বিএনপির ভোট বর্জনের রাজনীতির ভবিষ্যৎ কী । খবরের কাগজ
ঢাকা ৬ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১, সোমবার, ২০ মে ২০২৪

বিএনপির ভোট বর্জনের রাজনীতির ভবিষ্যৎ কী

প্রকাশ: ০৭ মে ২০২৪, ১১:০৬ এএম
বিএনপির ভোট বর্জনের রাজনীতির ভবিষ্যৎ কী
ড. সুলতান মাহমুদ রানা

উপজেলা নির্বাচনে প্রার্থী হওয়ায় বিএনপি যাদের দল থেকে বহিষ্কার করেছে, তাদের মধ্যে একজন বাদে সবাই ভোটের মাঠেই রয়েছেন। বরং তারা বেশির ভাগই কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের সমালোচনা করছেন। বাস্তবে বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতারা যে ধরনের স্ট্যান্ড নিয়েছেন রাজনীতিতে, তাতে পরিষ্কার ধারণা করা যাচ্ছে, তৃণমূলে তারা পুরোটাই নিশ্চিহ্ন হওয়ার পথে। এভাবে ক্রমাগতভাবে সব নির্বাচন বর্জন করলে স্থানীয় পর্যায়ে রাজনীতি করা তাদের পক্ষে সম্ভব হবে না। আর স্থানীয় পর্যায়ে রাজনীতি না থাকলে কোনোভাবেই সেই রাজনীতি টেকসই হয় না। খুব স্বাভাবিকভাবেই এখন প্রশ্ন উঠেছে, বিএনপির নিষ্ক্রিয়তাই মূলত আওয়ামী লীগের ক্রমাগত শক্তি বৃদ্ধির মূল কারণ।

সাধারণ মানুষসহ বিএনপির নেতা-কর্মীরা ভাবছেন, বারবার ভোট বর্জন করলে দলের ভবিষ্যৎ কী? তৃণমূলের নেতা-কর্মীরা এতটাই নির্বাচনমুখী যে, বিএনপির হাইকমান্ডকে অমান্য করে এখন তারা রাজনীতিতে টিকে থাকতে চান। তারা নিশ্চয়ই অনুধাবন করেছেন যে, এভাবে কোনো দলের অস্তিত্ব থাকে না।

জাতীয় নির্বাচনের পর বিএনপি নানাভাবে শক্তি সঞ্চয় করে আন্দোলনের প্রতিশ্রুতি এবং ঘোষণা দিলেও বাস্তবে তারা মোটেও দাঁড়াতে পারছে না। আর এ অবস্থায় কারও অনুমান করতে বাকি নেই যে, উপজেলা নির্বাচনের পর বিএনপি কোনোভাবেই রাজনীতির মাঠে টিকতে পারবে না। আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন আসতে আসতে বিএনপির মূল খুঁজে পাওয়াই কঠিন হবে বলে ধারণা করা যাচ্ছে। অনেকটা হতাশাবন্দি হয়ে দলটি খাঁচার বাইরে আসতে পারবে না। এমন আশঙ্কা করলে ভুল হবে না যে, বিএনপির পরিণতি ক্রমেই সাইন বোর্ডসর্বস্ব হতে পারে। সাম্প্রতিক সময়ে বিএনপি একটি সমাবেশ ডেকে গরমের অজুহাতে সেটি আবার স্থগিত ঘোষণা করেছে। নিকট ভবিষ্যতে বিএনপি কোনো সফল সমাবেশ করতে পারবে না বলে ধারণা করা যায়। কারণ যাদের নিয়ে সমাবেশ সফল করবে, উপজেলা নির্বাচনকে কেন্দ্র করে তাদের বহিষ্কার করেই চলেছে দলটি।

বিএনপি হয়তো ভাবছে, দেশের জনগণের মনে তাদের সম্পর্কে একটি ইতিবাচক ধারণা রয়েছে। আপাতদৃষ্টিতে তারা এমনটি মনে করলেও কোনো সভা-সমাবেশ, মিছিল-মিটিং বা যেকোনো ধরনের কর্মসূচি ডাকলে সেভাবে তা সফলতার মুখ দেখছে না। বলা যায়, তারা এখন বক্তব্য-বিবৃতির মধ্যেই চলে গেছে। বিএনপির বর্তমান এই করুণ দশার জন্য বিগত বিভিন্ন সময়ে তাদের গৃহীত রাজনৈতিক কর্মসূচিই দায়ী। মূলত তারা কিছু ভুল কর্মসূচি গ্রহণ করে নিজেদের অস্তিত্ব বিলীন করেছে। বর্তমান সময়েও ঢালাও দলীয় নেতা-কর্মীদের বহিষ্কারের সিদ্ধান্তটিও ১০০ ভাগ ভুল সিদ্ধান্ত। বিএনপি একসময় সংখ্যাসর্বস্ব ৫৪টি রাজনৈতিক দলকে নিয়ে জোট বেঁধেছিল। বিএনপির পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল, নির্দলীয়-নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি আদায় না করা পর্যন্ত তারা রাজপথে থাকবে। কিন্তু সেসব দল এবং জোট কোনোটিই এখন বিএনপির পাশে নেই।

অথচ ’৯০-পরবর্তী বেশ কয়েকটি সরকারে আওয়ামী লীগ এবং বিএনপিকে সরকারি ও বিরোধী দলে শক্ত অবস্থানে দেখা গেছে। এমনকি রাজনীতির মাঠেও সব সময়েই মুখোমুখি অবস্থানে ছিল। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকলে বিএনপিকে বিরোধী দলে আর বিএনপি ক্ষমতায় থাকলে আওয়ামী লীগকে বিরোধী দলে দেখা গেছে। কিন্তু গত চারটি নির্বাচনে পরপর আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করেছে। আর এই রাস্তাটি সহজ করে দিয়েছে বিএনপি নিজেই। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি প্রথম বিএনপি নির্বাচনে অংশগ্রহণ না করে বিরোধী দলের অস্তিত্ব হারিয়েছিল। সে সময় এই সিদ্ধান্তের ক্ষেত্রেও বিএনপির মধ্যে মতবিরোধ ছিল। পরবর্তী সময়ে মোটামুটিভাবে বিএনপির একটি অংশ দাবি করেছে এবং স্বীকার করেছে যে, বিএনপি ওই নির্বাচনে গেলে কোনোভাইে বর্তমান সময়ের সংকটাবস্থায় পড়তে হতো না। বিএনপি ইতোপূর্বে কখনোই এমন সংকটাবস্থার মুখোমুখি হয়নি। এর জন্য বিভিন্ন মহল থেকে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে বিএনপির একগুঁয়েমি অবস্থানকে দায়ী করা হয়েছে। কারণ ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচন-পূর্ব সরকারের পক্ষ থেকে নির্বাচনকালীন সর্বদলীয় সরকার গঠনের প্রস্তাবে বিএনপিকে যেকোনা গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয় দেওয়ার শর্ত, বিএনপি চেয়ারপারসনকে প্রধানমন্ত্রীর টেলিফোন প্রভৃতি বিষয়ে ‘নির্বাচন ও গণতন্ত্র’ নিয়ে উভয় দলের আগ্রহ এবং অনাগ্রহের মাত্রাটি অবলোকন করা গেছে। তখন নির্বাচনের মাঠে প্রতিপক্ষকে বাধাহীন গোল করার সুযোগ করে দিয়েছিল বিএনপি। পরবর্তী সময়ে বিএনপি আর কোনোভাবেই নিজেদের শক্ত অবস্থান তৈরি করতে পারেনি।

সমসাময়িক রাজনীতিতে বিএনপি বড় ধরনের কোনো আন্দোলন কিংবা প্রতিরোধ গড়ে তোলার শক্তি হারিয়ে ফেলেছে। আর শক্ত ইস্যু এবং প্রতিরোধ ছাড়া কোনোভাবেই সরকারকে ধরাশায়ী করা সম্ভব না। এ ছাড়া বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর সরকার পরিচালনার কৌশল ও তার ব্যক্তিগত কঠোর অবস্থানের ফলে রাজনীতিতে খুব বেশি ভুল করার সুযোগ পাচ্ছেন না অন্যান্য মন্ত্রী কিংবা রাজনৈতিক নেতা।

সংবিধান মোতাবেক দেশে নির্বাচন হয়, নির্বাচনে জয়-পরাজয় থাকেই। সংখ্যার চেয়ে বড় কথা হচ্ছে অংশগ্রহণ। এই মুহূর্তে বিএনপি উপজেলা নির্বাচন বর্জন না করে অংশ নিতে পারত। তা হলে কিছুটা হলেও তৃণমূল পর্যায়ে আওয়ামী লীগের বিপক্ষে একটি শক্ত অবস্থান ধরে রাখতে পারত। এমনকি বিএনপি তাদের গঠনমূলক বক্তব্য-বিবৃতি জনগণের সামনে ন্যায্যভাবে তুলে ধরতে পারত। সংখ্যা কম হলেও সরকারের বিপক্ষে সংসদের বাইরে একটি সচেতন অবস্থা তৈরি করার সুযোগ পেত। কিন্তু এই মুহূর্তে কোনোভাবেই গুণগত প্রভাব বিস্তার করা সম্ভব হবে না বিএনপির পক্ষে। বর্তমানে দেশে কোনো রাজনৈতিক সংকট কিংবা অস্থিরতা নেই বললেই চলে। অনেকেরই প্রত্যাশা, বর্তমান সরকারের অধীনে দেশ উন্নতির পথে এগিয়ে যাচ্ছে। এ রকম রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা বজায় থাকলে দেশ দ্রুততম সময়ে উন্নত রাষ্ট্রের কোটায় পৌঁছে যাবে। বিএনপির মধ্যে একটি বড় অংশই এখন মনে করছে যে, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে আন্দোলন করে জাতীয় নির্বাচন বর্জন করা যেমন একটি হঠকারিতা ছিল ঠিক, তেমনি উপজেলা নির্বাচন বর্জন এবং দলীয় নেতা-কর্মীকে বহিষ্কারের সিদ্ধান্তটিও আরেকটি হঠকারিতা।

