ঢাকা ৯ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২, শুক্রবার, ২৩ মে ২০২৫
English

বিদায় নিচ্ছে ইবাদতের স্বর্ণমৌসুম

প্রকাশ: ০৮ এপ্রিল ২০২৪, ০৯:০০ এএম
বিদায় নিচ্ছে ইবাদতের স্বর্ণমৌসুম
প্রতীকী ছবি। ইন্টারনেট

বিদায় নেবে পবিত্র রমজানুল মোবারক। আল-বিদা ইয়া শাহরু রমাদান ধ্বনিতে বেজে উঠবে রমজান মাসের বিদায় ঘণ্টা। রমজান মাসের বিদায়লগ্নে মুমিন-মুসলমানের হৃদয়ে রক্তক্ষরণ ঘটে। ঢুকরে কেঁদে ওঠে মন। পবিত্র এ মাসের বিদায় ধ্বনিতে সবচেয়ে বেশি কষ্ট পায় একজন মুমিন। সবচেয়ে বেশি বেদনায় সিক্ত হয় রোজাদারের অন্তর। পবিত্র এ মাসের বিদায়বেলায় মুমিন-মুসলমানের মনে সবচেয়ে বেশি যে প্রশ্নটি দাগ কাটে সেটা হলো, ইবাদতের স্বর্ণমৌসুম চলে যাচ্ছে, কী অর্জন হলো আমার? পবিত্র এ মাসটির কতটুকু সময় আমল-ইবাদতে ব্যয় করতে সক্ষম হয়েছি আমি? অতীত জীবনের গুনাহকে ক্ষমা করাতে পেরেছি তো?

রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘দুর্ভাগা ওই ব্যক্তি এবং ধ্বংস হোক ওই মুসলমান, যে রমজানের রোজা পেল কিন্তু নিজের অতীত জীবনের গুনাহ-পাপ ক্ষমা করাতে সক্ষম হলো না।’(ইবনে হব্বিান, ৯০৭)

প্রিয় পাঠক, নীরবে একটু ভাবুন। রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর সতর্কবার্তাটিকে একটু গভীর মনোযোগ নিয়ে বারবার পড়ুন এবং চিন্তা করুন। পবিত্র এ মাসে কত দিন, কত রাত অতীত জীবনের গুনাহ মাফের জন্য আল্লাহ মহানের দরবারে হাত তুলেছি? কতক্ষণ রোনাজারি করেছি মোনাজাতে জায়নামাজে? যদি করে থাকি আলহামদুলিল্লাহ। যদি না করে থাকি, তা হলে এখনই সংকল্প করুন এবং কোমর বেঁধে রমজানের বাকি সময়টুকু কাজে লাগানোর জন্য নেমে পড়ুন। 

একবার ভাবুন, আজকের রোজাটি যদি হয় আপনার জীবনের শেষ রোজা, কাল কেয়ামতের ময়দানে বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড়ানোর মতো যথেষ্ট প্রস্তুতি আছে কি আপনার? আপনার আমার আশপাশে এমন অনেক মানুষই রয়েছেন গত রমজানে অথবা এই রমজানের শুরুতে এক প্লেটে ইফতার করেছি এবং একসঙ্গে তারাবির নামাজ আদায় করেছি কিন্তু আজ আর তিনি নেই। একবার ভাবুন প্লিজ! 

আগামীকাল আপনি আমি থাকব, আগামী রমজানে আবার রোজা পালন করব— এমন নিশ্চয়তা কি আছে আপনার আমার? না, নেই। এক সেকেন্ডের গ্যারান্টি নেই মানুষের জীবনের। সুতরাং আমল-ইবাদতের স্বর্ণমৌসুম রমজানের শেষবেলার প্রতিটি মুহূর্তকে কাজে লাগাতে ব্যস্ত হওয়া প্রকৃত মুমিন-মুসলমানের অবশ্য কর্তব্য। পবিত্র মাসের এই শেষলগ্নগুলোয় একটি মোনাজাত হোক আপনার আমার জীবনের সেরা পাথেয়। আসুন আমরা সবাই পবিত্র মাসের শেষ সময়গুলো অতীত জীবনের গুনাহ মাফের উত্তম সময় হিসেবে গ্রহণ করে রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর সুরে প্রার্থনা করি, ‘হে আল্লাহ, নিশ্চয়ই আপনি ক্ষমাশীল! আপনি ক্ষমা করে দিতে ভালোবাসেন। অতএব, আমাকেও ক্ষমা করুন।’ (তিরমিজি, ৫/৪১৬)

