়গুলোর শিক্ষকদের অনেকে এসব পরিবর্তনের সঙ্গে সঠিকভাবে মানিয়ে নিতে পুরোপুরি সক্ষম হননি। বেসরকারি বিদ্যালয়ের নিয়োগ ও পরিচালনা প্রক্রিয়ায় নানা অযাচিত রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ ইত্যাদি তো রয়েছেই। মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিকে বিজ্ঞান শিক্ষা বিষয়ে বলতে হয়, বিজ্ঞান শিক্ষার সক্ষমতা বেশির ভাগ স্কুল ও কলেজে নেই। কোনো ব্যবহারিক ক্লাস ও পরীক্ষা সঠিকভাবে হয় না। ব্যবহারিকে ইচ্ছামতো নম্বর দেওয়া হয়। স্কুল-কলেজ থেকে বিজ্ঞান বিভাগে পাস করার পর বেশির ভাগ শিক্ষার্থী বিজ্ঞান আর পড়ে না। এভাবে এ দেশে বিজ্ঞান ও কারিগরি শিক্ষার প্রসার হচ্ছে না। স্কুল ও কলেজ পর্যায়ে ল্যাব সুবিধা এত অপ্রতুল, কল্পনাও করা যায় না। হালে অনেক প্রতিষ্ঠানে কম্পিউটার ল্যাব হয়েছে, কিন্তু চর্চা খুবই সীমিত।

মেয়েদের আগে যাওয়ার প্রসঙ্গে ফিরে আসি। মেয়েদের ‌‘আগে দেওয়া’র একটি পুরোনো গল্প দিয়ে আজকের লেখা শেষ করি। এক নৃতত্ত্ববিদ বার্মায় দীর্ঘদিন ধরে গবেষণা করেছেন। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ শেষ হওয়ার পর তিনি পুনরায় বার্মায় গিয়ে অভিভূত। সমাজে এক বৈপ্লবিক পরিবর্তন হয়ে গেছে। মাঠে-ঘাটে, শহরে-গ্রামে সর্বত্র মেয়েরা পুরুষদের বেশ তফাতে রেখে সামনে হাঁটে। পুরুষরা ত্রস্তপায়ে ধীরলয়ে বেশ তফাতে মেয়েদের পেছন পেছন হাটে। মেয়েদের এ উন্নতি ও সামনে আসার এ পরিবর্তনের কারণ অনুসন্ধানে নৃতত্ত্ববিদ যা দেখতে পেলেন তাতে তার আক্কেলগুড়ুম! জাপানিরা যুদ্ধের সময় বিভিন্ন স্থানে মাইন পুঁতে গেছে। তাদের কাছে মাইন অপসারণের কোনো প্রযুক্তি ও প্রশিক্ষণ নেই। শেষে দেশের পুরুষরা একটা কৌশল অবলম্বন করল। এখন থেকে কিছুদিন নারীরা পুরুষের সামনে থাকবে। নারীদের মাইন বিস্ফোরণের সম্ভাব্য বিপদের ঢাল হিসেবে পুরুষের সামনে হাঁটতে হবে। পুরুষরা আত্মরক্ষার জন্য এভাবে নারীদের এগিয়ে যেতে হবে। দেশপ্রেমিক নারীরা হাসিমুখে এ মহান দায়িত্ব কিছুদিন পালন করে যাবেন।

বাংলাদেশের মাধ্যমিক স্তরের মেয়েদের এগিয়ে যাওয়া সে রকম নয়। এটি তাদের সত্যিকারের অর্জন। এ অর্জনের জন্য আন্তরিক অভিনন্দন। এ অর্জন টেকসই এবং আরও উজ্জ্বল হোক।

লেখক: গবেষক ও স্থানীয় শাসন বিশেষজ্ঞ
[email protected] 

রাখাইনে আরাকান আর্মির নিয়ন্ত্রণ ও বাংলাদেশের প্রস্তুতি

প্রকাশ: ১৯ মে ২০২৪, ১০:২০ এএম
রাখাইনে আরাকান আর্মির নিয়ন্ত্রণ ও বাংলাদেশের প্রস্তুতি
ব্রিগেডিয়ার জে. হাসান মো. শামসুদ্দীন (অব.)

রাখাইন রাজ্যের ওপর তাদের পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার জন্য আরাকান আর্মি (এএ) মায়ানমার সেনাবাহিনীর সঙ্গে অপ্রতিরোধ্য গতিতে যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছে। এএ সিটওয়ে ও চকপিউ শহর ঘিরে ফেলেছে এবং সিটওয়ে ও চকপিউ বন্দরের কাছাকাছি চীনা অর্থায়নকৃত তেল ও গ্যাস টার্মিনালের খুব কাছের এলাকায় যুদ্ধ করছে। সমগ্র আরাকান পুনরুদ্ধার করাই এএর উদ্দেশ্য এবং সে উদ্দেশ্য বাস্তবায়নে তারা অপ্রতিরোধ্য গতিতে এগিয়ে চলছে। দক্ষিণ রাখাইনের আন ও থান্ডওয়ে টাউনশিপের পাশাপাশি বাংলাদেশ সীমান্তবর্তী উত্তর রাখাইন, বুথিডং ও মংডুতেও লড়াই তীব্র আকার ধারণ করেছে। মায়ানমারের রাখাইন রাজ্যের বাংলাদেশের সঙ্গে লাগোয়া ট্রাইজংশন থেকে শুরু করে মংডু-সংলগ্ন পুরো এলাকা বর্তমানে এএর নিয়ন্ত্রণে।

২০২২ সালের নভেম্বরে এএ জান্তার সঙ্গে একটি অনানুষ্ঠানিক যুদ্ধবিরতিতে রাজি হয়। ব্রাদারহুড অ্যালায়েন্স ২০২৩ সালের অক্টোবরে অপারেশন ১০২৭ নামে জান্তার ওপর সমন্বিত আক্রমণ শুরুর পর এএ চুক্তি লঙ্ঘন করে ১৩ নভেম্বর রাখাইন রাজ্যের রাথেডং, মংডু ও মিনবাইয়া শহরে পাঁচটি ঘাঁটিতে হামলা চালিয়ে মায়ানমার সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে অভিযান শুরু করে। রাখাইনে সেনাবাহিনীর ওপর এএর আক্রমণ অব্যাহত রয়েছে এবং দিন দিন এর তীব্রতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। ২৭ এপ্রিল অ্যানে ওয়েস্টার্ন রিজিওনাল কমান্ডের সদর দপ্তরের কাছের দুটি কৌশলগত অবস্থানে তাদের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করে। এএ অ্যানসহ আরও তিনটি শহরতলিতে আক্রমণ চালাচ্ছে। 

পরবর্তী সময়ে এএ ৩০ এপ্রিল রাখাইন রাজ্যের বুথিডং টাউনশিপে হামলা চালিয়ে তিনটি আউটপোস্ট দখল করে। বর্তমানে রাখাইন রাজ্যের ১৭টি শহরতলির মধ্যে ৮টি এবং পার্শ্ববর্তী রাজ্য চীনের পালেতোয়া শহর এখন এএর নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। জান্তা স্থলপথে শক্তি বৃদ্ধি করতে সেনা পাঠাতে বাধার সম্মুখীন হচ্ছে এবং এএ তাদের ওপর অতর্কিতে হামলা চালাচ্ছে। অ্যান টাউনশিপের গ্রামগুলোর কাছেও লড়াই তীব্র আকার ধারণ করেছে। চলমান সংঘর্ষের কারণে আশপাশের গ্রামের বাসিন্দারা বাড়িঘর ছেড়ে পালিয়েছে। মায়ানমার সেনাবাহিনী অ্যান পর্যন্ত রাস্তা ও নৌপথ অবরোধ করে বাণিজ্য বন্ধ করে দেওয়ায় খাদ্য ও ওষুধের সংকটের কারণে মানুষ ভোগান্তিতে দিন কাটাচ্ছে। 

রাখাইন রাজ্যে এএ ও সামরিক বাহিনীর মধ্যকার লড়াইয়ের তীব্রতার কারণে বিজিপি ও অন্যান্য নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যরা প্রাণভয়ে পালিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নিচ্ছেন। বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া বিজিপি, সেনাবাহিনী ও শুল্ক কর্মকর্তাসহ মায়ানমারের ৩৩০ নাগরিককে ১৫ ফেব্রুয়ারি ও পরে ২৮৮ জনকে ২৫ এপ্রিল বিজিপির কাছে হস্তান্তর করা হয়। এএর আক্রমণে বিজিপি সদস্যদের প্রাণভয়ে পালিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া অব্যাহত রয়েছে। 

২০১৭ সালে রাখাইন থেকে রোহিঙ্গা বিতাড়নের পর ২০১৮ সালের শেষের দিকে এএর সঙ্গে মায়ানমার সেনাবাহিনীর তীব্র সংঘর্ষ শুরু হয়। সে সময় আরাকানে ২ লাখ ৩০ হাজারের বেশি মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়েছিল। সংঘাতের সময় ইয়াঙ্গুন থেকে খাদ্যপণ্যের আমদানি বন্ধ হয়ে গেলে রাখাইনে মানবিক সমস্যাগুলো গুরুতর হয়ে ওঠে। রাখাইনে মানবিক সাহায্যের অনুমতি দেওয়া, এএর প্রশাসনিক কাজে এবং রাখাইনে বিচার-প্রক্রিয়ায় জান্তা বাহিনীর বাধা না দেওয়ার শর্তে ২০২০ সালের ২৬ নভেম্বর এএ জাপানের মায়ানমারবিষয়ক বিশেষ দূত সাসাকাওয়ার নেতৃত্বে মায়ানমার সেনাবাহিনীর সঙ্গে একটি অনানুষ্ঠানিক যুদ্ধবিরতিতে সম্মত হয়। 

২০২০ সালের নির্বাচনে এনএলডি রাখাইনে ইউনাইটেড লিগ অব আরাকানের (ইউএলএ) কাছে শোচনীয়ভাবে পরাজিত হয়। ক্ষমতায় থাকাকালীন সু চি সরকার এএকে সন্ত্রাসী সংগঠনের তালিকাভুক্ত করে রেখেছিল। ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারির সামরিক অভ্যুত্থানের পর রাখাইন রাজ্যে আপাত শান্তি বজায় ছিল। সে সময় দেশব্যাপী চলমান প্রতিরোধ আন্দোলন থেকে এএকে দূরে সরিয়ে রাখতে জান্তা সংগঠনটিকে কালো তালিকা থেকে বাদ দিয়ে তাদের সঙ্গে একটি অনানুষ্ঠানিক যুদ্ধবিরতির আয়োজন করে। 

এএ ও ইউএলএ এই সুযোগ কাজে লাগিয়ে পুরোপুরি রাজনীতিতে মনোনিবেশ করে এবং রাখাইন রাজ্যে ব্যাপক গণসংযোগ চালায়। সে সময় রাখাইনের অনেক এলাকায় তাদের প্রশাসনিক নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করে ও তাদের রাজনৈতিক এবং বিচারিক নেটওয়ার্ক ছড়িয়ে দেয়। উত্তর এবং দক্ষিণ রাখাইনের মধ্যে যুগ যুগ ধরে বিদ্যমান দূরত্ব কমিয়ে আনে এবং ধীরে ধীরে তারা রাখাইনবাসীর একমাত্র আস্থার প্রতীক হয়ে ওঠে। এএ রাখাইনে একটি শাসনব্যবস্থা বাস্তবায়নের জন্যপ্রশাসন, বিচার বিভাগ এবং জননিরাপত্তা নিশ্চিতে শক্তিশালী প্রতিষ্ঠান তৈরির লক্ষ্যে কাজ করছে। জান্তা বিষয়টি ভালোভাবে গ্রহণ না করায় ২০২২ সালের আগস্ট এএ ও মায়ানমার সেনাবাহিনীর মধ্যে আবার তীব্র লড়াই শুরু হয়। ২০২২ সালের নভেম্বরে পুনরায় অনানুষ্ঠানিক যুদ্ধবিরতিতে উভয় পক্ষ সম্মত হয়। 

এএ মায়ানমারের জাতিগত সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোর মধ্যে সবচেয়ে নতুন হওয়া সত্ত্বেও দেশের সবচেয়ে শক্তিশালী এবং সফল সংগঠনগুলোর একটিতে পরিণত হয়েছে। এএর ক্যারিশম্যাটিক নেতৃত্বের কারণে উত্তর ও দক্ষিণ রাখাইনে তাদের প্রভাব ও সুসংগঠিত নেটওয়ার্ক তৈরি হয়। রাখাইনে এর আগে কোনো সশস্ত্র গোষ্ঠীর এভাবে সুসংগঠিত নেতৃত্বের নিয়ন্ত্রণে ছিল না। এএ প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর গত ১৫ বছরে উল্লেখযোগ্য অর্জনের মাধ্যমে তাদের লক্ষ্যের কাছাকাছি যাওয়ার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। এএর সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার জননিরাপত্তা।

বিমান হামলা এবং ল্যান্ডমাইন থেকে নিজেদের রক্ষার বিষয়ে তারা বাসিন্দাদের ক্রমাগত সচেতন করছে। তারা ল্যান্ডমাইন পরিষ্কার করা, খাদ্য, ওষুধ, কৃষি খাতে সহায়তা ও স্বাস্থ্যসেবা প্রদান করছে। এএ বাংলাদেশ-মায়ানমার সীমান্ত এলাকার নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার পর নাফ নদীসহ এই সীমান্তে পাচার রোধে কাজ করে যাচ্ছে। তবে তা পুরোপুরি বন্ধ করতে তারা বাংলাদেশ সরকারের সহযোগিতা চায়। সম্প্রতি এএর মুখপাত্র থেকে জানা যায় যে, তারা ধর্ম-বর্ণনির্বিশেষে ভবিষ্যতে আরাকানের সব নাগরিকের দায়িত্ব নিতে প্রস্তুত। তারা আরাকানের সব নাগরিকের জন্য কাজ করছে এবং নিজেদের লক্ষ্য পূরণ না হওয়া পর্যন্ত এএ লড়াই চালিয়ে যাবে। 

এএ পূর্ণ আত্মনিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে মায়ানমারের রাষ্ট্রকাঠামোর অধীনে ভবিষ্যতে আরাকান রাজ্য গড়ে তুলতে চায়। এএর মূল শক্তি হলো রাখাইনবাসীর সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি, ধর্মীয় সহনশীলতা ও শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের অঙ্গীকার। এএ-নিয়ন্ত্রিত এলাকাগুলোয় রোহিঙ্গাদের সঙ্গে তাদের একধরনের স্বস্তিমূলক সম্পর্ক গড়ে উঠেছে বলে জানা যায়। কিছু কিছু প্রশাসনিক কাজেও রোহিঙ্গাদের নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। অদূর ভবিষ্যতে রাখাইনে ওদের প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার মতো আর কেউ থাকবে না। এএ রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবর্তন এবং আরাকানে নাগরিক মর্যাদাসহ তাদের বসবাসের বিষয়ে মায়ানমার জান্তা সরকারের চেয়ে অনেক নমনীয়। 

অতীতে সেনা-সরকার ও এনএলডি রোহিঙ্গাদের প্রতি বিদ্বেষমূলক আচরণ দেখালেও এএ রোহিঙ্গাদের সঙ্গে নিয়েই এগোতে চায়। এএ রাখাইনে নিজস্ব প্রশাসন, বিচার বিভাগ ও অন্যান্য অবকাঠামো তৈরির জন্য কাজ করে যাচ্ছে। রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন টেকসই ও নিরাপদ করতে হলে এবং রাখাইনে যেকোনো ধরনের কার্যক্রম পরিচালনায় তাদের সম্পৃক্ত করতেই হবে। বাংলাদেশ প্রান্তে রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোর শান্তিশৃঙ্খলা নিশ্চিত করতে হবে। রোহিঙ্গাদের মায়ানমারে ফিরে যাওয়ার বিষয়ে মানসিকভাবে প্রস্তুত রাখার পাশাপাশি তাদের স্বাবলম্বী বানাতে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সহায়তায় প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে। 

রাখাইনে চলমান সংঘাত একটা দীর্ঘমেয়াদি সংকটের জন্ম দিতে পারে। জান্তা রাখাইনে ‘ফোর কাট স্ট্র্যাটেজি’ ব্যবহার করে সংঘাতপূর্ণ এলাকায় খাদ্য, চিকিৎসাব্যবস্থা, যোগাযোগ বিছিন্ন করে এএকে জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। চলমান সংঘাতে রাখাইনের সাধারণ মানুষ চরম দৈন্যদশায় রয়েছে এবং রাখাইন রাজ্যের বিভিন্ন এলাকায় প্রায় দুর্ভিক্ষের অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। রাজ্যের স্বাভাবিক জীবনযাত্রা এবং উন্নয়ন কার্যক্রম ব্যাহত ও ধীর হয়ে পড়ছে। যুদ্ধ আরও তীব্র হলে মায়ানমার থেকে বাস্তুচ্যুত জনগণের বাংলাদেশের সীমান্তের দিকে পালিয়ে আসার সম্ভাবনা রয়েছে। বাংলাদেশ আর কোনো মায়ানমারের নাগরিককে প্রবেশ করতে দেবে না বলে জানিয়েছে। তাই বিকল্প হিসেবে থাইল্যান্ড-মায়ানমার সীমান্তবর্তী অঞ্চলে যে ধরনের মানবিক করিডরের পরিকল্পনা করা হয়েছে, রাখাইনে জাতিসংঘ ও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সহায়তায় সে ধরনের করিডর তৈরির পরিকল্পনা করা যেতে পারে।

অদূর ভবিষ্যতে রাখাইনের পরিস্থিতি স্থিতিশীল হওয়ার সম্ভাবনা খুব ক্ষীণ। রাখাইন রাজ্যটি ভূ-কৌশলগত কারণে গুরুত্বপূর্ণ বিধায় এখানে আঞ্চলিক দেশ ও অন্য স্টেকহোল্ডারদের অর্থনৈতিক, বাণিজ্যিক ও অন্যান্য স্বার্থ রয়েছে। মায়ানমার সেনাবাহিনী এই গুরুত্বপূর্ণ রাজ্যটি সহজে হাতছাড়া করবে না। রাখাইনের দখল নিয়ে এএ ও মায়ানমার সেনাবাহিনীর মধ্যে আক্রমণ ও পাল্টা আক্রমণ চলতে থাকবে এবং পরিস্থিতি আরও অস্থিতিশীল হয়ে উঠবে। বাংলাদেশকে সামনের দিনগুলোতে মায়ানমার সরকার, এএর সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়ন, সীমান্ত নিরাপত্তা এবং চলমান রোহিঙ্গা সংকটের সমাধানে কূটনৈতিক ও নিরাপত্তা চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে। 

লেখক: মায়ানমার ও রোহিঙ্গাবিষয়ক গবেষক 

পরিবেশগত যুদ্ধাপরাধের বিচার চাওয়ার সময় এসেছে

প্রকাশ: ১৮ মে ২০২৪, ১১:১০ এএম
পরিবেশগত যুদ্ধাপরাধের বিচার চাওয়ার সময় এসেছে
মেরি রবিনসন ও মার্গট ওয়ালস্ট্রোম

যুদ্ধ সব সময় ব্যক্তি, সম্প্রদায় এবং জাতির জন্য ভয়াবহ। যুদ্ধের ফলে মানুষের জীবন যে কতভাবে বিপর্যয়ের শিকার হয়, বিশ্বে তা প্রতিনিয়ত দেখা যাচ্ছে। অবিলম্বে এ বিষয়ে মনোযোগ, সমবেদনা এবং পদক্ষেপের দাবি রাখে। যদিও কিছু লঙ্ঘন স্পষ্ট, কিন্তু সেগুলো তদন্ত করা ও আশ্রয় দেওয়ার যেসব প্রতিষ্ঠান রয়েছে, সেগুলো ততটা স্পষ্ট নয়। তার মধ্যে অন্যতম উদাহরণ হলো পরিবেশগত যুদ্ধাপরাধ।

আমরা ইতোমধ্যে বায়ু, জল এবং প্রাকৃতিক পরিবেশের ওপর যুদ্ধের প্রভাবের সম্পূর্ণ পরিমাণ বুঝতে শুরু করেছি। মাটি ও কৃষি, শক্তি ও জল অবকাঠামো এবং শেষ পর্যন্ত জনস্বাস্থ্য এবং নিরাপত্তার ওপর যুদ্ধের প্রভাব চরম আকারে পড়েছে। চ্যালেঞ্জ হলো, এর অনেক কিছুই সহজে দেখা যায় না এবং এসব বিষয়ে কখনো গবেষণা করা হয়নি। যুদ্ধের ভয়াবহতা আমরা যা দেখি তা নামেমাত্র দৃশ্যমান। যুদ্ধকবলিতদের সংখ্যা কল্পনার চেয়ে অনেক বেশি হতে পারে।

