ভেজালবিরোধী অভিযান বাড়াতে হবে । খবরের কাগজ
ঢাকা ২ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১, বৃহস্পতিবার, ১৬ মে ২০২৪

ভেজালবিরোধী অভিযান বাড়াতে হবে

প্রকাশ: ২৯ এপ্রিল ২০২৪, ১২:২৩ পিএম
ভেজালবিরোধী অভিযান বাড়াতে হবে
গোলাম রহমান

খাদ্যপণ্যের মান নিয়ন্ত্রণ যাচাই করতে আছে বিএসটিআই। তারা তাদের কাজ ঠিকমতো করলে বাজারে নকল, ভেজাল ও মানহীন পণ্য সহজে আসবে না। কারণ মানহীন ও ভেজাল হলে তাদের অভিযানে ধরা পড়ে। একইভাবে বাংলাদেশ নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষকেও বাজারে অভিযান পরিচালনা করতে হবে। এতে নকল ও মানহীন পণ্যের সরবরাহের প্রবণতা কমবে। তারা এসব কাজ করলে বাজারে মানুষ স্বাস্থ্যঝুঁকিতে পড়বে না। কারণ ভোক্তা অধিদপ্তরের তো ল্যাব নেই। ভেজালের বিরুদ্ধে তারা অভিযান করে, ভেজাল পেলে শুধু জরিমানা করে। সেই টাকা সরকারের কোষাগারে জমা হয়।

কিন্তু শিল্প মন্ত্রণালয়ের আওতায় বিএসটিআইয়ের যেহেতু ভালো মানের ল্যাব রয়েছে। তাদের ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করার ক্ষমতাও আছে। তাই তাদের অভিযান বাড়াতে হবে। আটক করা পণ্য ল্যাবে পরীক্ষা করতে হবে। ভেজাল প্রতিরোধ করতে হবে। মানুষের স্বাভাবিক ও সুস্থ জীবনের জন্যই তাদের এই কাজ করতে হবে। একইভাবে খাদ্য মন্ত্রণালয়ের আওতায় নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ করা হয়েছে। তাদেরও ল্যাবের তৎপরতা বাড়াতে হবে। ভেজালবিরোধী অভিযান বাড়াতে হবে।

লেখক: সভাপতি, কনজুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব) 

পৃথিবীর ইতিহাসে ফিলিস্তিনিদের মতো কেউ ত্যাগ স্বীকার করেনি: ইউসুফ রামাদান

প্রকাশ: ১৫ মে ২০২৪, ১১:১৫ এএম
পৃথিবীর ইতিহাসে ফিলিস্তিনিদের মতো কেউ ত্যাগ স্বীকার করেনি: ইউসুফ রামাদান
বাংলাদেশে নিযুক্ত ফিলিস্তিনের রাষ্ট্রদূত ইউসুফ এস ওয়াই রামাদান

বাংলাদেশে নিযুক্ত ফিলিস্তিনের রাষ্ট্রদূত ইউসুফ এস ওয়াই রামাদান। ৯ বছর ধরে এ দায়িত্ব পালন করছেন তিনি। বাংলাদেশ ও ফিলিস্তিনের মধ্যকার কূটনৈতিক সম্পর্ক অনন্য উচ্চতায় নিয়ে যাওয়ার নেপথ্যে তার অবদান অতুলনীয়। হামাস ও ইসরায়েলের মধ্যকার যুদ্ধ, ফিলিস্তিনের বর্তমান পরিস্থিতি, বিশ্বব্যাপী চলমান আন্দোলনসহ তার ব্যক্তিজীবন ও ফিলিস্তিনসংক্রান্ত নানা প্রসঙ্গ নিয়ে খবরের কাগজের সঙ্গে দীর্ঘ সময় কথা বলেন তিনি। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন মিরাজ রহমানরিয়াজ উদ্দীন। সঙ্গে ছিলেন রায়হান রাশেদ

খবরের কাগজ: প্রথমেই জানতে চাই, ফিলিস্তিনের বর্তমান পরিস্থিতি কী? 

ইউসুফ রামাদান: ফিলিস্তিনের সর্বশেষ পরিস্থিতি হলো, কাতার ও মিসরের মধ্যস্থতায় যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব নিয়ে আলোচনা চলছে। প্রথমে ইসরায়েলের কাছে প্রস্তাব পাঠানো হলে তারা কিছু সংশোধনী দেয় এবং হামাস এ প্রস্তাবে সম্মতি জানায়। হামাসের সম্মতির বিষয়টি নেতানিয়াহুকে খুবই অবাক করেছে। কারণ, তিনি এমনটা শুনতে চাচ্ছিলেন না। নেতিবাচক কিছু শুনতে চেয়েছিলেন তিনি। তারা ভেবেছে, এ সংশোধনী হামাস প্রত্যাখ্যান করবে। 

নেতানিয়াহুর হয়ে যারা কাজ করে, তারা তাকে বলেছে- এ প্রস্তাব হামাস মেনে নেবে না। কিন্তু হামাস শেষ মুহূর্তে চমক দেখিয়েছে, মেনে নিয়েছে। নেতানিয়াহু এবং তার সরকারের জন্য এটি অবাক করা খবর। কারণ তিনি যেকোনো উপায়ে, যেকোনো মূল্যে এ যুদ্ধ চালিয়ে যেতে চান। এ যুদ্ধের ধারাবাহিকতা ধরে রাখা তার জন্য অনেক গুরুত্বপূর্ণ। কারণ এর সঙ্গে তার ভাগ্য ও ভবিষ্যৎ জড়িত। যুদ্ধ বন্ধ হয়ে গেলে নেতানিয়াহুর ক্যারিয়ারও থমকে যাবে। 

বিশ্বের প্রায় সব সচেতন মানুষ বিশ্বাস করে, এ যুদ্ধটা ইসরায়েলের নয়; নেতানিয়াহুর এবং তার সরকারের যুদ্ধ। যদিও বর্তমান সময়ের সবকিছু নেতানিয়াহুর স্বার্থের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। 

মিসর, কাতার, আমেরিকা এবং মধ্যপ্রাচ্যের বহু প্রভাবশালী দেশসহ ফিলিস্তিনিরা চাচ্ছেন, এবার অন্তত এ যুদ্ধটি বন্ধ হোক। কিন্তু নেতানিয়াহুর একগুঁয়েমির কারণে বিষয়টি থমকে আছে। নেতানিয়াহু জানিয়েছেন, ইসরায়েল একা লড়তে পারে। সুতরাং আমরা অপেক্ষা করছি সামনে কী ঘটে। 

খবরের কাগজ: ফিলিস্তিনের সাধারণ মানুষের বর্তমান অবস্থা কেমন?

ইউসুফ রামাদান: ফিলিস্তিনের সাধারণ মানুষের বর্তমান পরিস্থিতি বর্ণনা করার মতো নেই। এ পরিস্থিতির সঠিক ব্যাখ্যা করা কারও পক্ষেই সম্ভব নয়। গাজার মানুষ পুরোপুরি দুর্দশাগ্রস্ত, এমনকি পশ্চিম তীরের মানুষও মারা হচ্ছে। হাজার হাজার মানুষকে হত্যা করা হয়েছে, যার মধ্যে বহু নারী ও শিশু রয়েছে। গাজার বর্তমান পরিস্থিতিটা আসলে অনুমান করা সম্ভব নয়, লাখ লাখ মানুষ অনাহারে দিন কাটাচ্ছে এবং আহত অবস্থায় কাতরাচ্ছে। গাজা ভূখণ্ডের ৭০ থেকে ৭৫ শতাংশ পুরোপুরি ধ্বংস হয়ে গেছে। অসংখ্য মানুষ গৃহহীন হয়ে এখন নিজ দেশেই শরণার্থী। এর ওপর খাবারের চরম সংকট বিরাজ করছে। গাজায় যে পরিমাণ খাবার প্রবেশ করছে, তাতে ২০ শতাংশ মানুষের চাহিদাও মিটছে না। ২০ শতাংশ মানুষের অপ্রতুল খাবার বণ্টিত হচ্ছে পুরো জনগোষ্ঠীর মধ্যে। ফলে তৈরি হচ্ছে তীব্র খাদ্যসংকট। 

এর মানে এই নয় যে, বহির্বিশ্ব আমাদের সহযোগিতা করছে না। বাংলাদেশসহ অনেক দেশ খাবার ও ওষুধসহ বিভিন্ন জিনিস দিয়ে সহযোগিতা করছে। কিন্তু ইসরায়েল সেসব সামগ্রী ফিলিস্তিনে প্রবেশের অনুমতি দিচ্ছে না। ইন্টারনেট নেই, যোগাযোগের ব্যবস্থা নেই, খাদ্য ও পানি নেই, ওষুধ নেই। সব বিশ্ববিদ্যালয় ধ্বংস করে দেওয়া হয়েছে। মসজিদ, চার্চ ধ্বংস করা হয়েছে। হামলার কারণে অকার্যকর হয়ে গেছে সব হাসপাতাল ও ক্লিনিক। কারও কাছে প্রয়োজনীয় ওষুধও নেই। ছোট একটি উদাহরণ দিই, কোথাও কোনো অ্যানেস্থেসিয়ার ব্যবস্থা নেই। অ্যানেস্থেসিয়া ছাড়া সব ধরনের অপারেশন করা হচ্ছে। ১০ বছরের একটি বালকের পা কেটে ফেলা হয়েছে অ্যানেস্থেসিয়া ছাড়াই। এবার আপনি চিন্তা করে দেখুন, সেখানকার মানুষ কেমন জীবন যাপন করছে!

খবরের কাগজ: যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান কী?

