ঢাকা ৬ ফাল্গুন ১৪৩১, বুধবার, ১৯ ফেব্রুয়ারি ২০২৫
English
বুধবার, ১৯ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ৬ ফাল্গুন ১৪৩১

রেকার বিলে দুর্নীতি: নকল রসিদে টাকা নেওয়ার অভিযোগ

প্রকাশ: ০৪ মে ২০২৪, ১০:৪৭ এএম
আপডেট: ০৪ মে ২০২৪, ১১:২১ এএম
রেকার বিলে দুর্নীতি: নকল রসিদে টাকা নেওয়ার অভিযোগ
পুলিশের রেকারের ছবিটি শুক্রবার রাজধানীর সার্ক ফোয়ারা এলাকা থেকে তোলা। ছবি: খবরের কাগজ

গত মঙ্গলবার বেলা আড়াইটা। রাজধানীর সোনারগাঁও ট্রাফিক পুলিশ বক্সের সিগন্যালে দাঁড়িয়ে আছে ঢাকা মেট্রো-দ ১১-২২-২৫ নম্বরের একটি সিএনজিচালিত অটোরিকশা। সিগন্যাল পার হওয়ার সময় অটোরিকশাটিকে থামানোর সংকেত দেন বুলবুল নামের ট্রাফিক পুলিশের একজন সদস্য। থেমে যায় অটোরিকশাটি। এরপর ট্রাফিক সার্জেন্ট অটোরিকশার চালক রহিমের কাগজপত্র দেখতে চান। কাগজ নিয়ে অটোরিকশা থেকে নেমে সার্জেন্টের সঙ্গে পুলিশ বক্সে ঢোকেন চালক। বক্সে ১০ মিনিটের মতো থাকার পর তিনি বের হয়ে আসেন।

পুলিশ তাকে জানায়, এই গাড়ির ফিটনেসে সমস্যা আছে। কিন্তু চালকের দাবি ফিটনেসে কোনো সমস্যা নেই। চালক এরপর মালিকের সঙ্গে ফোনে কথা বলেন। এমনকি পুলিশের সঙ্গেও তার মালিককে ফোনে কথা বলিয়ে দেন। এভাবে চলতে থাকে সমঝোতার চেষ্টা। কিন্তু শেষ রক্ষা হয় না। অটোরিকশা নাকি তাকে রেখেই যেতে হবে। কিছুক্ষণ পর পুলিশ আবারও ঢোকে বক্সে, এরপর একটি রেকার বিলের রসিদ নিয়ে বেরিয়ে আসে।

রহিম জানান, জরিমানা করা হয়েছে ১ হাজার ২০০ টাকা। এ ধরনের ঘটনা সোনারগাঁও ট্রাফিক পুলিশ বক্সের নিত্যদিনের। প্রতিদিন কম করে হলেও ১০টি গাড়িকে জরিমানা করা হয়। কিছু গাড়ি ডাম্পিং করলেও অধিকাংশ ছেড়ে দেওয়া হয়।

সম্প্রতি ইস্কাটনে পরিবার নিয়ে ডাক্তার দেখাতে আসেন মোহাম্মদ সরস ভূঁইয়া। তাকে একটি হাসপাতালের সামনে নামিয়ে দেন তার নিজস্ব গাড়ির চালক মনির। নামিয়ে দেওয়ার দৃশ্য নিজ মোবাইলে ভিডিও ধারণ করে গাড়িটি আটকান ট্রাফিক সার্জেন্ট রেজাউল ও ট্রাফিক কনস্টেবল সেলিম। তাদের অভিযোগ- গাড়ির চালক মূল সড়কে তার মালিককে নামিয়েছেন, যা নিয়মবহির্ভূত।

এ সময় রেজাউল ও সেলিম ড্রাইভার মনির হোসেনের লাইসেন্স নিয়ে ৫ হাজার টাকার একটি মামলা দিতে চান। মনির গাড়ির নামে মামলা দিতে বলেন। কিন্তু পুলিশ গাড়ির নামে মামলা দিতে ইচ্ছুক নয়। পরে মনির তার বস সরসকে ফোন দেন। তখন সরস বলেন, ‘আমি ডাক্তারের চেম্বারে আছি। পুলিশকে সেটা বুঝিয়ে বলেন।’ পুলিশকে বোঝাতে গিয়ে উল্টো বিপদে পড়েন মনির। রেগে গিয়ে কনস্টেবল সেলিম বলেন, ‘এমপি-মন্ত্রী ফোন দিলেও মামলা দেব।’ পরে সার্জেন্ট রেজাউল গাড়ি রেকারে লাগিয়ে দেওয়ার ভয় দেখিয়ে একটি ভুয়া রসিদ দিয়ে ৬০০ টাকা আদায় করেন চালক মনিরের কাছ থেকে।

মনির অভিযোগ করে বলেন, ‘আমি ১০ বছরে কখনো আমার লাইসেন্সে মামলা খাইনি। সব সময় আইন মেনে গাড়ি চালাই। হঠাৎ ট্রাফিক কনস্টেবল সেলিম এসে আমাকে ধরেন এবং গাড়ি রেকার দেওয়ার ভয় দেখিয়ে রেকার বিলের রসিদ ধরিয়ে দেন। পরে নগদ ৬০০ টাকা দিতে হলো।’

একই দিনে বাংলামোটর মোড়ে ট্রাফিক কনস্টেবল জসিম এক মোটরসাইকেলচালকের বিরুদ্ধে মামলা দিতে চান। বক্সের মধ্যে ওই চালক তার পায়ে পড়েন। কিন্তু কনস্টেবল সেলিম কোনোভাবেই তা মানতে নারাজ। জসিম পাঠাওয়ের চালক। ৩০০ টাকা দিয়ে কোনোভাবে তিনি ম্যানেজ করেন কনস্টেবল সেলিমকে। এই মোটরসাইকেলটির নম্বরটি হচ্ছে- ঢাকা মেট্রো-ল-১৩৫৭৪৩।

সরেজমিনে রাজধানীর কারওয়ান বাজার, বাংলামোটরসহ বেশ কয়েকটি ট্রাফিক বক্স ঘুরে দেখা যায়, রাজধানীর বিভিন্ন ট্রাফিক পয়েন্টে এ ধরনের ঘটনা নিত্যদিনের। এই রেকার বিল নিয়ে চলে নয়ছয়। ট্রাফিক বক্সগুলো স্বচ্ছ কাচ দিয়ে ঘেরার কথা থাকলেও পুরোটাই টিনের বেড়া দেওয়া। তাই ভেতরে কী হয়, বাইরে থেকে দেখার কোনো সুযোগ নেই। সেই সুযোগ কাজে লাগিয়ে প্রতিনিয়ত বিভিন্ন কায়দায় অপরাধ করে যাচ্ছে কিছু সংখ্যক পুলিশ।

বিভিন্ন ভুক্তভোগীর অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে রেকার বিলের বিষয়ে অনুসন্ধান চালায় খবরের কাগজের অনুসন্ধানী টিম। অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে চাঞ্চল্যকর অনেক তথ্য। ইতোমধ্যে এ বিষয়ে বেশ কয়েকটি ভিডিও ফুটেজ ও ছবি খবরের কাগজের হাতে এসে পৌঁছেছে।

অনুসন্ধানে জানা যায়, ট্রাফিক পুলিশের কাছে রেকার বিলের দুটি রসিদ থাকে। এর মধ্যে একটি সরকারি রসিদ (আসল)। ওই সরকারি রসিদ অনুযায়ী সড়কে দায়িত্বপ্রাপ্ত কতিপয় ট্রাফিক সার্জেন্ট হুবহু নকল আরেকটি রসিদ বানিয়ে নিজেদের কাছে রেখে দেন। নকল ওই রসিদটি দেখে বোঝার উপায় নেই যে সেটি আসল নয়। রেকার লাগানোর পর কোনো চালকের সঙ্গে মীমাংসা হলে টাকা নিয়ে দেওয়া হয় নকল রসিদ। মীমাংসা না হলে মামলা দিয়ে তাকে সরকারি রসিদ দেওয়া হয়।

অনুসন্ধানে আরও জানা যায়, রিকশা, ভ্যান, মোটরসাইকেল, প্রাইভেট কার, সিএনজিচালিত অটোরিকশাসহ হালকা যানবাহনের জন্য ১ হাজার ২০০ টাকা এবং ট্রাক, বাস, বড় পিকআপ-ভ্যান, কার্গোসহ ভারী যানবাহনের জন্য রেকার বিল ২ হাজার টাকা। সন্ধ্যার পর থেকে সারা রাতই রেকারের ব্যবহার বাড়ে। অভিযোগ হচ্ছে- গাড়ির কাগজপত্র ঠিক নেই, চালকের লাইসেন্স নেই, গাড়ির ফিটনেস নেই। এরপর সুযোগ বুঝে আদায় করা হয় রেকার বিল। সমঝোতা হলে কখনো নকল রসিদ দিয়ে আদায় করা হয় টাকা। আবার কখনো রসিদ ছাড়াও টাকা নিয়ে ছেড়ে দেওয়া হয়।

ট্রাফিকের একটি বিশ্বস্ত সূত্র জানায়, অভিযোগ রয়েছে সার্জেন্ট থেকে শুরু করে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারাও এই টাকার ভাগ পেয়ে থাকেন। পুলিশের অবৈধভাবে আয়ের একটি বড় খাত এটি। তবে এখানে যে বড় ধরনের দুর্নীতি হচ্ছে, সেটিও শনাক্ত করা কঠিন।

সোনারগাঁও ট্রাফিক পুলিশ বক্সে দায়িত্বরত পুলিশ সদস্য মতিউর রহমান খবরের কাগজকে বলেন, ‘হালকা যানের জন্য ১ হাজার ২০০ ও ভারী যানের জন্য রেকার বিল ২ হাজার টাকা। তবে ঢাকার বাইরের গাড়ি হলে হিসাব অন্য রকম। এর বেশি তথ্য দিতে পারব না। আপনি ডিসির সঙ্গে কথা বলেন।’

দিনে কয়টি গাড়ি ডাম্পিং হয় জানতে চাইলে সোনারগাঁও ট্রাফিক বক্সের দায়িত্বরত পুলিশ সদস্য বুলবুল খবরের কাগজকে বলেন, কোনো দিন ১০টি, কোনো দিন তিন থেকে চারটি। অবৈধ যানবাহন ও যেসব যানবাহনে সমস্যা থাকে সেগুলাতেই রেকার লাগানো হয় বলে জানান তিনি।

রেকার বিল এবং সড়কে হালকা ও ভারী যানবাহন থেকে চাঁদাবাজি, অপহরণ, নির্যাতন থেকে শুরু করে ঘুষ, মাদক চোরাকারবার, মিথ্যা মামলায় ফাঁসানো, অবৈধভাবে আটক করাসহ পুলিশের বিরুদ্ধে নানাবিধ অভিযোগ রয়েছে। এসব অপরাধের অভিযোগ মূলত পুলিশ সুপার থেকে কনস্টেবল পদমর্যাদার পুলিশ সদস্যদের বিরুদ্ধে।

২০২২ সালের ১২ মে জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশনারের অফিসে বাংলাদেশ সরকারের সরবরাহ করা তথ্য অনুসারে, দেশের ২ লাখ ১৩ হাজার আইন প্রয়োগকারী বাহিনীর সদস্যের মধ্যে প্রায় ৯ দশমিক ৬ শতাংশ কেবল ২০২১ সালে বিভাগীয় তদন্তের মুখোমুখি হয়েছেন। ২০১৫ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত এই সংখ্যা ১ লাখ ১৭ হাজার বা বাহিনীর মোট সদস্য সংখ্যার ৫৫ শতাংশ। ওই সময়ের মধ্যে বাহিনীর সদস্যদের বিরুদ্ধে অন্তত ১ হাজার ৬৯২টি ফৌজদারি মামলা করা হয়।

২০২১ সালে মোট ১৭ হাজার ৯৬৬ জন সদস্য সতর্কতা, তিরস্কার বা অস্থায়ী বেতন হ্রাসের মতো ছোটখাটো শাস্তির মুখোমুখি হয়েছিলেন এবং ২ হাজার ৩৮৮ জন বরখাস্ত বা পদাবনতির মতো বড় শাস্তি পেয়েছেন।

তবে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়ার পরও এই পুলিশ সদস্যরা তাদের অপরাধমূলক কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছেন।

এ বিষয়ে সমাজ ও অপরাধ বিশেষজ্ঞ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহকারী অধ্যাপক তৌহিদুল হক খবরের কাগজকে বলেন, আর্থিক ফায়দা এবং সামাজিক প্রতিপত্তির চাহিদা থেকেই অপরাধমূলক কাজে জড়িয়ে পড়েন কতিপয় পুলিশ সদস্য।

পুলিশের নিয়োগ প্রক্রিয়ায় ব্যাপক অনিয়মের অভিযোগও রয়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, নিয়োগ-বাণিজ্যের মাধ্যমে চাকরিতে আসা ব্যক্তি বিনিয়োগ করা অর্থ তুলে নিতে চান, যা থেকেই শুরু হয় অনিয়মের। তাই তাদের অপরাধমূলক কাজ থেকে ফেরানো কঠিন।

রেকার বিলের এসব দুর্নীতির বিষয়ে কথা হয় অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার (ট্রাফিক) মো. মনিবুর রহমানের সঙ্গে। তিনি খবরের কাগজকে বলেন, ট্রাফিক সার্জেন্ট, কনস্টেবল ও ট্রাফিকে দায়িত্বরত কেউ যদি রেকার বিলের নকল রসিদ দিয়ে বিল আদায় করে ও প্রমাণ পাওয়া যায়, তবে তাদের বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলা হবে। তিনি বলেন, পুলিশের কোনো সদস্য অপরাধ করলে তাকে ছাড় দেওয়া হয় না। এ বিষয়ে কাজ করার জন্য পুলিশ সদর দপ্তরে একটি আলাদা সেলও রয়েছে। ওই সেলের কাজই হচ্ছে- সাধারণ মানুষের অভিযোগ নিয়ে কাজ করা। সেখানে প্রতিদিনই বিভিন্ন অভিযোগ জমা পড়ে। তদন্ত করে কর্তৃপক্ষ ব্যবস্থা নিয়ে থাকে। অপরাধ করলে কাউকে ছাড় দেওয়া হয় না।

বর্ধিত ভ্যাট-শুল্ক কমানোর দাবিতে অনড় ব্যবসায়ীরা

প্রকাশ: ১৯ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ০৬:১০ এএম
আপডেট: ১৯ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ১২:০০ এএম
বর্ধিত ভ্যাট-শুল্ক কমানোর দাবিতে অনড় ব্যবসায়ীরা

ব্যাপক সমালোচনা ও চাপের মুখে ৯টি পণ্য ও সেবায় বাড়তি ভ্যাট ও সম্পূরক শুল্ককর কমিয়েছে সরকার। তবে এখনো বেশির ভাগ পণ্য ও সেবায় তা রয়েই গেছে। ব্যবসায়ীরা বর্ধিত ভ্যাট ও সম্পূরক শুল্ক কমানোর দাবি জানালেও আমলে নিচ্ছে না জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। তবে ব্যবসায়ীরাও দাবি আদায়ে অনড় রয়েছেন।

ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআইয়ের সাবেক সভাপতি এ কে আজাদ খবরের কাগজকে বলেন, ‘অর্থবছরের মাঝামাঝি সময়ে এসে প্রায় ১০০ পণ্য ও সেবায় ভ্যাট ও সম্পূরক শুল্ক বাড়ানো হয়েছে। এর প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ প্রভাবে খরচ বেড়েছে অনেক খাতে। ব্যবসায়ীরা করোনার সময়ে ব্যবসা করতে পারেননি। করোনার পর শুরু হয় রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ। এই যুদ্ধের প্রভাবে এখনো আমরা ঠিকমতো ব্যবসা করতে পারছি না। এমন পরিস্থিতিতে বর্ধিত ভ্যাট ও সম্পূরক শুল্ক বাড়ানোর ফলে আমাদের ওপর চাপ আরও বেড়েছে। বাড়তি চাপ সামলাতে না পেরে অনেকে ব্যবসা বন্ধ করে দিতে বাধ্য হবেন।’

একই মত জানিয়ে এফবিসিসিআইয়ের আরেক সাবেক সভাপতি আবদুল আউয়াল মিন্টু খবরের কাগজকে বলেন, ‘এরই মধ্যে অনেক ব্যবসায়ী সরকারের নীতিনির্ধারকদের সঙ্গে যোগাযোগ করে বর্ধিত ভ্যাট ও সম্পূরক শুল্ক কমানোর দাবি জানিয়েছেন। এসব দাবি বাস্তবায়ন হতে দেখছি না। আশা করি এনবিআর বিষয়টি বিবেচনা করবে।’

বর্ধিত ভ্যাট ও সম্পূরক শুল্ক কমানোর প্রজ্ঞাপন জারির পর ব্যবসায়ীদের মধ্যে ব্যাপক প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে। অনেক সংগঠন সংবাদ সম্মেলন করেও বর্ধিত ভ্যাট ও সম্পূরক শুল্ক কমানোর দাবি জানিয়েছে। অটোমোবাইল ও হোটেল-রেস্তোরাঁ খাতের ব্যবসায়ীরা রাজপথে নামেন। এনবিআরের সামনে অনেক ব্যবসায়ী সংগঠনের পক্ষ থেকে অবস্থান কর্মসূচিও পালন করা হয়।

এনবিআর চেয়ারম্যান আবদুর রহমান খান খবরের কাগজকে বলেন, ‘গত মাসে (জানুয়ারি) অধ্যাদেশ জারি করে কয়েকটি খাতে পণ্য ও সেবায় ভ্যাট ও সম্পূরক শুল্ক বাড়ানো হয়েছে। এরই মধ্যে বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের পরামর্শে কিছু খাতের বর্ধিত ভ্যাট ও সম্পূরক শুল্ক সমন্বয় করা হয়েছে। আরও অনেকে বর্ধিত ভ্যাট ও সম্পূরক শুল্ক কমানোর দাবি জানিয়েছেন। তাৎক্ষিণকভাবে এসব কমানো সম্ভব নয়। অনেক হিসাবের বিষয় আছে। আগামী ২০২৫-২৬ অর্থবছরের বাজেটে এসব বিষয় নিয়ে ভেবে দেখা হবে। নতুন বাজেট প্রণয়নের কাজ এরই মধ্যে শুরু হয়েছে।

গত এক মাসে অনেক ব্যবসায়ী ব্যক্তিগতভাবে এনবিআর চেয়ারম্যান ও অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদের সঙ্গে দেখা করে বর্ধিত ভ্যাট ও সম্পূরক শুল্ক কমানোর দাবি জানিয়েছেন। ব্যবসায়ী সংগঠনের প্রতিনিধিরা এক জোট হয়ে দেখা করে একই দাবি করেছেন। তবে এসব বৈঠক থেকে বর্ধিত ভ্যাট ও সম্পূরক শুল্ক কমানো হবে এমন নিশ্চয়তা পাওয়া যায়নি।

প্রাণ-আরএফএল গ্রুপের চেয়ারম্যান আহসান খান চৌধুরী খবরের কাগজকে বলেন, ‘ভ্যাট, কর ও শুল্কহার এমনভাবে নির্ধারণ করতে হবে যেন ব্যবসায়ীদের ওপর চাপ না পড়ে। ভ্যাট, কর ও শুল্কের ভারে ব্যবসায়ীরা ব্যবসা করতে না পারলে রাজস্ব পরিশোধ করবেন কীভাবে? বিষয়টি সরকারকে লক্ষ্য রাখতে হবে। দেশকে এগিয়ে নিতে কর্মসংস্থান ও রাজস্ব বাড়াতে ব্যবসায়ীদের দরকার আছে। তাই ব্যবসায়ীদের দাবি বিবেচনায় নিয়ে আলোচনার মাধ্যমে ভ্যাট, কর ও শুল্কহার ধার্য করা প্রয়োজন।’

তিনি হিসাব কষে বলেন, ‘আমরা প্রান্তিক কৃষকের কাছ থেকে আম, টমেটো, আনারস, কলাসহ বিভিন্ন কৃষিপণ্য কিনে প্রক্রিয়াজাত করে জুস, ড্রিংকস, আচার, সস তৈরি করি। টমেটো, আম, আনারস, পেয়ারা ও কলার পাল্পের ওপর ভ্যাট ৫ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ১৫ শতাংশ করা হয়েছে। এতে খরচ বাড়বে। বর্ধিত ভ্যাটের কারণে প্রকৃতপক্ষে ক্ষতিগ্রস্ত হবেন প্রান্তিক চাষিরা। অন্যদিকে প্রক্রিয়াজাত পণ্যের দাম বাড়াতে বাধ্য হবে ব্যবসায়ীরা। দাম বাড়ার কারণে অনেকেই এসব পণ্য কিনবেন না। এভাবে উৎপাদন খরচ বাড়ায় ব্যবসা কমিয়ে আনতে হবে। কারখানা বন্ধ হলে অনেক শ্রমিক বেকার হবেন।’

বর্ধিত ভ্যাট ও সম্পূরক শুল্ক কমানোর দাবি জানিয়ে বিভিন্ন ব্যবসায়ী সংগঠন থেকে এনবিআরে আবেদন করা হয়েছে। এসব আবেদনে অর্থবছরের মাঝামাঝি ভ্যাট ও সম্পূরক শুল্ক বাড়ানোর ফলে ব্যবসায়ে খরচ বেড়েছে অভিযোগ করে আরোপিত ভ্যাট ও সম্পূরক শুল্ক প্রত্যাহারের দাবি জানানো হয়েছে।

বাংলাদেশ অটো বিস্কুট অ্যান্ড ব্রেড ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি শফিকুর রহমান ভূঁইয়া খবরের কাগজকে বলেন, ‘নিত্যপণ্যে যদি ভ্যাট থাকে, তাহলে ব্যবসায়ীরা কীভাবে ব্যবসা করবেন? এরই মধ্যে আমরা সরকারের নীতিনির্ধারকদের কাছে বর্ধিত ভ্যাট ও সম্পূরক শুল্ক কমানোর জোরালো আবেদন করেছি। কিন্তু আমাদের দাবি এখনো বাস্তবায়ন করা হয়নি। কবে বাস্তবায়ন করা হবে তার আশ্বাসও পাওয়া যায়নি।’

বর্ধিত ভ্যাট কমানোর দাবিতে এনবিআরে জমা দেওয়া আবেদনে বাংলাদেশ অ্যাগ্রো প্রসেসরস অ্যাসোসিয়েশন (বাপা) থেকে বলা হয়েছে, সংগঠনের প্রায় ৪০০ সক্রিয় সদস্য রয়েছেন। এর বাইরেও পাঁচ শতাধিক প্রতিষ্ঠান কৃষি প্রক্রিয়াজাতকরণ খাদ্যপণ্য উৎপাদন করছে। এসব প্রতিষ্ঠানে ৫ লাখ শ্রমিক কর্মরত আছেন। কাঁচামাল সরবরাহকারী, খুচরা বিক্রেতাসহ পরোক্ষভাবে বিপুলসংখ্যক মানুষ এ খাতে যুক্ত। হঠাৎ এ ধরনের উদ্যোগে সবাই ক্ষতিগ্রস্ত হবেন। কৃষি ও প্রক্রিয়াজাত খাদ্যপণ্য শীর্ষ পাঁচ রপ্তানি খাতের একটি। আমেরিকা, ইউরোপ, মধ্যপ্রাচ্য ও আফ্রিকা অঞ্চলের সুপারশপেও এখন বাংলাদেশে তৈরি প্রক্রিয়াজাত খাদ্যপণ্যের সরবরাহ বেড়েছে। এ খাতে রপ্তানি ১০০ কোটি ডলার ছাড়িয়েছে। এখন বর্ধিত ভ্যাট আরোপের ফলে এ খাত মুখথুবড়ে পড়বে। ভারত, পাকিস্তান, থাইল্যান্ড ও ভিয়েতনামের কাছে বাজার হারাবে বাংলাদেশ।

বাপার সভাপতি এম এ হাশেম খবরের কাগজকে বলেন, ‘প্রক্রিয়াজাত খাদ্যপণ্যে বর্ধিত ভ্যাট ও শুল্ক আরোপের ফলে দাম বেড়ে গেলে পণ্য কেনা কমিয়ে দেবেন ভোক্তারা। স্বাভাবিকভাবে কোম্পানিগুলোও কাঁচামাল হিসেবে কৃষিপণ্য সংগ্রহ কমিয়ে দেবেন। সে ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবেন কৃষকরা। তারা ফসলের ভালো দাম পাবেন না।’

এনবিআরে জমা দেওয়া ব্যবসায়ী সংগঠনের আবেদনে হিসাব কষে দেখানো হয়েছে, ভ্যাটের হার বাড়িয়ে অনেক খাতে ১৫ শতাংশ ধার্য করা হয়েছে। এ হারের সঙ্গে বিভিন্ন ধাপে ভ্যাট যোগ হয়ে শেষ পর্যন্ত ২০-২৫ শতাংশ পর্যন্ত পরিশোধ করতে হবে ভোক্তাকে। এর মধ্যে ব্যাংকঋণের সুদের হার ১৫-১৬ শতাংশ পর্যন্ত হয়েছে। বর্ধিত ভ্যাট ও সম্পূরক শুল্ক আরোপের কারণে ব্যবসা ও শিল্পে মুনাফা কমবে। অনেক প্রতিষ্ঠান লোকসানে পড়বে। 

বিআইডিএসের সাবেক মহাপরিচালক মুস্তফা কে মুজেরী খবরের কাগজকে বলেন, ‘অর্থবছরের মাঝপথে ভ্যাটের হার বাড়ানোর সিদ্ধান্ত ঠিক মনে করি না। এই সিদ্ধান্তের ফলে ব্যবসায়ীরা বিপাকে পড়বেন। মনে রাখতে হবে, এনবিআর ও ব্যবসাযীরা একে অন্যের সহযোগী, প্রতিপক্ষ না।’ 

সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম খবরের কাগজকে বলেন, ‘ব্যবসায়ীদের চাপে রেখে অর্থনীতি গতিশীল করা যায় না। বরং ব্যবসার পরিবেশ নিশ্চিত করে, রাজস্ব ছাড় দিয়ে ব্যবসা-বাণিজ্য গতিশীল করতে হবে। এতে রাজস্ব আদায় বাড়বে।’

কমছে ট্রেজারি বিল-বন্ডের সুদহার, বাড়বে বিনিয়োগ

প্রকাশ: ১৯ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ০৩:০৫ এএম
আপডেট: ১৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ১১:৫৯ পিএম
কমছে ট্রেজারি বিল-বন্ডের সুদহার, বাড়বে বিনিয়োগ
ছবি: সংগৃহীত

সরকারের ঋণের চাহিদা কিছুটা কমে যাওয়ায় এবং ব্যাংকগুলোর আগ্রহ বেড়ে যাওয়ায় ট্রেজারি বিল ও বন্ডে সুদহার কমছে। এতে পর্যায়ক্রমে ব্যাংকঋণের সুদহারও অনেকটাই কমে আসবে। সেই সঙ্গে বেসরকারি খাতে বিনিয়োগ বাড়বে। সংশ্লিষ্টরা এ মত প্রকাশ করেছেন। তাদের মতে, প্রথমত- এবারের মুদ্রানীতিতে নীতি সুদহার বাড়ানো হয়নি, ফলে ঋণের সুদহার বাড়বে না। দ্বিতীয়ত, সরকারের ঋণের চাহিদা কমে যাওয়ায় ট্রেজারি বিল-বন্ডের সুদহারও অনেকটাই কমে আসছে। অর্থাৎ ব্যাংকগুলোর হাতে পর্যাপ্ত তারল্য থাকছে। ফলে বেসরকারি খাত প্রয়োজন অনুযায়ী ঋণ পাবে। বিনিয়োগের দুয়ার আরও সম্প্রসারিত হবে।

এই প্রসঙ্গে জানতে চাইলে বিশ্বব্যাংকের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন খবরের কাগজকে বলেন, ‘সম্প্রতি সরকারি ট্রেজারি বিল-বন্ডে উল্লেখযোগ্য হারে সুদের হার কমে গেছে। এতে ব্যাংকগুলোর ব্যক্তি খাতে বিনিয়োগের আগ্রহ বাড়বে। এতদিন ট্রেজারি বিল ও বন্ডে বিনিয়োগ করে ঝুঁকিবিহীনভাবে মুনাফা করেছে ব্যাংকগুলো। এখন সুদের হার কমে যাওয়ায় মুনাফাও কমবে। ফলে তারা এখন ঝুঁকি নিয়ে হলেও বেশি মুনাফার আশায় ব্যক্তি খাতে বিনিয়োগ করবে। তবে বিনিয়োগের পরিবর্তে ব্যক্তি খাতে ব্যয় বাড়লে মূল্যস্ফীতির ঝুঁকি থেকেই যাবে। যথাযথভাবে বিনিয়োগ বাড়লে জিডিপি প্রবৃদ্ধির সম্ভাবনা স্ফীত হবে।’