যেখানে ভেঙে পড়া ভবন রয়েছে, সেখানে প্রাণঘাতী অ্যাসবেস্টস এবং সিলিকা ধুলো বাতাসে ছড়িয়ে পড়তে পারে। যেখানে ল্যান্ডমাইন এবং অবিস্ফোরিত বোমা, ভারী ধাতু এবং অন্যান্য শক্তিশালী দূষণকারী পদার্থ ছড়িয়ে থাকতে পারে। এর মধ্যেই কিছু প্রজন্ম জীবন ধারণ করে চলছে। যেখানে হ্রদ ও কষিজমি বিষাক্ত হয়ে ওঠে, সেখানে খাদ্যনিরাপত্তা ক্ষতিগ্রস্ত হয়।

আজকের আন্তর্জাতিক আইনে ইতোমধ্যেই এমন যুদ্ধাপরাধের বিচারের আওতায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে, যা পরিবেশের ব্যাপক ক্ষতি করে। তবে এ ধরনের অপরাধের বিচার স্থানীয় বা আন্তর্জাতিক আদালতে বিরল ঘটে। এ ধরনের ক্ষতির জন্য ক্ষতিপূরণও অনেক কম। 

কিছু ইতিবাচক লক্ষণ আছে, এটি পরিবর্তন হতে পারে। জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদ ২০২২ সালে সশস্ত্র সংঘাতের ক্ষেত্রে পরিবেশ সুরক্ষার বিষয়ে একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রস্তাবে এই বিষয়টির প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিল। সেখানে উল্লেখ করা হয়েছিল, যুদ্ধে অন্যায়ভাবে যারা পরিবেশের ক্ষতি করবে, সম্পূর্ণ ক্ষতিপূরণ সেই সব  রাষ্ট্রকে দিতে হবে। মার্চের ১ তারিখে জাতিসংঘের পরিবেশ পরিষদ একটি সর্বসম্মত প্রস্তাব পাস করেছে, এতে সশস্ত্র সংঘাতে পরিবেশগত ক্ষতি সম্পর্কে আরও তথ্য সংগ্রহের আহ্বান জানানো হয়।

আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের প্রসিকিউটর করিম খান ঘোষণা করেছেন, তার কার্যালয় পরিবেশগত অপরাধের ওপর ব্যাপক নীতি প্রণয়ন করছে। এই অপরাধের জন্য জবাবদিহি করতে হবে। 

বাস্তব একটি চ্যালেঞ্জ হলো, পরিবেশের ক্ষতি পরিমাপ করা বিশেষ করে যখন সংঘর্ষ চলে। কিন্তু জনস্বাস্থ্য রক্ষা এবং ক্ষতি কমানোর জন্য জরুরি ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য এটি খুবই দরকার; যেমন নদী বা কৃষিজমিতে মারাত্মক দূষণ ছড়িয়ে পড়া বন্ধ করা। ক্ষয়ক্ষতির নথিভুক্ত করাও গুরুত্বপূর্ণ, যাতে সম্পূর্ণ ক্ষতিপূরণ প্রদান করা সম্ভব হয়। যদি যুদ্ধের অপব্যবহার বা বেআইনি কাজের কারণে হয়, তাহলে অপরাধীদের জবাবদিহি করা যাবে। 

ইউক্রেনে রাশিয়ার পূর্ণ মাত্রায় আগ্রাসন প্রাকৃতিক পরিবেশে ভয়াবহ প্রভাব ফেলেছে। ইউক্রেন চিত্তাকর্ষক জীববৈচিত্র্য ও প্রাকৃতিক সম্পদের একটি দেশ, কিন্তু যুদ্ধ অনেক এলাকা ধ্বংস করে দিয়েছে। মাটি এবং জলপথ রাসায়নিক মিশ্রণে দূষিত হয়েছে। অন্যদিকে কৃষিজমি, বন এবং সবুজ স্থানগুলো গোলাবর্ষণ, আগুন এবং বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এক বছর আগে কাখোভকা বাঁধ ধ্বংস, যা দখলদার রাশিয়ান বাহিনীর ইচ্ছাকৃত কাজ বলে মনে করা হয়। এর ফলে গ্রাম ও কৃষিজমি প্লাবিত হয় এবং কৃষ্ণ সাগরের সর্বত্র ব্যাপক পরিবেশদূষণ হয়।

ইউক্রেনের এক-তৃতীয়াংশ অঞ্চল ল্যান্ডমাইন বা অবিস্ফোরিত বোমায় দূষিত বলে সন্দেহ করা হচ্ছে, যা বিশ্বের অন্য যেকোনো দেশকে ছাড়িয়ে গেছে। আমরা ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কির সাহসী উদ্যোগে যোগ দিয়ে পরিবেশগত উদ্বেগগুলোকে বিশ্বের নজরে আনার প্রচেষ্টায় অংশগ্রহণ করেছি। 

প্রেসিডেন্ট ইউক্রেন যুদ্ধের পরিবেশগত পরিণতি নিয়ে উচ্চস্তরের কর্মশালা গ্রুপ তৈরি করেছেন। তার সদস্য হতে পেরে আমরা সন্তুষ্ট। তিনি যুদ্ধ শেষ হওয়ার জন্য একটি কাঠামো প্রস্তাব করেছেন; যেখানে শান্তি প্রতিষ্ঠার মূল উপাদান হিসেবে থাকবে পরিবেশগত সুরক্ষা।

প্রথমত, পরিবেশগত ক্ষয়ক্ষতি নথিভুক্ত করার জন্য আধুনিক প্রযুক্তিকে কাজে লাগাতে সুস্পষ্ট নির্দেশিকা প্রতিষ্ঠা করতে হবে। এ ধরনের মান প্রতিষ্ঠার জন্য আন্তর্জাতিক অংশীদারদের সঙ্গে কাজ করতে হবে। ইউক্রেন তার সব সংঘাতে পরিবেশগত ক্ষতির নথিভুক্ত করার নির্দেশনায় সাহায্য পাবে। 

দ্বিতীয়ত, এ তথ্য ও প্রমাণ হাতে নিয়ে আমাদের অবশ্যই অপরাধীকে জবাবদিহির আওতায় আনতে হবে। তাদের কাছ থেকে সম্পূর্ণ ক্ষতিপূরণ আদায় নিশ্চিত করতে হবে। জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক পর্যায়ে পরিবেশগত দূষণ কমানোর প্রচেষ্টা চলছে।

পরিবেশগত ন্যায়বিচারের জন্য একটি জাতীয় কৌশল তৈরি করেছে ইউক্রেনের প্রসিকিউটর জেনারেল। আন্তর্জাতিক পর্যায়ে সর্বজনীন ক্ষমতা প্রয়োগ করে আদালতে এই অপরাধগুলোর বিচারের জন্য আরও বেশি মনোযোগ দিতে হবে। 

