ছোটবেলায় স্কুলের বইয়ে বাগধারা বাগবিধিতে মাকাল ফলের নামের সঙ্গে পরিচয়। দেখতে সুন্দর, অথচ অকম্মা কাউকে দেখলেই তাকে আমরা বলি ‘মাকাল ফল’। তুলনা করি মাকাল ফলের আকর্ষণীয় লাল টুকটুকে রূপের সঙ্গে। যে ফল না যায় খাওয়া, না কোনো কাজে লাগে!
সেই মাকাল ফলের দেখা পেলাম বেনুভিটা মানমন্দিরের আঙিনায়। গিয়েছিলাম কয়েকজন প্রকৃতিসখার সঙ্গে গাজীপুরে শ্রীপুরের বিন্দুবাড়ি গ্রামে। সেখানে প্রকৃতিবন্ধু শাহজাহান মৃধা বেনু ব্যক্তিগত উদ্যোগে একটা মানমন্দির গড়ে তুলেছেন। তার আতিথেয়তায় আমরা ডিসেম্বরের শেষে গিয়েছিলাম শালবনের গাছপালা দেখতে ও চিনতে। তরুপল্লবের সেটি ছিল ৩৫তম গাছ দেখা, গাছ চেনার আয়োজন।
শালবনের গাছপালা চিনে তো ফিরলাম বেনুভিটায়। কিন্তু কে জানত যে, সেই অঙিনাতেই মাকাল ফলের দেখা পাব! তবে আমি নিশ্চিত, মাকাল ফলের নাম শুনলেও অনেকেরই তা দেখার সুযোগ ঘটেনি। তাই কয়েকজন সঙ্গীসাথিকে ডেকে তা দেখালাম।
বেনু ভাই একটা ফলের বাগান গড়ে তুলেছেন। সে বাগানে ঢুকতেই বাঁশের বেড়ার ওপর লতিয়ে উঠেছে লাল ঝুমকোলতা ফুলের গাছ। টকটকে লাল ফুলে আলোকিত করে ফেলেছে। বেড়ার কোলেই একটা কিশোরী তালগাছ। সে গাছের পাতা জড়িয়ে ঝুলে আছে শুকনো কিছু লতা, লতায় লতায় ঝুলে আছে লাল সুগোল বলের মতো কয়েকটা ফল।
মনে হলো জঙ্গল সাফ করার অছিলায় হয়তো লতাটার গোড়া কেউ কেটে দিয়েছে। তাই শুকনো বাদামি লতায় ফলগুলো ঝুলছে। পাতাগুলো শুকিয়ে মচমচে বাদামি হয়ে রয়েছে। কিন্তু ফল দেখে আর চিনতে কষ্ট হলো না, এই তো সেই মাকাল ফল। বেনুবর্ণা বললেন, একবার ফলটা ভেঙেছিলাম, কি বিচ্ছিরি রে বাবা! একেবারে বেড়ালের বিষ্ঠার মতো কালচে আর দুর্গন্ধ। শেয়ালের বিষ্ঠার মতো দেখতে কদবেলের ভেতরটাও, কিন্তু তার একটা নেশাময় সুগন্ধ আছে, স্বাদ আছে। আমরা মজা করে তা নুন-মরিচ মাখিয়ে খাই। কিন্তু মাকাল ফল কেউ খায় বলে কখনো শুনিনি।
বাংলাদেশ উদ্ভিদ ও প্রাণী জ্ঞানকোষের সপ্তম খণ্ডে মাকালের কিছু ঔষধি গুণের উল্লেখ করা হয়েছে। এর ফল বিষাক্ত, তবে তার শাঁস ঘায়ের ওপর প্রলেপ দেওয়া হয় ঘা সারানোর জন্য। এ ছাড়া এ গাছের শিকড় দুষ্টব্রণ ও ফুসফুসের স্ফীতি নিরাময়ে উপকারী। এই ফলের বীজ বমি উদ্রেককারী। ভারতের ছোট নাগপুরের মুন্ডা আদিবাসী সম্প্রদায়ের লোকেরা মাথাব্যথা নিরাময়ের জন্য ফল ও শিকড় সরিষার তেলের সঙ্গে জ্বাল দিয়ে তা ব্যবহার করে। তাই মাকাল যে একেবারে আমড়া কাঠের ঢেঁকি বা অকম্মা, তাও বলা যাবে না।
মাকাল ফলের ইংরেজি নাম রেডবল স্নেক গোর্ড। চিচিঙ্গার ইংরেজি নাম স্নেক গোর্ড, সাপের মতো রেখায়িত লম্বা ফল বলে এর এরূপ নাম। চিচিঙ্গার অন্য বাংলা নাম রেখা বা কুশি। লাল বলের মতো ফল বলে মাকাল ফলের এরূপ ইংরেজি নাম দেওয়া হয়েছে। উদ্ভিদতাত্ত্বিক নাম ট্রাইকোস্যানথাস ট্রাইকাসপিডাটা (Trichosanthus tricuspidate) ও গোত্র কিউকারবিটেসী।
লতানো গাছ শাখায়িত, লতা কোণাকার রেখাযুক্ত, লতা থেকে আকর্ষী বের হয়, যা দিয়ে অন্য গাছকে পেঁচিয়ে ওপরে ওঠে। পাতা করতলাকার ও কিনারা গভীর খাঁজবিশিষ্ট। পাতার বোঁটার কোল থেকে সাদা রঙের ফুল ফোটে। ফুল ছোট ও দেখতে কিছুটা চিচিঙ্গা ফুলের মতো। পাপড়ির কিনারা ঝালরের মতো থাকে। একই গাছে পুরুষ ও মেয়ে ফুল আলাদা ফোটে। মেয়ে ফুলের বোঁটার পরে বা পাপড়ির নিচে ফলের মতো অঙ্গ থাকে, পুরুষের তা থাকে না।
ফল মোটামুটি টেবিল টেনিস বলের চেয়ে একটু বড়, সুগোল। কাঁচা ফল সবুজ, পাকলে হয় টকটকে লাল, আপেলের চেয়েও সুন্দর! বীজও গোলাকার। বীজ থেকে সহজে গাছ জন্মে। জুলাই থেকে ডিসেম্বরে ফুল-ফল ধরে ও বীজ হয়। এ দেশে সাধারণত বনেজঙ্গলে দেখা যায়। বিশেষ করে চট্টগ্রাম, পার্বত্য চট্টগ্রাম, সিলেট, গাজীপুরের বনাঞ্চলে মাকাল গাছ আছে। আগের দিনের তুলনায় এদের এখন কম চোখে পড়ে, তবে এখনো বিলুপ্তির শঙ্কা নেই।
ছবির ক্যাপশন
গাজীপুর শ্রীপুরে বিন্দুবাড়ি গ্রামে বেনুভিটায় দেখা মাকাল ফল। ছবি: লেখক