প্রকৃতির অপার বিস্ময় ও সৌন্দর্যের লীলাভূমি বঙ্গোপসাগরের বুকে জেগে ওঠা সেন্ট মার্টিন দ্বীপ। সেখানকার গাছপালা, পাখপাখালি, প্রবাল, শৈবাল, শামুক-ঝিনুক, মাছ সেই সঙ্গে সবুজ ও নীলচে টলটলে জলরাশি, দ্বীপে আছড়ে পড়া ঢেউয়ের শব্দ খুব সহজেই মানুষের হৃদয় জয় করে নেয়।
এক শীতের শেষ প্রান্তে সেখানে যাওয়া হয়েছিল প্রবাল দ্বীপে বসবাসকারী পাখি প্রশান্ত শৈলাবগা দেখতে। শীতের সময় পরিযায়ী হয়ে এ পাখি আসে সেন্ট মার্টিন দ্বীপে। দ্বীপের সর্ব দক্ষিণ কোণে পাখিটি দেখা যায়।
খুব ভোরের দিকে, তখন সমুদ্রের বুকে জোয়ার। নৌকায় করে পৌঁছে গেলাম ছেঁড়া দ্বীপে। সেখানে যেন এ দ্বীপের অপার সৌন্দর্য লুকিয়ে আছে। কেয়া গাছ, নীলচে জলের ঢেউগুলো ভেঙে যাচ্ছে প্রবালের গায়ে আছড়ে পড়ে। নিসর্গের রূপ দেখতে দেখতে সমুদ্রে ভাটা শুরু হয়ে গেছে। অজান্তে কখন যে সময় কেটে গেছে! পরিকল্পনা করলাম ছেঁড়া দ্বীপ দিয়ে হেঁটেই সেন্ট মার্টিন যাব।
ভাটার সময় সমুদ্রের পানি কমতে শুরু করলে দুই দ্বীপের মধ্যে সংযোগপথ জেগে ওঠে। ভাটা শুরু হলেই সামুদ্রিক পাখিরা খাবার খেতে নামে বেলাভূমিতে। ভাটার সময় পানি কমে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে নানান সামুদ্রিক পোকা-মাকড়, কাঁকড়া জেগে ওঠে। প্রায় ঘণ্টাতিনেক হেঁটে সেন্ট মার্টিন দ্বীপে পৌঁছলাম। পথে পথে সামুদ্রিক শৈবাল, পাখি দেখা ও পাখির ছবি তোলার জন্য অতিরিক্ত এক ঘণ্টা সময় বেশি লেগেছে। সেদিন প্রশান্ত শৈলাবগার দেখা না পেলেও প্রায় ২৬টি বড় টিকিপানচিলের একটি ঝাঁকের দেখা পেয়েছিলাম।
পানচিলগুলো প্রবালের ওপর বসে বিশ্রাম নিচ্ছিল। কিছু আবার রাজকীয় ভঙ্গিতে উড়ছিল সমুদ্রের নীল জলের একেবারে কাছ দিয়ে। সে দৃশ্য অপূর্ব। বড় টিকিপানচিল (Greater Crested Tern) উপকূল, মোহনা ও সাগরের চরে বিচরণ করে, তবে তীর থেকে দূরে থাকতে পছন্দ করে তারা। সচরাচর ছোট বিচ্ছিন্ন দলে থাকে।
প্রায়ই বাংলা টিকিপানচিলের সঙ্গে যোগ দেয়। পানির সামান্য ওপরে ওড়ে। বাতাসে ভেসে বেড়িয়ে অথবা পানিতে ঝাঁপ দিয়ে এরা খাবার সংগ্রহ করে। খাদ্য তালিকায় আছে ছোট মাছ ও চিংড়ি। খাওয়ার সময় কর্কশ গলায় ডাকে: চ্যারাক..চ্যারাক সুরে। এরা দীর্ঘক্ষণ ধরে উড়ে বেড়াতে অভ্যস্ত ও প্রায়ই গভীর সাগরে উড়ে যায়। সেন্ট মার্টিন থেকে শাহপরীর দ্বীপ ও সোনাদিয়া দ্বীপে এরা আসা যাওয়া করে।
বড় টিকিপানচিল হলদে ঠোঁট ও কালচে ডানার সামুদ্রিক পাখি। শরীরের দৈর্ঘ্য ৫৩ সেমি, ডানা ৩৬ সেমি। অপ্রাপ্ত বয়স্ক পাখির দেহের সামান্য কিছু অংশ ছাড়া পিঠ কালচে ধূসর, দেহের নিচের দিক সাদা। প্রজনন সময়কালীন ঠোঁটের ওপরের অংশের কপাল সাদা হয়, পুরো মাথার চাঁদি ও ঘাড়ের পিছনটা থাকে কালো। অসমান কালো ঝুঁটি থাকে মাথার পিছনে। প্রজনন সময় ছাড়া মাথার চাঁদিতে সাদা তিলা থাকে। লম্বা ডানা ও খাটো লেজটির মাঝামাঝি অংশ ধূসর; ঠোঁট হালকা পীত থেকে সবুজে লেবু-হলুদ। চোখ কালচে বাদামি। পা ও পায়ের পাতায় কিছুটা বাদামি-কালোর মিশ্রণ থাকে। ছেলে ও মেয়ে পাখির চেহারা অভিন্ন।
বড় টিকিপানচিল উপনিবেশ করে প্রজননের সময়। এপ্রিল-জুন মাসে সাগরের তীর থেকে দূরের দ্বীপে বালুর প্রাকৃতিক খোদলে কিংবা প্রবালের মাঝে বাসা বানিয়ে ডিম পাড়ে। ডিম সাদা থেকে হালকা পীতবর্ণের বা সামান্য বেগুনি। সংখ্যায় ১-২টি। ২১-২৩ দিনে ডিম ফুটে ছানা বের হয়। বড় টিকিপানচিল বাংলাদেশের বিরল পরিযায়ী পাখি। শীতে চট্টগ্রাম বিভাগের উপকূলে পাওয়া যায়।
লেখক: পরিবেশবিদ, জার্মান অ্যারোস্পেস সেন্টার
[email protected]