ইউসুফ রামাদান: দেখুন, রাজনীতিতে সবাই নিজ নিজ স্বার্থের কথা চিন্তা করে কাজ করে। যুদ্ধের প্রথম দিন থেকেই যুক্তরাষ্ট্রের আগ্রহ ছিল যেকোনো উপায়ে, যেকোনো মূল্যে ইসরায়েলকে সমর্থন করা। ‘ইসরায়েলেরও তাকে রক্ষা করার অধিকার রয়েছে’- এমন নীতির পক্ষে যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান। আমরা অনেকেই জানি, আমেরিকায় জায়োনিস্ট লবি (কট্টরপন্থি ইহুদিদের প্রভাব ও গ্রুপিং) খুবই শক্তিশালী এবং কার্যকর। তাদের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করার মতো অন্য কোনো লবি আমেরিকায় নেই। এটা যেমন বর্তমানে আছে, তেমন অতীতেও ছিল। ফিলিস্তিন-ইসরায়েল যুদ্ধের শুরু (১৯৪৮ সাল) থেকে, আমেরিকার জায়োনিস্ট লবি ইসরায়েলের পক্ষে কাজ করছে। দেখুন, আমেরিকায় ৬০-৬৫টি দেশের ৩০-৪০ লাখ মুসলমান রয়েছে। তারা সবাই আলাদা দলে, কমিউনিটিতে বিভক্ত। আলাদা স্থান ও সমাজে বসবাস করে। তাদের মধ্যে শক্তিশালী ঐক্য নেই। আর এই অনৈক্য ভিন্ন লবিকে আমেরিকায় যেভাবে খুশি সেভাবে প্রভাব বিস্তার করার সুযোগ করে দিচ্ছে। 

এ ছাড়া জায়োনিস্ট লবির আর্থিক সামর্থ্য অনেক বেশি এবং গণমাধ্যমেও তারা খুবই সক্রিয়। ফলে জায়োনিস্ট লবি আমেরিকায় খুবই শক্তিশালী। হোয়াইট হাউস, সিনেট, কংগ্রেসসহ আমেরিকার সর্বত্র এদের বিচরণ। আমি এটাকে ‘আমেরিকায় ছড়িয়ে পড়া ক্যানসার’ বলে থাকি। এ লবি আমেরিকার সরকারের মাধ্যমে মানুষের স্বাধীনতাকে বাজেয়াপ্ত করার মতো প্রভাব বিস্তার করার ক্ষমতা রাখে। পরিস্থিতি এখন এমন হয়ে দাঁড়িয়েছে, আপনি আমেরিকান হলে আমেরিকার সবকিছু নিয়ে সমালোচনা করতে পারবেন, দেশটির প্রেসিডেন্ট এবং কংগ্রেস সদস্যদের নিয়েও কথা বলতে পারবেন, কিন্তু কোনোভাবেই ইসরায়েলের সমালোচনা করতে পারবেন না। এভাবে আপনার কাছ থেকে স্বাধীনতা কেড়ে নেওয়া হয়েছে। যেটা নিয়ে আমেরিকারও কিছু করার নেই। ইসরায়েলের সমালোচনা করলে তারা আপনাকে অ্যান্টিসিমেটিকের তকমা দিয়ে কারাগারে পাঠিয়ে দেবে। কিন্তু প্রেসিডেন্টের সমালোচনা করলে কিছুই হবে না।

বর্তমানে পরিস্থিতি কিছুটা পাল্টেছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এখন খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। ফিলিস্তিনের চৌকস কিছু সাংবাদিক সবকিছু রেকর্ড করছেন এবং বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে দিচ্ছেন। এ কাজ করতে গিয়ে তাদের অনেকেই জীবন হারিয়েছেন, অনেকে পরিবার হারিয়েছেন। তবু তারা কাজটি চালিয়ে যাচ্ছেন। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের প্রভাবে আমেরিকায় ছাত্র আন্দোলন শুরু হয়েছে।

খবরের কাগজ: আপনার কথার সূত্র ধরে জানতে চাই, আমেরিকার ছাত্র আন্দোলনকে ফিলিস্তিন কীভাবে দেখে?  

ইউসুফ রামাদান: এই বিপ্লব, ছাত্রদের এই আন্দোলন আমেরিকার প্রশাসনকে কঠিন পরিস্থিতির মুখোমুখি দাঁড় করিয়েছে। তাদের সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময় এসেছে, কার পক্ষে অবস্থান নেবে তারা। আমেরিকার জনসাধারণের স্বার্থ দেখবে নাকি ইসরায়েলের স্বার্থের পক্ষে অবস্থান নেবে। আর এ কারণে আমেরিকা এখন জোরালোভাবে যুদ্ধবিরতি চাচ্ছে। অথচ তারা ফিলিস্তিনের পূর্ণ সদস্যপদের দাবিতে আলজেরিয়ার প্রস্তাবে ভেটো দেওয়াসহ তিনবার যুদ্ধবিরতিতে ভেটো দিয়েছে। ছয় মাসে তারা চারবার ভেটো দিয়েছিল। আর এটাই জায়োনিস্ট লবিস্টদের অভূতপূর্ব ক্ষমতা। এভাবেই নেতানিয়াহু সমর্থকরা জো বাইডেনকে প্রতিবন্ধকতায় ফেলে। 

পরিস্থিতি এখন কিছুটা পাল্টেছে। বাইডেন বুঝতে পারছেন, বারবার একই পথে যাওয়াটা তার দেশ, জনগণ ও প্রশাসনের স্বার্থের বিপক্ষে যাচ্ছে। তিনি বিকল্প ভাবতে শুরু করেছেন। তিনি ইসরায়েলকে অস্ত্র ও গোলাবারুদ না দেওয়ার কথাও বলছেন। এর মানে এই নয় যে, তিনি গাজার মানুষকে ভালোবাসেন কিংবা তাদের ব্যাপারে উদ্বিগ্ন; আসলে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ইসরায়েলবিরোধী আন্দোলনের কারণে তিনি এমনটা করতে বাধ্য হচ্ছেন। আমরা আশাবাদী। কারণ ইসরায়েল বর্তমানে সারা বিশ্ব থেকে বিচ্ছিন্ন। হামাসের প্রস্তুাব মেনে নেওয়াটা ইসরায়েলকে আরও কঠিন পরিস্থিতিতে ফেলে দিয়েছে। এখন হয়তো তারা চরমভাবে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবে, নয়তো ভিন্ন কিছু চিন্তা করবে।   

খবরের কাগজ: বিশ্বের বিভিন্ন মুসলিম দেশ, বিশেষত আরব বিশ্বের ভূমিকায় কি আপনারা সন্তুষ্ট?

ইউসুফ রামাদান: আরব বিশ্বের ভূমিকা কিংবা সাধারণ মুসলিম দেশের ভূমিকা নিয়ে কিছুটা সমস্যা আছে এবং সেটা যে কেবল ফিলিস্তিন ইস্যুতে সীমাবদ্ধ, বিষয়টা কিন্তু এমন নয়। বিভিন্ন ইস্যুতে তাদের ভূমিকা নিয়ে সমস্যা আছে। অনেক ইস্যুতেই যথার্থভাবে তারা পাশে দাঁড়াচ্ছে না। উদাহরণ হিসেবে রোহিঙ্গা সংকট নিয়ে কথা বলা যায়। ফিলিস্তিন ইস্যুর তুলনায় এটা অনেক অনেক সহজ ইস্যু। এখানে কি মুসলিম বিশ্ব কিংবা আরব বিশ্ব কার্যকর ভূমিকা পালন করতে সক্ষম হয়েছে? তারা এখনো উদ্বাস্তু এবং বাংলাদেশ একমাত্র দেশ যারা এটি বহন করছে এবং দুর্ভোগ পোহাচ্ছে। ফিলিস্তিন ইস্যুতে তারা (আরব বিশ্ব) অবশ্যই তাদের মতো করে ভূমিকা পালন করছে। তারা কি পর্যাপ্ত ভূমিকা পালন করছে? না, সেটা তারা করছে না। তারা কাজ করছে, কিন্তু তা যথেষ্ট নয়।

খবরের কাগজ: বাংলাদেশ-আমেরিকাসহ বিভন্ন দেশে আন্দোলন হচ্ছে, একে আপনি কীভাবে দেখছেন?

ইউসুফ রামাদান: এটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি মুহূর্ত। ফিলিস্তিনি মানুষের জন্য এটি গুরুত্বপূর্ণ সাপোর্ট। এমনটা এর আগে ঘটেনি। একেবারেই নতুন কিছু হচ্ছে। এটা ফিলিস্তিনি জনগণের প্রাপ্য। কারণ তারা যে ত্যাগ স্বীকার করেছে, তার মূল্যটা বেশ ভারি। যে পরিমাণ ধ্বংসযজ্ঞ, দুর্দশা ও নির্যাতন ফিলিস্তিনের মানুষ সহ্য করছে, তারা এমন একটি সংহতি পাওয়ার প্রকৃত হকদার। 

গোটা বিশ্বের মানুষ এখন ফিলিস্তিনের পক্ষে একাত্মতা ঘোষণা করছে। তারা বুঝতে পেরেছে, ইসরায়েলের এ হামলা শুধু ফিলিস্তিনের বিপক্ষে নয়, এটা মানবতা ও ন্যায়ের বিপক্ষে এবং এ কারণে মানবতা কলঙ্কিত হচ্ছে। 

আমেরিকার মানুষ তাদের সরকারকে প্রশ্ন করছে, ‘কোথায় তোমার মানবতা, কোথায় তোমার নীতি-আদর্শ, কোথায় তোমার নৈতিকতা ও মোরালিটি? তোমরা আমাদের যেসব নীতি ও মানবতার কথা বলেছ, তা কি শুধু নির্দিষ্ট কিছু মানুষের জন্য? আমরা কি সেসব নীতির পক্ষে অবস্থান নেব?’ সুতরাং এটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি আন্দোলন এবং এমন কাজ চালু রাখতে আমরা তাদের আরও উৎসাহিত করি। 

বাংলাদেশের জনসাধারণকেও ধন্যবাদ জানাচ্ছি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রসহ বাংলাদেশের জনগণ যে আন্দোলন-সংহতি বাস্তবায়ন করছে, তা খুব দারুণ। আশা করি, বাংলাদেশের অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ও একই কাজ করবে। ফিলিস্তিনি মানুষের সমর্থনে এগিয়ে আসবে এবং আশা করি, বিশ্বের বিভিন্ন দেশেও এ সংহতি আন্দোলন ছড়িয়ে পড়বে। 
 
খবরের কাগজ: বাংলাদেশের সঙ্গে ফিলিস্তিনের কূটনৈতিক সম্পর্ক কেমন?