আওয়ামী লীগ তাদের কৌশলে নির্বাচনকে উৎসবমুখর রাখবেই। অংশগ্রহণমূলক এবং প্রতিযোগিতামূলক করতে আওয়ামী লীগের সব কৌশল চলমান রয়েছে। বিএনপির পক্ষে নির্বাচন প্রতিরোধ করা সাংগঠনিকভাবে সম্ভব নয়। কারণ এই মুহূর্তে বিএনপি সাংগঠনিকভাবে অনেকটা বিধ্বস্ত হয়ে পড়েছে।

একের পর এক দুর্যোগে দলের ভিত হিসেবে পরীক্ষিত তৃণমূলের নেতা-কর্মীরা যেন কোনো আস্থার জায়গা পাচ্ছেন না। আগামী দিনে বিএনপির সামনে কঠিন রাজনৈতিক চ্যালেঞ্জ রয়েছে। এই চ্যালেঞ্জকে কত গুরুত্বের সঙ্গে মোকাবিলা করতে পারবে তার ওপরেই নির্ভর করছে তাদের ভবিষ্যৎ রাজনৈতিক সম্ভাবনা। এই মুহূর্তে নিজেদের মধ্যে ঐক্য ও সমঝোতার মনোভাব তৈরি করে স্থিতিশীল রাজনৈতিক কর্মসূচি এবং অংশগ্রহণের ভেতর দিয়ে জনগণের মনে আবেদন সৃষ্টি করতে না পারলে কোনোভাবেই তারা সফল হতে পারবে না।

লেখক: অধ্যাপক, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়
[email protected]

ভারতের নির্বাচনে জটিল সমীকরণ

প্রকাশ: ২০ মে ২০২৪, ১১:৩৫ এএম
ভারতের নির্বাচনে জটিল সমীকরণ
সুখরঞ্জন দাশগুপ্ত

আর মাত্র দুই সপ্তাহ বাকি কিন্তু তার আগেই জুন সন্ধ্যা ৬টার পর টিভি চ্যানেলগুলো বুথফেরত সমীক্ষা দেখাবে তাতেই একটা আঁচ পাওয়া যাবে ভারতে কারা এবার তখতে বসবে সব সময় সব হিসাব না মিললেও বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই এই সমীক্ষা একটা আভাস দিতে পারে

প্রধানমন্ত্রী মঙ্গলবার তার নির্বাচনি কেন্দ্র উত্তর প্রদেশের বারানসীতে গঙ্গার ঘাটে ঘাটে পূজা দিয়েছেন মনোনয়নপত্র দাখিল করার পর তিনি এক জনসভায় বিরোধীদের কটাক্ষ করে বলেছেন, এবার ৫৪৩টি আসনের মধ্যে তিনি ৪০০-এর বেশি পাবেন ৪০০-এর বেশি পেয়ে প্রথম যে কাজটি তিনি করবেন, তাও তিনি প্রকাশ্যে ঘোষণা করে দিয়েছেন

তার ঘোষণাটি হলো: কংগ্রেসের নেতৃত্বে বিরোধী জোট যদি সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায়, তাহলে সংবিধান সংশোধন করে মুসলিমদের জন্য শিক্ষা চাকরির ক্ষেত্রে সংরক্ষণ করে দেবে আর তিনি যদি ৪০০-এর বেশি পান, তাহলে সংবিধান সংশোধন করে মুসলিমদের শিক্ষা, চাকরিসহ একাধিক বিষয়ে কোনো সুবিধা দেবেন না তাকে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে পাল্টা বিবৃতি দিয়ে বিরোধী জোট বলছে, মোদি ৪০০ পার তো দূরের কথা, ২০০ আসনও পাবেন না এদিকে গোটা বিশ্ব থেকে শত শত সাংবাদিক ভারতে এসে গেছেন তারা শুধু দিল্লি নয়, গোটা ভারতবর্ষ চষে বেড়াচ্ছেন তারাও বিভিন্ন টিভি চ্যানেলে বলছেন, এই পরিস্থিতিতে মোদির পক্ষে ৪০০ আসন পাওয়া সহজ হবে না কেউ কেউ বলছেন, মোদির দলের পক্ষে ২০০টি আসন বের করাও কঠিন হয়ে দাঁড়াবে

শুধু তা- নয়, বিজেপি আরএসএসের একাধিক মহল থেকে বলা হচ্ছে, মোদি প্রধানমন্ত্রী হলেও কতদিন থাকবেন? বিজেপির সংগঠনে বলা আছে, ৭৫ বছর বয়স হয়ে গেলে কেউ সরকারি পদে থাকতে পারবেন না অনেকে উদাহরণ দিয়ে বলছেন, মোদি নিজেই পাঁচ বছর আগে এই আইনটি করেছিলেন সেই আইনের বলেই আরএসএস বাবরি মসজিদ ধ্বংসের নায়ক লালকৃষ্ণ আদভানি, মুরলি মনোহর যোশি এবং মোদি জমানার প্রথমবারের স্পিকার সুমিত্রা মহাজনকে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার জন্য টিকিট দেওয়া হয়নি

আগামী নভেম্বরে মোদির ৭৫ বছর পূর্ণ হবে তাহলে তিনি কি মাত্র ছয় মাসের জন্যই প্রধানমন্ত্রী হবেন? এই প্রশ্নে বিজেপির অন্দর মহলে তোলপাড় সৃষ্টি হয়েছে নির্বাচন বিশেষজ্ঞরা মোদির বক্তব্য শুনে নানা রকম কটাক্ষ শুরু করে দিয়েছেন গত সোমবার দিল্লির একটি ইংরেজি চ্যানেলে সাক্ষাৎকার দিতে গিয়ে মোদি এক উদ্ভট মন্তব্য করেছেন তিনি বলেছেন, ভারতের সংবিধান তার পরিবারের জন্য রচনা করেছিলেন জওহরলাল নেহরু সংবিধান তৈরি করার সময় (১৯৪৭-৫০) জনসঙ্ঘ বা বিজেপির জন্ম হয়নি হিন্দু মহাসভার প্রতিনিধি হিসেবে শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জি গণপরিষদে ছিলেন তিনি নেহরু মন্ত্রিসভার মন্ত্রীও ছিলেন

ভারতের ইতিহাসকে মোদি গত কয়েক মাসে নানাভাবে বিকৃত করছেন গত সোমবার রাতেই একটি ইংরেজি চ্যানেলে আলোচনায় অংশ নিয়ে ভোট বিশেষজ্ঞ যোগেন্দ্র যাদব ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেছেন, বিজেপি-আরএসএস ভারতের ইতিহাস জানে না যদি একটু পড়াশোনা করতেন, তাহলেই জানতে পারতেন ভারতের সংবিধান কীভাবে তৈরি হয়েছিল

সেখানে সব দলের প্রতিনিধি ছিলেন বাবা সাহেব আম্মেদকর, শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জিসহ একাধিক নেতা সংবিধান প্যানেলে ছিলেন একা নেহরু সংবিধান কী করে রচনা করতে পারেন আমার মনে আছে নয়ের দশকে জার্মানির নির্বাচন কভার করতে গিয়েছিলাম যোগেন্দ্র যাদবের সঙ্গে সেখানে আমার পরিচয় হয় সেই থেকে আমাদের মধ্যে যোগাযোগ যোগেন্দ্র যাদব নির্বাচনের ১৫ দিন আগে আমাকে বলেছিলেন প্রধানমন্ত্রী চ্যান্সেলর হয়ে আসবেন কোল তাই হয়েছিল তার সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছেন, বর্তমানে ভারতে মোদি-বিরোধী হাওয়া চলছে মোদি ২০১৪ এবং ২০১৯- যেসব প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, তার একটাও পালন করেননি তিনি সব বুঝতে পেরেই হিন্দু-মুসলমান মেরূকরণে জোর দিয়েছেন শুধু তা- নয়, তার সহযোগী স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ প্রতিদিন বুলি আওড়ে যাচ্ছেন, নির্বাচনের পর অধিকৃত কাশ্মীর ভারত নিয়ে নেবে কিন্তু কীভাবে নেবে তা তিনি বলছেন না যোগেন্দ্র যাদবের প্রশ্ন, তাহলে কি তিনি যুদ্ধ করবেন?

বিজেপি-আরএসএস এখন দিশেহারা হয়ে পড়েছে তাদের মূল বক্তব্যই হলো, সংখ্যালঘু মুসলমানদের যাতে দেশ থেকে উৎখাত করা যায় গত চার দফা নির্বাচনে ভোটদানের যে হিসাব পেশ করা হয়েছে, তাতে কিছুটা জল মেশানো আছে বলে নির্বাচন কমিশনারকে চিঠি দিয়ে অভিযোগ করেছেন কংগ্রেস সভাপতি মল্লিকার্জুন খাড়গে

কমিশন তার কোনো সদুত্তর না দিয়ে পাল্টা অভিযোগ করে বলেছে, খাড়গের আগ্রাসী মন্তব্য নির্বাচন-প্রক্রিয়ার ওপর প্রভাব ফেলেছে কমিশনের স্বচ্ছতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে কংগ্রেস যে ভাষায় নির্বাচন কমিশন খাড়গের সমালোচনা করেছে, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে রাজনৈতিক মহলে

প্রথম দফার ভোটের ১১ দিন দ্বিতীয় দফার ভোটের দিন পর ওই দুটি পর্বে চূড়ান্ত ভোটদানের হার প্রকাশ্যে আনে কমিশন দুটি পর্বেই দেখা যায়, প্রাথমিকের পর চূড়ান্ত পরিসংখ্যানে প্রায় শতাংশ ভোট বেড়েছে এত বেশিসংখ্যক ভোট পড়া নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেন বিরোধীরা

খাড়গের প্রশ্নের জবাব না দিয়ে নির্বাচন কমিশন এক্স হ্যান্ডলে জানায়, নির্বাচন চলাকালীন আপনি যে ধরনের অভিযোগ তুলছেন তা অবাঞ্ছিত এবং দেখে মনে হয় সুষ্ঠু অবাধ নির্বাচন সম্পর্কে ভোটারদের মনে সংশয় তৈরি করতেই ওই কথা বলা হয়েছে কমিশন মনে করছে, খাড়গের ধরনের মন্তব্য ভোটারদের মনে নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে

অন্যদিকে প্রধানমন্ত্রী জনসভা থেকেমুসলিমশব্দটি বারবার বললেও অন্যদের তা বলতে বাধা দেওয়া হচ্ছে অভিযোগ করেছেন ফরওয়ার্ড ব্লকের ডি দেবরাজন দূরদর্শন আকাশবাণীর প্রচারে তিনি তার লিখিত বক্তব্যে জানিয়েছিলেন, সংশোধিত নাগরিকত্ব আইন মুসলিমদের জন্য বৈষম্যমূলক সরকারি গণমাধ্যমগুলো থেকে তাদের বলা হয়, বিবৃতিতেমুসলিমশব্দটি রাখা যাবে না

২০০৪ সালে অটল বিহারি বাজপেয়ি যে হেরে যাবেন, তা কেউ কল্পনা করতে পারেননি তার আগের পাঁচ বছরে অটলজি সবাইকে নিয়েই দেশ শাসন করেছিলেন ২০০৪ সালে কংগ্রেস সভানেত্রী সোনিয়া গান্ধী বাজপেয়িকে হারিয়ে দেন তারপর দুবার কংগ্রেস দেশ শাসন করে প্রসঙ্গত স্মরণ করা যেতে পারে, গুজরাট দাঙ্গার সময় এই বাজপেয়িই বলেছিলেন, মোদি রাজধর্ম পালন করছেন না অর্থনীতিবিদ থেকে শুরু করে অধ্যাপক মহল সবাই বলছেন, এবারও একবার পালাবদল হতে চলেছে

লেখক: ভারতের সিনিয়র সাংবাদিক

তাপপ্রবাহের তীব্রতা ও আগামীর বাংলাদেশ

প্রকাশ: ২০ মে ২০২৪, ১১:৩৩ এএম
তাপপ্রবাহের তীব্রতা ও আগামীর বাংলাদেশ
ড. এম এ ফারুখ

বাংলাদেশ পৃথিবীর অষ্টম জনবহুল দেশ এবং গ্লোবাল ক্লাইমেট রিস্ক ইনডেক্স ২০২১ অনুযায়ী পৃথিবীতে সপ্তম দুর্যোগপূর্ণ দেশ। বজ্রঝড়, বন্যা, সাইক্লোন, খরার মতো তাপপ্রবাহও আমাদের দেশের জন্য দৈবাৎ কোনো ঘটনা নয়। বাংলাদেশে প্রায় প্রতিবছরই এপ্রিল মাসে গড়ে সাধারণত দুই থেকে তিনটি ‘মৃদু থেকে মাঝারি’ এবং এক থেকে দুটি ‘তীব্র থেকে অতি তীব্র’ তাপপ্রবাহ বয়ে যায়। বিশ্ব আবহাওয়া সংস্থার মতে, একটি জায়গার দৈনিক গড় তাপমাত্রা ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস বেড়ে গেলে এবং সেটি পরপর পাঁচ দিন চলমান থাকলে তাকে তাপপ্রবাহ বা ইংরেজিতে হিটওয়েভ বলা হয়।

এ বছরের এপ্রিলে বাংলাদেশে বিরাজমান তাপপ্রবাহের ব্যাপ্তিকাল, মাত্রা এবং প্রবাহমান এলাকার বিস্তৃতি বিগত ৭৬ বছরের ইতিহাসকে ছাড়িয়েছে। এবার এপ্রিলের শুরু থেকেই তাপপ্রবাহ শুরু হয় এবং টানা ২৬ দিন অব্যাহত থাকে, যেটি অতিমাত্রায় তীব্রতা পায় এপ্রিলের ১৯ তারিখ থেকে। গত এপ্রিল মাসে বাংলাদেশের গড় তাপমাত্রা প্রায় ২ ডিগ্রি সেলসিয়াস বৃদ্ধি পেয়েছে এবং ৩০ এপ্রিলের তাপমাত্রা ঢাকায় ৪০.৫ ডিগ্রি এবং যশোরে ৪৩.৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস হয়েছে। ঢাকাসহ বাংলাদেশের ৪৫টিরও বেশি জেলার ওপর দিয়ে তাপপ্রবাহ বয়ে গেছে এবং তীব্র গরমে সারা দেশেই জনজীবন বিপর্যস্ত হয়েছে। এ বছর তীব্র তাপপ্রবাহ অনুভূত হওয়ায় তিন থেকে চারটি হিট অ্যালার্ট বা তাপপ্রবাহের সতর্কবার্তা জারি করেছে আবহাওয়া অধিদপ্তর। তীব্র গরমের কারণে স্কুল-কলেজে ছুটি ঘোষণা করা হয়েছে এবং বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় অনলাইনে ক্লাস চালানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে। গরমে হিট স্ট্রোকসহ বিভিন্ন শারীরিক সমস্যা বেড়ে যাওয়ায় অন্তত ১২ জনের মৃত্যু হয়েছে। 

আবহাওয়াবিদদের ভাষায়, বাতাসের তাপমাত্রা ৩৬ থেকে ৩৮ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে হলে সেটিকে ‘মৃদু’, ৩৮ থেকে ৪০ ডিগ্রির মধ্যে হলে ‘মাঝারি’, ৪০ থেকে ৪২ ডিগ্রির মধ্যে হলে ‘তীব্র’ এবং তাপমাত্রা ৪২ ডিগ্রি সেলসিয়াসের বেশি হলে তাকে ‘অতি তীব্র’ তাপপ্রবাহ বলা হয়ে থাকে। এবার এপ্রিলে রাজশাহী ও পটুয়াখালীতে মৃদু; পাবনা, খুলনা, চুয়াডাঙ্গা, রাজশাহী ও রাঙামাটিতে মাঝারি; পাবনা, যশোর, চুয়াডাঙ্গা, খুলনা, কুষ্টিয়া ও পটুয়াখালীতে তীব্র এবং যশোর ও চুয়াডাঙ্গা জেলায় অতি তীব্র তাপপ্রবাহ দেখা গেছে। ১৮৫০ সাল থেকে রক্ষিত তাপমাত্রার রেকর্ডে দেখা যায়, ২০২৩ সাল ছিল পৃথিবীর উষ্ণতম বছর, যে বছর পৃথিবীর তাপমাত্রা পূর্ববর্তী শতাব্দীর গড় তাপমাত্রা ১৩.৯ ডিগ্রি থেকে ১.১৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস বৃদ্ধি পায়।

বিগত ৫৮ বছরের মধ্যে ২০২৩ সালে ঢাকায় সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ছিল ৪০.৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস এবং এই সালটিকে বাংলাদেশের উষ্ণতম বছর হিসেবে বর্ণনা করেছিলেন আবহাওয়াবিদরা। নিকট অতীতে ২০১৪ সালে বাংলাদেশের চুয়াডাঙ্গায় সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ৪৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস রেকর্ড করা হয়েছিল। ১৯৬০ ও ১৯৬৫ সালে ঢাকার তাপমাত্রা যথাক্রমে ৪২.৩ ও ৪২ ডিগ্রি সেলসিয়াস রেকর্ড করা হয়েছিল এবং বাংলাদেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ১৫ মে ১৯৭২ সালে রাজশাহীতে রেকর্ড করা হয়েছিল, যার মাত্রা ছিল ৪৫.১ ডিগ্রি সেলসিয়াস। বাংলাদেশে ২০২৩ সালে একটানা ১৬ দিন তাপপ্রবাহ রেকর্ড করা হয়েছিল, ২০১৯ সালেও ২৩ দিনের একটি তাপপ্রবাহ বিদ্যমান ছিল, ২০১০ সালে রাজশাহীতে মৃদু থেকে মাঝারি ও তীব্র তাপপ্রবাহ বিরতিসহযোগে সর্বোচ্চ ২০ দিন বিরাজমান ছিল। 

বাংলাদেশ গ্লোবাল কার্বনিকেশনের মাত্র ০.৬ শতাংশ নির্গমন করে। তদুপরি এ বছর এপ্রিলে দেশের প্রায় ৭০ শতাংশ জায়গায় তাপপ্রবাহের তীব্রতার প্রাথমিক কারণ হলো, ভূপৃষ্ঠ থেকে বায়ুমণ্ডলের বেশ কিছুটা ওপর পর্যন্ত গরম বাতাসের একটি স্তর তৈরি হওয়া, যাকে উষ্ণ বাতাসের একটি গম্বুজের সঙ্গে তুলনা করা যেতে পারে। এ ধরনের একটি গম্বুজ বা ডোম আকৃতির উষ্ণ বাতাসের স্তর ভূপৃষ্ঠ থেকে অপেক্ষাকৃত ওপরের স্তরের উচ্চ বায়ুমণ্ডলীয় চাপের দরুন আটকা পড়ে যায়। এই প্রকারের উষ্ণ বাতাসের স্তর অতিরিক্ত আর্দ্রতা ও তীব্র তাপমাত্রা সঞ্চয় করে কোনো বৃষ্টিপাত ছাড়াই একটি শক্তিশালী উচ্চচাপ ব্যবস্থা তৈরি করে, যা ওই এলাকার বায়ুমণ্ডলে গরম বাতাসকে আটকে রাখে। এ ধরনের তাপপ্রবাহগুলো আবার বিরাজমান এলাকার জলাধার, হ্রদ, নদী এবং গাছপালা দ্বারাও ব্যাপকভাবে প্রভাবিত হয়। সাধারণত গাছপালা, জলাধার এবং উন্মুক্ত মাটি থেকে সরবরাহকৃত বাষ্পীভূত পানির কণা, বহুতল ভবনের পৃষ্ঠতল থেকে বিকিরিত তাপ, অন্ধকার পৃষ্ঠ, ফুটপাত, ছায়াহীন রাস্তা, নর্দমা, এয়ার কন্ডিশনার এবং উপজাত হিসেবে উৎপাদিত তাপ কোনো এলাকায় তাপপ্রবাহের মাত্রা, বিস্তৃতি ও স্থায়িত্বে প্রভাব ফেলে। এ ছাড়া বনভূমির পরিমাণ কমে যাওয়া, বৃষ্টিপাতের মৌসুমগত পরিবর্তন, ভূ-গর্ভস্থ পানির স্তর নিচে নেমে যাওয়া এবং শিল্পায়ন ও নগরায়ণ বেড়ে যাওয়া ইত্যাদি বিষয়ও সার্বিকভাবে তাপমাত্রা বাড়াতে ভূমিকা রাখে। 

