
গত মঙ্গলবার বেলা আড়াইটা। রাজধানীর সোনারগাঁও ট্রাফিক পুলিশ বক্সের সিগন্যালে দাঁড়িয়ে আছে ঢাকা মেট্রো-দ ১১-২২-২৫ নম্বরের একটি সিএনজিচালিত অটোরিকশা। সিগন্যাল পার হওয়ার সময় অটোরিকশাটিকে থামানোর সংকেত দেন বুলবুল নামের ট্রাফিক পুলিশের একজন সদস্য। থেমে যায় অটোরিকশাটি। এরপর ট্রাফিক সার্জেন্ট অটোরিকশার চালক রহিমের কাগজপত্র দেখতে চান। কাগজ নিয়ে অটোরিকশা থেকে নেমে সার্জেন্টের সঙ্গে পুলিশ বক্সে ঢোকেন চালক। বক্সে ১০ মিনিটের মতো থাকার পর তিনি বের হয়ে আসেন।
পুলিশ তাকে জানায়, এই গাড়ির ফিটনেসে সমস্যা আছে। কিন্তু চালকের দাবি ফিটনেসে কোনো সমস্যা নেই। চালক এরপর মালিকের সঙ্গে ফোনে কথা বলেন। এমনকি পুলিশের সঙ্গেও তার মালিককে ফোনে কথা বলিয়ে দেন। এভাবে চলতে থাকে সমঝোতার চেষ্টা। কিন্তু শেষ রক্ষা হয় না। অটোরিকশা নাকি তাকে রেখেই যেতে হবে। কিছুক্ষণ পর পুলিশ আবারও ঢোকে বক্সে, এরপর একটি রেকার বিলের রসিদ নিয়ে বেরিয়ে আসে।
রহিম জানান, জরিমানা করা হয়েছে ১ হাজার ২০০ টাকা। এ ধরনের ঘটনা সোনারগাঁও ট্রাফিক পুলিশ বক্সের নিত্যদিনের। প্রতিদিন কম করে হলেও ১০টি গাড়িকে জরিমানা করা হয়। কিছু গাড়ি ডাম্পিং করলেও অধিকাংশ ছেড়ে দেওয়া হয়।
সম্প্রতি ইস্কাটনে পরিবার নিয়ে ডাক্তার দেখাতে আসেন মোহাম্মদ সরস ভূঁইয়া। তাকে একটি হাসপাতালের সামনে নামিয়ে দেন তার নিজস্ব গাড়ির চালক মনির। নামিয়ে দেওয়ার দৃশ্য নিজ মোবাইলে ভিডিও ধারণ করে গাড়িটি আটকান ট্রাফিক সার্জেন্ট রেজাউল ও ট্রাফিক কনস্টেবল সেলিম। তাদের অভিযোগ- গাড়ির চালক মূল সড়কে তার মালিককে নামিয়েছেন, যা নিয়মবহির্ভূত।
এ সময় রেজাউল ও সেলিম ড্রাইভার মনির হোসেনের লাইসেন্স নিয়ে ৫ হাজার টাকার একটি মামলা দিতে চান। মনির গাড়ির নামে মামলা দিতে বলেন। কিন্তু পুলিশ গাড়ির নামে মামলা দিতে ইচ্ছুক নয়। পরে মনির তার বস সরসকে ফোন দেন। তখন সরস বলেন, ‘আমি ডাক্তারের চেম্বারে আছি। পুলিশকে সেটা বুঝিয়ে বলেন।’ পুলিশকে বোঝাতে গিয়ে উল্টো বিপদে পড়েন মনির। রেগে গিয়ে কনস্টেবল সেলিম বলেন, ‘এমপি-মন্ত্রী ফোন দিলেও মামলা দেব।’ পরে সার্জেন্ট রেজাউল গাড়ি রেকারে লাগিয়ে দেওয়ার ভয় দেখিয়ে একটি ভুয়া রসিদ দিয়ে ৬০০ টাকা আদায় করেন চালক মনিরের কাছ থেকে।
মনির অভিযোগ করে বলেন, ‘আমি ১০ বছরে কখনো আমার লাইসেন্সে মামলা খাইনি। সব সময় আইন মেনে গাড়ি চালাই। হঠাৎ ট্রাফিক কনস্টেবল সেলিম এসে আমাকে ধরেন এবং গাড়ি রেকার দেওয়ার ভয় দেখিয়ে রেকার বিলের রসিদ ধরিয়ে দেন। পরে নগদ ৬০০ টাকা দিতে হলো।’
একই দিনে বাংলামোটর মোড়ে ট্রাফিক কনস্টেবল জসিম এক মোটরসাইকেলচালকের বিরুদ্ধে মামলা দিতে চান। বক্সের মধ্যে ওই চালক তার পায়ে পড়েন। কিন্তু কনস্টেবল সেলিম কোনোভাবেই তা মানতে নারাজ। জসিম পাঠাওয়ের চালক। ৩০০ টাকা দিয়ে কোনোভাবে তিনি ম্যানেজ করেন কনস্টেবল সেলিমকে। এই মোটরসাইকেলটির নম্বরটি হচ্ছে- ঢাকা মেট্রো-ল-১৩৫৭৪৩।
