![সিরিয়ালেই জীবন শেষ ক্যানসার রোগীদের](uploads/2024/02/04/1707018294.cancer-hospital.jpg)
প্রতিদিনই যেন রোগী উপচে পড়ছে রাজধানীর মহাখালীতে ক্যানসার চিকিৎসায় দেশের একমাত্র সরকারি বিশেষায়িত চিকিৎসা প্রতিষ্ঠান জাতীয় ক্যানসার গবেষণা ইনস্টিটিউট ও হাসপাতাল প্রাঙ্গণে। মাত্র ৩০০ বেডের এই হাসপাতালটিতে প্রতিদিন সারা দেশ থেকে ১ হাজারেরও বেশি রোগী ভিড় করেন বলে ওই হাসপাতাল সূত্র জানিয়েছে। রোগ নির্ণয় থেকে শুরু করে রোগী ভর্তি ও পরবর্তী পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য সিরিয়াল পেতে দিনের পর দিন অপেক্ষা করতে হয়। ক্ষেত্রবিশেষে কয়েক মাস লেগে যায়। অপেক্ষায় থাকতে থাকতে অনেক রোগীর মৃত্যু হয়েছে বলে জানিয়েছেন হাসপাতালেরই একাধিক সূত্র। এক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি ও জনবল সংকটের কারণেই এমনটা ঘটে বলে দাবি করেছেন হাসপাতালের একাধিক কর্মকর্তা।
শুধু এই একটি হাসপাতালই নয় দেশের অন্যান্য সব সরকারি বড় হাসপাতালগুলোতেও ক্যানসার ইউনিটে একইভাবে রোগীরা ক্যানসার নির্ণয় ও চিকিৎসা ভর্তির জন্য সিরিয়াল পেতে হয়রানির শিকার হচ্ছেন। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, আটটি বিভাগীয় শহরে নতুন আটটি ক্যানসার সেন্টার পুরোপুরি চালু হয়ে গেলে এই সমস্যা অনেকখানি কমে যাবে।
জাতীয় ক্যানসার গবেষণা ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের সাবেক পরিচালক অধ্যাপক ডা. কাজী মুস্তাক হোসেন খবরের কাগজকে বলেন, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নির্দেশনা অনুসারে বাংলাদেশের ১৮ কোটি জনসংখ্যা অনুপাতে কমপক্ষে ১৮০টি ক্যানসার সেন্টার দরকার। কিন্তু সেন্টার আছে ৩৫টির মতো। অন্যদিকে জনসংখ্যা অনুপাতে চিকিৎসক দরকার কমপক্ষে দুই হাজার। আছে মাত্র ২৫০ জন। সরকারি হাসপাতালগুলোতে ক্যানসার চিকিৎসার উন্নত যন্ত্রপাতির বড় ঘাটতি রয়েছে। ঢাকার বাইরে দুটি প্রতিষ্ঠান ছাড়া আর সব যন্ত্র নষ্ট। তো সিরিয়ালের জন্য মানুষের দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে।
এদিকে ক্যানসার চিকিৎসা কার্যক্রমে যুক্ত বিভিন্ন পর্যায়ের বিশেষজ্ঞরা জানান, দেশে এখন পর্যন্ত মোট ক্যানসার রোগীর সংখ্যা নির্ণয় নিবন্ধন কার্যক্রম কার্যকর হচ্ছে না। ফলে ক্যানসার রোগীর সঠিক সংখ্যা জানা সম্ভব হচ্ছে না। যা চলছে তা আন্তর্জাতিক কিছু সূচককে ধরে অনুমাননির্ভর। অনেক বিশেষজ্ঞ যে যার মতো পরিসংখ্যান দিয়ে থাকেন। অন্যদিকে ক্যানসার চিকিৎসায় যন্ত্রপাতি নিয়েও চলছে বড় ধরনের নৈরাজ্যকর পরিস্থিতি। শত শত কোটি টাকা খরচ করে কখনো কখনো উন্নত বিশ্বের নিষিদ্ধ যন্ত্রপাতি কিনে আনা হচ্ছে বাংলাদেশের সরকারি হাসপাতালগুলোতে। যা কিছুদিন ব্যবহারের পরে আর কোনো কাজে লাগছে না। আধুনিক যন্ত্রপাতি কিনলেও সঠিকভাবে রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে অল্প দিনের মধ্যে তাও অকেজো হয়ে যায়।