এ ছাড়া রমজানের বিদায়বেলায় আরও একটি সংকল্প হোক মুমিন-মুসলামানের সংকল্প। রমজান মাসেটিকে আমরা যেমন আমল-ইবাদতে, ভালো ও কল্যাণকর কাজে কাটিয়েছি—রমজানপরবর্তী গোটা বছরটাও যেভাবে কাটানোর সংকল্প করা উচিত। আমরা রমজান মাসে যেমন আল্লাহর বান্দা ছিলাম, বছরের অন্য সময়েও আমরা আল্লাহর বান্দা থাকব। তাই তখন যেমন গুনাহ পরিহারের ব্যাপারে বিশেষ গুরুত্ব দিতাম, নামাজের প্রতি খেয়াল রাখতাম, জামাতের সাথে নামাজ আদায়ের চেষ্টা করতাম—সে ধারাবাহিকতা সব সময় অব্যাহত রাখা উচিত।

আমাদের থেকে পবিত্র রমজান বিদায় নেওয়ার পর আমরা যেন ইবাদতে গাফিলতি না করি; বরং পবিত্র রমজানের ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে পারি—মহান আল্লাহতায়ালা আমাদেরকে সেই তাওফিক দান করুন। আমিন। 

লেখক: আলেম, গবেষক ও সাংবাদিক

হজ নিয়ে যা না জানলেই নয়

প্রকাশ: ২৩ মে ২০২৫, ০৮:৩০ এএম
হজ নিয়ে যা না জানলেই নয়
তারকার মাঝে কাবা শরিফের ছবি। সংগৃহীত

হজ দুনিয়ার বুকের ঐশী সফর। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের মতো বাংলাদেশ থেকেও পবিত্র হজ পালনের উদ্দেশ্যে যাচ্ছেন মুসলিম নর-নারীরা। বিদেশ সফরের অভিজ্ঞতা এবং হজ পালনের আমল ও বিধান সম্পর্কে যথার্থ জ্ঞান না থাকার কারণে পবিত্র এ সফরে ভুল হওয়ার সম্ভাবনা থেকে যায়। বাংলাভাষী হাজিদের জন্য হজ পালনের প্রয়োজনীয় বিধানাবলি তুলে ধরা হলো।

হজের গুরুত্ব ও ফজিলত
হজ ইসলাম ধর্মের পাঁচটি স্তম্ভের অন্যতম এবং বিশ্বের কোটি কোটি মুসলমানের জন্য এক পবিত্রতম ইবাদত। প্রতি বছর ধর্মপ্রাণ মুসলমানরা আল্লাহর ডাকে সাড়া দিয়ে মক্কা ও মদিনার পানে ছুটে যান। এই যাত্রা শুধু আল্লাহর একত্ববাদের স্বীকৃতি কিংবা অতীতের পাপের জন্য ক্ষমা প্রার্থনাই নয়, বরং এটি মুমিনের ঈমান ও আনুগত্যের এক দৃঢ় বহিঃপ্রকাশ। কোরআন ও হাদিসের আলোকে হজের গুরুত্ব ও ফজিলত অপরিসীম। 

হজ পালন করা প্রত্যেক সামর্থ্যবান মুসলমানের জন্য আল্লাহতায়ালার এক সুস্পষ্ট নির্দেশ। পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘আর আল্লাহর জন্য মক্কা-এলাকায় হজ আদায় করা তার জন্য বাধ্যতামূলক, আর আল্লাহর জন্য মানুষের ওপর হজ করা ফরজ, যাদের সেখানে যাওয়ার সামর্থ্য আছে।’ (সুরা ইমরান, ৯৭) এই আয়াত দ্ব্যর্থহীনভাবে প্রমাণ করে যে, শারীরিক ও আর্থিকভাবে সক্ষম প্রত্যেক মুসলিমের জন্য হজ পালন করা ফরজ বা অবশ্য কর্তব্য।