সরেজমিনে রাজধানীর কারওয়ান বাজার, বাংলামোটরসহ বেশ কয়েকটি ট্রাফিক বক্স ঘুরে দেখা যায়, রাজধানীর বিভিন্ন ট্রাফিক পয়েন্টে এ ধরনের ঘটনা নিত্যদিনের। এই রেকার বিল নিয়ে চলে নয়ছয়। ট্রাফিক বক্সগুলো স্বচ্ছ কাচ দিয়ে ঘেরার কথা থাকলেও পুরোটাই টিনের বেড়া দেওয়া। তাই ভেতরে কী হয়, বাইরে থেকে দেখার কোনো সুযোগ নেই। সেই সুযোগ কাজে লাগিয়ে প্রতিনিয়ত বিভিন্ন কায়দায় অপরাধ করে যাচ্ছে কিছু সংখ্যক পুলিশ।
বিভিন্ন ভুক্তভোগীর অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে রেকার বিলের বিষয়ে অনুসন্ধান চালায় খবরের কাগজের অনুসন্ধানী টিম। অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে চাঞ্চল্যকর অনেক তথ্য। ইতোমধ্যে এ বিষয়ে বেশ কয়েকটি ভিডিও ফুটেজ ও ছবি খবরের কাগজের হাতে এসে পৌঁছেছে।
অনুসন্ধানে জানা যায়, ট্রাফিক পুলিশের কাছে রেকার বিলের দুটি রসিদ থাকে। এর মধ্যে একটি সরকারি রসিদ (আসল)। ওই সরকারি রসিদ অনুযায়ী সড়কে দায়িত্বপ্রাপ্ত কতিপয় ট্রাফিক সার্জেন্ট হুবহু নকল আরেকটি রসিদ বানিয়ে নিজেদের কাছে রেখে দেন। নকল ওই রসিদটি দেখে বোঝার উপায় নেই যে সেটি আসল নয়। রেকার লাগানোর পর কোনো চালকের সঙ্গে মীমাংসা হলে টাকা নিয়ে দেওয়া হয় নকল রসিদ। মীমাংসা না হলে মামলা দিয়ে তাকে সরকারি রসিদ দেওয়া হয়।
অনুসন্ধানে আরও জানা যায়, রিকশা, ভ্যান, মোটরসাইকেল, প্রাইভেট কার, সিএনজিচালিত অটোরিকশাসহ হালকা যানবাহনের জন্য ১ হাজার ২০০ টাকা এবং ট্রাক, বাস, বড় পিকআপ-ভ্যান, কার্গোসহ ভারী যানবাহনের জন্য রেকার বিল ২ হাজার টাকা। সন্ধ্যার পর থেকে সারা রাতই রেকারের ব্যবহার বাড়ে। অভিযোগ হচ্ছে- গাড়ির কাগজপত্র ঠিক নেই, চালকের লাইসেন্স নেই, গাড়ির ফিটনেস নেই। এরপর সুযোগ বুঝে আদায় করা হয় রেকার বিল। সমঝোতা হলে কখনো নকল রসিদ দিয়ে আদায় করা হয় টাকা। আবার কখনো রসিদ ছাড়াও টাকা নিয়ে ছেড়ে দেওয়া হয়।
ট্রাফিকের একটি বিশ্বস্ত সূত্র জানায়, অভিযোগ রয়েছে সার্জেন্ট থেকে শুরু করে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারাও এই টাকার ভাগ পেয়ে থাকেন। পুলিশের অবৈধভাবে আয়ের একটি বড় খাত এটি। তবে এখানে যে বড় ধরনের দুর্নীতি হচ্ছে, সেটিও শনাক্ত করা কঠিন।
সোনারগাঁও ট্রাফিক পুলিশ বক্সে দায়িত্বরত পুলিশ সদস্য মতিউর রহমান খবরের কাগজকে বলেন, ‘হালকা যানের জন্য ১ হাজার ২০০ ও ভারী যানের জন্য রেকার বিল ২ হাজার টাকা। তবে ঢাকার বাইরের গাড়ি হলে হিসাব অন্য রকম। এর বেশি তথ্য দিতে পারব না। আপনি ডিসির সঙ্গে কথা বলেন।’
দিনে কয়টি গাড়ি ডাম্পিং হয় জানতে চাইলে সোনারগাঁও ট্রাফিক বক্সের দায়িত্বরত পুলিশ সদস্য বুলবুল খবরের কাগজকে বলেন, কোনো দিন ১০টি, কোনো দিন তিন থেকে চারটি। অবৈধ যানবাহন ও যেসব যানবাহনে সমস্যা থাকে সেগুলাতেই রেকার লাগানো হয় বলে জানান তিনি।
