ঢাকা ৯ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২, শুক্রবার, ২৩ মে ২০২৫
English

ধৈর্যশীলদের জন্য সুসংবাদ

প্রকাশ: ০৮ এপ্রিল ২০২৪, ০২:২২ পিএম
আপডেট: ০৮ এপ্রিল ২০২৪, ০২:২২ পিএম
ধৈর্যশীলদের জন্য সুসংবাদ
তাসবিহের ছবি। ইন্টারনেট
ধৈর্যধারণ করা রমজানের মহান শিক্ষা। আল্লাহ বলেন, ‘তোমাদেরকে ভয় ও ক্ষুধা এবং ধনসম্পদ, জীবন ও ফল-ফসলের ক্ষয়ক্ষতি (এসবের) কোনো কিছুর দ্বারা নিশ্চয়ই পরীক্ষা করব, ধৈর্যশীলদের সুসংবাদ প্রদান করো।’ (সুরা  বাকারা, আয়াত: ১৫৫)
 
ইসলাম প্রচারের শুরুর সময়ে শত্রুদের ব্যাপক অপপ্রচারণায় নব দীক্ষাপ্রাপ্ত সাহাবিদের মন বিষাক্ত করে  তোলা হচ্ছিল। মুসলমানদের এ সংকটকালে সুরা বাকারার  ১৫৩ আয়াতে ধৈর্য ও নামাজের মাধ্যমে প্রার্থনা করার নির্দেশ দিয়ে বলা হয়, ‘আল্লাহ ধৈর্যশীলদের সঙ্গে  আছেন।’ পরের আয়াতে বলা  হয়, ‘আর আল্লাহর পথে নিহতদের মৃত বলো না; বরং তারা জীবিত, কিন্তু তোমরা বুঝ না।’ ১৫৫ আয়াতে বিষয়টি আরও স্পষ্ট করে  ধৈর্যশীলদের জন্য শুভসংবাদ উল্লেখ করা হয়েছে। এর চেয়ে বড় শুভসংবাদ কী হতে পারে, আল্লাহ নিজে ধৈর্যশীলদের সঙ্গে আছেন। 
 
আরবি সবর শব্দের বহুমাত্রিক অর্থ ও তাৎপর্য রয়েছে। আল্লামা ইউসুফ আলির মতে, সবরের ব্যবহারিক অর্থ ধীরস্থিরতা অবলম্বন, অব্যাহত অধ্যবসায়, একাগ্রতা, একনিষ্ঠতা, হঠাৎ কিছু পাওয়ার প্রত্যাশা না করা, বিপদে-আপদে ধৈর্যধারণ করা। 
 
ধৈর্য মানবিক গুণাবলির মধ্যে শ্রেষ্ঠতর এবং এর মানসিক ও আত্মিক তাৎপর্য অপরিসীম। সবরের গুণ অর্জন স্বাভাবিকভাবেই  সহজ নয়। আর এ কারণে এটি অর্জনে আল্লাহর কাছে প্রার্থনার তাগিদ দেওয়া হয়েছে।’ (সুরা বাকারা, আয়াত: ২৫০)
 
ভয়, ক্ষুধা, ধনসম্পদ, ফল-ফসলের ক্ষয়ক্ষতি ও নানা দুর্ঘটনা উদ্ভূত বলে প্রতীয়মান হয়। সন্দেহ নেই এতে মারাত্মক অর্থনৈতিক বিপর্যয় ঘটে। দুর্ভিক্ষ, মহামারি, প্লাবন ইত্যাদি যখন গোটা সমাজের ওপর দুর্দশা ও বিপদ নিয়ে  আসে, তখন গোটা সমাজ তথা সমগ্র রাষ্ট্রব্যবস্থাকে তা ধৈর্যের সঙ্গেই মোকাবিলা করা উচিত। ধীরস্থিরভাবে যেকোনো বিপদ অতিক্রম করার লক্ষ্যে সার্বিক প্রচেষ্টা চালাতে হয়। এ পরিস্থিতিতে ব্যক্তি ও সমষ্টিকে ধৈর্য ও নামাজের শক্তি ও সাহায্য নিতে হয়, একই সঙ্গে ঈমানের ওপর দৃঢ় আস্থা রেখে ধৈর্যধারণে অবিচল থাকার জন্য পরস্পরকে সহযোগিতা করতে হয়। আল্লাহ বলেন, ‘মানুষ অবশ্যই ক্ষতির মধ্যে (ডুবে) আছে, কিন্তু তারা নয়, যারা ঈমান আনে ও সৎকর্ম করে এবং পরস্পরকে সত্যের উপদেশ দেয় এবং পরস্পরকে ধৈর্যধারণের উপদেশ দেয়।’ (সুরা আসর, আয়াত: ২-৩) 
 