বাংলাদেশে সাধারণত এপ্রিল মাসে সূর্যরশ্মি মোটামুটি খাড়াভাবে পড়ে বিধায় খুলনা, যশোর, চুয়াডাঙ্গা, কুষ্টিয়া অঞ্চলের বিস্তৃর্ণ সমভূমিতে ভূপৃষ্ঠীয় তাপমাত্রা বাড়ে। এই অঞ্চলগুলোর পশ্চিমে বিশাল এলাকাজুড়ে অবস্থিত ভারতের পশ্চিমবঙ্গও সমভূমি হওয়ায় এই অঞ্চল থেকে প্রবাহিত বায়ুর সঙ্গে পরিবহন পদ্ধতিতে তাপ বাংলাদেশের অভ্যন্তরে প্রবেশ করে। ভারতের পশ্চিমবঙ্গ, বিহার, ঝাড়খন্ড প্রভৃতি প্রদেশের তাপমাত্রা বছরের এই সময়ে ৪২ থেকে ৪৮ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে ওঠানামা করে এবং গত বছর ভারতের এসব অঞ্চলের তাপমাত্রা সর্বোচ্চ ৫২ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত রেকর্ড করা হয়েছিল।

আবার শীতের অব্যবহিত পরই বঙ্গোপসাগর থেকে প্রচুর জলীয় বাষ্প বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলের দক্ষিণ-পশ্চিম এলাকা দিয়ে দেশের অভ্যন্তরে প্রবেশ করে। জলীয় বাষ্প গ্রিনহাউস গ্যাস হওয়ায় বাতাসের তাপ পুঞ্জীভূত হয়ে খুলনা, যশোর, চুয়াডাঙ্গা, কুষ্টিয়া, রাজশাহী অঞ্চলে বাতাসের তাপমাত্রা অন্যান্য এলাকার তুলনায় বাড়িয়ে দেয়। উপরন্তু শীতকালের গড় দৈর্ঘ্য কমে যাওয়া এবং বৃষ্টিপাতের মৌসুমগত তারতম্য বাংলাদেশের তাপমাত্রার ওপর বিরূপ প্রভাব ফেলছে। যদিও এ বছর শীত মৌসুমের ব্যাপ্তি সামান্য প্রলম্বিত হয়েছিল কিন্তু এপ্রিলের গড় বৃষ্টিপাত ১৩০ মিমি  থেকে ৮০ শতাংশ কমেছে, যেখানে ঢাকায় গড় বৃষ্টিপাতের ৯০ শতাংশ কমেছে এবং রংপুর ও রাজশাহী বিভাগে একেবারেই বৃষ্টি হয়নি।

এপ্রিলের ৭ তারিখে দেশের দক্ষিণাঞ্চলের পিরোজপুর, ঝালকাঠি, বাগেরহাটের বিভিন্ন স্থানে বজ্রঝড় হয়েছে এবং বজ্রপাতে বাগেরহাটে একজনের মৃত্যু হয়েছে। দক্ষিণ জনপদের মানুষের কাছে এ সময়ে এ ধরনের বজ্রঝড় বেশ অস্বাভাবিক। আবার চট্টগ্রামের পার্বত্য এলাকাগুলোয় ১ ও ২ মে প্রচণ্ড বজ্রঝড়ে প্রায় ১১ জনের মৃত্যু হয়েছে, যেটিও পূর্ববর্তী বছরগুলোতে সংঘটিত বজ্রঝড়ের ধরন থেকে সম্পূর্ণ ভিন্নতর। যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল ওশানিক অ্যান্ড অ্যাটমোস্ফেয়ারিক অ্যাডমিনিস্ট্রেশনের মডেলিং ডেটা বিশ্লেষণে এই ভিন্নতার কারণ হিসেবে ভারত থেকে বাংলাদেশের পশ্চিমাঞ্চল হয়ে আসা উষ্ণ বায়ুপ্রবাহকে দায়ী করা যায়, যা বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের পার্বত্য এলাকায় গিয়ে বজ্রমেঘ ও বজ্রঝড় তৈরি করে। এ সময়টায় বায়ুপ্রবাহ সাধারণত বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চল থেকে উত্তরের দিকে ধাবিত হয়ে থাকে। এ বছর এল-নিনো প্রভাবের কারণেও ভারত, পাকিস্তান, মায়ানমারসহ দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার অনেক দেশেই তাপপ্রবাহ দেখা গেছে।

এল-নিনো নিরক্ষীয় প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে সমুদ্রের পানির উষ্ণতা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে আশপাশের এলাকার বায়ুর উষ্ণায়নের অবস্থা নির্দেশ করে। অস্ট্রেলিয়া ব্যুরো-অব-মেটেরিওলজির ১৬ এপ্রিলের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০২৩ থেকে চলমান এল-নিনো ২০২৪-এর এপ্রিলের মধ্যবর্তী সময়ে এসে শেষ হয়েছে। এল-নিনোর সময় সাধারণত নিরক্ষীয় প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে সমুদ্রপৃষ্ঠের তাপমাত্রা স্বাভাবিকের চেয়ে বৃদ্ধি পায় এবং পূর্বাঞ্চলীয় বাতাসের গতিপ্রবাহ স্বাভাবিকের চেয়ে দুর্বল হয়ে পড়ে। এ বছর এল-নিনো প্রভাবের কারণে কম্বোডিয়া, ভিয়েতনাম, মায়ানমার এবং ভারতে এপ্রিলের শুরুতেই তাপমাত্রা ৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের বেশি হওয়ার পূর্বাভাস দেওয়া হয়েছিল। ফিলিপাইন ও দক্ষিণ সুদানে তীব্র তাপপ্রবাহের কারণে স্কুল বন্ধ রাখা হয়েছিল। ভারতে এ বছরের এপ্রিল ছিল ১২২ বছরের মধ্যে সবচেয়ে বেশি উষ্ণ। ভারতীয় উপমহাদেশে শক্তিশালী এল-নিনোর ঘটনা দেখা গেছে ১৯৭২-৭৩, ১৯৮২-৮৩, ১৯৯৭-৯৮, ২০১৪-১৬ এবং ২০২৩-২৪ সালে। এই ঘটনাবলির ঠিক পরই ১৯৭৩, ১৯৮৪ ও ১৯৯৯ সালে প্রচণ্ড খরার কবলে পড়ে বাংলাদেশ। আবার ২০১৫ থেকে ২০১৭ পর্যন্ত সাইক্লোন কোমেন, রোয়ানু, মোরাসহ তিনটি বন্যা ও ভূমিধসের ঘটনা ঘটে।  

গত ১৫ এপ্রিল ভারতের আবহাওয়া অধিদপ্তর বলেছে, এবার স্বাভাবিকের চেয়ে বর্ষা মৌসুমে বেশি বৃষ্টি হতে পারে। বলা হয়েছে, এবার ভারতের তামিলনাড়ু, উত্তর প্রদেশ এবং পশ্চিমবঙ্গের বড় অংশে দীর্ঘদিনের স্বাভাবিক বৃষ্টির চেয়ে ১০৬ শতাংশ বেশি বৃষ্টি হতে পারে। ইউরোপিয়ান সেন্টার ফর মিডিয়াম রেঞ্জ ওয়েদার ফোরকাস্ট (ইসিএমডব্লিউএফ) এবং দ্য গ্লোবাল ফোরকাস্ট সিস্টেমের (জিএসএস) পূর্বাভাস থেকে জানা যায়, মে মাসেও বাংলাদেশে এপ্রিলের মতো তাপপ্রবাহ অব্যাহত থাকতে পারে। আসন্ন বর্ষা মৌসুমে এ ধরনের তাপপ্রবাহ থেকে উৎপাদিত ও আটকে থাকা জলীয় বাষ্প এবং তাপমাত্রা থেকে বিশালাকায় বজ্রমেঘসহ ঘন ঘন বজ্রঝড়ের প্রাদুর্ভাব বাড়বে। সেই সঙ্গে বাড়তে পারে মৌসুমি বৃষ্টিপাতসহ ভূমিধস, পাহাড়ধস ও বন্যার মতো দুর্যোগগুলো। 

আমেরিকান মেট্রোলোজিক্যাল সোসাইটির প্রকাশিত একটি নির্দেশিকায় ২০১৭ সালের একটি গবেষণার উদ্ধৃতি দিয়ে বলা হয়েছে, তীব্র তাপপ্রবাহের দিনগুলোতে মৃত্যু ২২ শতাংশ পর্যন্ত বেড়ে যেতে পারে। কাজেই আমাদের উচিত ভবিষ্যতের আরও তীব্র ও দীর্ঘমেয়াদি তাপপ্রবাহের প্রকোপ থেকে রক্ষার জন্য নিজেদের ভালোভাবে প্রস্তুত করা। বিস্তর আশঙ্কা ও উদ্বেগের মাঝে বসবাস করলেও এ কথা অনস্বীকার্য যে, ক্রমশ পৃথিবীর আবহাওয়া ও জলবায়ু বিরূপ হচ্ছে। পৃথিবীর উষ্ণতা, শুষ্কতা ও আর্দ্রতা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে প্রকৃতির অদ্ভুত আচরণও প্রবল আকারে দৃশ্যমান হচ্ছে। দীর্ঘমেয়াদি তাপপ্রবাহ, দাবানল, বজ্রঝড়, ঘূর্ণিঝড়, বন্যা এবং দীর্ঘস্থায়ী খরা বেশ ঘন ঘনই মানবসভ্যতাকে স্মরণ করিয়ে দিচ্ছে আগামী দিনের বিপদাপন্নতা। সুতরাং আমাদের এখনকার কার্যাবলি নির্ধারণ করবে আগামী দিনের জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবগুলোকে। পৃথিবীর উষ্ণতা বৃদ্ধির প্রক্রিয়াটিকে স্থবির করতে আমাদের নৈতিকতা, দায়িত্ববোধ, বিচক্ষণতা, সম্মিলিত প্রচেষ্টা এবং জীবনাচরণ ও দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন একান্ত কাম্য, যার মাধ্যমে আমরা পৃথিবীকে আরও কিছুদিন শীতল ও বাসযোগ্য রাখতে পারব। 

লেখক: অধ্যাপক ও সাবেক বিভাগীয় প্রধান, পরিবেশবিজ্ঞান বিভাগ, বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, ময়মনসিংহ
[email protected]

মেয়েরা আগে আগে ছেলেরা পিছে, তাতে হলোটা কী?