পরিবেশগত ক্ষতি এবং প্রয়োজনীয় প্রতিকার বোঝার জন্য তদন্তকারী এবং প্রসিকিউটরদের শিকারকেন্দ্রিক পদ্ধতি অবলম্বন করা উচিত। ইউক্রেনের মানবাধিকার তদন্তে পরিবেশগত ক্ষতি এবং জনস্বাস্থ্যের ঝুঁকির দিকে বিশেষভাবে মনোযোগ দেওয়া উচিত।

পরিশেষে কর্মরত গ্রুপটি টেকসই পুনর্গঠনের গুরুত্বের দিকে বেশি জোর দিচ্ছে। জলবায়ু ও পরিবেশের বন্ধুত্বপূর্ণ উন্নয়ন কৌশলগুলোকে অন্তর্ভুক্তি করতে হবে। এই নীতিগুলো প্রয়োগ করার প্রচেষ্টা এখনই শুরু করতে হবে। কারণ ইউক্রেনের কিছু অংশে ইতোমধ্যেই পুনর্নির্মাণের কাজ চলছে।

ইউক্রেনে ন্যায়বিচার এবং সবুজায়ন পুনরুদ্ধার হলে বিশ্বজুড়ে সংঘাত এড়ানো যাবে এবং অন্যান্য দেশের উপকারে আসবে। দুই বছর আগে রাশিয়া যখন ইউক্রেনে তার পূর্ণমাত্রায় আগ্রাসন শুরু করেছিল, তখন ক্রেমলিন আন্তর্জাতিক আইনকে ঝুঁকির মধ্যে ফেলেছিল। রাশিয়ার কর্মকাণ্ড আন্তর্জাতিক আইন ও জাতিসংঘ সনদের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন। ভবিষ্যতের বৈশ্বিক পরিস্থিতি, আইনের স্পষ্ট লঙ্ঘনের জন্য ন্যায়বিচারের প্রত্যাশা, পরিবেশের ওপর ভয়ানক আক্রমণসহ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় কীভাবে এই আগ্রাসনের প্রতিবাদ করে তা নির্ধারণ করা দরকার।

আমরা সবাই জানি যে, পরিবেশগত হুমকি সীমান্তে থেমে থাকে না। ইউক্রেনে পারমাণবিক বিকিরণ বিপর্যয়ের ঝুঁকি রয়েছে। কারণ ইউরোপের বৃহত্তম জাপোরিঝঝিয়া পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র রাশিয়া দখল করে নিয়েছে। ফলে আঞ্চলিক হুমকির বড় উদ্বেগজনক অবস্থায় রয়েছে। আরেকটি হলো কৃষ্ণসাগরে যুদ্ধের প্রভাব, যেখানে পরিবেশগত ক্ষতি সামুদ্রিক জীববৈচিত্র্যের ওপর মারাত্মক প্রভাব ফেলছে। সমুদ্রজলের এই গুরুত্বপূর্ণ অংশের সীমান্তবর্তী সব দেশ এর মাধ্যমে ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। 

এখন বিশ্ব সংঘাতে পরিবেশগত অপরাধের মাত্রার প্রতি জনগণ জাগ্রত হচ্ছে। আমাদের অবশ্যই কাজ করতে হবে, যাতে জবাবদিহি অনুসরণ করা হয়। স্বতন্ত্র অপরাধ এবং অপরাধকারী রাষ্ট্রের পরিবেশগত ক্ষতির দায় বহন করতে হবে এবং উভয়ই তা মোকাবিলায় ক্ষতিপূরণ দিতে হবে। 

ইউক্রেনে বিচার হবে। ন্যায়বিচার সব ক্ষেত্রেই সমানভাবে প্রযোজ্য। যেখানে বলপ্রয়োগ আইনের সীমা অতিক্রম করে, সেখানেও সমানভাবে কার্যকর হবে। আসুন, আমরা একসঙ্গে কাজ করি। একটি সবুজ, ন্যায্য এবং শান্তিপূর্ণ ভবিষ্যৎ গড়ে তুলি। 

লেখক: মেরি রবিনসন, আয়ারল্যান্ডের সাবেক প্রেসিডেন্ট
দ্য এল্ডার্সের চেয়ার ও মানবাধিকারবিষয়ক জাতিসংঘের সাবেক হাইকমিশনার 
মার্গট ওয়ালস্ট্রোম, সুইডেনের সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী
আল-জাজিরা থেকে সংক্ষেপিত অনুবাদ: সানজিদ সকাল 

প্রথম কালবৈশাখী

প্রকাশ: ১৮ মে ২০২৪, ১১:০৩ এএম
প্রথম কালবৈশাখী
ড. পবিত্র সরকার

এ বছর তার মতো অভ্যর্থনাযোগ্য আর কিছুই ছিল না। প্রচণ্ড গরম পড়েছিল, কাগজে (রেডিও শোনা হয় না, টেলিভিশনও দেখা হয় না) মার্চ, এপ্রিল- দুই মাসেই কত কত দশকের গরমের রেকর্ড হচ্ছে বলে দেখাচ্ছিল। আর শুধু কাগজ কেন, আমাদের সর্বাঙ্গে যে জীবিত মনুষ্য চর্ম আছে, তা আমার ক্ষেত্রে যথেষ্ট পুরু, কিন্তু সেও হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছিল যে গরম পড়ছে বটে। প্রতিটি পরের দিন আগের দিনটিকে ছাড়িয়ে যাচ্ছে গরমে। আমরা দরদর করে ঘামছি, যেখানে ফ্যানের হাওয়া আড়াল হচ্ছে, সেখানে ঘাম জমছে, বাইরে রোদে বেরোলে শরীরটা ঝাঁকি দিয়ে উঠছে, ফিরে এসে জল বা ওআরএস গিলছি চোঁ-চোঁ করে, ঘুমের মধ্যে নিদ্রাহীনতা এসে হামলা করছে। সকালে কলের জল দেখতে দেখতে গরম হয়ে যাচ্ছে, কল থেকে চোখেমুখে জল দিয়ে স্বস্তি পাচ্ছি না। আমি নিজেকে সর্বহারা ভাবি না, কিন্তু এসি চালাতে গিয়ে মাসের শেষে পিলে চমকে দেওয়া বিদ্যুৎ বিলের কথা ভাবব না, এখনো উচ্চবিত্ততার সেই আরামপ্রদ স্তরে উঠতে পারিনি। দিনক্ষণের হিসেবে আর পারার সম্ভাবনাও নেই। 

তাই আমারও এবারের গরমে, আমার প্রয়াত স্ত্রীর ভাষায়, ‘পাগল-পাগল’ লাগছিল। মনে হচ্ছিল, সহ্যের শেষ সীমায় পৌঁছে গেছি, আর দু-এক ডিগ্রি বাড়লেই প্রাণপাখি খাঁচা ছেড়ে শুট করে পালাবে। খবরের কাগজে দেখলামও বটে যে, দেশে বেশ কয়েকজন বৃদ্ধবৃদ্ধা মারা গেছে গরমে। আগে জানতাম শীতকালই বৃদ্ধবৃদ্ধাদের মরবার পক্ষে প্রশস্ত সময়, এখন দেখছি গরমকালও কম যায় না। যা-ই হোক, এই গরমে ‘এবার আমার গেল বেলা’ গোছের একটা কোটেশন যখন মাথার মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছে, তখন সে এল।

