করোনা মহামারি ও ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের প্রভাবে দেশে কয়েক বছর ধরে বেসরকারি বিনিয়োগ স্থবির। দেশীয় উদ্যোক্তারা বলছেন, দেশে নতুন বিনিয়োগ হচ্ছে না। একদিকে গ্যাসসংকট, ব্যাংক অর্থায়নের অভাব, ডলারের দামে অস্থিরতায় নতুন বিনিয়োগে উদ্যোক্তারা উৎসাহ হারিয়ে ফেলছেন। অন্যদিকে কেউ কেউ বলছেন, দক্ষ শ্রমিকের ঘাটতি, শুল্কায়নব্যবস্থার জটিলতা, মজুরি বৃদ্ধি, বিদ্যুতের সমস্যা ও কাঁচামালের মূল্যবৃদ্ধিও এর জন্য দায়ী। তথ্যমতে, গত বছর (২০২৩) নতুন বিনিয়োগ শূন্যের কোঠায় নেমে এসেছে। এর আগে কিছু বিনিয়োগ হলেও নতুন বিনিয়োগের আশা কমেছে। শিল্পের সম্প্রসারণ ও অবকাঠামো খাত বাদে গত বছর পোশাক, বস্ত্রসহ বিভিন্ন খাতে সম্পূর্ণ নতুন কারখানা গড়ে ওঠেনি একটিও। অর্থনৈতিক মন্দার প্রভাবে অনেক ব্যবসা-বাণিজ্য সংকুচিত হয়েছে। এতে কাজের নতুন ক্ষেত্রগুলো ঝুঁকিতে রয়েছে। সবচেয়ে বড় বিষয় হচ্ছে নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি করা। অনেকেই চাকরিচ্যুত হয়েছেন বা হচ্ছেন। অনেকের বেতন বন্ধ রয়েছে বা কমেছে। রপ্তানি আয় এবং কর্মসংস্থানের দিক থেকে সর্ববৃহৎ তৈরি পোশাকশিল্পে তেমন কোনো বিনিয়োগ হয়নি ২০২৩ সালে।
পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্য অনুযায়ী দেশে প্রতিবছর গড়ে ২৬ থেকে ২৭ লাখ মানুষ নতুন করে শ্রমবাজারে প্রবেশ করে। এ হিসাবে করোনার দুই বছরে অন্তত ৫২ থেকে ৫৪ লাখ মানুষ শ্রমবাজারে প্রবেশ করলেও তাদের বেশির ভাগেরই কর্মসংস্থান হয়নি। করোনার পর আরও দুই বছর কেটেছে। তেমন বিনিয়োগ বাড়েনি। ফলে বেকারের সংখ্যাও বেড়েছে।
আইএলওর সাম্প্রতিক সময়ের এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, বাংলাদেশে বেকারের সংখ্যা প্রায় সাড়ে ৩ কোটি। এই সংখ্যা প্রতিনিয়ত বাড়ছে। এটি একটি অশনিসংকেত বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্য অনুসারে, ২০১৮-১৯ অর্থবছরে মোট দেশজ উৎপাদনে (জিডিপি) বেসরকারি বিনিয়োগ ছিল ২৫ দশমিক ২৫ শতাংশ। আর ২০২২-২৩ অর্থবছরে তা কমে দাঁড়ায় ২৩ দশমিক ৬৪ শতাংশ, অর্থাৎ পাঁচ বছরেও প্রবৃদ্ধি বাড়েনি। ২০১৯-২০ অর্থবছরে জিডিপিতে বিনিয়োগের অবদান ছিল ২৪ দশমিক শূন্য ২ শতাংশ, ২০২০-২১ অর্থবছরে ২৩ দশমিক ৭০ শতাংশ এবং ২০২১-২২ অর্থবছরে ২৪ দশমিক ৫২ শতাংশ। অপরদিকে জিডিপিতে শিল্প উৎপাদন খাতের অবদানও কমেছে।
নতুন বিনিয়োগকারীরা পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছেন। অর্থাৎ ধীরে চলা নীতি অনুসরণ করছেন। জ্বালানিসংকট ও ব্যাংক তহবিলের ঘাটতির কারণে উদ্যোক্তারা বিনিয়োগে আকৃষ্ট হচ্ছেন না। দেশে এফডিআই আকৃষ্ট করতে অর্থনৈতিক অঞ্চল গড়ে তোলা হয়েছে। নেওয়া হয়েছে ওয়ান স্টপ সার্ভিস। তবু বিদেশি বিনিয়োগ লক্ষ্যমাত্রা ছুঁতে পারেনি। শুধু ভারতের মতো অর্থনৈতিকভাবে বলিষ্ঠ দেশই নয়, মালদ্বীপ ও শ্রীলঙ্কার মতো দক্ষিণ এশিয়ার ছোট অর্থনীতির দেশগুলোও এফডিআইয়ের দিক থেকে বাংলাদেশের তুলনায় এগিয়ে। ওয়ার্ল্ড ইনভেস্টমেন্ট রিপোর্ট ২০২৩ অনুযায়ী বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ার দ্বিতীয় অর্থনীতির দেশ হওয়ার পরও জিডিপির শতাংশ হিসাবে এফডিআইয়ের দিক থেকে এ অঞ্চলের দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ চতুর্থ।
কর্মসংস্থানের একটি বড় খাত হলো সিরামিকস। তথ্যমতে, গত বছর এই খাতে নতুন কোনো বিনিয়োগ হয়নি। যারা নতুন করে পরিকল্পনা করেছে, তারাও এখন পরিকল্পনা বাস্তবায়ন স্থগিত রেখেছেন। বিজিএমইএর সাবেক সভাপতি আনোয়ার-উল-আলম চৌধুরী পারভেজ খবরের কাগজকে বলেন, বিনিয়োগ তেমন হয়েছে বলে মনে হয় না। ২০২৪ সালে শিল্প খাতে ভালো প্রবৃদ্ধি হবে না। অনেক ব্যাংক তারল্যসংকটে ভুগছে। এ অবস্থায় শিল্প খাতের পরিবর্তে ট্রেজারি বন্ডে বিনিয়োগ করা হচ্ছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের বর্তমান নীতি অনুসরণ করে বিনিয়োগ করছে ব্যাংকগুলো। বাংলাদেশ ব্যাংকের এখন মূল লক্ষ্য হচ্ছে শিল্পায়নের চেয়ে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করা। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণকে লক্ষ্য হিসেবে ধরার কারণে ব্যাংকের সুদহারও বেড়েছে। ফলে ঋণ পাওয়া আরও কঠিন হবে। তা ছাড়া বাংলাদেশ ব্যাংক সংকোচনমুখী মুদ্রানীতিতে গেছে। ডলারসংকট মোকাবিলায় আমদানি আরও কঠোর করেছে। ফলে উদ্যোক্তারা প্রয়োজনীয় কাঁচামাল আনতে পারছেন না। এ অবস্থায় বিদ্যমান শিল্প টিকিয়ে রাখা কঠিন হয়ে পড়ছে। যতদিন পর্যন্ত ব্যাংকের তারল্য পরিস্থিতি ভালো না হবে, ততদিন পর্যন্ত শিল্পে বিনিয়োগ হবে না। এসব কারণে এবার শিল্প খাতে প্রবৃদ্ধি হবে না।
অর্থনীতিবিদরা বলছেন, দেশে বেসরকারি বিনিয়োগ ছাড়া অর্থবছর শেষে মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) কাঙ্ক্ষিত প্রবৃদ্ধি অর্জন সম্ভব নয়। কাজেই দারিদ্র্যবিমোচনের পাশাপাশি অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ত্বরান্বিত করতে হলে দেশি-বিদেশি বিনিয়োগ বাড়ানোর কোনো বিকল্প নেই। বিনিয়োগ বাড়াতে হলে প্রয়োজনে স্বল্প সুদের ‘টেকসই উন্নয়ন ফান্ড’ গঠন করতে হবে।
পাশাপাশি শিল্প খাতে গ্যাস, বিদ্যুৎ ও অন্যান্য সেবা নিশ্চিতকরণ, করপোরেট ট্যাক্স হ্রাস এবং প্রাতিষ্ঠানিক দক্ষতা বৃদ্ধি করতে হবে। বিনিয়োগে গতি আনতে এগুলো দ্রুত আমলে নিয়ে তা কার্যকরে সরকারকে সর্বোচ্চ নজর দিতে হবে।
এসব সংকট উত্তরণ থেকে রেহাই পেতে সবার আগে প্রয়োজন নতুন নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি করা। কিন্তু বাস্তবতা ভিন্ন। অনেক ক্ষেত্রেই নতুন বিনিয়োগ হচ্ছে না। সে কারণে বিনিয়োগ বৃদ্ধির জন্য জোরালো পদক্ষেপ নিতে হবে। অর্থনৈতিক সুরক্ষা নিশ্চিত করতে পারলে উদ্যোক্তারা বিনিয়োগে উৎসাহী হবেন। দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় অর্জিত হবে, সেটিই প্রত্যাশা।