বিপদে অন্যের সহযোগিতার বিষয়টিও এখানে তাৎপর্যপূর্ণ। বিপদগ্রস্ত সমাজের সবাই ধৈর্যধারণেই শুধু সীমাবদ্ধ থাকবে না, পরস্পর সহযোগিতা অর্থাৎ বিপদগ্রস্ত ব্যক্তির বৈষয়িক সাহায্যে এগিয়ে আসাও গুরুত্বপূর্ণ। জরুরি পরিস্থিতিতে জরুরি পরিকল্পনা গ্রহণ এবং পারস্পরিক সাহায্য আদান-প্রদানে ত্যাগ স্বীকারের  মাধ্যমে এই প্রয়াসে উপযোগী নেতৃত্বদান ও সফল কর্ম সম্পাদনে সহায়তা করা বাঞ্ছনীয়। এমন ভূমিকা পালনে কোনো বিপর্যয়ই কোনো সমাজকে কাবু করতে পারে না।   
 
ধৈর্যধারণের মাধ্যমে বিপদ মোকাবিলার মধ্যে রয়েছে আল্লাহর অপার সন্তুষ্টি ও সমর্থন। আল্লাহ বলেন, ‘পূর্ব ও পশ্চিম দিকে তোমাদের মুখ ফেরানোতে কোনো পুণ্য নেই, কিন্তু পুণ্য আছে....অভাবে, দুঃখ-ক্লেশে ও সংকটে ধৈর্যধারণ করবে, এ লোকেরাই সত্যপরায়ণ। আর এরাই মুত্তাকি।’
 
লেখক: সাবেক সচিব ও প্রাক্তন চেয়ারম্যান, এনবিআর 
 

তালবিয়া কী, কখন ও কীভাবে পড়তে হয়?

প্রকাশ: ২৩ মে ২০২৫, ০৬:০০ পিএম
তালবিয়া কী, কখন ও কীভাবে পড়তে হয়?
আরবিতে তালবিয়া লেখা ছবি। সংগৃহীত

তালবিয়া হজের এক বিশেষ আহ্বান, যা ইহরাম বাঁধার পর মক্কায় পৌঁছানোর আগে অথবা হজের বিভিন্ন কার্যক্রম চলাকালীন সময়ে মুসলমানরা উচ্চারণ করেন। এটি আল্লাহর প্রতি আনুগত্য এবং তাওহিদ বা একত্ববাদের ঘোষণা। এই পবিত্র বাক্য আল্লাহর প্রতি গভীর ভালোবাসা ও আত্মসমর্পণের প্রকাশ।

তালবিয়ার বাংলা উচ্চারণ: ‘লাব্বাইক আল্লাহুম্মা লাব্বাইক, লাব্বাইকা লা শারিকা লাকা লাব্বাইক, ইন্নাল হামদা ওয়ান-নিয়মাতা লাকা ওয়াল মুলক, লা শারিকা লাক।’

তালবিয়ার অর্থ: ‘হে আল্লাহ! আমি তোমার ডাকে সাড়া দিচ্ছি, আমি তোমার ডাকে সাড়া দিচ্ছি। তোমার কোনো শরিক নেই, আমি তোমার ডাকে সাড়া দিচ্ছি। নিশ্চয়ই সব প্রশংসা, নিয়ামত ও বাদশাহি তোমারই, তোমার কোনো শরিক নেই।’

তালবিয়া ইহরাম বাঁধার পর থেকে পাঠ করা শুরু হয় এবং হজের বিভিন্ন কার্যক্রমের সময় তা একটানা চলতে থাকে। মিনা, আরাফাত, মুজদালিফা এবং মক্কা, এসব স্থানেই তালবিয়া পাঠ করা হয়। ইহরাম বাঁধার পর হজযাত্রী যখন মক্কা বা অন্য কোনো স্থানে যান, তখন তারা তালবিয়া পাঠ করেন। মিনায় পৌঁছানোর পর এবং আরাফাতে অবস্থানের সময়ও এর পাঠ অব্যাহত থাকে। কঙ্কর নিক্ষেপের সময়, শয়তানকে প্রতীকীভাবে পাথর ছুড়ে মারার সময় এবং হজের অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ স্থান পরিদর্শনের সময়ও তালবিয়া পাঠ করা হয়। তালবিয়া পাঠের উদ্দেশ্য হলো আল্লাহর সম্মানে এবং হজের প্রতি পূর্ণ মনোযোগের জন্য শারীরিক ও মানসিকভাবে প্রস্তুত থাকা।