ইউসুফ রামাদান: বাংলাদেশ ও ফিলিস্তিনের কূটনৈতিক সম্পর্ক অসাধারণ। এ সম্পর্ক খুবই গভীর ও আন্তরিক। বাংলাদেশ বিশ্বের অন্যতম শীর্ষ দেশ, যাদের সরকার ও জনগণ যেকোনো ইস্যুতে ব্যাপকভাবে ফিলিস্তিনকে সমর্থন করে থাকে। গত ৯ বছর ধরে আমি বাংলাদেশে বসবাস করছি, বাংলাদেশের পক্ষ থেকে যে পরিমাণ এবং যে মানের সাহায্য-সহযোগিতা ফিলিস্তিন গ্রহণ করেছে, আমি তা স্বচক্ষে দেখেছি এবং আমি এর প্রধান সাক্ষী। 

১৯৭১ সালে বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর ইসরায়েলের পররাষ্ট্রমন্ত্রী বাংলাদেশকে একটি স্বীকৃতি পত্র পাঠিয়েছিল। যদিও সে সময়ে বাংলাদেশের জন্য এ স্বীকৃতির প্রয়োজন ছিল, কিন্তু বাংলাদেশ তা প্রত্যাখ্যান করেছিল। অথচ বাংলাদেশের সঙ্গে তখন ফিলিস্তিনের সম্পর্ক তৈরি হয়নি। বাংলাদেশ ফিলিস্তিনের অকৃত্রিম বন্ধু।

বর্তমানে সবাই পরিষ্কারভাবে বুঝতে সক্ষম হয়েছেন, ফিলিস্তিনের যুদ্ধের বিষয়টি কেবল ইসরায়েল ও ফিলিস্তিনের মধ্যে সীমাবন্ধ নেই; বরং এটা ভালো ও মন্দের মধ্যকার যুদ্ধে পরিণত হয়েছে। বাংলাদেশ তাদের স্বাধীনতার প্রথম দিন থেকেই ভালোর পক্ষে থাকার সঠিক সিদ্ধান্ত নিয়ে ফিলিস্তিনের পাশে ছিল, আছে এবং আশা করি থাকবে। 

খবরের কাগজ: বাংলাদেশ থেকে সরকারি ও বেসরকারিভাবে ফিলিস্তিনে যেসব সহযোগিতা পাঠানো হচ্ছে, আদৌ কি তা সেখানে পৌঁছে?

ইউসুফ রামাদান: বাংলাদেশর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশনায় আমরা প্রথমবার বিপুল পরিমাণ ওষুধ এবং পরবর্তী সময়ে শুকনো খাবার সাহায্য হিসেবে গ্রহণ করেছি এবং কায়রোয় থাকা বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত তা গ্রহণ করে রেড ক্রিসেন্টের মাধ্যমে ফিলিস্তিনে পৌঁছানোর ব্যবস্থা করেছেন। বাংলাদেশের এ সাহায্য ফিলিস্তিনের মানুষের হৃদয় ছুঁয়ে গেছে। সবাই বাংলাদেশের প্রশংসা করেছেন। এগুলো হস্তান্তর করা, পৌঁছানো, বিতরণ, রান্না করা এবং খাওয়ার অনেক ভিডিও রয়েছে। বাংলাদেশের পতাকা পেছনে রেখে সাহায্য গ্রহণ করার সময় শিশুরা বাংলাদেশকে ধন্যবাদ জানাচ্ছে- এমন ভিডিও রয়েছে। 

এ ছাড়া বেসরকারিভাবেও বহু মানুষ এবং অনেক সংগঠনের কাছ থেকে আমরা বিপুল সাহায্য-সহযোগিতা পাচ্ছি। গত রমজানেও আমরা সরকারি ও বেসরকারিভাবে ইফতারের সহযোগিতা গ্রহণ করেছি এবং যথাযথভাবে তা ফিলিস্তিনে পৌঁছিয়েছি। তবে সমস্যা হচ্ছে, যে পরিমাণ সাহায্য পাচ্ছি, সব পৌঁছাতে কষ্ট হচ্ছে। কারণ ইসরায়েল ফিলিস্তিনে কোনো কিছু প্রবেশ করাতে প্রচণ্ড বাধার সৃষ্টি করছে। 

গাজায় ‘বাংলাদেশ অনাথ আশ্রম’ নামে একটি আশ্রম প্রতিষ্ঠার পরিকল্পনা চলমান রয়েছে। বাংলাদেশ ফিলিস্তিনের পাশে ছিল, আছে এবং থাকবে বলে আশা করি। আরও একটি খুশির সংবাদ হলো, বাংলাদেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় ফিলিস্তিনিদের ফুল ফ্রি শিক্ষাবৃত্তি প্রদানে সম্মত হয়েছে, যেটা ফিলিস্তিনের জন্য অনেক বড় সুসংবাদ। অনেক বড় সহযোগিতা। প্রত্যাশার চেয়ে অনেক বেশি সাড়া পেয়েছি আমরা। এ জন্য আমি বাংলাদেশের শিক্ষামন্ত্রীসহ সংশ্লিষ্ট সব বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে ধন্যবাদ জানাচ্ছি। 

খবরের কাগজ: বাংলাদেশের জনসাধারণের কাছে ফিলিস্তিনের প্রত্যাশা কী? 

ইউসুফ রামাদান: এটা খুবই পরিষ্কার। তারা অতীতে যা করেছেন, বর্তমানে যা করছেন- এটাকে অব্যাহত রাখুন। হাল ছেড়ে দেবেন না। এ দেশের জনগণ যা করছে, তা অভূতপূর্ব। ফিলিস্তিন একে মূল্যায়ন করে। ফিলিস্তিনের ইতিহাসের পাতায় এসব সাহায্য-সহযোগিতার কথা খচিত থাকবে। আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম তা পড়বে এবং জানবে। ফিলিস্তিন মুক্ত হওয়ার পর, আশা করছি আমরা একদিন বাংলাদেশের এ ভালোবাসার মর্যাদাপূর্ণ প্রতিদান দেব।  

খবরের কাগজ: গাজায় ইসরায়েলের হামলার ক্ষতির প্রভাব কী?

ইউসুফ রামাদান: এ হামলার ক্ষতির প্রভাব অবর্ণনীয়। আমি আগেই বলেছি, গাজার প্রায় ৭৫ শতাংশ এলাকা একেবারে ধ্বংস হয়ে গেছে। কীভাবে আমরা এগুলো পুনঃপ্রতিষ্ঠা করব? এগুলো পুনর্নির্মাণ করতে বহু অর্থ প্রয়োজন। কিন্তু ফিলিস্তিনের সে সামর্থ্য নেই। ফিলিস্তিনের আর্থিক সক্ষমতা এমনিতেই কম। এ হামলা ও যুদ্ধের ফলে তারা আরও পঙ্গু হয়ে গেছে। 

ফিলিস্তিনের জন্য সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হলো, ধ্বংস হওয়া জনপদের পুনঃপ্রতিষ্ঠা। ফিলিস্তিনের যেহেতু এ সামর্থ্য নেই, সুতরাং সারা বিশ্বের সহযোগিতা প্রয়োজন। 

এ যুদ্ধ বন্ধ না হওয়া পর্যন্ত এ জনপদ পুনঃপ্রতিষ্ঠায় কেউ সহযোগিতাও করবে না। কারণ আজকে নির্মাণ করলে কালকে যে আবার ইসরায়েল তা ধ্বংস করে দেবে না, তার কোনো গ্যারান্টি নেই।    

খবরের কাগজ: গাজায় আপনার কি কোনো আত্মীয় রয়েছে? 

ইউসুফ রামাদান: সরাসরি রক্তের সম্পর্কের কোনো আত্মীয় নেই। তবে আমার একজন জামাতা রয়েছে সেখানে। যুদ্ধের প্রথম তিন সপ্তাহে সে তার পরিবারের ৫৯ সদস্যকে হারিয়েছে। আর আমি গাজার অধিবাসীও নই। আমি ফিলিস্তিনের অন্য অংশের অধিবাসী। ফলে গাজায় আমার সরাসরি কোনো আত্মীয় নেই। তবে আমি বিশ্বাস করি, গাজায় যত ফিলিস্তিনি মৃত্যুবরণ করেছেন এবং বর্তমানে যত মানুষ জীবিত রয়েছেন, সবাই আমার আত্মীয়। তাদের কেউ আমার মা, কেউ বাবা, কেউ আমার বোন, কেউ ভাই, কেউবা ছেলে কিংবা মেয়ে। তারা সবাই আমার পরিবারের সদস্য।

খবরের কাগজ: ইসরায়েল কেন ফিলিস্তিনে হামলা চালাচ্ছে? এখানে কি কোনো ধর্মীয় বা রাজনৈতিক কারণ জড়িত? মূলত কি কারণে তারা হামলা চালাচ্ছে বা যুদ্ধ করছে? 

