প্রশান্ত মহাসাগরে বিষুব রেখার দুই পাশ জুড়ে ছড়িয়ে থাকা দ্বীপপুঞ্জ গালাপাগোস। এই দ্বীপপুঞ্জটি মূলত আগ্নেয় দ্বীপের সমন্বয়ে গঠিত। এই দ্বীপগুলো ইকুয়েডর থেকে ৯৭২ কিলোমিটার পশ্চিমে অবস্থিত। গালাপাগোস দ্বীপপুঞ্জ ইকুয়েডরের গালাপাগোস প্রদেশের অন্তর্গত এবং দেশটির জাতীয় পার্ক সিস্টেমের অংশ।
এই দ্বীপপুঞ্জে প্রচুর বিরল প্রজাতির প্রাণী আছে, যা পৃথিবীর আর কোথাও দেখা যায় না। দ্বীপপুঞ্জটি এর অনন্য জীববৈচিত্র্যের কারণে ইউনেস্কোর বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী স্থান হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে।
বিবর্তন তত্ত্বের জনক চার্লস ডারউইন এই দ্বীপ ভ্রমণ করেছিলেন। ডারউইনের ভ্রমণই মূলত গালাপাগোসকে বিখ্যাত করেছে। কারণ এখানকার বৈচিত্র্যময় বিরল প্রজাতিগুলো নিবিড় পর্যবেক্ষণের মাধ্যমেই ডারউইন প্রথমবারের মতো বিবর্তনের পক্ষে প্রমাণ পেতে শুরু করেন। এখানকার অনেকগুলো প্রজাতি ডারউইনের প্রাকৃতিক নির্বাচন তত্ত্বের পক্ষে প্রমাণ হিসেবে কাজ করেছে।
এর মধ্যে অন্যতম কচ্ছপ। সরীসৃপ জাতীয় প্রাণী কচ্ছপকে প্রাকৃতিক প্রকৌশলীও বলা হয়। গ্যালাপাগোস দ্বীপপুঞ্জে কচ্ছপের একটি বাহিনী পরিবেশগত ভারসাম্য করতে সাহায্য করছে। এই দ্বীপের বিশাল আকৃতির কচ্ছপগুলো সামুদ্রিক দিবাচর পাখি আলব্যাট্রসের চলার পথ পরিষ্কার করে।
স্প্যানিশ নদীর তীরে অবস্থিত এস্পানোলা (Española) দ্বীপে মানুষের আগমনের আগে প্রায় ৮ হাজার কচ্ছপ ছিল। ১৮ শতকে জলদস্যুরা এস্পানোলা ও প্রতিবেশী দ্বীপগুলো দখল করে। তারা খাবারের চাহিদা পূরণের জন্য কচ্ছপ ও তিমির উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ে। ফলে কমতে থাকে এই দ্বীপের কচ্ছপের সংখ্যা। এখান থেকে যাওয়ার সময় তারা এই দ্বীপগুলোতে কিছু ছাগল রেখে যায়। ছাগলের সংখ্যা অনেক বেড়ে গেলে সেখানকার গাছপালা শেষ হয়ে যায়।
ফলে ১৯৭০ এর দশকের মধ্যে তৃণভোজী প্রাণী কচ্ছপের আদিম আবাসস্থল প্রায় ধ্বংস হয়ে যায়। এ সময় এস্পানোলায় কচ্ছপের বাস্তুতন্ত্র পুনরুদ্ধার করতে সহায়তা করে এই দ্বীপপুঞ্জের সবচেয়ে জনপ্রিয় কচ্ছপ ডিয়েগো। এস্পানোলায় ডিয়েগোর সর্বশেষ ১৪টি কচ্ছপের মধ্যে ১২টি নারী ও দুটি পুরুষ কচ্ছপ ছিল।