তালবিয়া হজের একটি অপরিহার্য অংশ, যা মুসলমানদের ঐক্য, আনুগত্য ও ঈমানের গভীরতাকে ফুটিয়ে তোলে। এটি কেবল কয়েকটি শব্দ নয়, বরং আল্লাহর প্রতি পূর্ণ আত্মসমর্পণের ও একত্ববাদের ঘোষণা। তালবিয়া পাঠের মাধ্যমে মুসলমানরা আল্লাহর কাছে ক্ষমা, রহমত ও বরকত প্রার্থনা করেন। এটি হজযাত্রীদের মধ্যে এক আধ্যাত্মিক শক্তি সঞ্চার করে, যা তাদের জীবনে দীর্ঘস্থায়ী প্রভাব ফেলে।

 

লেখক: খতিব, বঙ্গভবন জামে মসজিদ

 

হজ শেষে মদিনায় কি যেতেই হবে?

প্রকাশ: ২৩ মে ২০২৫, ০৩:০০ পিএম
হজ শেষে মদিনায় কি যেতেই হবে?
মসজিদে নববির ছবি। সংগৃহীত

হজের ফরজ ও ওয়াজিব আমল সবই মক্কায় সম্পন্ন হয়। তবে মদিনায় যাওয়ার গুরুত্ব এবং ফজিলত ইসলামের দৃষ্টিতে অনেক বেশি, যদিও তা হজের অংশ নয়।

১. রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর রওজা জিয়ারত: ইবনে ওমর (রা.) থেকে বর্ণিত, হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেন, ‘যে আমার ওফাতের পর আমার (রওজা) জিয়ারত করল, সে যেন আমার জীবদ্দশায় আমার সঙ্গে সাক্ষাৎ করল।’ (দারাকুতনি, হাদিস: ২৬৯৪)
রাসুলুল্লাহ (সা.) আরও বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি আমার কবর জিয়ারত করবে, তার জন্য আমার শাফাআত (সুপারিশ) ওয়াজিব হয়ে যাবে।’ (দারাকুতনি, ২/২৭৮, বায়হাকি, শুআবুল ঈমান, ৩৮৬২)
রাসুলুল্লাহ (সা.) আরও বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি বায়তুল্লায় হজ করল, অথচ আমার (কবর) জিয়ারত করল না, সে ব্যক্তি আমার সঙ্গে অসৌজন্যমূলক আচরণ করল।’ (ইবন হিব্বান, ২/৪১৪; আল-মাউদুআত মিনাল আহাদিস আল-মারফুআত, হাদিস: ১১৬৮)

২. মসজিদে নববিতে নামাজ আদায়: ইবনে উমর (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘আমার এ মসজিদে এক ওয়াক্ত নামাজ আদায় করা মসজিদে হারাম ছাড়া অন্যান্য মসজিদে ১ হাজার নামাজ আদায় করার চেয়েও উত্তম।’ (বুখারি: ১১৯০; মুসলিম: ১৩৯৪)

৩. রিয়াজুল জান্নাহ: মসজিদে নববিতে ‘রিয়াজুল জান্নাহ’ নামক একটি বিশেষ স্থান রয়েছে, যাকে জান্নাতের টুকরা বলা হয়েছে। সেখানে ইবাদত করা অনেক ফজিলতপূর্ণ।

৪. সাহাবায়ে কিরামের কবর জিয়ারত: মদিনায় অনেক সাহাবি এবং ইসলামের প্রথম যুগের মহান ব্যক্তিত্বরা শায়িত আছেন। তাদের কবর জিয়ারতের মাধ্যমে আমরা তাদের প্রতি সম্মান দেখাতে পারি এবং নিজেদের ঈমান মজবুত করতে পারি।

হজের অংশ না হলেও, মদিনায় যাওয়া একটি বরকতময় সফর যা ঈমান বাড়ায়, রাসুলের প্রতি ভালোবাসা জাগায় এবং অতিরিক্ত সওয়াবের দরজা খুলে দেয়।

 

লেখক: আলেম, গবেষক ও সাংবাদিক

হজ নিয়ে যা না জানলেই নয়

প্রকাশ: ২৩ মে ২০২৫, ০৮:৩০ এএম
হজ নিয়ে যা না জানলেই নয়
তারকার মাঝে কাবা শরিফের ছবি। সংগৃহীত

