সুন্দরবন বিশ্বের অন্যতম দুর্গম অরণ্যের মধ্যে একটি। শ্বাপদসংকুল এই অরণ্য দুই বাংলার অহংকারও। সুন্দরবনের বিস্তৃতি মোট ১০ হাজার বর্গকিলোমিটার নিয়ে। এর মধ্যে বাংলাদেশ অংশের আয়তন ৬ হাজার ১৭ বর্গকিলোমিটার। অন্যদিকে পশ্চিমবঙ্গে অবস্থিত অংশের আয়তন ৩ হাজার ৯৮৩ বর্গকিলোমিটার। বিশাল আয়তনের এই বন ১৯৮৭ সালে জাতিসংঘের বিবেচনায় বিশ্বের অন্যতম ‘ওয়ার্ল্ড হ্যারিটেজ’ হিসেবে স্থান করে নিয়েছে। এই দুর্গম অরণ্যটি যুগ যুগ ধরে মানুষের কাছে এক রোমাঞ্চকর জঙ্গল হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে। আর রোমাঞ্চকর বলেই হয়তো এ জঙ্গলের গুরুত্ব অপরিসীম পর্যটকদের কাছে।
প্রকৃতির এ লীলাভূমি দর্শনের উদ্দেশ্যে প্রতিবছর হাজার হাজার দেশি-বিদেশি পর্যটক ছুটে আসেন সুন্দরবন এলাকায়। তার মধ্যে ৮৭.৬ শতাংশ দেশি, বাকি ১২.৪ শতাংশ বিদেশি পর্যটকের আগমন ঘটে। ফলে পর্যটন খাতেও আমরা বছরে দেশি-বিদেশি মিলিয়ে প্রায় ৪১৪ কোটি টাকা অর্জনের সুযোগ পেয়ে থাকি। শুধু পর্যটন খাতেই নয়, মৎস্য, মধু, গোলপাতা ও জ্বালানি কাঠ থেকে শুরু করে নিত্যপ্রয়োজনীয় বহুবিধ জিনিসের মাধ্যমে সরকার প্রচুর রাজস্ব আয় করে সুন্দরবন থেকে। সে প্রাপ্তিও বিরাট অঙ্কের। সর্বশেষ ২০১৭ সালের (শেষ জরিপ) সমীক্ষা মোতাবেক সুন্দরবনের বার্ষিক আয় প্রায় ৫ হাজার ৮৫৬ কোটি টাকা। অন্যদিকে বন বিভাগের এক গবেষণায় জানা যায়, সুন্দরবন বছরে প্রায় ১৬ কোটি মেট্রিক টন কার্বন ধরে রাখতে সক্ষম; যার আন্তর্জাতিক বাজারমূল্য প্রায় ৫-৬ বিলিয়ন ডলার।
এ ছাড়া সুন্দরবনের পেশাজীবীদের মধ্যে ৩১ শতাংশ জ্বালানি কাঠ, ৬.৩ শতাংশ মধু ও মোম, ৯.৪ শতাংশ গোলপাতা, ৫৪.৮ শতাংশ মাছ, ১৮ শতাংশ চিড়িং, ২৯ শতাংশ কাঁকড়ার মাধ্যমে বছরে ১ হাজার ১৬১ কোটি টাকা সরকারের রাজস্ব আদায় হয়। এতে করে প্রত্যক্ষ-পরোক্ষভাবে প্রায় ৩৫ লাখ মানুষ সুন্দরবনের ওপর নির্ভরশীল হওয়ার সুযোগ পেয়েছে। অপরদিকে দেশি-বিদেশি পর্যটন খাত থেকেও বিপুল অঙ্কের রাজস্ব সরকারের ভাণ্ডারে জমা হচ্ছে বছর বছর।
সুন্দরবন থেকে আহরিত রাজস্বের পরিমাণ এবং জীববৈচিত্র্যের বিষয়টি বিবেচনা করে সরকার ২০১৬ সালের দিকে উদ্যোগ নিয়েছে এই বনকে আগামী ১০ বছরের জন্য সংরক্ষণ করার। যদিও এ উদ্যোগ নেওয়া উচিত ছিল ঘূর্ণিঝড় সিডর বয়ে যাওয়ার পরপরই। তাতে হয়তো জীববৈচিত্র্য বিপর্যয়ের হাত থেকে তুলনামূলক বেশি রক্ষা পেত। তারপরও সরকারের এ উদ্যোগের ভূয়সী প্রশংসা না করে পারা যায় না।
