ঢাকা ১৬ বৈশাখ ১৪৩২, মঙ্গলবার, ২৯ এপ্রিল ২০২৫
English
মঙ্গলবার, ২৯ এপ্রিল ২০২৫, ১৬ বৈশাখ ১৪৩২

আলব্যাট্রসের রানওয়ে পরিষ্কার করে যে প্রাণী

প্রকাশ: ২৮ এপ্রিল ২০২৪, ০৯:৫৪ এএম
আপডেট: ২৮ এপ্রিল ২০২৪, ১০:০৭ এএম
আলব্যাট্রসের রানওয়ে পরিষ্কার করে যে প্রাণী
ডিয়েগো, দৈত্যাকার কচ্ছপ যে প্রায় এককভাবে তার নিজের প্রজাতিকে বাঁচিয়েছিল। ছবি: সংগৃহীত

প্রশান্ত মহাসাগরে বিষুব রেখার দুই পাশ জুড়ে ছড়িয়ে থাকা দ্বীপপুঞ্জ গালাপাগোস। এই দ্বীপপুঞ্জটি মূলত আগ্নেয় দ্বীপের সমন্বয়ে গঠিত। এই দ্বীপগুলো ইকুয়েডর থেকে ৯৭২ কিলোমিটার পশ্চিমে অবস্থিত। গালাপাগোস দ্বীপপুঞ্জ ইকুয়েডরের গালাপাগোস প্রদেশের অন্তর্গত এবং দেশটির জাতীয় পার্ক সিস্টেমের অংশ। 

এই দ্বীপপুঞ্জে প্রচুর বিরল প্রজাতির প্রাণী আছে, যা পৃথিবীর আর কোথাও দেখা যায় না। দ্বীপপুঞ্জটি এর অনন্য জীববৈচিত্র্যের কারণে ইউনেস্কোর বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী স্থান হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে।

বিবর্তন তত্ত্বের জনক চার্লস ডারউইন এই দ্বীপ ভ্রমণ করেছিলেন। ডারউইনের ভ্রমণই মূলত গালাপাগোসকে বিখ্যাত করেছে। কারণ এখানকার বৈচিত্র্যময় বিরল প্রজাতিগুলো নিবিড় পর্যবেক্ষণের মাধ্যমেই ডারউইন প্রথমবারের মতো বিবর্তনের পক্ষে প্রমাণ পেতে শুরু করেন। এখানকার অনেকগুলো প্রজাতি ডারউইনের প্রাকৃতিক নির্বাচন তত্ত্বের পক্ষে প্রমাণ হিসেবে কাজ করেছে।

এর মধ্যে অন্যতম কচ্ছপ। সরীসৃপ জাতীয় প্রাণী কচ্ছপকে প্রাকৃতিক প্রকৌশলীও বলা হয়। গ্যালাপাগোস দ্বীপপুঞ্জে কচ্ছপের একটি বাহিনী পরিবেশগত ভারসাম্য করতে সাহায্য করছে। এই দ্বীপের বিশাল আকৃতির কচ্ছপগুলো সামুদ্রিক দিবাচর পাখি আলব্যাট্রসের চলার পথ পরিষ্কার করে।

স্প্যানিশ নদীর তীরে অবস্থিত এস্পানোলা (Española) দ্বীপে মানুষের আগমনের আগে প্রায় ৮ হাজার কচ্ছপ ছিল। ১৮ শতকে জলদস্যুরা এস্পানোলা ও প্রতিবেশী দ্বীপগুলো দখল করে। তারা খাবারের চাহিদা পূরণের জন্য কচ্ছপ ও তিমির উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ে। ফলে কমতে থাকে এই দ্বীপের কচ্ছপের সংখ্যা। এখান থেকে যাওয়ার সময় তারা এই দ্বীপগুলোতে কিছু ছাগল রেখে যায়। ছাগলের সংখ্যা অনেক বেড়ে গেলে সেখানকার গাছপালা শেষ হয়ে যায়।

ফলে ১৯৭০ এর দশকের মধ্যে তৃণভোজী প্রাণী কচ্ছপের আদিম আবাসস্থল প্রায় ধ্বংস হয়ে যায়। এ সময় এস্পানোলায় কচ্ছপের বাস্তুতন্ত্র পুনরুদ্ধার করতে সহায়তা করে এই দ্বীপপুঞ্জের সবচেয়ে জনপ্রিয় কচ্ছপ ডিয়েগো। এস্পানোলায় ডিয়েগোর সর্বশেষ ১৪টি কচ্ছপের মধ্যে ১২টি নারী ও দুটি পুরুষ কচ্ছপ ছিল। 

১৯৬৪ থেকে ১৯৭৪ সালের মধ্যে এদেরকে বংশবিস্তার কর্মসূচির জন্য সান্তা ক্রুজে ডারউইন রিসার্চ স্টেশনে নিয়ে আসা হয়। পরে সান ডিয়েগো চিড়িয়াখানা থেকে উদ্ধার করা ডিয়েগোকেও এদের সাথে যুক্ত করা হয়। ডিয়েগো পরবর্তীতে শত শত কচ্ছপের বাবা হয়ে ওঠে এবং এই বিপন্ন প্রজাতিকে রক্ষায় মূল ভূমিকা পালন করে। ২০২০ সালে, তার জন্মস্থানে অবসরে জীবন কাটাতে ফিরে আসার আগ পর্যন্ত সে এই কাজে সাহায্য করে।

