চরাঞ্চলের মানুষ নগর থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ার কারণে নানা ধরনের সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত। বিশেষ করে যোগাযোগের সুব্যবস্থা না থাকায় নানা সংকট চরাঞ্চলের মানুষকে মোকাবিলা করতে হয়। সেচসংকট, উন্নত বীজ, সার ও প্রযুক্তির অভাবের কারণে জমি অনাবাদি পড়ে থাকে। নদ-নদীর চরাঞ্চলে অনাবাদি জমি প্রায় সাড়ে ৩৬ লাখ একর। এই জমিতে সঠিকভাবে শুধু ভুট্টা, মরিচ, পাট, ধান আর ঘাস চাষ করলেই বছরে জাতীয় অর্থনীতিতে যোগ হবে প্রায় ৫ লাখ কোটি টাকা। স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের গবেষণা প্রতিষ্ঠান বগুড়া পল্লী উন্নয়ন একাডেমি (আরডিএ) তাদের এক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানিয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে, চরে পতিত ৩৬ লাখ ৪৪ হাজার একর জমির মধ্যে এখন ধান, পাট, মরিচ, ভুট্টাসহ নানা ধরনের ফসল চাষ হয় ৯ লাখ ১১ হাজার একর জমিতে। আর বছরের পর বছর অনাবাদি পড়ে আছে প্রায় ২৭ লাখ ৩৩ হাজার একর জমি। চরের মানুষের জীবনমান উন্নয়নে পল্লী উন্নয়ন একাডেমির সঙ্গে কাজ করছে মেকিং মার্কেট ওয়ার্ক ফর দ্য চরস (এমফোরসি) প্রকল্প। এই প্রকল্প ইতোমধ্যেই উত্তরাঞ্চলে তিস্তা, ব্রহ্মপুত্র আর যমুনার চরে থাকা প্রত্যক্ষভাবে ৭৯ হাজার মানুষের জীবনমানে ইতিবাচক পরিবর্তন আনতে পেরেছে। তথ্যমতে, চর উন্নয়ন ও গবেষণা কেন্দ্র (সিডিআরসি) একটি মাস্টারপ্ল্যান তৈরি করে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ে জমা দিয়েছে। এটা সবুজ পাতার অন্তর্ভুক্ত করার প্রক্রিয়া চলছে। প্রকল্প গ্রহণ করা হলে কাজ শুরু হবে। ২০০ কোটি টাকায় প্রস্তাবিত এ প্রকল্পের কাজ শুরু হলে দেশের উত্তরাঞ্চলে চরাঞ্চলের মানুষের মতোই জীবনমানে পরিবর্তন আসবে দেশের অন্য এলাকার চরে থাকা মানুষের।
এক প্রতিবেদনের তথ্যমতে, দেশের মোট আয়তনের ১০ শতাংশ চর। আর এ চরাঞ্চলেই বাস করেন অন্তত ৮০ লাখ মানুষ। তাদের পাঁচ ধরনের ফসল- ভুট্টা, মরিচ, পাট, ঘাস ও ধান চাষে সঠিকভাবে কাজে লাগাতে পারলে বছরে ওই সব ফসলের অতিরিক্ত ফলন হবে কমপক্ষে ৬৫ লাখ মণ।
শুধু উত্তরাঞ্চলেই তিস্তা, ব্রহ্মপুত্র আর যমুনা নদীর পতিত জমি থেকে বছরে পাওয়া যাবে ৪ লাখ ২০ হাজার মণ ঘাস, যার বর্তমান বাজারমূল্য ২৯ হাজার ৪০০ কোটি টাকা। চরের পতিত জমিতে ভুট্টা চাষ সম্ভব হলে বছরে পাওয়া যাবে প্রায় ১০ হাজার ৮০ কোটি টাকা মূল্যের অতিরিক্ত ১ লাখ ৪৪ হাজার মণ ভুট্টা। পাট ও ধানের চেয়ে মরিচ আর ভুট্টা চাষ করে চরের চাষিরা টাকা গুনছেন বেশি। ভুট্টার মতোই চরে পতিত জমিতে মরিচ চাষ করা হলে বছরে ১২ হাজার ৬০০ কোটি টাকায় অতিরিক্ত প্রায় ১ লাখ ৮০ হাজার মণ শুকনো মরিচ পাওয়া যাবে। একইভাবে চরের পতিত জমিতে পাট লাগাতে পারলে বছরে ৬ হাজার ৩০০ কোটি টাকা মূল্যের অতিরিক্ত পাট পাওয়া যাবে ৯০ হাজার মণ।