হজ দুনিয়ার বুকের ঐশী সফর। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের মতো বাংলাদেশ থেকেও পবিত্র হজ পালনের উদ্দেশ্যে যাচ্ছেন মুসলিম নর-নারীরা। বিদেশ সফরের অভিজ্ঞতা এবং হজ পালনের আমল ও বিধান সম্পর্কে যথার্থ জ্ঞান না থাকার কারণে পবিত্র এ সফরে ভুল হওয়ার সম্ভাবনা থেকে যায়। বাংলাভাষী হাজিদের জন্য হজ পালনের প্রয়োজনীয় বিধানাবলি তুলে ধরা হলো।

হজের গুরুত্ব ও ফজিলত
হজ ইসলাম ধর্মের পাঁচটি স্তম্ভের অন্যতম এবং বিশ্বের কোটি কোটি মুসলমানের জন্য এক পবিত্রতম ইবাদত। প্রতি বছর ধর্মপ্রাণ মুসলমানরা আল্লাহর ডাকে সাড়া দিয়ে মক্কা ও মদিনার পানে ছুটে যান। এই যাত্রা শুধু আল্লাহর একত্ববাদের স্বীকৃতি কিংবা অতীতের পাপের জন্য ক্ষমা প্রার্থনাই নয়, বরং এটি মুমিনের ঈমান ও আনুগত্যের এক দৃঢ় বহিঃপ্রকাশ। কোরআন ও হাদিসের আলোকে হজের গুরুত্ব ও ফজিলত অপরিসীম। 

হজ পালন করা প্রত্যেক সামর্থ্যবান মুসলমানের জন্য আল্লাহতায়ালার এক সুস্পষ্ট নির্দেশ। পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘আর আল্লাহর জন্য মক্কা-এলাকায় হজ আদায় করা তার জন্য বাধ্যতামূলক, আর আল্লাহর জন্য মানুষের ওপর হজ করা ফরজ, যাদের সেখানে যাওয়ার সামর্থ্য আছে।’ (সুরা ইমরান, ৯৭) এই আয়াত দ্ব্যর্থহীনভাবে প্রমাণ করে যে, শারীরিক ও আর্থিকভাবে সক্ষম প্রত্যেক মুসলিমের জন্য হজ পালন করা ফরজ বা অবশ্য কর্তব্য।

হজের মাধ্যমে বান্দা মহান আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন করে এবং অতীতের সব পাপ থেকে মুক্তি লাভ করার সুযোগ পায়। কোরআনে কারিমে বলা হয়েছে, ‘যে ব্যক্তি আল্লাহর জন্য হজ পালন করবে, সে যেন অসামাজিক কাজ এবং গুনাহ থেকে বিরত থাকে।’ (সুরা বাকারা, ১৯৭) শুধু তাই নয়, হজ এমন এক মহান ইবাদত, যা মুমিনের জীবনের সব গুনাহকে ধুয়ে-মুছে তাকে নিষ্পাপ করে তোলে।

ইসলামে হজের মর্যাদা অতুলনীয়। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি আল্লাহর জন্য হজ করবে এবং সেখানে কোনো অশ্লীলতা বা পাপ কাজ করবে না, সে তার জন্মের দিনটির মতো পবিত্র হয়ে ফিরে আসবে।’ (বুখারি, ১৫২১) 
এই হাদিস হজের তাৎপর্য ও ফজিলত সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা দেয় যে, এটি পাপ মোচনের ও আত্মশুদ্ধির এক বিশেষ সুযোগ।

হজের ইতিহাস 
হজ শুধু একটি ইবাদত নয়, এটি ইসলাম ধর্মের পঞ্চম স্তম্ভ এবং মুসলমানদের জীবনে এক তাৎপর্যপূর্ণ অধ্যায়। এই পবিত্র সফর বিশ্বজুড়ে মুসলিম উম্মাহকে এক কাতারে শামিল করে, যেখানে আল্লাহর প্রতি পরম আনুগত্য ও দাসত্বের সুর প্রতিধ্বনিত হয়। হজের ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট, এর গভীর তাৎপর্য এবং মানবজীবনে এর প্রভাব অনন্য। 

হজের ইতিহাস সুপ্রাচীন, যা ইসলামের আবির্ভাবের বহু আগে থেকেই এই অঞ্চলে একটি গুরুত্বপূর্ণ ধর্মীয় প্রথা হিসেবে প্রচলিত ছিল। প্রাক-ইসলামিক যুগে আরবের বিভিন্ন গোত্র পবিত্র কাবাঘরের প্রতি অগাধ ভক্তি প্রদর্শন করত। যদিও সেই সময় শিরক ও কুসংস্কারে পরিপূর্ণ ছিল তাদের আচার-অনুষ্ঠান। কালের বিবর্তনে হজের মূলনীতি থেকে সরে গিয়ে নানাবিধ কুপ্রথা সেখানে স্থান করে নিয়েছিল।

