![মানব পাচারকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিন](uploads/2024/04/04/1712205477.Editorial.gif)
প্রলোভনে পড়ে অথবা ভাগ্য বদলের জন্য নানা উপায়ে বিদেশে যান দেশের হাজারও তরুণ। ধারদেনা করে জোগাড় করেন টাকা। অনেকে বিক্রি করেছেন নিজের ভিটেমাটি। বিদেশে গিয়ে অনেকে নির্যাতন ও প্রতারণা শিকার হচ্ছেন। এরই মধ্যে নিঃস্ব হয়ে ফিরেছেন ৩ হাজার নারী। বাংলাদেশ থেকে বিভিন্ন দেশে মানব পাচার একটি পুরোনো বিষয় হলেও সম্প্রতি এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে আটকে রেখে মুক্তিপণ আদায়। ইউরোপে নিয়ে যাওয়ার কথা বলে লিবিয়া, মায়ানমার ও থাইল্যান্ডে আটকে রেখে অমানুষিক নির্যাতন করে সেই ভিডিও ও ছবি পরিবারকে পাঠিয়ে বিপুল টাকা আদায় করছে মানব পাচার সিন্ডিকেট। বিচারের মুখোমুখি করা সম্ভব না হওয়ায় বেপরোয়া হয়ে উঠেছে চক্রটি।
প্রতিবছর বিশ্বব্যাপী মানব পাচারের হালচাল নিয়ে মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তর একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে। সর্বশেষ ২০২৩ সালের প্রতিবেদনেও মানব পাচার নির্মূল প্রচেষ্টায় বাংলাদেশের অগ্রগতি নেই বলে উল্লেখ করা হয়েছে। প্রতিবেদনে অভিযোগ করা হয়েছে, বাংলাদেশের আদালত বেশির ভাগ পাচারকারীর কারাদণ্ডের পরিবর্তে জরিমানা করেন। এটি মানব পাচার প্রতিরোধকে দুর্বল করে এবং পাচারের শিকার ও ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য নিরাপত্তার উদ্বেগ সৃষ্টি করে।
গত দুই বছরে বিদেশে কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রে নতুন রেকর্ড হলেও নির্যাতন ও প্রতারণার কারণে কমেছে নারীর কর্মসংস্থান। ২০২৩ সালে বিদেশে মোট কর্মী গেছেন ১৩ লাখের বেশি। এর মধ্যে নারীকর্মী গেছেন ৭৭ হাজার ২৬৩। সচেতনতার অভাব, দালালের মিথ্যা প্রলোভন ও দক্ষতার অভাবে নারীরা নির্যাতন ও প্রতারণার শিকার হচ্ছেন। সৌদিতে নারীকর্মী পাঠানোর আগে প্রশিক্ষণ বাধ্যতামূলক থাকলেও বেশির ভাগ ক্ষেত্রে মানা হচ্ছে না সেই নিয়ম। ফলে প্রতিবছর অনেক নারী দেশে ফিরে নির্যাতন-নিপীড়নসহ নানা অভিযোগ করছেন।
বেসরকারি সংস্থা ব্র্যাক বলছে, সরকারি চক্রের সঙ্গে জড়িত আছে বাংলাদেশ, পাকিস্তান, আফগান ও ইরানিরা। বহুদিন ধরে তারা মধ্যপ্রাচ্যে গড়ে তুলেছে একটি চক্র। তারা শুরুতে কাউকে টাকা ছাড়াই, কাউকে ৪০ থেকে ৫০ হাজার টাকা আবার কাউকে ২ থেকে ৩ লাখ টাকার বিনিময়ে ইউরোপে যাওয়ার স্বপ্ন দেখায়। যারা কম টাকা দিতে চায় তাদের আকর্ষণীয় শর্ত দিয়ে বলা হয়, গন্তব্যে পৌঁছে বার্ষিক ২ থেকে ৩ লাখ টাকা কাজ করে পরিশোধ করতে হবে। এই চক্রের কাছে রয়েছে অত্যাধুনিক অস্ত্র। লিবিয়া, মায়ানমার ও থাইল্যান্ডের জঙ্গলে এবং শহর ও গ্রামের বিভিন্ন জায়গায় তাদের ভাড়া বাসা আছে, যেগুলো টর্চার সেল হিসেবে ব্যবহৃত হয়। সেখান থেকে ছাড়া পেতে আটক ব্যক্তির স্বজনদের দেশে দিতে হয় লাখ লাখ টাকা মুক্তিপণ। মুক্তিপণের টাকা না দিলে হত্যা করে লাশ পুঁতে ফেলা হবে বলে বারবার হুমকি দেওয়া হয়।
সরকার ২০১২ সালে মানব পাচার প্রতিরোধ ও দমন আইন করে। এই আইনে ২০১২ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত ৬ হাজারেরও বেশি মামলা হয়েছে। এসব মামলায় দেখা গেছে, ১০ হাজারেরও বেশি মানুষ পাচারের শিকার। এতে মোট আসামির সংখ্যা প্রায় ৩০ হাজার। এসব মামলার প্রায় সব কটি বছরের পর বছর ঝুলে আছে। সাজা হয়েছে ১ শতাংশেরও কম মামলায়। সেই সাজাও দৃষ্টান্তমূলক হয়নি বলে অভিযোগ ভুক্তভোগীদের।
জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের সদস্য তানিয়া হক খবরের কাগজকে বলেন, দেশের মানুষ সচেতন নয়, আবার আইনও মানতে চায় না। আইনের ফাঁকফোকর দিয়ে কীভাবে কম টাকায় বিদেশে যাওয়া যায় সেই সুযোগ খোঁজে। ফলে অবধারিতভাবে ট্র্যাপে পড়ে। এই সংখ্যাও কম নয়। এজন্য সচেতনতার ওপর গুরুত্ব দিতে হবে।
মানব পাচার মোকাবিলায় মানবাধিকার এবং সব মানুষের মৌলিক স্বাধীনতার প্রচার ও সুরক্ষার ভিত্তিতে একটি সমন্বিত ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে। দেশের ভাবমূর্তি সমুন্নত রাখতে সরকার ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের মানব পাচারকারীদের বিরুদ্ধে কঠোর নজরদারি বাড়াতে হবে। অপরাধীদের আইনের আওতায় এনে শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে।