গত কয়েক দশক ধরেই লবণাক্ততার কারণে জমিতে ফলে না ফসল। মিঠাপানির আধারগুলো গেছে শুকিয়ে। গ্রামের পাশ দিয়ে খাল প্রবাহমান থাকলেও পানির অভাবে শস্য আবাদ করতে পারেন না উপকূলের কৃষকরা। শুষ্ক মৌসুমে দিগন্তজুড়ে দেখা দেয় খরা। এরই মাঝে সম্ভাবনার স্বপ্ন দেখছে এই এলাকার কৃষকরা। পতিত থাকা ফসলি জমির কোণায় পুকুর করে মিঠাপানির সংস্থান করছেন তারা। সেই পানি দিয়ে এখন ফলানো হচ্ছে শস্য। দিগন্তজুড়ে শস্যের খেতগুলো ভুট্টা ও সবজির আবাদে সবুজ হয়ে গেছে। এক ফসলি জমিগুলো এখন তিন ফসলে রূপান্তর হচ্ছে।
সাতক্ষীরার উপকূলীয় শ্যামনগর উপজেলার কাশিমারি ইউনিয়নের খুটিকাটা গ্রাম। আগে এখানকার কৃষকরা কেবল আমন ধান আবাদ করতে পারতেন। এখন সেই লবণাক্ত জমিতে লাউ, কুমড়া, পেঁপে, ঢেঁড়স, পুঁইশাক, শশা, লাল শাক, করলা, সূর্যমুখীসহ বিভিন্ন প্রকার ফসল উৎপাদন করে সফল হয়েছেন তারা। সম্ভাবনার স্বপ্ন দেখাচ্ছেন আশপাশের কৃষকদের। পতিত জমি এখন আশা দেখাচ্ছে তাদের। স্বপ্ন বুনছেন আগামীর জন্য।
খুটিকাটা গ্রামের প্রান্তিক কৃষক নির্মল সরকার, রবীন্দ্রনাথ সরকার ও নিহার সরকার জানান, লবণাক্ততার কারণে তাদের গ্রামের শত শত হেক্টর কৃষিজমি পতিত থাকে। ফসল ফলে না ঠিকমতো। তা ছাড়া মিঠাপানির আধারগুলো শুকিয়ে গেছে। গত বছর সিনজেনটার সহযোগিতায় লবণাক্ত জমিতে ফসল উৎপাদন করে এলাকায় রীতিমতো সাড়া ফেলে দিয়েছে তারা। গ্রামের অধিকাংশ কৃষককে বৃষ্টির পানি সংরক্ষণে পুকুর খনন করে দিয়েছে সিনজেনটা। এ ছাড়া আবাদের জন্য ভার্মিকম্পোস্ট সার প্ল্যান্ট, শস্যবীজ এবং অন্যান্য কৃষি উপকরণ সরবরাহ করেছে।
তারা আরও জানান, কৃষকরা লবণাক্ত জমিতে বৃষ্টির পানি ব্যবহার করে নানা প্রকার ফসল উৎপাদন করে লাভবান হচ্ছেন। চলতি মৌসুমে প্রতি বিঘা জমিতে একেকজন কৃষক ৩০-৫০ হাজার টাকা লাভ করেছেন। আরও অধিকসংখ্যক পুকুর খনন এবং গ্রামের ওপর দিয়ে বয়ে যাওয়া খালগুলো পুর্নখনন করে বৃষ্টির পানি সংরক্ষণের ব্যবস্থা করলে বারো মাসই সবজিসহ বিভিন্ন প্রকার ফসল উৎপাদন করা সম্ভব।
এ বিষয়ে সিনজেনটা বাংলাদেশ লিমিটেডের পরিচালক (বিজনেস সাসটেইনেবিলিটি ও এক্সটার্নাল অ্যাফেয়ার্স) মো. শহীদুল ইসলাম বলেন, ‘উপকূলের পরিস্থিতি বিবেচনা করে কৃষকদের শস্য আবাদে পুকুর খনন কার্যক্রম পরিচালনা করছে সিনজেনটা। এতে করে কৃষকরা লাভবান হচ্ছেন। বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ করে লবণাক্ত জমিতে ফসল ফলাতে পারছেন তারা।’
তিনি বলেন, ‘উপকূলীয় এলাকায় অধিকসংখ্যক পুকুর খননের পাশাপাশি উন্মুক্ত জলাশয় সংরক্ষণ করতে হবে। যাতে করে কৃষকরা বৃষ্টির পানি ব্যবহার করে ফসল উৎপাদন করতে পারেন। সিনজেনটা কৃষকদের পুকুর খননের পাশাপাশি বীজ, ভার্মিকম্পোস্ট , সোলার ইরিগেশন ও কৃষি বিষয়ক প্রশিক্ষণ দিচ্ছে। বীজ ও কীটনাশকের পরিমিত ব্যবহারের মাধ্যমে ফসলের সর্বোচ্চ উৎপাদনের বিষয়ে কার্যকর পরামর্শ দিচ্ছে সিনজেনটা। সব মিলিয়ে এ অঞ্চলের কৃষকদের মধ্যে টেকসই কৃষি ব্যবস্থার পাশাপাশি রিজেনারেটিভ এগ্রিকালচার পদ্ধতিগুলো অনুসরণ করা হচ্ছে।’ সফলভাবে প্রকল্প বাস্তবায়নের মাধ্যমে এসডিজির অনেকগুলো লক্ষ্য পূরণ করা হচ্ছে বলে উল্লেখ করেন তিনি।
জানা গেছে, খুটিকাটা গ্রামে শস্য আবাদের মাধ্যমে কৃষিকে টেকসই রূপান্তর করতে গো গ্রো প্রকল্প গ্রহণ করেছে সিনজেনটা। গত বছর শুরু হওয়া এ প্রকল্পে জড়িত কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর (ডিএই), বিনা, ডিএইর এসএসি প্রকল্প এবং এসআরডিআই। শুরুতে পুকুর খননের মাধ্যমে মিঠাপানির সংস্থান করা হয়। খুটিকাটা গ্রামের ৪০ জন কৃষক দিয়ে এই কার্যক্রম শুরু হয়। সেসব কৃষক জমির কোণায় কয়েকটি পুকুর খনন করেন। এক একটি পুকুর ১০-১৫ ফুট গভীর। খননে প্রায় এক লাখ টাকা খরচ হয়। আর সেই পুকুর মিঠাপানির আধার হিসেবে কাজ করে। সবজি ও শস্য আবাদের সময় পুকুরের পানি দিয়ে সেচ দেওয়া হয়। তবে মিঠা পানির সরবরাহ বাড়াতে এই ধরনের পুকুর খননেন পাশাপাশি বিদ্যমান খালের পানি সরবরাহের উদ্যোগ নিতে হবে। তাহলে এ অঞ্চলে আরও বেশি উৎপাদন বাড়ানো সম্ভব।
এ বিষয়ে জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ হুমায়ুন কবির বলেন, ‘উপকূলে বসবাসরত মানুষদের বারো মাসই নানা ধরনের প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলা করতে হয়। ঝড়, জলোচ্ছ্বাস ও খরার কারণে তাদের টিকে থাকা মুশকিল। সেখানে জমি পতিত থাকলে অর্থনৈতিকভাবে তারা ব্যাপক ক্ষতির মুখে পড়েন। তাদের টিকে থাকার পাশাপাশি অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী করার উপায় বের করতে হবে আমাদের। কারণ ঝড়, জলোচ্ছ্বাস ও বন্যা বন্ধ করা তো কারও পক্ষে সম্ভব নয়। ফলে এমন পরিবেশে টিকে থাকতে ফসলের উৎপাদন বাড়াতে হবে।’
তিনি আরও বলেন, ‘সিনজেনটার এ প্রযুক্তি জেলার অন্যান্য গ্রামে সম্প্রসারণের উদ্যোগ নিতে হবে। সরকারের পাশাপাশি বেসরকারিখাতকে এগিয়ে আসতে হবে। মিঠাপানি সরবরাহের লক্ষ্যে খালে পানি সংরক্ষণের ব্যবস্থা নিতে কার্যকর উদ্যোগ নেওয়া হবে।’
সালমান/