গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার অন্যতম বৈশিষ্ট্য হচ্ছে জনগণের ভোটাধিকার। কিন্তু সেই অধিকার আজ সর্বজনীন নেই। আমাদের নিম্নমুখী দায়বদ্ধতা যতটুকু ছিল, তাও লোপ পেয়েছে। সমান্তরাল দায়বদ্ধতা সৃষ্টির জন্য জাতীয় সংসদ কাজ করে। কিন্তু বর্তমান জাতীয় সংসদ একমুখী- একটি দলের। ফলে গণতন্ত্রের সব বৈশিষ্ট্য লোপ পেয়েছে। এর ফলে দুর্নীতি, দুর্বৃত্তায়ন চলছে। এমন অবস্থা অব্যাহত থাকলে তা আরও ভয়াবহ আকার নিতে পারে। পরবর্তী প্রজন্মের জন্য আমাদের উচিত এই ব্যবস্থাকে রোধ করে একটি জবাবদিহিমূলক সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় কাঠামো নির্মাণে সবার সক্রিয় ভূমিকা রাখা। দেশে গণতন্ত্র, সুশাসন, জবাবদিহিমূলক সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় কাঠামোর জন্য সুজন কাজ করছে। আমরা মানুষের পক্ষে, গণতন্ত্রের পক্ষে।
কোনো দলের পক্ষে নই, আমরা নিরপেক্ষ। কিন্তু আমরা সচেতন নাগরিক হিসেবে আমাদের যা করণীয় রয়েছে, এখনো তা করতে পারিনি। এই স্বাধীনতার জন্য রক্ত, জীবন, মা-বোনেরা সম্ভ্রম দিয়েছেন। স্বাধীনতা পেয়েছি বলেই আমরা স্বাধীনভাবে কথা বলার অধিকার পেয়েছি। দেশ অনেক সমৃদ্ধ হয়েছে। কিন্তু এত কিছুর পরও দেশমাতার বদনখানি এখনো মলিন। কারণ, এখনো স্বাধীনতার অনেক স্বপ্ন পূরণ হয়নি। মানুষ ভোট দিতে চায়। কিন্তু ভোট দিতে গিয়ে বিকল্প থাকতে হবে। নিজেদের মধ্যে ভোট হলে তো সেই বিকল্প থাকে না। তাই মানুষ ভোটকেন্দ্রে যাওয়ার ব্যাপারে আগ্রহ দেখায় না। পছন্দমতো প্রার্থী বাছাই করতে নির্বাচন সবার জন্য অংশগ্রহণমূলক হওয়া প্রয়োজন। তারা বলেন, দেশকে এগিয়ে নিতে হলে শুধু ক্ষমতা পরিবর্তন হলেই চলবে না। গণতন্ত্র, জবাবদিহি, স্বচ্ছতা, ভোটাধিকারসহ সব ক্ষেত্রে ইতিবাচক পরিবর্তন আনতে হবে। আর এতে সবচেয়ে বেশি ভূমিকা রাখতে পারেন সমাজের বিভিন্ন অঙ্গনের সচেতন ব্যক্তিরা।
একটি কার্যকর ও শক্তিশালী নাগরিক সমাজ গঠনের পথের প্রতিবন্ধকতাগুলো দূর করা দরকার। যাতে রাষ্ট্রবহির্ভূত প্রতিষ্ঠান হিসেবে এটি সব সাংবিধানিক ও বিধিবদ্ধ প্রতিষ্ঠানের ওপর নজরদারি করার মাধ্যমে গণতন্ত্রকে কার্যকর ও সুশাসন প্রতিষ্ঠার পথ সুগম করতে পারে। অযাচিত নিয়ন্ত্রণের অবসান ঘটানোর মাধ্যমে নাগরিক সমাজের কাজের জন্য একটি সহায়ক পরিবেশ সৃষ্টি করা। মানবাধিকার সংরক্ষণ ও নাগরিকের মৌলিক অধিকার বলবৎ করার লক্ষ্যে নিবর্তনমূলক আইনগুলোর সংস্কার ও বাতিল করা এবং নিবর্তনমূলক নতুন আইন প্রণয়ন থেকে বিরত থাকা। গুম, অপহরণ ও বিচারবহির্ভূত হত্যার অবসানের মাধ্যমে মানবাধিকার লঙ্ঘনের সংস্কৃতির অবসান করা। রাষ্ট্রে ক্রমবর্ধমান আয় ও সুযোগের বৈষম্য নিরসনে একটি নতুন সামাজিক চুক্তি প্রণয়ন করা, যাতে রাষ্ট্রীয় সম্পদে সমাজের পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর ন্যায্য হিস্যা নিশ্চিত হয়, তারা মানসম্মত সেবা সুলভ মূল্যে ও দায়বদ্ধতার ভিত্তিতে পান এবং সত্যিকারভাবেই রাষ্ট্রের মালিকে পরিণত হন।
প্রতিবন্ধী ও তৃতীয় লিঙ্গের জনগোষ্ঠীর প্রতি সব বৈষম্যের অবসান করা। জীববৈচিত্র্য ও পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা এবং জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাত থেকে মুক্তির লক্ষ্যে একটি যুগোপযোগী পরিকল্পনা প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন করা। উন্নয়ন প্রকল্পগুলোর পুনর্মূল্যায়ন করে পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর প্রকল্পগুলো বাতিল করা। ‘ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড’ বা জনসংখ্যাজনিত বিশেষ সুবিধা অর্জনের লক্ষ্যে তরুণদের জন্য মানসম্মত শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা, নিরাপত্তা নিশ্চিত ও সুযোগ সৃষ্টি এবং তাদের নেতৃত্ব বিকাশের লক্ষ্যে কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ করা। গ্রামীণ শিক্ষার মানোন্নয়নে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করা। নারী ও কন্যাশিশুদের প্রতি সব নির্যাতনের অবসান ঘটিয়ে তাদের অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ক্ষমতায়নে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করা। সব ক্ষেত্রে নারীদের জন্য সমসুযোগের ব্যবস্থা করা।
বাংলাদেশকে উন্নত দেশ করতে হলে চারটি প্রাতিষ্ঠানিক স্তম্ভের ওপর নির্ভর করতে হবে। এগুলো হচ্ছে সুশাসন, গণতন্ত্রায়ন, বিকেন্দ্রীকরণ এবং সক্ষমতা বৃদ্ধি। বস্তুত, সুশাসন ও গণতন্ত্র নিশ্চিত না হলে কোনো উন্নয়নের সুফলই জনগণের কাছে পৌঁছায় না। বিদেশি বিনিয়োগ বৃদ্ধির জন্যও প্রাতিষ্ঠানিক এই স্তম্ভগুলোর বিকাশ জরুরি। বিনিয়োগকারীরা এ অঞ্চলে ব্যবসা প্রসারিত করতে চাইলেও বিনিয়োগের আগে তারা দেশে শান্তিপূর্ণ ও স্থিতিশীল পরিবেশ আছে কি না, তা যাচাই করেন। পাশাপাশি শ্রমের মানোন্নয়ন, পরিবেশ, গণতন্ত্র, স্বচ্ছতা, সহনশীলতা, সুশাসন ও মানবাধিকারের মতো বিষয়গুলো নিয়েও বিনিয়োগকারীরা চিন্তিত থাকেন। তাই দেশি-বিদেশি বিনিয়োগ বাড়াতে হলে সামনের দিনগুলোতে নীতিনির্ধারকদের এই প্রাতিষ্ঠানিক বিষয়গুলো নিশ্চিত করতে হবে। যেখানে গণতন্ত্র, স্বচ্ছতা, বহুত্ববাদ, সহনশীলতা, সুশাসন ও মানবাধিকারের প্রতি শ্রদ্ধাশীল পরিবেশ বজায় থাকবে এবং এর সঙ্গে সামাজিক ও পরিবেশগতভাবে সহনশীল পরিবেশ নিশ্চিত করা হবে।
আমাদের বর্তমান সংকটের সঙ্গে দুটি রাজনৈতিক বিষয় ওতপ্রোতভাবে জড়িত। একটি হলো কার্যকর গণতন্ত্রের অনুপস্থিতি তথা ‘ডেমোক্রেটিক ডেফিসিট’। অপরটি সুশাসনের অভাব বা ‘গভর্ন্যান্স ফেইলিওর’। এ দুইয়ের মধ্যে গভীর যোগসূত্র আছে। বস্তুত এগুলো একই সূত্রে গাঁথা এবং একে অন্যের পরিপূরকও বটে। প্রথমত, গণতন্ত্রের প্রধানতম অনুষঙ্গ সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন হলেও একতরফা ও ব্যর্থ জাতীয় নির্বাচনের কারণে সরকারকে জনগণের কাছে জবাবদিহি করার অন্যতম প্রধান একটি মাধ্যম ভেঙে পড়েছে। যার কারণে আন্তর্জাতিক থিংকট্যাংকগুলো বাংলাদেশকে এখন আর গণতান্ত্রিক দেশ হিসেবে বিবেচনা করছে না।
আজকের এ অবস্থার জন্য দ্বিতীয় যে বিষয়টি প্রভাবকের ভূমিকা পালন করেছে, তা হলো গভর্ন্যান্স ফেইলিওর বা সুশাসনের অভাব। যার সঙ্গে জড়িয়ে আছে মানবাধিকার ও আইনের শাসনের অভাব থেকে শুরু করে ন্যায়পরায়ণতার অনুপস্থিতি, স্বচ্ছ-জবাবদিহি নিশ্চিতকরণ ও জনগণের কার্যকর অংশগ্রহণের অভাব। সরকারের আশীর্বাদপুষ্টরা যে যেখানে পারছেন, গোষ্ঠীতন্ত্র কায়েম করে দুর্নীতিকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিয়েছেন। সরকারের পৃষ্ঠপোষকতা ও সহযোগিতায় লুটপাটের আয়োজন এবং বিদেশে অর্থ ও সম্পদ পাচারের ঘটনার স্বরূপ উন্মোচিত হলেও তারা বহাল তবিয়তেই রয়েছেন।
লেখক: সম্পাদক, সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন)