সংস্কৃত ভাষায় রচিত কবি কালিদাসের বিখ্যাত ‘মেঘদূত’ কাব্য আমার পক্ষে পড়া ও তার অর্থ বোঝা সম্ভব না। স্কুলে দু-বছর সংস্কৃত পড়লেও আমার দৌড় ওই সংস্কৃত অক্ষর আর কয়েকটা পাতার মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। মেঘদূতের সংস্কৃত লাইনগুলোকে একটা বইয়ে দেখলাম বাংলা অক্ষর দিয়েও লেখা হয়েছে। তাও দুর্বোধ্য আমার কাছে। হঠাৎ হাতে পেলাম কবি বুদ্ধদেব বসু অনূদিত বাংলা মেঘদূত। বুদ্ধদেব বসুর বাংলা অনুবাদকৃত ‘মেঘদূত’ বইটিতে পেলাম মেঘদূত কাব্যের এক অসাধারণ কাব্যক্রীড়া। পড়তে পড়তে দেখলাম পূর্বমেঘের চতুর্থ স্তবকে রয়েছে-
‘কেমনে প্রিয়তমা রাখবে প্রাণ তার অদূরে উদ্যত শ্রাবণে
যদি-না জলধরে বাহন ক’রে আমি পাঠাই মঙ্গল-বার্তা?
যক্ষ অতএব কুরচি ফুল দিয়ে সাজিয়ে প্রণয়ের অর্ঘ্য
স্বাগত-সম্ভাষ জানালে মেঘবরে মোহন, প্রীতিময় বচনে।’
অর্থাৎ বিরহী যক্ষ প্রিয়ার কাছে বার্তা পৌঁছানোর জন্য যে ফুলে মেঘকে অর্চনা করেছিল, সেটা আমাদের দেশীয় ফুল কুরচি। এ দেশের পাহাড়ে জঙ্গলে অঢেল আছে কুরচিগাছ। সিলেট, বান্দরবান, গাজীপুরের শালবনে কুরচিগাছ দেখেছি অনেক। এ জন্যই কি এর আর এক নাম গিরিমল্লিকা? কবি নজরুলের কাছে কুরচি হয়েছে গিরিমল্লিকা, রবীন্দ্রনাথের কাছে কুরচি আর কালিদাসের কাছে কুড়চি/কুরচি ও কূটজ। মেঘদূত কাব্যে সেই কূটজের দেখা পাই-
‘যদিও জানি তুমি আমার প্রিয় কাজে অচির যাত্রায় উৎসুক
দেখেছি তবু সব, কূটজ সৌরভে মোদিত পর্বতে কাটাবে কাল।’
কুরচির (Holarrhena pubescens) সাদা সুগন্ধময় পাঁচ পাপড়ির থোকাধরা ফুল প্রবলভাবে আকৃষ্ট করেছিল বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামকে। রবীন্দ্রনাথের ‘বনবাণী’ কবিতায় কুরচির সে সৌন্দর্য ও আকর্ষণকে তিনি অকৃপণ হাতে লিখে রেখেছেন-
‘সূর্যের আলোর ভাষা আমি কবি কিছু কিছু চিনি
কুরচি পড়েছ ধরা, তুমি রবির আদরিণী।’
শিলাইদহ থেকে কবি এক দিন ট্রেনে চেপে কলকাতা যাচ্ছিলেন। কুষ্টিয়া স্টেশনের পেছনের দেয়ালঘেঁষে একটি কুরচিগাছ হাটবাজারের কোলাহল, রেললাইন, গরুর গাড়ির ভিড় ও বাতাসের নিবিড় ধুলোকে অগ্রাহ্য করেও পরিপূর্ণভাবে ফুটে বসন্তকে স্বাগত জানিয়েছিল। সেই কুরচির রূপ কবিগুরুর মনকে নাড়া দিয়েছিল, তাগিদ দিয়েছিল কুরচির মতো কবিতা লিখতে ও কুরচিকে মনে রাখতে। বনবাণী কাব্যের ‘কুরচি’ কবিতার কয়েকটি পঙ্ক্তি-
‘কুরচি, তোমার লাগি পদ্মেরে ভুলেছে অন্যমনা
যে ভ্রমর, শুনি নাকি তারে কবি করেছে ভর্ৎসনা।
আমি সেই ভ্রমরের দলে। তুমি আভিজাত্যহীনা,
নামের গৌরবহারা; শ্বেতভুজা ভারতীয় বীণা
তোমারে করেনি অভ্যর্থনা অলংকার ঝংকারিত
কাব্যের মন্দিরে। তবু সেথা তব স্থান অবারিত,
বিশ্বলক্ষ্মী করেছেন আমন্ত্রণ যে প্রাঙ্গণতলে
প্রসাদচিহ্নিত তার নিত্যকার অতিথি দলে।’
কবি রবীন্দ্রনাথের ভালো লাগা কুরচি ফুলকে নিসর্গী দ্বিজেন শর্মাকে করেছিল আন্দোলিত। তিনি তো ‘কুরচি তোমার লাগি’ নামে একটা বই-ই লিখে ফেলেছিলেন।
