পাই (π) গণিতের গুরুত্বপূর্ণ একটি ধ্রুবক, যা বৃত্তের পরিধি ও ক্ষেত্রফলের সঙ্গে সম্পর্কিত। এর মান প্রায় ৩.১৪১৫৯। ইউক্লিডীয় জ্যামিতিতে যেকোনো বৃত্তের পরিধি ও ব্যাসের অনুপাতকে এই ধ্রুবক দিয়ে প্রকাশ করা হয়।
পাই একটি অমূলদ সংখ্যা অর্থাৎ এটিকে দুটি পূর্ণসংখ্যার ভগ্নাংশ আকারে প্রকাশ করা যায় না। অন্যভাবে বলা যায় এটিকে দশমিক আকারে সম্পূর্ণ প্রকাশ করা সম্ভব নয়। তার মানে আবার এই নয় এটিতে কিছু অঙ্ক পর্যাবৃত্ত বা পৌনঃপুনিক আকারে আসে। বরং দশমিকের পরের অঙ্কগুলো দৈবভাবেই পাওয়া যায়। পাই কেবল অমূলদ তা নয়, এটি একই সঙ্গে একটি তুরীয় সংখ্যা। অর্থাৎ এটিকে কোনো বহুপদী সমীকরণের মূল হিসেবেও গণনা করা যায় না।
গ্রিক বর্ণ পাই, গ্রিক শব্দ ‘পেরিমেত্রোস’ থেকে এসেছে। সম্ভবত ১৭০৬ সালে উইলিয়াম জোনস প্রথম এটি ব্যবহার করেন। পরবর্তীতে লেওনার্ড অয়লার এটিকে জনপ্রিয় করেন। পাইকে গণিতে ব্যবহারের সময় ইংরেজি পাই হিসেবে উচ্চারণ করা হয়, যদিও এর গ্রিক উচ্চারণ পি। এটিকে কোনো কোনো সময় বৃত্তীয় ধ্রুবক, আর্কিমিডিসের ধ্রুবক অথবা রুডলফের সংখ্যাও বলা হয়।
১৪ মার্চ বিশ্বব্যাপী পাই দিবস হিসেবে পালিত হয়। এই দিনটি নির্ধারণ করা হয়েছে পাই এর প্রথম তিনটি অঙ্ক (৩.১৪) ও এর সঙ্গে ‘π’ প্রতীকের মিল ধরে।
পাই গণিত, বিজ্ঞান ও প্রকৌশলের একটি মৌলিক ধারণা। এটি বিভিন্ন গাণিতিক সূত্র, ভৌত নীতি এবং প্রকৌশল নকশায় ব্যবহৃত হয়। পাইয়ের রহস্যময় প্রকৃতি গণিতবিদ এবং বিজ্ঞানীদের কাছে আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে দীর্ঘদিন ধরে গবেষণার বিষয়বস্তু হিসেবে বিবেচিত হয়ে আসছে। গণিতের ইতিহাস জুড়ে, নির্ভুলভাবে পাইয়ের মান নির্ণয়ের ব্যাপক চেষ্টা করা হয়েছে।
এর ধারাবাহিকতায় সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের কম্পিউটার স্টোরেজ কোম্পানি সলিডিগম এখন পর্যন্ত সবচেয়ে বড় মানের পাই গণনায় করে রেকর্ড গড়েছে। পাইয়ের ১০৫ ট্রিলিয়ন ডিজিট পর্যন্ত মান গণনা করেছে প্রতিষ্ঠানটি। কয়েক হাজার স্মার্টফোনের সমান কম্পিউটিং শক্তি ব্যবহার করে এই মান নির্ণয় করেছে প্রতিষ্ঠানটি। এই ডেটা সংরক্ষণের জন্য ব্যবহৃত হয়েছে ১ পেটাবাইট বা ১০ লাখ গিগাবাইট স্টোরেজ ক্ষমতাসম্পন্ন নতুন ডিভাইস। টানা ৭৫ দিন সময় লেগেছে এই মান বের করতে।
গত ১৪ মার্চ পাই দিবসে ১০৫ ট্রিলিয়নের ঘর পর্যন্ত দশমিক স্থানের অঙ্ক বের করেছে ক্যালিফোর্নিয়ায় অবস্থিত সলিডিগম। নতুন আবিষ্কৃত ১০৫ ট্রিলিয়ন সংখ্যাটা আসলে কত বড়? ১ হাজার বিলিয়নে হয় এক ট্রিলিয়ন। এক বিলিয়ন মানে ১০০ কোটি। সুতরাং ১ ট্রিলিয়ন মানে ১ লাখ কোটি। আপনি যদি ১০ আকারের ফন্ট ব্যবহার করে ১০৫ ট্রিলিয়ন টাইপ করেন, তাহলে ৩৭০ কোটি কিলোমিটার দীর্ঘ হবে এ লাইন। অর্থাৎ পৃথিবী থেকে লাইন শুরু হলে ইউরেনাস এবং নেপচুনের মাঝামাঝি কোথাও গিয়ে থামবে। নতুন আবিষ্কৃত মানের শেষ সংখ্যাটি হলো ৬।
মহাবিশ্ব বা মহাজাগতিক জটিল কোনো হিসাব-নিকাশ করতে পাইয়ের এ রকম বড় মান দরকার পড়ে না। মহাবিশ্বের জন্য সর্বোচ্চ দশমিকের পরে পাইয়ের ৪০ ঘর পর্যন্ত মান-ই যথেষ্ট। মার্কিন মহাকাশ গবেষণা সংস্থা নাসা এখন পর্যন্ত দশমিকের পরে ১৫ ঘর পর্যন্ত মান ব্যবহার করেছে পাইয়ের। নতুন কম্পিউটার প্রোগ্রাম এবং ডেটা স্টোরেজ সিস্টেমগুলো পরীক্ষা করার জন্য একটি বেঞ্চমার্ক হিসেবে দীর্ঘদিন ধরে সংখ্যাটি ব্যবহৃত হয়ে আসছে।
১৯৮৯ সালে ১০০ কোটি ঘরের পাইয়ের মান নির্ণয় সম্ভব হয়েছে। পৃথিবীর প্রথম অ্যানালগ কম্পিউটার এনিয়াকের সাহায্যে ১৯৪৯ সালে ৭০ ঘণ্টার চেষ্টায় পাইয়ের মান পাওয়া গিয়েছিল ২ হাজার ৩৭ ঘর পর্যন্ত। এরপর হাজার থেকে লাখে যেতে সময় লেগেছে ১৩ বছর। ততদিনে কম্পিউটার আরও উন্নত হয়েছে। ১৯৮৯ সালে ১০০ কোটি ঘরের পাইয়ের মান নির্ণয় সম্ভব হয়েছে। কোটি থেকে এখন ট্রিলিয়নে পৌঁছে গেছে পাইয়ের মান। বুঝতেই পারছেন কম্পিউটারের অগ্রগতির চিত্রটা কেমন ঊর্ধ্বমুখী। কম্পিউটার আসলে কতটা উন্নতি করল, তা বোঝা যায় পাইয়ের মান দেখে।
কম্পিউটারে তো ট্রিলিয়ন ঘর পর্যন্ত পাইয়ের মান বের করা গেছে। তবে মানুষ এখন পর্যন্ত সর্বোচ্চ ৭০ হাজার ঘর পর্যন্ত পাইয়ের মান মুখস্থ করতে পেরেছে। এটি করেছে ভারতের ভেলোর ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজির (ভিআইটি) রাজবীর মিনা। যিনি সর্বোচ্চ ৭০ হাজার ঘর পর্যন্ত পাইয়ের মান মুখস্থ বলতে পারেন।
ভবিষ্যতে আরও শক্তিশালী কম্পিউটার আবিষ্কার হলে হয়তো পাইয়ের আরও বড় মান পাওয়া যাবে। সে জন্য হয়তো ব্যবহার করতে হবে সুপার কম্পিউটার বা কোয়ান্টাম কম্পিউটার। পাইয়ের মান লিখে যেহেতু শেষ করা যাবে না, তাই সবচেয়ে বড় মান নির্ণয় করার লড়াইটা চলবে সম্ভবত আজীবন।
জাহ্নবী