প্রায় বছর পাঁচেক ধরে দেশের বাজারে পানি নিয়ে বাণিজ্য বাড়ছে। খোলা ও বোতলজাত দুই ধরনের পানি বিক্রি হচ্ছে। এ দেশে আমদানি করা পানির চাহিদাও আছে। বছরে লাখ ডলার ব্যয় হচ্ছে বোতলজাত পানি আমদানিতে। স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত পানি রপ্তানিও হচ্ছে। তবে আমদানির তুলনায় রপ্তানি এখনো কম।
কয়েক দিন ধরে গরমে অতিষ্ঠ জনজীবন। তাপমাত্রা বাড়ার ফলে পানির চাহিদা বেড়েছে কয়েক গুণ। প্রাকৃতিক ও বিশুদ্ধ দুই ধরনের পানির চাহিদা বেশি। এসব পানির দামও বেড়েছে।
আগে এক গ্লাস পানি পাঁচ টাকা থেকে সাত টাকায় বিক্রি করা হলেও এখন ১০ থেকে ১৫ টাকায়ও বিক্রি করছেন অনেকে। খোলা পানি বেশি দামে বিক্রি করায় ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন খেটে খাওয়া সাধারণ মানুষের অনেকে।
খোলা পানি বিক্রেতারা বলেছেন, ঘণ্টার পর ঘণ্টা লাইনে দাঁড়িয়ে পানি সংগ্রহ করতে পাত্রে করে বিক্রি করতে হচ্ছে। অনেক সময় কিনেও আনতে হয়। রোদে পানির চাহিদা বেড়েছে। এ পানি বিক্রি করেই জীবন চালাতে হয়। সব কিছুর দাম বেশি।
অন্যদিকে বোতলজাত পানির চাহিদা কয়েক গুণ বেড়েছে। ক্রেতাদের অভিযোগ, এক সময়ে ধনী পরিবারের সচ্ছল মানুষরাই বোতলজাত পানি খেতেন। এখন সাধারণ মানুষও শারীরিক সুস্থতার কথা ভেবে বোতলজাত পানি খাচ্ছেন। গরমে রাস্তাঘাটে বোতলজাত পানি কিনে খাচ্ছেন অনেকে। খুচরা পর্যায়ে দাম বাড়িয়ে বিক্রি করা হচ্ছে। খুচরা বিক্রেতারা এ অভিযোগের জবাবে বলেছেন, চাহিদা বাড়ায় অনেক ক্ষেত্রে নির্ধারিত দামের চেয়ে বেশি দিয়েও বোতলজাত পানি মিলছে না। ক্ষেত্রবিশেষে বেশি দিয়েই সংগ্রহ করতে হচ্ছে। এ ছাড়া গত কয়েক মাসেই বোতলজাত পানির দাম কোম্পানিগুলোই বাড়িয়েছে।
দেশের ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআইর সভাপতি মাহবুবুল আলম খবরের কাগজকে বলেন, ডলার সংকটের প্রভাব পড়েছে বোতলজাত পানি বিক্রিতে। প্লাস্টিকের বোতল, লেবেল, জ্বালানি, পরিবহনসহ পানি বিশুদ্ধকরণের খরচ বেশি। ন্যূনতম লাভে বিক্রি করলেও দাম বেশি পড়ছে।
এফবিসিসিআই থেকে জানা যায়, দেশে পানির বাজার এখন হাজার কোটি টাকার। প্রতি বছর ৩৫ থেকে ৪০ কোটি লিটার বোতলজাত পানি বিক্রি হয়। গ্রাম হোক বা শহর- বিশুদ্ধ পানির চাহিদা এখন সবখানেই। আমাদের দেশে হাত বাড়ালেই পাওয়া যায় বিশুদ্ধ পানি। এক সময় বিশুদ্ধ পানির বড় উৎস ছিল ভূগর্ভস্থ প্রাকৃতিক পানি। এখনো গ্রামাঞ্চলে ভূগর্ভস্থ পানিই বিশুদ্ধ পানির বড় উৎস। তবে শহর এলাকায় এ জায়গা দখল করে নিচ্ছে বোতলজাত পানি। আবার পানি বিশুদ্ধকরণের ফিল্টারও এখন ঘরে ঘরে।
বোতলজাত মাম পানি ৫০০ মিলি লিটারের দাম ২০ টাকা, এক লিটার ৩০ টাকা, দুই লিটার ৫০ টাকা বিক্রির জন্য দাম নির্ধারণ করে দেওয়া হয়েছে। একইভাবে বোতলজাত কিনলে পানির ৫০০ মিলি লিটারের দাম ২০ টাকা, দুই লিটার ৪০ টাকায় বিক্রির জন্য কোম্পানির বেঁধে দেওয়া দাম। বোতলজাত ফ্রেশ পানি ৫০০ মিলি লিটারের দাম ২০ টাকা, ৫ লিটার ৯০ টাকা। এ ছাড়া দেশের বিভিন্ন বিভাগীয় ও জেলা শহরেও স্থানীয়ভাবে বোতলজাত পানি বিক্রি হয়। এসব পানির দামও গড়ে একই।
চেইনশপে কোম্পানির বেঁধে দেওয়া দামে বিক্রি করা হলেও ভ্যাটের কারণে দাম বেশি পড়ছে। বাইরের বড় দোকানে, পাড়ামহল্লা ও উপজেলার দোকানে বোতলজাত বিশুদ্ধ পানি নির্ধারিত দামের চেয়ে দুই থেকে পাঁচ টাকা পর্যন্ত বেশি রাখা হচ্ছে। বাজার নজরদারিতে ব্যবস্থা না থাকায় বিক্রেতারা যার কাছ থেকে যা পারছেন নিচ্ছেন বলেও অভিযোগ পাওয়া যায়।