হজের মাধ্যমে বান্দা মহান আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন করে এবং অতীতের সব পাপ থেকে মুক্তি লাভ করার সুযোগ পায়। কোরআনে কারিমে বলা হয়েছে, ‘যে ব্যক্তি আল্লাহর জন্য হজ পালন করবে, সে যেন অসামাজিক কাজ এবং গুনাহ থেকে বিরত থাকে।’ (সুরা বাকারা, ১৯৭) শুধু তাই নয়, হজ এমন এক মহান ইবাদত, যা মুমিনের জীবনের সব গুনাহকে ধুয়ে-মুছে তাকে নিষ্পাপ করে তোলে।

ইসলামে হজের মর্যাদা অতুলনীয়। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি আল্লাহর জন্য হজ করবে এবং সেখানে কোনো অশ্লীলতা বা পাপ কাজ করবে না, সে তার জন্মের দিনটির মতো পবিত্র হয়ে ফিরে আসবে।’ (বুখারি, ১৫২১) 
এই হাদিস হজের তাৎপর্য ও ফজিলত সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা দেয় যে, এটি পাপ মোচনের ও আত্মশুদ্ধির এক বিশেষ সুযোগ।

হজের ইতিহাস 
হজ শুধু একটি ইবাদত নয়, এটি ইসলাম ধর্মের পঞ্চম স্তম্ভ এবং মুসলমানদের জীবনে এক তাৎপর্যপূর্ণ অধ্যায়। এই পবিত্র সফর বিশ্বজুড়ে মুসলিম উম্মাহকে এক কাতারে শামিল করে, যেখানে আল্লাহর প্রতি পরম আনুগত্য ও দাসত্বের সুর প্রতিধ্বনিত হয়। হজের ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট, এর গভীর তাৎপর্য এবং মানবজীবনে এর প্রভাব অনন্য। 

হজের ইতিহাস সুপ্রাচীন, যা ইসলামের আবির্ভাবের বহু আগে থেকেই এই অঞ্চলে একটি গুরুত্বপূর্ণ ধর্মীয় প্রথা হিসেবে প্রচলিত ছিল। প্রাক-ইসলামিক যুগে আরবের বিভিন্ন গোত্র পবিত্র কাবাঘরের প্রতি অগাধ ভক্তি প্রদর্শন করত। যদিও সেই সময় শিরক ও কুসংস্কারে পরিপূর্ণ ছিল তাদের আচার-অনুষ্ঠান। কালের বিবর্তনে হজের মূলনীতি থেকে সরে গিয়ে নানাবিধ কুপ্রথা সেখানে স্থান করে নিয়েছিল।

ইসলাম আগমনের আগে কাবাঘর বিভিন্ন আরব জাতির মিলনকেন্দ্র হলেও, সেখানে পৌত্তলিকতা ও নানা অপকর্ম বিস্তার লাভ করেছিল। অশ্লীলতা, পাপাচার ও নৈতিক অবক্ষয় ছিল সেই সময়ের হজের অবিচ্ছেদ্য অংশ। ইসলামের আগে হজের অনেক নিয়ম পরিবর্তিত হয়ে বিকৃত রূপ ধারণ করেছিল। যা মহান আল্লাহতায়ালার নির্দেশে ইসলামের পূর্ণাঙ্গ বিধিবিধানের মাধ্যমে সংশোধিত হয়।
ইসলামের আগমন হজের বিধানকে সুস্পষ্টভাবে কোরআন ও হাদিসের আলোকে প্রতিষ্ঠা করে। হজের মূল আনুষ্ঠানিকতা মূলত আল্লাহর নির্দেশে হজরত ইব্রাহীম (আ.) ও তার ছেলে হজরত ইসমাইল (আ.) কর্তৃক শুরু হয়েছিল। যখন ইব্রাহীম (আ.) আল্লাহর আদেশে কাবাঘরের পুনর্নির্মাণ করেন, তখনই আল্লাহ তাঁকে হজের বিধান দান করেন।