এক দশকেরও বেশি সময় ধরে গ্যালাপাগোস দ্বীপপুঞ্জে কচ্ছপের বাস্তুশাস্ত্র অধ্যয়ন করা মার্কিন ভূতাত্ত্বিক জরিপ ও ভার্জিনিয়া টেকের সংরক্ষণ জীববিজ্ঞানী এলিজাবেথ হান্টার বলেন, কচ্ছপের গুরুত্বপূর্ণ বাস্তুতন্ত্র গঠনের বৈশিষ্ট্য রয়েছে। তৃণভোজী এই প্রাণী হারিয়ে গেলে সেখানে জন্মানো আগাছা, অন্যান্য প্রজাতি ও তাদের আবাসস্থলে বিরুপ প্রভাব ফেলবে।

তিনি বলেন, ১৮৩৫ সালে চার্লস ডারউইন যখন গ্যালাপাগোস দ্বীপপুঞ্জ পরিদর্শন করেন তখন তিনি উচ্চভূমি থেকে নিচের দিকে একটি চলার পথ দেখতে পান। যা উচ্চভূমি থেকে নিম্নভূমিতে কচ্ছপের চলাচলের জন্য তৈরী হয়েছে।

এস্পানোলায় কচ্ছপগুলো ঐতিহাসিকভাবে আলব্যাট্রসের চলার পথ এবং বাসা বানানোর জায়গা পরিষ্কার করে থাকে। এর ফলে আলব্যাট্রস একচেটিয়াভাবে বংশবৃদ্ধি করতে পারে।

হান্টার বলেন, ‘আলব্যাট্রসের ২ মিটার লম্বা বিশাল ডানা রয়েছে। এরা ওড়ার জন্য প্রথমে দৌড় শুরু করে। এর জন্য তাদের প্রয়োজন হয় খোলা জায়গার। কচ্ছপগুলো আলব্যাট্রসের সেই খোলা জায়গা (ল্যান্ডিং স্ট্রিপ) তৈরি করে দেয়।’

হান্টার বলেন, কচ্ছপের দৈনন্দিন কার্যক্রম প্রাকৃতিক চক্রকে উৎসাহিত করে। একটি কচ্ছপ প্রতি বছর শত শত কিলোগ্রাম গাছপালা খেতে পারে। আর যেসব খেতে পারে না সেগুলো পদদলিত করে। গতিশীল একটি দৈত্যাকার কচ্ছপ মূলত একটি বুলডোজার। যা তার চলার পথের সমস্ত কিছুকে পথ থেকে সরিয়ে দেয়। এর মাধ্যমে কচ্ছপগুলো সেখানকার জীববৈচিত্র্যকে সমৃদ্ধ করে।

এস্পানোলায় কচ্ছপের ৫০ বছরের প্রজনন কর্মসূচির আওয়ায় বর্তমানে কচ্ছপের সংখ্যা তিন হাজার। ২০২৩ সালের এক গবেষণায় দেখা গেছে, এই দ্বীপে কাঠের গাছপালা ধীরে ধীরে হ্রাস পাচ্ছে এবং ঘাস-বৃক্ষ জাতীয় উদ্ভিদের মিশ্রণে তৈরি বাস্তুতন্ত্র সাভানা ফিরে আসছে। যা সম্ভব হচ্ছে কচ্ছপের কারণে।

কচ্ছপ স্থলজ প্রাণী হওয়া সত্ত্বেও গ্যালাপাগোসে কচ্ছপের জলের প্রতি রয়েছে অগভীর ভালবাসা। দুই ডজন বা তারও অধিক কচ্ছপ একসঙ্গে একটি কর্দমাক্ত পুকুরে ভিজতে পারে। পানিতে এরা দুই পা দিয়ে প্যাডেলিং করে।

যখন একটি কচ্ছপ ঠাণ্ডা হওয়ার জন্য পুকুরে নামে, তখন এটি শরীরে করে মাটি নিয়ে যায়। কচ্ছপ পানিতে মলত্যাগ করে, যার ফলে পানি সার সমৃদ্ধ হয় এবং পানিতে অক্সিজেনের মাত্রা বৃদ্ধি করে। যা উদ্ভিদ ও পোকামাকড়ের জন্য একটি পুষ্টিসমৃদ্ধ জলজ পরিবেশ তৈরি হয়।
এক সমীক্ষা অনুসারে কচ্ছপ বীজ বিচ্ছুরণকারী একটি প্রাণী। এরা দুই সপ্তাহে ১০ কিমি পর্যন্ত হাঁটতে পারে। হাটার পথে তারা মলত্যাগের মাধ্যমে হাজার হাজার বীজ ছড়িয়ে দেয়।

বিশ্বের অনেক জায়গায় কচ্ছপ পাওয়া যায় এবং বিভিন্ন জায়গায় ভিন্ন ভিন্ন উপায়ে এরা ইকোসিস্টেম ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে কাজ করে। উত্তর আমেরিকায়, গোফার কচ্ছপ ১২ মিটার পর্যন্ত লম্বা গর্ত খুঁড়তে পারে। যা ৩৫০ টির মতো অন্যান্য প্রজাতির প্রাণী ব্যবহার করে থাকে। এরমধ্যে রয়েছে বরোজিং পেঁচা, ফ্লোরিডা মাউস ও ইস্টার্ন ইন্ডিগো সাপ।

মরিশাসের প্রধান দ্বীপের ইবোনি ফরেস্ট রিজার্ভে অ্যালডাব্রা অ্যাটল থেকে বিশালাকার দুটি বিলুপ্তপ্রায় প্রজাতির কচ্ছপ আনা হয়েছে। যাতে এরা ক্ষতিকর ঘাস খায় এবং দেশীয় গাছপালা বৃদ্ধিতে সহায়তা করে।

রিজার্ভ পরিচালনাকারী সংরক্ষণ জীববিজ্ঞানী ক্রিস্টিন গ্রিফিথস বলেন, আমরা বনভূমিতে একটি চারণ কার্যক্রমের (ইকোসিস্টেম) অভাববোধ করছিলাম। স্বাভাবিকভাবেই কচ্ছপ খোলা জায়গা তৈরি করে, আমরা চাই এরা এ দ্বীপে আগাছা কম রাখুক যেন রোপণ করা গাছগুলো বড় হতে পারে।