জাতীয় ক্যানসার গবেষণা ইনস্টিটিউট সূত্র জানায়, সরকারি ৯টি হাসপাতালে ৯টি লিনিয়ার এক্সেলারেটরের মধ্যে এখন মাত্র দুটি চালু আছে। গত বছর আরও দুটি লিনিয়ার এক্সেলারেটর কেনা হয়েছে যেগুলো এখনো ইনস্টল করা হয়নি। নতুন আটটি ক্যানসার সেন্টারের জন্য ৮টি লিনিয়ার এক্সেলারেটর এবং ৮টি কোবাল্ট ৬০ রেডিওথেরাপি মেশিন কেনার প্রক্রিয়া চলছে। কোবাল্ট ৬০ প্রযুক্তি ৩০ বছরেরও বেশি পুরোনো। বিশ্বের বেশির ভাগ দেশেই ক্যানসার চিকিৎসায় এই প্রযুক্তির ব্যবহার বন্ধ হয়ে গেছে। এর আগেও বাংলাদেশে কয়েকটি কোবাল্ট ৬০ মেশিন ব্যবহারের পর তা বাতিল করা হয়। বরং এখন পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতসহ অন্যতম বিশ্বে ক্যানসার চিকিৎসায় কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাভিত্তিক রেডিওথেরাপি সিস্টেম বাংলাদেশে চালু হয়েছে। প্রোটন পদ্ধতিতে চিকিৎসা সবচেয়ে বেশি নির্ভরযোগ্য বলেও প্রমাণিত বিভিন্ন দেশে। যদিও এই প্রযুক্তির যন্ত্রের দাম খুবই বেশি।
অন্যদিকে শুধু যন্ত্রপাতি না, ক্যানসার রোগের তথ্য-উপাত্ত ও পরিসংখ্যান নিয়ে রয়েছে নানান বিভ্রান্তি। সরকারি উদ্যোগে ক্যানসার রেজিস্ট্রেশন চললেও তা হচ্ছে খুবই ধীর গতিতে।
রাজধানীর স্কয়ার হাসপাতালের ক্যানসার বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ডাক্তার সৈয়দ আকরাম হোসেন খবরের কাগজকে বলেন, ‘সরকারি হাসপাতালগুলো রোগী সামাল দিতে না পারায় স্বাভাবিকভাবেই প্রাইভেট হাসপাতালগুলোতে ক্যানসার রোগীর ভিড় বাড়তে শুরু করেছে। আর সরকারি হাসপাতালের চেয়ে প্রাইভেটে খরচ বেশি হয় বলে রোগীরা দিশেহারা হয়ে পড়ে। অনেকেই চিকিৎসা শেষ করতে পারেন না। এ ছাড়া অন্যান্য রোগের চেয়ে ক্যানসারের চিকিৎসা অনেক ব্যয়বহুল।’
ওই ক্যানসার বিশেষজ্ঞ জানান, সঠিক কোনো হিসাব না থাকলেও বিভিন্ন সূত্র অনুযায়ী ধারণা করা যেতে পারে, দেশে ১৫ থেকে ২০ লাখ ক্যানসার রোগী রয়েছেন। এর মধ্যে মাত্র আড়াই লাখ রোগের মতো শনাক্ত করা যায় বা চিকিৎসার আওতায় আসে। যাদের মধ্যে বছরে দেড় লাখের মতো রোগীর মৃত্যু ঘটে।
অপরদিকে বাংলাদেশ মেডিকেল ফিজিক্স সোসাইটির উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. অনুপমা আজহারি খবরের কাগজকে বলেন, ‘আন্তর্জাতিক প্রটোকল অনুযায়ী ক্যানসার চিকিৎসায় যত ধরনের রেডিয়েশন যন্ত্রপাতি ব্যবহার করা হয় তার সঙ্গে চিকিৎসক ও মেডিকেল ফিজিসিস্ট যৌথভাবে যুক্ত থাকেন। মেডিকেল ফিজিসিস্টের সহায়তা ছাড়া এই কার্যক্রম করা যায় না। কিন্তু বাংলাদেশে এখন পর্যন্ত মাত্র ৫০/৬০ জন মেডিকেল ফিজিসিস্ট বিভিন্নভাবে কাজ করছেন। যেহেতু ২০টির বেশি যন্ত্র রয়েছে, সেখানে কমপক্ষে দেড়শ ফিজিসিস্ট দরকার। নতুন ৮টি ক্যানসার সেন্টারের জন্য মেডিকেল ফিজিসিস্টদের পদ রাখা হয়েছে। তবে পুরোনোগুলোর ক্ষেত্রে নিয়োগে আইনগত জটিলতা রয়েছে। এ সংক্রান্ত গেজেট হয়নি।’
তিনি বলেন মেডিকেল ফিজিসিস্ট ছাড়া শুধু চিকিৎসক দিয়ে চিকিৎসা রোগীদের জন্য ভয়ানক বিপদ বয়ে আনতে পারে।