যুদ্ধ বন্ধ না করলে পশ্চিমাদেরই ক্ষতি । খবরের কাগজ
ঢাকা ৫ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১, রোববার, ১৯ মে ২০২৪

যুদ্ধ বন্ধ না করলে পশ্চিমাদেরই ক্ষতি

প্রকাশ: ০৫ মে ২০২৪, ১১:০৯ এএম
যুদ্ধ বন্ধ না করলে পশ্চিমাদেরই ক্ষতি
মুন্সি ফয়েজ আহমেদ

অস্ত্র ও অর্থ দিয়ে গণহত্যা টিকিয়ে রেখেছে পশ্চিমারা। এখন অবস্থা এমন হয়েছে যে ইসরায়েল যুদ্ধ বন্ধ না করলে যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমাদের ক্ষতি হবে। চলমান বিক্ষোভের বিশ্বব্যাপী একটি প্রভাব তো আমরা দেখতে পাচ্ছি। মার্কিন রাজনীতিবিদরা অস্থির হয়ে পড়েছেন। তারা কী করবেন বুঝতে পারছেন না।

এসব বিক্ষোভের কারণে হয়তো যুদ্ধ থামানোর চেষ্টা করতে পারে সব পক্ষ। পাশাপাশি যুক্তরাষ্ট্র সারা বিশ্বে মানবাধিকার নিয়ে যে লেকচার দিত, সেই লেকচার তাদের ফিরিয়ে দেওয়ার সময় এসেছে বলে মনে হচ্ছে। এবার তারা উলঙ্গভাবে ধরা পড়েছে। তারা যদি লজ্জা পায়, তাহলে তো ভালো। তবে তারা ইতোমধ্যে প্রমাণ করেছে তাদের লজ্জা নেই।

এসব বিক্ষোভ ও মার্কিনবিরোধী মনোভাব দেশটির নির্বাচনের ওপর প্রভাব ফেলবে। কারণ যুক্তরাষ্ট্রের পুরো রাজনীতিই বিক্রি হয়ে আছে জায়োনিস্ট অর্থনীতির ওপর। যা-ই হোক, আমরা আশা করব যে পৃথিবীব্যাপী যে গণজাগরণ দেখছি যুদ্ধ বন্ধের ব্যাপারে, সেটির একটি পজিটিভ রেজাল্ট দেখব। ইইউর অনেক দেশ ফিলিস্তিনকে স্বাধীন হিসেবে স্বীকৃতি দিতে চাইছে। এটি ভালো পদক্ষেপ। অবশেষে তারা উপলব্ধি করতে পেরেছে।

সাবেক রাষ্ট্রদূত

পরিবেশগত যুদ্ধাপরাধের বিচার চাওয়ার সময় এসেছে

প্রকাশ: ১৮ মে ২০২৪, ১১:১০ এএম
পরিবেশগত যুদ্ধাপরাধের বিচার চাওয়ার সময় এসেছে
মেরি রবিনসন ও মার্গট ওয়ালস্ট্রোম

যুদ্ধ সব সময় ব্যক্তি, সম্প্রদায় এবং জাতির জন্য ভয়াবহ। যুদ্ধের ফলে মানুষের জীবন যে কতভাবে বিপর্যয়ের শিকার হয়, বিশ্বে তা প্রতিনিয়ত দেখা যাচ্ছে। অবিলম্বে এ বিষয়ে মনোযোগ, সমবেদনা এবং পদক্ষেপের দাবি রাখে। যদিও কিছু লঙ্ঘন স্পষ্ট, কিন্তু সেগুলো তদন্ত করা ও আশ্রয় দেওয়ার যেসব প্রতিষ্ঠান রয়েছে, সেগুলো ততটা স্পষ্ট নয়। তার মধ্যে অন্যতম উদাহরণ হলো পরিবেশগত যুদ্ধাপরাধ।

আমরা ইতোমধ্যে বায়ু, জল এবং প্রাকৃতিক পরিবেশের ওপর যুদ্ধের প্রভাবের সম্পূর্ণ পরিমাণ বুঝতে শুরু করেছি। মাটি ও কৃষি, শক্তি ও জল অবকাঠামো এবং শেষ পর্যন্ত জনস্বাস্থ্য এবং নিরাপত্তার ওপর যুদ্ধের প্রভাব চরম আকারে পড়েছে। চ্যালেঞ্জ হলো, এর অনেক কিছুই সহজে দেখা যায় না এবং এসব বিষয়ে কখনো গবেষণা করা হয়নি। যুদ্ধের ভয়াবহতা আমরা যা দেখি তা নামেমাত্র দৃশ্যমান। যুদ্ধকবলিতদের সংখ্যা কল্পনার চেয়ে অনেক বেশি হতে পারে।