মরিশাস উপকূলের দুটি দ্বীপে কচ্ছপ বন সম্প্রসারণে সহায়তা করছে। ভারত মহাসাগরের দ্বীপগুলোতেও কচ্ছপ বনায়নের অংশীদার হচ্ছে। এই দ্বীপগুলোতে দৈত্যাকার কচ্ছপগুলো পুনরুদ্ধার করার সঙ্গে সঙ্গে উদ্ভিদ ও প্রকৃতিতে বিরাট পরিবর্তন হতে শুরু করেছে। যদিও এই জাতীয় প্রকল্পের সাফল্য পরিমাপ করতে কয়েক দশক পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয়। একইভাবে এস্পানোলা দ্বীপেও কচ্ছপের মাধ্যমে ইতিবাচক পরিবর্তন দেখতে গবেষকদের এক দশক পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হতে পারে। সূত্র: বিবিসি

ভাষান্তর: ইসরাত জাহান চৈতী  

রূপবতী জহর পোকা

প্রকাশ: ২৮ এপ্রিল ২০২৫, ০৯:৩২ এএম
রূপবতী জহর পোকা
রংপুরে অড়বরইগাছে দেখা জহর পোকা। ছবি: লেখক

বগুড়া থেকে প্রকৃতিবন্ধু জিনিয়া নাসরিন সুমনের ফেসবুকে পোস্ট করা ভিডিওতে দেখলাম, লাল ছিটকিগাছের পাতার মধ্যে রূপবতী চকচকে নীল-সবুজ রঙের কালো ফোঁটাযুক্ত একটা পোকা ঘুরঘুর করছে। দেখে মনে পড়ে গেল কয়েক বছর আগে রংপুরে বুড়িরহাট হর্টিকালচার সেন্টারের ভেতরে এই ছিটকি গোত্রেরই আরেক গাছ অড়বরইয়ের ডালপালা ও পাতায় পাতায় হাঁটতে দেখেছিলাম এ পোকাটিকে। বেশ কিছুক্ষণ ধরে তার হাবভাব দেখছিলাম। তাই পোকাটিকে চিনতেই তার অনেক কথা মনে পড়ে গেল। পোকাটার নাম জুয়েল বাগ বা জহরপোকা। 

মিলনের আগে পুরুষ জহরপোকারা মেয়ে পোকার সঙ্গে সখ্য স্থাপনের চেষ্টা করে। ওদের সখ্যের ধরনটাও বেশ চমৎকার। পুরুষ পোকাটা কোনো মেয়ে জহরপোকাকে দেখলে তার চারপাশে ঘুরঘুর করতে থাকে। নানা ভঙ্গিমায় মেয়ে পোকাটাকে তার ইচ্ছেটা বুঝাতে চেষ্টা করে। এরপর মেয়ে পোকার সায় আছে কি না, তা বুঝার জন্য পুরুষ পোকাটা তার পেট পাতার সঙ্গে ছুঁইয়ে মেয়ে পোকার সামনে বসে পড়ে। তারপর নতজানু ভঙ্গিতে সে তার শুঁড় দিয়ে মেয়ে পোকার শুঁড়কে স্পর্শ করে। এতেই ওদের ভাবের আদান-প্রদান হয়। মেয়েটার সঙ্গে ভাব করার জন্য পুরুষটা একই রকম অঙ্গভঙ্গি কয়েক বার করে। মেয়ে পোকা রাজি না থাকলে পুরুষ পোকার শুঁড় স্পর্শ করে না। ভাব না হলে পুরুষ পোকারা সেখান থেকে সটকে পড়ে। 

আর তাদের ভাব হলে হয় মিলন। সাধারণত মার্চ থেকে অক্টোবরের মধ্যে এদের মিলন হয়। মিলনের পর মেয়ে পোকাটা অন্তঃসত্ত্বা হয়। গর্ভের ডিমগুলোকে পরিপুষ্ট করার জন্য মেয়ে জহরপোকাগাছের ফলের ভেতর শুঁড় বা মুখের নল ঢুকিয়ে বীজ থেকে রস চুষে খেয়ে উদরপূর্তি করে। এভাবে রস চুষে খাওয়ার কারণে সেসব বীজ অপুষ্ট বা চিটা হয়ে যায়। এর ফলে ফল বিকৃত হয়ে যায়। 

জহরপোকারা পাতার ওপর ডিম পাড়ে। ডিমগুলো কয়েক সারিতে গুচ্ছাকারে থাকে। ছোট ডিমগুলো দেখতে পিপা বা ব্যারেলের মতো দেখায়। ডিমের মুখে একটা ঢাকনা থাকে। ডিমের রং হয় সাদা ময়লাটে। ডিম ফুটে বাচ্চা বের হলে সেই ঢাকনা খুলে যায়। বাচ্চারা বেরিয়ে কিছুদিন দল বেঁধে থাকে। শত্রুর হাত থেকে বাঁচতে বাচ্চা ও বড় পোকারা ওদের গা থেকে এক ধরনের তীব্র দুর্গন্ধযুক্ত রাসায়নিক পদার্থ ছাড়ে। এতে যদি শত্রু ভয় না পায় বা বিরক্ত না হয়, তখন বড় পোকারা ডানা মেলে সেখান থেকে সটকে পড়ে বা পা গুটিয়ে টুপ করে মাটিতে পড়ে যায় ও লুকিয়ে পড়ার চেষ্টা করে।

