বাংলাদেশে নিযুক্ত ফিলিস্তিনের রাষ্ট্রদূত ইউসুফ এস ওয়াই রামাদান। ৯ বছর ধরে এ দায়িত্ব পালন করছেন তিনি। বাংলাদেশ ও ফিলিস্তিনের মধ্যকার কূটনৈতিক সম্পর্ক অনন্য উচ্চতায় নিয়ে যাওয়ার নেপথ্যে তার অবদান অতুলনীয়। হামাস ও ইসরায়েলের মধ্যকার যুদ্ধ, ফিলিস্তিনের বর্তমান পরিস্থিতি, বিশ্বব্যাপী চলমান আন্দোলনসহ তার ব্যক্তিজীবন ও ফিলিস্তিনসংক্রান্ত নানা প্রসঙ্গ নিয়ে খবরের কাগজের সঙ্গে দীর্ঘ সময় কথা বলেন তিনি। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন মিরাজ রহমান ও রিয়াজ উদ্দীন। সঙ্গে ছিলেন রায়হান রাশেদ
খবরের কাগজ: প্রথমেই জানতে চাই, ফিলিস্তিনের বর্তমান পরিস্থিতি কী?
ইউসুফ রামাদান: ফিলিস্তিনের সর্বশেষ পরিস্থিতি হলো, কাতার ও মিসরের মধ্যস্থতায় যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব নিয়ে আলোচনা চলছে। প্রথমে ইসরায়েলের কাছে প্রস্তাব পাঠানো হলে তারা কিছু সংশোধনী দেয় এবং হামাস এ প্রস্তাবে সম্মতি জানায়। হামাসের সম্মতির বিষয়টি নেতানিয়াহুকে খুবই অবাক করেছে। কারণ, তিনি এমনটা শুনতে চাচ্ছিলেন না। নেতিবাচক কিছু শুনতে চেয়েছিলেন তিনি। তারা ভেবেছে, এ সংশোধনী হামাস প্রত্যাখ্যান করবে।
নেতানিয়াহুর হয়ে যারা কাজ করে, তারা তাকে বলেছে- এ প্রস্তাব হামাস মেনে নেবে না। কিন্তু হামাস শেষ মুহূর্তে চমক দেখিয়েছে, মেনে নিয়েছে। নেতানিয়াহু এবং তার সরকারের জন্য এটি অবাক করা খবর। কারণ তিনি যেকোনো উপায়ে, যেকোনো মূল্যে এ যুদ্ধ চালিয়ে যেতে চান। এ যুদ্ধের ধারাবাহিকতা ধরে রাখা তার জন্য অনেক গুরুত্বপূর্ণ। কারণ এর সঙ্গে তার ভাগ্য ও ভবিষ্যৎ জড়িত। যুদ্ধ বন্ধ হয়ে গেলে নেতানিয়াহুর ক্যারিয়ারও থমকে যাবে।
বিশ্বের প্রায় সব সচেতন মানুষ বিশ্বাস করে, এ যুদ্ধটা ইসরায়েলের নয়; নেতানিয়াহুর এবং তার সরকারের যুদ্ধ। যদিও বর্তমান সময়ের সবকিছু নেতানিয়াহুর স্বার্থের সঙ্গে সাংঘর্ষিক।
মিসর, কাতার, আমেরিকা এবং মধ্যপ্রাচ্যের বহু প্রভাবশালী দেশসহ ফিলিস্তিনিরা চাচ্ছেন, এবার অন্তত এ যুদ্ধটি বন্ধ হোক। কিন্তু নেতানিয়াহুর একগুঁয়েমির কারণে বিষয়টি থমকে আছে। নেতানিয়াহু জানিয়েছেন, ইসরায়েল একা লড়তে পারে। সুতরাং আমরা অপেক্ষা করছি সামনে কী ঘটে।
খবরের কাগজ: ফিলিস্তিনের সাধারণ মানুষের বর্তমান অবস্থা কেমন?
ইউসুফ রামাদান: ফিলিস্তিনের সাধারণ মানুষের বর্তমান পরিস্থিতি বর্ণনা করার মতো নেই। এ পরিস্থিতির সঠিক ব্যাখ্যা করা কারও পক্ষেই সম্ভব নয়। গাজার মানুষ পুরোপুরি দুর্দশাগ্রস্ত, এমনকি পশ্চিম তীরের মানুষও মারা হচ্ছে। হাজার হাজার মানুষকে হত্যা করা হয়েছে, যার মধ্যে বহু নারী ও শিশু রয়েছে। গাজার বর্তমান পরিস্থিতিটা আসলে অনুমান করা সম্ভব নয়, লাখ লাখ মানুষ অনাহারে দিন কাটাচ্ছে এবং আহত অবস্থায় কাতরাচ্ছে। গাজা ভূখণ্ডের ৭০ থেকে ৭৫ শতাংশ পুরোপুরি ধ্বংস হয়ে গেছে। অসংখ্য মানুষ গৃহহীন হয়ে এখন নিজ দেশেই শরণার্থী। এর ওপর খাবারের চরম সংকট বিরাজ করছে। গাজায় যে পরিমাণ খাবার প্রবেশ করছে, তাতে ২০ শতাংশ মানুষের চাহিদাও মিটছে না। ২০ শতাংশ মানুষের অপ্রতুল খাবার বণ্টিত হচ্ছে পুরো জনগোষ্ঠীর মধ্যে। ফলে তৈরি হচ্ছে তীব্র খাদ্যসংকট।
এর মানে এই নয় যে, বহির্বিশ্ব আমাদের সহযোগিতা করছে না। বাংলাদেশসহ অনেক দেশ খাবার ও ওষুধসহ বিভিন্ন জিনিস দিয়ে সহযোগিতা করছে। কিন্তু ইসরায়েল সেসব সামগ্রী ফিলিস্তিনে প্রবেশের অনুমতি দিচ্ছে না। ইন্টারনেট নেই, যোগাযোগের ব্যবস্থা নেই, খাদ্য ও পানি নেই, ওষুধ নেই। সব বিশ্ববিদ্যালয় ধ্বংস করে দেওয়া হয়েছে। মসজিদ, চার্চ ধ্বংস করা হয়েছে। হামলার কারণে অকার্যকর হয়ে গেছে সব হাসপাতাল ও ক্লিনিক। কারও কাছে প্রয়োজনীয় ওষুধও নেই। ছোট একটি উদাহরণ দিই, কোথাও কোনো অ্যানেস্থেসিয়ার ব্যবস্থা নেই। অ্যানেস্থেসিয়া ছাড়া সব ধরনের অপারেশন করা হচ্ছে। ১০ বছরের একটি বালকের পা কেটে ফেলা হয়েছে অ্যানেস্থেসিয়া ছাড়াই। এবার আপনি চিন্তা করে দেখুন, সেখানকার মানুষ কেমন জীবন যাপন করছে!
খবরের কাগজ: যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান কী?
ইউসুফ রামাদান: দেখুন, রাজনীতিতে সবাই নিজ নিজ স্বার্থের কথা চিন্তা করে কাজ করে। যুদ্ধের প্রথম দিন থেকেই যুক্তরাষ্ট্রের আগ্রহ ছিল যেকোনো উপায়ে, যেকোনো মূল্যে ইসরায়েলকে সমর্থন করা। ‘ইসরায়েলেরও তাকে রক্ষা করার অধিকার রয়েছে’- এমন নীতির পক্ষে যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান। আমরা অনেকেই জানি, আমেরিকায় জায়োনিস্ট লবি (কট্টরপন্থি ইহুদিদের প্রভাব ও গ্রুপিং) খুবই শক্তিশালী এবং কার্যকর। তাদের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করার মতো অন্য কোনো লবি আমেরিকায় নেই। এটা যেমন বর্তমানে আছে, তেমন অতীতেও ছিল। ফিলিস্তিন-ইসরায়েল যুদ্ধের শুরু (১৯৪৮ সাল) থেকে, আমেরিকার জায়োনিস্ট লবি ইসরায়েলের পক্ষে কাজ করছে। দেখুন, আমেরিকায় ৬০-৬৫টি দেশের ৩০-৪০ লাখ মুসলমান রয়েছে। তারা সবাই আলাদা দলে, কমিউনিটিতে বিভক্ত। আলাদা স্থান ও সমাজে বসবাস করে। তাদের মধ্যে শক্তিশালী ঐক্য নেই। আর এই অনৈক্য ভিন্ন লবিকে আমেরিকায় যেভাবে খুশি সেভাবে প্রভাব বিস্তার করার সুযোগ করে দিচ্ছে।
এ ছাড়া জায়োনিস্ট লবির আর্থিক সামর্থ্য অনেক বেশি এবং গণমাধ্যমেও তারা খুবই সক্রিয়। ফলে জায়োনিস্ট লবি আমেরিকায় খুবই শক্তিশালী। হোয়াইট হাউস, সিনেট, কংগ্রেসসহ আমেরিকার সর্বত্র এদের বিচরণ। আমি এটাকে ‘আমেরিকায় ছড়িয়ে পড়া ক্যানসার’ বলে থাকি। এ লবি আমেরিকার সরকারের মাধ্যমে মানুষের স্বাধীনতাকে বাজেয়াপ্ত করার মতো প্রভাব বিস্তার করার ক্ষমতা রাখে। পরিস্থিতি এখন এমন হয়ে দাঁড়িয়েছে, আপনি আমেরিকান হলে আমেরিকার সবকিছু নিয়ে সমালোচনা করতে পারবেন, দেশটির প্রেসিডেন্ট এবং কংগ্রেস সদস্যদের নিয়েও কথা বলতে পারবেন, কিন্তু কোনোভাবেই ইসরায়েলের সমালোচনা করতে পারবেন না। এভাবে আপনার কাছ থেকে স্বাধীনতা কেড়ে নেওয়া হয়েছে। যেটা নিয়ে আমেরিকারও কিছু করার নেই। ইসরায়েলের সমালোচনা করলে তারা আপনাকে অ্যান্টিসিমেটিকের তকমা দিয়ে কারাগারে পাঠিয়ে দেবে। কিন্তু প্রেসিডেন্টের সমালোচনা করলে কিছুই হবে না।
বর্তমানে পরিস্থিতি কিছুটা পাল্টেছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এখন খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। ফিলিস্তিনের চৌকস কিছু সাংবাদিক সবকিছু রেকর্ড করছেন এবং বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে দিচ্ছেন। এ কাজ করতে গিয়ে তাদের অনেকেই জীবন হারিয়েছেন, অনেকে পরিবার হারিয়েছেন। তবু তারা কাজটি চালিয়ে যাচ্ছেন। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের প্রভাবে আমেরিকায় ছাত্র আন্দোলন শুরু হয়েছে।
খবরের কাগজ: আপনার কথার সূত্র ধরে জানতে চাই, আমেরিকার ছাত্র আন্দোলনকে ফিলিস্তিন কীভাবে দেখে?
ইউসুফ রামাদান: এই বিপ্লব, ছাত্রদের এই আন্দোলন আমেরিকার প্রশাসনকে কঠিন পরিস্থিতির মুখোমুখি দাঁড় করিয়েছে। তাদের সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময় এসেছে, কার পক্ষে অবস্থান নেবে তারা। আমেরিকার জনসাধারণের স্বার্থ দেখবে নাকি ইসরায়েলের স্বার্থের পক্ষে অবস্থান নেবে। আর এ কারণে আমেরিকা এখন জোরালোভাবে যুদ্ধবিরতি চাচ্ছে। অথচ তারা ফিলিস্তিনের পূর্ণ সদস্যপদের দাবিতে আলজেরিয়ার প্রস্তাবে ভেটো দেওয়াসহ তিনবার যুদ্ধবিরতিতে ভেটো দিয়েছে। ছয় মাসে তারা চারবার ভেটো দিয়েছিল। আর এটাই জায়োনিস্ট লবিস্টদের অভূতপূর্ব ক্ষমতা। এভাবেই নেতানিয়াহু সমর্থকরা জো বাইডেনকে প্রতিবন্ধকতায় ফেলে।
পরিস্থিতি এখন কিছুটা পাল্টেছে। বাইডেন বুঝতে পারছেন, বারবার একই পথে যাওয়াটা তার দেশ, জনগণ ও প্রশাসনের স্বার্থের বিপক্ষে যাচ্ছে। তিনি বিকল্প ভাবতে শুরু করেছেন। তিনি ইসরায়েলকে অস্ত্র ও গোলাবারুদ না দেওয়ার কথাও বলছেন। এর মানে এই নয় যে, তিনি গাজার মানুষকে ভালোবাসেন কিংবা তাদের ব্যাপারে উদ্বিগ্ন; আসলে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ইসরায়েলবিরোধী আন্দোলনের কারণে তিনি এমনটা করতে বাধ্য হচ্ছেন। আমরা আশাবাদী। কারণ ইসরায়েল বর্তমানে সারা বিশ্ব থেকে বিচ্ছিন্ন। হামাসের প্রস্তুাব মেনে নেওয়াটা ইসরায়েলকে আরও কঠিন পরিস্থিতিতে ফেলে দিয়েছে। এখন হয়তো তারা চরমভাবে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবে, নয়তো ভিন্ন কিছু চিন্তা করবে।
খবরের কাগজ: বিশ্বের বিভিন্ন মুসলিম দেশ, বিশেষত আরব বিশ্বের ভূমিকায় কি আপনারা সন্তুষ্ট?
ইউসুফ রামাদান: আরব বিশ্বের ভূমিকা কিংবা সাধারণ মুসলিম দেশের ভূমিকা নিয়ে কিছুটা সমস্যা আছে এবং সেটা যে কেবল ফিলিস্তিন ইস্যুতে সীমাবদ্ধ, বিষয়টা কিন্তু এমন নয়। বিভিন্ন ইস্যুতে তাদের ভূমিকা নিয়ে সমস্যা আছে। অনেক ইস্যুতেই যথার্থভাবে তারা পাশে দাঁড়াচ্ছে না। উদাহরণ হিসেবে রোহিঙ্গা সংকট নিয়ে কথা বলা যায়। ফিলিস্তিন ইস্যুর তুলনায় এটা অনেক অনেক সহজ ইস্যু। এখানে কি মুসলিম বিশ্ব কিংবা আরব বিশ্ব কার্যকর ভূমিকা পালন করতে সক্ষম হয়েছে? তারা এখনো উদ্বাস্তু এবং বাংলাদেশ একমাত্র দেশ যারা এটি বহন করছে এবং দুর্ভোগ পোহাচ্ছে। ফিলিস্তিন ইস্যুতে তারা (আরব বিশ্ব) অবশ্যই তাদের মতো করে ভূমিকা পালন করছে। তারা কি পর্যাপ্ত ভূমিকা পালন করছে? না, সেটা তারা করছে না। তারা কাজ করছে, কিন্তু তা যথেষ্ট নয়।
খবরের কাগজ: বাংলাদেশ-আমেরিকাসহ বিভন্ন দেশে আন্দোলন হচ্ছে, একে আপনি কীভাবে দেখছেন?
ইউসুফ রামাদান: এটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি মুহূর্ত। ফিলিস্তিনি মানুষের জন্য এটি গুরুত্বপূর্ণ সাপোর্ট। এমনটা এর আগে ঘটেনি। একেবারেই নতুন কিছু হচ্ছে। এটা ফিলিস্তিনি জনগণের প্রাপ্য। কারণ তারা যে ত্যাগ স্বীকার করেছে, তার মূল্যটা বেশ ভারি। যে পরিমাণ ধ্বংসযজ্ঞ, দুর্দশা ও নির্যাতন ফিলিস্তিনের মানুষ সহ্য করছে, তারা এমন একটি সংহতি পাওয়ার প্রকৃত হকদার।
গোটা বিশ্বের মানুষ এখন ফিলিস্তিনের পক্ষে একাত্মতা ঘোষণা করছে। তারা বুঝতে পেরেছে, ইসরায়েলের এ হামলা শুধু ফিলিস্তিনের বিপক্ষে নয়, এটা মানবতা ও ন্যায়ের বিপক্ষে এবং এ কারণে মানবতা কলঙ্কিত হচ্ছে।
আমেরিকার মানুষ তাদের সরকারকে প্রশ্ন করছে, ‘কোথায় তোমার মানবতা, কোথায় তোমার নীতি-আদর্শ, কোথায় তোমার নৈতিকতা ও মোরালিটি? তোমরা আমাদের যেসব নীতি ও মানবতার কথা বলেছ, তা কি শুধু নির্দিষ্ট কিছু মানুষের জন্য? আমরা কি সেসব নীতির পক্ষে অবস্থান নেব?’ সুতরাং এটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি আন্দোলন এবং এমন কাজ চালু রাখতে আমরা তাদের আরও উৎসাহিত করি।
বাংলাদেশের জনসাধারণকেও ধন্যবাদ জানাচ্ছি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রসহ বাংলাদেশের জনগণ যে আন্দোলন-সংহতি বাস্তবায়ন করছে, তা খুব দারুণ। আশা করি, বাংলাদেশের অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ও একই কাজ করবে। ফিলিস্তিনি মানুষের সমর্থনে এগিয়ে আসবে এবং আশা করি, বিশ্বের বিভিন্ন দেশেও এ সংহতি আন্দোলন ছড়িয়ে পড়বে।
খবরের কাগজ: বাংলাদেশের সঙ্গে ফিলিস্তিনের কূটনৈতিক সম্পর্ক কেমন?
ইউসুফ রামাদান: বাংলাদেশ ও ফিলিস্তিনের কূটনৈতিক সম্পর্ক অসাধারণ। এ সম্পর্ক খুবই গভীর ও আন্তরিক। বাংলাদেশ বিশ্বের অন্যতম শীর্ষ দেশ, যাদের সরকার ও জনগণ যেকোনো ইস্যুতে ব্যাপকভাবে ফিলিস্তিনকে সমর্থন করে থাকে। গত ৯ বছর ধরে আমি বাংলাদেশে বসবাস করছি, বাংলাদেশের পক্ষ থেকে যে পরিমাণ এবং যে মানের সাহায্য-সহযোগিতা ফিলিস্তিন গ্রহণ করেছে, আমি তা স্বচক্ষে দেখেছি এবং আমি এর প্রধান সাক্ষী।
১৯৭১ সালে বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর ইসরায়েলের পররাষ্ট্রমন্ত্রী বাংলাদেশকে একটি স্বীকৃতি পত্র পাঠিয়েছিল। যদিও সে সময়ে বাংলাদেশের জন্য এ স্বীকৃতির প্রয়োজন ছিল, কিন্তু বাংলাদেশ তা প্রত্যাখ্যান করেছিল। অথচ বাংলাদেশের সঙ্গে তখন ফিলিস্তিনের সম্পর্ক তৈরি হয়নি। বাংলাদেশ ফিলিস্তিনের অকৃত্রিম বন্ধু।
বর্তমানে সবাই পরিষ্কারভাবে বুঝতে সক্ষম হয়েছেন, ফিলিস্তিনের যুদ্ধের বিষয়টি কেবল ইসরায়েল ও ফিলিস্তিনের মধ্যে সীমাবন্ধ নেই; বরং এটা ভালো ও মন্দের মধ্যকার যুদ্ধে পরিণত হয়েছে। বাংলাদেশ তাদের স্বাধীনতার প্রথম দিন থেকেই ভালোর পক্ষে থাকার সঠিক সিদ্ধান্ত নিয়ে ফিলিস্তিনের পাশে ছিল, আছে এবং আশা করি থাকবে।
খবরের কাগজ: বাংলাদেশ থেকে সরকারি ও বেসরকারিভাবে ফিলিস্তিনে যেসব সহযোগিতা পাঠানো হচ্ছে, আদৌ কি তা সেখানে পৌঁছে?
ইউসুফ রামাদান: বাংলাদেশর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশনায় আমরা প্রথমবার বিপুল পরিমাণ ওষুধ এবং পরবর্তী সময়ে শুকনো খাবার সাহায্য হিসেবে গ্রহণ করেছি এবং কায়রোয় থাকা বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত তা গ্রহণ করে রেড ক্রিসেন্টের মাধ্যমে ফিলিস্তিনে পৌঁছানোর ব্যবস্থা করেছেন। বাংলাদেশের এ সাহায্য ফিলিস্তিনের মানুষের হৃদয় ছুঁয়ে গেছে। সবাই বাংলাদেশের প্রশংসা করেছেন। এগুলো হস্তান্তর করা, পৌঁছানো, বিতরণ, রান্না করা এবং খাওয়ার অনেক ভিডিও রয়েছে। বাংলাদেশের পতাকা পেছনে রেখে সাহায্য গ্রহণ করার সময় শিশুরা বাংলাদেশকে ধন্যবাদ জানাচ্ছে- এমন ভিডিও রয়েছে।
এ ছাড়া বেসরকারিভাবেও বহু মানুষ এবং অনেক সংগঠনের কাছ থেকে আমরা বিপুল সাহায্য-সহযোগিতা পাচ্ছি। গত রমজানেও আমরা সরকারি ও বেসরকারিভাবে ইফতারের সহযোগিতা গ্রহণ করেছি এবং যথাযথভাবে তা ফিলিস্তিনে পৌঁছিয়েছি। তবে সমস্যা হচ্ছে, যে পরিমাণ সাহায্য পাচ্ছি, সব পৌঁছাতে কষ্ট হচ্ছে। কারণ ইসরায়েল ফিলিস্তিনে কোনো কিছু প্রবেশ করাতে প্রচণ্ড বাধার সৃষ্টি করছে।
গাজায় ‘বাংলাদেশ অনাথ আশ্রম’ নামে একটি আশ্রম প্রতিষ্ঠার পরিকল্পনা চলমান রয়েছে। বাংলাদেশ ফিলিস্তিনের পাশে ছিল, আছে এবং থাকবে বলে আশা করি। আরও একটি খুশির সংবাদ হলো, বাংলাদেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় ফিলিস্তিনিদের ফুল ফ্রি শিক্ষাবৃত্তি প্রদানে সম্মত হয়েছে, যেটা ফিলিস্তিনের জন্য অনেক বড় সুসংবাদ। অনেক বড় সহযোগিতা। প্রত্যাশার চেয়ে অনেক বেশি সাড়া পেয়েছি আমরা। এ জন্য আমি বাংলাদেশের শিক্ষামন্ত্রীসহ সংশ্লিষ্ট সব বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে ধন্যবাদ জানাচ্ছি।
খবরের কাগজ: বাংলাদেশের জনসাধারণের কাছে ফিলিস্তিনের প্রত্যাশা কী?
ইউসুফ রামাদান: এটা খুবই পরিষ্কার। তারা অতীতে যা করেছেন, বর্তমানে যা করছেন- এটাকে অব্যাহত রাখুন। হাল ছেড়ে দেবেন না। এ দেশের জনগণ যা করছে, তা অভূতপূর্ব। ফিলিস্তিন একে মূল্যায়ন করে। ফিলিস্তিনের ইতিহাসের পাতায় এসব সাহায্য-সহযোগিতার কথা খচিত থাকবে। আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম তা পড়বে এবং জানবে। ফিলিস্তিন মুক্ত হওয়ার পর, আশা করছি আমরা একদিন বাংলাদেশের এ ভালোবাসার মর্যাদাপূর্ণ প্রতিদান দেব।
খবরের কাগজ: গাজায় ইসরায়েলের হামলার ক্ষতির প্রভাব কী?