ইউসুফ রামাদান: তাদের যুদ্ধের মূল উদ্দেশ্য পরিষ্কার। লুকানোর কিছু নেই। ৭৬ বছর ধরে যার জন্য তারা যুদ্ধ চালাচ্ছে, সেটা হলো- ফিলিস্তিনের পুরো ভূখণ্ড তারা দখলে নিতে চায়। পুরো ভূমি দখল করার পর তারা ‘বৃহত্তর ইসরায়েল’ গঠন করতে চায়। অন্য সব কারণ গৌণ। এটাই মূল বা প্রধান কারণ। নেতানিয়াহুর মতো কিছু কট্টরপন্থি ইহুদি এ মিশন বাস্তবায়নে জড়িত। এই মিশনের অংশ হিসেবে এখন তারা যেকোনো মূল্যে গাজার জনসাধরণকে ভূমিছাড়া করতে চাচ্ছে। গাজাকে খালি করে এটা দখল করবে এবং তাদের ‘বৃহত্তম ইসরায়েল’ প্রতিষ্ঠার একটি ধাপ সম্পন্ন করবে, এটাই তাদের উদ্দেশ্য। ফিলিস্তিনি জনগণ তাদের এ মিশন কোনোভাবেই বাস্তবায়ন করতে দেবে না। তারা তাদের জন্মভূমি রক্ষায় আমরণ লড়াই করে যাবে। ফিলিস্তিনি মানুষের দেশপ্রেম ও সাহসিকতা বিশ্বের মানুষকে বিস্মিত করেছে। 

পৃথিবীর ইতিহাসে কোনো জাতি ফিলিস্তিনিদের মতো ত্যাগ স্বীকার করেনি। ফিলিস্তিনিরা বিশ্বাস করে, তারা স্বাধীনভাবে এখানে জন্মেছে এবং স্বাধীনভাবে বসবাস করার অধিকার তাদের আছে। কেউ তাদের ভাগ্য নির্ধারণের অধিকার রাখে না। তারা সৃষ্টিকর্তার দাস। নেতানিয়াহু, বাইডেন কিংবা অন্য কারও দাসত্ব করার জন্য তাদের জন্ম হয়নি। 

খবরের কাগজ: অনেকে বলেন, ‘হামাস ও ফাতাহ গ্রুপে বিভক্ত থাকা এবং শক্তিশালী বিশ্বস্ত নেতা না থাকার কারণে ফিলিস্তিনের এ সমস্যার সমাধান হচ্ছে না’- এ মন্তব্যকে আপনি কীভাবে দেখেন? 

ইউসুফ রামাদান: ইয়াসির আরাফাত কি শক্তিশালী ও বিশ্বস্ত নেতা ছিলেন না? অবশ্যই ছিলেন। তো তখন এ সমস্যার সমাধান হলো না কেন? ১৯৯০ সালে মাদ্রিদ থেকে তিনি এ সমস্যা সমাধানের প্রচেষ্টা শুরু করেন এবং ২০০৪-এ এসে মারা যান। ১৪ বছর চেষ্টা করে তিনি কী পেয়েছেন? তখন তো হামাস ছিল না, ফাতাহও ছিল না। আমরা তখন একসঙ্গে ছিলাম। দেখুন, এটা ইসরায়েলের ছড়ানো একটি অজুহাত মাত্র। প্রোপাগান্ডা। তারা বলে বেড়ায়, ফিলিস্তিনিরা দেশ গড়তে পারবে না, কারণ তারা বিভক্ত। আমার দৃষ্টিতে, তারা (হামাস ও ফাতাহ) উভয়ই একই ভিশনে কাজ করছে। তারা উভয়ই ফিলিস্তিনের স্বাধীনতা চায়। তবে দুই পক্ষের পন্থা ও চিন্তা আলাদা। কিন্তু ভিশন এক। স্বাধীন রাষ্ট্র চায় তারা। 

ইসরায়েল ফিলিস্তিনকে বিভক্ত রাখার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে এবং আমেরিকা তাকে এ কাজে মদদ দিচ্ছে। আশার কথা হলো, বর্তমান পৃথিবী বাস্তবতা বুঝতে সক্ষম হয়েছে এবং পরিস্থিতি পাল্টাতে শুরু করেছে।

খবরের কাগজ: ফিলিস্তিনের ভবিষ্যৎ কী? আপনি কি কোনো আশার আলো দেখছেন?

ইউসুফ রামাদান: অবশ্যই, সব সময় আশা ছিল, আছে এবং থাকবে। আশা ছাড়া মানুষ বাঁচতে পারে না। আশাবাদী না হলে আমরা বাঁচতে পারব না। আমরা মুসলিম। আপনি জানেন, মুসলিম মানে কী? ‘আল্লাহর রহমত থেকে নিরাশ হইও না।’ হতাশ হওয়া যাবে না। সব সময় আল্লাহর ওপর আশা-ভরসা রাখতে হবে। আপনি যদি এই আশা হারিয়ে ফেলেন, তাহলে আপনি মানবতাকে হারিয়ে ফেলবেন। 

আমরা আশার ওপর বেঁচে থাকি, আশা নিয়েই অগ্রসর হই। আর এ কারণেই ৭৬ বছর ধরে ফিলিস্তিনিরা বেঁচে আছে। নইলে আমরা অনেক আগেই অনেকের মতো হারিয়ে যেতাম। ফিলিস্তিনিরা ব্যতিক্রম। আল্লাহর ওপর আমাদের শক্ত বিশ্বাস আছে। আমাদের যা করার আছে, আমরা তা করছি- মুক্তি ও স্বাধীনতার জন্য স্বাভাবিক সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছি। বাকিটা আল্লাহর ওপর ছেড়ে দিয়েছি। তিনি যা ভালো মনে করেন, তার ফয়সালা করবেন। প্রত্যেক ফিলিস্তিনি দৃঢ়ভাবে এমনটা বিশ্বাস করে।

খবরের কাগজ: আপনাকে ধন্যবাদ। 

ইউসুফ রামাদান: আপনাদেরও ধন্যবাদ।  

যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নে মনোযোগী হবে বাংলাদেশ

প্রকাশ: ১৪ মে ২০২৪, ১১:৩৮ এএম
যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নে মনোযোগী হবে বাংলাদেশ
এম. হুমায়ুন কবির

ডোনাল্ড লু যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়াবিষয়ক সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী। দক্ষিণ এশিয়ার বিষয়টি মাথায় রেখেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রনীতি অনুসরণ করবেন ডোনাল্ট লু। ডোনাল্ড লু প্রথমে ভারত ও শ্রীলঙ্কা হয়ে ঢাকায় পৌঁছবেন। এর অর্থ দাঁড়াচ্ছে, ডোনাল্ড লু যে দায়িত্বে আছে বিশেষ করে মার্কিন পররাষ্ট্রনীতি নিয়ে, সেই দায়িত্বের একটি স্বাভাবিক প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে তার সফল বাস্তবায়ন করবেন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বৈশ্বিক শক্তি হিসেবে তার একটা প্রাধান্য রয়েছে। তাদের অগ্রাধিকারের বিষয়ের আলোকেই তিনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্কের উন্নয়ন ঘটাবেন। সেদিক থেকে দুই দেশের সম্পর্ককে স্বাভাবিকভাবেই দেখছি। বাংলাদেশে আমরা দুটি প্রবণতা দেখছি। বাংলাদেশের নির্বাচনকালীন সময়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান কেমন ছিল, তা আমরা জানি। বাংলাদেশের নির্বাচনের প্রক্রিয়া ও গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বড় ধরনের অবস্থান রয়েছে। আমাদের দেশের যে সাম্প্রতিক রিপোর্ট হিউমান রাইটসের কাছে আছে, সে ক্ষেত্রে দেশ কিছুটা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। বাংলাদেশের নির্বাচনের গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া, নাগরিক অধিকার, স্বাধীনতা, সামগ্রিক অর্থনৈতিক গভর্ন্যান্স হিসেবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের একটি অবস্থান রয়েছে।

ডোনাল্ট লু বাংলাদেশে এসে দেশের কর্মকর্তাদের সঙ্গে তার কথাবার্তা ও শুভেচ্ছা জ্ঞাপন করবেন। সেখানে তিনি তার অবস্থান তুলে ধরবেন এবং আমাদের অবস্থান জানতে চাইবেন। আমরা মনে করি যে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক টেকসই হওয়ার ক্ষেত্রে যে উপাদানগুলো দীর্ঘমেয়াদি ভূমিকা রাখতে পারবে সেই বিষয়গুলোই আলোকপাত করা হবে। তার মধ্যে অন্যতম আলোচনার বিষয় হবে বাংলাদেশের সঙ্গে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনৈতিক সম্পর্কের উন্নয়ন। সে ক্ষেত্রে বাংলাদেশ এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র দুই দেশের ক্ষেত্রেই এই বিষয়টি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। যেহেতু দুই দিক থেকেই সম্পর্কটি উপাদেয়, সেহেতু দুই দিক থেকেই সম্পর্কটিকে সামনে এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে।