কে? না, বছরের প্রথম কালবৈশাখী। সে যখন দিন তিনেক আগে সন্ধের পর এল, তখন আমি ঘুমোইনি যে বলব, ‘আমি তখন ছিলেম মগন গহন ঘুমের ঘোরে’। তারপর রবীন্দ্রনাথের বর্ণনামতো তার পাল্লায় পড়ে যাব। আসলে সেসব কিছুই হয়নি। এমনকি বললে অবিশ্বাস্য মনে হবে, আমি তার আসা টেরই পাইনি, সম্পূর্ণ জেগে থাকা সত্ত্বেও। আমি ছিলাম আমার বাড়ির পেছনে আমার কম্পিউটারের কুঠুরিতে, কী একটা লেখা নিয়ে ব্যস্ত। ঘরটায় আগে বারান্দা ছিল, এখন কাচের জানালা দিয়ে ঘেরা। তবে সবই বন্ধ থাকে। কম্পিউটারের চাবি টেপায় ব্যস্ত ছিলাম বলে বাইরের আওয়াজকে বাইক, অটো ইত্যাদির স্বাভাবিক চলাচলের আওয়াজ বলে আমার অন্যমনস্কতা বুঝে নিচ্ছিল, এমন সময় আমার গৃহসহায়িকার সেই নাতি, এগারো বছরের সুদীপ মিস্ত্রি দৌড়ে এসে বলল, ‘দাদু, খুব ঝড়বৃষ্টি হচ্ছে!’

শুনে আমার একটা ধাক্কা লাগল। আমার অভ্যস্ত প্রতিবেশে আমি বহাল, আর সেখানে ‘ঝড়বৃষ্টি হচ্ছে’ এই খবরটা আমাকে অন্যের মুখে শুনতে হলো! সারা জীবনে তো এমন কখনো হয়নি! 

পাঠক জানেন, আমি গ্রামের ছেলে, শৈশবের বছর এগারো আমার শহর স্পর্শহীন গ্রামে কেটেছে। আমার বাড়ির সামনেই ছিল দিগন্তব্যাপী শস্যক্ষেত্র- তার আন্তরিক কাজই ছিল উত্তর-পুবের নদী আর গ্রামকে ছেড়ে দিয়ে ওই দক্ষিণের আর পশ্চিমের দিগন্তকে যত দূরে ঠেলে সরিয়ে রাখা যায় তার চেষ্টা, আর দূরের গ্রামের গাছপালাগুলোকে কালো পেনসিলের সামান্য দাগের চেহারা দেওয়া। আমাদের আকাশকে সে টেনেটুনে অনেকটা বাড়িয়ে রেখেছিল, যাতে আমাদের মনে হতো আকাশ শুধু সূর্যোদয় সূর্যাস্তের জায়গা নয়, সে নিজেই একটা ঘটনা। কার্তিক মাসের কৃষ্ণপক্ষের শেষ দিকের রাতে কখনো গ্রামের মাঠে শুয়ে সেই আকাশকে লক্ষ করেছি, দেখেছি অন্তহীন গ্রহ-নক্ষত্রের মেলা তার গভীর থেকে গভীরে ছড়িয়ে গেছে। সেই বিশাল ছড়িয়ে যাওয়া আকাশে দিনের শেষে যখন কালবৈশাখী দেখা দিত তাকে এড়িয়ে যাওয়ার কোনো রাস্তাই আমাদের ছিল না। না, শুধু কাঁচা আম কুড়োনোর স্মৃতি নয়। 

দেখতাম দক্ষিণ-পশ্চিম কোণ থেকে মেঘের স্তর ছুটে আসছে প্রবল বাতাসে সওয়ার হয়ে, গ্রামের গাছগুলোর ঝুঁটি ধরে নাড়তে শুরু করেছে, গাছগুলোর ডালপালা এক দিকে হেলে নুয়ে পড়ছে। শস্যক্ষেত্রের অবস্থাও একই রকম বিপর্যয়কর, কিন্তু সবচেয়ে সংকটজনক ছবি মাঠের গরুবাছুরগুলোর। তারা খুঁটি উপড়ে, গলার দড়িটড়িসুদ্ধ লেজ তুলে ঘরের দিকে দৌড় শুরু করেছে হাম্বা হাম্বা আওয়াজ তুলে, রাখালরা ছুটে গিয়ে তাদের সামলাতে পারছে না। কোথাও গরিবের ঘরের টিনের চাল উড়ে গিয়ে পড়ছে, চতুর্দিকে বিপুল বাজ পড়ার শব্দ আর বিজলির ঝলকানি। মা-কাকিমারা অনেক আগেই উঠোনের তারে শুকোতে দেওয়া শাড়ি-ধুতি তুলে এনেছেন, আর উঠোনে একটা জলচৌকি পেতে দিয়েছেন, যাতে ঝড়বৃষ্টির দেবতা বরুণ একটু শান্ত হয়ে বসেন। 

তারই মধ্যে বৃষ্টি শুরু হয়ে গেল। সব জায়গায় একসঙ্গে নয়। গ্রামে বৃষ্টি একটা দিক থেকে ‘আসত’। আমরা দেখতাম আমাদের ওই বিশাল শস্যভূমির ওপর দিয়ে ভারী ধূসর পর্দা বা দেয়ালের মতো একটা বৃষ্টি এগিয়ে আসছে চরাচর আচ্ছন্ন করবে বলে- দৌড়ে আসছে সে, ওই এল, এল, এসে আমাদের গ্রামকে আচ্ছন্ন করে জলধারা ঢালতে লাগল, গাছপালার বিপন্নতা কেটে গিয়ে যেন একটা উল্লাসে শব্দ শুরু হলো, ‘বৃষ্টি, বৃষ্টি, সারা বছরের তৃষ্ণার তর্পণ!’

আর আমরা ছেলেপুলের দল তখন কী করতাম! প্রায়ই এমন হয়েছে যে সবাই মিলে ওই বৃষ্টিধারার মধ্যে ছুটে বেরিয়ে যেতাম, সর্বাঙ্গে প্রতিটি রোমকূপে ওই বৃষ্টিকে ডেকে নিতাম, কখনো মাঠের ঘাসের ওপরে লুটোপুটি খেতে খেতে। সেই ‘পথের পাঁচালী’র অপু-দুর্গার মতো, ‘পথের পাঁচালী’ তো আমাদেরই শৈশবকে আশ্রয় দিয়েছিল। এখনো এই বৃদ্ধের সারা শরীরে সেই বৃষ্টিজলের প্রথম স্পর্শের স্মৃতি যেন জেগে ওঠে। জেগে ওঠে ধারাস্নান করার অজস্র স্মৃতি। 