হজ না করার শাস্তি
যদি কোনো মুসলমান হজ করার মতো শারীরিক ও আর্থিক সক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও এই ফরজ ইবাদত পালনে অবহেলা করেন, তবে ইসলামি শরিয়তের দৃষ্টিতে তিনি গুনাহগার হবেন। কোরআন ও হাদিসে এ বিষয়ে সুস্পষ্ট নির্দেশনা রয়েছে।
কোরআনুল কারিমে আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘আর আল্লাহর জন্য মানুষের ওপর হজ করা ফরজ, যার সেখানে যাওয়ার সামর্থ্য আছে।’ (সুরা ইমরান, আয়াত: ৯৭) এই আয়াত স্পষ্টভাবে সামর্থ্যবানদের জন্য হজ ফরজ হওয়ার কথা উল্লেখ করে এবং যারা এই নির্দেশ অমান্য করে, তারা আল্লাহর অবাধ্য হিসেবে গণ্য হবে।
সহিহ মুসলিমের একটি হাদিসে উল্লেখ আছে, ‘যে ব্যক্তি ইবাদত করার জন্য সক্ষম অথচ হজ করেনি, তার যদি মৃত্যু হয়, তবে সে যেন ইসলাম ছাড়া অন্য কোনো অবস্থায় মারা গেল।’ (নাউজুবিল্লাহ)। এ হাদিসের মাধ্যমে বোঝা যায়, হজ পালনে সক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও তা ত্যাগ করা অত্যন্ত গর্হিত কাজ।
ইচ্ছাকৃতভাবে হজ না করলে আল্লাহর কাছে এর জবাবদিহি করতে হবে এবং কঠিন শাস্তি পেতে হবে । শুধু তাই নয়, হজ ফরজ হওয়ার পরও যারা তা দীর্ঘদিন ধরে এড়িয়ে চলেন, তারা আল্লাহর দয়া ও কৃপা থেকে বঞ্চিত হতে পারেন। ফরজ ইবাদত পালনে ইচ্ছাকৃত অবহেলা করা, আধ্যাত্মিক দিক থেকেও ক্ষতির কারণ হয়ে থাকে ।

হজ কত প্রকার ও কী কী?
ইসলামি শরিয়াহ অনুযায়ী, হজ প্রধানত তিন প্রকার। সেগুলো হলো—১. তামাত্তু। ২. কিরান। ৩. ইফরাদ।

তামাত্তু: তামাত্তু হজ হচ্ছে এমন একটি হজ, যেখানে একজন মুসলমান প্রথমে ওমরা পালন করে এবং পরে হজ পালন করেন একই বছর। এটি বিশেষভাবে ওই মুসলিমদের জন্য যারা মক্কা বা তার আশপাশে অবস্থান করছেন এবং যারা আলাদা আলাদা করে ওমরা ও হজ সম্পাদন করতে চান। তামাত্তু হজে ওমরা পালন করা হয় হজের আগে। হজ ও ওমরার মধ্যে ইহরাম খুলে দেওয়া হয় এবং পরে আবার নতুন করে ইহরাম বাঁধতে হয়। এ ধরনের হজ সাধারণত আলাদা আলাদা সময়ে পালিত হয়, তবে তা একই বছরেই করতে হয়। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘তামাত্তু হজ হলো সর্বোত্তম হজ।’ (মুসলিম, ১২১১)

কিরান: কিরান হজ হলো এমন হজ যেখানে একজন মুসলমান ওমরা ও হজ একত্রে করেন, কিন্তু তার মধ্যে ইহরাম খুলে দেওয়া হয় না। অর্থাৎ একজন মুসলমান ইহরাম বাঁধে এবং তা পুরো হজ ও ওমরা পালনকালীন অবস্থায় থাকে। কিরান হজে ওমরা এবং হজ একই সঙ্গে পালিত হয়, কিন্তু ইহরাম খুলে দেওয়ার সুযোগ থাকে না। ওমরা ও হজ একত্রে পালন করা হয়। হজের সময় ইহরাম খুলে দেওয়ার সুযোগ নেই। এটি তামাত্তু থেকে কঠিন হলেও, বেশির ভাগ মুসলমান কিরান হজ পছন্দ করেন। কারণ এটি একটি সম্মানজনক পদ্ধতি। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘কিরান হজ করলে ইহরাম একবারেই থাকতে হবে এবং ওমরার পরেই হজ পালিত হবে।’ (বুখারি)