আমরা জানি, বাংলাদেশের নির্বাচনের পরপরই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের শক্তিশালী একটি দল বাংলাদেশে এসেছিল। সে আগমনটি ন্যাশনাল সিকিউরিটি কাউন্সিলের নেতৃত্বাধীন হয়েছিল। তাদের সঙ্গে বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা ছিলেন। তখন কিন্তু তারা দুই দেশের অর্থনৈতিক সম্পর্ককে শক্তিশালী করার জন্য একসঙ্গে কাজ করার প্রত্যয় ব্যক্ত করেছিলেন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের উদীয়মান অর্থনীতির দেশ হিসেবে বড় বাজার মনে করছে। বাংলাদেশকে দক্ষিণ এশিয়ার একটি সম্ভাব্য দেশ হিসেবে চিন্তা করেছে। সেই কথা মাথায় রেখেই কিন্তু তারা বাংলাদেশে কাজ করতে আগ্রহী। গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক বিবেচনায় দুই দেশের অবস্থানগত পার্থক্য থাকলেও নৈতিক বিষয়ে সহযোগিতার ক্ষেত্রে সবাই সহনশীল ও সহমত পোষণ করবে। পারস্পরিকভাবে দুই দেশেরই ইতিবাচক ধারণা রয়েছে। বৈদেশিক সম্পর্কটা সামনে এগিয়ে যাওয়ার জন্য দুই দেশেরই সহমত আছে। 

কিছু আঞ্চলিক বা বৈশ্বিক ক্ষেত্রে অগ্রাধিকারের বিষয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের প্রতি অনেক মনোযোগ দিয়েছে। সে ক্ষেত্রে বাংলাদেশ কীভাবে ইতিবাচক অবস্থান ধরে রাখতে পারে সেদিকে নজর দিতে হবে। বাংলাদেশ কীভাবে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে অর্থনীতিকে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারে, সেটাই গুরুত্বপূর্ণ। মূলত আমাদের আগ্রহ নৈতিক বিষয়ের অগ্রগতি এবং অপ্রচলিত নিরাপত্তার বিষয় নিয়ে। আমরা নন ট্রাডিশনাল সিকিউরিটি বিষয় যেমন; জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে কাজ করতে আগ্রহী। বাংলাদেশ-ভারত, বাংলাদেশ-চীন, বাংলাদেশ-ইউরোপ, বাংলাদেশ-মধ্যপ্রাচ্যর চলমান বিষয়গুলো নিয়ে পারস্পরিক আলোচনা হবে বলে মনে হয়। সে ক্ষেত্রে দুই পক্ষই তাদের অবস্থান পরিষ্কার করবে। সে ক্ষেত্রে অনেক বিষয়ে বাংলাদেশ তার অবস্থান তুলে ধরবে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে কোনো কোনো বিষয়ে হয়তো আমাদের মতভেদ আছে। যেমন: ফিলিস্তিন-ইসরায়েল ও রাশিয়া- ইউক্রেন যুদ্ধ নিয়ে। অন্যান্য বিষয় যেমন: অপ্রচলিত নিরাপত্তা, মুক্ত অঞ্চল ও বাণিজ্য অঞ্চল এসব বিষয়ে আমরা সহমত আছি। 

আরেকটি বিষয় হলো বাংলাদেশের জলবায়ুসংক্রান্ত বিষয়। যেহেতু জলবায়ু পরিবর্তন বড় ধরনের একটি বৈশ্বিক চ্যালেঞ্জ। জলবায়ু পরিবর্তনে বাংলাদেশ যেহেতু ভুক্তভোগীর শিকার, সে ক্ষেত্রে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কীভাবে বাংলাদেশকে সহযোগিতা করতে পারে সেই ব্যাপারে বিশদ আলোচনা করতে হবে।

বাংলাদেশের জ্বালানি নিরাপত্তা একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। সে ব্যাপারেও দুই পক্ষের মধ্যে ইতিবাচক আলাপ-আলোচনা হবে। বাংলাদেশ নবায়নযোগ্য জ্বালানির জন্য নতুন করে চিন্তা-ভাবনা করছে। সে ক্ষেত্রে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে কীভাবে আমরা সহযোগিতা পেতে পারি, তা আলোচনায় আনতে হবে। এ ব্যাপারে আমরা আমাদের অবস্থানটা তাদের কাছে তুলে ধরতে পারি যে, আমরা তাদের কাছ থেকে সহযোগিতা পেতে পারি। জ্বালানি নিরাপত্তা বিষয়টি জলবায়ুর সঙ্গেও সম্পর্কযুক্ত। 

সেই আলোকেও আমরা আলাপ-আলোচনা করতে পারি। জলবায়ু পরিবর্তনে যত আলোচনা করুক না কেন, বাংলাদেশের জ্বালানি জলবায়ুর সঙ্গে সংযুক্ত হয়ে আছে, সে ক্ষেত্রে আমেরিকার যে বৈশ্বিক জলবায়ু বিষয়ে পরিকল্পনা আছে, তার মধ্যে আমরা কীভাবে জ্বালানি নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পারি তা দেখতে হবে। বাংলাদেশ সে বিষয় নিয়ে আলোচনা করে সামনে এগিয়ে যাবে বলে আশা করি। দুই দেশের মধ্যে কিছু মতপার্থক্য থাকলেও এখন ইতিবাচকভাবেই সামনে এগিয়ে যাবে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের চলমান সম্পর্ক ও অবস্থান এবং আগামী দিনের ইতিবাচক অবস্থানগুলো আলোচনা করে একে অপরকে কীভাবে সহযোগিতা করতে পারে সে ব্যাপারে বিশদ আলোচনা হবে বলে আশা করি।

লেখক: মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের সাবেক রাষ্ট্রদূত

দ্বৈত নাগরিকত্ব ও বাংলাদেশের পাসপোর্ট

প্রকাশ: ১৪ মে ২০২৪, ১১:৩৫ এএম
দ্বৈত নাগরিকত্ব ও বাংলাদেশের পাসপোর্ট
নোমান জাকির

গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী বাংলাদেশের নাগরিকরা বাংলাদেশের নাগরিকত্ব অব্যাহত রাখার পাশাপাশি পৃথিবীর মোট ১০১টি দেশের নাগরিকত্ব গ্রহণ করতে পারবেন। অর্থাৎ, বাংলাদেশের নাগরিকরা বাংলাদেশের পাসপোর্ট রাখার পাশাপাশি আরও ১০১টি দেশের মধ্য থেকে যেকোনো দেশের পাসপোর্ট বহন করতে পারবেন। 

বাংলাদেশের নাগরিকরা বিশ্বায়নের এই সময়ে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে পড়েছেন। প্রবাসী বাংলাদেশিরা বেশির ভাগই পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে গিয়েছেন কাজের সন্ধানে। তারা যদি সেই উন্নত দেশের নাগরিকত্ব গ্রহণ করেন, তবে তারা সেখানে তুলনামূলক সহজভাবে কর্মসংস্থান খুঁজে নিতে পারার সঙ্গে সঙ্গে সেই দেশে ব্যবসা-বাণিজ্যও চালু করতে পারবেন। এই ব্যবসার পরিসর বাংলাদেশেও আসার সম্ভাবনা অস্বাভাবিক প্রত্যাশা নয়। বরং এই প্রত্যাশা এখন  বাস্তবতা।  

তাই, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের দ্বৈত নাগরিকত্ব গ্রহণের সুযোগ দেওয়ার এই  উদ্যোগ নিঃসন্দেহে প্রশংসার দাবিদার। একটি জাতীয় দৈনিকে দ্বৈত নাগরিকত্ব প্রদানের বিষয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সুরক্ষা ও সেবা বিভাগের অতিরিক্ত সচিব (নিরাপত্তা ও বহিরাগমন অনুবিভাগ) মো. হাবিবুর রহমানের বক্তব্য এই প্রবন্ধে পুনরায় প্রকাশ করার লোভ সামলাতে পারছি না। দ্বৈত নাগরিকত্ব নিয়ে তিনি বলেন, দ্বৈত নাগরিকত্বের ক্ষেত্রে তিনটি বিষয় বিবেচনায় নেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে প্রথম হচ্ছে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড। দ্বৈত নাগরিকত্ব গ্রহণকারী প্রবাসীরা সেসব দেশে ভালোভাবে আয়-রোজগার করার সুযোগ-সুবিধা পাবেন এবং দেশে অর্থ পাঠাবেন, তাতে দেশ অর্থনৈতিকভাবে লাভবান হবে।
দ্বিতিয়ত, বিশ্ব নাগরিক বিবেচনায় গ্লোবাল ভিলেজে কেউ দ্বৈত নাগরিক হতে চাইলে দেশের স্বার্থ ঠিক রেখে সে সুযোগ দেওয়া উচিত, যা বাংলাদেশ ‘নাগরিকত্ব আইন-২০১৬’ বিলের মাধ্যমেও অনুমোদিত।  

আর তৃতীয় বিষয়টি হচ্ছে, প্রযুক্তি ও জ্ঞানের আদান-প্রদান। দ্বৈত নাগরিকরা উন্নত প্রযুক্তির ব্যবহার দেশে প্রয়োগ করতে পারবেন এবং দেশের বিভিন্ন প্রযুক্তিনির্ভর খাতে প্রযুক্তির ব্যবহারে দিকনির্দেশনা দেওয়ার পাশাপাশি বিনিয়োগ করার লক্ষ্যেও আকৃষ্ট হবেন। সেই সঙ্গে দেশের সঙ্গে তাদের নিবিড় সম্পর্ক পারে দেশকে প্রযুক্তি ও জ্ঞানে আরও সমৃদ্ধ করতে।

কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য, দ্বৈত নাগরিকত্ব গ্রহণকারী বেশির ভাগ নাগরিকই কীভাবে একই সঙ্গে নতুন নাগরিকত্ব পাওয়া দেশের পাসপোর্ট ও বাংলাদেশের পাসপোর্ট অব্যাহত রাখবেন কিংবা কীভাবে বাংলাদেশে তার ভোটাধিকার প্রয়োগ করবেন, সে বিষয়ে অসচেতন। 
অথচ খুব সহজেই স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সুরক্ষা সেবা বিভাগের ওয়েবসাইট থেকে অনলাইনে দ্বৈত নাগরিকত্বের সনদের জন্য আবেদন করা যায়। আবার অফলাইনেও আবেদন করার প্রক্রিয়া রয়েছে। অনলাইনে আবেদন করলে কীভাবে আবেদন করতে হবে, কী কী ডকুমেন্টস দিতে হবে সব নির্দেশনা ওয়েবসাইটে দেওয়া আছে। 

তাছাড়া, বর্তমানে অনলাইনে আবেদনের মাধ্যমে বিদেশের যেকোনো জায়গা থেকে দ্বৈত নাগরিকত্ব সনদের আবেদন করা যায়, যা বিগত দিনগুলোতে সংশ্লিষ্ট দেশের মিশনের মাধ্যমে করা হতো। এতে করে প্রবাসী সেবাপ্রত্যাশীদের দ্বৈত নাগরিকত্বের সুবিধা টিকিয়ে রাখতে অনেক ভোগান্তির সম্মুখীন হতে হতো এবং প্রচুর অর্থ ও সময় ব্যয় হতো। 

বর্তমানে সোনালি ব্যাংকের ‘সোনালি পেমেন্ট গেটওয়ে’ অ্যাপের সঙ্গে পররাষ্ট্র, স্বরাষ্ট্র ও পুলিশের বিশেষ শাখার সংযোগ থাকায় পেমেন্ট সংক্রান্ত ভোগান্তি থেকে রেহাই পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে দ্বৈত নাগরিকরা খুব সহজেই দেশ-বিদেশের যেকোনো প্রান্ত থেকে ব্যাংকিং লেনদেন করতে পারবেন এবং সনদ প্রদানকারী সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারাও প্রয়োজনীয় কাজগুলো  অতিদ্রুত সম্পন্ন করতে পারেন। এতে করে প্রবাসীরা দ্বৈত নাগরিকত্ব টিকিয়ে রাখতে আগের চেয়ে অনেক বেশি আগ্রহী হবেন।

বাংলাদেশের  দ্বৈত নাগরিকত্বের সনদ দিয়ে একজন ব্যক্তি বাংলাদেশের পাসপোর্টের জন্যও আবেদন করতে পারবেন কিংবা তার ইতোমধ্যে বাংলাদেশের পাসপোর্ট থাকলে, সেই পাসপোর্ট খুব সহজেই নবায়ন করতে পারবেন। সুতরাং, পাসপোর্ট সংক্রান্ত ভোগান্তি থেকেও খুব সহজেই দ্বৈত নাগরিকরা মুক্তি পাবেন।

আবার অনেক দ্বৈত নাগরিকত্ব গ্রহণকারীর বাংলাদেশের পাসপোর্ট গ্রহণের জন্য দ্বৈত নাগরিকত্ব সনদ গ্রহণেরও প্রয়োজন হয় না। এসআরও নম্বর ২৭০-আইন/২০০৮ অনুযায়ী বাংলাদেশের কোনো নাগরিক যদি যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, ইউরোপের বিভিন্ন দেশ তথা জার্মানি, রাশিয়া, ফ্রান্স, ইতালি, স্পেন, ইউক্রেন, পোল্যান্ড, রোমানিয়া, নেদারল্যান্ডস, বেলজিয়াম, চেকপ্রজাতন্ত্র, গ্রিস, পর্তুগাল, সুইডেন, হাঙ্গেরি, বেলারুশ, অস্ট্রিয়া, সার্বিয়া, সুইজারল্যান্ড, বুলগেরিয়া, ডেনমার্ক, ফিনল্যান্ড, স্লোভাকিয়া, নরওয়ে, আয়ারল্যান্ড, ক্রোয়েশিয়া, মোলদোভা, বসনিয়া, আলবেনিয়া, লিথুয়ানিয়া, উত্তর মেসিডোনিয়া, স্লোভেনিয়া, লাটভিয়া, এস্তোনিয়া, মন্টিনিগ্রো, লুক্সেমবার্গ, মাল্টা, আইসল্যান্ড, অ্যান্ডোরা, মোনাকো, লিচেনস্টাইন, সান মারিনো, কসোভো, ইংল্যান্ড, এনডোরা, সাইপ্রাস, আর্মেনিয়া এবং জর্জিয়ার নাগরিকত্ব গ্রহণ করে, তখন পাসপোর্টের আবেদনের জন্য তাদের আর নতুন করে দ্বৈত নাগরিকত্বের সনদ প্রদান করতে হবে না। পরবর্তীতে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার এসআরও নম্বর ২৭-আইন/২০১২ অনুযায়ী বাংলাদেশের নাগরিক যারা এশিয়ার আরও সাতটি দেশ তথা হংকং, সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া, ব্রুনাই, দক্ষিণ কোরিয়া এবং জাপানের নাগরিকত্ব গ্রহণ করবেন, তাদের ক্ষেত্রেও পাসপোর্টের আবেদন করার সময় দ্বৈত নাগরিকত্বের সনদের প্রয়োজন হবে না মর্মে গেজেট প্রকাশ করে। 

আবার নির্বাচন কমিশন সচিবালয়ের নির্বাচন সহায়তা-২ শাখার ১২ এপ্রিল ২০২২ তারিখের প্রজ্ঞাপন অনুযায়ী নিউজিল্যান্ড এবং অস্ট্রেলিয়ার নাগরিকত্ব গ্রহণকারী বাংলাদেশিদের ক্ষেত্রেও বাংলাদেশের পাসপোর্ট গ্রহণের সময় দ্বৈত নাগরিকত্বের সনদের প্রয়োজন হবে না। উপরিউক্ত সব দেশের নাগরিকত্ব গ্রহণের শপথ গ্রহণে বাংলাদেশের নাগরিকত্ব বিষয়ে কোনো বক্তব্য থাকতে পারবে না, মর্মে সব গেজেটে উল্লেখ করা হয়েছে। যদি তারা এমন শপথ গ্রহণ করে থাকেন, তখন বাংলাদেশের পাসপোর্টের জন্য আবেদন করলে তাদের ক্ষেত্রে দ্বৈত নাগরিকত্বের সনদের প্রয়োজন হবে।

দ্বৈত নাগরিকত্ব বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়, তাই এর সঠিক ব্যবহার এবং সুযোগ-সুবিধা সম্পর্কে দ্বৈত নাগরিকদের অবহিত করা অত্যন্ত জরুরি। ঠিক তেমনি দ্বৈত নাগরিকত্বের সনদপ্রাপ্তিও যেন ভোগান্তির কারণ না হয় সেদিকে সংশ্লিষ্টদের নজর দিতে হবে। 

তবে দ্বৈত নাগরিকত্বের বিষয়ে সার্বক্ষণিক পর্যবেক্ষণ প্রয়োজন, যেন কোনো অসাধু ব্যক্তি এর সুযোগ না নিতে পারে। আর এই জন্য ‘নাগরিকত্ব আইন ২০১৬’ অতি দ্রুত বলবৎ করা উচিত। এতে করে নাগরিকত্ব এবং দ্বৈত নাগরিকত্ব দুটি বিষয়ই সার্বিক পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে এগুলোর  সুব্যস্থাপনা নিশ্চিত করা যাবে এবং নাগরিকরাও তাদের অধিকার সম্পর্কে সচেতন হতে পারবেন। একই সঙ্গে দ্বৈত নাগরিকদের পাসপোর্ট সংক্রান্ত ভোগান্তিও অনেকাংশে কমবে।

লেখক: উপ-পরিচালক 
বিভাগীয় পাসপোর্ট ও ভিসা অফিস, বরিশাল
[email protected]

মোদির হিন্দুত্ববাদের অস্ত্র এবং দুশ্চিন্তার ভাঁজ

প্রকাশ: ১৩ মে ২০২৪, ১০:৫৫ এএম
মোদির হিন্দুত্ববাদের অস্ত্র এবং দুশ্চিন্তার ভাঁজ
সুখরঞ্জন দাশগুপ্ত

তৃতীয় দফার নির্বাচন শেষ হওয়ার পরও সরকারপক্ষ, অর্থাৎ নরেন্দ্র মোদির দল বিজেপি এবং আরএসএস নিশ্চিত হতে পারছে না, তারা ৪০০ আসন পাবে কি না। নির্বাচন শুরুর অনেক আগে থেকেই প্রচারে নেমেছেন নরেন্দ্র মোদি, অমিত শাহ এবং আরএসএস-প্রধান মোহন ভাগবত।

তাদের কোনো বক্তৃতায় উন্নয়ন, বেকারত্ব, দারিদ্র্য, দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির কথা নেই। শুধু গান্ধী পরিবারকে কুৎসিত ভাষায় গালাগালি রয়েছে। যেসব শব্দ তারা ব্যবহার করছেন টিভির পর্দায় সরাসরি দেখালেও ছাপার অক্ষরে তা লেখা যায় না।

সাত দফার মধ্যে তিন দফা ভোট গ্রহণ হয়ে গেলেও মোদি এখনো ৪০০ আসন পাওয়ার ব্যাপারে নিশ্চিত নন। গোড়া থেকেই ৪০০ আসন পেয়ে সংবিধান সংশোধনের যে ডাক তিনি দিয়েছেন, তা কতটা কার্যকর হবে, নিজেও জানেন না।

