‘ওগো, নির্জনে বকুল শাখায়
দোলায় কে আজি দুলিছে, দোদুল দুলিছে?/
ঝরকে ঝরকে ঝরিছে বকুল/
আঁচল আকাশে হতেছে আকুল/
উড়িয়া অলক ঢাকিছে পলক-/কবরী খসিয়া খুলিছে।…’ কবিগুরু রবীন্দ্রনাথের অন্যতম প্রিয় ফুল ছিল বকুল। শিলাইদহের কুঠিবাড়িতে নিজের লাগানো বকুলগাছের ছায়ায় বসে কবি রচনা করেছেন এমন পঙ্ক্তিমালা। তবে এবারে তীব্র তাপপ্রবাহে এই কংক্রিটের ঢাকা নগরীতেও তেমনি বকুল ছায়ায় মানুষের পরান জুড়ায় কোথাও কোথাও।
দুপুরের রোদ তির্যকভাবে পড়ছে শহরের বুকে। মধ্যগগনে থাকা সূর্যের তেজ যেন ইটপাথরের নগরীর বুকে ছিটাচ্ছে আগুনের হলকা। মাথার ওপর তপ্ত রোদ উপেক্ষা করে যাদের ঘরের বাইরে বের হতে হয়েছে, গরম তাদের ছাড় দিচ্ছে না একচুলও। তবুও জীবিকার টানে ও জীবনের টানে ছুটে চলা মানুষের। এই ব্যস্ত রাজধানীর অন্যতম একটি জনবহুল এলাকা মানিক মিয়া অ্যাভিনিউ। এ এলাকাতেই ২১৫ একর জায়গাজুড়ে সগর্বে দাঁড়িয়ে আছে পৃথিবীর দৃষ্টিনন্দন স্থাপত্যকীর্তির একটি, জাতীয় সংসদ ভবন। এই ভবনের সীমানার সামনে দক্ষিণ চত্বরে প্রশস্ত ফুটপাতের পাশ ঘেঁষে শোভা বিলাচ্ছে গোড়ায় শানবাঁধানো সারি সারি বকুলের গাছ। তবে শুধু শোভাবর্ধনই নয়, গাছগুলো যেন তপ্ত নগরীতে মানুষের জন্য এক টুকরো শীতল আশ্রয় হয়ে দাঁড়িয়েছে।
উত্তপ্ত রোদে মানুষকে যেন প্রশান্তি জোগায় সার দেওয়া এই ছায়াবৃক্ষ। শুধু কি ছায়া! আকারে বড় ঝোপালো এই গাছগুলোতে সুখে সংসার বেঁধেছে কত পাখি। দিনভর কিচিরমিচিরে পথিককে শোনায় তাদের আনন্দের সুর। কত ক্লান্ত পথিকের সুখ-দুঃখের আড্ডা, কত মানুষের প্রেম-বিচ্ছেদের সাক্ষী হয়ে ঠাঁয় দাঁড়িয়ে আছে গাছগুলো। কেউ এসে গোড়ায় বসলেই টুপ টুপ করে শুভ্র ফুল ঝরিয়ে শুভেচ্ছা জানায়। চড়া রোদে সংসদ ভবনের সামনের ফুটপাত দিয়ে কেউ হেঁটে যাচ্ছেন আর এই বকুলতলায় একটু বসে জিরিয়ে নেননি, এমন মানুষ হয়তো পাওয়া ভার।
শনিবার (২৭ এপ্রিল) দুপুরে এই সারি সারি গাছের একটির নিচে দেখা পাওয়া যায় মকবুল মিঞার। প্রচণ্ড রোদে সারা সকাল মানিক মিয়া অ্যাভিনিউর সিগন্যালে ভিক্ষা করে করে ক্লান্ত দেহ তার। চলাচলে অক্ষম সত্তরোর্ধ্ব এই প্রতিবন্ধী মানুষটির বাহন হুইলচেয়ারের মতো করে বানিয়ে নেওয়া চলাচলের উপযোগী একটি কাঠের ভ্যান। বকুলতলার ছায়ায় এই ভ্যানের ওপর শুয়েই বিশ্রাম নিচ্ছিলেন তিনি।