যেখানে ভেঙে পড়া ভবন রয়েছে, সেখানে প্রাণঘাতী অ্যাসবেস্টস এবং সিলিকা ধুলো বাতাসে ছড়িয়ে পড়তে পারে। যেখানে ল্যান্ডমাইন এবং অবিস্ফোরিত বোমা, ভারী ধাতু এবং অন্যান্য শক্তিশালী দূষণকারী পদার্থ ছড়িয়ে থাকতে পারে। এর মধ্যেই কিছু প্রজন্ম জীবন ধারণ করে চলছে। যেখানে হ্রদ ও কষিজমি বিষাক্ত হয়ে ওঠে, সেখানে খাদ্যনিরাপত্তা ক্ষতিগ্রস্ত হয়।

আজকের আন্তর্জাতিক আইনে ইতোমধ্যেই এমন যুদ্ধাপরাধের বিচারের আওতায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে, যা পরিবেশের ব্যাপক ক্ষতি করে। তবে এ ধরনের অপরাধের বিচার স্থানীয় বা আন্তর্জাতিক আদালতে বিরল ঘটে। এ ধরনের ক্ষতির জন্য ক্ষতিপূরণও অনেক কম। 

কিছু ইতিবাচক লক্ষণ আছে, এটি পরিবর্তন হতে পারে। জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদ ২০২২ সালে সশস্ত্র সংঘাতের ক্ষেত্রে পরিবেশ সুরক্ষার বিষয়ে একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রস্তাবে এই বিষয়টির প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিল। সেখানে উল্লেখ করা হয়েছিল, যুদ্ধে অন্যায়ভাবে যারা পরিবেশের ক্ষতি করবে, সম্পূর্ণ ক্ষতিপূরণ সেই সব  রাষ্ট্রকে দিতে হবে। মার্চের ১ তারিখে জাতিসংঘের পরিবেশ পরিষদ একটি সর্বসম্মত প্রস্তাব পাস করেছে, এতে সশস্ত্র সংঘাতে পরিবেশগত ক্ষতি সম্পর্কে আরও তথ্য সংগ্রহের আহ্বান জানানো হয়।

আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের প্রসিকিউটর করিম খান ঘোষণা করেছেন, তার কার্যালয় পরিবেশগত অপরাধের ওপর ব্যাপক নীতি প্রণয়ন করছে। এই অপরাধের জন্য জবাবদিহি করতে হবে। 

বাস্তব একটি চ্যালেঞ্জ হলো, পরিবেশের ক্ষতি পরিমাপ করা বিশেষ করে যখন সংঘর্ষ চলে। কিন্তু জনস্বাস্থ্য রক্ষা এবং ক্ষতি কমানোর জন্য জরুরি ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য এটি খুবই দরকার; যেমন নদী বা কৃষিজমিতে মারাত্মক দূষণ ছড়িয়ে পড়া বন্ধ করা। ক্ষয়ক্ষতির নথিভুক্ত করাও গুরুত্বপূর্ণ, যাতে সম্পূর্ণ ক্ষতিপূরণ প্রদান করা সম্ভব হয়। যদি যুদ্ধের অপব্যবহার বা বেআইনি কাজের কারণে হয়, তাহলে অপরাধীদের জবাবদিহি করা যাবে। 

ইউক্রেনে রাশিয়ার পূর্ণ মাত্রায় আগ্রাসন প্রাকৃতিক পরিবেশে ভয়াবহ প্রভাব ফেলেছে। ইউক্রেন চিত্তাকর্ষক জীববৈচিত্র্য ও প্রাকৃতিক সম্পদের একটি দেশ, কিন্তু যুদ্ধ অনেক এলাকা ধ্বংস করে দিয়েছে। মাটি এবং জলপথ রাসায়নিক মিশ্রণে দূষিত হয়েছে। অন্যদিকে কৃষিজমি, বন এবং সবুজ স্থানগুলো গোলাবর্ষণ, আগুন এবং বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এক বছর আগে কাখোভকা বাঁধ ধ্বংস, যা দখলদার রাশিয়ান বাহিনীর ইচ্ছাকৃত কাজ বলে মনে করা হয়। এর ফলে গ্রাম ও কৃষিজমি প্লাবিত হয় এবং কৃষ্ণ সাগরের সর্বত্র ব্যাপক পরিবেশদূষণ হয়।

ইউক্রেনের এক-তৃতীয়াংশ অঞ্চল ল্যান্ডমাইন বা অবিস্ফোরিত বোমায় দূষিত বলে সন্দেহ করা হচ্ছে, যা বিশ্বের অন্য যেকোনো দেশকে ছাড়িয়ে গেছে। আমরা ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কির সাহসী উদ্যোগে যোগ দিয়ে পরিবেশগত উদ্বেগগুলোকে বিশ্বের নজরে আনার প্রচেষ্টায় অংশগ্রহণ করেছি। 

প্রেসিডেন্ট ইউক্রেন যুদ্ধের পরিবেশগত পরিণতি নিয়ে উচ্চস্তরের কর্মশালা গ্রুপ তৈরি করেছেন। তার সদস্য হতে পেরে আমরা সন্তুষ্ট। তিনি যুদ্ধ শেষ হওয়ার জন্য একটি কাঠামো প্রস্তাব করেছেন; যেখানে শান্তি প্রতিষ্ঠার মূল উপাদান হিসেবে থাকবে পরিবেশগত সুরক্ষা।

প্রথমত, পরিবেশগত ক্ষয়ক্ষতি নথিভুক্ত করার জন্য আধুনিক প্রযুক্তিকে কাজে লাগাতে সুস্পষ্ট নির্দেশিকা প্রতিষ্ঠা করতে হবে। এ ধরনের মান প্রতিষ্ঠার জন্য আন্তর্জাতিক অংশীদারদের সঙ্গে কাজ করতে হবে। ইউক্রেন তার সব সংঘাতে পরিবেশগত ক্ষতির নথিভুক্ত করার নির্দেশনায় সাহায্য পাবে। 

দ্বিতীয়ত, এ তথ্য ও প্রমাণ হাতে নিয়ে আমাদের অবশ্যই অপরাধীকে জবাবদিহির আওতায় আনতে হবে। তাদের কাছ থেকে সম্পূর্ণ ক্ষতিপূরণ আদায় নিশ্চিত করতে হবে। জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক পর্যায়ে পরিবেশগত দূষণ কমানোর প্রচেষ্টা চলছে।

পরিবেশগত ন্যায়বিচারের জন্য একটি জাতীয় কৌশল তৈরি করেছে ইউক্রেনের প্রসিকিউটর জেনারেল। আন্তর্জাতিক পর্যায়ে সর্বজনীন ক্ষমতা প্রয়োগ করে আদালতে এই অপরাধগুলোর বিচারের জন্য আরও বেশি মনোযোগ দিতে হবে। 

পরিবেশগত ক্ষতি এবং প্রয়োজনীয় প্রতিকার বোঝার জন্য তদন্তকারী এবং প্রসিকিউটরদের শিকারকেন্দ্রিক পদ্ধতি অবলম্বন করা উচিত। ইউক্রেনের মানবাধিকার তদন্তে পরিবেশগত ক্ষতি এবং জনস্বাস্থ্যের ঝুঁকির দিকে বিশেষভাবে মনোযোগ দেওয়া উচিত।

পরিশেষে কর্মরত গ্রুপটি টেকসই পুনর্গঠনের গুরুত্বের দিকে বেশি জোর দিচ্ছে। জলবায়ু ও পরিবেশের বন্ধুত্বপূর্ণ উন্নয়ন কৌশলগুলোকে অন্তর্ভুক্তি করতে হবে। এই নীতিগুলো প্রয়োগ করার প্রচেষ্টা এখনই শুরু করতে হবে। কারণ ইউক্রেনের কিছু অংশে ইতোমধ্যেই পুনর্নির্মাণের কাজ চলছে।

ইউক্রেনে ন্যায়বিচার এবং সবুজায়ন পুনরুদ্ধার হলে বিশ্বজুড়ে সংঘাত এড়ানো যাবে এবং অন্যান্য দেশের উপকারে আসবে। দুই বছর আগে রাশিয়া যখন ইউক্রেনে তার পূর্ণমাত্রায় আগ্রাসন শুরু করেছিল, তখন ক্রেমলিন আন্তর্জাতিক আইনকে ঝুঁকির মধ্যে ফেলেছিল। রাশিয়ার কর্মকাণ্ড আন্তর্জাতিক আইন ও জাতিসংঘ সনদের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন। ভবিষ্যতের বৈশ্বিক পরিস্থিতি, আইনের স্পষ্ট লঙ্ঘনের জন্য ন্যায়বিচারের প্রত্যাশা, পরিবেশের ওপর ভয়ানক আক্রমণসহ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় কীভাবে এই আগ্রাসনের প্রতিবাদ করে তা নির্ধারণ করা দরকার।

আমরা সবাই জানি যে, পরিবেশগত হুমকি সীমান্তে থেমে থাকে না। ইউক্রেনে পারমাণবিক বিকিরণ বিপর্যয়ের ঝুঁকি রয়েছে। কারণ ইউরোপের বৃহত্তম জাপোরিঝঝিয়া পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র রাশিয়া দখল করে নিয়েছে। ফলে আঞ্চলিক হুমকির বড় উদ্বেগজনক অবস্থায় রয়েছে। আরেকটি হলো কৃষ্ণসাগরে যুদ্ধের প্রভাব, যেখানে পরিবেশগত ক্ষতি সামুদ্রিক জীববৈচিত্র্যের ওপর মারাত্মক প্রভাব ফেলছে। সমুদ্রজলের এই গুরুত্বপূর্ণ অংশের সীমান্তবর্তী সব দেশ এর মাধ্যমে ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। 