প্রকাশ: ১৯ মে ২০২৪, ১০:২৩ এএম
মেয়েরা আগে আগে ছেলেরা পিছে, তাতে হলোটা কী?
ড. তোফায়েল আহমেদ

প্রসঙ্গ মাধ্যমিক পরীক্ষার ফলাফল। প্রতিবছরই মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশের পর অনেক রকমের বিশ্লেষণ হয়। কিন্তু দুঃখের বিষয় হচ্ছে, এসব বিশ্লেষণ কোনো নীতিকাঠামোয় কার্যকরভাবে প্রতিফলিত হয় না। বিশ্লেষণগুলো বুদ্বুদের মতো বাতাসে মিলিয়ে যায়। কোন বছর বিশ্লেষণে কোন বিষয়টা প্রাধান্য পাবে তা আগে থেকে বলা যায় না। যেমন এ বছরের বিশ্লেষণে প্রাধান্য পাচ্ছে, মেয়েদের তুলনায় ছেলেরা পিছিয়ে পড়েছে। এখানে কেন এত মনোযোগ ও এত বিস্ময়! কারণ পুরুষশাসিত সমাজের মনস্তত্ত্ব হচ্ছে, ছেলেরাই সামনে থাকবে এবং মেয়েরা সব সময় ছেলেদের পেছনে থাকবে। ২০১৮ থেকে ২০২৪ সাল- সাত বছরের মাধ্যমিকের ফলাফলে দেখা যাচ্ছে, মেয়েরা প্রতিবছর পাসের হারে ছেলেদের চেয়ে ২-৩% এগিয়ে যাচ্ছে। এতে দেশের কোনো ক্ষতি হয়নি। ছেলে এবং মেয়ে একই ক্লাসে পড়েছে এবং একই সমাজের বাসিন্দা। ছেলে ও মেয়ে যারাই পাস করল, তারা এ দেশেরই ছেলে বা মেয়ে।

 এখানে আলোচনার বিষয় হতে পারে, যারা পাস করল তাদের সবাই কলেজে যাবে কি না। একটা বড় অংশ শিক্ষাব্যবস্থা থেকে ঝরে যাবে। গ্রামের মেয়েদের অনেকের বিয়ে হয়ে যাবে। অনেক গরিব ঘরের ছেলে বেকার থাকলেও কলেজে যাওয়ার সুযোগ পাবে না পরিবারের আর্থিক অসচ্ছলতার করণে। অনেকে ভর্তি হওয়ার মতো কলেজে স্থান পাবে না। সম্মিলিতভাবে ৮৩.০৪% মাধ্যমিক পরীক্ষায় সফল হলো, বাকিদের ভাগ্যে কী আছে? তাদের স্থান কোথায় হবে? শতকরা হারে ১৭ হলেও মোট সংখ্যা কয়েক লাখ। প্রতিবছরই এই একই ঘটনা ঘটছে, কিন্তু কোনো প্রতিকারমূলক পদক্ষেপের বিষয় আলোচিত হয় না। লাখ লাখ ছেলেমেয়ে এভাবে প্রতিবছর হারিয়ে যায়!

শুধু পাসের শতকরা হার শেষ কথা নয়। যারা ফেল করল, তারা কোন কোন বিয়য়ে ফেল করল। সাধারণভাবে ফেলের হার গণিত এবং ইংরেজিতেই বেশি। ওই সব ফেল করা শিক্ষার্থীর স্কুলগুলোতে গণিত এবং ইংরেজির শিক্ষক আছে কি না; ভালো ফল করা বিদ্যায়তনগুলোর ভৌগোলিক অবস্থান কোথায়- প্রায় সব ভালো ফলের  স্কুলগুলো শহরে। আবার শহরেরও সব স্কুল নয়, সারা দেশের বড়জোর ৫০০টা স্কুল গড়পড়তা ফলকে ইতিবাচকভাবে প্রভাবিত করে। মোট কথা, সারা দেশের গড়পড়তা ফলাফল শিক্ষার মান ও বৈষম্যকে আড়াল করে রাখে। 

এখানে শহর-গ্রামের শিক্ষার গুণমানে যে আকাশ-পাতাল ব্যবধান, তার আলোচনা মাঝেমধ্যে হলেও কার্যকর কোনো প্রতিকার হয় না। দেশের মাধ্যমিক শিক্ষার মূল কাঠামোতে বেসরকারি বিদ্যালয়ের প্রাধান্য। দেশের বেসরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের সমস্যা বিস্তর। এসব সমস্যার সমাধানের জন্য এখানে অধিকতর বিনিয়োগ প্রয়োজন। বিনিয়েগের কোনো বিকল্প নেই। বেসরকারি মাধ্যমিকে সরকারি বিনিয়োগ সবচেয়ে কম। শিক্ষাব্যবস্থার ভিত্তি যদি হয় প্রাথমিক শিক্ষা, মাধ্যমিক তার মেরুদণ্ড তথা দেহপিঞ্জরের মূল কাঠামো। কিন্তু মাধ্যমিক শিক্ষা এ দেশে সবচেয়ে অবহেলিত।

মেয়েদের ভালো ফলে সরকারের একটি সহায়তার ইতিবাচক প্রভাব রয়েছে। তা হচ্ছে উপবৃত্তি। মেয়েদের বেশি সংখ্যায় অংশগ্রহণ ও স্কুলে ধরে রাখতে উপবৃত্তির সহায়ক ভূমিকা রয়েছে। গ্রাম ও শহরের দরিদ্র পরিবারগুলোতে স্কুলগামী ছেলেমেয়েরা পড়াশোনার সঙ্গে সঙ্গে পরিবারের নানা কাজে প্রচুর সময় দিয়ে থাকে। তাদের অনেকে নিরবচ্ছিন্নভাবে পড়াশোনায় সময় দিতে পারে না। স্কুলগুলোতে শিক্ষকসংকট না থাকলে এসব শিক্ষার্থী বিশেষ মনোযোগ পেতে পারত। ধনী বা শহুরে মধ্যবিত্ত পরিবারে স্কুলপড়ুয়া ছেলেমেয়েরা শুধু পড়াশোনাই করে। আবার স্কুলের পাঠের অতিরিক্ত হিসেবে প্রাইভেট টিউটরের কাছেও পড়ার সুযোগ পায়। গ্রামের দরিদ্র পরিবারের শিক্ষার্থীদের সে সুযোগ নেই। ভবিষ্যতে দরিদ্র ছেলেদের জন্যও উপবৃত্তি দেওয়া যায় কি না, বিষয়টি ভেবে দেখতে অনুরোধ করি।

কয়েক বছর ধরে কারিকুলাম, প্রশ্ন প্রণয়ন পদ্ধতি ও মূল্যায়নব্যবস্থায় অনেক পরীক্ষা-নিরীক্ষা হয়েছে। এখনো হচ্ছে। গ্রামের অনুন্নত বিদ্যালয়গুলোর শিক্ষকদের অনেকে এসব পরিবর্তনের সঙ্গে সঠিকভাবে মানিয়ে নিতে পুরোপুরি সক্ষম হননি। বেসরকারি বিদ্যালয়ের নিয়োগ ও পরিচালনা প্রক্রিয়ায় নানা অযাচিত রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ ইত্যাদি তো রয়েছেই। মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিকে বিজ্ঞান শিক্ষা বিষয়ে বলতে হয়, বিজ্ঞান শিক্ষার সক্ষমতা বেশির ভাগ স্কুল ও কলেজে নেই। কোনো ব্যবহারিক ক্লাস ও পরীক্ষা সঠিকভাবে হয় না। ব্যবহারিকে ইচ্ছামতো নম্বর দেওয়া হয়। স্কুল-কলেজ থেকে বিজ্ঞান বিভাগে পাস করার পর বেশির ভাগ শিক্ষার্থী বিজ্ঞান আর পড়ে না। এভাবে এ দেশে বিজ্ঞান ও কারিগরি শিক্ষার প্রসার হচ্ছে না। স্কুল ও কলেজ পর্যায়ে ল্যাব সুবিধা এত অপ্রতুল, কল্পনাও করা যায় না। হালে অনেক প্রতিষ্ঠানে কম্পিউটার ল্যাব হয়েছে, কিন্তু চর্চা খুবই সীমিত।