একই বিষয়ে ঢাকা চেম্বারের সাবেক সভাপতি শামস মাহমুদ খবরের কাগজকে বলেন, ‘বাংলাদেশ ব্যাংকের সাম্প্রতিক কিছু স্বল্পমেয়াদি উদ্যোগে বেসরকারি খাত কিছুটা চাপ অনুভব করেছে। তবে তার সুফল এখন দেখা যাচ্ছে। মুদ্রানীতিতে নীতি সুদহার না বাড়ানো একটা ইতিবাচক পদক্ষেপ। আবার ট্রেজারি বিল-বন্ডের সুদহারও অনেকটা কমে গেছে। অর্থাৎ বাংলাদেশ ব্যাংক যথাযথভাবে তার নীতি পরিপালন করছে। এটা অত্যন্ত ইতিবাচক একটা দিক। এখন গ্যাস-বিদ্যুতের সমস্যার সমাধান হলে এবং আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতি হলে আগামী রোজার ঈদের পরে বেসরকারি খাতের উদ্যোক্তারা নতুন বিনিয়োগ শুরু করতে পারবেন।’

বাংলাদেশ ব্যাংকের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত তথ্যে দেখা গেছে, ট্রেজারি বিল ও বন্ডের সুদহার যেখানে সর্বোচ্চ প্রায় ১২ শতাংশে উঠে গিয়েছিল তা এখন ১০ শতাংশে নেমে এসেছে।

ট্রেজারি বিল ও বন্ড হলো একটি স্বল্পমেয়াদি আর্থিক ঋণপত্র যা একটি নির্দিষ্ট সময়ের জন্য সরকার জারি করে। সাধারণত এগুলো এক বছর বা এর কম মেয়াদি হয়ে থাকে। এটি একটি নিরাপদ এবং কম ঝুঁকিপূর্ণ বিনিয়োগ হিসেবেও পরিচিত। কারণ এর ওপর সুদ প্রাপ্তির নিশ্চয়তা থাকে এবং সরকারের পক্ষে ইস্যু করা হয়। ট্রেজারি বিল ও বন্ড সাধারণত যেকোনো প্রতিষ্ঠান কিংবা ব্যক্তি কিনতে পারেন। তবে গত কয়েক বছর ধরে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো তাদের অতিরিক্ত তারল্য ট্রেজারি বিল-বন্ডে বিনিয়োগ করছে। এর ফলে বেসরকারি খাতে চাহিদা অনুযায়ী ঋণ ছাড় হচ্ছে না।

বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো থেকে সরকার বেশি ঋণ নেওয়ায় বিদায়ী ২০২৩-২৪ অর্থবছরের বেশির ভাগ সময়েই বেসরকারি খাতে কমেছে ঋণ প্রবৃদ্ধি। চলতি অর্থবছরেও একই ধারা বহাল রয়েছে। অর্থবছরের প্রথম ছয় মাস শেষে বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধির হার দাঁড়িয়েছে ৭ দশমিক ২৮ শতাংশ। যা গত ১০ বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন। শুধু তাই নয়, এ সময় শিল্পের প্রয়োজনীয় মধ্যবর্তী পণ্য এবং মূলধনি যন্ত্রপাতি আমদানিও ব্যাপক হারে কমেছে। এ সময় মূলধনি যন্ত্রপাতি আমদানির জন্য ঋণপত্র বা এলসি খোলার হার গত অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় কমেছে ৩৪ শতাংশ। একইভাবে মূলধনি যন্ত্রপাতি আমদানির ঋণপত্র নিষ্পত্তি কমেছে ২৭ শতাংশ। একই সময়ে শিল্পের মধ্যবর্তী পণ্য আমদানিও উল্লেখযোগ্য হারে কমেছে। এ ছাড়া, সবশেষ প্রকাশিত জিডিপির তথ্যে দেখা গেছে, প্রথম তিন মাসে (জুলাই-সেপ্টেম্বর) সময়ে চলতি মূল্যে জিডিপির হার দাঁড়িয়েছে ১ দশমিক ৮১ শতাংশ। যা গত বছরের একই সময়ে ছিল ৬ দশমিক ৪ শতাংশ।

এমন পরিস্থিতিতে উদ্বেগ প্রকাশ করে অর্থনীতিবিদরা সরকারকে ব্যাংকমুখী না হয়ে রাজস্ব আদায় বাড়ানোর দিকে মনোযোগ দেওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন। তারা বলেছেন, সাধারণত বাণিজ্যিক ব্যাংক থেকে সরকারের ঋণ বাড়লে বেসরকারি খাত প্রয়োজনীয় ঋণের জোগান থেকে বঞ্চিত হয়। এ কারণে বাণিজ্যিক ব্যাংক থেকে যত সম্ভব কম ঋণ নেওয়ার পরামর্শ দেন তারা।

এই বিষয়ে জ্যেষ্ঠ অর্থনীতিবিদ ও সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা ড. মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম খবরের কাগজকে বলেন, ‘বর্তমানে বেশ কিছু বাণিজ্যিক ব্যাংকে তারল্য সংকট দেখা যাচ্ছে। এর মধ্যে যদি সরকার বেশি ঋণ নেয় তাহলে বেসরকারি খাত ক্ষতিগ্রস্ত হবে। এতে বিনিয়োগ কম হবে, আর বিনিয়োগ কম হলে কর্মসংস্থান কম হবে। ফলে প্রবৃদ্ধির ওপর চাপ সৃষ্টি হবে। এমন অবস্থায় সরকারকে ব্যাংক থেকে বেশি ঋণ না নিয়ে রাজস্ব আয় বাড়াতে হবে।’

এদিকে বাস্তবতার আলোকে ও অর্থনীতিবিদদের পরামর্শ মেনে সরকারও খরচ কমানোর দিকে মনোযোগ দিয়েছে। এরই মধ্যে অপ্রয়োজনীয় অনেক প্রকল্প বাতিল করা হয়েছে। এতে সরকারের ব্যয় অনেক কমে আসছে। সে জন্য সরকার ব্যাংক থেকে ঋণ নেওয়ার লক্ষ্যমাত্রাও অনেক কমিয়ে দিয়েছে।

চলতি অর্থবছর বাজেট ঘাটতি মেটাতে ব্যাংক খাত থেকে ১ লাখ ৩৭ হাজার ৫০০ কোটি টাকা ঋণের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছিল সরকার। সম্প্রতি সেটা কমিয়ে সংশোধিত লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে ৯৯ হাজার কোটি টাকা।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, গত ৩০ জানুয়ারি শেষে সরকারের মোট ব্যাংকঋণের স্থিতি দাঁড়িয়েছে ৪ লাখ ৮৮ হাজার ৬০ কোটি টাকা। গত ৩০ জুন শেষে যা ছিল ৪ লাখ ৭৪ হাজার ৪৮৯ কোটি টাকা। এই হিসাবে অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসে সরকারের নিট ব্যাংকঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে মাত্র ১৩ হাজার ৫৭১ কোটি টাকা।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, বর্তমানে সার্বিকভাবে ব্যাংকের আমানত খুব বেশি না বাড়লেও ভালো ব্যাংকগুলোতে আমানতের প্রবৃদ্ধি হচ্ছে। দুর্বল ব্যাংকগুলো থেকে আমানত তুলে অনেকে ভালো ব্যাংকে রাখছেন। অন্যদিকে বেসরকারি খাতে ঋণের চাহিদাও কমে আসছে। সব মিলিয়ে ব্যাংকগুলোতে তারল্য বাড়ছে। আর এই তারল্য ব্যাংকগুলো ঝুঁকিবিহীন নিরাপদ বিনিয়োগ হিসেবে ট্রেজারি বিল-বন্ডে বিনিয়োগ করছে। এখন সরকারের চাহিদা কিছুটা কমায় ব্যাংকের পক্ষ থেকে চাইলেও বেশি বিনিয়োগ করা সম্ভব হবে না। এই অবস্থায় কিছুটা ঝুঁকি নিয়ে হলেও বেশি লাভের আশায় বেসরকারি খাতে বিনিয়োগ করবে ব্যাংকগুলো।

এই বিষয়ে মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান নির্বাহী সৈয়দ মাহবুবুর রহমান বলেন, ‘অধিকাংশ ব্যাংকে পর্যাপ্ত তারল্য আছে। আবার বেসরকারি খাতেও ঋণের খুব বেশি চাহিদা ছিল না। তাই ব্যাংকগুলো ট্রেজারি বিল-বন্ডে বেশি বিনিয়োগ করেছে। কিন্তু এখন সরকার নিট ঋণ নেওয়া কমিয়ে দিয়েছে- খরচ কমাতে চাইছে। এই অবস্থায় বেসরকারি খাতে চাহিদা বাড়লে ব্যাংকগুলো সেখানেই বিনিয়োগ করবে।

পুলিশে আগে ছিল অনাস্থা, এখন ভয় কম

প্রকাশ: ১৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ০১:৩৯ পিএম
আপডেট: ১৯ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ০৩:২৫ পিএম
পুলিশে আগে ছিল অনাস্থা, এখন ভয় কম
খবরের কাগজ ইনফোগ্রাফ

৫ ফেব্রুয়ারি বেলা আড়াইটা, রাজধানীর ব্যস্ততম এলাকা ফার্মগেটের পশ্চিম পাশে খামারবাড়ি ট্রাফিক সিগন্যাল। এই সিগন্যালে গণপরিবহনের জটলার মধ্যে দাঁড়িয়ে ছিল একটি ব্যাটারিচালিত রিকশা। সিগন্যাল ছাড়তেই ফার্মগেট হয়ে কারওয়ান বাজারের দিকে অন্যান্য যানবাহনের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে ছুটতে শুরু করে রিকশাটি। খামারবাড়ি সিগন্যালে দায়িত্বরত ট্রাফিক পুলিশ রিকশাটিকে থামাতে না পারলেও কারওয়ান বাজারে আসার পর পুলিশ সার্জেন্ট সেটি আটকানোর চেষ্টা করেন। রিকশায় থাকা যাত্রী নেমে যাওয়ার পর পেছন থেকে তিন চাকার ‘পঙ্খিরাজ’ নামের বাহনটি আটকানোর চেষ্টা করলে পুলিশের সঙ্গে ওই চালকের কথা-কাটাকাটি শুরু হয়। এরপর শুরু হয় ধস্তাধস্তি। এর একপর্যায়ে রিকশাটি উল্টে যায়। পরে রিকশাটি আটকে রাখে পুলিশ।