হায় ২০২৪-এর কলকাতার শহরতলির প্রথম কালবৈশাখী, এবারকার বীভৎস দাবদাহে তুমি যতই কাঙ্ক্ষিত হও, বরণীয় হও, আমি তো তোমাকে সেই শৈশবের মতো তেমন করে অভ্যর্থনা জানাতেই পারলাম না। আরও লজ্জার কথা যে, তুমি এসেছ তা টেরই পাইনি আমি। আমার শহরতলির আকাশ তো অনেক ছোট, তোমার খেলবার জায়গা, তোমার মহিমা আমরা কেড়ে নিয়েছি। অথচ এই ২০২৪-এর গ্রীষ্মে তোমার মতো প্রার্থিত আর কিছুই ছিল না।

এ বছরের প্রথম কালবৈশাখী, বৃদ্ধ হয়েছি, আমি তোমার কাছে ক্ষমা চেয়ে নিই।

লেখক: ভাষাতাত্ত্বিক পণ্ডিত, শিক্ষাবিদ ও গবেষক এবং সাবেক উপাচার্য, রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয় 

শিক্ষার্থীদের পুথিগত বিদ্যা ও মুখস্থবিদ্যা থেকে সরে আসতে হবে

প্রকাশ: ১৭ মে ২০২৪, ১১:৩১ এএম
শিক্ষার্থীদের পুথিগত বিদ্যা ও মুখস্থবিদ্যা থেকে সরে আসতে হবে
রাশেদা কে চৌধূরী

মাধ্যমিক ও সমমানের পরীক্ষার ফল প্রকাশিত হয়েছে ১২ মে। বরাবরের মতো এবারও পরীক্ষায় ছাত্রীরা এগিয়ে আছে। ছাত্ররা কেন পিছিয়ে, তার কারণ এখনই বলা সম্ভব নয়। প্রধানমন্ত্রী নিজেও এর কারণ খোঁজার কথা বলেছেন। তবে এটার মধ্যে আমরা একটা ধারাবাহিকতা দেখতে পাচ্ছি। এক দিনেই এটা তৈরি হয়নি। বেশ কয়েক বছর ধরেই মেয়েরা আশাব্যঞ্জক ফল নিয়ে ছেলেদের থেকে এগিয়ে আছে। মাধ্যমিকে উত্তীর্ণ সব শিক্ষার্থীকে অভিনন্দন এবং যারা আশানুরূপ করতে পারেনি আগামীতে ভালো করবে, সেই আশাবাদ ও শুভকামনা। 

শিক্ষাক্ষেত্রে সর্বস্তরের মানুষের চাহিদা সৃষ্টি হয়েছে। বিশেষ করে নারীশিক্ষার ব্যাপক বিস্তার ঘটানো সম্ভব হয়েছে। দেশের শিক্ষাব্যবস্থায় সবচেয়ে বড় অর্জন হলো সরকার মেয়েদের শিক্ষার ওপর জোর দিয়েছে। যার ফল আমরা ইতোমধ্যে দেখতে পাচ্ছি। আমাদের মেয়েরা পড়ালেখায় ভালো ফল করছে। স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশে কুদরাত-এ-খুদা শিক্ষানীতি প্রণীত হলেও সেটির বাস্তবায়ন আজ অবধি হয়নি। পরবর্তী সময়ে ২০১০ সালের শিক্ষানীতিতে মৌলিক পরিবর্তনের কথা ছিল। এই শিক্ষানীতিতে একটি স্থায়ী শিক্ষা কমিশন ও একটি সমন্বিত শিক্ষা আইন প্রণয়নের কথাও বলা ছিল। সেই শিক্ষানীতি বাস্তবায়িত হয়নি। আমার মতে, শিক্ষাটা জ্ঞানকেন্দ্রিক না হয়ে পরীক্ষাকেন্দ্রিক হয়ে গেছে। এর ফলে শিক্ষার্থীদের উচ্চশিক্ষায় যাওয়ার আগে বিভিন্ন পাবলিক পরীক্ষায় অবতীর্ণ হতে হয়। 

পৃথিবীর আর কোনো দেশে এত পাবলিক পরীক্ষা নেই। পাবলিক পরীক্ষার মূল যে লক্ষ্য, দক্ষতা ও যোগ্যতা যাচাই, সেটি আমাদের পরীক্ষায় হয় না। পরীক্ষায় ব্যাপক হারে পাস করিয়ে দেওয়ার পরও গবেষণায় ছাত্রছাত্রীরা ভালো করতে পারে না। তার মানে পাবলিক পরীক্ষা তাদের তেমন কোনো কাজে আসে না। যে কারণে নীতিনির্ধারকরাও বিভিন্ন শ্রেণিভিত্তিক পরীক্ষা তুলে দেওয়ার কথা চিন্তা করেছেন। তাহলে হয়তো পরীক্ষাকেন্দ্রিক শিক্ষা থেকে শিক্ষার্থীরা মুক্তি পাবে। পরীক্ষা পাসে দেশে কোচিং-বাণিজ্যের দৌরাত্ম্যও কমবে। জ্ঞানভিত্তিক শিক্ষা কার্যকর হবে। কোচিং-বাণিজ্য ও গাইড বইয়ের ব্যবহার হ্রাস পাবে। আমাদের দীর্ঘদিনের শিক্ষককেন্দ্রিক, মুখস্থনির্ভর শিখন-শেখানো প্রক্রিয়া এবং পরীক্ষানির্ভর মূল্যায়নব্যবস্থাকে পরিবর্তন করে নতুন শিক্ষাক্রমের যে রূপরেখা আমরা দেখেছি, তাতে শিক্ষার্থীকেন্দ্রিক ও পারদর্শিতানির্ভর শিক্ষাব্যবস্থায় রূপান্তর ঘটানোর উপাদান রয়েছে। এর ওপর ভিত্তি করে নতুন শিক্ষাক্রম যথাযথভাবে বাস্তবায়ন হলে পরিবারের শিক্ষাব্যয়ের চাপও কমবে। পরীক্ষানির্ভরতা হ্রাস পাওয়ার কারণে গাইড বই কিংবা কোচিংয়ের ওপর শিক্ষার্থীদের আর নির্ভর করার প্রয়োজন হবে না।

দীর্ঘদিন ধরে এক নিয়মে আবদ্ধ হওয়ার পর সেখান থেকে নতুনভাবে উত্তরণের পথে চলার সময় নানামুখী বিরোধিতাসহ সংকট তৈরি হওয়া অস্বাভাবিক নয়। নতুন শিক্ষাক্রম বাস্তবায়নে মোটাদাগে তিনটি বিষয় আমি গুরুত্বপূর্ণ মনে করি। প্রথমত, শিক্ষকদের দক্ষতা কতটা। যেহেতু এ শিক্ষাক্রমের বাস্তবায়নে শিক্ষকদের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, তাই শিক্ষকের দক্ষতা অত্যন্ত জরুরি। শিক্ষক কীভাবে শিক্ষার্থীকে মূল্যায়ন করবেন, সেই প্রশিক্ষণও  লাগবে। শিক্ষক প্রশিক্ষণে ঘাটতি থাকলে নতুন শিক্ষাক্রম পুরোপুরি বাস্তবায়ন করা কঠিন হবে। এর আগে আমরা দেখেছি এ কারণে সৃজনশীল পদ্ধতি হোঁচট খেয়েছে। দ্বিতীয় বিষয়টি হলো, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সার্বিক অবস্থা ও সক্ষমতা। মহানগরে যেমন অবকাঠামো রয়েছে, প্রত্যন্ত অঞ্চলে তেমনটি না থাকলে সেখানকার শিক্ষার্থীরা তো একই সুফল পাবে না। আর তৃতীয় বিষয় হচ্ছে মনিটরিং। 