হেমিপ্টেরা বর্গের এ পোকার বৈজ্ঞানিক নাম বা প্রজাতি ক্রাইসোকোরিস স্টোল (Chysocoris stollii) ও গোত্র স্কুটেলেরিডি। বাংলাদেশে কয়েক প্রজাতির জুয়েল বাগ আছে। আগে এরা পেন্টাটমিডি গোত্রের অন্তর্ভুক্ত ছিল। কিন্তু এদের কাঁধে থাকা ত্রিভুজাকার শক্ত স্কুটেলামের কারণে বর্তমানে এদের স্কুটেলেরিডি গোত্রভুক্ত করা হয়েছে। এরা গান্ধি বা বাগজাতীয় পোকা। এ পোকার রং চকচকে সবুজ বা নীল-সবুজ। মাথার মাঝ বরাবর কালো দাগ থাকে। শুঁড় লম্বা ও পাঁচটি খণ্ডে বিভক্ত। দুই চোখের পাশে কালো ছোপ, বুকের সামনে আটটি দাগ আছে। পাখার ওপর সাতটি কালো ফোঁটা থাকে। এর মধ্যে দুই পাশে তিনটি করে ছয়টি ও মাঝখানে একটি কালো ফোঁটা থাকে। 

ছাত্রজীবনে পড়ার সময় এ পোকাকে মেটালিক শিল্ড বাগ নামে চিনতাম। তবে এর কোনো বাংলা নাম কোথাও পাইনি। আগে ফুটবল খেলায় বিজয়ীদের শিল্ড উপহার দেওয়া হতো। এদের দেহের গড়নটা সেই শিল্ডের মতো বলেই হয়তো এর এরূপ নাম রাখা হয়েছে। তরবারি যোদ্ধারা যুদ্ধের সময় শত্রুদের আঘাত ঠেকানোর জন্য যে ধাতব ঢাল ব্যবহার করতেন, এই পোকার দেহের আকৃতি অনেকটা সে রকম। সে জন্য একে মেটালিক শিল্ড বাগ বলা হয়। আর এর ডানার রংটাও ধাতব দ্রব্যের মতো উজ্জ্বল ও চকচকে, বর্ণময়। দেখে মনে হয় ওদের দেহ থেকে যেন রংধনুর রং বিচ্ছুরিত হচ্ছে, ময়ূরকণ্ঠী সে রং। সাধারণত পুরুষ পোকারা হয় একবর্ণা। কিন্তু মেয়ে পোকারা হয় বহুবর্ণা। পতঙ্গজগতে এমন রূপবতী সুশ্রী পোকা খুব কমই দেখা যায়। 

এখন দেখি, ইংরেজি নাম জুয়েল বাগ আর বাংলা নাম জহরপোকা। এর মানে কি? জুয়েল মানে হীরে-জহরত, মণি-মাণিক্যর মতো উজ্জ্বল দ্যুতিময়। সে অর্থে এর বাংলা নামকরণ হতে পারে জহর পোকা। জহর পোকাদের সাধারণত খেতে, মাঠে, ঝোপঝাড়ে ও অরণ্যে দেখা যায়। বাংলাদেশ ছাড়াও নেপাল এবং ভারতেও জুয়েল বাগ আছে। বাংলাদেশে এ প্রজাতির পোকা অনেক দেখা যায়, বিলুপ্তির কোনো শঙ্কা নেই। এটি অড়বরই, আমলকী, লিচু, আঁশফল, সফেদা ইত্যাদি ফলের একটি ক্ষতিকর পোকা, তাই গবেষণার সুযোগ আছে।

সোনাকপালি হরবোলা

প্রকাশ: ২৬ এপ্রিল ২০২৫, ০৯:৪০ এএম
আপডেট: ২৬ এপ্রিল ২০২৫, ০১:০৯ পিএম
সোনাকপালি হরবোলা
সাতছড়ি জাতীয় উদ্যানে সোনাকপালি হরবোলা। ছবি: লেখক

গ্রীষ্মের দুপুরে বনের পাখিরা একটি বুনো বৃক্ষে পাকা ফল খেতে ভিড় করে। পাখিরা গরমের সময় রসালো ফল খেতে পছন্দ করে। রাঙামাটির কাপ্তাই জাতীয় উদ্যানের সেই গাছটির ফল পেকেছে। ফলগুলোর বর্ণ লাল। ফলগুলো দেখে মনে হয়েছিল আমাদের ছেলেবেলায় দেখা লোহাগাড়া ফল। কিছুটা জামের মতো, তবে তা দেখতে গোলাকার। বনের অনেক প্রজাতির পাখি সেদিন বনের সেই গাছটিতে ফল খেতে এসেছিল। তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো বুনো হরিয়াল, জলপাই বুলবুল, তেলশালিক, নীলপরি, ধলাচোখ, সিপাহি বুলবুল ও কমলাপেট ফুলঝুরি। সেই সব পাখির মধ্যে একটি সবুজ পালকের পাখি আমাকে মুগ্ধ করেছিল। পাখিটি তার সরু ঠোঁট দিয়ে ছোট ফল ঠুকরে খাচ্ছিল। পাখিটির নাম সোনাকপালি হরবোলা। কপালে তার সোনালি-কমলা পালক। প্রথম দেখায় সে নজর কেড়েছিল আমার।  

সোনাকপালি হরবোলা বাংলাদেশের চিরসবুজ বন, পাতাঝরা বন এবং বৃক্ষবহুল অঞ্চলে বিচরণ করে। প্রধানত ছোট দলে অথবা জোড়ায় থাকে। গাছের ঘন পাতা এবং উঁচু ডালে এরা খাবার খোঁজে। বনের মান্দারগাছে ফুল এলে তারা নিয়মিত মান্দার ফুলে বিচরণ করে ফুলের মধু পান করতে। সাতছড়ি জাতীয় উদ্যানে মান্দারগাছে ফুল ফুটলে সেই গাছে পাখিটি প্রতিদিন ভিড় করে এবং খুব সহজেই দেখা যায়। এ পাখি পোকামাকড়, বিশেষ করে শুঁয়োপোকাও খায়। অন্য পাখিদের সঙ্গে মিলে খাবারের জন্য গাছে গাছে ঘুরে বেড়ায়। 

