যুদ্ধ সব সময় ব্যক্তি, সম্প্রদায় এবং জাতির জন্য ভয়াবহ। যুদ্ধের ফলে মানুষের জীবন যে কতভাবে বিপর্যয়ের শিকার হয়, বিশ্বে তা প্রতিনিয়ত দেখা যাচ্ছে। অবিলম্বে এ বিষয়ে মনোযোগ, সমবেদনা এবং পদক্ষেপের দাবি রাখে। যদিও কিছু লঙ্ঘন স্পষ্ট, কিন্তু সেগুলো তদন্ত করা ও আশ্রয় দেওয়ার যেসব প্রতিষ্ঠান রয়েছে, সেগুলো ততটা স্পষ্ট নয়। তার মধ্যে অন্যতম উদাহরণ হলো পরিবেশগত যুদ্ধাপরাধ।
আমরা ইতোমধ্যে বায়ু, জল এবং প্রাকৃতিক পরিবেশের ওপর যুদ্ধের প্রভাবের সম্পূর্ণ পরিমাণ বুঝতে শুরু করেছি। মাটি ও কৃষি, শক্তি ও জল অবকাঠামো এবং শেষ পর্যন্ত জনস্বাস্থ্য এবং নিরাপত্তার ওপর যুদ্ধের প্রভাব চরম আকারে পড়েছে। চ্যালেঞ্জ হলো, এর অনেক কিছুই সহজে দেখা যায় না এবং এসব বিষয়ে কখনো গবেষণা করা হয়নি। যুদ্ধের ভয়াবহতা আমরা যা দেখি তা নামেমাত্র দৃশ্যমান। যুদ্ধকবলিতদের সংখ্যা কল্পনার চেয়ে অনেক বেশি হতে পারে।
যেখানে ভেঙে পড়া ভবন রয়েছে, সেখানে প্রাণঘাতী অ্যাসবেস্টস এবং সিলিকা ধুলো বাতাসে ছড়িয়ে পড়তে পারে। যেখানে ল্যান্ডমাইন এবং অবিস্ফোরিত বোমা, ভারী ধাতু এবং অন্যান্য শক্তিশালী দূষণকারী পদার্থ ছড়িয়ে থাকতে পারে। এর মধ্যেই কিছু প্রজন্ম জীবন ধারণ করে চলছে। যেখানে হ্রদ ও কষিজমি বিষাক্ত হয়ে ওঠে, সেখানে খাদ্যনিরাপত্তা ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
আজকের আন্তর্জাতিক আইনে ইতোমধ্যেই এমন যুদ্ধাপরাধের বিচারের আওতায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে, যা পরিবেশের ব্যাপক ক্ষতি করে। তবে এ ধরনের অপরাধের বিচার স্থানীয় বা আন্তর্জাতিক আদালতে বিরল ঘটে। এ ধরনের ক্ষতির জন্য ক্ষতিপূরণও অনেক কম।
কিছু ইতিবাচক লক্ষণ আছে, এটি পরিবর্তন হতে পারে। জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদ ২০২২ সালে সশস্ত্র সংঘাতের ক্ষেত্রে পরিবেশ সুরক্ষার বিষয়ে একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রস্তাবে এই বিষয়টির প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিল। সেখানে উল্লেখ করা হয়েছিল, যুদ্ধে অন্যায়ভাবে যারা পরিবেশের ক্ষতি করবে, সম্পূর্ণ ক্ষতিপূরণ সেই সব রাষ্ট্রকে দিতে হবে। মার্চের ১ তারিখে জাতিসংঘের পরিবেশ পরিষদ একটি সর্বসম্মত প্রস্তাব পাস করেছে, এতে সশস্ত্র সংঘাতে পরিবেশগত ক্ষতি সম্পর্কে আরও তথ্য সংগ্রহের আহ্বান জানানো হয়।
আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের প্রসিকিউটর করিম খান ঘোষণা করেছেন, তার কার্যালয় পরিবেশগত অপরাধের ওপর ব্যাপক নীতি প্রণয়ন করছে। এই অপরাধের জন্য জবাবদিহি করতে হবে।
বাস্তব একটি চ্যালেঞ্জ হলো, পরিবেশের ক্ষতি পরিমাপ করা বিশেষ করে যখন সংঘর্ষ চলে। কিন্তু জনস্বাস্থ্য রক্ষা এবং ক্ষতি কমানোর জন্য জরুরি ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য এটি খুবই দরকার; যেমন নদী বা কৃষিজমিতে মারাত্মক দূষণ ছড়িয়ে পড়া বন্ধ করা। ক্ষয়ক্ষতির নথিভুক্ত করাও গুরুত্বপূর্ণ, যাতে সম্পূর্ণ ক্ষতিপূরণ প্রদান করা সম্ভব হয়। যদি যুদ্ধের অপব্যবহার বা বেআইনি কাজের কারণে হয়, তাহলে অপরাধীদের জবাবদিহি করা যাবে।
ইউক্রেনে রাশিয়ার পূর্ণ মাত্রায় আগ্রাসন প্রাকৃতিক পরিবেশে ভয়াবহ প্রভাব ফেলেছে। ইউক্রেন চিত্তাকর্ষক জীববৈচিত্র্য ও প্রাকৃতিক সম্পদের একটি দেশ, কিন্তু যুদ্ধ অনেক এলাকা ধ্বংস করে দিয়েছে। মাটি এবং জলপথ রাসায়নিক মিশ্রণে দূষিত হয়েছে। অন্যদিকে কৃষিজমি, বন এবং সবুজ স্থানগুলো গোলাবর্ষণ, আগুন এবং বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এক বছর আগে কাখোভকা বাঁধ ধ্বংস, যা দখলদার রাশিয়ান বাহিনীর ইচ্ছাকৃত কাজ বলে মনে করা হয়। এর ফলে গ্রাম ও কৃষিজমি প্লাবিত হয় এবং কৃষ্ণ সাগরের সর্বত্র ব্যাপক পরিবেশদূষণ হয়।
ইউক্রেনের এক-তৃতীয়াংশ অঞ্চল ল্যান্ডমাইন বা অবিস্ফোরিত বোমায় দূষিত বলে সন্দেহ করা হচ্ছে, যা বিশ্বের অন্য যেকোনো দেশকে ছাড়িয়ে গেছে। আমরা ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কির সাহসী উদ্যোগে যোগ দিয়ে পরিবেশগত উদ্বেগগুলোকে বিশ্বের নজরে আনার প্রচেষ্টায় অংশগ্রহণ করেছি।
প্রেসিডেন্ট ইউক্রেন যুদ্ধের পরিবেশগত পরিণতি নিয়ে উচ্চস্তরের কর্মশালা গ্রুপ তৈরি করেছেন। তার সদস্য হতে পেরে আমরা সন্তুষ্ট। তিনি যুদ্ধ শেষ হওয়ার জন্য একটি কাঠামো প্রস্তাব করেছেন; যেখানে শান্তি প্রতিষ্ঠার মূল উপাদান হিসেবে থাকবে পরিবেশগত সুরক্ষা।
প্রথমত, পরিবেশগত ক্ষয়ক্ষতি নথিভুক্ত করার জন্য আধুনিক প্রযুক্তিকে কাজে লাগাতে সুস্পষ্ট নির্দেশিকা প্রতিষ্ঠা করতে হবে। এ ধরনের মান প্রতিষ্ঠার জন্য আন্তর্জাতিক অংশীদারদের সঙ্গে কাজ করতে হবে। ইউক্রেন তার সব সংঘাতে পরিবেশগত ক্ষতির নথিভুক্ত করার নির্দেশনায় সাহায্য পাবে।
দ্বিতীয়ত, এ তথ্য ও প্রমাণ হাতে নিয়ে আমাদের অবশ্যই অপরাধীকে জবাবদিহির আওতায় আনতে হবে। তাদের কাছ থেকে সম্পূর্ণ ক্ষতিপূরণ আদায় নিশ্চিত করতে হবে। জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক পর্যায়ে পরিবেশগত দূষণ কমানোর প্রচেষ্টা চলছে।
পরিবেশগত ন্যায়বিচারের জন্য একটি জাতীয় কৌশল তৈরি করেছে ইউক্রেনের প্রসিকিউটর জেনারেল। আন্তর্জাতিক পর্যায়ে সর্বজনীন ক্ষমতা প্রয়োগ করে আদালতে এই অপরাধগুলোর বিচারের জন্য আরও বেশি মনোযোগ দিতে হবে।
পরিবেশগত ক্ষতি এবং প্রয়োজনীয় প্রতিকার বোঝার জন্য তদন্তকারী এবং প্রসিকিউটরদের শিকারকেন্দ্রিক পদ্ধতি অবলম্বন করা উচিত। ইউক্রেনের মানবাধিকার তদন্তে পরিবেশগত ক্ষতি এবং জনস্বাস্থ্যের ঝুঁকির দিকে বিশেষভাবে মনোযোগ দেওয়া উচিত।
পরিশেষে কর্মরত গ্রুপটি টেকসই পুনর্গঠনের গুরুত্বের দিকে বেশি জোর দিচ্ছে। জলবায়ু ও পরিবেশের বন্ধুত্বপূর্ণ উন্নয়ন কৌশলগুলোকে অন্তর্ভুক্তি করতে হবে। এই নীতিগুলো প্রয়োগ করার প্রচেষ্টা এখনই শুরু করতে হবে। কারণ ইউক্রেনের কিছু অংশে ইতোমধ্যেই পুনর্নির্মাণের কাজ চলছে।
ইউক্রেনে ন্যায়বিচার এবং সবুজায়ন পুনরুদ্ধার হলে বিশ্বজুড়ে সংঘাত এড়ানো যাবে এবং অন্যান্য দেশের উপকারে আসবে। দুই বছর আগে রাশিয়া যখন ইউক্রেনে তার পূর্ণমাত্রায় আগ্রাসন শুরু করেছিল, তখন ক্রেমলিন আন্তর্জাতিক আইনকে ঝুঁকির মধ্যে ফেলেছিল। রাশিয়ার কর্মকাণ্ড আন্তর্জাতিক আইন ও জাতিসংঘ সনদের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন। ভবিষ্যতের বৈশ্বিক পরিস্থিতি, আইনের স্পষ্ট লঙ্ঘনের জন্য ন্যায়বিচারের প্রত্যাশা, পরিবেশের ওপর ভয়ানক আক্রমণসহ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় কীভাবে এই আগ্রাসনের প্রতিবাদ করে তা নির্ধারণ করা দরকার।
আমরা সবাই জানি যে, পরিবেশগত হুমকি সীমান্তে থেমে থাকে না। ইউক্রেনে পারমাণবিক বিকিরণ বিপর্যয়ের ঝুঁকি রয়েছে। কারণ ইউরোপের বৃহত্তম জাপোরিঝঝিয়া পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র রাশিয়া দখল করে নিয়েছে। ফলে আঞ্চলিক হুমকির বড় উদ্বেগজনক অবস্থায় রয়েছে। আরেকটি হলো কৃষ্ণসাগরে যুদ্ধের প্রভাব, যেখানে পরিবেশগত ক্ষতি সামুদ্রিক জীববৈচিত্র্যের ওপর মারাত্মক প্রভাব ফেলছে। সমুদ্রজলের এই গুরুত্বপূর্ণ অংশের সীমান্তবর্তী সব দেশ এর মাধ্যমে ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।
এখন বিশ্ব সংঘাতে পরিবেশগত অপরাধের মাত্রার প্রতি জনগণ জাগ্রত হচ্ছে। আমাদের অবশ্যই কাজ করতে হবে, যাতে জবাবদিহি অনুসরণ করা হয়। স্বতন্ত্র অপরাধ এবং অপরাধকারী রাষ্ট্রের পরিবেশগত ক্ষতির দায় বহন করতে হবে এবং উভয়ই তা মোকাবিলায় ক্ষতিপূরণ দিতে হবে।
ইউক্রেনে বিচার হবে। ন্যায়বিচার সব ক্ষেত্রেই সমানভাবে প্রযোজ্য। যেখানে বলপ্রয়োগ আইনের সীমা অতিক্রম করে, সেখানেও সমানভাবে কার্যকর হবে। আসুন, আমরা একসঙ্গে কাজ করি। একটি সবুজ, ন্যায্য এবং শান্তিপূর্ণ ভবিষ্যৎ গড়ে তুলি।
লেখক: মেরি রবিনসন, আয়ারল্যান্ডের সাবেক প্রেসিডেন্ট
দ্য এল্ডার্সের চেয়ার ও মানবাধিকারবিষয়ক জাতিসংঘের সাবেক হাইকমিশনার
মার্গট ওয়ালস্ট্রোম, সুইডেনের সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী
আল-জাজিরা থেকে সংক্ষেপিত অনুবাদ: সানজিদ সকাল