বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ সারা জীবন মিলনের গান গেয়েছেন। এ মিলন ব্যক্তির সঙ্গে ব্যক্তির, সীমার সঙ্গে অসীমের। তিনি সব সময়ই মানবতা থেকে বিশ্বমানবতায় উত্তরণের প্রচেষ্টায় রত ছিলেন। তাই তিনি যখনই সময় পেয়েছেন বিশ্বপরিক্রমা করেছেন। মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে দিয়েছেন প্রেম, ছড়িয়ে দিয়েছেন শান্তি ও মিলনের বারতা। মানবপ্রেমকে ছড়িয়ে দিয়েছেন বিশ্বমানবের কাছে।
বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর শুধু বাঙালির কবি ছিলেন না। তিনি ছিলেন সমগ্র বিশ্বের এবং মানবতাবাদী অসাম্প্রদায়িক চেতনার কবি। তার চিন্তাচেতনা, অন্তর্নিহিত ভাব ও দর্শন আমাদের জাতীয় ও ব্যক্তিজীবনে প্রতিনিয়ত প্রাসঙ্গিক করে তুলতে পারলে সামগ্রিক উন্নয়ন ও কল্যাণ সাধিত হবে। এই সময়ের সংঘাতময় বিশ্বে রবীন্দ্রভাবনা ও চেতনা একান্ত প্রয়োজন। তাহলে বিশ্বে বয়ে যাবে শান্তির ঝরনাধারা।
আমরা জানি, অসাম্প্রদায়িক রবীন্দ্রমানসের একটি বিশাল অংশের প্রত্যাশা ছিল বিশ্বে সব মানুষের পরিচয় হোক তারা কেবল মানুষ, কোনো জাতি কিংবা ধর্মের মাধ্যমে নয়। তাহলেই বিশ্ব হবে শান্তিময়।
বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথের মধ্যে ছিল পরিচ্ছন্ন মানস এবং শুভচেতনা। সাম্প্রদায়িকতা কখনোই তার চেতনাকে স্পর্শ করতে পারেনি। তাই তিনি ‘গোরা’ উপন্যাসে বলতে পেরেছিলেন, ‘আপনি আজ আমাকে সেই দেবতার মন্ত্রে দীক্ষা দিন যিনি হিন্দু, মুসলমান, খ্রিষ্টান, ব্রাহ্ম সকলেরই। যার মন্দিরের দ্বার কোন জাতির কাছে, কোন ব্যক্তির কাছে কোন দিন অবরুদ্ধ হয় না, যিনি কেবলই হিন্দুর দেবতা নয়, গোটা ভারতবর্ষের দেবতা।’ বিশ্বসাহিত্যের এমন অবিনাশী বাণী অসাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র গঠনে চিরকালই সহায়ক হয়ে থাকবে।
‘রবীন্দ্রস্মৃতি’ প্রবন্ধে পল্লিকবি জসীমউদদীন বলেছেন, ‘আমি তখন এম এ পড়তে কলিকাতা এমসিএ হোস্টেলে ছিলাম, সেই সময়ে আমি প্রায়ই রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে দেখা করতে যেতাম; আমাকে দেখলেই কবি সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির ব্যাপার নিয়ে আলোচনা করতেন।’
তিনি বুঝেছিলেন মানুষে মানুষে মিলনের পথে সবচেয়ে বড় বাধা প্রভুত্ব-প্রবণতা। তিনি এই প্রভুত্বের বিরোধী ছিলেন। তাই জমিদারতনয় এবং নিজেই যখন জমিদারি দেখাশোনার দায়িত্ব পেয়েছেন তখনো প্রভুত্ব করার প্রবণতামুক্ত ছিলেন। অন্য জমিদারদের দ্বারা নির্যাতিত প্রজার ব্যথাময় কাহিনি উঠে এসেছে তার রচনায়।
‘দীক্ষা’ প্রবন্ধে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছেন, ‘এ আশ্রম, এখানে কোন দল নেই, সম্প্রদায় নেই। মানব সরোবরে যেমন পদ্ম বিকশিত হয়, তেমনি এই প্রান্তরের আকাশে এই আশ্রমটি জেগে উঠেছে; এক কোন সম্প্রদায়ের বলতে পারবে না।’ তিনি বারবার ধর্মের দীক্ষার অন্তরালে মনুষ্যত্বের দীক্ষার কথা বলেছেন।
জীবনের অধিকাংশ ক্ষেত্রে তিনি পিতা মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের দ্বারা প্রভাবিত ছিলেন। মহর্ষি সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছেন, ‘অর্জনের দ্বারা তিনি যাহা আমাদিগকে দিয়াছেন, তাহা আমরা গ্রহণ করিয়াছি; বর্জনের দ্বারা যাহা তিনি আমাদিগকে দিয়াছেন, তাহাও যেন গৌরবের সহিত গ্রহণ করিবার যোগ্য আমরা হইতে পারি।’ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর আরও উল্লেখ করেছিলেন, ‘কত অনাথ পরিবারের তিনি আশ্রয় ছিলেন, কত দরিদ্র গুণীকে অভাবের পেষণ হইতে উদ্ধার করিয়াছেন, দেশের হিতকর্মে তিনি বিনা আড়ম্বরে গোপনে সাহায্য দিয়াছেন। এই দিকে কৃপণতা করিয়া তিনি কোনদিন বিলাসভোগ বা ধর্মাভিমানচর্চায় প্রশ্রয় দেন নাই।’
পিতার এই দিকগুলো তাকে এতটাই প্রভাবিত করেছিল যে, যেসব সংকীর্ণ স্বার্থবোধ মানুষের মনের ভেতর ধর্মীয়, জাতিগত ও দেশগত বিভেদ সৃষ্টি করে তা থেকে তিনি মুক্ত ছিলেন।
শুধু মহর্ষি নন, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর এবং রামমোহন রায়ও রবীন্দ্রনাথকে বিশ্বজনীন মানসিকতা গঠনে সহায়তা করেছেন। কারণ এই দুই মহান ব্যক্তিত্ব সমাজ থেকে সামাজিক ও ধর্মীয় কুসংস্কার, অজ্ঞানতা, জাতিভেদ, জাত্যভিমান, নারীর অবমানতার মানসিকতাকে অপসারণ করতে চেয়েছিলেন। এই প্রচেষ্টা দ্বারা উভয়ই সমাজে যেমন ন্যায়নীতি প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা করেছেন, তেমনি সমাজকে আধুনিক করে গড়ে তুলতেও চেষ্টা করেছেন।
এই দুই মহাপুরুষ দুভাবে রবীন্দ্রনাথকে প্রভাবিত করেছিলেন, রামমোহন রায়ের কাছ থেকে তিনি পেয়েছিলেন সাহস এবং ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের কাছ থেকে আবেগ। তিনি বুঝতে পেরেছিলেন আবেগ না থাকলে শক্তি-সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও অনেক বৃহৎ কর্ম সম্পাদন করা যায় না। এই আবেগ দ্বারাই তিনি সেই সময় বিধবা বিবাহের মতো একটি কঠিন কর্ম সম্পাদন করতে পেরেছিলেন।
তিনি কখনোই ধর্মের ভিত্তিতে দেশ ও জাতি গঠনের পরিকল্পনা ও চিন্তার পক্ষে ছিলেন না। তবে তাই বলে তিনি নাস্তিক ছিলেন না, আবার আদর্শগতভাবে তিনি বামপন্থিও ছিলেন না। কোনো না কোনোভাবে ঈশ্বর-বিশ্বাস তার গানে ও কবিতায় স্পষ্টভাবেই অভিব্যক্ত হয়েছে। ধর্মবিশ্বাসকে তিনি নিজের মতো করে গড়ে তুলেছেন, তার বিশ্বাসের একটি বড় জায়গা-অধিকৃত চিন্তাটি ছিল, ‘মানুষের চেয়ে বড়ো আর কিছুই নয়।’ তার মানস জগতে ধর্মান্ধতা, জাতীয়তা এবং সাম্প্রদায়িকতা কোনোভাবেই ঠাঁই করে নিতে পারেনি।
তিনি বিশ্বাস করতেন নাস্তিকের জীবন অত্যন্ত কঠিন। কারণ ঈশ্বর-বিশ্বাসীর জন্য কোনো একটা জায়গা থাকে যেখানে সে আশ্রয় নিতে পারে। কিন্তু নাস্তিককে নিজের অহংকারেই নিষ্কলঙ্ক ও সৎ থাকতে হয়, কারণ তার তো আশ্রয় নেই, যেখানে দাঁড়িয়ে ক্ষমা চাওয়া যায় কিংবা পাপ ধৌত করা যায়।
যেই তিনি ঈশ্বরে বিশ্বাসী কিন্তু গোঁড়ামিতে আসক্ত নন, সেই তিনিই এককে নয় একান্নবর্তীতে ভরসা রেখেছেন।
তিনি বিশ্বাস করেন সব ধর্মের মানুষের মধ্যে মিলন অনিবার্য। যখন একের সঙ্গে অন্যজন মিলিত হয় তখনই পারস্পরিক ভুল ও মিথ্যাগুলো সামনে আসে এবং তা সংশোধনের সুযোগ থাকে।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মের বিরোধী ছিলেন। কারণ প্রতিষ্ঠানপন্থি প্রতিক্রিয়াশীল শক্তি নিজস্ব কায়েমি স্বার্থকে চরিতার্থ করার সুযোগ পায়। কিন্তু মানুষের স্বাভাবিক ধর্মবুদ্ধি জাগ্রত থাকলে তা কখনোই সম্ভব হয় না। এভাবেই ভাবতে ভাবতে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তার ‘জীবন দেবতা’র সন্ধান করেছেন নিজের মধ্যে, কোনো দেবালয়ে নয়।
ধর্মের ভেদাভেদে তিনি কখনোই বিশ্বাসী ছিলেন না, তাই তার দৃষ্টিতে হিন্দু-মুসলমান উভয়ই ‘ভারতভাগ্যের শরিক’। তার সে সময়ের চেতনা আজ যদি নতুন করে ভাবা যেত, তাহলে সত্যি বিশ্বের সর্বত্র ছড়িয়ে থাকা অশান্তির সুরাহা হতো। আজ যখন সাম্প্রদায়িক শক্তি সাধারণ মানুষকে বিভ্রান্ত করতে, বিভক্ত করতে মরিয়া হয়ে উঠছে, তখন রবীন্দ্রনাথের প্রদর্শিত পথেই বিশ্বের সব সম্প্রদায়ের মানুষকে মিলিত হতে হবে। এই মিলন একান্তই প্রয়োজন বিচ্ছিন্নতাবাদ, মৌলবাদ, সাম্প্রদায়িকতার পক্ষের শক্তিকে নিশ্চিহ্ন করার জন্য।
আমরা যদি মনের গভীরে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘আমি মানুষ’- এই মন্ত্রটি ধারণ করতে পারি তাহলে সংকীর্ণতার ঊর্ধ্বে উঠে পরম ভ্রাতৃত্ববোধে বিশ্বকে আলিঙ্গন করতে পারব। ভাইয়ের বুকে ঠাঁই পাবে ভাই। মিলনের জ্যোতিতে আলোকিত হবে পৃথিবী।
তাই বলতেই পারি, অসাম্প্রদায়িক চেতনায় বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর চিরদিনই প্রাসঙ্গিক।
লেখক: কবি, গল্পকার ও শিশু সাহিত্যিক