ইউসুফ রামাদান: এ হামলার ক্ষতির প্রভাব অবর্ণনীয়। আমি আগেই বলেছি, গাজার প্রায় ৭৫ শতাংশ এলাকা একেবারে ধ্বংস হয়ে গেছে। কীভাবে আমরা এগুলো পুনঃপ্রতিষ্ঠা করব? এগুলো পুনর্নির্মাণ করতে বহু অর্থ প্রয়োজন। কিন্তু ফিলিস্তিনের সে সামর্থ্য নেই। ফিলিস্তিনের আর্থিক সক্ষমতা এমনিতেই কম। এ হামলা ও যুদ্ধের ফলে তারা আরও পঙ্গু হয়ে গেছে।
ফিলিস্তিনের জন্য সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হলো, ধ্বংস হওয়া জনপদের পুনঃপ্রতিষ্ঠা। ফিলিস্তিনের যেহেতু এ সামর্থ্য নেই, সুতরাং সারা বিশ্বের সহযোগিতা প্রয়োজন।
এ যুদ্ধ বন্ধ না হওয়া পর্যন্ত এ জনপদ পুনঃপ্রতিষ্ঠায় কেউ সহযোগিতাও করবে না। কারণ আজকে নির্মাণ করলে কালকে যে আবার ইসরায়েল তা ধ্বংস করে দেবে না, তার কোনো গ্যারান্টি নেই।
খবরের কাগজ: গাজায় আপনার কি কোনো আত্মীয় রয়েছে?
ইউসুফ রামাদান: সরাসরি রক্তের সম্পর্কের কোনো আত্মীয় নেই। তবে আমার একজন জামাতা রয়েছে সেখানে। যুদ্ধের প্রথম তিন সপ্তাহে সে তার পরিবারের ৫৯ সদস্যকে হারিয়েছে। আর আমি গাজার অধিবাসীও নই। আমি ফিলিস্তিনের অন্য অংশের অধিবাসী। ফলে গাজায় আমার সরাসরি কোনো আত্মীয় নেই। তবে আমি বিশ্বাস করি, গাজায় যত ফিলিস্তিনি মৃত্যুবরণ করেছেন এবং বর্তমানে যত মানুষ জীবিত রয়েছেন, সবাই আমার আত্মীয়। তাদের কেউ আমার মা, কেউ বাবা, কেউ আমার বোন, কেউ ভাই, কেউবা ছেলে কিংবা মেয়ে। তারা সবাই আমার পরিবারের সদস্য।
খবরের কাগজ: ইসরায়েল কেন ফিলিস্তিনে হামলা চালাচ্ছে? এখানে কি কোনো ধর্মীয় বা রাজনৈতিক কারণ জড়িত? মূলত কি কারণে তারা হামলা চালাচ্ছে বা যুদ্ধ করছে?
ইউসুফ রামাদান: তাদের যুদ্ধের মূল উদ্দেশ্য পরিষ্কার। লুকানোর কিছু নেই। ৭৬ বছর ধরে যার জন্য তারা যুদ্ধ চালাচ্ছে, সেটা হলো- ফিলিস্তিনের পুরো ভূখণ্ড তারা দখলে নিতে চায়। পুরো ভূমি দখল করার পর তারা ‘বৃহত্তর ইসরায়েল’ গঠন করতে চায়। অন্য সব কারণ গৌণ। এটাই মূল বা প্রধান কারণ। নেতানিয়াহুর মতো কিছু কট্টরপন্থি ইহুদি এ মিশন বাস্তবায়নে জড়িত। এই মিশনের অংশ হিসেবে এখন তারা যেকোনো মূল্যে গাজার জনসাধরণকে ভূমিছাড়া করতে চাচ্ছে। গাজাকে খালি করে এটা দখল করবে এবং তাদের ‘বৃহত্তম ইসরায়েল’ প্রতিষ্ঠার একটি ধাপ সম্পন্ন করবে, এটাই তাদের উদ্দেশ্য। ফিলিস্তিনি জনগণ তাদের এ মিশন কোনোভাবেই বাস্তবায়ন করতে দেবে না। তারা তাদের জন্মভূমি রক্ষায় আমরণ লড়াই করে যাবে। ফিলিস্তিনি মানুষের দেশপ্রেম ও সাহসিকতা বিশ্বের মানুষকে বিস্মিত করেছে।
পৃথিবীর ইতিহাসে কোনো জাতি ফিলিস্তিনিদের মতো ত্যাগ স্বীকার করেনি। ফিলিস্তিনিরা বিশ্বাস করে, তারা স্বাধীনভাবে এখানে জন্মেছে এবং স্বাধীনভাবে বসবাস করার অধিকার তাদের আছে। কেউ তাদের ভাগ্য নির্ধারণের অধিকার রাখে না। তারা সৃষ্টিকর্তার দাস। নেতানিয়াহু, বাইডেন কিংবা অন্য কারও দাসত্ব করার জন্য তাদের জন্ম হয়নি।
খবরের কাগজ: অনেকে বলেন, ‘হামাস ও ফাতাহ গ্রুপে বিভক্ত থাকা এবং শক্তিশালী বিশ্বস্ত নেতা না থাকার কারণে ফিলিস্তিনের এ সমস্যার সমাধান হচ্ছে না’- এ মন্তব্যকে আপনি কীভাবে দেখেন?
ইউসুফ রামাদান: ইয়াসির আরাফাত কি শক্তিশালী ও বিশ্বস্ত নেতা ছিলেন না? অবশ্যই ছিলেন। তো তখন এ সমস্যার সমাধান হলো না কেন? ১৯৯০ সালে মাদ্রিদ থেকে তিনি এ সমস্যা সমাধানের প্রচেষ্টা শুরু করেন এবং ২০০৪-এ এসে মারা যান। ১৪ বছর চেষ্টা করে তিনি কী পেয়েছেন? তখন তো হামাস ছিল না, ফাতাহও ছিল না। আমরা তখন একসঙ্গে ছিলাম। দেখুন, এটা ইসরায়েলের ছড়ানো একটি অজুহাত মাত্র। প্রোপাগান্ডা। তারা বলে বেড়ায়, ফিলিস্তিনিরা দেশ গড়তে পারবে না, কারণ তারা বিভক্ত। আমার দৃষ্টিতে, তারা (হামাস ও ফাতাহ) উভয়ই একই ভিশনে কাজ করছে। তারা উভয়ই ফিলিস্তিনের স্বাধীনতা চায়। তবে দুই পক্ষের পন্থা ও চিন্তা আলাদা। কিন্তু ভিশন এক। স্বাধীন রাষ্ট্র চায় তারা।
ইসরায়েল ফিলিস্তিনকে বিভক্ত রাখার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে এবং আমেরিকা তাকে এ কাজে মদদ দিচ্ছে। আশার কথা হলো, বর্তমান পৃথিবী বাস্তবতা বুঝতে সক্ষম হয়েছে এবং পরিস্থিতি পাল্টাতে শুরু করেছে।
খবরের কাগজ: ফিলিস্তিনের ভবিষ্যৎ কী? আপনি কি কোনো আশার আলো দেখছেন?
ইউসুফ রামাদান: অবশ্যই, সব সময় আশা ছিল, আছে এবং থাকবে। আশা ছাড়া মানুষ বাঁচতে পারে না। আশাবাদী না হলে আমরা বাঁচতে পারব না। আমরা মুসলিম। আপনি জানেন, মুসলিম মানে কী? ‘আল্লাহর রহমত থেকে নিরাশ হইও না।’ হতাশ হওয়া যাবে না। সব সময় আল্লাহর ওপর আশা-ভরসা রাখতে হবে। আপনি যদি এই আশা হারিয়ে ফেলেন, তাহলে আপনি মানবতাকে হারিয়ে ফেলবেন।
আমরা আশার ওপর বেঁচে থাকি, আশা নিয়েই অগ্রসর হই। আর এ কারণেই ৭৬ বছর ধরে ফিলিস্তিনিরা বেঁচে আছে। নইলে আমরা অনেক আগেই অনেকের মতো হারিয়ে যেতাম। ফিলিস্তিনিরা ব্যতিক্রম। আল্লাহর ওপর আমাদের শক্ত বিশ্বাস আছে। আমাদের যা করার আছে, আমরা তা করছি- মুক্তি ও স্বাধীনতার জন্য স্বাভাবিক সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছি। বাকিটা আল্লাহর ওপর ছেড়ে দিয়েছি। তিনি যা ভালো মনে করেন, তার ফয়সালা করবেন। প্রত্যেক ফিলিস্তিনি দৃঢ়ভাবে এমনটা বিশ্বাস করে।
খবরের কাগজ: আপনাকে ধন্যবাদ।
ইউসুফ রামাদান: আপনাদেরও ধন্যবাদ।