এখন বিশ্ব সংঘাতে পরিবেশগত অপরাধের মাত্রার প্রতি জনগণ জাগ্রত হচ্ছে। আমাদের অবশ্যই কাজ করতে হবে, যাতে জবাবদিহি অনুসরণ করা হয়। স্বতন্ত্র অপরাধ এবং অপরাধকারী রাষ্ট্রের পরিবেশগত ক্ষতির দায় বহন করতে হবে এবং উভয়ই তা মোকাবিলায় ক্ষতিপূরণ দিতে হবে। 

ইউক্রেনে বিচার হবে। ন্যায়বিচার সব ক্ষেত্রেই সমানভাবে প্রযোজ্য। যেখানে বলপ্রয়োগ আইনের সীমা অতিক্রম করে, সেখানেও সমানভাবে কার্যকর হবে। আসুন, আমরা একসঙ্গে কাজ করি। একটি সবুজ, ন্যায্য এবং শান্তিপূর্ণ ভবিষ্যৎ গড়ে তুলি। 

লেখক: মেরি রবিনসন, আয়ারল্যান্ডের সাবেক প্রেসিডেন্ট
দ্য এল্ডার্সের চেয়ার ও মানবাধিকারবিষয়ক জাতিসংঘের সাবেক হাইকমিশনার 
মার্গট ওয়ালস্ট্রোম, সুইডেনের সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী
আল-জাজিরা থেকে সংক্ষেপিত অনুবাদ: সানজিদ সকাল 

প্রথম কালবৈশাখী

প্রকাশ: ১৮ মে ২০২৪, ১১:০৩ এএম
প্রথম কালবৈশাখী
ড. পবিত্র সরকার

এ বছর তার মতো অভ্যর্থনাযোগ্য আর কিছুই ছিল না। প্রচণ্ড গরম পড়েছিল, কাগজে (রেডিও শোনা হয় না, টেলিভিশনও দেখা হয় না) মার্চ, এপ্রিল- দুই মাসেই কত কত দশকের গরমের রেকর্ড হচ্ছে বলে দেখাচ্ছিল। আর শুধু কাগজ কেন, আমাদের সর্বাঙ্গে যে জীবিত মনুষ্য চর্ম আছে, তা আমার ক্ষেত্রে যথেষ্ট পুরু, কিন্তু সেও হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছিল যে গরম পড়ছে বটে। প্রতিটি পরের দিন আগের দিনটিকে ছাড়িয়ে যাচ্ছে গরমে। আমরা দরদর করে ঘামছি, যেখানে ফ্যানের হাওয়া আড়াল হচ্ছে, সেখানে ঘাম জমছে, বাইরে রোদে বেরোলে শরীরটা ঝাঁকি দিয়ে উঠছে, ফিরে এসে জল বা ওআরএস গিলছি চোঁ-চোঁ করে, ঘুমের মধ্যে নিদ্রাহীনতা এসে হামলা করছে। সকালে কলের জল দেখতে দেখতে গরম হয়ে যাচ্ছে, কল থেকে চোখেমুখে জল দিয়ে স্বস্তি পাচ্ছি না। আমি নিজেকে সর্বহারা ভাবি না, কিন্তু এসি চালাতে গিয়ে মাসের শেষে পিলে চমকে দেওয়া বিদ্যুৎ বিলের কথা ভাবব না, এখনো উচ্চবিত্ততার সেই আরামপ্রদ স্তরে উঠতে পারিনি। দিনক্ষণের হিসেবে আর পারার সম্ভাবনাও নেই। 

তাই আমারও এবারের গরমে, আমার প্রয়াত স্ত্রীর ভাষায়, ‘পাগল-পাগল’ লাগছিল। মনে হচ্ছিল, সহ্যের শেষ সীমায় পৌঁছে গেছি, আর দু-এক ডিগ্রি বাড়লেই প্রাণপাখি খাঁচা ছেড়ে শুট করে পালাবে। খবরের কাগজে দেখলামও বটে যে, দেশে বেশ কয়েকজন বৃদ্ধবৃদ্ধা মারা গেছে গরমে। আগে জানতাম শীতকালই বৃদ্ধবৃদ্ধাদের মরবার পক্ষে প্রশস্ত সময়, এখন দেখছি গরমকালও কম যায় না। যা-ই হোক, এই গরমে ‘এবার আমার গেল বেলা’ গোছের একটা কোটেশন যখন মাথার মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছে, তখন সে এল।