সত্যি কথা হচ্ছে, সরকার সচেষ্ট হলেও সুন্দরবনের ওপর বিষফোঁড়ার আবির্ভাব থেমে থাকেনি। বরং একের পর এক বিভিন্নভাবে সুন্দরবন আক্রান্ত হচ্ছে। বিশেষ করে সুন্দরবনের ভেতর দিয়ে প্রবাহিত নদ-নদীগুলো বিপর্যয়ের শিকার হচ্ছে খুব বেশি। বারবার জাহাজডুবির কারণে নদ-নদীর জল যেমন দূষিত হচ্ছে, অপরদিকে ধ্বংস হচ্ছে সুন্দরবনের জীববৈচিত্র্য। তার সঙ্গে যোগ হয়েছে অগ্নিকাণ্ডের মতো জঘন্য ঘটনাও। যে ঘটনাটা দুই দশকের মধ্যে ২৫ বার ঘটেছে।
ধারণা করা হচ্ছে, এতে প্রায় দেড় শ একর বনভূমি পুড়ে ছারখার হয়েছে এ পর্যন্ত। সর্বশেষ ২০২৪ সালের মে মাসের প্রথম সপ্তাহে বাগেরহাটের পূর্ব সুন্দরবন বিভাগের চাঁদপাই রেঞ্জের আমুরবুনিয়া টহল ফাঁড়ি-সংলগ্ন লতিফের ছিলা এলাকায় অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। একই ঘটনা ২০২১ সালের মে মাসেও ঘটেছিল সুন্দরবনে। তা-ও পরপর দুবার তখন অগ্নিকাণ্ড ঘটেছে সুন্দরবনের শরণখোলা রেঞ্জের দাসের ভারানি টহল ফাঁড়ির বনে। পরিতাপের বিষয় হচ্ছে, আগুন নিয়ন্ত্রণে আনার আগেই ওখানে প্রায় ২ একর বনের লতাগুল্ম, গাছগাছালি পুড়ে ছারখার হয়ে গিয়েছিল। আরও পরিতাপের বিষয়, প্রথম দফার আগুন নিয়ন্ত্রণে আনার পরের দিনই পুনরায় অগ্নিকাণ্ড ঘটেছিল দাসের ভারানিতে।
চাঁদপাই রেঞ্জের আমুরবুনিয়ার অগ্নিকাণ্ড ৩০ ঘণ্টার প্রচেষ্টায় নিয়ন্ত্রণে এলেও ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ এখনো নিরূপণ করা যায়নি। বারবার অগ্নিকাণ্ড সম্পর্কে সার্বিক তত্ত্বাবধানে থাকা খুলনা অঞ্চলের বন সংরক্ষক বলেন, ‘সুন্দরবন লোকালয়সংলগ্ন নদী এবং খাল ভরাট হয়ে যাওয়ায় নিয়মিত জোয়ারের পানিতে বনভূমি প্লাবিত না হওয়ায় এর আগেও বিভিন্ন সময় এই এলাকায় আগুনের ঘটনা ঘটেছে। এখানে মাটির ওপর কয়েক ইঞ্চি পুরু জৈব পদার্থ (লতাপাতা ও ডাল-পালা) মজুত হয়ে আছে। কাজেই এই তীব্র গরমে সেখানে নিচের দিকে মিথেন গ্যাস মজুত হয়ে আগুনের সূত্রপাত হতে পারে।’
অপরদিকে বিশেষজ্ঞদের অভিমত, সুন্দরবনে আগুন লাগানোর ঘটনার প্রথম দায়ী ব্যক্তিরা হচ্ছে মৌয়াল। তারা মধু আহরণ করতে গিয়ে মৌচাকে আগুন বা ধোঁয়া লাগিয়ে এ সর্বনাশটি করে থাকে। চোরা শিকারি, মৎস্যজীবীরা রান্নাবান্না এবং ধূমপান করেও আগুনের সূত্রপাত ঘটিয়ে থাকে। এ ছাড়া দখলদারত্বের বিষয়টিও এর সঙ্গে জড়িত রয়েছে বলে বিশেষজ্ঞদের অভিমত। তাই এবারের বিষয়টিও নাশকতামূলক কর্মকাণ্ড হিসেবে ধরে নিয়েছেন পরিবেশবিদরা। এর কারণ হচ্ছে অতীতের সব অগ্নিকাণ্ডের নাশকতার প্রমাণ মিলেছে।