ইসলাম আগমনের আগে কাবাঘর বিভিন্ন আরব জাতির মিলনকেন্দ্র হলেও, সেখানে পৌত্তলিকতা ও নানা অপকর্ম বিস্তার লাভ করেছিল। অশ্লীলতা, পাপাচার ও নৈতিক অবক্ষয় ছিল সেই সময়ের হজের অবিচ্ছেদ্য অংশ। ইসলামের আগে হজের অনেক নিয়ম পরিবর্তিত হয়ে বিকৃত রূপ ধারণ করেছিল। যা মহান আল্লাহতায়ালার নির্দেশে ইসলামের পূর্ণাঙ্গ বিধিবিধানের মাধ্যমে সংশোধিত হয়।
ইসলামের আগমন হজের বিধানকে সুস্পষ্টভাবে কোরআন ও হাদিসের আলোকে প্রতিষ্ঠা করে। হজের মূল আনুষ্ঠানিকতা মূলত আল্লাহর নির্দেশে হজরত ইব্রাহীম (আ.) ও তার ছেলে হজরত ইসমাইল (আ.) কর্তৃক শুরু হয়েছিল। যখন ইব্রাহীম (আ.) আল্লাহর আদেশে কাবাঘরের পুনর্নির্মাণ করেন, তখনই আল্লাহ তাঁকে হজের বিধান দান করেন।

হজ না করার শাস্তি
যদি কোনো মুসলমান হজ করার মতো শারীরিক ও আর্থিক সক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও এই ফরজ ইবাদত পালনে অবহেলা করেন, তবে ইসলামি শরিয়তের দৃষ্টিতে তিনি গুনাহগার হবেন। কোরআন ও হাদিসে এ বিষয়ে সুস্পষ্ট নির্দেশনা রয়েছে।
কোরআনুল কারিমে আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘আর আল্লাহর জন্য মানুষের ওপর হজ করা ফরজ, যার সেখানে যাওয়ার সামর্থ্য আছে।’ (সুরা ইমরান, আয়াত: ৯৭) এই আয়াত স্পষ্টভাবে সামর্থ্যবানদের জন্য হজ ফরজ হওয়ার কথা উল্লেখ করে এবং যারা এই নির্দেশ অমান্য করে, তারা আল্লাহর অবাধ্য হিসেবে গণ্য হবে।
সহিহ মুসলিমের একটি হাদিসে উল্লেখ আছে, ‘যে ব্যক্তি ইবাদত করার জন্য সক্ষম অথচ হজ করেনি, তার যদি মৃত্যু হয়, তবে সে যেন ইসলাম ছাড়া অন্য কোনো অবস্থায় মারা গেল।’ (নাউজুবিল্লাহ)। এ হাদিসের মাধ্যমে বোঝা যায়, হজ পালনে সক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও তা ত্যাগ করা অত্যন্ত গর্হিত কাজ।
ইচ্ছাকৃতভাবে হজ না করলে আল্লাহর কাছে এর জবাবদিহি করতে হবে এবং কঠিন শাস্তি পেতে হবে । শুধু তাই নয়, হজ ফরজ হওয়ার পরও যারা তা দীর্ঘদিন ধরে এড়িয়ে চলেন, তারা আল্লাহর দয়া ও কৃপা থেকে বঞ্চিত হতে পারেন। ফরজ ইবাদত পালনে ইচ্ছাকৃত অবহেলা করা, আধ্যাত্মিক দিক থেকেও ক্ষতির কারণ হয়ে থাকে ।

হজ কত প্রকার ও কী কী?
ইসলামি শরিয়াহ অনুযায়ী, হজ প্রধানত তিন প্রকার। সেগুলো হলো—১. তামাত্তু। ২. কিরান। ৩. ইফরাদ।

তামাত্তু: তামাত্তু হজ হচ্ছে এমন একটি হজ, যেখানে একজন মুসলমান প্রথমে ওমরা পালন করে এবং পরে হজ পালন করেন একই বছর। এটি বিশেষভাবে ওই মুসলিমদের জন্য যারা মক্কা বা তার আশপাশে অবস্থান করছেন এবং যারা আলাদা আলাদা করে ওমরা ও হজ সম্পাদন করতে চান। তামাত্তু হজে ওমরা পালন করা হয় হজের আগে। হজ ও ওমরার মধ্যে ইহরাম খুলে দেওয়া হয় এবং পরে আবার নতুন করে ইহরাম বাঁধতে হয়। এ ধরনের হজ সাধারণত আলাদা আলাদা সময়ে পালিত হয়, তবে তা একই বছরেই করতে হয়। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘তামাত্তু হজ হলো সর্বোত্তম হজ।’ (মুসলিম, ১২১১)

