![বন থেকে বাগানে সহস্রবেলি](uploads/2024/01/13/1705125018.Vat-ful.jpg)
ভাঁটফুল এ দেশের পথের পাশে প্রায়ই চোখে পড়ে। বসন্ত এলে ডালের মাথায় সুন্দর সাদা সুগন্ধি ফুল ফোটে। সহস্রবেলি গাছের পাতাও ভাঁটফুলের মতো। এ জন্য গ্রামে এ গাছকে বলা হয় চন্দনা ভাঁট, অন্য নাম হাজারী বেলি ও রাজবেলি।
তবে ফুলগুলো ভাঁটফুলের মতো না, ওর ফুল দেখতে অনেকটা বেলি ফুলের মতো। একটি থোকায় বেলি ফুলের মতো এ রকম অনেক ফুল থাকে বলেই ওর বাংলা নাম রাখা হয়েছে সহস্রবেলি। সহস্র কেন হলো তা অবশ্য বোঝা গেল না। কেননা, শতাধিক ফুল একটি মঞ্জরিতে থাকলেও তার সংখ্যা কখনোই হাজার পার হবে না। ইংরেজি নাম গ্লোরি বোয়ার, উদ্ভিদতাত্ত্বিক নাম Clerodendrum chinense.
গাছটার জন্ম চীনে। গাছটা এ দেশে এসেছে নেপাল ও হিমালয়ের পূর্বাঞ্চল থেকে। তবে এখন তা দক্ষিণ এশিয়ার অনেক দেশেই চোখে পড়ে। চীন, ভারতের আসাম ও আন্দামান নিকোবর, মালয়েশিয়া প্রভৃতি দেশে এ গাছ জন্মাতে দেখা যায়। এমনকি ফিজি, পূর্ব আফ্রিকা, ক্যারিবীয় দ্বীপপুঞ্জ ও ফ্লোরিডাতেও এ গাছ আছে। এ দেশে কক্সবাজার, ঠাকুরগাঁও ও দিনাজপুরের বাঁশবনগুলোর মধ্যে এ ফুলগাছটিকে দেখেছি বুনো আগাছার মতো জন্মাতে।
অযত্নে লালিত সেসব গাছের ফুলগুলোর চেহারা অবশ্য লালিত গাছগুলোর ফুলের চেয়ে কিছুটা ম্লান, আকারেও ফুলগুলো ছোট। পোকামাকড়ের উপদ্রব দেখা যায় ফুলগুলোর ভেতর, বিশেষ করে পিঁপড়ার। যেখানেই দেখেছি, দু-একটা গাছ না, বেশ খানিকটা জায়গায় ঝোপ করে রেখেছে গাছগুলো। ঢাকায় রমনা উদ্যান ও বলধা গার্ডেনেও এ গাছ আছে।
ভার্বেনেসি গোত্রের গুল্মপ্রকৃতির এ গাছ বাঁচে কয়েক বছর, না কাটলে গাছটি ৩ মিটার পর্যন্ত লম্বা হতে পারে। ছেঁটে ছেঁটে সুন্দর গড়নে রাখলে ডালপালা বেশি হয় ও ফুলও ভালো ফোটে। গাছের ডালপালা ও কাণ্ড চৌকোনাকার, আগার দিকটা রোমশ। পাতা পানপাতার মতো হলেও মখমল কোমল, নরম। পাতার ওপরের পিঠ সবুজ ও নিচের পিঠ ধূসর সবুজ। সাদা রঙের ফুলগুলোতে এক ধরনের গোলাপি দাগ বা ছোপ থাকে, যা ফুলগুলোকে আলাদা সৌন্দর্য দেয়। সুগন্ধ ভেসে আসে ফোটা ফুল থেকে। ফুল ফোটার প্রকৃত সময় এপ্রিল থেকে আগস্ট হলেও ডিসেম্বরেও এ ফুলের দেখা পেলাম।
অনেকেই এখন শখ করে এই বুনো গাছকে বাগানে লাগাচ্ছেন, নার্সারিতে এর চারাও মিলছে। কিন্তু একবার যদি জন্মানো যায়, তবে একে উচ্ছেদ করা কঠিন। এ গাছের শিকড় যতদূর পর্যন্ত মাটির তলা দিয়ে বয়ে যাবে, সেসব শিকড় থেকে সেখানেই এর চারা গজাবে। গিঁটসহ ডাল কেটে ভেজা মাটিতে পুঁতে দিলে তা থেকেও চারা জন্মে। কোনো কোনো দেশে একে আগ্রাসী আগাছা হিসেবে মনে করা হয়।
গাছটি বিপন্ন না। তবে সব জায়গায় ভাঁটগাছের মতো চোখেও পড়ে না। গাছটির বেশ কিছু ঔষধি গুণ আছে বলে জানা যায়। চীনের কয়েকজন গবেষক গবেষণা করে দেখেছেন যে, এ গাছের নির্যাস বা রস ক্যানসার, উচ্চরক্তচাপ, ডায়রিয়া, হাইপোগ্লাইসেমিক বা ডায়াবেটিস প্রভৃতি অসুখের বিরুদ্ধে কার্যকর, স্মৃতিশক্তিও বাড়ায়। এ দেশে আদিবাসীদের কেউ কেউ গেঁটে বাতের ব্যথা হলে ও কাঁপুনি দিয়ে জ্বর এলে চন্দনা ভাঁটের পাতা গরম করে সেঁক দেন।
পাখিবন্ধু ইনাম আল হক ও বইবন্ধু সৈয়দ জাকির হোসাইনের সঙ্গে এ বছর এক শীতের সকালে গিয়েছিলাম প্রকৃতিবন্ধু মাহবুবুর রহমানের প্রকৃতিবাড়িতে। গাজীপুরের কালীগঞ্জে ফুলদি গ্রামের সে বাড়িতে গিয়েই দেখা পেয়েছিলাম সহস্রবেলি ফুলের। সেখানে আরও দেখা পেলাম হংসলতা, হস্তীলতা, হিজল, পলাশ, চাঁপা, নাগচাঁপা, লতাপারুল, বিচিত্র হেলিকোনিয়া, শিউলি, রক্তকাঞ্চন, বুদ্ধ নারকেল, রুদ্রাক্ষ ইত্যাদি গাছের।
দিন শেষে ফিরে এলাম ক্যামেলিয়া গাছটার অসংখ্য কুঁড়ি দেখার তৃপ্তি নিয়ে। শীত শেষে সেগুলো ফুটে আলোময় করবে ওখানকার প্রকৃতি আর মানুষের মন। আশা রইল, রবীন্দ্রনাথের সেই ক্যামেলিয়ার রূপ দেখতে আমরা আবার এক দিন হয়তো সেখানে যাব।