কে? না, বছরের প্রথম কালবৈশাখী। সে যখন দিন তিনেক আগে সন্ধের পর এল, তখন আমি ঘুমোইনি যে বলব, ‘আমি তখন ছিলেম মগন গহন ঘুমের ঘোরে’। তারপর রবীন্দ্রনাথের বর্ণনামতো তার পাল্লায় পড়ে যাব। আসলে সেসব কিছুই হয়নি। এমনকি বললে অবিশ্বাস্য মনে হবে, আমি তার আসা টেরই পাইনি, সম্পূর্ণ জেগে থাকা সত্ত্বেও। আমি ছিলাম আমার বাড়ির পেছনে আমার কম্পিউটারের কুঠুরিতে, কী একটা লেখা নিয়ে ব্যস্ত। ঘরটায় আগে বারান্দা ছিল, এখন কাচের জানালা দিয়ে ঘেরা। তবে সবই বন্ধ থাকে। কম্পিউটারের চাবি টেপায় ব্যস্ত ছিলাম বলে বাইরের আওয়াজকে বাইক, অটো ইত্যাদির স্বাভাবিক চলাচলের আওয়াজ বলে আমার অন্যমনস্কতা বুঝে নিচ্ছিল, এমন সময় আমার গৃহসহায়িকার সেই নাতি, এগারো বছরের সুদীপ মিস্ত্রি দৌড়ে এসে বলল, ‘দাদু, খুব ঝড়বৃষ্টি হচ্ছে!’

শুনে আমার একটা ধাক্কা লাগল। আমার অভ্যস্ত প্রতিবেশে আমি বহাল, আর সেখানে ‘ঝড়বৃষ্টি হচ্ছে’ এই খবরটা আমাকে অন্যের মুখে শুনতে হলো! সারা জীবনে তো এমন কখনো হয়নি! 

পাঠক জানেন, আমি গ্রামের ছেলে, শৈশবের বছর এগারো আমার শহর স্পর্শহীন গ্রামে কেটেছে। আমার বাড়ির সামনেই ছিল দিগন্তব্যাপী শস্যক্ষেত্র- তার আন্তরিক কাজই ছিল উত্তর-পুবের নদী আর গ্রামকে ছেড়ে দিয়ে ওই দক্ষিণের আর পশ্চিমের দিগন্তকে যত দূরে ঠেলে সরিয়ে রাখা যায় তার চেষ্টা, আর দূরের গ্রামের গাছপালাগুলোকে কালো পেনসিলের সামান্য দাগের চেহারা দেওয়া। আমাদের আকাশকে সে টেনেটুনে অনেকটা বাড়িয়ে রেখেছিল, যাতে আমাদের মনে হতো আকাশ শুধু সূর্যোদয় সূর্যাস্তের জায়গা নয়, সে নিজেই একটা ঘটনা। কার্তিক মাসের কৃষ্ণপক্ষের শেষ দিকের রাতে কখনো গ্রামের মাঠে শুয়ে সেই আকাশকে লক্ষ করেছি, দেখেছি অন্তহীন গ্রহ-নক্ষত্রের মেলা তার গভীর থেকে গভীরে ছড়িয়ে গেছে। সেই বিশাল ছড়িয়ে যাওয়া আকাশে দিনের শেষে যখন কালবৈশাখী দেখা দিত তাকে এড়িয়ে যাওয়ার কোনো রাস্তাই আমাদের ছিল না। না, শুধু কাঁচা আম কুড়োনোর স্মৃতি নয়। 

দেখতাম দক্ষিণ-পশ্চিম কোণ থেকে মেঘের স্তর ছুটে আসছে প্রবল বাতাসে সওয়ার হয়ে, গ্রামের গাছগুলোর ঝুঁটি ধরে নাড়তে শুরু করেছে, গাছগুলোর ডালপালা এক দিকে হেলে নুয়ে পড়ছে। শস্যক্ষেত্রের অবস্থাও একই রকম বিপর্যয়কর, কিন্তু সবচেয়ে সংকটজনক ছবি মাঠের গরুবাছুরগুলোর। তারা খুঁটি উপড়ে, গলার দড়িটড়িসুদ্ধ লেজ তুলে ঘরের দিকে দৌড় শুরু করেছে হাম্বা হাম্বা আওয়াজ তুলে, রাখালরা ছুটে গিয়ে তাদের সামলাতে পারছে না। কোথাও গরিবের ঘরের টিনের চাল উড়ে গিয়ে পড়ছে, চতুর্দিকে বিপুল বাজ পড়ার শব্দ আর বিজলির ঝলকানি। মা-কাকিমারা অনেক আগেই উঠোনের তারে শুকোতে দেওয়া শাড়ি-ধুতি তুলে এনেছেন, আর উঠোনে একটা জলচৌকি পেতে দিয়েছেন, যাতে ঝড়বৃষ্টির দেবতা বরুণ একটু শান্ত হয়ে বসেন। 

তারই মধ্যে বৃষ্টি শুরু হয়ে গেল। সব জায়গায় একসঙ্গে নয়। গ্রামে বৃষ্টি একটা দিক থেকে ‘আসত’। আমরা দেখতাম আমাদের ওই বিশাল শস্যভূমির ওপর দিয়ে ভারী ধূসর পর্দা বা দেয়ালের মতো একটা বৃষ্টি এগিয়ে আসছে চরাচর আচ্ছন্ন করবে বলে- দৌড়ে আসছে সে, ওই এল, এল, এসে আমাদের গ্রামকে আচ্ছন্ন করে জলধারা ঢালতে লাগল, গাছপালার বিপন্নতা কেটে গিয়ে যেন একটা উল্লাসে শব্দ শুরু হলো, ‘বৃষ্টি, বৃষ্টি, সারা বছরের তৃষ্ণার তর্পণ!’

আর আমরা ছেলেপুলের দল তখন কী করতাম! প্রায়ই এমন হয়েছে যে সবাই মিলে ওই বৃষ্টিধারার মধ্যে ছুটে বেরিয়ে যেতাম, সর্বাঙ্গে প্রতিটি রোমকূপে ওই বৃষ্টিকে ডেকে নিতাম, কখনো মাঠের ঘাসের ওপরে লুটোপুটি খেতে খেতে। সেই ‘পথের পাঁচালী’র অপু-দুর্গার মতো, ‘পথের পাঁচালী’ তো আমাদেরই শৈশবকে আশ্রয় দিয়েছিল। এখনো এই বৃদ্ধের সারা শরীরে সেই বৃষ্টিজলের প্রথম স্পর্শের স্মৃতি যেন জেগে ওঠে। জেগে ওঠে ধারাস্নান করার অজস্র স্মৃতি। 

হায় ২০২৪-এর কলকাতার শহরতলির প্রথম কালবৈশাখী, এবারকার বীভৎস দাবদাহে তুমি যতই কাঙ্ক্ষিত হও, বরণীয় হও, আমি তো তোমাকে সেই শৈশবের মতো তেমন করে অভ্যর্থনা জানাতেই পারলাম না। আরও লজ্জার কথা যে, তুমি এসেছ তা টেরই পাইনি আমি। আমার শহরতলির আকাশ তো অনেক ছোট, তোমার খেলবার জায়গা, তোমার মহিমা আমরা কেড়ে নিয়েছি। অথচ এই ২০২৪-এর গ্রীষ্মে তোমার মতো প্রার্থিত আর কিছুই ছিল না।

এ বছরের প্রথম কালবৈশাখী, বৃদ্ধ হয়েছি, আমি তোমার কাছে ক্ষমা চেয়ে নিই।

লেখক: ভাষাতাত্ত্বিক পণ্ডিত, শিক্ষাবিদ ও গবেষক এবং সাবেক উপাচার্য, রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয় 

শিক্ষার্থীদের পুথিগত বিদ্যা ও মুখস্থবিদ্যা থেকে সরে আসতে হবে

প্রকাশ: ১৭ মে ২০২৪, ১১:৩১ এএম
শিক্ষার্থীদের পুথিগত বিদ্যা ও মুখস্থবিদ্যা থেকে সরে আসতে হবে
রাশেদা কে চৌধূরী

মাধ্যমিক ও সমমানের পরীক্ষার ফল প্রকাশিত হয়েছে ১২ মে। বরাবরের মতো এবারও পরীক্ষায় ছাত্রীরা এগিয়ে আছে। ছাত্ররা কেন পিছিয়ে, তার কারণ এখনই বলা সম্ভব নয়। প্রধানমন্ত্রী নিজেও এর কারণ খোঁজার কথা বলেছেন। তবে এটার মধ্যে আমরা একটা ধারাবাহিকতা দেখতে পাচ্ছি। এক দিনেই এটা তৈরি হয়নি। বেশ কয়েক বছর ধরেই মেয়েরা আশাব্যঞ্জক ফল নিয়ে ছেলেদের থেকে এগিয়ে আছে। মাধ্যমিকে উত্তীর্ণ সব শিক্ষার্থীকে অভিনন্দন এবং যারা আশানুরূপ করতে পারেনি আগামীতে ভালো করবে, সেই আশাবাদ ও শুভকামনা। 

