ইচ্ছাশক্তি, অটুট লক্ষ্য ও একাগ্রতা- এই তিন গুণের সম্মিলিত শক্তিই পারে মানুষকে যেকোনো প্রতিকূলতা কাটিয়ে সাফল্যের চূড়ান্ত শিখরে পৌঁছে দিতে। যদিও এর সামনে নানা প্রতিবন্ধকতা বাধা হয়ে আসে। কিন্তু এসব প্রতিবন্ধকতাকে বৃদ্ধাঙুলি দেখিয়ে ‘জয়বাংলা ইয়ুথ অ্যাওয়ার্ড-২০২২’ জয় করেছেন এক স্বপ্নবাজ তরুণ শেখ মোহাম্মদ আতিফ আসাদ। জামালপুর জেলার সরিষাবাড়ী উপজেলার ডোয়াইল ইউনিয়নের হাসড়া মাজালিয়া প্রত্যন্ত গ্রামে জন্ম ও বেড়ে ওঠা আসাদের। বাবা-মা আর সাত ভাইবোনের অভাবের সংসারে তিনি সবার ছোট। পড়াশোনা করছেন জামালপুর সরকারি আশেক মাহমুদ কলেজে উদ্ভিদ বিজ্ঞান বিভাগে অনার্স তৃতীয় বর্ষে। পরিবারের অভাব-অনটনের কারণে প্রাইমারি স্কুল থেকে এখন পর্যন্ত ধানকাটা, দিনমজুরি, রং বার্নিশ, রাজমিস্ত্রি, রডমিস্ত্রির কাজ এমনকি ভ্যান চালিয়ে খরচ জোগাচ্ছেন লেখাপড়ার। অনেক সময় মায়ের সঙ্গে নকশিকাঁথায়ও সুই ফুটিয়েছেন। এসব কাজ করে পড়ালেখার পাশাপাশি হাল ধরেছেন পরিবারের।
অর্থাভাবের এই কষ্টগুলো ছোট থেকেই তার বিবেককে নাড়া দিত। তিনি ভাবতেন সমাজের জন্য শিক্ষার আলো দরকার। কারণ তার মতোই গ্রামের অধিকাংশ মানুষ। অর্থাভাবে লেখাপড়া বন্ধ হয়ে যেতে দেখেছেন অনেককে। তাদের জন্য ছোট থেকেই কিছু করার ইচ্ছা ছিল আসাদের। তিনি ভাবেন ভালো কিছু করতে হলে প্রয়োজন যথাযথ জ্ঞানার্জনের। আর জ্ঞানকে বিকশিত করার জন্য বই পড়ার বিকল্প নেই। এর জন্য প্রয়োজন পাঠাগারের। কিন্তু প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলে পাঠাগার সুবিধা নেই। আবার টাকা দিয়ে বই কিনে পড়ার সামর্থ্য নেই অনেকের।
যেই ভাবনা সেই কাজ। ২০১৮ সালে প্রতিবেশী এক আপুর দেওয়া ২০টি বই নিয়ে যাত্রা শুরু হয় আসাদের পাঠাগারের। শুরুতে পাঠাগারটির কোনো নাম না থাকলেও পরবর্তীতে পাঠাগারটির নামকরণ করা হয় বড় ভাই অকালপ্রায়ত মিলনের নামে। ২০টি বই নিয়ে আসাদের শুরু করা পাঠাগারের নামকরণ হয় ‘মিলন স্মৃতি পাঠাগার’। ঘর ভাড়া নিয়ে পাঠাগার পরিচালনা করার টাকা ছিল না তার। যেহেতু শিক্ষার ও জ্ঞানের আলো ছড়ানোই তার মূল লক্ষ্য, সেহেতু অবকাঠামো কোনো বাধা হতে পারে না, এমন চিন্তা থেকেই নিজের ঘরের বারান্দায় পাটকাঠির বেড়া দিয়ে পাঠাগার শুরু করেন। বইগুলো সংরক্ষণ করার জন্য বাবার পরামর্শে ঘরে থাকা কাঠ দিয়ে তৈরি করেন নড়বড়ে একটা বুকশেলফ।
আসাদ বলেন, শুরুর দিকে বিভিন্ন লোকের কাছ থেকে চেয়ে দু-একটা করে বই নিয়ে বই সংখ্যা বাড়ানো আর পাঠকদের নতুন বই দেওয়ার চেষ্টা করি। এরপর গ্যাসটন ব্যাটারিজ লিমিটেডের নির্বাহী পরিচালক কে এইচ মালেক স্যার পাঠাগারের এই ভালো কাজ দেখে খুশি হয়ে ১০০ বই উপহার দেন এবং ভিয়েতনামে নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত সামিনা নাজ ম্যাম বই কেনার জন্য কিছু টাকা দেন। এতে আমার পাঠাগার সমৃদ্ধ হয়।