মেয়েদের আগে যাওয়ার প্রসঙ্গে ফিরে আসি। মেয়েদের ‌‘আগে দেওয়া’র একটি পুরোনো গল্প দিয়ে আজকের লেখা শেষ করি। এক নৃতত্ত্ববিদ বার্মায় দীর্ঘদিন ধরে গবেষণা করেছেন। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ শেষ হওয়ার পর তিনি পুনরায় বার্মায় গিয়ে অভিভূত। সমাজে এক বৈপ্লবিক পরিবর্তন হয়ে গেছে। মাঠে-ঘাটে, শহরে-গ্রামে সর্বত্র মেয়েরা পুরুষদের বেশ তফাতে রেখে সামনে হাঁটে। পুরুষরা ত্রস্তপায়ে ধীরলয়ে বেশ তফাতে মেয়েদের পেছন পেছন হাটে। মেয়েদের এ উন্নতি ও সামনে আসার এ পরিবর্তনের কারণ অনুসন্ধানে নৃতত্ত্ববিদ যা দেখতে পেলেন তাতে তার আক্কেলগুড়ুম! জাপানিরা যুদ্ধের সময় বিভিন্ন স্থানে মাইন পুঁতে গেছে। তাদের কাছে মাইন অপসারণের কোনো প্রযুক্তি ও প্রশিক্ষণ নেই। শেষে দেশের পুরুষরা একটা কৌশল অবলম্বন করল। এখন থেকে কিছুদিন নারীরা পুরুষের সামনে থাকবে। নারীদের মাইন বিস্ফোরণের সম্ভাব্য বিপদের ঢাল হিসেবে পুরুষের সামনে হাঁটতে হবে। পুরুষরা আত্মরক্ষার জন্য এভাবে নারীদের এগিয়ে যেতে হবে। দেশপ্রেমিক নারীরা হাসিমুখে এ মহান দায়িত্ব কিছুদিন পালন করে যাবেন।

বাংলাদেশের মাধ্যমিক স্তরের মেয়েদের এগিয়ে যাওয়া সে রকম নয়। এটি তাদের সত্যিকারের অর্জন। এ অর্জনের জন্য আন্তরিক অভিনন্দন। এ অর্জন টেকসই এবং আরও উজ্জ্বল হোক।

লেখক: গবেষক ও স্থানীয় শাসন বিশেষজ্ঞ
[email protected] 

রাখাইনে আরাকান আর্মির নিয়ন্ত্রণ ও বাংলাদেশের প্রস্তুতি

প্রকাশ: ১৯ মে ২০২৪, ১০:২০ এএম
রাখাইনে আরাকান আর্মির নিয়ন্ত্রণ ও বাংলাদেশের প্রস্তুতি
ব্রিগেডিয়ার জে. হাসান মো. শামসুদ্দীন (অব.)

রাখাইন রাজ্যের ওপর তাদের পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার জন্য আরাকান আর্মি (এএ) মায়ানমার সেনাবাহিনীর সঙ্গে অপ্রতিরোধ্য গতিতে যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছে। এএ সিটওয়ে ও চকপিউ শহর ঘিরে ফেলেছে এবং সিটওয়ে ও চকপিউ বন্দরের কাছাকাছি চীনা অর্থায়নকৃত তেল ও গ্যাস টার্মিনালের খুব কাছের এলাকায় যুদ্ধ করছে। সমগ্র আরাকান পুনরুদ্ধার করাই এএর উদ্দেশ্য এবং সে উদ্দেশ্য বাস্তবায়নে তারা অপ্রতিরোধ্য গতিতে এগিয়ে চলছে। দক্ষিণ রাখাইনের আন ও থান্ডওয়ে টাউনশিপের পাশাপাশি বাংলাদেশ সীমান্তবর্তী উত্তর রাখাইন, বুথিডং ও মংডুতেও লড়াই তীব্র আকার ধারণ করেছে। মায়ানমারের রাখাইন রাজ্যের বাংলাদেশের সঙ্গে লাগোয়া ট্রাইজংশন থেকে শুরু করে মংডু-সংলগ্ন পুরো এলাকা বর্তমানে এএর নিয়ন্ত্রণে।

২০২২ সালের নভেম্বরে এএ জান্তার সঙ্গে একটি অনানুষ্ঠানিক যুদ্ধবিরতিতে রাজি হয়। ব্রাদারহুড অ্যালায়েন্স ২০২৩ সালের অক্টোবরে অপারেশন ১০২৭ নামে জান্তার ওপর সমন্বিত আক্রমণ শুরুর পর এএ চুক্তি লঙ্ঘন করে ১৩ নভেম্বর রাখাইন রাজ্যের রাথেডং, মংডু ও মিনবাইয়া শহরে পাঁচটি ঘাঁটিতে হামলা চালিয়ে মায়ানমার সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে অভিযান শুরু করে। রাখাইনে সেনাবাহিনীর ওপর এএর আক্রমণ অব্যাহত রয়েছে এবং দিন দিন এর তীব্রতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। ২৭ এপ্রিল অ্যানে ওয়েস্টার্ন রিজিওনাল কমান্ডের সদর দপ্তরের কাছের দুটি কৌশলগত অবস্থানে তাদের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করে। এএ অ্যানসহ আরও তিনটি শহরতলিতে আক্রমণ চালাচ্ছে। 

পরবর্তী সময়ে এএ ৩০ এপ্রিল রাখাইন রাজ্যের বুথিডং টাউনশিপে হামলা চালিয়ে তিনটি আউটপোস্ট দখল করে। বর্তমানে রাখাইন রাজ্যের ১৭টি শহরতলির মধ্যে ৮টি এবং পার্শ্ববর্তী রাজ্য চীনের পালেতোয়া শহর এখন এএর নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। জান্তা স্থলপথে শক্তি বৃদ্ধি করতে সেনা পাঠাতে বাধার সম্মুখীন হচ্ছে এবং এএ তাদের ওপর অতর্কিতে হামলা চালাচ্ছে। অ্যান টাউনশিপের গ্রামগুলোর কাছেও লড়াই তীব্র আকার ধারণ করেছে। চলমান সংঘর্ষের কারণে আশপাশের গ্রামের বাসিন্দারা বাড়িঘর ছেড়ে পালিয়েছে। মায়ানমার সেনাবাহিনী অ্যান পর্যন্ত রাস্তা ও নৌপথ অবরোধ করে বাণিজ্য বন্ধ করে দেওয়ায় খাদ্য ও ওষুধের সংকটের কারণে মানুষ ভোগান্তিতে দিন কাটাচ্ছে। 

রাখাইন রাজ্যে এএ ও সামরিক বাহিনীর মধ্যকার লড়াইয়ের তীব্রতার কারণে বিজিপি ও অন্যান্য নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যরা প্রাণভয়ে পালিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নিচ্ছেন। বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া বিজিপি, সেনাবাহিনী ও শুল্ক কর্মকর্তাসহ মায়ানমারের ৩৩০ নাগরিককে ১৫ ফেব্রুয়ারি ও পরে ২৮৮ জনকে ২৫ এপ্রিল বিজিপির কাছে হস্তান্তর করা হয়। এএর আক্রমণে বিজিপি সদস্যদের প্রাণভয়ে পালিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া অব্যাহত রয়েছে। 

২০১৭ সালে রাখাইন থেকে রোহিঙ্গা বিতাড়নের পর ২০১৮ সালের শেষের দিকে এএর সঙ্গে মায়ানমার সেনাবাহিনীর তীব্র সংঘর্ষ শুরু হয়। সে সময় আরাকানে ২ লাখ ৩০ হাজারের বেশি মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়েছিল। সংঘাতের সময় ইয়াঙ্গুন থেকে খাদ্যপণ্যের আমদানি বন্ধ হয়ে গেলে রাখাইনে মানবিক সমস্যাগুলো গুরুতর হয়ে ওঠে। রাখাইনে মানবিক সাহায্যের অনুমতি দেওয়া, এএর প্রশাসনিক কাজে এবং রাখাইনে বিচার-প্রক্রিয়ায় জান্তা বাহিনীর বাধা না দেওয়ার শর্তে ২০২০ সালের ২৬ নভেম্বর এএ জাপানের মায়ানমারবিষয়ক বিশেষ দূত সাসাকাওয়ার নেতৃত্বে মায়ানমার সেনাবাহিনীর সঙ্গে একটি অনানুষ্ঠানিক যুদ্ধবিরতিতে সম্মত হয়। 

২০২০ সালের নির্বাচনে এনএলডি রাখাইনে ইউনাইটেড লিগ অব আরাকানের (ইউএলএ) কাছে শোচনীয়ভাবে পরাজিত হয়। ক্ষমতায় থাকাকালীন সু চি সরকার এএকে সন্ত্রাসী সংগঠনের তালিকাভুক্ত করে রেখেছিল। ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারির সামরিক অভ্যুত্থানের পর রাখাইন রাজ্যে আপাত শান্তি বজায় ছিল। সে সময় দেশব্যাপী চলমান প্রতিরোধ আন্দোলন থেকে এএকে দূরে সরিয়ে রাখতে জান্তা সংগঠনটিকে কালো তালিকা থেকে বাদ দিয়ে তাদের সঙ্গে একটি অনানুষ্ঠানিক যুদ্ধবিরতির আয়োজন করে। 

এএ ও ইউএলএ এই সুযোগ কাজে লাগিয়ে পুরোপুরি রাজনীতিতে মনোনিবেশ করে এবং রাখাইন রাজ্যে ব্যাপক গণসংযোগ চালায়। সে সময় রাখাইনের অনেক এলাকায় তাদের প্রশাসনিক নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করে ও তাদের রাজনৈতিক এবং বিচারিক নেটওয়ার্ক ছড়িয়ে দেয়। উত্তর এবং দক্ষিণ রাখাইনের মধ্যে যুগ যুগ ধরে বিদ্যমান দূরত্ব কমিয়ে আনে এবং ধীরে ধীরে তারা রাখাইনবাসীর একমাত্র আস্থার প্রতীক হয়ে ওঠে। এএ রাখাইনে একটি শাসনব্যবস্থা বাস্তবায়নের জন্যপ্রশাসন, বিচার বিভাগ এবং জননিরাপত্তা নিশ্চিতে শক্তিশালী প্রতিষ্ঠান তৈরির লক্ষ্যে কাজ করছে। জান্তা বিষয়টি ভালোভাবে গ্রহণ না করায় ২০২২ সালের আগস্ট এএ ও মায়ানমার সেনাবাহিনীর মধ্যে আবার তীব্র লড়াই শুরু হয়। ২০২২ সালের নভেম্বরে পুনরায় অনানুষ্ঠানিক যুদ্ধবিরতিতে উভয় পক্ষ সম্মত হয়। 

এএ মায়ানমারের জাতিগত সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোর মধ্যে সবচেয়ে নতুন হওয়া সত্ত্বেও দেশের সবচেয়ে শক্তিশালী এবং সফল সংগঠনগুলোর একটিতে পরিণত হয়েছে। এএর ক্যারিশম্যাটিক নেতৃত্বের কারণে উত্তর ও দক্ষিণ রাখাইনে তাদের প্রভাব ও সুসংগঠিত নেটওয়ার্ক তৈরি হয়। রাখাইনে এর আগে কোনো সশস্ত্র গোষ্ঠীর এভাবে সুসংগঠিত নেতৃত্বের নিয়ন্ত্রণে ছিল না। এএ প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর গত ১৫ বছরে উল্লেখযোগ্য অর্জনের মাধ্যমে তাদের লক্ষ্যের কাছাকাছি যাওয়ার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। এএর সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার জননিরাপত্তা।

বিমান হামলা এবং ল্যান্ডমাইন থেকে নিজেদের রক্ষার বিষয়ে তারা বাসিন্দাদের ক্রমাগত সচেতন করছে। তারা ল্যান্ডমাইন পরিষ্কার করা, খাদ্য, ওষুধ, কৃষি খাতে সহায়তা ও স্বাস্থ্যসেবা প্রদান করছে। এএ বাংলাদেশ-মায়ানমার সীমান্ত এলাকার নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার পর নাফ নদীসহ এই সীমান্তে পাচার রোধে কাজ করে যাচ্ছে। তবে তা পুরোপুরি বন্ধ করতে তারা বাংলাদেশ সরকারের সহযোগিতা চায়। সম্প্রতি এএর মুখপাত্র থেকে জানা যায় যে, তারা ধর্ম-বর্ণনির্বিশেষে ভবিষ্যতে আরাকানের সব নাগরিকের দায়িত্ব নিতে প্রস্তুত। তারা আরাকানের সব নাগরিকের জন্য কাজ করছে এবং নিজেদের লক্ষ্য পূরণ না হওয়া পর্যন্ত এএ লড়াই চালিয়ে যাবে। 

এএ পূর্ণ আত্মনিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে মায়ানমারের রাষ্ট্রকাঠামোর অধীনে ভবিষ্যতে আরাকান রাজ্য গড়ে তুলতে চায়। এএর মূল শক্তি হলো রাখাইনবাসীর সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি, ধর্মীয় সহনশীলতা ও শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের অঙ্গীকার। এএ-নিয়ন্ত্রিত এলাকাগুলোয় রোহিঙ্গাদের সঙ্গে তাদের একধরনের স্বস্তিমূলক সম্পর্ক গড়ে উঠেছে বলে জানা যায়। কিছু কিছু প্রশাসনিক কাজেও রোহিঙ্গাদের নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। অদূর ভবিষ্যতে রাখাইনে ওদের প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার মতো আর কেউ থাকবে না। এএ রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবর্তন এবং আরাকানে নাগরিক মর্যাদাসহ তাদের বসবাসের বিষয়ে মায়ানমার জান্তা সরকারের চেয়ে অনেক নমনীয়। 

অতীতে সেনা-সরকার ও এনএলডি রোহিঙ্গাদের প্রতি বিদ্বেষমূলক আচরণ দেখালেও এএ রোহিঙ্গাদের সঙ্গে নিয়েই এগোতে চায়। এএ রাখাইনে নিজস্ব প্রশাসন, বিচার বিভাগ ও অন্যান্য অবকাঠামো তৈরির জন্য কাজ করে যাচ্ছে। রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন টেকসই ও নিরাপদ করতে হলে এবং রাখাইনে যেকোনো ধরনের কার্যক্রম পরিচালনায় তাদের সম্পৃক্ত করতেই হবে। বাংলাদেশ প্রান্তে রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোর শান্তিশৃঙ্খলা নিশ্চিত করতে হবে। রোহিঙ্গাদের মায়ানমারে ফিরে যাওয়ার বিষয়ে মানসিকভাবে প্রস্তুত রাখার পাশাপাশি তাদের স্বাবলম্বী বানাতে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সহায়তায় প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে। 

রাখাইনে চলমান সংঘাত একটা দীর্ঘমেয়াদি সংকটের জন্ম দিতে পারে। জান্তা রাখাইনে ‘ফোর কাট স্ট্র্যাটেজি’ ব্যবহার করে সংঘাতপূর্ণ এলাকায় খাদ্য, চিকিৎসাব্যবস্থা, যোগাযোগ বিছিন্ন করে এএকে জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। চলমান সংঘাতে রাখাইনের সাধারণ মানুষ চরম দৈন্যদশায় রয়েছে এবং রাখাইন রাজ্যের বিভিন্ন এলাকায় প্রায় দুর্ভিক্ষের অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। রাজ্যের স্বাভাবিক জীবনযাত্রা এবং উন্নয়ন কার্যক্রম ব্যাহত ও ধীর হয়ে পড়ছে। যুদ্ধ আরও তীব্র হলে মায়ানমার থেকে বাস্তুচ্যুত জনগণের বাংলাদেশের সীমান্তের দিকে পালিয়ে আসার সম্ভাবনা রয়েছে। বাংলাদেশ আর কোনো মায়ানমারের নাগরিককে প্রবেশ করতে দেবে না বলে জানিয়েছে। তাই বিকল্প হিসেবে থাইল্যান্ড-মায়ানমার সীমান্তবর্তী অঞ্চলে যে ধরনের মানবিক করিডরের পরিকল্পনা করা হয়েছে, রাখাইনে জাতিসংঘ ও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সহায়তায় সে ধরনের করিডর তৈরির পরিকল্পনা করা যেতে পারে।

অদূর ভবিষ্যতে রাখাইনের পরিস্থিতি স্থিতিশীল হওয়ার সম্ভাবনা খুব ক্ষীণ। রাখাইন রাজ্যটি ভূ-কৌশলগত কারণে গুরুত্বপূর্ণ বিধায় এখানে আঞ্চলিক দেশ ও অন্য স্টেকহোল্ডারদের অর্থনৈতিক, বাণিজ্যিক ও অন্যান্য স্বার্থ রয়েছে। মায়ানমার সেনাবাহিনী এই গুরুত্বপূর্ণ রাজ্যটি সহজে হাতছাড়া করবে না। রাখাইনের দখল নিয়ে এএ ও মায়ানমার সেনাবাহিনীর মধ্যে আক্রমণ ও পাল্টা আক্রমণ চলতে থাকবে এবং পরিস্থিতি আরও অস্থিতিশীল হয়ে উঠবে। বাংলাদেশকে সামনের দিনগুলোতে মায়ানমার সরকার, এএর সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়ন, সীমান্ত নিরাপত্তা এবং চলমান রোহিঙ্গা সংকটের সমাধানে কূটনৈতিক ও নিরাপত্তা চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে। 

লেখক: মায়ানমার ও রোহিঙ্গাবিষয়ক গবেষক 

পরিবেশগত যুদ্ধাপরাধের বিচার চাওয়ার সময় এসেছে

প্রকাশ: ১৮ মে ২০২৪, ১১:১০ এএম
পরিবেশগত যুদ্ধাপরাধের বিচার চাওয়ার সময় এসেছে
মেরি রবিনসন ও মার্গট ওয়ালস্ট্রোম

যুদ্ধ সব সময় ব্যক্তি, সম্প্রদায় এবং জাতির জন্য ভয়াবহ। যুদ্ধের ফলে মানুষের জীবন যে কতভাবে বিপর্যয়ের শিকার হয়, বিশ্বে তা প্রতিনিয়ত দেখা যাচ্ছে। অবিলম্বে এ বিষয়ে মনোযোগ, সমবেদনা এবং পদক্ষেপের দাবি রাখে। যদিও কিছু লঙ্ঘন স্পষ্ট, কিন্তু সেগুলো তদন্ত করা ও আশ্রয় দেওয়ার যেসব প্রতিষ্ঠান রয়েছে, সেগুলো ততটা স্পষ্ট নয়। তার মধ্যে অন্যতম উদাহরণ হলো পরিবেশগত যুদ্ধাপরাধ।

আমরা ইতোমধ্যে বায়ু, জল এবং প্রাকৃতিক পরিবেশের ওপর যুদ্ধের প্রভাবের সম্পূর্ণ পরিমাণ বুঝতে শুরু করেছি। মাটি ও কৃষি, শক্তি ও জল অবকাঠামো এবং শেষ পর্যন্ত জনস্বাস্থ্য এবং নিরাপত্তার ওপর যুদ্ধের প্রভাব চরম আকারে পড়েছে। চ্যালেঞ্জ হলো, এর অনেক কিছুই সহজে দেখা যায় না এবং এসব বিষয়ে কখনো গবেষণা করা হয়নি। যুদ্ধের ভয়াবহতা আমরা যা দেখি তা নামেমাত্র দৃশ্যমান। যুদ্ধকবলিতদের সংখ্যা কল্পনার চেয়ে অনেক বেশি হতে পারে।

যেখানে ভেঙে পড়া ভবন রয়েছে, সেখানে প্রাণঘাতী অ্যাসবেস্টস এবং সিলিকা ধুলো বাতাসে ছড়িয়ে পড়তে পারে। যেখানে ল্যান্ডমাইন এবং অবিস্ফোরিত বোমা, ভারী ধাতু এবং অন্যান্য শক্তিশালী দূষণকারী পদার্থ ছড়িয়ে থাকতে পারে। এর মধ্যেই কিছু প্রজন্ম জীবন ধারণ করে চলছে। যেখানে হ্রদ ও কষিজমি বিষাক্ত হয়ে ওঠে, সেখানে খাদ্যনিরাপত্তা ক্ষতিগ্রস্ত হয়।

আজকের আন্তর্জাতিক আইনে ইতোমধ্যেই এমন যুদ্ধাপরাধের বিচারের আওতায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে, যা পরিবেশের ব্যাপক ক্ষতি করে। তবে এ ধরনের অপরাধের বিচার স্থানীয় বা আন্তর্জাতিক আদালতে বিরল ঘটে। এ ধরনের ক্ষতির জন্য ক্ষতিপূরণও অনেক কম। 

