প্রাণহানি বিবেচনায় ২০১৬ সালে বজ্রাঘাতকে দুর্যোগ হিসেবে ঘোষণা করে সরকার। এরপর সাত বছর পার হলেও এখনো এই দুর্যোগ প্রতিরোধে টেকসই কোনো প্রকল্প নিতে পারেননি মন্ত্রণালয় ও সংশ্লিষ্টরা। বজ্রাঘাত প্রতিরোধে ত্রাণ ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয়ের নেওয়া তালগাছ প্রকল্প, আবহাওয়া অধিদপ্তরের লাইটনিং ডিটেকশন সেন্সর প্রকল্প থেকে প্রত্যাশিত সাফল্য পাওয়া যায়নি।
সর্বশেষ বজ্রনিরোধক দণ্ড, বজ্রনিরোধক যন্ত্র ও ছাউনি স্থাপনের মাধ্যমে চেষ্টা করা হচ্ছে। তবে কোনো কিছুর মাধ্যমেই বজ্রাঘাতে প্রাণহানি ঠেকানো যাচ্ছে না। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সব কৌশলই ব্যর্থ হয়েছে। তাই গবেষণার মাধ্যমে সব অংশীজন ও বিশেষজ্ঞকে নিয়ে প্রকল্প নেওয়া হলে উপযুক্ত সমাধান আসতে পারে বলে মনে করছেন তারা।
এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউট অব ডিজাস্টার ম্যানেজমেন্ট অ্যান্ড ভালনারেবিলিটি স্টাডিজের অধ্যাপক এবং উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য অধ্যাপক ড. মাহবুবা নাসরীন খবরের কাগজকে বলেন, ‘বজ্রাঘাতে মৃত্যু বাড়ছে। এটি যেহেতু দুর্যোগ হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে, আমাদের নির্দেশনা মানতে হবে। একই সঙ্গে এটি প্রতিরোধে গবেষণার মাধ্যমে সম্ভাব্য সব উপায় বের করতে হবে।’
টানা তাপপ্রবাহে গত বৃহস্পতিবার বজ্রাঘাতে দেশের চার জেলায় ১০ জনের মৃত্যু হয়। এর মধ্যে কুমিল্লায় চারজন, রাঙামাটিতে তিনজন, কক্সবাজারে দুজন এবং খাগড়াছড়ি জেলায় একজন।
দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, দেশে ২০১১ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত ২ হাজার ১৬৪ জনের প্রাণহানি ঘটেছে এই বজ্রাঘাতে। এ ছাড়া ২০২১ সালে ৩৬৩ জন এবং ২০২২ সালে মারা গেছেন ২৭৪ জন। সেভ দ্য সোসাইটি অ্যান্ড থান্ডারস্টর্ম অ্যাওয়ারনেস ফোরামের (এসএসটিএফ) হিসাব অনুযায়ী, ২০২২-এর এপ্রিল থেকে ২০২৩ সালের মে মাস পর্যন্ত বজ্রাঘাতে ৩৪০ জন প্রাণ হারিয়েছেন।
মন্ত্রণালয় ও অধিদপ্তর-সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ২০১৭ সালে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তর দুই প্রকল্পের (কাবিখা ও টিআর) মাধ্যমে সারা দেশে ৪০ লাখ তালগাছের চারা রোপণ শুরু করে। কিন্তু সেটিতে প্রত্যাশিত সাফল্য না আসায় ২০২২ সালে সেটি বাতিল ঘোষণা করেন তৎকালীন দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা প্রতিমন্ত্রী এনামুর রহমান। ২০১৮ সালে আবহাওয়া অধিদপ্তরের নেওয়া ‘লাইটনিং ডিটেকশন সেন্সর’ প্রকল্পও রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে কার্যক্ষমতা হারিয়েছে।
অন্যদিকে ২০২১-২২ অর্থবছরের আওতায় দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তর বজ্রপাতপ্রবণ ১৫ জেলায় একই প্রকল্পের (কাবিখা ও টিআর) মাধ্যমে ৩৩৫টি বজ্রনিরোধক দণ্ড-যন্ত্র বসায়। সংশ্লিষ্ট জেলাগুলোতে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এর অনেকগুলোই সচল নেই। আবার কোনোটির কাভারেজ বা রেডিয়াস খুবই কম। এই ধরনের আরও ৬ হাজার ৭৯৩টি দণ্ড বসানোর জন্য ১ হাজার ৩২১ কোটি টাকার প্রকল্প সম্প্রতি পরিকল্পনা কমিশনে পাঠিয়েছে মন্ত্রণালয়।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই প্রকল্পও খুব বেশি কার্যকরী হবে না। কারণ এসব যন্ত্রের কাভারেজ খুবই কম। যদি কাভারেজ কয়েক কিলোমিটার বা কয়েক শ মিটারও হয়, তাহলে এটি বজ্রাঘাত থেকে রক্ষায় কার্যকর হবে। না হলে এ থেকে এটি থেকে সুফল আসবে না।
বিষয়টির সত্যতা পাওয়া যায় ত্রাণ ও দুর্যোগ মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. কামরুল হাসানের কথায়। খবরের কাগজকে তিনি বলেন, ‘১ হাজার ৩০০ কোটি টাকার প্রজেক্ট আমরা পাঠিয়ে দিয়েছি। ১৫টি জেলা চিহ্নিত করেছি। এসব অঞ্চলে বজ্রনিরোধক দণ্ড স্থাপনের জন্য প্রকল্প করে আমরা পাঠিয়ে দিয়েছি। তবে প্রকল্পটি এখনো পাস হয়নি।’
আগের বসানো দণ্ডের উপযোগিতা কেমন এবং অনেক জায়গায় সচল না থাকার বিষয়ে প্রশ্ন করলে তিনি বলেন, ‘খবরটি আমার কাছেও এসেছে। যেসব দণ্ড স্থাপন করা হয়েছে, কিছু জায়গায় নষ্ট হয়ে গেছে। যেগুলো নষ্ট হয়েছে, সেগুলো ঠিক করতে বলেছি। এর কাভারেজে ভিন্নতা রয়েছে। সর্বোচ্চ ৮০০ মিটার কাভার করে। এটি ক্যাপাসিটির ওপর নির্ভর করে। আমরা চাচ্ছি, অত্যাধুনিক প্রযুক্তির মাধ্যমে এটি করতে। কারণ প্রত্যেক মানুষের জীবন মূল্যবান।’
বজ্রপাতে করণীয় সম্পর্কে জানতে চাইলে আবহাওয়াবিদ ওমর ফারুক খবরের কাগজকে বলেন, ‘এপ্রিল থেকে জুন পর্যন্ত বেশি বজ্রপাত হয়। আমাদের সচেতন হতে হবে। বজ্রপাত হওয়ার আগে বোঝা যায়। আগেই বিদ্যুৎ চমকানি শুরু হয়। এ জন্য পশ্চিম দিকে তাকাতে হবে। কারণ পশ্চিম দিক থেকে ধীরে ধীরে এটি নিজের অবস্থানের দিকে আসবে। বিষয়টি জনসাধারণকে বোঝাতে হবে। এটির স্থায়িত্ব এক ঘণ্টার বেশি থাকে না। এ সময় বাড়িতে বা নিরাপদে থাকতে হবে। তাহলে প্রাণহানি হবে না।’
এই বিষয়ে বিশেষজ্ঞদের মতামত জানতে পড়ুন...