শিক্ষাক্রম কীভাবে বাস্তবায়ন হচ্ছে, তার নিয়মিত মনিটরিং না হলে বাস্তবায়ন কঠিন হয়ে পড়বে। শিক্ষকরা কেমন খাপ খাইয়ে নিয়েছেন, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নতুন শিক্ষাক্রম কীভাবে চলছে, শিক্ষা প্রশাসনকে সেটি নিয়মিত তদারক করতেই হবে। তদারকিতে ঘাটতি থাকলে সুফল পাওয়া যাবে না। মনে রাখা প্রয়োজন, আমাদের সর্বস্তরের জনমানুষের মধ্যে শিক্ষার চাহিদা তৈরি হয়েছে। সবাই চায় তাদের সন্তানরা পড়াশোনা করুক। কিন্তু চাহিদা অনুযায়ী সরবরাহে যদি ঘাটতি থাকে, তাহলে আমরা এগোতে পারব না। সময়ে সময়ে যথাযথ তদারকির মাধ্যমে আমাদের ঘাটতি চিহ্নিত করে সেই অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়ার মাধ্যমে সবার জন্য শিক্ষা নিশ্চিত হতে পারে। সে জন্য আরও প্রয়োজন সঠিক সময়ে সঠিক তথ্যনির্ভর পরিকল্পনা, যথাযথ বিনিয়োগ ও সঠিক বাস্তবায়ন। নতুন কারিকুলাম নিয়ে নানা ধরনের মতভেদ সামাজিক যোগাযোগমাধমে দেখা যাচ্ছে। অথচ উন্নত বিশ্বে টিফিন ক্লাসের মধ্য দিয়ে শিক্ষকরা খাবারের পুষ্টিগুণ সম্পর্কে শিক্ষার্থীদের শেখাচ্ছেন এবং বাচ্চারা সেটি এমনভাবে রপ্ত করছে যে তারা মনে রাখছে। 

আমাদের বাচ্চাদের আল্লাহতায়ালা অনেক মেধা দিয়েছেন। যদি শিক্ষকদের সক্ষমতা থাকে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ইচ্ছা থাকে, অভিভাবকদের ইচ্ছা থাকে তারা যেকোনোভাবে খাপ খাইয়ে নিতে পারে। আমি বারবার যে কথাটি বলতে চাই, তা হলো শিক্ষকদের দক্ষতা, সেই সঙ্গে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সক্ষমতা জরুরি। আগে শিক্ষকরা প্রশিক্ষণ নিয়ে এসেও শ্রেণিকক্ষে প্রশিক্ষণের বাস্তবায়ন করেননি। দুনিয়া অনেক বদলে গেছে। আমরা যদি তার সঙ্গে তাল মেলাতে না পারি, তাহলে আমাদের বাচ্চারা আরও অনেক বেশি পিছিয়ে যাবে। আমাদের পুথিগত বিদ্যা ও মুখস্থবিদ্যা থেকে সরে আসতে হবে। ছাত্রছাত্রীরা এতগুলো পরীক্ষা দিয়ে গোল্ডেন জিপিএ পেয়ে ভালো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে আসন পায় না। এই গোল্ডেন এ+ দিয়ে আমি কী করব? এর মাধ্যমে কী প্রমাণিত হয়? পরীক্ষাকেন্দ্রিক যে শিক্ষাব্যবস্থা চালু আছে, তা আমাদের শিক্ষার্থীদের পিছু পা করিয়েছে।

পরিবার থেকেই শিক্ষার্থীদের বিকাশ শুরু করতে হবে। মা-বাবাকে তার সন্তানদের দিকে নজর দিতে হবে। সেই নজর দেওয়া বলতে তাদের জিপিএ-এর বোঝা বাড়িয়ে দেওয়া নয়। বরং তাদের মেধা সুস্থভাবে বিকাশ হচ্ছে কি না, সে দিকটি দেখতে হবে। তারপরের দায়িত্ব বর্তায় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ওপর। শিক্ষকদের দক্ষ করে তৈরি করা। আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার মধ্যেই একটি গলদ আছে। সেটি দূর করতে হবে। ক্রমপরিবর্তনশীল পৃথিবীর সঙ্গে আমরা বদলাইনি। আমরা শিক্ষাক্রমে কোনো বিভাজন থাকার পক্ষে নই। বিজ্ঞান, মানবিক, বাণিজ্য ইত্যাদি বিভাজন করেই আমরা শিক্ষার্থীদের আরেকটি জালের ভেতর ফেলে দিয়েছি। আজকে বিজ্ঞানের শিক্ষার্থীরা মানবিকে যায় না। মানবিকের শিক্ষার্থীরা বিজ্ঞানের ধারেকাছে যায় না। বিভাজনের তো কোনো দরকার নেই। সবাইকে ন্যূনতম কতগুলো বিষয়ে পড়ালেখা করতে হবে এবং স্ব স্ব শ্রেণিক্ষেত্রে পড়ালেখার পাশাপাশি দক্ষতা নিশ্চিত করতে হবে।

এখন যে চ্যালেঞ্জটি, সেটি হলো আগামীর। এরপর কী হচ্ছে? অসংখ্য জিপিএ থাকার কারণে তাদের মধ্যে এবং অভিভাবকদের মধ্যেও উৎসাহ এবং প্রত্যাশার সৃষ্টি হয়েছে। সবাই যেন নামিদামি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষা গ্রহণ করতে পারে। সেখানেই হয়তো একটি হোঁচট খাবে তারা। প্রধানমন্ত্রী বারবার যে কথাটি বলেছেন, সেটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তিনি বলেছেন, পরবর্তী পর্যায়ের জন্য প্রস্তুতি নেওয়া। একই সঙ্গে তিনি বলছেন, শিক্ষার্থীরা যেন সাধারণ শিক্ষায় না গিয়ে উদ্যোক্তা হওয়ার দিকে মনোনিবেশ করে। এখন সে পথেই আমাদের এগোতে হবে। তথ্যপ্রযুক্তির যুগে শুধু শিক্ষিত বেকার হয়ে লাভ নেই। আগামীতে সম্ভাবনাকে আরও ভালোভাবে নিয়ে আসতে হবে। আসনসংখ্যা কিন্তু এসব নামিদামি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সীমিত। কাজেই সেই চ্যালেঞ্জ তো সামনে থাকবেই। এসব কিছু মাথায় নিয়েই প্রস্তুতি নিতে হবে পরবর্তী পর্যায়ের জন্য। সে লক্ষ্যেই এগিয়ে যেতে হবে এবং কিছুতেই হতাশ হওয়া যাবে না।

লেখক: সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা