চার দিন আগে রাজধানীর বেইলি রোডে প্রচণ্ড গরমে অসুস্থ হয়ে পড়েন ট্রাফিক পুলিশের সার্জেন্ট মো. আরিফ। ৩৮ ডিগ্রি তাপমাত্রা অসহ্য হয়ে উঠেছিলেন। আরিফ খবরের কাগজকে বলেন, ‘দুই দিন রেস্ট নেওয়ার পর আবারও কাজ শুরু করেছি। শারীরিক সমস্যা তো কিছুটা রয়েছেই। তারপরও আমাদের সার্জেন্টদের একটা দায়িত্ব-কর্তব্য রয়েছে। সেটা আমাদের কাছে অনেক বড়। আমরা দেশসেবার জন্য শপথ গ্রহণ করেছি।’
গত রবিবার দুপুর সাড়ে ১২টার ঘটনা। সূর্য রুদ্রমূর্তি ধারণ করেছে। রাজধানীতে তাপমাত্রা ৩৭ ডিগ্রি সেলসিয়াসের বেশি। কিন্তু গরম অনুভূত হচ্ছিল এর চেয়ে বেশি। রমনা বিভাগের পুলিশ বক্সের সামনে তীব্র গরমের মধ্যে ডিউটিরত অবস্থায় ছটফট করতে দেখা যায় ট্রাফিক পুলিশের সার্জেন্ট মো. রেজাকে। তিনি বলেন, ‘এই গরমে কিছু ভালো লাগে না। শুধু ছটফট করি। কবে যে অসুস্থ হয়ে পড়ি বা ডায়রিয়া হয়ে যায় তা আল্লাহ জানেন।’
গত সোমবার বেলা ২টা ১০ মিনিটের দিকে কথা হয় বাংলামোটরে ডিউটিরত ট্রাফিক পুলিশের সার্জেন্ট মো. মনিরের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘তীব্র এই গরমের মধ্যে আমাদের অনেক সহকর্মী অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। কেউবা বাসায় বিশ্রামে আছেন। প্রচণ্ড রোদের মধ্যে আমিও কিছুটা অসুস্থ বোধ করছি।’
নাম প্রকাশ না করার শর্তে সাতরাস্তায় কর্তব্যরত ট্রাফিক পুলিশের এক সার্জেন্ট বলেন, ‘আমি এই গরমে তিন দিন অসুস্থ ছিলাম। এক দিন রাস্তায় ছটফট করতে থাকি। শরীরের কাপড় খুলে পুলিশ বক্স থেকে খাওয়ার পানি নিয়ে গায়ে ঢালি। তারপর জুতা খুলে পায়ে ঢেলে দিই। পরে একটু ভালো লাগে। এর দুই দিন পর অসুস্থ হয়ে পড়ি। আমাদের অনেক পুলিশ সদস্যই এ রকম অসুস্থ হয়ে পড়েছেন।’
একাধিক ট্রাফিক সার্জেন্ট বলেন, ‘ভয়ংকর এই দাবদাহে দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে মাথা প্রচণ্ড গরম হয়ে যায়। পায়ের জুতা পর্যন্ত গরম হয়ে যায়। অনেক সময় কানেও কম শুনি। প্রচণ্ড গরমে অনেক ক্লান্ত লাগে। মেজাজ খিটখিটে হয়ে যায়। ঘণ্টার পর ঘণ্টা ঠায় দাঁড়িয়ে থেকে ডিউটি করতে হয়। হিট স্ট্রোকে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি সবচেয়ে বেশি আমাদের। তারপরও মানুষের যাতায়াতের সুবিধার কথা চিন্তা করে দায়িত্ব পালনের জন্য এই সেবা দিতে হয়। আমরা জনগণের বন্ধু হয়ে থাকতে চাই। ট্রাফিক পুলিশের সদস্যরা দাবি জানিয়েছেন, এই দুঃসহ গরমে তারা ৫ থেকে ৬ ঘণ্টা ডিউটি করতে চান।’
ট্রাফিক সূত্র জানায়, বাংলাদেশে ট্রাফিক পুলিশের সংখ্যা প্রায় ১০ হাজার। শুধু রাজধানীতে ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণে কাজ করছেন প্রায় ৪ হাজার পুলিশ সদস্য। এর মধ্যে টানা তাপপ্রবাহের কারণে প্রায় অর্ধেক ট্রাফিক পুলিশের সদস্য শারীরিকভাবে ফিট নন। তারা গরমে অসুস্থ হয়ে রেস্টে আছেন। অনেকে পুলিশ সদস্য হাসপাতাল ও বিভিন্ন হাসপাতালে চিকিৎসা নিচ্ছেন। সূত্রমতে, ১৭তম ট্রাফিকের ২৪ ব্যাচের সদস্যের সংখ্যা ৬৬৫ জন। এর মধ্যে সারা দেশে দেড় শতাধিক ট্রাফিক পুলিশ অসুস্থ হয়ে পড়েছে।