একইভাবে কবি নজরুলও লিখে গেছেন-
‘কি হবে কেয়া, দেয়া নাই গগনে;
আনো সন্ধ্যামালতী গোধূলি-লগনে।
গিরিমল্লিকা কই চামেলি পেয়েছে সই
চাঁপা এনে দাও, নয় বাঁধব না চুল॥’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় মসজিদের পাশে কবি কাজী নজরুল ইসলামের সমাধিস্থলেও লাগানো হয়েছে দুটি কুরচিগাছ। চৈত্রশেষে এক ভোরবেলায় গিয়ে সে গাছ দুটো দেখে তো আমি থ! কে বলে চেরি ফুল দেখতে জাপানে যেতে হবে? ফুলে ফুলে সাদা হয়ে গাছের সব ডালপালা ভরে রয়েছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলাভবনের সামনের কুরচিগাছগুলোরও একই অবস্থা। কেবল ফুল আর ফুল। বসন্ত এলেই এ দেশের বনে-জঙ্গলে উদ্যানে কুরচি গাছেরা ফুলে ফুলে ভরে যায়, ফুলের ভিড়ে পাতারা লুকিয়ে পড়ে। এদেশের পাহাড়ি বনে ও শালবনে কুরচি গাছের দেখা পাওয়া যায়। এমনকি জাতীয় সংসদ ভবনের সামনে মানিক মিয়া অ্যাভিনিউর ফুটপাতের কোলেও লাগানো হয়েছে কুরচিগাছ। তরুণ সেসব গাছগুলোতে ফুল ফুটেছে। আর একটি ছোট কুরচিগাছ আছে খামারবাড়ির পাশে কৃষিবিদ ইনস্টিটিউশন বাংলাদেশের সামনে।
যে গাছের গুণ যত বেশি, তার নামও হয় তত বেশি। ঢাকায় কুরচিগাছের সংবাদ দিতে গিয়ে নিসর্গী দ্বিজেন শর্মা ২০০৬ সালে লেখা তার ‘কুরচি তোমার লাগি’ নিবন্ধে বলেছেন: ‘ঢাকায় ষাটের দশকের শুরুতে ইস্কাটন, মগবাজারের পোড়োজমিতে যেসব কুরচি ছিল বহুতল ভবনের তলায় কবেই তারা চাপা পড়েছে। ... হেয়ার ও মিন্টো রোডের মন্ত্রীপাড়ায়, পরিবাগে (ডা. বাসেত সাহেবের বাড়ির প্রাচীরলগ্ন) এবং কার্জন হলের পুব সীমানায় কুরচিগাছে এখন ফুল ফুটছে। রমনা পার্ক বা সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে কোনো কুরচি দেখি না। ... ঢাকার ফ্রি স্কুল স্ট্রিটে আমার এক বন্ধু-গৃহের চাতালে একাধিক বয়স্ক কুরচিগাছ আছে। অনুমান, কেউ ওগুলো লাগাননি।’
এসব সূত্র ধরেই ওসব জায়গায় গিয়েছি কুরচি গাছের খোঁজে। সেখানে না পেলেও অন্যখানে পেয়েছি। কুরচি পাহাড়ি বনের সীমানা ছেড়ে এখন ঢাকা শহরে বেশ ছড়িয়ে পড়েছে, ঢাকা ক্যান্টনমেন্টের মধ্যেও কুরচিগাছ আছে। রমনা পার্কে, ঐতিহাসিক রমনার বটমূল প্রাঙ্গণের কিনারায় কয়েকটা কুরচিগাছ বসন্তের শেষে নিষ্পত্র ডালে ডালে ঢেলে দিয়েছে পুষ্পরসের অমৃতধারা, শুভ্রসাদা মদিরগন্ধে স্বর্গীয় সে দৃশ্য! একটি বয়স্ক কুরচি গাছের দেখা পেলাম রমনা উদ্যানের ভেতরে, নার্সারির একেবারে শেষ প্রান্তে। চৈত্রের প্রথম দিকে সে গাছে ছিল শুধু ফুল আর ফুল, এখন সেই গাছে ফুলের সঙ্গে সঙ্গে ভরে উঠেছে নতুন কচি পাতাও। যদি কোথাও কোনো রাস্তার পাশে বা মাঠজুড়ে অনেকগুলো কুরচিগাছ লাগানো যায়, তবে সেখানে আমরা জাপানের মতো হয়তো এক দিন কুরচি উৎসব করতে পারব, গাইতে পারব কুরচিকে নিয়ে লেখা রবীন্দ্রনাথের গান।