১৯৬৪ থেকে ১৯৭৪ সালের মধ্যে এদেরকে বংশবিস্তার কর্মসূচির জন্য সান্তা ক্রুজে ডারউইন রিসার্চ স্টেশনে নিয়ে আসা হয়। পরে সান ডিয়েগো চিড়িয়াখানা থেকে উদ্ধার করা ডিয়েগোকেও এদের সাথে যুক্ত করা হয়। ডিয়েগো পরবর্তীতে শত শত কচ্ছপের বাবা হয়ে ওঠে এবং এই বিপন্ন প্রজাতিকে রক্ষায় মূল ভূমিকা পালন করে। ২০২০ সালে, তার জন্মস্থানে অবসরে জীবন কাটাতে ফিরে আসার আগ পর্যন্ত সে এই কাজে সাহায্য করে।
এক দশকেরও বেশি সময় ধরে গ্যালাপাগোস দ্বীপপুঞ্জে কচ্ছপের বাস্তুশাস্ত্র অধ্যয়ন করা মার্কিন ভূতাত্ত্বিক জরিপ ও ভার্জিনিয়া টেকের সংরক্ষণ জীববিজ্ঞানী এলিজাবেথ হান্টার বলেন, কচ্ছপের গুরুত্বপূর্ণ বাস্তুতন্ত্র গঠনের বৈশিষ্ট্য রয়েছে। তৃণভোজী এই প্রাণী হারিয়ে গেলে সেখানে জন্মানো আগাছা, অন্যান্য প্রজাতি ও তাদের আবাসস্থলে বিরুপ প্রভাব ফেলবে।
তিনি বলেন, ১৮৩৫ সালে চার্লস ডারউইন যখন গ্যালাপাগোস দ্বীপপুঞ্জ পরিদর্শন করেন তখন তিনি উচ্চভূমি থেকে নিচের দিকে একটি চলার পথ দেখতে পান। যা উচ্চভূমি থেকে নিম্নভূমিতে কচ্ছপের চলাচলের জন্য তৈরী হয়েছে।
এস্পানোলায় কচ্ছপগুলো ঐতিহাসিকভাবে আলব্যাট্রসের চলার পথ এবং বাসা বানানোর জায়গা পরিষ্কার করে থাকে। এর ফলে আলব্যাট্রস একচেটিয়াভাবে বংশবৃদ্ধি করতে পারে।
হান্টার বলেন, ‘আলব্যাট্রসের ২ মিটার লম্বা বিশাল ডানা রয়েছে। এরা ওড়ার জন্য প্রথমে দৌড় শুরু করে। এর জন্য তাদের প্রয়োজন হয় খোলা জায়গার। কচ্ছপগুলো আলব্যাট্রসের সেই খোলা জায়গা (ল্যান্ডিং স্ট্রিপ) তৈরি করে দেয়।’
হান্টার বলেন, কচ্ছপের দৈনন্দিন কার্যক্রম প্রাকৃতিক চক্রকে উৎসাহিত করে। একটি কচ্ছপ প্রতি বছর শত শত কিলোগ্রাম গাছপালা খেতে পারে। আর যেসব খেতে পারে না সেগুলো পদদলিত করে। গতিশীল একটি দৈত্যাকার কচ্ছপ মূলত একটি বুলডোজার। যা তার চলার পথের সমস্ত কিছুকে পথ থেকে সরিয়ে দেয়। এর মাধ্যমে কচ্ছপগুলো সেখানকার জীববৈচিত্র্যকে সমৃদ্ধ করে।
এস্পানোলায় কচ্ছপের ৫০ বছরের প্রজনন কর্মসূচির আওয়ায় বর্তমানে কচ্ছপের সংখ্যা তিন হাজার। ২০২৩ সালের এক গবেষণায় দেখা গেছে, এই দ্বীপে কাঠের গাছপালা ধীরে ধীরে হ্রাস পাচ্ছে এবং ঘাস-বৃক্ষ জাতীয় উদ্ভিদের মিশ্রণে তৈরি বাস্তুতন্ত্র সাভানা ফিরে আসছে। যা সম্ভব হচ্ছে কচ্ছপের কারণে।