রেকার বিল এবং সড়কে হালকা ও ভারী যানবাহন থেকে চাঁদাবাজি, অপহরণ, নির্যাতন থেকে শুরু করে ঘুষ, মাদক চোরাকারবার, মিথ্যা মামলায় ফাঁসানো, অবৈধভাবে আটক করাসহ পুলিশের বিরুদ্ধে নানাবিধ অভিযোগ রয়েছে। এসব অপরাধের অভিযোগ মূলত পুলিশ সুপার থেকে কনস্টেবল পদমর্যাদার পুলিশ সদস্যদের বিরুদ্ধে।
২০২২ সালের ১২ মে জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশনারের অফিসে বাংলাদেশ সরকারের সরবরাহ করা তথ্য অনুসারে, দেশের ২ লাখ ১৩ হাজার আইন প্রয়োগকারী বাহিনীর সদস্যের মধ্যে প্রায় ৯ দশমিক ৬ শতাংশ কেবল ২০২১ সালে বিভাগীয় তদন্তের মুখোমুখি হয়েছেন। ২০১৫ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত এই সংখ্যা ১ লাখ ১৭ হাজার বা বাহিনীর মোট সদস্য সংখ্যার ৫৫ শতাংশ। ওই সময়ের মধ্যে বাহিনীর সদস্যদের বিরুদ্ধে অন্তত ১ হাজার ৬৯২টি ফৌজদারি মামলা করা হয়।
২০২১ সালে মোট ১৭ হাজার ৯৬৬ জন সদস্য সতর্কতা, তিরস্কার বা অস্থায়ী বেতন হ্রাসের মতো ছোটখাটো শাস্তির মুখোমুখি হয়েছিলেন এবং ২ হাজার ৩৮৮ জন বরখাস্ত বা পদাবনতির মতো বড় শাস্তি পেয়েছেন।
তবে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়ার পরও এই পুলিশ সদস্যরা তাদের অপরাধমূলক কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছেন।
এ বিষয়ে সমাজ ও অপরাধ বিশেষজ্ঞ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহকারী অধ্যাপক তৌহিদুল হক খবরের কাগজকে বলেন, আর্থিক ফায়দা এবং সামাজিক প্রতিপত্তির চাহিদা থেকেই অপরাধমূলক কাজে জড়িয়ে পড়েন কতিপয় পুলিশ সদস্য।
পুলিশের নিয়োগ প্রক্রিয়ায় ব্যাপক অনিয়মের অভিযোগও রয়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, নিয়োগ-বাণিজ্যের মাধ্যমে চাকরিতে আসা ব্যক্তি বিনিয়োগ করা অর্থ তুলে নিতে চান, যা থেকেই শুরু হয় অনিয়মের। তাই তাদের অপরাধমূলক কাজ থেকে ফেরানো কঠিন।
রেকার বিলের এসব দুর্নীতির বিষয়ে কথা হয় অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার (ট্রাফিক) মো. মনিবুর রহমানের সঙ্গে। তিনি খবরের কাগজকে বলেন, ট্রাফিক সার্জেন্ট, কনস্টেবল ও ট্রাফিকে দায়িত্বরত কেউ যদি রেকার বিলের নকল রসিদ দিয়ে বিল আদায় করে ও প্রমাণ পাওয়া যায়, তবে তাদের বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলা হবে। তিনি বলেন, পুলিশের কোনো সদস্য অপরাধ করলে তাকে ছাড় দেওয়া হয় না। এ বিষয়ে কাজ করার জন্য পুলিশ সদর দপ্তরে একটি আলাদা সেলও রয়েছে। ওই সেলের কাজই হচ্ছে- সাধারণ মানুষের অভিযোগ নিয়ে কাজ করা। সেখানে প্রতিদিনই বিভিন্ন অভিযোগ জমা পড়ে। তদন্ত করে কর্তৃপক্ষ ব্যবস্থা নিয়ে থাকে। অপরাধ করলে কাউকে ছাড় দেওয়া হয় না।