গাছে গাছে বিচরণের সময় এরা মধুর সুরে ডাকে। এরা অন্য পাখির সুরও অনুকরণ করতে পারে। প্রজননকালে গাছের খাড়া ও সরু ডালে ঘাস, শেওলা, মাকড়সার জাল দিয়ে বাটির মতো বাসা বাঁধে। হালকা পীতাভ বর্ণের দুই থেকে তিনটি ডিম পাড়ে। জানুয়ারি থেকে আগস্ট এদের প্রজননকাল। এ সময় পাখি ডিমে তা দেয়। ডিম পাড়ার প্রায় দুই সপ্তাহ পরে ডিম ফুটে ছানা বের হয়। ডিম ফোটার ১৩ থেকে ১৫ দিন পর ছানারা বাসা ছাড়ে। 

প্রধানত সবুজ পালকের এ পাখির ঈষৎ বাঁকা কালো ঠোঁট থাকে। চোখের পেছন থেকে সারা বুকের জায়গাটাকে ঘিরে আছে প্রশস্ত হলুদ বন্ধনী। চোখ গাঢ় বাদামি। পা এবং পায়ের পাতা কালো। মেয়েপাখির কপালের পালক অনুজ্জ্বল। এ ছাড়া দেখতে উভয় পাখি একই রকম। দেহের  দৈর্ঘ্য ১৭ সেমি এবং ওজন ১৯ গ্রাম। অপ্রাপ্তবয়স্ক পাখির দেহ পুরোপরি সবুজ, কেবল গালের নিচ নীলচে। 

বাংলাদেশে চার প্রজাতির হরবোলা দেখা যায়। তদের মধ্যে সোনাকপালি হরবোলা সবচেয়ে বেশি দেখা যায়। অন্য তিন প্রজাতির হরবোলা বিরল। সোনাকপালি হরবোলা বাংলাদেশের সুলভ আবাসিক পাখি। দেশের সব বিভাগের বনে এদের দেখা যায়। এ পাখির ইংরেজি নাম গোল্ডেন ফ্রন্টেড লিফবার্ড। এদের  বিস্তৃতি ভারতীয় উপমহাদেশ এবং দক্ষিণ-পশ্চিম চীন থেকে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া এবং সুমাত্রা পর্যন্ত। সোনাকপালি হরবোলা বাংলাদেশে এবং বিশ্বের বিপদমুক্ত পাখি হিসেবে বিবেচিত। বাংলাদেশের বন্যপ্রাণী আইনে পাখিটি সংরক্ষিত। 

প্রকৃতিবিষয়ক লেখক ও পরিবেশবিদ, জার্মান এরোস্পেস সেন্টার

জারুল ফুল ফুটলোরে

প্রকাশ: ২৫ এপ্রিল ২০২৫, ০১:২০ পিএম
জারুল ফুল ফুটলোরে
চন্দ্রিমা উদ্যানে বৈশাখে ফোটা জারুল ফুল। ছবি: লেখক

বৈশাখ মাস পড়তে না পড়তেই জারুল এসে হাজির। জাতীয় উদ্ভিদ উদ্যান, সোহরাওয়ার্দী উদ্যান, রমনা উদ্যান, চন্দ্রিমা উদ্যান, জাতীয় জাদুঘরের কোণে সবুজ ঝাঁকড়া মাথার জারুলগাছগুলোতে এখন বেগুনি রঙের ফুলের মাতামাতি। রমনায় জারুলগাছের বাগিচাটার নামই দেওয়া হয়েছে জারুল চত্বর। চন্দ্রিমা উদ্যানের পশ্চিম অংশে লাগানো জারুল বনটাকে বড়ই মনোরম মনে হয় বৈশাখের দিনে। তার ছায়াঘন পুষ্পময়ী বৃক্ষতলে বসে প্রকৃতিপ্রেমীরা বিদেশের চেরি উৎসবের মতো জারুল উৎসব করতে পারেন। নদীর তীরে, রাস্তার ধারে, হাওর বাঁওড়েও ফুটেছে এ ফুল। গ্রীষ্মের দিনে এ দেশে কৃষ্ণচূড়া, রাধাচূড়া, কনকচূড়া ফুলের পাশাপাশি জারুল ফুলও রাঙিয়ে দেয় প্রকৃতিকে। গোটা গ্রীষ্মকাল থাকে সেই পুষ্পপ্রাচুর্য। 

নগরে তো বটেই, ঢাকা মহানগর ছেড়ে রাজপথে দূরে কোথাও যাওয়ার পথে, পথের ধারে থাকা জারুলগাছগুলো যেন রৌদ্রতপ্ত বৈশাখী দুপুরে এক প্রশান্তির ছায়া ও রঙে রঙে ঢলে পড়া কোনো তন্বী তরুণীর বুটিদার ওড়না, স্বর্গ থেকে খসে পড়া কোনো উর্বশীর দোপাট্টা। জারুল ফুলগুলোকে দেখে তাই মনে হয় কবি নজরুল লিখেছিলেন: ‘জারুল ফুল/ পারুল ফুল/ ফুটলরে,/ আসলো কে?’ সত্যিই তো কে এল? জারুল আর পারুল, দুটোই বৈশাখে ফোটে। কবির চোখে যেন কিছুই এড়ায় না। যে পারুল বাংলায় দুষ্প্রাপ্য, সেই পারুল ফুলেরও কবি দেখা পেয়েছেন বৈশাখে। এই বৈশাখেই মাঠ ভরে থাকে সবুজ ধানেরগাছ, শীষে ধরে হলদে রং। কবি সেই ধান খেতকে কল্পনা করেছেন সবুজ শাড়িরূপে, আর সে শাড়ির পাড় বানিয়েছেন জারুল ফুল দিয়ে: ‘সবুজ শাড়ির ধানি আঁচল জারুল ফুলে বেগুনি পাড়-/ উড়িয়ে কে ঐ আসল রে ভাই আকাশ-বীণায় বাজিয়ে তার!’ ঝড় কাব্যে মুকুলের উদ্বোধন কবিতায় জারুল ফুলের এ চিত্রকল্পটি আমাদের আন্দোলিত করে।