সেই থেকে শুরু। সমাজের ছাত্র, শিক্ষক, চাকরিজীবী, প্রবাসী সবার দেওয়া বই নিয়ে আমার পাঠাগারে বর্তমানে বই সংখ্যা ৮ হাজার। আমি লেখাপড়ার পাশাপাশি বাড়ি বাড়ি গিয়ে বই বিতরণ করি সপ্তাহে দু-তিন দিন। এ ছাড়া কেউ যদি ১০-১৫ কিলোমিটার দূর থেকেও ফোন করে। তাকে সাইকেল চালিয়ে গিয়ে বই দিয়ে আসি। বর্তমানে প্রায় ১ হাজার ৫০০ পাঠক আছেন আমার পাঠাগারে। শুরুর দিকে বিভিন্ন সমস্যার সম্মুখীন হতাম। অনেকে উপহাস করত টিটকারি দিয়ে কথা বলত, এখনো বলে। তাতে আমার কষ্ট লাগত কিন্তু দমে যাইনি। আমার অবসর সময়টুকু মানুষের জন্যই কাজে লাগাচ্ছি এবং সেটা বই দিয়ে আলোকিত করার মাধ্যমে। আমি চাই সমাজে শিক্ষার আলো ছড়িয়ে পড়ুক।
আসাদ জানান, পাঠাগারের সব বই কুরিয়ারে আসে উপজেলায়। তাকে ৮-১০ কিলোমিটার সাইকেল অথবা ভ্যান চালিয়ে নিয়ে আসতে হয় সেসব বই। আবার কোনো কারণে আসাদ বাড়ি না থাকলে, তার মা পাঠকদের বই দেন এবং বই সংগ্রহ করেন। কারণ লেখাপড়ার খরচের জন্য তাকে এখনো মাঝে-মাধ্যেই দূরে কোথাও দীর্ঘ সময় কাজ করতে যেতে হয়। আসাদের ইচ্ছে নিজ উপজেলা সরিষাবাড়িতে প্রতিবছর অনুষ্ঠিত হবে বইমেলা। প্রচণ্ড মনোবলের কারণে তার কাছের এক বড় ভাইয়ের সহায়তায় ২০২০ সালের ১৭, ১৮ ও ১৯ জানুয়ারি তিন দিনব্যাপী নিজ উপজেলায় অনুষ্ঠিত হয় বইমেলা। দেশের অনেক গুণী মানুষ তার বইমেলায় অতিথি হিসেবে আসেন। তার ইচ্ছা ও আত্মবিশ্বাস থেকেই পাঠাগার ও বইমেলা শুরু করা। শুধু তাই নয়, বর্তমানে তিনি আটটি গ্রামভিত্তিক পাঠাগার, চারটি পথ পাঠাগার, পাঁচটি স্টেশন পাঠাগার, একটি শিশু পাঠাগার গড়ে তুলেছেন। আর তার এই ভালো কাজের স্বীকৃতিস্বরূপ এবং বইপড়া আন্দোলন নিয়ে কাজ করায় আসাদ ‘জয় বাংলা ইয়ুথ অ্যাওয়ার্ড-২০২২’ অর্জন করেন। এ ছাড়া পেয়েছেন আইভিডি বাংলাদেশ ভলান্টিয়ার অ্যাওয়ার্ড ২০২১, আলোর প্রদীপ সম্মাননা ২০২২, বছরের সেরা নায়ক-২০২২ ইত্যাদি সম্মাননা।
এর মাধ্যমে তিনি দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন বহু তরুণের মাঝে। টাকার অভাবে পড়ালেখা বন্ধ হওয়ার উপক্রম হওয়া আসাদ আজ বহু মানুষের অনুপ্রেরণা। বর্তমানে তিনি সফল একজন উদ্যোক্তা ও সমাজের আলোচিত মুখ। আসাদ বলেন, পাঠাগারের জন্য একটা ফাউন্ডেশন ও দুজন ব্যক্তি মিলে একটা ভ্যান কিনে দেন। সেটা পাঠাগারের কাজে ব্যবহারের পাশাপাশি নিজে অবসর সময়ে ভ্যান চালাই। সেটা থেকে গত বছর ৬০ হাজার টাকা ইনকাম করি। যেটা দিয়ে পাঠাগার উন্নয়নের পাশাপাশি কিছু জমিও বন্ধক রেখেছি।
ভবিষ্যৎ পরিকল্পনার কথা জানতে চাইলে অদম্য সাহসী স্বপ্নবাজ এই তরুণ বলেন, বই পড়ার আন্দোলন আমার গ্রাম থেকে অন্য গ্রাম এবং সারা বাংলাদেশে ছড়িয়ে পড়ুক। প্রত্যেকটি গ্রামেই একটি করে পাঠাগার গড়ে উঠুক। লাখ লাখ পাঠাগারে সারা দেশ ভরে যাক। সবাই বই পড়ুক। বই পড়ার বিকল্প কিছু নেই। তাই বলব বই পড়ো, পড়ো এবং পড়ো। মৃত্যুর আগে হলেও দেখে যেতে চাই সব গ্রামেই একটি করে পাঠাগার হয়েছে। তাতেই আমার মৃত্যু সার্থক হবে।
জাহ্নবী