আলাপচারিতায় জানালেন, এই বকুলতলা তার শান্তির জায়গা। সারা দিন ভিক্ষা করে রোদের তাপে পোড়েন তিনি। দুপুরে খাওয়ার পর একটু বিশ্রাম নিতে আঁকুপাঁকু করে বয়সি শরীর। তবে ইটের শহরে এই তপ্ত রোদের ভেতর প্রশান্তি কোথায়! এই বকুলগাছের ছায়াই যেন তার প্রাণ জুড়িয়ে দেয়। গত সাত বছর ধরে এই রুটিনের কোনো হেরফের হয়নি তার। প্রতিদিনই তাতানো দুপুরে তাকে দেখা যায় সংসদ ভবনের সামনে বকুলগাছের ছায়ায়।
বকুলতলায় আরও দেখা পাওয়া যায় ক্লান্ত একদল দিনমজুরের। গাছের ছায়ায় গোল হয়ে বসে দুপুরের খাবার খাচ্ছিলেন পরিশ্রান্ত মানুষগুলো। খবরের কাগজকে তারা জানান, তীব্র গরম আর রোদে কাজ করে শরীর হাঁসফাঁস করে। তাই খাওয়ার জন্য যতটুকু সময় পান, সংসদ ভবনের সামনে ছায়া-বাতাসেঘেরা বকুলতলায় একটু বিশ্রাম নিতে আসেন। বকুলগাছের ছায়ায় একটু বসলেই যেন প্রাণ জুড়িয়ে যায়। সারা দিনের ক্লান্তি ঘুচে যায় কিছুক্ষণেই।
এই দলের একজন সদস্য লাইঞ্চু মিঞা বলেন, পুরো এলাকায় এই জায়গাটা যেন শান্তির জায়গা। আশেপাশে রোদের তীব্রতায় টেকা না গেলেও, এখানটায় এলে প্রাণ শীতল হয়ে যায়। তাই যতদিন এইখানে কাজ করছেন, প্রতিদিনই বিশ্রামের জন্য এই জায়গাটিকে বেছে নেন তারা।
গাছের ছায়ায় বসে থাকা কলেজছাত্র নাফিস হক খবরের কাগজকে জানান, ক্লাস শেষ করে এই পথ দিয়েই তিনি বাসায় যান প্রতিদিন। যাওয়ার পথে প্রতিদিনই এই বকুলতলায় কিছুটা সময় কাটিয়ে যান। বকুল ফুলের মিষ্টি গন্ধ, পাখির কলরব, সেই সঙ্গে গাছের শীতল ছায়ায় নিজের মতো কিছু সময় কাটানোটা বেশ উপভোগ করেন তিনি।
সংসদ ভবন এলাকায় ঘুরতে আসা ও এখানে জিরোতে আসা মানুষকে কেন্দ্র করে ফুটপাতের ওপর গড়ে উঠেছে নানা রকম অস্থায়ী দোকান। রোজই এখানে বিক্রি হচ্ছে চটপটি, ফুচকা, আমড়া, পেয়ারা, হাওয়াই মিঠাইসহ বিভিন্ন ধরনের খাবার। বিকেল-সন্ধ্যা-রাতে জমজমাট হয়ে ওঠে এই চত্বর।
দেখা মেলে ফ্লাক্সে করে চা বিক্রেতা ও চিপস বিক্রেতাদেরও। তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, বিকেলে ঘুরতে আসা মানুষের লক্ষণীয় ভিড় থাকলেও দুপুরে মানুষগুলো কড়া রোদ আর গরমে ক্লান্ত হয়েই বিশ্রাম নিতে আসেন এ বকুলতলায়। কড়া রোদেও বকুলগাছের ছায়ায় মোটামুটি শীতল থাকে এ এলাকা। শুধু মানুষই নয়, রাস্তার প্রাণীগুলোও প্রচণ্ড গরমে একটু শীতলতার খোঁজে বিশ্রাম নেয় এখানে। ক্লান্ত প্রাণের শীতল নিবিড় এক আশ্রয় যেন সংসদ ভবনের সামনের এই বকুলতলা।