দেশজুড়ে চলছে তীব্র দাবদাহ। এই দাবদাহ ছাপিয়ে সুনামগঞ্জের হাওরে হাওরে চলছে বোরো ফসল তোলার ধুম। হাওরপাড়ে রীতিমতো চলছে ধানকাটা, মাড়াই ও গোলায় তোলার উৎসব।
অন্য বছরগুলোতে যেখানে আগাম বন্যা ও পাহাড়ি ঢলে কৃষকের সারা বছরের একমাত্র জীবিকা পানির নিচে তলিয়ে স্বপ্নভঙ্গ হয়, সেখানে এ বছর অতিবৃষ্টি ও পাহাড়ি ঢল না থাকায় অনেকটা নির্ভার হয়েই ফসল তুলছেন হাওরপাড়ের কিষান-কিষানিরা। ফলে হাওরজুড়ে শুধুই স্বস্তির হাসি।
কৃষকরা বলছেন, আরও সপ্তাহখানেক আবহাওয়া অনুকূলে থাকলে এবং ভারী বর্ষণ ও উজানের পাহাড়ি ঢল না এলে এ বছর শতভাগ ফসলই গোলায় উঠবে।
হাওরে বছরে একটিই ফসল হয়। তাই এই বোরো ফসলকে ঘিরে হাওরপাড়ের ৩০ লাখ মানুষ স্বপ্ন দেখেন। এই একটি ফসলের ওপরই তাদের জীবন-জীবিকা নির্ভর করে। তবে এই স্বপ্নের ফসল কোনো বছর দেখা মেলে তো কোনো বছর অকাল বন্যা ও পাহাড়ি ঢলে তলিয়ে যায়। তাই হাওর এলাকায় বোরো ধান যেন সোনার হরিণ। আর তাই যে বছর ফসল ওঠে, সে বছর হাওরে হাওরে চলে উৎসব।
এ বছর দেশজুড়ে এপ্রিলের শুরু থেকেই তীব্র দাবদাহ ও প্রচণ্ড গরমে জনজীবন অতিষ্ঠ। সুনামগঞ্জেও এর ব্যতিক্রম নয়। কিন্তু সব গরম আর দাবদাহ ছাপিয়ে সুনামগঞ্জের ১৩৭টি ছোট বড় হাওরেরই চলছে নিজেদের একমাত্র সম্বল বোরো ধান তোলার উৎসব। এই তীব্র গরমেও হাওরের মানুষের চোখে-মুখে স্বস্তির হাসি।
গভীর হাওর থেকে কৃষক ধান কেটে খলায় নিয়ে আসেন। আর কিষান-কিষানিরা মিলে সেই ধান মাড়াই এবং শুকানোর কাজ করেন খলাতেই। ধান তোলায় ব্যস্ত কিষান-কিষানিরা কথা বলাও ফুরসত পাচ্ছেন না।
তারপরও রোদ ও তীব্র গরম সুনামগঞ্জের জন্য উপকারী জানিয়ে তারা বলেন, এ বছর অতিবৃষ্টি ও আগাম পাহাড়ি ঢল না হওয়ায় অনেকটা স্বস্তিতেই ফসল গোলায় তুলছেন তারা। আরও ৭ থেকে ১০ দিন বৃষ্টিপাত না হলে শতভাগ ফসল কেটে গোলায় তুলতে পারবেন।
সুনামগঞ্জ সদর উপজেলার দেখার হাওরপাড়ের কৃষক নুরুল ইসলামের (৫৬) কাছে গরমের মধ্যে ধান কাটতে ও শুকাতে সমস্যা হচ্ছে কি-না জানতে চাইলে বলেন, এই রোদ গরম এ বছর হাওরের মানুষের জন্য আশীর্বাদ। আরও ৭ থেকে ১০ দিন রোদ থাকলে হাওরের সব ধান কেটে রোদে শুকিয়ে গোলায় তোলা সম্ভব হবে। তা না হলে কোনো বছর পাহাড়ি ঢলে, না হলে কোনো বছর রোদের অভাবে কাটা ধান বা শুকানো সম্ভব হয় না। পচে নষ্ট হয়ে যায়। তাই এ বছর রোদ, গরম হাওরের মানুষের জন্য আশীর্বাদ হয়ে এসেছে।
তিনি বলেন, তাদের পরিবারে চার সন্তানসহ ছয় সদস্য। জমিতে যে ধান হয়েছে তাতে সারা বছর ভালোই চলে যাবে।