ইফরাদ: ইফরাদ হজ হলো একমাত্র হজ পালন করা, যেখানে একজন মুসলমান কেবল হজ পালন করেন এবং ওমরা করার প্রয়োজন হয় না। এটি সাধারণত মক্কা থেকে দূরবর্তী অঞ্চলের মুসলমানদের জন্য যারা প্রথমবারের মতো হজে যান। এ হজে ওমরা পালনের প্রয়োজন নেই। শুধু হজ পালন করা হয়। এটি ওইসব মুসলমানদের জন্য সহজ, যারা হজের আগে ওমরা করতে ইচ্ছুক নন। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘হজ হলো একটাই, তবে এটি করার আগে যদি কোনো বাধা না থাকে, তবে তুমি ওমরা করতে পারো।’ (মুসলিম)

হজের ফরজ ও ওয়াজিব 
হজ ইসলামের পাঁচটি মূল স্তম্ভের একটি। হজ শুধু শারীরিক ইবাদত নয়; এটি আত্মিক পরিশুদ্ধি, ধৈর্য, কৃতজ্ঞতা এবং তাওহিদের পূর্ণ প্রকাশ। একজন মুসলমানের জীবনে একবার হজ ফরজ হয়, যদি সে আর্থিক ও শারীরিকভাবে সামর্থ্যবান হয়। কিন্তু অনেকেই জানেন না—হজ পালনের কিছু নির্দিষ্ট ফরজ ও ওয়াজিব কাজ আছে, যেগুলো সঠিকভাবে না করলে হজ শুদ্ধ হয় না।

ফরজ কাজ (৩টি): ‘ফরজ’ হলো এমন কাজ, যা ইচ্ছাকৃতভাবে পরিত্যাগ করলে হজ বাতিল হয়ে যায়। হজে তিনটি ফরজ রয়েছে। আর তা হলো, 
১. ইহরাম বাঁধা ও নিয়ত করা: হজ শুরু করার আগে ইহরাম বাঁধা ও হজের নিয়ত করা আবশ্যক। 
২. আরাফাতে অবস্থান (ওকুফে আরাফা): ৯ জিলহজ দিন আরাফার ময়দানে অবস্থান করা হজের মূল রোকন। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘হজ হলো আরাফা।’ (তিরমিজি, ৮৯১)। 
৩. বিদায়ি তাওয়াফ (তাওয়াফে বিদা): মক্কা ত্যাগ করার আগে কাবাঘর শেষবার তাওয়াফ করা ফরজ। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘সবার শেষ আমল হোক বাইতুল্লাহর তাওয়াফ, তবে হায়েজ (ঋতুমতী) নারীরা ব্যতীত।’ (মুসলিম, ১৩২৮)

ওয়াজিব কাজ (৬টি): ‘ওয়াজিব’ এমন কাজ, যা ইচ্ছাকৃতভাবে পরিত্যাগ করলে দম (কোরবানি) দিতে হয়, তবে হজ বাতিল হয় না। হজের ছয়টি ওয়াজিব কাজ রয়েছে। আর তা হলো, 
১. মুজদালিফায় অবস্থান: ৯ জিলহজ রাতে আরাফা থেকে ফেরার পর মুজদালিফায় অবস্থান করা ওয়াজিব। হাদিসে এসেছে, এক সাহাবি বলেছেন, ‘আমি দেখেছি রাসুলুল্লাহ মাগরিব ও এশার নামাজ একত্রে পড়ে রাত কাটিয়েছেন মুজদালিফায়।’ (বুখারি, ১৬৭৫)। 
২. জামারায় কঙ্কর নিক্ষেপ করা: ১০, ১১, ১২ (বা ১৩) জিলহজ শয়তানকে কঙ্কর নিক্ষেপ করা। ‘তোমরা আমার কাছ থেকে হজের কর্মপদ্ধতি শিখে নাও।’ (মুসলিম, ১২৯৭)। 
৩. কোরবানি করা: তামাত্তু ও কিরান হজ করলে কোরবানি ওয়াজিব। (সুরা বাকারা, ১৯৬)। 
৪. হালক বা কসর করা: পুরুষদের মাথা মুণ্ডানো বা চুল ছোট করা ও নারীদের হালকা কাটতে হয়। 
৫. সাঈ করা (সাফা-মারওয়া): তাওয়াফের পর সাফা ও মারওয়ার মধ্যে সাতবার দৌড়ানো। ‘নিশ্চয়ই সাফা ও মারওয়া আল্লাহর নিদর্শনগুলোর অন্তর্ভুক্ত।’ (সুরা বাকারা, ১৫৮)। 
৬. বিদায়ি তাওয়াফ করা: বিদায়ি তাওয়াফ শেষ করে মাকামে ইবরাহিমের কাছে দুই রাকাত নামাজ পড়াও ওয়াজিব।