জারুল একটি বৃক্ষজাতীয় পাতাঝরা প্রকৃতির গাছ। এটি ১৫ মিটার পর্যন্ত লম্বা হয়। কাঠবৃক্ষ হলেও জারুল ফুল ফোটার সময় যেন ফুলগাছ। ফুল, শুধু ফুল-অজস্র ফুলে ফুলে মেতে ওঠে ডালপালা, বন। সুন্দর সে দৃশ্য! জারুল জন্মে এ দেশের প্রায় সর্বত্র। তবে জারুলের আদি নিবাস ছিল চীন দেশে। ভারত, মায়ানমার, শ্রীলংকা, মালয়েশিয়াতেও গাছটি জন্মেছে। তবে এ দেশে সব জায়গায় জারুল থাকলেও চট্টগ্রাম, পার্বত্য চট্টগ্রাম ও সিলেটে বেশি রয়েছে। পাথুরে বালি মাটির মধ্যেও জারুল ঠিকই ঠাঁই করে নিতে পারে। জারুলগাছের কাণ্ড খাটো, সরল, মসৃণ। পাতা উপবৃত্তাকার, ওপরের দিক গাঢ় সবুজ, নিচের দিক হালকা সবুজ। বয়স্ক পাতার রং লাল। খাড়া লম্বা ছড়ায় ফুল ফোটে, ফুলের রঙ আকর্ষণীয় বেগুনি, খাড়া লম্বা ছড়ায় অনেকগুলো ফুল ফোটে, বোঁটা লম্বা, ছয়টি পাপড়ি। পাপড়িগুলো কুঁচকানো রঙিন কাগজের মতো। ফল ডিম্বাকৃতি। 

জারুলগাছ পানিসহিষ্ণু। তাই নিচু বা জলার ধারেও জারুলগাছ লাগানো যায়। জারুলের কাঠ শক্ত ও লাল। প্রধান কাণ্ড ও ডালপালা শক্ত বলে ঝড়-বাতাস এ গাছের সহজে ক্ষতি করতে পারে না। এমনকি বনে আগুন লাগলেও জারুলগাছ সে আগুনে সহজে পুড়ে না। কাঠ আর্দ্রতাসহিষ্ণু। চারা লাগানোর ২-৩ বছর পর থেকে ফুল ফুটতে শুরু করে। চারা লাগানোর পর প্রথম বছরে বৃদ্ধি ধীর থাকলেও পরে গাছ দ্রুত বাড়ে, তিন বছর বয়সেই গাছ প্রায় ৩ মিটার লম্বা হয়ে যায়। বীজ থেকে জারুলের চারা তৈরি করা যায়। বর্ষাকালের আগে চারা লাগানো ভালো। যেকোনো উদ্যান ও নগর পথের ধারে ছায়াবৃক্ষ হিসেবে জারুলগাছ অসাধারণ। যেসব শহরে বায়ুদূষণ বেশি হয়, খারাপ পয়োনিষ্কাশনব্যবস্থা, আটোসাঁটো ও শুকনো মাটি, শুষ্ক আবহাওয়া সেসব শহরের জন্য জারুলগাছ যেন সর্বংসহা, প্রকৃতির এক অপূর্ব দান। ভূমিক্ষয় রোধেও জারুলগাছ চমৎকার। কেননা, এর শেকড় বহুদূর পর্যন্ত বিস্তৃত হয়ে মাটিকে আটকে রাখে। পাহাড় ধস ঠেকাতে তাই পাহাড়েও জারুলগাছ লাগানো যায়।

ফুলপ্রেমিদের কেউ কেউ জারুলকে বসিয়েছেন একেবারে রানির আসনে, ইংরেজিতে ওর নাম দিয়েছেন ‘Queen’s Flowers’, ভারতীয়দের কাছে জারুলের পরিচয় Pride of India রূপে। জারুলের ইংরেজি নাম Giant crepe-myrtle, উদ্ভিদতাত্ত্বিক নাম Lagerstroemia speciosa ও গোত্র Lythraceae. নামের শেষাংশ স্পেসিওসা অর্থ সুন্দর। যথার্থ সে নামের অর্থ। সৌন্দর্য ছাড়াও জারুলের আছে ঔষধি গুণ। ফিলিপিনসের স্বাস্থ্য অধিদপ্তর সে দেশের গুরুত্বপূর্ণ ৬৯টি ঔষধি গাছের মধ্যে জারুলকে ঠাঁই দিয়েছে। ভিয়েতনামে জারুলের কচি পাতা সবজি হিসেবে খাওয়া হয় এবং এর বয়স্ক বা পুরোনো পাতা ও পরিপক্ব ফল রক্তে শর্করার পরিমাণ কমাতে ব্যবহৃত হয়। এর বীজ নেশা উদ্রেককারী। ভারতে মহারাষ্ট্রে রাজ্য ফুলের মর্যাদা দেওয়া হয়েছে জারুলকে। 