একইভাবে ব্রি-২৪ ধানের বাড়তি উৎপাদন সম্ভব ৫৪ হাজার মণ আর তা করা সম্ভব হলে আয় হতে পারে বর্তমান বাজারমূল্য অনুযায়ী ৩ হাজার ৭৮০ কোটি টাকা। উত্তরাঞ্চলের নদ-নদীর চরাঞ্চলে এখন ফসলের ফলন যে হারে বৃদ্ধি পেয়েছে, তাতে ওই তিনটি নদ-নদীর চরাঞ্চল থেকেই বছরে জাতীয় অর্থনীতিতে যোগ হবে প্রায় ৬২ হাজার ১৬০ কোটি টাকা। অনুরূপভাবে সারা দেশের চরের জমিতে পরিকল্পিতভাবে সম্ভাবনাময় ফসল আবাদ করা সম্ভব হলে দেশের অর্থনীতিতে ৫ লাখ কোটি টাকা যোগ হতে পারে।
চরের বাসিন্দারা জানান, কয়েক বছর ধরেই চরে সব ধরনের ফসলের ফলন বেড়েছে। চরে এখন পাওয়া যায় ভালো বীজ, আছে বিভিন্ন সংস্থা থেকে ফসল চাষের জন্য ঋণসুবিধা।
বগুড়া পল্লী উন্নয়ন একাডেমির একফোরসি প্রকল্পের পরিচালক আব্দুল মজিদ বলেছেন, ইতোমধ্যেই চরে ওই সব ফসলের ফলন বেড়েছে ২ থেকে ৪ গুণ। সবচেয়ে বেশি ফলন বেড়েছে ভুট্টা ও মরিচের। এ প্রকল্পের আওতায় মূল ভূখণ্ডের সুযোগ-সুবিধা চরাঞ্চলের মানুষের কাছে পৌঁছানোর চেষ্টা করা হচ্ছে। ইতোমধ্যেই মূল ভূখণ্ডের কিছু সুবিধা চরাঞ্চলে নেওয়া সম্ভব হওয়ায় ফসলের ফলন বেড়েছে। আগে চরে প্রতি একরে ভুট্টা উৎপাদন হতো ৩০ মণ, সেখানে এখন হচ্ছে ১২০ মণ পর্যন্ত। মরিচের ফলন আগে একরে পাওয়া যেত ১৫ মণ আর এখন বেড়ে হয়েছে ৩০ মণ। পাটের ফলনে একরে ৯ মণ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩০ মণে আর ব্রি-ধান ২৪ এখন একরে হচ্ছে ৫৪ মণ পর্যন্ত। কিছুদিন আগেও চরে একরে এ ধানের ফলন ছিল ৩৬ মণের মধ্যেই সবচেয়ে বেশি ফলন বেড়েছে ঘাসের। এখন পাওয়া যাচ্ছে গড়ে একরে ২১ মণ করে।
বেশির ভাগ চরে উৎপাদিত কৃষিপণ্যের সঠিক বিপণন, প্রক্রিয়াজাতকরণ ব্যবস্থা না থাকায় চরের কৃষকরা তাদের ন্যায্যমূল্য থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। এতে তাদের দারিদ্র্য লেগেই থাকছে।
সরকারকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে পতিত জমিগুলোর সঠিক ব্যবহার করে চাহিদা অনুযায়ী ফসল ফলানোর উপযোগী বিভিন্ন প্রকল্প নিয়ে কাজ করা। এটির সঠিক ব্যবহার করতে পারলে অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়ানোর মাধ্যমে চরাঞ্চলের মানুষের জীবনমানের উন্নয়ন এবং দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ঘটবে।