ট্রাফিক পুলিশের এসব সমস্যা নিয়ে সচেতন মহল ও স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ট্রাফিক পুলিশ সদস্যরা মানুষের সেবা দিতে রোদে পুড়ে গরমের মধ্যে কষ্ট করছেন এবং বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন। সারা দিন ট্রাফিক পুলিশকে মোটা কাপড়ে থাকতে হয়, যেটা খুবই কষ্টকর। বিশেষ করে ট্রাফিকের জন্য সরকারের উচিত ডিউটি কমিয়ে দেওয়া অথবা ৩ শিফটে ডিউটির ব্যবস্থা করা। এতে সংশ্লিষ্ট সবাই প্রশান্তি পেতেন।
ট্রাফিক পুলিশদের দাবি, তীব্র এই গরমের মধ্যে মোটা কাপড়ের ইউনিফর্ম পরে একটানা ডিউটি করতে কষ্ট হয়। ঘামে ভিজে নিরলসভাবে কাজ করতে হয় রোজ। নির্দিষ্ট সময়ের বাইরেও তপ্ত রোদে রাস্তায় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে নিয়ন্ত্রণে রাখতে হয় যানবাহনের চাকা। সেটা যদি যথাসময়ে না করা যায়, তাহলে সাধারণ মানুষের গালমন্দও হজম করতে হয়।
রাজধানীর রাসেল স্কয়ার মোড়ে রাস্তার চারপাশ যেন আগুনে পুড়ে যাচ্ছিল। তপ্ত রোদে দাঁড়িয়ে যানবাহন নিয়ন্ত্রণে কাজ করছিলেন ট্রাফিক কনস্টেবল শেখ মহিদুল ইসলাম। ঘামে পুরো ইউনিফর্ম ভিজে গেছে তার। পুরো শরীর থেকে ঘাম ঝরছে। তবুও দায়িত্ব থেকে সরে দাঁড়াননি এক মুহূর্তের জন্যও। তিনি বলেন, ‘আমাদের কাজ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে করতেই হয়। বসার কোনো সুযোগ নেই। যতই গরম হোক, দায়িত্ব তো পালন করতে হবে।’
গরমে আপনাদের কোন ধরনের অসুবিধা হচ্ছে? এই প্রশ্নের উত্তরে ডেমরা বিভাগে ডিউটিরত ট্রাফিক সার্জেন্ট কৌশিক মাহমুদ খবরের কাগজকে বলেন, ‘গরমে যেন অসুস্থ না হতে হয়, এ জন্য স্যালাইন, মিনারেল পানি, গ্লুকোজ খাচ্ছি। সবই আমাদের ডিএমপি কমিশনার ব্যবস্থা করেছেন। গরম মোকাবিলার জন্য আলাদা করে একটি ছাতাও পেয়েছি। তবে শরীর অনেক সময় পেরে ওঠে না। স্বাস্থ্যগত কিছু সমস্যা তৈরি হচ্ছে অনেকের।’
বাংলামোটরে ডিউটিরত ট্রাফিক পুলিশের টিআই নিউটন দাশ বলেন, ‘আমরা এই গরমে অনেক বাজে অবস্থায় আছি, আমাদের ভীষণ কষ্ট হয়। তবে কিছু সিনিয়র ট্রাফিক সদস্য যাতে একটু আলো-বাতাস পান, এ জন্য তাদের ক্ষেত্রে আমাদের কাছে কিছু নির্দেশনা আছে। সেটা হলো তাদের আলো-বাতাসের মধ্যে ডিউটি দেওয়া।’
ট্রাফিক পুলিশের সদস্যরা প্রতিদিন ৮ ঘণ্টা নয়, ৫ থেকে ৬ ঘণ্টা ডিউটি করতে চান। এই বিষয়ে তিনি বলেন, ‘এটা হলে তো ভালো হয়। তবে বললাম তো সিনিয়র ট্রাফিক সদস্যদের ক্ষেত্রে সামান্য কিছু নির্দেশনা আছে।’
তেজগাঁও জোনের সহকারী পুলিশ কমিশনার (ট্রাফিক) স্নেহাশিস কুমার বলেন, ‘ট্রাফিক সদস্যদের কেউ যেন ছাতা ছাড়া ডিউটি না করেন। সেই বিষয়টি আমরা খেয়াল রাখছি। আলাদা করে লেবুর শরবত সরবরাহ করা হচ্ছে। গরম যতই হোক না কেন, আমরা রাস্তা ছাড়তে পারি না।’
ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ (ডিএমপি) কমিশনার হাবিবুর রহমান বলেন, ‘আমাদের কাজ করতে হবে। তবে সবাইকে সতর্ক থাকতে বলা হয়েছে। কেউ যেন অসুস্থ না হয়ে পড়েন। রাস্তার ট্রাফিক শৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণের জন্য প্রচণ্ড রোদে তাদের কাজ করতে হয়। তবে কিছু কিছু সময় কেউ কেউ অসুস্থ হতে পারেন। সে ক্ষেত্রে আমরা রেস্ট এবং চিকিৎসার পরামর্শ বা সুযোগ দিচ্ছি।’