একই দিনে রাজধানীর নজরুল ইসলাম অ্যাভিনিউর এই ভিআইপি সড়কে সাধারণ মানুষকে ফুটওভার ব্রিজ ব্যবহার না করে যত্রতত্র রাস্তা পার হতে দেখা গেছে। পুলিশ সদস্যরা পথচারীদের সতর্ক করলেও কোনোভাবেই মানানো যাচ্ছে না তাদের। পুলিশকে তোয়াক্কা করছেন না পথচারীরা।

পুলিশকে ভয় না পাওয়ার এই প্রবণতা শুরু হয়েছে গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর থেকেই। কারণ হিসেবে বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, শেখ হাসিনার প্রায় ১৬ বছরের শাসনে জনগণের সঙ্গে পুলিশের একধরনের অনাস্থার সম্পর্ক তৈরি হয়েছিল। দলীয়করণের ফলে বিরোধী দলগুলোর পাশাপাশি জনগণের বড় অংশই মনে করেছে, পুলিশ মানেই হলো শেখ হাসিনাকে টিকিয়ে রাখার হাতিয়ার। 

বিশ্লেষকদের মতে, হাসিনা সরকারের সময়ে সবচেয়ে বেশি অভিযোগ ছিল পুলিশের বিরুদ্ধে। দেশের বেশির ভাগ রাজনৈতিক দলের অভিযোগ ছিল যে, হাসিনা সরকারকে পুলিশই টিকিয়ে রেখেছে। এমনকি তিনটি প্রশ্নবিদ্ধ নির্বাচনেও পুলিশের ভূমিকা সবচেয়ে বেশি ছিল বলে জনগণের মধ্যে আলোচনা আছে। এ ছাড়া বিএনপিসহ বিরোধী দলগুলোকে দমন-পীড়নের পাশাপাশি সর্বশেষ বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন দমনেও পুলিশের ভূমিকা সবচেয়ে বেশি দৃশ্যমান ছিল। ফলে হাসিনা সরকারের পতনের আন্দোলনের সঙ্গে সঙ্গে পুলিশের প্রতি জনগণের ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ ঘটে ব্যাপকভাবে। ওই আান্দোলনে মোট ১ হাজার ৫৮১ জন মারা যান, আহত হন ৩১ হাজারের বেশি। এ ছাড়া ঢাকাসহ সারা দেশের ৪৫০টির বেশি থানা ও কয়েক শ পুলিশ ফাঁড়িতে হামলা-অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটে। এমনকি অনেক থানায় লুটপাটের ঘটনাও ঘটে। সরকারি হিসাবে মোট ৪৪ জন পুলিশ সদস্য মারা যান। এসব ঘটনায় পুলিশের মনোবল ভেঙে যায়। সেনাবাহিনীর সহায়তায় বেশ কয়েক মাস সময় লাগে থানা-পুলিশের কার্যক্রম স্বাভাবিক করতে। তারপরও এখনো পুরোপুরি সক্রিয় হতে পারেনি বাহিনীটি। 

৫ আগস্টের পর থেকে ৫ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত বিভিন্ন দাবিতে ঢাকায় দেড় শ'র বেশি আন্দোলন হয়েছে। বিভিন্ন সংগঠন ও গোষ্ঠীর ব্যানারে এসব আন্দোলন পরিচালিত হয়েছে। এসব আন্দোলনকারী দাবি করেছেন, তারা বঞ্চিত ও বৈষম্যের শিকার। রাজধানীর গুরুত্বপূর্ণ বিভিন্ন সড়ক অবরোধ করা ছাড়াও তারা একাধিকবার ঘেরাও করেছেন সচিবালয়সহ গুরুত্বপূর্ণ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান। অবরোধের কারণে যানজটসহ নানা ভোগান্তিতে পড়েন সাধারণ মানুষ। এসব আন্দোলনে পুলিশকে কমই অ্যাকশনে যেতে দেখা গেছে। 

এ ছাড়া সম্প্রতি পুলিশভ্যান থেকে আসামি ছিনতাই, থানায় হামলা, জামিনের পর শীর্ষ সন্ত্রাসীদের বেপরোয়া হয়ে ওঠা, চাঁদাবাজি ও চুরি, ছিনতাই ও কিশোর গ্যাংয়ের আধিপত্য বিস্তারের চেষ্টাসহ বিভিন্ন অপরাধ বেড়েছে। এসব অপরাধ নিয়ন্ত্রণে পুলিশ চেষ্টা করেও প্রণিধানযোগ্য কোনো অগ্রগতি দেখাতে পারেনি। শক্ত অবস্থান গ্রহণ করে অপরাধ দমাতে চোখে পড়ার মতো তৎপরতা দেখায়নি পুলিশ। ফলে অপরাধীরা পুলিশকে তোয়াক্কা করছে না, এমনই আলোচনা আছে বিভিন্ন পর্যায়ে। বলা হচ্ছে, আগে পুলিশের প্রতি মানুষের ছিল অনাস্থা, আর এখন ভয় পাচ্ছে না। অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকে একশ্রেণির মানুষের মধ্যে আইন ভাঙার প্রবণতাও বেড়েছে।

এ প্রসঙ্গে পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি) বাহারুল আলম খবরের কাগজকে বলেন, “সরকার পতনের পর কিন্তু আমরা দেখেছি অনেক পুলিশ তাদের কর্মস্থল ছেড়ে চলে গিয়েছিল। সেই কারণে মানুষ মনে করছে, এরা তো সেই লোক যারা পালিয়ে গিয়েছিল। যদি এমন চিন্তা করা হতো, এই পুলিশ রাখব না, নতুন ফোর্স তৈরি করতে হবে। নতুন নাম হয়তো দেওয়া যেত ‘পুলিশ অফিসার’। অনেক জায়গায় এ রকম হয়, আয়ারল্যান্ডে পুলিশকে বলে ‘গার্দা সিওচানা না হেরিয়ান’ যার অর্থ শান্তির রক্ষক। নাম পরিবর্তন করলে মানুষ হয়তো মনে করত এটা একটা নতুন ফোর্স।” আইজিপি বলেন, ‘আগের পুলিশই রয়ে গেছে, মানুষ কিন্তু এমনটাই মনে করে। অসৎ সব পুলিশকে তো আমরা আইনের আওতায় আনতে পারিনি। শুধু যাদের সরাসরি জড়িত থাকার প্রমাণ পাওয়া গেছে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।’ 

বিগত সরকারের আমলে নেতিবাচক কর্মকাণ্ডে জড়িত পুলিশের প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘অনেকেই ভাবছেন এই বুঝি মামলায় পড়লাম, এই বুঝি ধরে জেলে নিয়ে যাবে। এই ধরনের আতঙ্ক পুলিশে এখনো আছে। তবে আমরা তাদের আশ্বস্ত করার চেষ্টা করছি। বিনা কারণে কাউকে ধরা বা হয়রানি করা হবে না।’ 

তিনি বলেন, ‘পুলিশ কাউকে গ্রেপ্তার করার পর অনেক সময় তাকে ছিনিয়ে নেওয়া হয় বা নেওয়ার চেষ্টা করা হয়- এ ধরনের ঘটনা পুলিশকে খুবই ডিমোটিভেট করে। পুলিশ মনে করে আমাকে তো মানছে না।’

তিনি বলেন, ‘সম্প্রতি ইউএনডিপির (জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচি) সঙ্গে আমাদের আলোচনা হয়েছে। আমরা তাদের বলেছিলাম, তারা আমাদের সোশ্যালি বা সাইকোলোজিক্যালি কিছু সাপোর্ট দিতে পারে কি না। আগামী দুই সপ্তাহের মধ্যে তাদের পুলিশ সদস্যদের নিয়ে ওয়ার্কশপ করার কথা রয়েছে। আশা করি, এই ওয়ার্কশপ পুলিশের মনোবল বাড়াতে সাহায্য করবে।’ 

সাবেক আইজিপি আবদুল কাইয়ুমের মতে, ‘বিগত সরকারের আমলে পুলিশ সেবক হয়ে কাজ করতে পারেনি। ফলে সরকার পতনের পর পুলিশে ভয়াবহ বিপর্যয় নেমে আসে। সেই বিপর্যয় পুলিশ এখনো কাটিয়ে উঠতে পারেনি।’ 

খবরের কাগজকে তিনি বলেন, ‘পুলিশের প্রতি মানুষের আস্থা, শ্রদ্ধা ও ভয় কোনোটাই নেই বললেই চলে। 

দেশের বেশির ভাগ মানুষই আইন, পুলিশ কিছুই মানতে চায় না। কিন্তু সবাইকে আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হতে হবে, আইন মানতে হবে, শৃঙ্খলার মধ্যে আসতে হবে। শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনার কাজটি পুলিশের একার পক্ষে সম্ভব নয়। পুলিশকে সবাই মিলে সহযোগিতা করতে হবে। শৃঙ্খলা ফেরাতে আইন মানার বিকল্প নেই।’ 

তিনি আরও বলেন, ‘বিগত সরকারের আমলে মানুষ পুলিশকে ভয় পেত। বিএনপির বিভিন্ন আন্দোলনে আমরা দেখেছি পুলিশের কঠোরতা। কারণ তখন ছিল একটি রাজনৈতিক গোষ্ঠীর পুলিশ। এখন জনগণের দেশ, জনগণের পুলিশ, জনগণই সব ক্ষমতার উৎস।’ 

এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক ড. তৌহিদুল হক খবরের কাগজকে বলেন, ‘পুলিশের অতীতের কর্মকাণ্ডের রেশ এখনো কাটেনি। তা ছাড়া বর্তমান সময়ে পুলিশ মানুষের প্রত্যাশা পূরণ করতে পারছে না। এতে বাড়ছে নিরাপত্তাঝুঁকি। ফলে আগের অনাস্থা রয়েছে ও বর্তমানে ভয় কমেছে।’ তিনি বলেন, চুরি, ছিনতাইসহ যেকোনো অপরাধে ভিকটিম পুলিশের দ্বারস্থ হলেও সেভাবে সেবা পাচ্ছে না। এ ছাড়া ভিকটিমের পরবর্তী সুরক্ষাও অনিশ্চিত। ফলে আস্থার জায়গা নষ্ট হয়ে সংকট তৈরি হয়েছে। মানুষ এখন পুলিশের চেয়ে অপরাধীদের বেশি শক্তিশালী মনে করছে। ফলে পুলিশকে এখন ভয় কম পাচ্ছে মানুষ। এ ছাড়া পুলিশ হামলার শিকার হচ্ছে, পুলিশ ভ্যান থেকে আসামি ছিনতাই ও থানায় হামলা হচ্ছে। এসব বিষয় চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে পুলিকে এখন আর মানুষ ভয় পাচ্ছে না।
 
পুলিশভ্যান থেকে আসামি ছিনতাই
গত ২ ফেব্রুয়ারি পাবনার সুজানগর উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি আব্দুল ওহাবকে পুলিশ ভ্যান থেকে ছিনিয়ে নেন নেতা-কর্মীরা। এরপর ৩ ফেব্রুয়ারি ঠাকুরগাঁওয়ের হরিপুর উপজেলায় পুলিশের কাছ থেকে এক আসামিকে ছিনিয়ে নেন স্বজনরা। ৪ ফেব্রুয়ারি সন্ধ্যায় উত্তরা পশ্চিম থানায় হামলা চালান বৈষম্যবিরোধী শিক্ষার্থীরা। এর আগে গত ৬ জানুয়ারি কুড়িগ্রামের ভূরুঙ্গামারীতে দুই মাদক কারবারিকে পুলিশের গাড়ি থেকে ছিনিয়ে নেন স্থানীয় বাসিন্দারা। ২৪ জানুয়ারি ছাত্রদল নেতা মোহাম্মদ হোসাইন ওরফে মিথুনকে পুলিশ ভ্যান থেকে ছিনিয়ে নিতে নিউ মার্কেট থানায় হামলা করা হয়। 

শীর্ষ সন্ত্রাসীরা বেপরোয়া, বেড়েছে চাঁদাবাজি চুরি ও ছিনতাই 
ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে ৫ আগস্ট হাসিনা সরকারের পতনের পর আলোচিত শীর্ষ সন্ত্রাসীদের মধ্যে অন্তত ছয়জন জামিনে মুক্তি পায়। তাদের বেশির ভাগই এক থেকে দেড় যুগের বেশি সময় ধরে কারাগারে ছিল। ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে গত ১৫ আগস্ট মুক্তি পায় ২৩ শীর্ষ সন্ত্রাসীর অন্যতম ইমন, ইমামুল হাসান হেলাল ওরফে পিচ্চি হেলাল, কিলার আব্বাস, সুইডেন আসলাম, খন্দকার নাঈম আহমেদ ওরফে টিটন ও খোরশেদ আলম ওরফে রাসু ওরফে ফ্রিডম রাসু। 

এসব দাগি অপরাধীর মুক্তির পর থেকেই ঢাকায় ছিনতাই, ডাকাতি, চাঁদাবাজি, খুনোখুনি ও ধারালো অস্ত্র দিয়ে কোপানোর মতো ঘটনা বেড়ে যায়। সন্ত্রাসীরা খুনোখুনির পাশাপাশি নিজ নিজ এলাকায় আধিপত্য বিস্তারের জন্য নেমে পড়ে। সর্বশেষ গত ১০ জানুয়ারি রাতে রাজধানীর এলিফ্যান্ট রোডে ইসিএস কম্পিউটার সিটির (মাল্টিপ্ল্যান সেন্টার) সামনে দুর্বৃত্তরা ব্যবসায়ী এহতেশামুল হককে এলোপাতাড়ি কুপিয়ে পালিয়ে যায়। চাঁদা দিতে রাজি না হওয়ায় তাদের ওপর হামলা হয় বলে জানা যায়। 

এ প্রসঙ্গে ঢাকা মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার (ক্রাইম অ্যান্ড অপারেশনস) এস এন মো. নজরুল ইসলাম খবরের কাগজকে বলেন, ‘শীর্ষ সন্ত্রাসী থেকে শুরু করে দাগী অপরাধীদের বিষয়ে আমাদের কাজ চলমান আছে। তা ছাড়া প্রতিনিয়ত রাজধানীতে নানা কারণে আইনশৃঙ্খলা স্বাভাবিক রাখার বিষয়ে বড় ধরনের চ্যালেঞ্জ আমাদের মোকাবিলা করতে হচ্ছে। এর মাঝেই ওই সব অপরাধীকে আইনের আওতায় আনার জন্য আমরা আন্তরিকভাবে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি।’ 

কিশোর গ্যাংয়ের আধিপত্য বিস্তারের চেষ্টা
সরকারের পতনের পর আদাবর, মোহাম্মদপুরসহ রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় দুর্ধর্ষ সন্ত্রাসীরা পালিয়ে গেলেও এই মুহূর্তে সক্রিয় রয়েছে বিভিন্ন গ্রুপের একাধিক কিশোর গ্যাং। গত ২৯ জানুয়ারি ঢাকার রায়ের বাজারে আসামি ধরতে গিয়ে হামলায় চার পুলিশসহ পাঁচজন আহত হয়েছেন। পরে অভিযান চালিয়ে গ্রেপ্তার করা হয়েছে ১৫ জনকে। আহত পুলিশ সদস্যদের সোহরাওয়ার্দী হাসপাতাল এবং জাতীয় অর্থোপেডিক ও পুনর্বাসন কেন্দ্রে (পঙ্গু হাসপাতাল) চিকিৎসা দেওয়া হয়। তাদের অনেকের মাথা ফেটে গেছে, হাতের রক্তনালি কেটে গেছে, কারও ভেঙেছে হাত।

এ বিষয়ে মোহাম্মদপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আলী ইফতেখার হাসান খবরের কাগজকে বলেন, ‘বিভিন্ন অপরাধে শুধু জানুয়ারি মাসে আমার এলাকায় কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যসহ ৪২৮ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। ছিনতাই, ডাকাতি, চাঁদাবাজি, খুনোখুনিসহ সব ধরনের অপরাধ কমে এসেছে। পুলিশ এসব নিয়ন্ত্রণের সর্বোচ্চ চেষ্টা করছে।’ 

রমজানে কৃত্রিমসংকটের পাঁয়তারা পণ্যবাহী ৩৬০ জাহাজ ভাসছে বঙ্গোপসাগরে

প্রকাশ: ১৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ০৯:৪৪ এএম
আপডেট: ১৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ০৯:৪৫ এএম
পণ্যবাহী ৩৬০ জাহাজ ভাসছে বঙ্গোপসাগরে
চট্টগ্রামে কর্ণফুলী নদীর বাংলাবাজার ঘাটে লাইটার জাহাজ থেকে পণ্য খালাস করছেন শ্রমিকরা। ছবি: মোহাম্মদ হানিফ

ভোগ্যপণ্য নিয়ে ৩৬০টি লাইটার জাহাজ বঙ্গোপসাগরে ভাসছে। লাইটার জাহাজগুলো পণ্য রাখার গুদাম হিসেবে ব্যবহার করছেন আমদানিকারকরা। এভাবে রমজানকে ঘিরে দেশে ভোগ্যপণ্যের কৃত্রিমসংকট তৈরির পাঁয়তারা চলছে। 

এদিকে মাদার ভেসেলগুলো (বড় জাহাজ) থেকে যথাসময়ে ভোগ্যপণ্য খালাস না করায় বহির্নোঙরে বাড়ছে বড় জাহাজের সারি। অন্যদিকে লাইটার জাহাজে পণ্য রাখায় প্রতিদিন আমদানিকারকরা মাশুল গুনতে হচ্ছে। এ কারণে রমজানে ভোগ্যপণ্যের দাম বাড়ারও শঙ্কা তৈরি হয়েছে।

লাইটার জাহাজ সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বর্তমানে প্রায় ১ হাজার ৮০০ লাইটার জাহাজ পণ্য পরিবহনে নিয়োজিত রয়েছে। আমদানিকারকরা পণ্য খালাস না করে প্রায় ২০ শতাংশ লাইটার জাহাজকে গুদাম হিসেবে ব্যবহার করছেন। সেই হিসাবে, প্রায় ৩৬০ লাইটার জাহাজ তাদের দখলে রাখায় নৌপথে সিমেন্ট, বালু, ক্লিংকারসহ অন্য পণ্য পরিবহনে গতি কমেছে। 

বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে আসা জাহাজ জড়ো হয় চট্টগ্রাম বন্দরের বহির্নোঙরে। মাদার ভেসেলের ড্রাফট বেশি হওয়ায় এসব জাহাজ সরাসরি বন্দর জেটিতে ভিড়তে পারে না। এ কারণে ৩০ ভাগ ফিডার জাহাজের সাহায্যে কনটেইনার আনা হয় বন্দর জেটিতে। সেখানে চলে খালাস প্রক্রিয়া। বাকি ৭০ ভাগ পণ্য বাল্ক জাহাজ থেকে ছোট ছোট লাইটার জাহাজে খালাস করে ৩৮টি নৌরুটে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে পাঠানো হয়। লাইটার জাহাজের ধারণ ক্ষমতা ১ হাজার থেকে ২ হাজার টন পর্যন্ত। এভাবে বন্দরের বহির্নোঙর থেকে বছরে প্রায় ৯ থেকে ১০ কোটি টন পণ্য পরিবহন হয়। 

