![অরণ্য চিরানের স্বাধীনতা পুরস্কারের ঘোষণায় সমালোচনার ঝড়!](uploads/2024/03/22/1711085865.Aronno_Chiran.jpg)
সরকার প্রতিবছর মুক্তিযুদ্ধ, শিক্ষা-সাহিত্য, চিকিৎসা, সমাজসেবাসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে গৌরবোজ্জ্বল ও কৃতিত্বপূর্ণ অবদানের জন্য রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ বেসামরিক পুরস্কার ‘স্বাধীনতা পুরস্কার’ দিয়ে থাকে। চলতি বছরের জন্য ১০ জনকে মনোনীত করা হয়। গত ১৫ মার্চ প্রকাশিত ওই তালিকায় ময়মনসিংহ থেকে চিকিৎসাবিদ্যায় ডা. হরিশংকর দাশ, ক্রীড়ায় ফিরোজা খাতুন ও সমাজসেবায় অরণ্য চিরান মনোনীত হন। কিন্তু তিনজনের মধ্যে সমাজসেবায় অবদানের জন্য মনোনীত হওয়া অরণ্য চিরানকে ঘিরে সৃষ্টি হয়েছে বিতর্ক। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অনেকে লাগাতার পোস্ট করে তার নাম পদক থেকে বাতিলের দাবি জানানোসহ মানববন্ধনও করা হয়েছে। তারা মনে করেন, স্বাধীনতা পুরস্কারের জন্য অরণ্য চিরান কখনোই যোগ্য নন।
গতকাল বুধবার ময়মনসিংহের সচেতন সমাজের ব্যানারে ময়মনসিংহ প্রেস ক্লাবের সামনে মানববন্ধন কর্মসূচি পালন করা হয়। সেখানে নাগরিক নেতা, শিক্ষক ও আদিবাসী নেতারা উপস্থিত হন। এ সময় বক্তারা তালিকা থেকে অরণ্যের নাম বাতিলের দাবি জানান। ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর মধ্যে আরও বেশি অবদান রাখা অনেকে এই রাষ্ট্রীয় পুরস্কার না পেলেও এনজিওকর্মী অরণ্য চিরান সমাজসেবায় রাষ্ট্রীয় পুরস্কার পেয়ে যাওয়ায় বিব্রত ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর নেতারা। ফলে গত শনিবার সমতল আদিবাসীদের জাতীয় সংগঠন ট্র্যাইবাল ওয়েলফেয়ার অ্যাসোসিয়েশনের একাংশের চেয়ারম্যান সুবাস চন্দ্র বর্মণ অরণ্য চিরানের কর্মকাণ্ড ও তার স্বাধীনতা পদক বাতিলের দাবি জানিয়ে মন্ত্রিপরিষদ সচিব বরাবর একটি লিখিত আবেদন করেন। জেলা প্রশাসক কার্যালয়ে দাবি সংবলিত আবেদনটি জমা দেন আদিবাসী নেতারা।
আবেদনে উল্লেখ করা হয়- রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ বেসামরিক এই পুরস্কার পাওয়ার মতো গারো সম্প্রদায় বা সাধারণ বাঙালি সমাজে অরণ্য চিরানের এমন কোনো অবদান নেই। বরং তার বিরুদ্ধে নানা অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ রয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর স্পেশাল অ্যাফেয়ার্স বিভাগ থেকে জমি আছে, কিন্তু বাড়ি নেই প্রকল্পের অধীনে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর মানুষের জন্য বরাদ্দকৃত ঘর ধনাঢ্য ব্যক্তিদের দিয়েছেন তিনি। অরণ্য চিরান ব্যক্তিগতভাবে আর্থিক লেনদেনের মাধ্যমে দুজন পিএইচডি ডিগ্রিধারী এবং একজন বিসিএস কর্মকর্তাকে ওই ঘরগুলো দিয়েছেন।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, অরণ্য চিরানের বাড়ি ময়মনসিংহের ধোবাউড়া উপজেলার দক্ষিণ মাইজপাড়া ইউনিয়নের দিঘলবাগ গ্রামে। তিনি ওই গ্রামের প্রয়াত ক্ষিতীশ মানখিনের ছয় ছেলে ও এক মেয়ের মধ্যে সবার বড়। ১৯৮০ সালের ২৯ নভেম্বর জন্ম নেওয়া অরণ্য চিরান ‘সারা’ নামে একটি এনজিওতে ময়মনসিংহ শহরে প্রোগ্রাম কো-অর্ডিনেটর হিসেবে কাজ করেন ২০১১ সাল থেকে। এর আগে টাঙ্গাইলের মধুপুর ও ধোবাউড়ায় দুটি স্কুলে ১৯৯৮ সাল থেকে ২০১১ সাল পর্যন্ত শিক্ষকতা করেন।
ক্ষুব্ধ নাগরিকরা জানান, সাধারণত সর্বজনীন গ্রহণযোগ্য ব্যক্তিদের জীবনব্যাপী অবদানের জন্য যেখানে স্বাধীনতা পুরস্কার দেওয়া হয়ে থাকে, সেখানে অরণ্য চিরান কোথাও কোনো অবদান রাখেনি। সমাজসেবার জন্য কোনো প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা কিংবা মানুষের কল্যাণকর কিছু করেছেন উল্লেখ করার মতো এমন কোনো কাজ তিনি করেননি। তবুও তাকে রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মাননা ‘স্বাধীনতা পুরস্কার’ দেওয়া হয়েছে।