সংবিধান সংশোধন করে সংখ্যালঘু মুসলিমদের গো-মাংস ভক্ষণ বন্ধ করতে চাইছে মোদি সরকার। তৃতীয় দফার নির্বাচনের পর মোদি এখন উন্নয়ন-সংক্রান্ত সব কথাবার্তা বাদ দিয়ে গান্ধী পরিবার এবং সংখ্যালঘু দমন নিয়ে পড়েছেন। এ বিষয়ে নির্বাচন কমিশনের কাছে অভিযোগ জানিয়েছিলেন কংগ্রেসের সর্বভারতীয় সভাপতি মল্লিকার্জুন খাড়গে। কিন্তু মোদি সে অভিযোগের এখনো কোনো জবাব দেননি।

বিজেপি-আরএসএসের কটূক্তির জবাব দিয়েছেন কংগ্রেস ওয়ার্কিং কমিটির সদস্য, তথা ইন্দিরা গান্ধীর নাতনি প্রিয়াঙ্কা গান্ধী। প্রিয়াঙ্কা মোদিকে সতর্ক করে দিয়ে বলেছেন, গান্ধী পরিবার শহিদ পরিবার। শহিদ পরিবারকে অপমান করা ভারতবর্ষের মানুষ মেনে নেবে না। তিনি বলেন, আমার ঠাকুমা ইন্দিরা গান্ধীকে যেভাবে হত্যা করা হয়েছিল, সে ব্যাপারে বিজেপি আরএসএসের কোনো ক্ষোভ, দুঃখ কিছুই নেই। আর ৯১ সালে নির্বাচনি প্রচারে গিয়ে দক্ষিণ ভারতে তিরুঅনন্তপুরমে মানববোমার হানায় আমার বাবার দেহটা ছিন্নবিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। সেই দৃশ্য দেখেও আরএসএস উল্লসিত হয়েছিল। কেন হয়েছিল তা জানি না। তবে এই আরএসএসেরই অপর এক ব্যক্তি মহাত্মা গান্ধীকে হত্যা করেছিল। এসব ঐতিহাসিক ঘটনা মোদিজির মনে পড়ে না। আমি তাকে বিনয়ের সঙ্গে বলতে চাই, এ ধরনের প্রচার আপনি বন্ধ করুন। আমার দাদা রাহুল গান্ধী দুই বছর ধরে দেশের এক প্রান্ত থেকে অপর প্রান্তে ঘুরেছেন। দেখেছেন মানুষের দুর্দশা, হতাশা। তিনি অন্যায়ের বিরুদ্ধে ন্যায় আনার জন্যই কংগ্রেসের নির্বাচনি ইশতেহারে অন্যায়ের বিরুদ্ধে ন্যায় করার কথা ঘোষণা করেছেন।

শুধু কংগ্রেস নয়, গত তিন-চার দিন ধরে INDIA জোটের সব শরিকই পৃথকভাবে বিবৃতি দিয়ে রাহুলের দাবি সমর্থন করেছেন। প্রিয়াঙ্কার বক্তব্যের পরও বিজেপি-আরএসএস মুখে কুলুপ এঁটে আছে। বুধবারও বিভিন্ন জনসভায় মোদির বক্তব্য- সংখ্যালঘু মুসলমানদের বিশেষ কোনো সুযোগ-সুবিধা দেওয়া হবে না। বিজেপি দেবে না।

ইন্ডিয়ান ইউনিয়ন অব মুসলিম লিগ প্রধান আসাফউদ্দিন ওয়েইসি বলেছেন, আমি কংগ্রেসবিরোধী। কিন্তু রাহুলের সংখ্যালঘু সংরক্ষণের প্রস্তাব পূর্ণ সমর্থন করি। চিরদিনের কংগ্রেসবিরোধী আসামের রাজনীতিবিদ বদরুদ্দিন বুধবার একাধিক জনসভায় বলেছেন, মুসলিমদের সংরক্ষণ নিয়ে রাহুলের চিন্তার সঙ্গে আমরা সম্পূর্ণ একমত।

শুধু রাজনৈতিক নেতারা নন, দিল্লির একটি সর্বভারতীয় ইংরেজি চ্যানেল এ বিষয়ে একটি সমীক্ষা চালায়। সেই সমীক্ষায় দেখা গেছে, ৯৬ শতাংশ মানুষই রাহুলের এই প্রস্তাবে সমর্থন জানিয়েছেন।

INDIA জোটের সংসদীয় বোর্ডের চেয়ারম্যান, তথা সাবেক কংগ্রেস সভানেত্রী সোনিয়া গান্ধী মঙ্গলবার মধ্যপ্রদেশে নির্বাচনি প্রচারে গিয়ে বলেছেন, রাজনৈতিক ফায়দার জন্যই ঘৃণাভাষণ দিয়ে চলেছেন নরেন্দ্র মোদি। তিনি আরও বলেন, হঠাৎই উন্নয়নের প্রচার বাদ দিয়ে সুস্পষ্ট মেরূকরণের পথে হাঁটছেন মোদি। ‍তৃতীয় দফার ভোটপর্বে মোদি অস্ত্র করেছেন ‘ভোট জিহাদ’কে। তীব্র ঘৃণাভাষণ ছড়িয়ে মোদিকে এ কথাও বলতে শোনা গেছে যে, বিজেপিকে ৪০০ আসন পাইয়ে দিতেই হবে। তা না হলে রামমন্দিরে তালা দিয়ে দিতে পারে কংগ্রেস।

এ প্রসঙ্গে মোদি সরাসরি কংগ্রেসকেই দায়ী করছেন। অর্থাৎ মোদির অভিযোগ ভোট জিহাদের নামে একটা নির্দিষ্ট ধর্মের লোকদের একজোট হয়ে বিজেপির বিরুদ্ধে ভোট দিতে বলছেন রাহুল গান্ধী। এদিকে কংগ্রেসসহ বিরোধীরা বলছে, প্রচারে আসলে মোদির হাতে কোনো ইতিবাচক অস্ত্র নেই। তাই ফের কড়ামাত্রার হিন্দুত্বের দিকেই ঝোঁক মোদি এবং অমিত শাহর। আর মোদির এই অস্ত্রকে ভোঁতা করতে কংগ্রেস মূলত তাদের আর্থসামাজিক প্রচারকেই তুলে ধরছে। সোনিয়া গান্ধীও এক ভিডিও বার্তায় বলেছেন, দেশের যুব সম্প্রদায় চরম বেকারত্বের সম্মুখীন। রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞরাও একই কথা বলছেন- এবার ভারতের নির্বাচনে ‘রাম’ আর মানুষ খাচ্ছে না।

লেখক: ভারতের সিনিয়র সাংবাদিক

উপজেলা নির্বাচনের প্রথম ধাপ কী দেখাল?

প্রকাশ: ১৩ মে ২০২৪, ১০:৫২ এএম
উপজেলা নির্বাচনের প্রথম ধাপ কী দেখাল?
রাজেকুজ্জামান রতন

উপজেলা নির্বাচনের প্রথম ধাপের ফলাফল পাওয়া গেছে। ষষ্ঠ উপজেলা নির্বাচন সরকারের পরিকল্পনা এবং প্রত্যাশা অনুযায়ী অনুষ্ঠিত হলেও কিছু নতুন সিদ্ধান্ত, নির্দেশনা আর দলীয় শৃঙ্খলাভঙ্গের নানা দৃষ্টান্ত তৈরি হয়েছে এই নির্বাচনে। স্থানীয় পর্যায়ের নির্বাচনে দলীয় প্রতীক নিয়ে নির্বাচন করার সিদ্ধান্ত যেমন আওয়ামী লীগ সরকারের, তেমনি এবারে প্রতীকবিহীন নির্বাচনের সিদ্ধান্তও আওয়ামী লীগের। এই সিদ্ধান্তকে নির্বাচনের গুণগত মান বৃদ্ধির চাইতেও নির্বাচনে দলীয় প্রার্থীদের বিজয়ী করে নিয়ে আসা এবং ভোটার উপস্থিতি বৃদ্ধির কৌশল বলেই মনে করা হয়েছে। এত কৌশলের পরও নির্বাচনে ভোটারের উপস্থিতি কম কেন, বিষয়টা গুরুত্বের সঙ্গে ভাবা দরকার। দেখা যাচ্ছে, এযাবৎকালে অনুষ্ঠিত উপজেলা নির্বাচনের মধ্যে সর্বনিম্ন ভোটার উপস্থিতি হয়েছে এই নির্বাচনে।
 
দেশে ষষ্ঠবার এবং আওয়ামী লীগ সরকার গঠনের পর এ নিয়ে চতুর্থবার উপজেলা নির্বাচন অনুষ্ঠিত হচ্ছে, যার প্রথম ধাপে নির্বাচন হলো ৮ মে, দ্বিতীয় ধাপের নির্বাচন ২৩ মে, তৃতীয় ধাপ ২৯ মে এবং চতুর্থ ও শেষ ধাপের নির্বাচন হবে ৫ জুন। প্রথম ধাপে ১৫২টি উপজেলা পরিষদে নির্বাচনের জন্য গত ২১ মার্চ তফসিল ঘোষণা করে নির্বাচন কমিশন। এর মধ্যে মামলাসহ অন্যান্য কারণে আটটি উপজেলার নির্বাচন স্থগিত হয়। চেয়ারম্যান, ভাইস চেয়ারম্যান ও মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান- এই তিনটি পদের সব প্রার্থী বিনা ভোটে নির্বাচিত হয়েছেন পাঁচ উপজেলায়। ফলে ৮ মে ১৩৯টি উপজেলায় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। 