খুলনার বাগমারা এলাকার মদিনা ডিপার্টমেন্টাল স্টোর থেকে স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত দুই লিটার মহুয়া পানির বোতল ৭০ টাকায় কিনেছেন বলে খবরের কাগজকে বলেন ব্যবসায়ী জহুরুল ইসলাম।
তিনি বলেন, আমি রাজধানীতে থাকি। ব্যবসায়ের কাজে খুলনা এলে বোতলের পানি খাই। এবারে গরম বাড়ার পর মাম, ফ্রেশ এখানে পাড়ার দোকানে পাওয়া যায়নি। বিক্রেতা বলেছেন মাল নেই। বাধ্য হয়েই স্থানীয়ভাবে তৈরি পানির বোতল কিনেছি। একেক দোকানে এক এক দাম। শেষ পর্যন্ত দাম বেশি দিয়েই কিনতে হলো।
প্রাকৃতিক খনিজ পানি সাধারণত পাত্রে রেখে গ্লাসে ঢেলে বিক্রি করা হয়। অন্যদিকে বিশুদ্ধ পানি সুপারশপ ও অভিজাত স্টোরে পাওয়া যায়। আবার আমদানি করা পানিরও চাহিদা আছে আমাদের দেশে। বিশেষভাবে বড় হোটেল, দূতাবাস ও বিদেশি প্রতিষ্ঠানে আমদানি করা পানি সরবরাহ করা হয়। এ দেশের অভিজাত এলাকায় বসবাসকারী উচ্চবিত্ত শ্রেণির বেশির ভাগ মানুষই আমদানি করা পানি পান করেন। এ ছাড়া বিদেশ থেকে আসা মানুষদের অনেকে এই পানির বড় গ্রাহক।
পানির দাম বাড়ানোর প্রতিবাদ করে দাম কমানোর দাবি জানিয়ে কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব) থেকে মানববন্ধন করা হয়।
সংগঠনের পক্ষ থেকে বলা হয়, বাংলাদেশে প্রতি বছর ১৫ থেকে ২০ শতাংশ হারে বোতলজাত পানির চাহিদা বৃদ্ধি পাচ্ছে। ভোগ্যপণ্য উৎপাদনকারী বড় বড় বেশির ভাগ প্রতিষ্ঠানেরই এখন পানির ব্যবসা রয়েছে। গরম সামনে রেখে বোতলজাত সব ধরনের পানির হঠাৎ মূল্যবৃদ্ধি অন্যায়, অযৌক্তিক ও ভোক্তা স্বার্থবিরোধী ।
ক্যাবের দাবি, অবিলম্বে সব ধরনের বোতলজাত পানির অযৌক্তিক, অন্যায় ও অন্যায্য মূল্যবৃদ্ধি বাতিল করতে হবে; ভোক্তাদের সাশ্রয়ীমূল্যে নিরাপদ, স্বাস্থ্যকর পানি সরবরাহ নিশ্চিত করতে হবে। বোতলজাত পানির মূল্য স্বাভাবিক করতে প্রতিযোগিতা কমিশন, ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরসহ সংশ্লিষ্ট সব মন্ত্রণালয়ের সক্রিয় পদক্ষেপ নিতে হবে। যেসব ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান জোটবদ্ধভাবে হঠাৎ বোতলজাত পানির দাম অযৌক্তিকভাবে বাড়িয়ে ভোক্তা সাধারণকে কষ্টে ফেলেছে তাদের আইনানুগ বিচার ও শাস্তি দিতে হবে।
ক্যাবের সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট হুমায়ুন কবির ভূইয়া বলেন, গরমে পানির চাহিদা বেড়েছে। বিশেষভাবে শারীরিক সুস্থতার জন্য বোতলজাত পানি এখন আর বিলাসী পণ্য নয়। জরুরি খাবার। বেশ কয়েকটি কোম্পানি প্রতি বোতল পানির দাম বাড়িয়েছে। আধা লিটার পানির বোতল এখন বিক্রি হচ্ছে ২০ টাকায়। বাজারে যেসব বোতলজাত পানি বিক্রি হচ্ছে সেগুলোর মধ্যে পরিচিত ব্র্যান্ডের ৫০০ মি.লি. পানির সর্বোচ্চ খুচরা মূল্য এখন ২০ টাকা। কয়েক দিন আগেও এসব ব্র্যান্ডের ৫০০ মি.লি. পানির সর্বোচ্চ খুচরা মূল্য ছিল ১৫ টাকা। এ ছাড়া প্রতি ৫০০ মি. লি. বোতলজাত খাবার পানির পাইকারি মূল্য ১১-১২ টাকা। অর্থাৎ ৫০০ মি.লি. পরিমাণের প্রতি বোতল পানি খুচরা পর্যায়ে ৮-৯ টাকা বেশি দরে বিক্রি হচ্ছে, যা স্বাভাবিকের তুলনায় বেশি। সাধারণ মানুষের কথা ভেবে বোতলজাত পানির দাম কমানো এখন সময়ের দাবি।
বাংলাদেশ প্রতিযোগিতা কমিশন থেকে বোতলজাত পানির অস্বাভাবিক দাম বাড়ার ঘটনাটি তদন্ত করা হচ্ছে বলে জানা যায়।