বাংলাদেশ লাইটার শ্রমিক ইউনিয়নের সহসভাপতি মোহাম্মদ নবী আলম বলেন, ‘আমদানিকারকরা ভোগ্যপণ্যে কৃত্রিমসংকট তৈরির জন্য লাইটার জাহাজগুলো গুদাম বানিয়েছেন। বছরের অন্যান্য সময় সীমিত পরিমাণে ভোগ্যপণ্যের আমদানি হওয়ায় আমদানিকারকেরা দ্রুত পণ্য খালাস করতেন। এখন রমজান মাস আসছে, পণ্যের চাহিদা বাড়ছে, পাশাপাশি আমদানিও অনেক বেড়েছে। তাই লাইটার জাহাজের চাহিদাও বেড়েছে। কিন্তু জাহাজেই পণ্য মজুত করে রাখায় অন্যান্য পণ্য পরিবহনে সমস্যা হচ্ছে। এ কারণে বহির্নোঙরে বড় জাহাজগুলোর অপেক্ষমাণ সময় বেড়েছে। ডব্লিউটিসিসহ সংশ্লিষ্ট অন্য প্রতিষ্ঠানগুলোর দুর্বল ব্যবস্থাপনার কারণে এমন পরিস্থিতি হচ্ছে। যে যেভাবে পারছে, সেভাবে অনিয়ম করে যাচ্ছে।’ 

লাইটারেজ জাহাজ কাদিরিয়া এন্টারপ্রাইজের মালিক হাজী শফি খবরের কাগজকে বলেন, ‘মাসখানেকের বেশি সময় ধরে লাইটার জাহাজগুলোতে পণ্য রেখে গুদাম হিসেবে ব্যবহার করছিলেন আমদানিকারকরা। এটা নতুন কিছু নয়। প্রতিবছরই আমদানিকারকরা এমনটা করে। নৌ-অধিদপ্তরের মহাপরিচালক সমস্যাটি সমাধানের উদ্যোগ নিয়েছেন। তিনি কোস্টগার্ড, নৌবাহিনীসহ সংশ্লিষ্টদের বিষয়টি দেখভাল করার নির্দেশ দিয়েছেন। এখন ধীরে ধীরে পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হচ্ছে।’ 

ওয়েটিং টাইম বাড়লে মাদার ভেসেলগুলোকে (বড় জাহাজ) মাশুল দিতে হয় (প্রতিদিন প্রায় ১৫ হাজার ডলার)। লাইটার জাহাজগুলোতেও পণ্য রাখলে প্রতিদিন মাশুল নেন মালিকরা। পরে এর প্রভাব পড়ে ভোগ্যপণ্যের ওপর। কিন্তু সরকারের নির্ধারিত ফি না থাকায় লাইটার জাহাজ মালিকরা যে যেভাবে পারছেন, মাশুল আদায় করছেন। তাই দৈনিক মাশুল ফির সংখ্যাটা জানাতে রাজি হননি লাইটার জাহাজ মালিকরা। 

চট্টগ্রাম বন্দরের তথ্যমতে, দেড় মাস আগেও বন্দরের আলফা, ব্র্যাভা ও চার্লি এই তিন বহির্নোঙরে গড়ে ৪০টি মাদার ভেসেল (বড় জাহাজ) পণ্য খালাসে লাইটার জাহাজের অপেক্ষায় ছিল। গত ৩১ জানুয়ারি বহির্নোঙরে জাহাজের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ৪৬টিতে। জাহাজের সংখ্যা আরও বেড়ে গত ১২ ফেব্রুয়ারি বন্দরের বহির্নোঙরে জাহাজের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ৬৪টিতে। বর্তমানেও অপেক্ষমাণ জাহাজের একই সংখ্যা বিরাজ করছে। 

সরকার ভোগ্যপণ্য আমদানিতে শুল্ক ছাড় দেওয়ায় এবার আমদানিকারক ও ভোগ্যপণ্যের আমদানির পরিমাণ বেড়েছে। গত বছর রমজানকে ঘিরে ২১৪ আমদানিকারক ভোগ্যপণ্য আমদানি করেছিলেন। এবার আমদানি করেছেন ৩৬৫ জন। বর্তমানে বহির্নোঙরে অপেক্ষমাণ জাহাজগুলোতে গম, ডাল, সরিষা, লবণ, কয়লা, পাথর, স্ল্যাগসহ বিভিন্ন পণ্য রয়েছে। 

চট্টগ্রামের আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান ফারুক ট্রেড ইন্টারন্যাশনালের মালিক ফারুক আহমেদ বলেন, ‘কোনো ধরনের অসৎ উদ্দেশ্যে আমদানিকারকরা লাইটার জাহাজে পণ্য রাখে না। পণ্য খালাস করে গুদামে নেওয়া, আবার গুদাম থেকে বাজারজাত করা, এসব কাজে ঝামেলা বেশি। তাই ঝামেলা এড়াতে অনেক সময় ভোগ্যপণ্যের চাহিদা কমলে আমদানিকারক এসব পণ্য জাহাজে রেখে দেন।’ 

কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব) কেন্দ্রীয় কমিটির ভাইস প্রেসিডেন্ট এস এম নাজের হোসাইন খবরের কাগজকে বলেন, ‘মাদার ভেসেল থেকে লাইটার জাহাজে পণ্য নেওয়া, সেখান থেকে ধীরে ধীরে গুদামে নেওয়া, এভাবে যদি ১৫ দিন সময় পার করতে পারে, তাহলে বাজারে স্বাভাবিকভাবে একটা সংকট তৈরি হবে। এ সুযোগে তারা একটা বিশাল অঙ্ক পকেটে ঢোকাতে পারবে। কাজেই ভোগ্যপণ্যের আমদানি হলেই তো হবে না, সেটা পুরোটাই বণ্টন নিশ্চিত করতে হবে। অন্যথায় পণ্যের দাম বাড়বে। অসাধু ব্যবসায়ীরা তাদের টার্গেট পূর্ণ করবে এবং সাধারণ মানুষ জিম্মি হয়ে থাকবে।’

আস্থা ফেরানোর প্রাণান্তকর চেষ্টায় রাজধানীর থানাগুলো

প্রকাশ: ১৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ০৪:১৫ এএম
আস্থা ফেরানোর প্রাণান্তকর চেষ্টায় রাজধানীর থানাগুলো
থানায় আগত সেবাপ্রত্যাশীদের মন জয়ের জন্যই যেন প্রাণান্তকর প্রচেষ্টা চালাচ্ছেন পুলিশ কর্মকর্তা ও সদস্যরা।

আসসালামু আলাইকুম। বসুন, কী বিষয়ে আপনাকে সহযোগিতা করতে পারি?’ গত ১৩ ফেব্রুয়ারি বেলা পৌনে ৩টায় ভাটারা থানায় একজন সেবাপ্রত্যাশীর উদ্দেশে এভাবেই কথা বলছিলেন ডিউটি অফিসারের সহযোগী এএসআই মেজবাহ পানির মিটার চুরিসংক্রান্ত একটি সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করতে যাওয়া ব্যক্তিকে এমন আন্তরিকতার সঙ্গে আইনি সেবা দিতে দেখা গেছে।

কেবল ভাটারায় নয়, গত দুই দিন রাজধানীর উত্তরা পূর্ব, পল্টন ও রমনা থানা সরেজমিন ঘুরে ও সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, পুলিশের আচরণে কিছু ইতিবাচক পরিবর্তন এসেছে। পাশাপাশি পাল্টে গেছে রাজধানী ঢাকার অধিকাংশ থানার চোহারা।

গত বছরের ৫ আগস্টের প্রেক্ষাপটে ভগ্নদশা হওয়া ভবনগুলোতে লেগেছে আধুনিকায়নের ছোঁয়া অভ্যন্তরীণ অবকাঠামো থেকে শুরু করে বসার জায়গাগুলো নতুন করে সাজানো হয়েছে। এসব থানায় এখন পুলিশের আইনি সেবাতেও এসেছে ইতিবাচক পরিবর্তন। থানায় আগত সেবাপ্রত্যাশীদের মন জয়ের জন্যই যেন প্রাণান্তকর প্রচেষ্টা চালাচ্ছেন পুলিশ কর্মকর্তা ও সদস্যরা।

ওপরে উল্লিখিত থানাগুলোতে অবস্থানকালে ডিউটি কক্ষে দায়িত্বরত পুলিশ সদস্যদের আচরণেও অনেক ইতিবাচক পরিবর্তন লক্ষ করা গেছে। অতীতের সেই রুক্ষ আচরণ এখন দেখা যায়নি, বরং সেবাগ্রহীতাদের সঙ্গে বিনয়ী আচরণ করতে দেখা গেছে। অভিযোগ পেলেই দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়া কিংবা ঘটনাস্থলে টিম পাঠানোর বিষয়েও তোড়জোড় দেখা যায়।

আলাপকালে কয়েকজন পুলিশ সদস্য বলেন, পুলিশ জনগণের সেবায় নিয়োজিতভুক্তভোগীর পাশে থেকে তাকে আইনি সেবা দেওয়াই আমাদের কাজ। সেটির আপ্রাণ চেষ্টা আমরা করছি। বিভিন্ন ক্ষেত্রে দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে কিছু বাধার সম্মুখীন হতে হচ্ছে আমাদের। তবে আমরা আমাদের দায়িত্ব আন্তরিকতার সঙ্গে পালন করতে চাই। পুলিশ দ্বারা যাতে কোনো নিরপরাধ ব্যক্তি নির্যাতন কিংবা ক্ষতির সম্মুখীন না হয়, সে বিষয়টি মাথায় রেখে আমরা সেবা দিতে কাজ করছি। সিনিয়র অফিসারদের নির্দেশনা অনুযায়ী আমরা শতভাগ কাজ করার চেষ্টা করছি। আসামি ধরতে গেলেও আগে ভালোভাবে তদন্ত করে দেখা হয়।’

উত্তরা পূর্ব থানা

১৩ ফেব্রুয়ারি দুপুর ১টা ১০ মিনিটউত্তরা পূর্ব থানা ভবনের প্রবেশ গেটে শফিকুল নামে একজন কনস্টেবল দাঁড়িয়ে ছিলেন। ভবনে ঢুকতে বাম দিকে ডিউটি অফিসারের কক্ষ। সেখানে বসে কাজ করছিলেন ডিউটি অফিসার উপ-পরিদর্শক (এসআই) সুবল ও একজন নারী পুলিশ সদস্য। এদিকে ডিউটি কক্ষে এক ব্যক্তি প্রবেশ করে জানান, তার গাড়ির ট্যাক্স টোকেন হারিয়ে গেছে। এখন এই কাগজটি নতুন করে তুলতে হবে। তাই থানায় সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করতে এসেছেন। ডিউটি অফিসার সুবল তার বিষয়টি শুনে বলেন, ‘একটু বসুন, জিডি করে দিচ্ছি। এর পরই দ্রুততম সময়ে জিডির প্রক্রিয়া সারতে দেখা যায়।

