ছবি: এআই
কখনো যাচাই করে দেখেছ কি তোমরা ঠিক কত বছর আগের স্মৃতি মনে করতে পার? এর উত্তরে হয়তো পাওয়া যাবে পাঁচ-সাত, বড়জোর তিন বছর বয়সের ঝাপসা কিছু স্মৃতি। শিশুকালের দুই কিংবা এক বছর বয়সের স্মৃতি মনে পড়া বাস্তবে আদতেই অসম্ভব। শিশু বয়সে আমরা ঠিক কী ভাবতাম, কী ভেবে কান্না পেত, আবার কী ভেবেই হাসতাম- এমন কিছু জানার কৌতূহল কিশোর বয়সে সবারই হয়। কিন্তু কেন আমরা শৈশবের প্রথম দিকের স্মৃতি মনে করতে পারি না? ঠিক এমন প্রশ্ন বিজ্ঞানীদের মনেও। চলো জেনে নেই এখন পর্যন্ত কী কী উত্তর খুঁজে পেলেন বিজ্ঞানীরা।
অভিযোজন সুবিধা দিতে
শৈশবের স্মৃতি ভুলে যাওয়ার এই রহস্যকে বলা হয় ‘ইনফ্যান্টাইল অ্যামনেশিয়া।’ মনোবিদ সিগমুন্ড ফ্রয়েড ১৯৩৫ সালে প্রথম এই শব্দটি ব্যবহার করেন। ফ্রয়েডের মতে, শিশু বয়সের অনেক স্মৃতিই মানসিক বিকাশ ও সামাজিক অভিযোজনের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠতে পারে। শিশুর স্বাভাবিক বিকাশের জন্যই এ সময়ের স্মৃতিগুলো অবচেতন মনেই বাদ হয়ে যায়। ফ্রয়েডের এই ব্যাখ্যা কতটুকু ঠিক বা ভুল নিশ্চিতভাবে বলা সম্ভব নয়। আধুনিক বিজ্ঞানীদের অনেকেই এড়িয়ে গিয়েছেন এই ধারণা।
দ্রুত স্মৃতি লোপ
আধুনিক বিজ্ঞানীরা মূলত জোর দিয়েছেন শিশুদের মস্তিষ্কের গঠন ও ধরনের ওপর। মস্তিষ্কে স্মৃতি থেকে যাওয়ার বিষয়টি ঘটে স্নায়ুকোষ সংযোগের মধ্য দিয়ে। স্নায়ু সংযোগ গড়ার দিক দিয়ে শিশুদের মস্তিষ্ক বিস্ময়করভাবে বেশ সক্রিয়। শিশুরা প্রতি সেকেন্ডে ৭০০ স্নায়ুযোগ গড়ে তুলতে পারে। যে কারণে আমরা দেখতে পাই শিশুরা বড়দের তুলনায় অনেক সহজে এবং দ্রুত ভাষা শিখতে পারে। তবে বিজ্ঞানীরা মনে করেন, শিশুদের স্মৃতি ধারণের ক্ষমতাটি হয় ক্ষণস্থায়ী। কিছু সময় পরই তাদের স্মৃতি পুরোপুরি লোপ পেয়ে যায়।
মস্তিষ্কের পরিবর্তন
শিশু ও প্রাপ্তবয়স্কদের মস্তিষ্কের গঠন, কার্যবিধি এক নয়। শৈশবে আমাদের মস্তিষ্ক থাকে অপরিণত। বড় হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে মস্তিষ্কের পরিপূর্ণ গঠন সম্পন্ন হয়। সেই সঙ্গে মস্তিষ্কের কার্যাবলি ও কাজ করার ধরনও বদলে যায়। যে কারণে শৈশবের স্মৃতি বড়বেলায় উদ্ধার করা সম্ভব হয় না বলে মনে করেন বিজ্ঞানীরা।
অপরিণত মস্তিষ্কের গঠন
