বাংলাদেশের তৈরি পোশাকের সবচেয়ে বড় বাজার ইউরোপ। পোশাকশিল্পে সংকটের শঙ্কা কারখানাসহ পণ্য সরবরাহ ও বিপণনের সার্বিক প্রক্রিয়ায় মানবাধিকার লঙ্ঘন ও পরিবেশের ক্ষতি বন্ধে ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানগুলোর পদক্ষেপ গ্রহণের বাধ্যবাধকতা আরোপ করে নতুন একটি বিধান পাস করেছে ইউরোপীয় পার্লামেন্ট। ইউরোপীয় পার্লামেন্টের নতুন এই বিধিবিধান পাস হওয়ার ফলে সংকটে পড়বেন দেশের অন্তত অর্ধেক গার্মেন্ট মালিক। তারা বলছেন, এই শর্তগুলো পূরণ করতে অনেক টাকার প্রয়োজন। এখন তারা যদি আর্থিকভাবে সহযোগিতায় এগিয়ে আসে তাহলে দ্রুতই পরিস্থিতির উত্তরণ ঘটবে। ইইউ পার্লামেন্টে নতুন এই ‘অবশ্যপালনীয়’ নির্দেশনার ওপর ভোটাভুটি হয়। ফলে ইউরোপীয় কোম্পানিগুলোর পাশাপাশি তারা যেসব প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে অংশীদারি ভিত্তিতে ব্যবসা পরিচালনা করে, সবার জন্য নতুন বাধ্যবাধকতা তৈরি হয়েছে। এর ফলে কোম্পানিগুলোকে তাদের কার্যক্রমের মাধ্যমে মানবাধিকার লঙ্ঘন ও পরিবেশের ক্ষতি প্রতিরোধ, নির্মূল ও প্রশমনে ব্যবস্থা নিতে হবে। এর মধ্যে রয়েছে দাসত্ব, শিশুশ্রম, শ্রমশোষণ, জীববৈচিত্র্যের ক্ষতি, দূষণ এবং প্রাকৃতিক ঐতিহ্যের ক্ষতি প্রতিরোধ, বন্ধ ও কমানোর ব্যবস্থা গ্রহণ।
ইইউ পার্লামেন্টে নতুন বিধান পাস হয়েছে, এটা সবার জন্যই ভালো। কিন্তু প্রশ্ন হলো- এই কাজগুলো করতে গেলে প্রচুর টাকার প্রয়োজন। তারা আর্থিকভাবে আমাদের কোনো সহযোগিতা করে না। মাঝেমধ্যেই নতুন বিধিবিধান নিয়ে হাজির হয়। সেগুলো বাস্তবায়ন করতে আমাদের প্রচুর টাকা খরচ করতে হয়। রানা প্লাজার ঘটনার পর তারা আমাদের যে সংস্কারের রূপরেখা দিয়েছিল, সেটা করতে ছোট ফ্যাক্টরিরও ৫-৭ কোটি টাকা খরচ হয়েছে। এখন তারা যদি আর্থিক সহযোগিতা নিয়ে এগিয়ে আসে, তাহলে ভালো। সরকারকেও এগিয়ে আসতে হবে। না হলে অর্ধেক ফ্যাক্টরি ভয়াবহ সংকটে পড়বে।
আমরা জানি, ইইউর এই বিধানের ইতিবাচক ও নেতিবাচক দুই দিকই আছে। ইতিবাচক দিক হচ্ছে ইইউর সব দেশের ব্র্যান্ডগুলো উন্নত কর্মপরিবেশের দিকে নজর দেবে। মানবাধিকার ও শ্রমিকের অধিকারের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ চীন ও ভিয়েতনামের তুলনায় ভালো অবস্থানে থাকায় খুব বেশি চ্যালেঞ্জ হবে না। আর নেতিবাচক দিক হচ্ছে ক্ষুদ্র ও অতি ক্ষুদ্র পণ্য সরবরাহকারীরা ব্যবসা থেকে ছিটকে যেতে পারে। এই ধরনের ফ্যাক্টরির সংখ্যাও কম নয়।
ইউরোপীয় কোম্পানির পাশাপাশি ওই সব দেশে ব্যবসা করা বাইরের কোম্পানিগুলোর ওপরও এই বিধান কার্যকর হবে। কোম্পানিগুলোকে অবশ্যপালনীয় বিষয়গুলোকে তাদের নীতিতে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। বাধ্যবাধকতার বিষয়গুলো প্রতিপালনে বিনিয়োগ করতে হবে। ইউরোপীয় কোম্পানিগুলোর ব্যবসায়িক অংশীদারদের সঙ্গে চুক্তি করার ক্ষেত্রে এসব বিষয় মেনে চলা হচ্ছে কি না, তার নিশ্চয়তা চাইতে হবে। ক্ষুদ্র ও মাঝারি আকারের ব্যবসায়িক অংশীদাররা যাতে নতুন বাধ্যবাধকতাগুলো মেনে চলতে পারে, সে জন্য তাদের সহায়তায় ব্যবসা পরিকল্পনা নতুন করে সাজাতে হবে। ব্যবসা মডেল যেন বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধি ১ দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে রাখার প্যারিস চুক্তির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ হয়, সেদিকে কর্যক্রম নিয়ে যাওয়ার জন্য একটি পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে।
আমাদের বুঝতে হবে, আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে পরিবর্তন আসছে। এর অন্যতম হলো- আগে আমরা পণ্যের মান নির্ণয় করতাম, এখন পণ্য থেকে প্রক্রিয়ার দিকে মনোযোগ দেওয়া হচ্ছে। অর্থাৎ, পণ্য উৎপাদন যে প্রক্রিয়ায় হচ্ছে তার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সবকিছু। একেবারে উৎসমুখে যেতে হচ্ছে। এই আইনটা হচ্ছে সেটাই। উৎপাদনের ক্ষেত্রে মনোভাবের যে পরিবর্তন সেদিকেই নজর দেওয়া হয়েছে। এখন আমাদের উৎস থেকে উৎপাদন পর্যন্ত সব জায়গাতেই তাদের দেওয়া মানদণ্ড মেনে চলতে হবে। পণ্যের মানের পাশাপাশি এর সঙ্গে যে মানুষগুলো জড়িত, তাদের যে অধিকার আছে, সে বিষয়ে শক্তভাবে নজর দিতে হবে।’
ইইউর নতুন বিধান কোম্পানিগুলো মানছে কি না, তা খতিয়ে দেখা এবং বিধান লঙ্ঘনের জন্য কোম্পানিকে দণ্ড দেওয়ার জন্য একটি কর্তৃপক্ষ গঠন করবে ইউরোপীয় ইউনিয়নের সদস্য দেশগুলো। যেসব কোম্পানি বিধান লঙ্ঘন করবে, তাদের নাম-পরিচয় প্রকাশের পাশাপাশি বিশ্বব্যাপী ওই কোম্পানির মোট লেনদেনের ৫ শতাংশ পর্যন্ত জরিমানা করা হবে। এ বিষয়গুলোতে সহযোগিতা ও সর্বোত্তম চর্চা ছড়িয়ে দেওয়ার লক্ষ্যে ইউরোপীয় কমিশনও একটি কর্তৃপক্ষ গঠন করবে। অবশ্য পালনীয় বাধ্যবাধকতা পূরণে ব্যর্থ হলে যে ক্ষতি হবে, তার দায় কোম্পানিকে নিতে হবে এবং ক্ষতিগ্রস্তকে পূর্ণ ক্ষতিপূরণ দিতে হবে।
আমরা বলতে চাই, বাংলাদেশে শ্রমিকদের কর্মপরিবেশ অনেক ভালো। আমরা তাদের শর্তগুলো মেনেই ফ্যাক্টরিকে নতুনভাবে সাজিয়েছি। এখন এই বিধিবিধানের ফলে যেটা হবে, বেশ কিছু ছোট গার্মেন্ট ক্ষতিগ্রস্ত হবে। এমনকি বন্ধও হয়ে যেতে পারে। আমাদের যে এক্সপোর্ট তার অর্ধেকের বেশি করে ২৫ ভাগ ফ্যাক্টরি। বাকি অর্ধেক করে ৭৫ ভাগ ফ্যাক্টরি। এই ৭৫ ভাগই বেকায়দায় পড়বে। এ থেকে পরিত্রাণের পথ যদি বলেন, তাহলে বায়ারদের এগিয়ে আসতে হবে। পাশাপাশি আমাদের সরকারকেও ভূমিকা নিতে হবে।’
ইইউর এই উদ্যোগকে আমরা সাধুবাদ জানাই। কারণ, এতে আমাদের শ্রমিকদের কর্মপরিবেশ যেমন ভালো হবে, তেমনি তাদের স্বার্থের বিষয়টি নিশ্চিত হবে। পাশাপাশি আমরা এটাও বলতে চাই, এই উদ্যোগগুলো বাস্তবায়ন করতে গেলে অনেক টাকার প্রয়োজন। সেই টাকা যেন বায়াররাও দেন। আমাদের মালিকদের এটা নিয়ে কথা বলতে হবে। সরকারকে ভূমিকা নিতে হবে। কিছু ফ্যাক্টরি হয়তো নিজেদের উদ্যোগেই করতে পারবে। কিন্তু অনেক ফ্যাক্টরি সংকটে পড়বে। আমাদের ফ্যাক্টরি যদি ৩ হাজার হয়, তাহলে অর্ধেক অর্থাৎ দেড় হাজার ফ্যাক্টরির এসব শর্ত পূরণের সামর্থ্য নেই। তাদের সহযোগিতা দিয়ে কাজগুলো করতে হবে। তাহলেই মূল উদ্দেশ্য বাস্তবায়ন হবে। উৎস: ডয়েচে ভেলে
লেখক: অর্থনীতিবিদ