উপজেলা নির্বাচনে প্রার্থী হওয়ায় বিএনপি যাদের দল থেকে বহিষ্কার করেছে, তাদের মধ্যে একজন বাদে সবাই ভোটের মাঠেই রয়েছেন। বরং তারা বেশির ভাগই কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের সমালোচনা করছেন। বাস্তবে বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতারা যে ধরনের স্ট্যান্ড নিয়েছেন রাজনীতিতে, তাতে পরিষ্কার ধারণা করা যাচ্ছে, তৃণমূলে তারা পুরোটাই নিশ্চিহ্ন হওয়ার পথে। এভাবে ক্রমাগতভাবে সব নির্বাচন বর্জন করলে স্থানীয় পর্যায়ে রাজনীতি করা তাদের পক্ষে সম্ভব হবে না। আর স্থানীয় পর্যায়ে রাজনীতি না থাকলে কোনোভাবেই সেই রাজনীতি টেকসই হয় না। খুব স্বাভাবিকভাবেই এখন প্রশ্ন উঠেছে, বিএনপির নিষ্ক্রিয়তাই মূলত আওয়ামী লীগের ক্রমাগত শক্তি বৃদ্ধির মূল কারণ।
সাধারণ মানুষসহ বিএনপির নেতা-কর্মীরা ভাবছেন, বারবার ভোট বর্জন করলে দলের ভবিষ্যৎ কী? তৃণমূলের নেতা-কর্মীরা এতটাই নির্বাচনমুখী যে, বিএনপির হাইকমান্ডকে অমান্য করে এখন তারা রাজনীতিতে টিকে থাকতে চান। তারা নিশ্চয়ই অনুধাবন করেছেন যে, এভাবে কোনো দলের অস্তিত্ব থাকে না।
জাতীয় নির্বাচনের পর বিএনপি নানাভাবে শক্তি সঞ্চয় করে আন্দোলনের প্রতিশ্রুতি এবং ঘোষণা দিলেও বাস্তবে তারা মোটেও দাঁড়াতে পারছে না। আর এ অবস্থায় কারও অনুমান করতে বাকি নেই যে, উপজেলা নির্বাচনের পর বিএনপি কোনোভাবেই রাজনীতির মাঠে টিকতে পারবে না। আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন আসতে আসতে বিএনপির মূল খুঁজে পাওয়াই কঠিন হবে বলে ধারণা করা যাচ্ছে। অনেকটা হতাশাবন্দি হয়ে দলটি খাঁচার বাইরে আসতে পারবে না। এমন আশঙ্কা করলে ভুল হবে না যে, বিএনপির পরিণতি ক্রমেই সাইন বোর্ডসর্বস্ব হতে পারে। সাম্প্রতিক সময়ে বিএনপি একটি সমাবেশ ডেকে গরমের অজুহাতে সেটি আবার স্থগিত ঘোষণা করেছে। নিকট ভবিষ্যতে বিএনপি কোনো সফল সমাবেশ করতে পারবে না বলে ধারণা করা যায়। কারণ যাদের নিয়ে সমাবেশ সফল করবে, উপজেলা নির্বাচনকে কেন্দ্র করে তাদের বহিষ্কার করেই চলেছে দলটি।
বিএনপি হয়তো ভাবছে, দেশের জনগণের মনে তাদের সম্পর্কে একটি ইতিবাচক ধারণা রয়েছে। আপাতদৃষ্টিতে তারা এমনটি মনে করলেও কোনো সভা-সমাবেশ, মিছিল-মিটিং বা যেকোনো ধরনের কর্মসূচি ডাকলে সেভাবে তা সফলতার মুখ দেখছে না। বলা যায়, তারা এখন বক্তব্য-বিবৃতির মধ্যেই চলে গেছে। বিএনপির বর্তমান এই করুণ দশার জন্য বিগত বিভিন্ন সময়ে তাদের গৃহীত রাজনৈতিক কর্মসূচিই দায়ী। মূলত তারা কিছু ভুল কর্মসূচি গ্রহণ করে নিজেদের অস্তিত্ব বিলীন করেছে। বর্তমান সময়েও ঢালাও দলীয় নেতা-কর্মীদের বহিষ্কারের সিদ্ধান্তটিও ১০০ ভাগ ভুল সিদ্ধান্ত। বিএনপি একসময় সংখ্যাসর্বস্ব ৫৪টি রাজনৈতিক দলকে নিয়ে জোট বেঁধেছিল। বিএনপির পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল, নির্দলীয়-নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি আদায় না করা পর্যন্ত তারা রাজপথে থাকবে। কিন্তু সেসব দল এবং জোট কোনোটিই এখন বিএনপির পাশে নেই।
অথচ ’৯০-পরবর্তী বেশ কয়েকটি সরকারে আওয়ামী লীগ এবং বিএনপিকে সরকারি ও বিরোধী দলে শক্ত অবস্থানে দেখা গেছে। এমনকি রাজনীতির মাঠেও সব সময়েই মুখোমুখি অবস্থানে ছিল। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকলে বিএনপিকে বিরোধী দলে আর বিএনপি ক্ষমতায় থাকলে আওয়ামী লীগকে বিরোধী দলে দেখা গেছে। কিন্তু গত চারটি নির্বাচনে পরপর আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করেছে। আর এই রাস্তাটি সহজ করে দিয়েছে বিএনপি নিজেই। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি প্রথম বিএনপি নির্বাচনে অংশগ্রহণ না করে বিরোধী দলের অস্তিত্ব হারিয়েছিল। সে সময় এই সিদ্ধান্তের ক্ষেত্রেও বিএনপির মধ্যে মতবিরোধ ছিল। পরবর্তী সময়ে মোটামুটিভাবে বিএনপির একটি অংশ দাবি করেছে এবং স্বীকার করেছে যে, বিএনপি ওই নির্বাচনে গেলে কোনোভাইে বর্তমান সময়ের সংকটাবস্থায় পড়তে হতো না। বিএনপি ইতোপূর্বে কখনোই এমন সংকটাবস্থার মুখোমুখি হয়নি। এর জন্য বিভিন্ন মহল থেকে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে বিএনপির একগুঁয়েমি অবস্থানকে দায়ী করা হয়েছে। কারণ ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচন-পূর্ব সরকারের পক্ষ থেকে নির্বাচনকালীন সর্বদলীয় সরকার গঠনের প্রস্তাবে বিএনপিকে যেকোনা গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয় দেওয়ার শর্ত, বিএনপি চেয়ারপারসনকে প্রধানমন্ত্রীর টেলিফোন প্রভৃতি বিষয়ে ‘নির্বাচন ও গণতন্ত্র’ নিয়ে উভয় দলের আগ্রহ এবং অনাগ্রহের মাত্রাটি অবলোকন করা গেছে। তখন নির্বাচনের মাঠে প্রতিপক্ষকে বাধাহীন গোল করার সুযোগ করে দিয়েছিল বিএনপি। পরবর্তী সময়ে বিএনপি আর কোনোভাবেই নিজেদের শক্ত অবস্থান তৈরি করতে পারেনি।
সমসাময়িক রাজনীতিতে বিএনপি বড় ধরনের কোনো আন্দোলন কিংবা প্রতিরোধ গড়ে তোলার শক্তি হারিয়ে ফেলেছে। আর শক্ত ইস্যু এবং প্রতিরোধ ছাড়া কোনোভাবেই সরকারকে ধরাশায়ী করা সম্ভব না। এ ছাড়া বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর সরকার পরিচালনার কৌশল ও তার ব্যক্তিগত কঠোর অবস্থানের ফলে রাজনীতিতে খুব বেশি ভুল করার সুযোগ পাচ্ছেন না অন্যান্য মন্ত্রী কিংবা রাজনৈতিক নেতা।
সংবিধান মোতাবেক দেশে নির্বাচন হয়, নির্বাচনে জয়-পরাজয় থাকেই। সংখ্যার চেয়ে বড় কথা হচ্ছে অংশগ্রহণ। এই মুহূর্তে বিএনপি উপজেলা নির্বাচন বর্জন না করে অংশ নিতে পারত। তা হলে কিছুটা হলেও তৃণমূল পর্যায়ে আওয়ামী লীগের বিপক্ষে একটি শক্ত অবস্থান ধরে রাখতে পারত। এমনকি বিএনপি তাদের গঠনমূলক বক্তব্য-বিবৃতি জনগণের সামনে ন্যায্যভাবে তুলে ধরতে পারত। সংখ্যা কম হলেও সরকারের বিপক্ষে সংসদের বাইরে একটি সচেতন অবস্থা তৈরি করার সুযোগ পেত। কিন্তু এই মুহূর্তে কোনোভাবেই গুণগত প্রভাব বিস্তার করা সম্ভব হবে না বিএনপির পক্ষে। বর্তমানে দেশে কোনো রাজনৈতিক সংকট কিংবা অস্থিরতা নেই বললেই চলে। অনেকেরই প্রত্যাশা, বর্তমান সরকারের অধীনে দেশ উন্নতির পথে এগিয়ে যাচ্ছে। এ রকম রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা বজায় থাকলে দেশ দ্রুততম সময়ে উন্নত রাষ্ট্রের কোটায় পৌঁছে যাবে। বিএনপির মধ্যে একটি বড় অংশই এখন মনে করছে যে, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে আন্দোলন করে জাতীয় নির্বাচন বর্জন করা যেমন একটি হঠকারিতা ছিল ঠিক, তেমনি উপজেলা নির্বাচন বর্জন এবং দলীয় নেতা-কর্মীকে বহিষ্কারের সিদ্ধান্তটিও আরেকটি হঠকারিতা।
আওয়ামী লীগ তাদের কৌশলে নির্বাচনকে উৎসবমুখর রাখবেই। অংশগ্রহণমূলক এবং প্রতিযোগিতামূলক করতে আওয়ামী লীগের সব কৌশল চলমান রয়েছে। বিএনপির পক্ষে নির্বাচন প্রতিরোধ করা সাংগঠনিকভাবে সম্ভব নয়। কারণ এই মুহূর্তে বিএনপি সাংগঠনিকভাবে অনেকটা বিধ্বস্ত হয়ে পড়েছে।
একের পর এক দুর্যোগে দলের ভিত হিসেবে পরীক্ষিত তৃণমূলের নেতা-কর্মীরা যেন কোনো আস্থার জায়গা পাচ্ছেন না। আগামী দিনে বিএনপির সামনে কঠিন রাজনৈতিক চ্যালেঞ্জ রয়েছে। এই চ্যালেঞ্জকে কত গুরুত্বের সঙ্গে মোকাবিলা করতে পারবে তার ওপরেই নির্ভর করছে তাদের ভবিষ্যৎ রাজনৈতিক সম্ভাবনা। এই মুহূর্তে নিজেদের মধ্যে ঐক্য ও সমঝোতার মনোভাব তৈরি করে স্থিতিশীল রাজনৈতিক কর্মসূচি এবং অংশগ্রহণের ভেতর দিয়ে জনগণের মনে আবেদন সৃষ্টি করতে না পারলে কোনোভাবেই তারা সফল হতে পারবে না।
লেখক: অধ্যাপক, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়
[email protected]