 

লেখক: আলেম, গবেষক ও সাংবাদিক

কোরবানি কত প্রকার?

প্রকাশ: ২২ মে ২০২৫, ১০:০০ পিএম
কোরবানি কত প্রকার?
প্রতীকী ছবি। সংগৃহীত

ওয়াজিব কোরবানি মোট ৪ প্রকার। এছাড়া আরও এক প্রকার কোরবানি রয়েছে, সেটা হলো নফল কোরবানি।

ওয়াজিব ৪ প্রকারের কোরবানি হলো,

১. মানতের কোরবানি: কেউ যদি আল্লাহর নামে কোরবানি করার মানত করে, তাহলে সে কোরবানি আদায় করা ওয়াজিব। 

২. গরিবের কোরবানি: কোনো দরিদ্র বা গরিব ব্যক্তি যদি কোরবানির দিনগুলোতে কোরবানি করার জন্য পশু ক্রয় করে, তাহলে ক্রয়কৃত সে পশু কোরবানি করা ওয়াজিব।

৩. অসিয়তের কোরবানি: কেউ যদি মৃত্যুকালে তার পক্ষ থেকে কোরবানি আদায় করার জন্য ওয়ারিশদের অসিয়ত করে, তাহলে সে কোরবানি আদায় করা ওয়াজিব।

৪. নেসাব পরিমাণ সম্পদের মালিকের কোরবানি: জিলহজ মাসের ১০, ১১ ও ১২ তারিখে নেসাব পরিমাণ সম্পদের মালিকের ওপর কোরবানি করা ওয়াজিব। (বাদায়েউস সানায়ে, ৭/৩৯৩; ফতোয়ায়ে শামি, ৫/২৯১)

 

লেখক : আলেম ও সাংবাদিক

 

ইতিহাসে প্রথম কোরবানিদাতা কে?

প্রকাশ: ২২ মে ২০২৫, ০৬:০০ পিএম
ইতিহাসে প্রথম কোরবানিদাতা কে?
প্রতীকী ছবি। সংগৃহীত

আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেন, ‘আপনি তাদেরকে বর্ণনা করুন আদমের দুই পুত্রের অবস্থা। যখন তারা উভয়েই কিছু কোরবানি করেছিল, তখন তাদের একজনের কোরবানি গৃহীত ও অপরজনের কোরবানি অগৃহীত হয়েছিল। সে বলল, আমি অবশ্যই তোমাকে হত্যা করব। অপরজন বলল, আল্লাহ কেবল ধর্মভীরুদের কোরবানিই গ্রহণ করেন। (সুরা মায়েদা, ২৭)। 

এ আয়াত থেকে বোধগম্য হয়, কোনো এক ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে হজরত আদম (আ.) নিজ সন্তান হাবিল-কাবিলকে কোরবানি করতে আদেশ করেছিলেন। ইমাম কুরতুবি (রহ.) এ আয়াতের ব্যাখ্যায় ঘটনাটি এভাবে বর্ণনা করেন, যখন আদম এবং হাওয়া (আ.) পৃথিবীতে আগমন করেন, তখন তাদের মাধ্যমে সন্তানপ্রজনন ও বংশবিস্তারের ধারা আরম্ভ হয়। প্রজনন-পদ্ধতি ছিল, হজরত হাওয়া (আ.)-এর প্রতিটি গর্ভ থেকে একটি পুত্র ও একটি কন্যা সন্তান জন্মগ্রহণ করত। তখন একমাত্র আদম আ.-এর সন্তান ব্যতীত আর কোনো মানবসন্তান পৃথিবীতে ছিল না। তাই আল্লাহ তায়ালা বিয়ে-শাদীর ব্যবস্থাপনার সূচনা করতে আদম আ.-এর শরিয়তে বিশেষভাবে করবে, তারা পরস্পরে সহোদর ভাই-বোন হিসেবে গণ্য হবে। তাদের মধ্যে বৈবাহিক সম্পর্ক হারাম। তবে পরবর্তী গর্ভ থেকে জন্ম নেওয়া পুত্র প্রথম গর্ভ থেকে জন্ম নেওয়া কন্যার সহোদর হিসেবে গণ্য হবে না। 