চলমান তাপপ্রবাহে সড়কে দায়িত্ব পালন করা ট্রাফিক পুলিশ সদস্যদের ইউনিফর্ম পরে ডিউটি করা কষ্টকর, এমন দাবি অনেক ট্রাফিক পুলিশের। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘আমাদের যে পোশাক রয়েছে তার বাইরে গিয়ে বিকল্প পোশাক পরিধানের সুযোগ একেবারে নেই বললেই চলে।’ অনেক জায়গায় পানির সংকট রয়েছে, এ বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, কিছু জায়গায় পানির ট্রলি দেওয়া আছে। আর বেশ কয়েকটি জায়গায় ভ্রাম্যমাণ কার্যক্রম চলমান আছে।
কারওয়ান বাজারে দায়িত্বরত ট্রাফিক সদস্য রশিদুল ইসলাম বলেন, ‘যত গরমই হোক, যেহেতু চাকরি করি দায়িত্ব তো পালন করতেই হবে। এ গরমে যেন আমরা সতর্ক থাকি। ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা আমাদের খোঁজ-খবর নিচ্ছেন। মাঝেমধ্যে শরীর দুর্বল হয়ে পড়ে। একটানা রোদে দাঁড়ানোর কারণে সারা শরীর ঘেমে যায়। সেই ঘাম শরীরেই শুকায়। দীর্ঘক্ষণ দাঁড়ানোর কারণে পায়ে ব্যথা করে। অসুস্থ হয়ে পড়ি।’
এ বিষয়ে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার (ট্রাফিক) মো. মুনিবুর রহমান বলেন, ‘ট্রাফিক পুলিশের কালো যে ছাতাটি রয়েছে, সেটির বদলে সাদা ছাতা দেওয়া হবে। যেন গরম কম লাগে তাদের। একই সঙ্গে রোদে বা তাপপ্রবাহে কোনো পুলিশ সদস্য অসুস্থ হয়ে পড়লে তাদের সেবা-শুশ্রূষা দেওয়ার জন্য পুলিশ হাসপাতাল সার্বক্ষণিক প্রস্তুত রাখা হয়েছে। তা ছাড়া ডিএমপি কমিশনারের নির্দেশে আমরা সব বিষয়ে খোঁজ-খবর নিচ্ছি।’
একাধিক ট্রাফিক পুলিশ বলছেন, ‘এই ৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রার মধ্যে যদি আমরা কাজ না করি, তাহলে জ্যামে একেবারেই নাজেহাল অবস্থা হয়ে যাবে মানুষের। তবে এত গরমে গায়ে জ্বালাপোড়া, মাথাব্যথা শুরু হয়। বাসায় যাওয়ার পর শরীরে বিভিন্ন ধরনের অস্বস্তি বোধ করি।’
ঢাকা কমিউনিটি মেডিকেল কলেজ অ্যান্ড হাসপাতালের অধ্যাপক ও স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. আব্দুল মালেক বলেন, টানা কয়েক দিন ধরে তাপপ্রবাহের মধ্যে সবচেয়ে ঝুঁকিতে আছেন ট্রাফিক পুলিশের সদস্যরা। পুলিশ সেবা দিতে রোদে পুড়ে গরমের মধ্যে কষ্ট করছে এবং বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হচ্ছে। তারা হিট স্ট্রোকের প্রবল ঝুঁকিতে রয়েছে।
ট্রাফিক পুলিশের দাবি, তারা ৫ থেকে ৬ ঘণ্টা ডিউটি করতে চান। এই দাবির যৌক্তিকতা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, তারা যদি গরমের মধ্যে ভালো মতো রেস্ট না থাকতে পারেন, তাহলে তাদের স্বাস্থ্যের ঝুঁকি থেকে যায়। এ ক্ষেত্রে তাদের দাবি যৌক্তিক বলে মনে করি।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক বিশেষজ্ঞ ড. তৌহিদুল হক খবরের কাগজকে বলেন, ‘ট্রাফিক পুলিশ সারা দিন যেভাবে কাজ করছে, প্রথমে তাদের ধন্যবাদ দিতে চাই। তবে গরমে ট্রাফিক পুলিশকে মোটা কাপড়ে থাকতে হয় যেটা আসলেই ভীষণ অস্বস্তির। বিশেষ করে ট্রাফিকের জন্য সরকারের উচিত ছিল ডিউটি কমিয়ে দেওয়া অথবা ৩ শিফটে ডিউটি তৈরি করা। এতে করে সবাই প্রশান্তি পেত। সেই ক্ষেত্রে ট্রাফিক পুলিশও সুস্থ থাকত। এর মধ্যে তাদের যদি কোনো দাবি দাওয়া থাকে তাহলে সেইগুলো সরকারের মেনে নেওয়া উচিত।’