সুনামগঞ্জের তাহিরপুরের শনির হাওরপাড়ের ফাতেমা ইসহাক (৬০) বলেন, এ বছর শনির হাওরে ভালো ফসল হয়েছে। বৃষ্টিপাত না থাকায় ধান কাটতে সমস্যা হয়নি। সেই সঙ্গে রোদ থাকায় ধান মাড়াই করে খলাতে শুকিয়ে ঘরে নিতে পারছেন। কিন্তু সব বছর এমন থাকে না। কোনো বছর অতিবৃষ্টি আর পাহাড়ি ঢলে ধান তলিয়ে যায়। আর কষ্ট করে কোনোমতে ধান কেটে আনলেও রোদের অভাবে সেই ধান শুকানো যায় না। পচে নষ্ট হয়ে যায়।
একই এলাকার নূর কালাম (৪০) বলেন, সুনামগঞ্জের বছরে এই একটি মাত্র বোরো ফসল হয়। এই একমাত্র ফসলের ওপরই আমাদের জীবন-জীবিকা চলে। যে বছর ফসল তোলা সম্ভব হয় না, সে বছর আমাদের খেয়ে না খেয়ে কোনোমতে টিকে থাকা লাগে। এ বছর ভালো ধান হয়েছে। ধান হলে আমরা খুশি থাকি। কারণ এই ধান সারা বছরের খাবার, সন্তানদের লেখাপড়া, চিকিৎসা সবকিছু নির্ভর করে।
সুনামগঞ্জ কৃষি অধিদপ্তরের দেওয়া তথ্যমতে, জেলার ১৩৭ ছোট বড় হাওরে একযোগে ধান কাটা শুরু হয়ে এখন প্রায় শেষের দিকে। এ বছর বোরো ধানের লক্ষ্যমাত্রা ছিল দুই লাখ ২৩ হাজার ২৪৫ হেক্টর। কিন্তু এ বছর বোরো ধানের আবাদ হয়েছে দুই লাখ ২৩ হাজার ৪০৭ হেক্টর জমিতে। যা লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ১৬২ হেক্টর বেশি বোরো ধানের আবাদ করা হয়েছে। যার বাজারমূল্য চার হাজার ১১০ কোটি টাকা।
গত রবিবার (২৮ এপ্রিল) পর্যন্ত গভীর হাওরেই ৮৫ ভাগ ধান কাটা শেষ হয়েছে।
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক বিমল কান্তি সোম বলেন, আবহাওয়া ভালো থাকায় হাওরের অবস্থা খুবই ভালো। এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহ থেকে জেলার সব হাওরে ধান টাকা শুরু হয়েছে। এখন পর্যন্ত গভীর হাওরে ৮৭ ভাগ ফসল কাটা হয়েছে। অন্যান্য হাওরে ৭৭ শতাংশ ধান কাটা হয়ে গেছে। আর চার থেকে পাঁচ দিনের মধ্যে গভীর হাওরে শতভাগ ধান কাটা হয়ে যাবে। ধান কাটতে কৃষকদের সব ধরনের সহায়তা দেওয়া হচ্ছে।
সুনামগঞ্জ জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ, রাশেদ ইকবাল চৌধুরী বলেন, সুনামগঞ্জের সব ক’টি হাওরে কৃষকরা উৎসবমুখর পরিবেশে ধান কাটছেন। কৃষকদের যাতে এই উৎসবমুখর পরিবেশ বজায় থাকে এবং সরকারের দেওয়া ধানের ন্যায্যমূল্য পান, প্রশাসন সে লক্ষ্যে কাজ করছে।
জেলা প্রশাসক আরও বলেন, মধ্যস্বত্বভোগীরা যাতে কৃষকের মধ্যে ঢুকে কৃষকদের লাভ তুলে নিতে না পারে, এ সে বিষয়ে প্রশাসন কঠোর প্রদক্ষেপ নেবে।
গিয়াস চৌধুরী/অমিয়/