মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর সেমিস্টার পরীক্ষা শেষ হওয়ার পথে, কিন্তু গাজা যুদ্ধবিরোধী বিক্ষোভ সহজে শেষ হচ্ছে না। ফিলিস্তিনিদের সমর্থন, যুদ্ধবিরতি এবং গাজায় ইসরায়েলের যুদ্ধের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ চলছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ও শিক্ষকদের ওপর প্রশাসন ও পুলিশি দমন-পীড়নের কারণে দেশে উত্তাল অবস্থা।
একদিকে ইহুদিবিদ্বেষের অভিযোগ উঠেছে। অন্যদিকে বাকস্বাধীনতা বন্ধ ও পদদলিত করতে ক্যাম্পাসে সতর্কবার্তা চলছে, যা সোশ্যাল মিডিয়ায় ছড়িয়ে পড়েছে। শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভের বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে প্রতিক্রিয়া ভিন্ন রকম হচ্ছে। কেউ কেউ বন্দুক নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ছে। ছাত্রদের ওপর পুলিশ আক্রমণ করছে। রাজনীতিবিদরা নিজেদের যুদ্ধে জড়িয়ে পক্ষ নিয়েছেন এবং ক্যাম্পাসগুলোকে রাজনৈতিক অঙ্গনে পরিণত করছেন।
কয়েক সপ্তাহজুড়ে অশান্তি বিরাজ করছে। কেউ সাহায্য করতে পারছে না। বিশ্ববিদ্যালয়ের নেতৃত্ব, প্রশাসক থেকে শুরু করে হোয়াইট হাউস ও কংগ্রেস পর্যন্ত সবাইকে এর জন্য দোষারোপ করছে। কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এই বিক্ষোভ প্রথম শুরু হয়েছিল। কলাম্বিয়া থেকে শুরু হলেও সেই আন্দোলন সারা দেশে ছড়িয়ে পড়েছে। শিক্ষাবিদরা বলেছেন, ঘটনাগুলো ভিন্ন দিকে গড়াতে পারে। কলাম্বিয়াতেই প্রথম পরীক্ষা ছিল। কংগ্রেসের সামনে কলাম্বিয়ার উপাচার্য মিনোচে শফিকের সাক্ষ্য দেওয়ায় সারা দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে বিশেষ করে কলাম্বিয়ায় ভয় এবং প্রত্যাশায় পরিপূর্ণ ছিল।
কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য মিনোচে শফিক ইহুদিবিরোধিতার বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নিয়েছিলেন। তার পরও কংগ্রেসের রিপাবলিকান সদস্যদের কঠোর সমালোচনার সম্মুখীন হয়েছেন। তারা বলেছিলেন, তিনি ইহুদি ছাত্রদের রক্ষায় যথেষ্ট কাজ করছেন না। কেউ কেউ তার পদত্যাগের আহ্বানও জানিয়েছেন। শফিক ক্যাম্পাসে ইহুদিবিদ্বেষের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে মনোনিবেশ করেছিলেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনেট, অনুষদ এবং ছাত্রদের যে বিষয়টি বিরক্ত করেছিল, তা হলো তিনি কমিটিকে বলেছিলেন যে, অধ্যাপকদের পদ থেকে তাদের সরিয়ে দেবেন। নিউইয়র্কের রিপাবলিকান এলিস স্টেফানিক; যিনি হার্ভার্ড এবং পেনসিলভানিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধানদের ক্ষমতাচ্যুত করার ঘটনাগুলোর পেছনে দায়ী।
কংগ্রেসে শফিকের বক্তব্য নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রতিক্রিয়া হয়েছিল। ছাত্র এবং শিক্ষকরা তার কর্মদক্ষতা নিয়ে সমালোচনা করেছিলেন। বিশেষ করে অধ্যাপকদের অভ্যন্তরীণ তদন্ত নিয়ে তাদের তথ্য জানানোর আগেই তা প্রকাশ করেছিলেন। প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনকে খারাপ পরামর্শ দিয়েছিলেন। তিনি পুলিশকে তাদের ক্যাম্প থেকে বিক্ষোভকারীদের সরিয়ে দেওয়ার নির্দেশ দেন এবং কয়েকজন ছাত্রকে বহিষ্কার করেন।