কচ্ছপ স্থলজ প্রাণী হওয়া সত্ত্বেও গ্যালাপাগোসে কচ্ছপের জলের প্রতি রয়েছে অগভীর ভালবাসা। দুই ডজন বা তারও অধিক কচ্ছপ একসঙ্গে একটি কর্দমাক্ত পুকুরে ভিজতে পারে। পানিতে এরা দুই পা দিয়ে প্যাডেলিং করে।
যখন একটি কচ্ছপ ঠাণ্ডা হওয়ার জন্য পুকুরে নামে, তখন এটি শরীরে করে মাটি নিয়ে যায়। কচ্ছপ পানিতে মলত্যাগ করে, যার ফলে পানি সার সমৃদ্ধ হয় এবং পানিতে অক্সিজেনের মাত্রা বৃদ্ধি করে। যা উদ্ভিদ ও পোকামাকড়ের জন্য একটি পুষ্টিসমৃদ্ধ জলজ পরিবেশ তৈরি হয়।
এক সমীক্ষা অনুসারে কচ্ছপ বীজ বিচ্ছুরণকারী একটি প্রাণী। এরা দুই সপ্তাহে ১০ কিমি পর্যন্ত হাঁটতে পারে। হাটার পথে তারা মলত্যাগের মাধ্যমে হাজার হাজার বীজ ছড়িয়ে দেয়।
বিশ্বের অনেক জায়গায় কচ্ছপ পাওয়া যায় এবং বিভিন্ন জায়গায় ভিন্ন ভিন্ন উপায়ে এরা ইকোসিস্টেম ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে কাজ করে। উত্তর আমেরিকায়, গোফার কচ্ছপ ১২ মিটার পর্যন্ত লম্বা গর্ত খুঁড়তে পারে। যা ৩৫০ টির মতো অন্যান্য প্রজাতির প্রাণী ব্যবহার করে থাকে। এরমধ্যে রয়েছে বরোজিং পেঁচা, ফ্লোরিডা মাউস ও ইস্টার্ন ইন্ডিগো সাপ।
মরিশাসের প্রধান দ্বীপের ইবোনি ফরেস্ট রিজার্ভে অ্যালডাব্রা অ্যাটল থেকে বিশালাকার দুটি বিলুপ্তপ্রায় প্রজাতির কচ্ছপ আনা হয়েছে। যাতে এরা ক্ষতিকর ঘাস খায় এবং দেশীয় গাছপালা বৃদ্ধিতে সহায়তা করে।
রিজার্ভ পরিচালনাকারী সংরক্ষণ জীববিজ্ঞানী ক্রিস্টিন গ্রিফিথস বলেন, আমরা বনভূমিতে একটি চারণ কার্যক্রমের (ইকোসিস্টেম) অভাববোধ করছিলাম। স্বাভাবিকভাবেই কচ্ছপ খোলা জায়গা তৈরি করে, আমরা চাই এরা এ দ্বীপে আগাছা কম রাখুক যেন রোপণ করা গাছগুলো বড় হতে পারে।
মরিশাস উপকূলের দুটি দ্বীপে কচ্ছপ বন সম্প্রসারণে সহায়তা করছে। ভারত মহাসাগরের দ্বীপগুলোতেও কচ্ছপ বনায়নের অংশীদার হচ্ছে। এই দ্বীপগুলোতে দৈত্যাকার কচ্ছপগুলো পুনরুদ্ধার করার সঙ্গে সঙ্গে উদ্ভিদ ও প্রকৃতিতে বিরাট পরিবর্তন হতে শুরু করেছে। যদিও এই জাতীয় প্রকল্পের সাফল্য পরিমাপ করতে কয়েক দশক পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয়। একইভাবে এস্পানোলা দ্বীপেও কচ্ছপের মাধ্যমে ইতিবাচক পরিবর্তন দেখতে গবেষকদের এক দশক পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হতে পারে। সূত্র: বিবিসি
ভাষান্তর: ইসরাত জাহান চৈতী