মৃত্যুঞ্জয় রায়: কৃষিবিদ ও প্রকৃতিবিষয়ক লেখক

জাতিংগা: পাখিদের রহস্যময় আত্মহননের উপত্যকা

প্রকাশ: ২১ এপ্রিল ২০২৫, ০৯:১৬ পিএম
আপডেট: ২১ এপ্রিল ২০২৫, ১০:১৬ পিএম
জাতিংগা: পাখিদের রহস্যময় আত্মহননের উপত্যকা
প্রতীকী ছবি

ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের আসাম রাজ্যের ডিমা হাসাও জেলার পাহাড়ঘেরা এক ছোট্ট গ্রাম জাতিংগা। নামটি সাধারণ হলেও এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে এক ভয়াবহ, রহস্যে মোড়া ও বৈজ্ঞানিক অনুসন্ধানের উপাদানে পূর্ণ ঘটনা। যা বহু বছর ধরে বিশ্বের নজর কেড়েছে।

এখানে বছরের একটি নির্দিষ্ট সময়ে আকাশ থেকে হঠাৎ করে শত শত পাখি নেমে আসে, ঝাঁকে ঝাঁকে নিচে পড়ে যায়, মরে যায় কিংবা হতবুদ্ধি হয়ে পড়ে থাকে। 

প্রতিবছর সেপ্টেম্বর থেকে নভেম্বর মাসের মাঝামাঝি সময়, সন্ধ্যা ৬টা থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত, এই পাখিদের রহস্যময় দৃশ্য দেখা যায়। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় হলো- এ ঘটনা শুধু জাতিংগা গ্রামের মাত্র ১ দশমিক ৫ কিলোমিটার দীর্ঘ একটি নির্দিষ্ট এলাকাতেই ঘটে। এমনকি এই এলাকা পেরোলেই পাখিগুলোর ওপর এই 'আত্মঘাতী প্রভাব' আর কাজ করে না।

এই ঘটনায় প্রধানত যে সব পাখিরা ক্ষতিগ্রস্ত হয় তাদের মধ্যে রয়েছে- টাইগার বিটার্ন, ব্লু ব্রেস্টেড কিংফিশার, ইন্ডিয়ান পিট্টা, ব্ল্যাক ড্রংগো ইত্যাদি। পাখিগুলোর বেশিরভাগই পরিযায়ী এবং এদের অনেকেই বিলুপ্তপ্রায়।

প্রথমদিকে স্থানীয় মানুষজন এই ঘটনাকে ভৌতিক বা অতিপ্রাকৃত বলে মনে করত। তারা বিশ্বাস করত, জাতিংগা অভিশপ্ত, আর এই পাখিগুলো যেন অপদেবতা দ্বারা আচ্ছন্ন হয়ে আত্মহত্যা করছে। অনেক সময় পাখিগুলোকে ডাইনির চিহ্ন হিসেবে ধরে নিয়ে পিটিয়ে মারা হত।

তবে কালের পরিবর্তনে, আজকের বিজ্ঞান এই রহস্যের যুক্তিসম্মত ব্যাখ্যা দেওয়ার চেষ্টা করছে।

বিশেষজ্ঞদের মতে, জাতিংগার ভৌগোলিক অবস্থান, হঠাৎ বৃষ্টির পর ঘন কুয়াশা, এবং গ্রামের আলো- এই তিনটি উপাদান একত্রে পাখিদের দিশেহারা করে তোলে। সন্ধ্যায় কুয়াশাচ্ছন্ন আকাশে আলো দেখা মাত্র পাখিরা বিভ্রান্ত হয়ে নিচের দিকে নেমে আসে। আলো তাদের চোখে আকর্ষণ সৃষ্টি করে এবং তারা অবচেতনে আলোকে অনুসরণ করতে থাকে, যা শেষমেশ তাদের পতনের কারণ হয়ে দাঁড়ায়।

আরও চমকপ্রদ বিষয় হলো- এই আলো যদি নিভিয়ে দেওয়া হয়, তবে এই 'আত্মহত্যা' বন্ধ হয়ে যায়। ফলে এটি প্রমাণিত হয় যে, প্রকৃতপক্ষে এটি আত্মহত্যা নয়, বরং একটি বিভ্রান্তিকর পরিবেশগত প্রতিক্রিয়া।

তবে প্রশ্ন থেকেই যায়, সব তথ্য ও যুক্তি থাকার পরও কেন এই নির্দিষ্ট এলাকা আর এই নির্দিষ্ট সময়েই এমন ঘটনা ঘটে? কেন অন্যান্য পাহাড়ি অঞ্চলে এমনটা হয় না? উত্তর এখনও পুরোপুরি নিশ্চিত নয়। এ বিষয়ে বিজ্ঞানের অনুসন্ধান এখনও চলমান।

বর্তমানে আসাম সরকারের উদ্যোগে এ ঘটনাটি নিয়ে ব্যাপক গবেষণা হচ্ছে এবং সচেতনতা বৃদ্ধির প্রচার চালানো হচ্ছে। পাখি সংরক্ষণ কর্মী ও পরিবেশবিদরা স্থানীয়দের বোঝাচ্ছেন, এটি কোনো অলৌকিক ঘটনা নয় বরং একটি বৈজ্ঞানিক বাস্তবতা। ফলে এখন পাখি নিধনের ঘটনা অনেকাংশে কমেছে।

বর্তমানে জাতিংগা একটি বৈজ্ঞানিক ও পর্যটন আকর্ষণের স্থান। প্রতিবছর হাজারো পাখিপ্রেমী, বিজ্ঞানী ও পর্যটক এখানে ভিড় করেন এই রহস্যময় দৃশ্যের সাক্ষী হতে। এই আগ্রহ যেমন অর্থনৈতিক সম্ভাবনা বাড়াচ্ছে, তেমনি পরিবেশগত ভারসাম্য রক্ষার চেষ্টাও জোরদার হচ্ছে।