কিরান: কিরান হজ হলো এমন হজ যেখানে একজন মুসলমান ওমরা ও হজ একত্রে করেন, কিন্তু তার মধ্যে ইহরাম খুলে দেওয়া হয় না। অর্থাৎ একজন মুসলমান ইহরাম বাঁধে এবং তা পুরো হজ ও ওমরা পালনকালীন অবস্থায় থাকে। কিরান হজে ওমরা এবং হজ একই সঙ্গে পালিত হয়, কিন্তু ইহরাম খুলে দেওয়ার সুযোগ থাকে না। ওমরা ও হজ একত্রে পালন করা হয়। হজের সময় ইহরাম খুলে দেওয়ার সুযোগ নেই। এটি তামাত্তু থেকে কঠিন হলেও, বেশির ভাগ মুসলমান কিরান হজ পছন্দ করেন। কারণ এটি একটি সম্মানজনক পদ্ধতি। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘কিরান হজ করলে ইহরাম একবারেই থাকতে হবে এবং ওমরার পরেই হজ পালিত হবে।’ (বুখারি)

ইফরাদ: ইফরাদ হজ হলো একমাত্র হজ পালন করা, যেখানে একজন মুসলমান কেবল হজ পালন করেন এবং ওমরা করার প্রয়োজন হয় না। এটি সাধারণত মক্কা থেকে দূরবর্তী অঞ্চলের মুসলমানদের জন্য যারা প্রথমবারের মতো হজে যান। এ হজে ওমরা পালনের প্রয়োজন নেই। শুধু হজ পালন করা হয়। এটি ওইসব মুসলমানদের জন্য সহজ, যারা হজের আগে ওমরা করতে ইচ্ছুক নন। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘হজ হলো একটাই, তবে এটি করার আগে যদি কোনো বাধা না থাকে, তবে তুমি ওমরা করতে পারো।’ (মুসলিম)

হজের ফরজ ও ওয়াজিব 
হজ ইসলামের পাঁচটি মূল স্তম্ভের একটি। হজ শুধু শারীরিক ইবাদত নয়; এটি আত্মিক পরিশুদ্ধি, ধৈর্য, কৃতজ্ঞতা এবং তাওহিদের পূর্ণ প্রকাশ। একজন মুসলমানের জীবনে একবার হজ ফরজ হয়, যদি সে আর্থিক ও শারীরিকভাবে সামর্থ্যবান হয়। কিন্তু অনেকেই জানেন না—হজ পালনের কিছু নির্দিষ্ট ফরজ ও ওয়াজিব কাজ আছে, যেগুলো সঠিকভাবে না করলে হজ শুদ্ধ হয় না।

ফরজ কাজ (৩টি): ‘ফরজ’ হলো এমন কাজ, যা ইচ্ছাকৃতভাবে পরিত্যাগ করলে হজ বাতিল হয়ে যায়। হজে তিনটি ফরজ রয়েছে। আর তা হলো, 
১. ইহরাম বাঁধা ও নিয়ত করা: হজ শুরু করার আগে ইহরাম বাঁধা ও হজের নিয়ত করা আবশ্যক। 
২. আরাফাতে অবস্থান (ওকুফে আরাফা): ৯ জিলহজ দিন আরাফার ময়দানে অবস্থান করা হজের মূল রোকন। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘হজ হলো আরাফা।’ (তিরমিজি, ৮৯১)। 
৩. বিদায়ি তাওয়াফ (তাওয়াফে বিদা): মক্কা ত্যাগ করার আগে কাবাঘর শেষবার তাওয়াফ করা ফরজ। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘সবার শেষ আমল হোক বাইতুল্লাহর তাওয়াফ, তবে হায়েজ (ঋতুমতী) নারীরা ব্যতীত।’ (মুসলিম, ১৩২৮)