তারা পরস্পরে বিবাহ-বন্ধনে আবদ্ধ হতে পারবে। কিন্তু ঘটনাচক্রে কাবিলের সহজাত সহোদর বোন ‘আকলিমা' ছিল পরমা সুন্দরী, আর হাবিলের সহজাত বোন 'লিজ' ছিল অতিশয় কুৎসিত। বিবাহের সময় এলে তাদের শরিয়ত-অনুসারে হাবিলের সহোদরা কুৎসিত বোন কাবিলের পাত্রী হিসেবে নির্বাচিত হয় । আর হাবিলের ভাগ্যে জুটে কাবিলের সুন্দরী বোন আকলিমা। কিন্তু কাবিল তা সন্তুষ্টচিত্তে না মেনে হাবিলের সাথে শত্রুতা শুরু করে। সে দাবি করে, আমার সহোদরা বোনকেই আমার সাথে বিয়ে দিতে হবে। আদম (আ.) তার এ দাবিকে প্রত্যাখান করেন। কিন্তু কাবিল তার দাবিতে রইল অনড় । তখন আদম আ. হাবিল-কাবিলের মতভেদ দূর করার লক্ষ্যে বললেন, তোমরা উভয়ে আল্লাহর নিকট নিজ নিজ কোরবানি পেশ করো। যার কোরবানি কবুল হবে সেই ‘আকলিমা'-কে বিয়ে করবে। এ নির্দেশ মেনে তারা উভয়ে কোরবানি করল। হাবিল ভেড়া, দুম্বা ইত্যাদি প্রতিপালন করত, তা থেকে একটি দুম্বা উৎসর্গ করার জন্য ইচ্ছেপোষণ করল। কাবিল কৃষি কাজ করত। 

এ হিসেবে সে কিছু শষ্য ও গম কোরবানির জন্য নির্ধারণ করল। সে সময়ে কোরবানি কবুল হওয়ার নিদর্শন হিসেবে আকাশ থেকে একটি অগ্নিশিখা এসে কোরবানির বস্তু জ্বালিয়ে দিতো। অর্থাৎ যার কোরবানিসামগ্রী জ্বলে যেত, তার কোরবানি কবুল হয়েছে বলে স্বীকৃতি পেত। এ নিয়মানুসারে আকাশ থেকে অগ্নিশিখা এসে হাবিলের কোরবানিটিকেই জ্বালিয়ে দিলো। আর কাবিলের কোরবানি যথাস্থানে পড়ে রইল। মোটকথা, এ আয়াতের সূত্র থেকে পরিলক্ষিত হয়, সর্বপ্রথম হজরত আদম (আ.) এর সন্তান হাবিল-কাবিলই কোরবানি করেছিল। (তাফসিরে কুরতুবি, ৬/১৩৪)

এখন প্রশ্ন হতে পারে, মুসলমানদের প্রচলিত কোরবানি আদম (আ.)-এর সুন্নাত নাকি ইবরাহিম (আ.)-এর? ইসলামধর্মে প্রচলিত কোরবানি ইবরাহিম (আ.)-এর সুন্নাত। কারণ রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, কোরবানি তোমাদের পিতা হজরত ইবরাহিম (আ.)-এর সুন্নত। (মিশকাত, ১/১২৯)

 

লেখক : আলেম, গবেষক ও সাংবাদিক

 

 

কার ওপর কোরবানি ওয়াজিব?