ময়মনসিংহ নাগরিক আন্দোলনের সাধারণ সম্পাদক বীর মুক্তিযোদ্ধা নুরুল আমিন কালাম বলেন, অনেক যোগ্য লোক থাকার পরেও সমাজসেবায় যে অপরিচিত মানুষটিকে রাষ্ট্র সর্বোচ্চ পদকের জন্য মনোনীত করা হয়েছে, তা সঠিক হয়নি। সমাজসেবায় মানুষটির ভূমিকার কথা কেউ জানে না। তার নাম শুনে সবাই বিস্মিত হয়েছেন।
সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) ময়মনসিংহ মহানগরের সম্পাদক আলী ইউসুফ বলেন, ইতিপূর্বে যারা স্বাধীনতা পুরস্কার পেয়েছেন, তাদের নামের পাশে যদি অরণ্য চিরানের নাম থাকে তাহলে তাদের অমর্যাদা করা হবে। আমরা মনে করছি, এটি একটি ভুল হয়েছে। এর আগে ২০২০ ও ২০২২ সালেও এরকম ভুল হয়েছিল, পরে সংশোধন করা হয়। এ বছরও অরণ্য চিরানের নামটি বাতিল করে নতুন তালিকা প্রকাশ করা হোক। কীভাবে অরণ্য চিরান পদকের জন্য মনোনীত হলেন এবং তিনি তালিকাভুক্ত হলেন, সেটা তদন্ত করে যারা জড়িত তাদের বিরুদ্ধেও শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা প্রয়োজন।
ময়মনসিংহ সাহিত্য সংসদের সম্পাদক স্বাধীন চৌধুরী বলেন, স্বাধীনতা পুরস্কার এমন একজন ব্যক্তিকে দেওয়া হবে, তার এমন কোনো অর্জন নেই যা ইতিবাচক কোনো বার্তা দেয় না। প্রশ্নহীনভাবে বলতে পারি, এটি ভুল সিদ্ধান্ত। এমন হতে পারে কোনোভাবে প্ররোচিত হয়ে পদক কমিটির লোকজন অন্যায় সিদ্ধান্তে তার নাম তালিকাভুক্ত করেছেন।
সমতল আদিবাসীদের সংগঠন ট্রাইবাল ওয়েল ফেয়ার অ্যাসোসিয়েশন ময়মনসিংহ সদর শাখার সভাপতি বিপুল হাজং বলেন, একজন আদিবাসী রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ পুরস্কার পেয়েছেন, এতে আমাদের আনন্দিত হওয়ার কথা। কিন্তু আমরা বিব্রত। আদিবাসীদের মধ্যে অনেকে আছেন, যারা জীবনব্যাপী অবদান রেখেছেন। অথচ স্বাধীনতা পুরস্কার পাননি। অরণ্য চিরান এনজিওকর্মী ব্যতীত কিছু নন। তিনি এলাকাতেও এমন কোনো প্রতিষ্ঠান গড়েননি যা সমাজসেবায় অবদান রেখেছে। বরং তার বিরুদ্ধে আদিবাসী সমাজের বিভিন্ন প্রকল্পে দুর্নীতির অভিযোগ রয়েছে। তদন্ত করলেই সত্যতা পাওয়া যাবে। স্বাধীনতা পুরস্কারে মহান ব্যক্তিদের নাম থাকলেও আমরা চাই না দুর্নীতিবাজ অরণ্যের নাম থাকুক। পুরস্কারের মর্যাদা অক্ষুণ্ণ রাখতে পুরস্কার থেকে তার নাম বাতিল করা হোক।
তবে অরণ্য চিরান বলেন, আমাকে সবাই চিনবে বিষয়টি এমন নয়। আমি বিভিন্ন সামাজিক সংগঠনের সঙ্গে দীর্ঘদিন ধরে কাজ করছি। তৃণমূল মানুষ ও আদিবাসীদের সেতুবন্ধন করে তাদের কল্যাণে কাজ করছি। আমার এলাকার রোগীরা হাসপাতালে এলে তাদের পাশে থেকেছি, রক্ত জোগাড় করে দিয়েছি। আদিবাসীদের ভূমি ও পারিবারিক বিরোধ নিষ্পত্তি করতে সালিশ করে সমাধান করেছি। সুবিধাবঞ্চিত অনেক শিক্ষার্থীকে পড়াশোনার সুযোগ করে দিয়েছি। আমার কাজের প্রতিদানস্বরূপ আমি স্বাধীনতা পুরস্কার পেয়েছি।
অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগ ওঠার কারণ সম্পর্কে তিনি বলেন, ট্র্যাইবাল ওয়েলফেয়ার অ্যাসোসিয়েশনের কিছু লোক ঈর্ষান্বিত হয়ে আমার স্বাধীনতা পুরস্কারপ্রাপ্তি নিয়ে অযথা সমালোচনা করছেন। মূলত সাংগঠনিক ঝামেলা নিয়ে আমার বিরুদ্ধে বদনাম রটাচ্ছেন তারা। আমার বিরুদ্ধে অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগ মিথ্যা ও ভিত্তিহীন।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে ময়মনসিংহের জেলা প্রশাসক দিদারে আলম মোহাম্মদ মাকসুদ চৌধুরী বলেন, ট্রাইবাল ওয়েল ফেয়ার অ্যাসোসিয়েশনের নেতারা রাষ্ট্রীয়ভাবে অভিযোগ দিয়েছেন। আমি অভিযোগের একটি কপি পেয়েছি। এখন আবারও কোনো সিদ্ধান্ত নিলে রাষ্ট্রীয়ভাবেই সিদ্ধান্ত হবে।