কিছু ইতিবাচক লক্ষণ আছে, এটি পরিবর্তন হতে পারে। জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদ ২০২২ সালে সশস্ত্র সংঘাতের ক্ষেত্রে পরিবেশ সুরক্ষার বিষয়ে একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রস্তাবে এই বিষয়টির প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিল। সেখানে উল্লেখ করা হয়েছিল, যুদ্ধে অন্যায়ভাবে যারা পরিবেশের ক্ষতি করবে, সম্পূর্ণ ক্ষতিপূরণ সেই সব  রাষ্ট্রকে দিতে হবে। মার্চের ১ তারিখে জাতিসংঘের পরিবেশ পরিষদ একটি সর্বসম্মত প্রস্তাব পাস করেছে, এতে সশস্ত্র সংঘাতে পরিবেশগত ক্ষতি সম্পর্কে আরও তথ্য সংগ্রহের আহ্বান জানানো হয়।

আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের প্রসিকিউটর করিম খান ঘোষণা করেছেন, তার কার্যালয় পরিবেশগত অপরাধের ওপর ব্যাপক নীতি প্রণয়ন করছে। এই অপরাধের জন্য জবাবদিহি করতে হবে। 

বাস্তব একটি চ্যালেঞ্জ হলো, পরিবেশের ক্ষতি পরিমাপ করা বিশেষ করে যখন সংঘর্ষ চলে। কিন্তু জনস্বাস্থ্য রক্ষা এবং ক্ষতি কমানোর জন্য জরুরি ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য এটি খুবই দরকার; যেমন নদী বা কৃষিজমিতে মারাত্মক দূষণ ছড়িয়ে পড়া বন্ধ করা। ক্ষয়ক্ষতির নথিভুক্ত করাও গুরুত্বপূর্ণ, যাতে সম্পূর্ণ ক্ষতিপূরণ প্রদান করা সম্ভব হয়। যদি যুদ্ধের অপব্যবহার বা বেআইনি কাজের কারণে হয়, তাহলে অপরাধীদের জবাবদিহি করা যাবে। 

ইউক্রেনে রাশিয়ার পূর্ণ মাত্রায় আগ্রাসন প্রাকৃতিক পরিবেশে ভয়াবহ প্রভাব ফেলেছে। ইউক্রেন চিত্তাকর্ষক জীববৈচিত্র্য ও প্রাকৃতিক সম্পদের একটি দেশ, কিন্তু যুদ্ধ অনেক এলাকা ধ্বংস করে দিয়েছে। মাটি এবং জলপথ রাসায়নিক মিশ্রণে দূষিত হয়েছে। অন্যদিকে কৃষিজমি, বন এবং সবুজ স্থানগুলো গোলাবর্ষণ, আগুন এবং বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এক বছর আগে কাখোভকা বাঁধ ধ্বংস, যা দখলদার রাশিয়ান বাহিনীর ইচ্ছাকৃত কাজ বলে মনে করা হয়। এর ফলে গ্রাম ও কৃষিজমি প্লাবিত হয় এবং কৃষ্ণ সাগরের সর্বত্র ব্যাপক পরিবেশদূষণ হয়।

ইউক্রেনের এক-তৃতীয়াংশ অঞ্চল ল্যান্ডমাইন বা অবিস্ফোরিত বোমায় দূষিত বলে সন্দেহ করা হচ্ছে, যা বিশ্বের অন্য যেকোনো দেশকে ছাড়িয়ে গেছে। আমরা ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কির সাহসী উদ্যোগে যোগ দিয়ে পরিবেশগত উদ্বেগগুলোকে বিশ্বের নজরে আনার প্রচেষ্টায় অংশগ্রহণ করেছি। 

প্রেসিডেন্ট ইউক্রেন যুদ্ধের পরিবেশগত পরিণতি নিয়ে উচ্চস্তরের কর্মশালা গ্রুপ তৈরি করেছেন। তার সদস্য হতে পেরে আমরা সন্তুষ্ট। তিনি যুদ্ধ শেষ হওয়ার জন্য একটি কাঠামো প্রস্তাব করেছেন; যেখানে শান্তি প্রতিষ্ঠার মূল উপাদান হিসেবে থাকবে পরিবেশগত সুরক্ষা।

প্রথমত, পরিবেশগত ক্ষয়ক্ষতি নথিভুক্ত করার জন্য আধুনিক প্রযুক্তিকে কাজে লাগাতে সুস্পষ্ট নির্দেশিকা প্রতিষ্ঠা করতে হবে। এ ধরনের মান প্রতিষ্ঠার জন্য আন্তর্জাতিক অংশীদারদের সঙ্গে কাজ করতে হবে। ইউক্রেন তার সব সংঘাতে পরিবেশগত ক্ষতির নথিভুক্ত করার নির্দেশনায় সাহায্য পাবে। 

দ্বিতীয়ত, এ তথ্য ও প্রমাণ হাতে নিয়ে আমাদের অবশ্যই অপরাধীকে জবাবদিহির আওতায় আনতে হবে। তাদের কাছ থেকে সম্পূর্ণ ক্ষতিপূরণ আদায় নিশ্চিত করতে হবে। জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক পর্যায়ে পরিবেশগত দূষণ কমানোর প্রচেষ্টা চলছে।

পরিবেশগত ন্যায়বিচারের জন্য একটি জাতীয় কৌশল তৈরি করেছে ইউক্রেনের প্রসিকিউটর জেনারেল। আন্তর্জাতিক পর্যায়ে সর্বজনীন ক্ষমতা প্রয়োগ করে আদালতে এই অপরাধগুলোর বিচারের জন্য আরও বেশি মনোযোগ দিতে হবে। 

পরিবেশগত ক্ষতি এবং প্রয়োজনীয় প্রতিকার বোঝার জন্য তদন্তকারী এবং প্রসিকিউটরদের শিকারকেন্দ্রিক পদ্ধতি অবলম্বন করা উচিত। ইউক্রেনের মানবাধিকার তদন্তে পরিবেশগত ক্ষতি এবং জনস্বাস্থ্যের ঝুঁকির দিকে বিশেষভাবে মনোযোগ দেওয়া উচিত।

পরিশেষে কর্মরত গ্রুপটি টেকসই পুনর্গঠনের গুরুত্বের দিকে বেশি জোর দিচ্ছে। জলবায়ু ও পরিবেশের বন্ধুত্বপূর্ণ উন্নয়ন কৌশলগুলোকে অন্তর্ভুক্তি করতে হবে। এই নীতিগুলো প্রয়োগ করার প্রচেষ্টা এখনই শুরু করতে হবে। কারণ ইউক্রেনের কিছু অংশে ইতোমধ্যেই পুনর্নির্মাণের কাজ চলছে।

ইউক্রেনে ন্যায়বিচার এবং সবুজায়ন পুনরুদ্ধার হলে বিশ্বজুড়ে সংঘাত এড়ানো যাবে এবং অন্যান্য দেশের উপকারে আসবে। দুই বছর আগে রাশিয়া যখন ইউক্রেনে তার পূর্ণমাত্রায় আগ্রাসন শুরু করেছিল, তখন ক্রেমলিন আন্তর্জাতিক আইনকে ঝুঁকির মধ্যে ফেলেছিল। রাশিয়ার কর্মকাণ্ড আন্তর্জাতিক আইন ও জাতিসংঘ সনদের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন। ভবিষ্যতের বৈশ্বিক পরিস্থিতি, আইনের স্পষ্ট লঙ্ঘনের জন্য ন্যায়বিচারের প্রত্যাশা, পরিবেশের ওপর ভয়ানক আক্রমণসহ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় কীভাবে এই আগ্রাসনের প্রতিবাদ করে তা নির্ধারণ করা দরকার।

আমরা সবাই জানি যে, পরিবেশগত হুমকি সীমান্তে থেমে থাকে না। ইউক্রেনে পারমাণবিক বিকিরণ বিপর্যয়ের ঝুঁকি রয়েছে। কারণ ইউরোপের বৃহত্তম জাপোরিঝঝিয়া পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র রাশিয়া দখল করে নিয়েছে। ফলে আঞ্চলিক হুমকির বড় উদ্বেগজনক অবস্থায় রয়েছে। আরেকটি হলো কৃষ্ণসাগরে যুদ্ধের প্রভাব, যেখানে পরিবেশগত ক্ষতি সামুদ্রিক জীববৈচিত্র্যের ওপর মারাত্মক প্রভাব ফেলছে। সমুদ্রজলের এই গুরুত্বপূর্ণ অংশের সীমান্তবর্তী সব দেশ এর মাধ্যমে ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। 

এখন বিশ্ব সংঘাতে পরিবেশগত অপরাধের মাত্রার প্রতি জনগণ জাগ্রত হচ্ছে। আমাদের অবশ্যই কাজ করতে হবে, যাতে জবাবদিহি অনুসরণ করা হয়। স্বতন্ত্র অপরাধ এবং অপরাধকারী রাষ্ট্রের পরিবেশগত ক্ষতির দায় বহন করতে হবে এবং উভয়ই তা মোকাবিলায় ক্ষতিপূরণ দিতে হবে। 

ইউক্রেনে বিচার হবে। ন্যায়বিচার সব ক্ষেত্রেই সমানভাবে প্রযোজ্য। যেখানে বলপ্রয়োগ আইনের সীমা অতিক্রম করে, সেখানেও সমানভাবে কার্যকর হবে। আসুন, আমরা একসঙ্গে কাজ করি। একটি সবুজ, ন্যায্য এবং শান্তিপূর্ণ ভবিষ্যৎ গড়ে তুলি। 

লেখক: মেরি রবিনসন, আয়ারল্যান্ডের সাবেক প্রেসিডেন্ট
দ্য এল্ডার্সের চেয়ার ও মানবাধিকারবিষয়ক জাতিসংঘের সাবেক হাইকমিশনার 
মার্গট ওয়ালস্ট্রোম, সুইডেনের সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী
আল-জাজিরা থেকে সংক্ষেপিত অনুবাদ: সানজিদ সকাল