এবারের অগ্নিকাণ্ড তারই ধারাবাহিকতা কি না, সেটি খতিয়ে দেখতে পরিবেশবাদী সংগঠনগুলো জোর দাবি জানাচ্ছে। কারণ যেকোনো ধরনের অগ্নিকাণ্ডই বন-জঙ্গলের বিপর্যয় ডেকে আনে। সুন্দরবনের ক্ষেত্রে বিষয়টা আরও মর্মাহত। কারণ এখানে রয়েছে জীববৈচিত্র্যের ব্যাপক সমাহার। সবচেয়ে বড় কথা হচ্ছে, সুন্দরবনের জীববৈচিত্র্য দুর্লভও। এখানে প্রায় ৪২৫ প্রজাতির প্রাণী, ৩০০ প্রজাতির উদ্ভিদ রয়েছে। প্রাণীদের মধ্যে ৩০০ প্রজাতির পাখি, ৩২ প্রজাতির স্তন্যপায়ী প্রাণী, ৩৫ প্রজাতির সরীসৃপ এবং ৮ প্রজাতির উভচর প্রাণী রয়েছে। অগ্নিকাণ্ডের মতো ঘটনা ঘটলে উদ্ভিদের সঙ্গে পোকামাকড়ও ছারখার হয়ে যায়; ফলে জীববৈচিত্র্য মারাত্মক হুমকিতে পড়ে।
সুন্দরবন ছাড়াও বনবনানী কিংবা পাহাড়-পর্বতের জঙ্গল পরিষ্কারের উদ্দেশ্যে আগুন লাগানো হচ্ছে। সাধারণত তিনটি কারণে এসব করা হচ্ছে। প্রথমত, নাশকতা। দ্বিতীয়, আর্থিক সাশ্রয় ও সময়ের তাগিদ। তৃতীয়, দুর্গম-দুর্ভেদ্যতার কারণ। বিশেষ করে বাংলাদেশের জুমচাষিরা এ কাজ বেশি বেশি করছে। মাঝেমধ্যে দুর্বৃত্তরাও ঝোপ-জঙ্গলে আগুন ধরিয়ে দিচ্ছে।
মূলত যারা এ ধরনের কাজ করছে, তারা জঙ্গলে আগুন লাগানোর ক্ষয়ক্ষতির বিষয়ে মোটেও জ্ঞান রাখেনি বলে আমাদের ধারণা। তারা জানে না, এতে করে পরিবেশের কতটা সর্বনাশ হচ্ছে। জানে না চরমভাবে হুমকির মুখে পড়ছে প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ও জীববৈচিত্র্য। বন্য প্রাণীরা আবাসস্থল হারাচ্ছে আর বিভিন্ন প্রজাতির সরীসৃপ ও পোকামাকড় পুড়ে ছারখার হচ্ছে। এত সব জানলে বোধকরি তারা সজ্ঞানে আগুন লাগিয়ে এমন ধ্বংসাত্মক কাজ করার সাহস পেত না।
আবার অনেকে নিজের জঙ্গলে নিজেও আগুন লাগিয়ে থাকে। তাদের ধারণা, তাতে অন্যের ক্ষতির কারণ কোথায়। আসলে যে ওই ব্যক্তি নিজেই নিজের সর্বনাশ ডেকে আনছেন জীববৈচিত্র্য ধ্বংস করে, তা তিনি অবগত নন বিধায় এসব ভাবছেন। বিষয়টি অনেকেই জানে না। তাই আমাদের উচিত এ ব্যাপারে সবাইকে বিশদভাবে জানানো। জানানো উচিত এটি একটি অন্যায় কাজও। বিষয়টি লোকের দ্বারে দ্বারে গিয়ে জানানো সম্ভব নয় বিধায় প্রয়োজন ব্যাপক প্রচার-প্রচারণা।
বিশেষ করে বাংলাদেশের জুমচাষিদের আগুন লাগানোর ক্ষতিকর দিক সম্পর্কে স্পষ্ট করে জানাতে হবে এবং সুন্দরবনের আশপাশের এলাকায় ব্যাপক প্রচার-প্রচারণার মাধ্যমে জানাতে হবে যে, বনে আগুন লাগানো থেকে বিরত থাকতে। তাতে যেমন সচেতনতা বৃদ্ধি পাবে, তেমনি রক্ষা পাবে জীববৈচিত্র্য। তাই আমাদের পরামর্শ প্রচার-প্রচারণার মাধ্যমে মানুষকে সচেতন করার পাশাপাশি নাশকতাকারীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিতে হবে। তবেই রক্ষা হবে বনবনানী তথা আমাদের প্রিয় সুন্দরবনও।
লেখক: কথাসাহিত্যিক, পরিবেশ ও জলবায়ুবিষয়ক কলামিস্ট
[email protected]