এই রহস্যময়তা জাতিংগাকে ঘিরে রেখেছে এক অদ্ভুত মোহে। যেখানে প্রকৃতি তার নিজস্ব নিয়মে খেলে চলেছে।

মেহেদী/

অপূর্ব উদয়ী ধলা চোখ

প্রকাশ: ১৯ এপ্রিল ২০২৫, ১১:৫১ এএম
আপডেট: ১৯ এপ্রিল ২০২৫, ১১:৫১ এএম
অপূর্ব উদয়ী ধলা চোখ
এক জোড়া উদয়ী ধলা চোখ। পিরোজপুর থেকে তোলা। ছবি: লেখক

গ্রামের মেঘশিরীষগাছে নতুন পাতা এসেছে। নতুন পাতা দিয়ে আচ্ছাদিত একটি মগডালে বাসা বানিয়েছে এক জোড়া খুদে ধলা চোখ পাখি। পাখি দুটি মেঘশিরীষগাছ এবং আশপাশের আম, কদম, মান্দার গাছেই ঘুরে বেড়ায়। চারপাশের পরিবেশ থেকে মাকড়সার জাল, শুকনো আঁশ, শেওলা, লাইকেন সংগ্রহ করে বাসাটি বানিয়েছে। কিছুদিন পরে বাটির মতো বাসাটির পুরোটাই গাছের পাতায় ঢেকে গেছে। ধলা চোখ গাছের দ্বিধাবিভক্ত মগডালের প্রান্তে পাতাঢাকা স্থানে বাসা বানায়। 

তাদের গায়ের পালকের রং জলপাই হলুদ। চোখের চারদিকে সাদা পালকের বলয়। গ্রামবাংলায় তাই এ পাখির অপর নাম শ্বেতাক্ষী। কোথাও আবার ধলা চোখ। তবে এ পাখির পোশাকি নাম উদয়ী ধলা চোখ। অপূর্ব সুন্দর এ পাখি দেশের শুধু গভীর পাহাড়ি বনে নয়, আমাদের গ্রামবাংলার বসতবাড়ির বাগানেও দেখা যায়। অনেক গভীর বনের পাখি দেশের সব জেলায় দেখা যায় না। তবে উদয়ী ধলা চোখ পাখিদের দেখা যায়। ঢাকা শহরের জাতীয় উদ্ভিদ উদ্যানেও দেখেছি তাদের। রাঙামাটির কাপ্তাই জাতীয় উদ্যান, হবিগঞ্জের সাতছড়ি জাতীয় উদ্যান, সুন্দরবন এবং বান্দরবানের সাঙ্গু অভয়ারণ্যেও তাদের সঙ্গে দেখা হয়েছে।

ছোট এই পাখি গাছের শাখায় শাখায় ধীরগতিতে বিচরণ করে। ছোট ছোট দূরত্বে লাফিয়ে ও উড়ে বেড়ায়। উড়ে উড়ে পোকা ধরে খায়। নতুন কিংবা পুরোনো পাতার নিচে এরা পোকা খোঁজে। এরা বন্ধুত্বপূর্ণ এবং ছোট থেকে মাঝারি দলে থাকে। একটি দলে ৩০ থেকে ৫০টি পাখি থাকতে পারে। আমি অবশ্য কখনোই দশের বেশি দেখিনি। প্রজনন ঋতু কাছাকাছি আসার সঙ্গে সঙ্গে দল থেকে আলাদা হয়ে যায়। জোড়া বেঁধে বাসা বানিয়ে দুই থেকে চারটি ফিকে নীল রঙের ডিম পাড়ে। উভয় পাখি মিলে ডিমে তা দেয় এবং ছানাদের যত্ন নেয়। এদের খাদ্যতালিকায় রয়েছে পোকা, মাকড়সা, শুঁয়াপোকা, রসালো ফল, ফুলের কুঁড়ি এবং মধু। এরা দলে চলার সময় কিংবা খাবার খোঁজার সময় ক্ষীণ স্বরে কিচমিচ করে ডাকে। কখনো ডাকার সুর বিরহের- প্রি-উ, প্রি-উ। 

এ পাখির দৈর্ঘ্য প্রায় ১০ সেন্টিমিটার এবং ওজন ৯ গ্রাম। প্রাপ্তবয়স্ক পাখির পিঠ হলদে-সবুজ। ডানা ও লেজ কালচে, গলা ও বুকের ওপরের পালক উজ্জ্বল হলুদ। চোখের বলয় সাদা। পেট সাদাটে ধূসর। তবে কিছু উপ-প্রজাতিতে হলুদ বর্ণের হতে পারে। ছেলে ও মেয়ে পাখির চেহারা অভিন্ন।

ধলা চোখ প্রধানত বৃক্ষবাসী পাখি। পাতায় জমে থাকা শিশিরে এ পাখি স্নান করে। ১৮২৪ সালে ডাচ প্রাণিবিজ্ঞানী কোয়েনরাড জ্যাকব টেমিঙ্ক বাংলায় সংগৃহীত একটি নমুনা থেকে এ পাখির প্রথম বর্ণনা দিয়েছিলেন। উদয়ী ধলা চোখ বাংলাদেশের সুলভ আবাসিক পাখি। দেশের সব বিভাগের বনে এবং গ্রামে দেখা যায়। শহরে এ পাখির উপস্থিতি কম। বিশ্বে এর প্রায় ১১টি উপ-প্রজাতি আছে। বাংলাদেশ বাদে এ পাখিদের ইন্দোনেশিয়া, আফগানিস্তান, ভারত, চীন, মায়ানমার, শ্রীলঙ্কা, থাইল্যান্ড, লাওস এবং কম্বোডিয়াতে পাওয়া যায়। 

সৌরভ মাহমুদ
প্রকৃতিবিষয়ক লেখক ও পরিবেশবিদ, জার্মান এরোস্পেস সেন্টার 
[email protected]