১৯৬৮ সালে ভিয়েতনাম যুদ্ধের বিরুদ্ধে বিক্ষোভের সময় কলাম্বিয়ার ছাত্ররা তৎকালীন উপাচার্যের কার্যালয়সহ পাঁচটি বিল্ডিং দখল করে রেখেছিল। একজন ডিনকে তার অফিসে বন্দি করে রাখা হয়েছিল। ওই সময় বিক্ষোভকারীরা বেশির ভাগই শান্তিপূর্ণ এবং চারদিকে তাদের ক্যাম্পে অবস্থান করছিল। ক্যাম্পাসে ব্যাপক ইহুদিবিদ্বেষের অভিযোগ ইহুদি ছাত্ররা অস্বীকার করেছিল।
কলাম্বিয়ায় পুলিশ কঠোর ব্যবস্থা নেয় এবং ১০০ জনকে গ্রেপ্তার করে। এতে প্রতিবাদ আরও প্রবল হয়। কলাম্বিয়ার ছাত্ররা এর সঙ্গে সংহতি প্রকাশ করে এবং সারা দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে। ছাত্ররা যুদ্ধবিরতির আহ্বান জানায়। তারা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ইসরায়েলের সঙ্গে যুক্ত ব্যবসা বা ইসরায়েলকে অস্ত্র সরবরাহ করা থেকে বিচ্ছিন্ন করার আহ্বান জানায়।
বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন বিক্ষোভ থামাতে পুলিশ ডেকেছে। কিছু বিশ্ববিদ্যালয়ে বিশেষ করে ইউনিভার্সিটি অব টেক্সাস এবং এমোরিতে ছাত্র ও অধ্যাপকদের পুলিশের কঠোর ও সহিংস গ্রেপ্তারের ঘটনা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে। ইউনিভার্সিটি অব সাউদার্ন ক্যালিফোর্নিয়া, ইয়েল, নিউইয়র্ক ইউনিভার্সিটি এবং ইউনিভার্সিটি অব টেক্সাসসহ বেশ কিছু বিশ্ববিদ্যালয়ে শত শত ছাত্রকে গ্রেপ্তার ও বহিষ্কার করা হয়েছে। এমোরি বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির অধ্যাপক ক্যারোলিন ফোহলিনের গ্রেপ্তার ক্যাম্পাসে দুঃসহ ক্ষোভ বাড়িয়েছে। পুলিশি বর্বরতার বিষয়টি আরও সামনে চলে এসেছে।
সিনেট কলাম্বিয়া ইউনিভার্সিটির উপাচার্য শফিকের সমালোচনা করেছে এবং অভিযোগ করেছে যে, তার প্রশাসন একাডেমিক স্বাধীনতাকে ক্ষুণ্ন করেছে। পুলিশ ডেকে ছাত্র ও অনুষদের শিক্ষকদের গোপনীয়তা এবং অধিকারকে অবজ্ঞা করেছে। অনুষদের শিক্ষকরা প্রেসকে বলেছেন যে, উপাচার্য যদি তার সিনেটের পরামর্শ গ্রহণ করতেন এবং প্রশাসন থেকে শুরু করে অনুষদ ও ছাত্রদের সঙ্গে সংলাপের মাধ্যমে বিষয়টি শান্তভাবে পরিচালনা করতেন, তাহলে হয়তো কলাম্বিয়া ও অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য পরিস্থিতি অন্য রকম হতো।
রাজনীতিবিদরা এর থেকে ভালো কিছু করেননি। তারা তাদের রাজনৈতিক কর্মসূচিকে এগিয়ে নিতে কলাম্বিয়ার সংকটকে ব্যবহার করেছিলেন। কংগ্রেসের সদস্যরা বেশির ভাগই রিপাবলিকান এবং হাউস স্পিকার মাইক জনসনের নেতৃত্বে কলাম্বিয়ায় নেমে আসেন। জনসন শফিককে পদত্যাগ করার আহ্বান জানিয়েছিলেন। বিশ্ববিদ্যালয়ে ন্যাশনাল গার্ড মোতায়েন করার পরামর্শ দিয়েছিলেন। তিনি দাবি করেছিলেন, এখনই উগ্র ও চরম মতাদর্শ ছড়িয়ে পড়ছে। ছাত্রদের নেতৃত্বের উচিত ছিল চরম বহিরাগত মতাদর্শ তাদের শিবিরে অনুপ্রবেশ করতে না দেওয়া। বিশ্ববিদ্যালয়গুলো দাবি করে, তাদের পদে থাকা চরমপন্থিদের সাংঘর্ষিক বিবৃতি দেওয়া থেকে বিরত রাখা।
প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন নির্বাচনের বছরে কীভাবে এই সমস্যাটি পরিচালনা করবেন। নভেম্বরে নির্বাচনে জিততে হলে তরুণ ভোটারদের কণ্ঠস্বর ভিন্ন হতে পারে তা দেখার জন্য সবার চোখ ছিল হোয়াইট হাউসের দিকে। প্রেসিডেন্ট ‘সাম্প্রদায়িক বিরোধিতা’ এবং সেই সঙ্গে ‘যারা বোঝেন না যে, ফিলিস্তিনিদের সঙ্গে কী চলছে’ তাদের নিন্দা করেছেন।
সেক্রেটারি অব স্টেট অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেন চীন সফরকালে বিক্ষোভকে ‘আমেরিকান গণতন্ত্রের একটি বৈশিষ্ট্য’ বলে মনে করেন। তিনি বলেছিলেন, ‘আমাদের নাগরিকরা যেকোনো সময় তাদের মতামত, উদ্বেগ, ক্রোধ প্রকাশ করতে পারে এবং আমি মনে করি এটি দেশের শক্তিকে প্রতিফলিত করে।’
ডেমোক্র্যাটরা বলছেন যে, এই কথাগুলো যদি প্রেসিডেন্ট হোয়াইট হাউস থেকে বলতেন, তাহলে মুখপাত্রের পরিবর্তে আরও বেশি প্রভাব ফেলত যে, প্রেসিডেন্ট ‘সর্বদা বাকস্বাধীনতা ও বৈষম্যহীনতায় সমর্থন করেন এবং বিশ্বাস করবেন।’ এই বিষয়টি জো বাইডেনের নির্বাচনি প্রচারে কোনো প্রভাব ফেলবে না।
প্রেসিডেন্ট পুনর্নির্বাচনের সম্ভাবনাকে কোনোভাবে যাতে আঘাত করে সেভাবেই তারা প্রতিরোধ করার জন্য চেষ্টা করেছেন। তারা জনগণকে বিচ্ছিন্ন করেছেন। ডেমোক্র্যাটরা নির্বাচনে জয়ী হওয়ার জন্য উদারপন্থি, বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক এবং শিক্ষার্থীসহ তরুণ ভোটার ওপর নির্ভর করে।
প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন এই সংকট উত্তরণে জাতির উদ্দেশে ভাষণ দিতে পারতেন। উভয় পক্ষকে শান্ত হওয়ার পরামর্শ দিতে পারতেন। বাক ও সমাবেশের স্বাধীনতার আমেরিকান নীতির ওপর জোর দিতেন এবং সংলাপে উৎসাহিত করতেন। একই সঙ্গে ঘৃণাত্মক বক্তৃতা, ভীতি প্রদর্শন এবং ইহুদিবিদ্বেষের নিন্দা করা উচিত ছিল।
পরের মাসে বাইডেন দুটি ঘোষণামূলক বক্তৃতা দেবেন। প্রথমটি ১৯ মে জর্জিয়ার মোরহাউস কলেজে ভাষণ দেবেন। এই জায়গাটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ রাজ্য, যেখানে তিনি তরুণ ভোটারদের কাছে তার আবেদন করার চেষ্টা করবেন। দ্বিতীয়টি ২৫ মে ইউএস মিলিটারি একাডেমিতে হবে। এই ঘোষণাটি দিতে দিতেও অনেক দেরি হয়ে যাচ্ছে। কারণ, প্রেসিডেন্টের বার্তা শিক্ষার্থীদের কাছে পৌঁছতে অনেক সময় লাগবে।
মনে হচ্ছে, প্রেসিডেন্টের প্রচার ততটা উদ্বিগ্ন নয় এ কারণেই যে, বিশ্ববিদ্যালয়ের বিক্ষোভ তাকে খুব একটা আঘাত করবে। নির্বাচন প্রচারাভিযানের দায়িত্বে যারা রয়েছেন তারা বলেছেন, এই তরুণ ভোটাররা ‘নির্বাচকদের উপসেটের একটি উপসেট’ যা রাজনৈতিক প্রভাবের তুলনায় অসম মিডিয়া কভারেজ তৈরি করেছে। তারা হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের যুবকদের উদ্ধৃত করেছে। ইসরায়েল-ফিলিস্তিন সংঘাত এখন তাদের সবচেয়ে বেশি উদ্বিগ্নের বিষয়।
হোয়াইট হাউস শুধু প্রচারের জন্য বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে কী ঘটছে তা দেখা উচিত নয়। স্বাধীনতার আলোকবর্তিকা হিসেবে বিশেষ করে বাক ও সমাবেশের স্বাধীনতার জন্য বিশ্বে আমেরিকার শক্ত অবস্থান রয়েছে। অধ্যাপক ও ছাত্রদের সহিংসভাবে গ্রেপ্তার করা এবং কিছু বিশ্ববিদ্যালয়ে বিক্ষোভ প্রতিরোধের মাধ্যমে আমেরিকা কলঙ্কিত হচ্ছে। জো বাইডেনের প্রশাসন যত তাড়াতাড়ি এই সমস্যাটির সমাধান করবে, দেশ এবং প্রেসিডেন্টের জন্য ততই ভালো।
লেখক: জাতিসংঘে লেবাননের সাবেক রাষ্ট্রদূত
আরব নিউজ থেকে সংক্ষেপিত অনুবাদ: সানজিদ সকাল