কাজ শেষে থানা থেকে বের হওয়ার সময় কথা হয় জিডিকারী আলী আজমের সঙ্গে তিনি বলেন,গত ২ ফেব্রুয়ারি রাতে উত্তরা-৪ নম্বর সেক্টরের ৪ নম্বর রোডে কোথাও তার আরএভি-৪ মডেলের গাড়ির ট্যাক্স টোকেনের কাগজ খোয়া যায়এ নিয়ে জিডি করতে এসেছি, এসে বেশ আন্তরিক আচরণ দেখলাম ভালোই লাগল।

দুপুর ১টা ২০ মিনিট উত্তরা পূর্ব থানার ডিউটিরত কর্মকর্তারা থানায় আসছিলেন দুপুরের খাবার খেতে। ঠিক তখন থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা তার কক্ষ থেকে বের হয়ে আসেন ডিউটি অফিসারের কক্ষে। তিনি বলছিলেন, দ্রুত বিডিআর মার্কেটের পাশে একটি টিম পাঠাতে হবে। সেখানে ঝামেলা শুরু হয়েছে। সেখানে উত্তরা নার্সিং ইনস্টিটিউটে হামলার ঘটনা ঘটেছে। ওসি দ্রুত টিম পাঠাতে বললে খাওয়া বন্ধ রেখেই পুলিশ কর্মকর্তারা ছোটেন ঘটনাস্থলের উদ্দেশে। ওই সময় থানায় পুলিশ সদস্যদের বেশ তৎপরতা দেখা গেছে।

আলাপকালে থানায় ডিউটিতে থাকা একাধিক পুলিশ সদস্য খবরের কাগজকে বলেন, ‘পুলিশ তো এখনো জনমানুষের চোখের বিষের মতো। কিন্তু কেউ বিপদে পড়লে পুলিশের কাছেই আগে আসেআমরাও তাদের সহযোগিতা করে থাকি। আমরা সাধারণ মানুষের আস্থায় যাওয়ার চেষ্টা চালাচ্ছি, তাদের মন জয়ের চেষ্টা করে যাচ্ছি।

এ প্রসঙ্গে উত্তরা পূর্ব থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোহাম্মদ শামীম আহমেদ দৈনিক খবরের কাগজকে বলেন, “স্বাভাবিকভাবে এই থানায় দৈনিক ২০ থেকে ২৫টি সাধারণ ডায়েরি বা অভিযোগ হচ্ছে। উত্তরা বিভাগের অন্যান্য থানা থেকে উত্তরা পূর্ব থানা এলাকা আয়তনে একটু ছোট। তবে আমাদের থানা এলাকায় একটু ভিআইপি মানুষের বসবাস বেশি। ঘনবসতি না হওয়ায় এখানে অন্যান্য ঝামেলা কম। কিন্তু আমরা প্রায়ই উটকো ঝামেলা পোহাই।

ভাটারা থানা

১৩ ফেব্রুয়ারি বেলা পৌনে ৩টায় ভাটারা থানায় গিয়ে দেখা যায়, থানা ভবনের বাইরে সড়কে পড়ে ছিল ৫ আগস্ট-পরবর্তী হামলায় ক্ষতিগ্রস্ত সেই গাড়িগুলো। থানা ভবনে প্রবেশ করে ডিউটি কক্ষে দেখা যায় বেশ কয়েকজন ভুক্তভোগীকেডিউটি ডেস্কে বসে কাজ করছিলেন ডিউটি অফিসার এসআই দিবাকর এবং এএসআই মেজবাহ। এসআই দিবাকর এক ভুক্তভোগীর একটি অভিযোগ লিখছিলেন। অন্যদিকে থানায় এক ভারতীয় নাগরিককের সঙ্গে আলাপ করছিলেন এএসআই মেজবাহজুবায়ের আহমেদ নামে ওই ভারতীয় নাগরিক তার পাসপোর্ট হারিয়ে গেছে মর্মে থানায় এসেছিলেন একটি জিডি করতে। তিনি বাংলা বোঝেন, কিন্তু বলতে পারেন না। তবে ডিউটি অফিসার তার সঙ্গে ইংরেজিতে কথা বলে তার বিষয়টি বোঝার চেষ্টা করছিলেন।

ভুক্তভোগী ভারতীয় নাগরিক জোবায়ের আহমেদ দৈনিক খবরের কাগজকে বলেন, ভারতের উত্তর প্রদেশের লক্ষ্ণৌ এলাকায় তার বাড়ি। তিনি বাংলাদেশি এক নারীকে বিয়ে করে বর্তমানে বসুন্ধরা এলাকার একটি বাসায় থাকছেন। তবে তার পাসপোর্ট হারিয়ে যাওয়ায় তিনি বিপদে পড়েছেন। তার পাসপোর্ট পুনরায় তৈরি করতে তিনি থানায় একটি জিডি করতে এসেছিলেন। তিনি বলছিলেন, ‘আমি আগে অনেক সময় থানায় এসেছিতবে বাংলাদেশ পুলিশ অনেক আন্তরিক। তারা আমার বিষয়টি নিয়েই কাজ করছেন।’

ভারতীয় নাগরিক জুবায়ের আহমেদ ছাড়াও অনেকেই সেবা নিতে এসেছিলেন। এর মধ্যে বারিধারা থেকে একজন এসেছেন তার পানির মিটার চুরি গেছে মর্মে জিডি করতে। জিডির কপি ওয়াসা অফিসে জমা দিলে নতুন মিটার দেওয়া হবে বলেও জানিয়েছেন ওই ভুক্তভোগী।

ভাটারা থানার ডিউটি অফিসার দিবাকর জানান, ওই দিন (১৩ ফেব্রুয়ারি) সকাল থেকে বেলা ৩টা পর্যন্ত ৩০ থেকে ৪০টি জিডি হয়েছে। এর মধ্যে কয়েকটি অভিযোগ রয়েছে। তবে হুমকি-সংক্রান্ত কোনো জিডি বা অভিযোগ এখনো পাওয়া যায়নি।

জানতে চাইলে ভাটারা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মোহাম্মদ মাজহারুল ইসলাম খবরের কাগজকে বলেন, ‘আমরা জনগণকে শতভাগ সেবা দিতে কাজ করছি। কিছুদিন আগেও পুলিশ পুরোপুরি কাজ করতে পারেনি। কিন্তু এখন আমাদের পুলিশ সদস্যরা সব জায়গায় গিয়ে সেবা দিতে পারছেন। ঘটনার খবর পাওয়ামাত্রই স্পটে ফোর্স পাঠানো হচ্ছে।’ 

পল্টন থানা

১৬ ফেব্রুয়ারি বেলা ২টার দিকে রাজধানীর পল্টন থানায় গিয়ে দেখা গেছে, থানা ফটকে দায়িত্বরত পুলিশ সদস্য থাকলেও থানা অনেকটাই ফাঁকা। থানা ভবনে ঢুকতেই ডান পাশে ডিউটি অফিসারের কক্ষ। সেখানে বসা ছিলেন এসআই শাহজালাল। পাশে ছিলেন একজন নারী পুলিশ সদস্য। সেখানে জাহিদুল ইসলাম জুয়েল নামে একজন ভুক্তভোগী একটি অভিযোগ দায়েরের জন্য এসেছিলেন। তার অভিযোগ ছিল- ‘ভিজকম ট্রাভেল অ্যান্ড ট্যুর’ নামক প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে। তিনি বলেন, ‘গত মার্চ মাসে ওই প্রতিষ্ঠানের কাছে মালয়েশিয়া পাঠাতে ছয়জনের জন্য ২৮ লাখ টাকা জমা দিয়েছি। তারা ভিসার কাগজপত্রও দিয়েছে, কিন্তু লোক পাঠাচ্ছে না। টাকা ফেরত চাইলে সেটিও দিচ্ছে না। তারা কোনো যোগাযোগও করছে না। এ জন্য থানায় এসেছি একটি অভিযোগ দেওয়ার জন্য

এ সময় ডিউটি অফিসারকে বলতে শোনা যায়, একটি অভিযোগ লিখে জমা দিলেই দ্রুত পুলিশ পাঠিয়ে ব্যবস্থা নেবেন। ওই সময় অবশ্য থানায় ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তার সঙ্গে দেখা করতে গেলে সেখানে তিনি ছিলেন না। তবে ডিউটি অফিসার জানিয়েছেন ওসি স্যার বাইরে টহল পরিদর্শনে গেছেন।

ডিউটি অফিসার এসআই শাহ জালাল খবরের কাগজকে বলেন, সকাল থেকে এখন পর্যন্ত ২০টি জিডি দায়ের হয়েছে। এর মধ্যে অধিকাংশই হারানোসংক্রান্ত। 

রমনা থানা

১৬ ফেব্রুয়ারি বেলা ৩টার দিকে রমনা থানায় গিয়ে দেখা যায়, ডিউটি অফিসারের কক্ষে ছিলেন এসআই আজিজুল ও নাজমুল। রমনা থানা ডিউটি কক্ষটি একটু ছোট পরিসরে রয়েছে। সেখানেও দেখা গেছে কয়েকজন ভুক্তভোগী সেবা নিচ্ছেন। সবকিছু দেখে মনে হচ্ছিল অনেক আন্তরিকতার সঙ্গেই পুলিশ সদস্যরা এ থানায় দায়িত্ব পালন করছিলেন। অস্বাভাবিক কোনো কিছু এ সময় চোখে পড়েনি। এ বিষয়ে আলাপ করতে গেলেও ডিউটি অফিসার বা কর্তব্যরত পুলিশ সদস্যরা আগ্রহ দেখাননি।

সিফাত/