ওয়াজিব কাজ (৬টি): ‘ওয়াজিব’ এমন কাজ, যা ইচ্ছাকৃতভাবে পরিত্যাগ করলে দম (কোরবানি) দিতে হয়, তবে হজ বাতিল হয় না। হজের ছয়টি ওয়াজিব কাজ রয়েছে। আর তা হলো, 
১. মুজদালিফায় অবস্থান: ৯ জিলহজ রাতে আরাফা থেকে ফেরার পর মুজদালিফায় অবস্থান করা ওয়াজিব। হাদিসে এসেছে, এক সাহাবি বলেছেন, ‘আমি দেখেছি রাসুলুল্লাহ মাগরিব ও এশার নামাজ একত্রে পড়ে রাত কাটিয়েছেন মুজদালিফায়।’ (বুখারি, ১৬৭৫)। 
২. জামারায় কঙ্কর নিক্ষেপ করা: ১০, ১১, ১২ (বা ১৩) জিলহজ শয়তানকে কঙ্কর নিক্ষেপ করা। ‘তোমরা আমার কাছ থেকে হজের কর্মপদ্ধতি শিখে নাও।’ (মুসলিম, ১২৯৭)। 
৩. কোরবানি করা: তামাত্তু ও কিরান হজ করলে কোরবানি ওয়াজিব। (সুরা বাকারা, ১৯৬)। 
৪. হালক বা কসর করা: পুরুষদের মাথা মুণ্ডানো বা চুল ছোট করা ও নারীদের হালকা কাটতে হয়। 
৫. সাঈ করা (সাফা-মারওয়া): তাওয়াফের পর সাফা ও মারওয়ার মধ্যে সাতবার দৌড়ানো। ‘নিশ্চয়ই সাফা ও মারওয়া আল্লাহর নিদর্শনগুলোর অন্তর্ভুক্ত।’ (সুরা বাকারা, ১৫৮)। 
৬. বিদায়ি তাওয়াফ করা: বিদায়ি তাওয়াফ শেষ করে মাকামে ইবরাহিমের কাছে দুই রাকাত নামাজ পড়াও ওয়াজিব।

 

লেখক: আলেম, গবেষক ও সাংবাদিক

কোরবানি কত প্রকার?

প্রকাশ: ২২ মে ২০২৫, ১০:০০ পিএম
কোরবানি কত প্রকার?
প্রতীকী ছবি। সংগৃহীত

ওয়াজিব কোরবানি মোট ৪ প্রকার। এছাড়া আরও এক প্রকার কোরবানি রয়েছে, সেটা হলো নফল কোরবানি।

ওয়াজিব ৪ প্রকারের কোরবানি হলো,

১. মানতের কোরবানি: কেউ যদি আল্লাহর নামে কোরবানি করার মানত করে, তাহলে সে কোরবানি আদায় করা ওয়াজিব। 

২. গরিবের কোরবানি: কোনো দরিদ্র বা গরিব ব্যক্তি যদি কোরবানির দিনগুলোতে কোরবানি করার জন্য পশু ক্রয় করে, তাহলে ক্রয়কৃত সে পশু কোরবানি করা ওয়াজিব।

৩. অসিয়তের কোরবানি: কেউ যদি মৃত্যুকালে তার পক্ষ থেকে কোরবানি আদায় করার জন্য ওয়ারিশদের অসিয়ত করে, তাহলে সে কোরবানি আদায় করা ওয়াজিব।

৪. নেসাব পরিমাণ সম্পদের মালিকের কোরবানি: জিলহজ মাসের ১০, ১১ ও ১২ তারিখে নেসাব পরিমাণ সম্পদের মালিকের ওপর কোরবানি করা ওয়াজিব। (বাদায়েউস সানায়ে, ৭/৩৯৩; ফতোয়ায়ে শামি, ৫/২৯১)

 

লেখক : আলেম ও সাংবাদিক

 

ইতিহাসে প্রথম কোরবানিদাতা কে?

প্রকাশ: ২২ মে ২০২৫, ০৬:০০ পিএম
ইতিহাসে প্রথম কোরবানিদাতা কে?
প্রতীকী ছবি। সংগৃহীত

আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেন, ‘আপনি তাদেরকে বর্ণনা করুন আদমের দুই পুত্রের অবস্থা। যখন তারা উভয়েই কিছু কোরবানি করেছিল, তখন তাদের একজনের কোরবানি গৃহীত ও অপরজনের কোরবানি অগৃহীত হয়েছিল। সে বলল, আমি অবশ্যই তোমাকে হত্যা করব। অপরজন বলল, আল্লাহ কেবল ধর্মভীরুদের কোরবানিই গ্রহণ করেন। (সুরা মায়েদা, ২৭)। 