প্রকাশ: ২২ মে ২০২৫, ০৩:০০ পিএম
কার ওপর কোরবানি ওয়াজিব?
প্রকৃতি ও পশুর ছবি । সংগৃহীত

প্রাপ্তবয়স্ক, সুস্থমস্তিষ্ক সম্পন্ন প্রত্যেক এমন মুসলিম নর-নারী, যিনি বা যারা ১০ জিলহজ ফজর থেকে ১২ জিলহজ সূর্যাস্ত পর্যন্ত সময়ের মধ্যে প্রয়োজন-অতিরিক্ত নেসাব পরিমাণ সম্পদের মালিক হবেন বা থাকবেন; তার ওপর কোরবানি করা ওয়াজিব।

টাকা-পয়সা, সোনা-রূপা, অলঙ্কার, বর্তমানে বসবাস ও খোরাকির প্রয়োজন আসে না এমন জমি, প্রয়োজন অতিরিক্ত বাড়ি, ব্যবসায়িক পণ্য ও অপ্রয়োজনীয় সব আসবাবপত্র কোরবানির নেসাবের ক্ষেত্রে হিসাবযোগ্য। আর নিসাব হলো স্বর্ণের ক্ষেত্রে সাড়ে সাত (৭.৫) ভরি, রূপার ক্ষেত্রে সাড়ে বায়ান্ন (৫২.৫) ভরি। টাকা-পয়সা ও অন্যান্য বস্তুর ক্ষেত্রে নিসাব হলা, সাড়ে বায়ান্ন তোলা রূপার মূল্যের সমপরিমাণ হওয়া। (রদ্দুল মুহতার, ৬/৩১২)

কারো কাছে স্বর্ণ ও রৌপ্য দুই প্রকারের অলঙ্কার থাকলে উভয় প্রকারের অলঙ্কারের মূল্য হিসাব করার পর যদি রৌপ্যের নেসাবেরর বরাবর হয়, তাহলে তার ওপর কোরবানি ওয়াজিব। (ফতোয়ায়ে শামি, ৪/২৯১)

লেখক: আলেম ও সাংবাদিক

কোরবানির ফজিলত ও পালন না করার শাস্তি

প্রকাশ: ২২ মে ২০২৫, ১১:৪৯ এএম
আপডেট: ২২ মে ২০২৫, ১১:৫৬ এএম
কোরবানির ফজিলত ও পালন না করার শাস্তি
পশুর প্রতি মালিকের ভালোবাসার দৃশ্য। ছবি: সংগৃহীত

আল্লাহতায়ালা পবিত্র কোরআনে ইরশাদ করেছেন, (হে রাসুল!) আপনি বলুন, আমার নামায, আমার কোরবানি, আমার জীবন, আমার মরণ (অর্থাৎ আমার সবকিছু) আল্লাহ রাববুল আলামীনের জন্য উৎসর্গিত। (সুরা আনআম,১৬২)। আল্লাহতায়লা আরও ইরশাদ করেছেন, (মনে রেখো, কোরবানির জন্তুর) গোশত অথবা রক্ত আল্লাহর কাছে কখনোই  পৌঁছে না; বরং তাঁর কাছে কেবলমাত্র তোমাদের পরহেজগারিই পৌঁছে। (সুরা হজ, ৩৭)


উম্মুল মুমিনীন আয়েশা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেছেন, কোরবানির দিনের আমলসমূহের মধ্য থেকে পশু কোরবানি করার চেয়ে কোনো আমল আল্লাহতায়লার নিকট সবচেয়ে প্রিয় নয়। কিয়ামতের দিন এই কোরবানিকে তার শিং, পশম ও ক্ষুরসহ উপস্থিত করা হবে। আর কোরবানির রক্ত জমিনে পড়ার আগেই আল্লাহতায়লার নিকট কবুল হয়ে যায়। সুতরাং তোমরা সন্তুষ্টচিত্তে কোরবানি কর। (তিরমিজি, ১৪৯৩)


সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও যে ব্যক্তি এই ইবাদত পালন করে না তার ব্যাপারে রাসুলুল্লাহ (সা.) থেকে সতর্কবার্তা রয়েছে। আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেছেন, ‘যার কোরবানির সামর্থ্য আছে তবুও সে কোরবানি করল না সে যেন আমাদের ঈদগাহে না আসে।’ (মুসনাদে আহমদ ২/৩২১; মুস্তাদরাকে হাকেম, ৭৬৩৯)

 

লেখক: আলেম,গবেষক ও সাংবাদিক