শিক্ষাক্ষেত্রে সর্বস্তরের মানুষের চাহিদা সৃষ্টি হয়েছে। বিশেষ করে নারীশিক্ষার ব্যাপক বিস্তার ঘটানো সম্ভব হয়েছে। দেশের শিক্ষাব্যবস্থায় সবচেয়ে বড় অর্জন হলো সরকার মেয়েদের শিক্ষার ওপর জোর দিয়েছে। যার ফল আমরা ইতোমধ্যে দেখতে পাচ্ছি। আমাদের মেয়েরা পড়ালেখায় ভালো ফল করছে। স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশে কুদরাত-এ-খুদা শিক্ষানীতি প্রণীত হলেও সেটির বাস্তবায়ন আজ অবধি হয়নি। পরবর্তী সময়ে ২০১০ সালের শিক্ষানীতিতে মৌলিক পরিবর্তনের কথা ছিল। এই শিক্ষানীতিতে একটি স্থায়ী শিক্ষা কমিশন ও একটি সমন্বিত শিক্ষা আইন প্রণয়নের কথাও বলা ছিল। সেই শিক্ষানীতি বাস্তবায়িত হয়নি। আমার মতে, শিক্ষাটা জ্ঞানকেন্দ্রিক না হয়ে পরীক্ষাকেন্দ্রিক হয়ে গেছে। এর ফলে শিক্ষার্থীদের উচ্চশিক্ষায় যাওয়ার আগে বিভিন্ন পাবলিক পরীক্ষায় অবতীর্ণ হতে হয়। 

পৃথিবীর আর কোনো দেশে এত পাবলিক পরীক্ষা নেই। পাবলিক পরীক্ষার মূল যে লক্ষ্য, দক্ষতা ও যোগ্যতা যাচাই, সেটি আমাদের পরীক্ষায় হয় না। পরীক্ষায় ব্যাপক হারে পাস করিয়ে দেওয়ার পরও গবেষণায় ছাত্রছাত্রীরা ভালো করতে পারে না। তার মানে পাবলিক পরীক্ষা তাদের তেমন কোনো কাজে আসে না। যে কারণে নীতিনির্ধারকরাও বিভিন্ন শ্রেণিভিত্তিক পরীক্ষা তুলে দেওয়ার কথা চিন্তা করেছেন। তাহলে হয়তো পরীক্ষাকেন্দ্রিক শিক্ষা থেকে শিক্ষার্থীরা মুক্তি পাবে। পরীক্ষা পাসে দেশে কোচিং-বাণিজ্যের দৌরাত্ম্যও কমবে। জ্ঞানভিত্তিক শিক্ষা কার্যকর হবে। কোচিং-বাণিজ্য ও গাইড বইয়ের ব্যবহার হ্রাস পাবে। আমাদের দীর্ঘদিনের শিক্ষককেন্দ্রিক, মুখস্থনির্ভর শিখন-শেখানো প্রক্রিয়া এবং পরীক্ষানির্ভর মূল্যায়নব্যবস্থাকে পরিবর্তন করে নতুন শিক্ষাক্রমের যে রূপরেখা আমরা দেখেছি, তাতে শিক্ষার্থীকেন্দ্রিক ও পারদর্শিতানির্ভর শিক্ষাব্যবস্থায় রূপান্তর ঘটানোর উপাদান রয়েছে। এর ওপর ভিত্তি করে নতুন শিক্ষাক্রম যথাযথভাবে বাস্তবায়ন হলে পরিবারের শিক্ষাব্যয়ের চাপও কমবে। পরীক্ষানির্ভরতা হ্রাস পাওয়ার কারণে গাইড বই কিংবা কোচিংয়ের ওপর শিক্ষার্থীদের আর নির্ভর করার প্রয়োজন হবে না।

দীর্ঘদিন ধরে এক নিয়মে আবদ্ধ হওয়ার পর সেখান থেকে নতুনভাবে উত্তরণের পথে চলার সময় নানামুখী বিরোধিতাসহ সংকট তৈরি হওয়া অস্বাভাবিক নয়। নতুন শিক্ষাক্রম বাস্তবায়নে মোটাদাগে তিনটি বিষয় আমি গুরুত্বপূর্ণ মনে করি। প্রথমত, শিক্ষকদের দক্ষতা কতটা। যেহেতু এ শিক্ষাক্রমের বাস্তবায়নে শিক্ষকদের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, তাই শিক্ষকের দক্ষতা অত্যন্ত জরুরি। শিক্ষক কীভাবে শিক্ষার্থীকে মূল্যায়ন করবেন, সেই প্রশিক্ষণও  লাগবে। শিক্ষক প্রশিক্ষণে ঘাটতি থাকলে নতুন শিক্ষাক্রম পুরোপুরি বাস্তবায়ন করা কঠিন হবে। এর আগে আমরা দেখেছি এ কারণে সৃজনশীল পদ্ধতি হোঁচট খেয়েছে। দ্বিতীয় বিষয়টি হলো, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সার্বিক অবস্থা ও সক্ষমতা। মহানগরে যেমন অবকাঠামো রয়েছে, প্রত্যন্ত অঞ্চলে তেমনটি না থাকলে সেখানকার শিক্ষার্থীরা তো একই সুফল পাবে না। আর তৃতীয় বিষয় হচ্ছে মনিটরিং। 