এ আয়াত থেকে বোধগম্য হয়, কোনো এক ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে হজরত আদম (আ.) নিজ সন্তান হাবিল-কাবিলকে কোরবানি করতে আদেশ করেছিলেন। ইমাম কুরতুবি (রহ.) এ আয়াতের ব্যাখ্যায় ঘটনাটি এভাবে বর্ণনা করেন, যখন আদম এবং হাওয়া (আ.) পৃথিবীতে আগমন করেন, তখন তাদের মাধ্যমে সন্তানপ্রজনন ও বংশবিস্তারের ধারা আরম্ভ হয়। প্রজনন-পদ্ধতি ছিল, হজরত হাওয়া (আ.)-এর প্রতিটি গর্ভ থেকে একটি পুত্র ও একটি কন্যা সন্তান জন্মগ্রহণ করত। তখন একমাত্র আদম আ.-এর সন্তান ব্যতীত আর কোনো মানবসন্তান পৃথিবীতে ছিল না। তাই আল্লাহ তায়ালা বিয়ে-শাদীর ব্যবস্থাপনার সূচনা করতে আদম আ.-এর শরিয়তে বিশেষভাবে করবে, তারা পরস্পরে সহোদর ভাই-বোন হিসেবে গণ্য হবে। তাদের মধ্যে বৈবাহিক সম্পর্ক হারাম। তবে পরবর্তী গর্ভ থেকে জন্ম নেওয়া পুত্র প্রথম গর্ভ থেকে জন্ম নেওয়া কন্যার সহোদর হিসেবে গণ্য হবে না। 

তারা পরস্পরে বিবাহ-বন্ধনে আবদ্ধ হতে পারবে। কিন্তু ঘটনাচক্রে কাবিলের সহজাত সহোদর বোন ‘আকলিমা' ছিল পরমা সুন্দরী, আর হাবিলের সহজাত বোন 'লিজ' ছিল অতিশয় কুৎসিত। বিবাহের সময় এলে তাদের শরিয়ত-অনুসারে হাবিলের সহোদরা কুৎসিত বোন কাবিলের পাত্রী হিসেবে নির্বাচিত হয় । আর হাবিলের ভাগ্যে জুটে কাবিলের সুন্দরী বোন আকলিমা। কিন্তু কাবিল তা সন্তুষ্টচিত্তে না মেনে হাবিলের সাথে শত্রুতা শুরু করে। সে দাবি করে, আমার সহোদরা বোনকেই আমার সাথে বিয়ে দিতে হবে। আদম (আ.) তার এ দাবিকে প্রত্যাখান করেন। কিন্তু কাবিল তার দাবিতে রইল অনড় । তখন আদম আ. হাবিল-কাবিলের মতভেদ দূর করার লক্ষ্যে বললেন, তোমরা উভয়ে আল্লাহর নিকট নিজ নিজ কোরবানি পেশ করো। যার কোরবানি কবুল হবে সেই ‘আকলিমা'-কে বিয়ে করবে। এ নির্দেশ মেনে তারা উভয়ে কোরবানি করল। হাবিল ভেড়া, দুম্বা ইত্যাদি প্রতিপালন করত, তা থেকে একটি দুম্বা উৎসর্গ করার জন্য ইচ্ছেপোষণ করল। কাবিল কৃষি কাজ করত। 

এ হিসেবে সে কিছু শষ্য ও গম কোরবানির জন্য নির্ধারণ করল। সে সময়ে কোরবানি কবুল হওয়ার নিদর্শন হিসেবে আকাশ থেকে একটি অগ্নিশিখা এসে কোরবানির বস্তু জ্বালিয়ে দিতো। অর্থাৎ যার কোরবানিসামগ্রী জ্বলে যেত, তার কোরবানি কবুল হয়েছে বলে স্বীকৃতি পেত। এ নিয়মানুসারে আকাশ থেকে অগ্নিশিখা এসে হাবিলের কোরবানিটিকেই জ্বালিয়ে দিলো। আর কাবিলের কোরবানি যথাস্থানে পড়ে রইল। মোটকথা, এ আয়াতের সূত্র থেকে পরিলক্ষিত হয়, সর্বপ্রথম হজরত আদম (আ.) এর সন্তান হাবিল-কাবিলই কোরবানি করেছিল। (তাফসিরে কুরতুবি, ৬/১৩৪)

এখন প্রশ্ন হতে পারে, মুসলমানদের প্রচলিত কোরবানি আদম (আ.)-এর সুন্নাত নাকি ইবরাহিম (আ.)-এর? ইসলামধর্মে প্রচলিত কোরবানি ইবরাহিম (আ.)-এর সুন্নাত। কারণ রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, কোরবানি তোমাদের পিতা হজরত ইবরাহিম (আ.)-এর সুন্নত। (মিশকাত, ১/১২৯)

 

লেখক : আলেম, গবেষক ও সাংবাদিক