ষষ্ঠ উপজেলা নির্বাচনের প্রথম ধাপের ১৩৯ উপজেলা নির্বাচনে চেয়ারম্যান পদে গড়ে ৩৬ দশমিক ১ শতাংশ ভোট পড়েছে বলে ৯ মে নির্বাচন কমিশনার মো. আলমগীর জানান। নির্বাচন ভবনে অনুষ্ঠিত সংবাদ সম্মেলনে তিনি এ তথ্য জানান। তিনি বলেন, বুধবারের (৮ মে) প্রথম ধাপের নির্বাচনে ৩৬ দশমিক ১ শতাংশ ভোট পড়েছে। এর মধ্যে ইভিএমে প্রদত্ত ভোটের হার ৩১ দশমিক ৩১ শতাংশ, ব্যালটে ৩৭ দশমিক ২২ শতাংশ।

গত ৮ মে ভোট শেষ হওয়ার পর প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কাজী হাবিবুল আউয়াল নির্বাচন ভবনে সংবাদ ব্রিফিংয়ে বলেছিলেন, অনেক ভোটার ধান কাটায় ব্যস্ত থাকায় ভোটকেন্দ্রে আসেননি। ভোটার বেশি এলে নির্বাচন আরও ভালো হতো। নির্বাচনে ভোট পড়ার হার ৩০ থেকে ৪০ শতাংশ হতে পারে জানিয়ে সিইসি বলেছিলেন, সকালে বৃষ্টি হয়। আবার ধান কাটার মৌসুম বিধায় ভোট পড়ার হার কম হতে পারে। ভোটাররা ধান কাটতে থাকায় ভোটকেন্দ্রে আসেননি, এটা জানতে পেরেছি। এ ছাড়া কিছু কিছু জায়গায় ঝড়বৃষ্টি হয়েছে। ভোটার বেশি এলে আরও বেশি ভালো হতো। 

এর আগে সর্বশেষ ২০১৯ সালের পঞ্চম উপজেলা নির্বাচনে গড়ে ৪১ শতাংশের বেশি ভোট পড়েছিল। ওই নির্বাচনে প্রথমবারের মতো দলীয় প্রতীকে ভোট হলেও বিরোধী দলগুলো নির্বাচন বর্জন করে। আর ২০১৪ সালে চতুর্থ উপজেলা ভোটে ৬১ শতাংশ এবং ২০০৯ সালে তৃতীয় উপজেলা নির্বাচনে ৬৭ দশমিক ৬৯ শতাংশ ভোট গণনা করা হয়েছিল। এর আগে ১৯৯০ সালে দ্বিতীয় উপজেলা নির্বাচন এবং ১৯৮৫ সালে প্রথম উপজেলা নির্বাচনে কত ভোট পড়েছিল সে বিষয়ে কোনো সঠিক তথ্য জানা যায়নি। ফলে যতটুকু ধারণা করা যায় তাতে উপজেলা নির্বাচনগুলোর মধ্যে এবারই সবচেয়ে কম ভোটার উপস্থিতি ঘটেছে। 

অথচ প্রার্থী বাড়ানোর মাধ্যমে ভোটার উপস্থিতি বাড়ানোর কৌশল হিসেবে এবার উপজেলা নির্বাচনে দলীয় প্রতীক বরাদ্দ দেয়নি ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। পাশাপাশি নির্বাচন যাতে নিজ দলের মধ্যেই প্রতিদ্বন্দ্বিতাহীন না হয় বা বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় ব্যাপক প্রার্থী নির্বাচিত না হয়, সে কারণে নির্বাচনকে প্রভাবমুক্ত রাখতে মন্ত্রী-এমপির স্বজনকে নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়াতে কেন্দ্রীয়ভাবে নির্দেশ দেওয়া হয়। তবে কেউই ওই নির্দেশনা কানে তোলেননি। পরবর্তী সময়ে অবশ্য বলা হয়, স্বামী-স্ত্রী ও সন্তানের বাইরে বাকিরা নির্বাচন করতে পারবেন। ২০১৯ সালের উপজেলা ভোটে চেয়ারম্যান পদে ১১৫ জন বিনা ভোটে জয়ী হলেও এবার প্রথম ধাপে মাত্র পাঁচটি উপজেলায় সব প্রার্থী বিনা ভোটে জয়ী হয়েছেন। ফলে সেই বিবেচনায়ও ভোটার উপস্থিতি বেশি থাকার কথা ছিল। কিন্তু তা হয়নি। নির্বাচন কমিশন ভোটার উপস্থিতি নিয়ে তথ্য দিলেও সংবাদ মাধ্যমে জানা যায়, দিনভর কেন্দ্রগুলো প্রায় ভোটারশূন্য ছিল। অবশ্য নির্বাচনের দিন ইসি সচিব জাহাংগীর আলম জানিয়েছিলেন, প্রথম চার ঘণ্টায় ভোটার উপস্থিতির হার ১৫ থেকে ২০ শতাংশ।

স্থানীয় পর্যায়ে নির্বাচন হবে কিন্তু ভোটার উপস্থিতি থাকবে না বা কম হবে, এটা গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। কিন্তু ভোটারদের আগ্রহ কমতে শুরু হয়েছিল প্রধানত পঞ্চম উপজেলা নির্বাচনের সময় থেকে। সেবারই প্রথমবারের মতো দলীয় প্রতীকে অনুষ্ঠিত হয়েছিল উপজেলা নির্বাচন। ২০১৮ সালের বিতর্কিত জাতীয় নির্বাচনের প্রেক্ষাপটে ২০১৯ সালের পঞ্চম উপজেলা নির্বাচন বিরোধী দলগুলো বর্জন করায় তখন ভোটের হারে ধস নামে। ফলে ধান কাটা, বৃষ্টি, গরম এসবের কিছু প্রভাব থাকলেও মূলত বিরোধী দলের অনুপস্থিতি বা ভোট বর্জন এবারের নিম্নহারের ভোটের প্রধান কারণ। মূল কারণ দূর না করলে অজুহাত যতই দেওয়া হোক না কেন, ভোটাররা নির্বাচনে আগ্রহী হবে না, এই সত্য মেনে নেওয়ার সময় এসেছে। 

পঞ্চম উপজেলা নির্বাচনে যে ব্যাপক প্রভাব বিস্তার ও অনিয়মের ঘটনায় এক-চতুর্থাংশ উপজেলায় বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছিল, তা নিয়ে সরকারি দলের শরিক দলের নেতারা জাতীয় সংসদে সোচ্চার হয়েছিলেন। সরকারি দলের নীতিনির্ধারকরা এই প্রতিবাদ, অভিযোগ বা অনুযোগ যে কানেই তোলেননি, সেটা পরবর্তী সময়ে তাদের সিদ্ধান্ত ও কর্মকাণ্ডে পরিষ্কার ফুটে উঠেছে। সংবিধানের কথা মেনে চলবেন বলে যে অঙ্গীকার প্রতিনিয়ত ক্ষমতাসীন দলের পক্ষ থেকে করা হয় সেই সংবিধানের ৫৯(১) অনুচ্ছেদে ‘আইনানুযায়ী নির্বাচিত ব্যক্তিদের সমন্বয়ে গঠিত প্রতিষ্ঠানগুলোর ওপর প্রজাতন্ত্রের প্রত্যেক প্রশাসনিক একাংশের স্থানীয় শাসনের ভার প্রদান’ করার নির্দেশনা আছে। কিন্তু ভোটারদের প্রাণবন্ত অংশগ্রহণ ছাড়া নির্বাচনের মাধ্যমে স্থানীয় শাসনের ভার যাদের ওপর প্রদান করা হয়, তাতে সংবিধানের মর্যাদা এবং নির্বাচনের সংস্কৃতি কোনোটাই তো রক্ষা হয় না। 

নির্বাচনকে ভোটারবিহীন করে আনুষ্ঠানিকতাসর্বস্ব বিষয়ে পরিণত করার ফল কি ভালো হবে? স্থানীয় শাসন থেকে জাতীয় সংসদ সর্বত্র কি মানুষ একই চিত্র দেখবে? ভোটাররা যদি ভোটে আগ্রহ হারিয়ে ফেলে, ঘোষিত জনপ্রতিনিধিরা জবাবদিহিহীন হয়ে পড়ে আর প্রশাসন দায়হীন আচরণ করতে থাকে, তাহলে গণতন্ত্র একটি চর্চাহীন শব্দগুচ্ছে পরিণত হয়ে পড়ে। বাংলাদেশে এখন সেটাই দেখা যাচ্ছে। এটা শুধু গণতন্ত্রহীন পরিবেশ তৈরি করে তাই নয়, ওপর থেকে সর্বনিম্ন স্তর পর্যন্ত স্বেচ্ছাচারিতার জন্ম দেয়। ক্ষমতাসীনদের দাপট সমাজে গণতন্ত্রহীন পরিবেশ তৈরি করে। পাশাপাশি জন্ম দেয় প্রতিশোধপরায়ণ মানসিকতার। যার বিষময় ফল ভোগ করতে হয় পরবর্তী প্রজন্মকে। উপজেলা শুধু দেশের গুরুত্বপূর্ণ প্রশাসনিক স্তর নয়, গণতন্ত্র চর্চার অন্যতম জায়গা। সেই নির্বাচনে যদি গণতন্ত্র ও জবাবদিহির চর্চা না হয়, তাহলে দেশের জনগণের আস্থা অর্জিত হবে কীভাবে? উপজেলা নির্বাচনের প্রথম ধাপ সেই প্রশ্ন ও আশঙ্কা আবার তুলে ধরল। 

লেখক: সদস্য, কেন্দ্রীয় কমিটি, বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল (বাসদ)
[email protected]