শিশুরা সাধারণত ক্ষুধা, খাওয়া, ঘুমের মতো কাজগুলোই মনে রাখতে পারে। তবে কোনো ঘটনা ঘটলে সেই অভিজ্ঞতা স্মৃতি আকারে হয়তো মনে রাখতে পারে না। অভিজ্ঞতা-জাতীয় স্মৃতি মনে রাখতে সাহায্য করে মস্তিষ্কের প্রি ফ্রন্টাল কর্টেক্স ও হিপোক্যাম্পাস নামের গুরুত্বপূর্ণ দুটি অংশ। শৈশবে প্রি ফ্রন্টাল কর্টেক্স ও হিপোক্যাম্পাসের বিকাশ থাকে অসম্পূর্ণ। মস্তিষ্কের এই অসম্পূর্ণতাই শৈশবের স্মৃতি ভুলে যাওয়ার এখন পর্যন্ত সবচেয়ে যৌক্তিক কারণ।
হাঁটা-চলার অক্ষমতা
‘ফ্রন্টিয়াস ইন সাইকোলজি’তে প্রকাশিত এক প্রবন্ধে বিজ্ঞানীরা দেখান, স্মৃতি ধারণের সঙ্গে রয়েছে চলা-ফেরা ও হাঁটা-চলার সম্পর্কও। প্রবন্ধে বলা হয়, যখন কোনো প্রাণী চলা-ফেরা করতে পারে না, তখন মস্তিষ্কের হিপোক্যাম্পাসের ঘটনা সমন্বয় করতে অসুবিধার সৃষ্টি হয়। তাই শিশুরা হাঁটা-চলা করতে শেখার আগের স্মৃতি মনে রাখতে পারে না এমনটাই দেখা যায়।
আত্মপরিচয় ও ভাষাগত অদক্ষতা
স্বভাবতই শিশুদের আত্মপরিচয়ের ধারণা থাকে না। ব্যক্তির নিজের সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা না থাকা নিজের সম্পর্কে ঘটে যাওয়া অভিজ্ঞতা সম্পর্কিত করতে না পারার কারণ বলে মনে করেন গবেষকরা। আর তাতেই বাধ সাধে স্মৃতি তৈরিতে। অন্যদিকে কোনো ঘটনার বিবরণ ও স্মৃতিচারণ করতে প্রয়োজন হয় ভাষার। শৈশবে ভাষাগত দক্ষতা না থাকাও সে সময়ের স্মৃতি মনে রাখতে না পারার সঙ্গে সম্পর্কিত।
তবে কি শৈশবের স্মৃতি হারিয়েই যায়
শৈশবের স্মৃতি লোপ পায়, নাকি মস্তিষ্কেই লুকিয়ে আছে তা নিয়ে বিজ্ঞানীদের সংশয় এখনো কাটেনি। তবে সাম্প্রতিক এক গবেষণায় শৈশবের স্মৃতির সন্ধানে বিজ্ঞানীরা খুঁজে পেয়েছেন আশার আলো। এতদিন ভাবা হতো অপরিণত হিপোক্যাম্পাস স্মৃতি ধারণে খুব একটা সমর্থ নয়। সায়েন্স জার্নালে প্রকাশিত এক গবেষণা বলছে উল্টো কথা। ইয়েল ইউনিভার্সিটির একদল গবেষক হিপোক্যাম্পাসের কার্যক্ষমতা দেখতে পরীক্ষা চালান ৪ মাস থেকে ২৫ মাস বয়সী শিশুদের ওপর। মস্তিষ্কের স্ক্যানের মাধ্যমে এই পরীক্ষায় উঠে আসে বিভিন্ন অভিজ্ঞতা। ঘটনার স্মৃতি তৈরিতে শিশুদের অপরিণত হিপোক্যাম্পাস প্রাপ্তবয়স্কদের মতোই সক্ষম। তা হলে শৈশবের স্মৃতি কোথায় যায়? অনেকেই মনে করছেন, হয়তো এসব স্মৃতি লুকিয়ে আছে মস্তিষ্কেরই কোনো অন্তরালে। আর তা খুঁজতেই এখন মনোযোগ দিয়েছেন বিজ্ঞানীরা।