শিক্ষাক্রম কীভাবে বাস্তবায়ন হচ্ছে, তার নিয়মিত মনিটরিং না হলে বাস্তবায়ন কঠিন হয়ে পড়বে। শিক্ষকরা কেমন খাপ খাইয়ে নিয়েছেন, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নতুন শিক্ষাক্রম কীভাবে চলছে, শিক্ষা প্রশাসনকে সেটি নিয়মিত তদারক করতেই হবে। তদারকিতে ঘাটতি থাকলে সুফল পাওয়া যাবে না। মনে রাখা প্রয়োজন, আমাদের সর্বস্তরের জনমানুষের মধ্যে শিক্ষার চাহিদা তৈরি হয়েছে। সবাই চায় তাদের সন্তানরা পড়াশোনা করুক। কিন্তু চাহিদা অনুযায়ী সরবরাহে যদি ঘাটতি থাকে, তাহলে আমরা এগোতে পারব না। সময়ে সময়ে যথাযথ তদারকির মাধ্যমে আমাদের ঘাটতি চিহ্নিত করে সেই অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়ার মাধ্যমে সবার জন্য শিক্ষা নিশ্চিত হতে পারে। সে জন্য আরও প্রয়োজন সঠিক সময়ে সঠিক তথ্যনির্ভর পরিকল্পনা, যথাযথ বিনিয়োগ ও সঠিক বাস্তবায়ন। নতুন কারিকুলাম নিয়ে নানা ধরনের মতভেদ সামাজিক যোগাযোগমাধমে দেখা যাচ্ছে। অথচ উন্নত বিশ্বে টিফিন ক্লাসের মধ্য দিয়ে শিক্ষকরা খাবারের পুষ্টিগুণ সম্পর্কে শিক্ষার্থীদের শেখাচ্ছেন এবং বাচ্চারা সেটি এমনভাবে রপ্ত করছে যে তারা মনে রাখছে। 

আমাদের বাচ্চাদের আল্লাহতায়ালা অনেক মেধা দিয়েছেন। যদি শিক্ষকদের সক্ষমতা থাকে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ইচ্ছা থাকে, অভিভাবকদের ইচ্ছা থাকে তারা যেকোনোভাবে খাপ খাইয়ে নিতে পারে। আমি বারবার যে কথাটি বলতে চাই, তা হলো শিক্ষকদের দক্ষতা, সেই সঙ্গে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সক্ষমতা জরুরি। আগে শিক্ষকরা প্রশিক্ষণ নিয়ে এসেও শ্রেণিকক্ষে প্রশিক্ষণের বাস্তবায়ন করেননি। দুনিয়া অনেক বদলে গেছে। আমরা যদি তার সঙ্গে তাল মেলাতে না পারি, তাহলে আমাদের বাচ্চারা আরও অনেক বেশি পিছিয়ে যাবে। আমাদের পুথিগত বিদ্যা ও মুখস্থবিদ্যা থেকে সরে আসতে হবে। ছাত্রছাত্রীরা এতগুলো পরীক্ষা দিয়ে গোল্ডেন জিপিএ পেয়ে ভালো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে আসন পায় না। এই গোল্ডেন এ+ দিয়ে আমি কী করব? এর মাধ্যমে কী প্রমাণিত হয়? পরীক্ষাকেন্দ্রিক যে শিক্ষাব্যবস্থা চালু আছে, তা আমাদের শিক্ষার্থীদের পিছু পা করিয়েছে।

পরিবার থেকেই শিক্ষার্থীদের বিকাশ শুরু করতে হবে। মা-বাবাকে তার সন্তানদের দিকে নজর দিতে হবে। সেই নজর দেওয়া বলতে তাদের জিপিএ-এর বোঝা বাড়িয়ে দেওয়া নয়। বরং তাদের মেধা সুস্থভাবে বিকাশ হচ্ছে কি না, সে দিকটি দেখতে হবে। তারপরের দায়িত্ব বর্তায় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ওপর। শিক্ষকদের দক্ষ করে তৈরি করা। আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার মধ্যেই একটি গলদ আছে। সেটি দূর করতে হবে। ক্রমপরিবর্তনশীল পৃথিবীর সঙ্গে আমরা বদলাইনি। আমরা শিক্ষাক্রমে কোনো বিভাজন থাকার পক্ষে নই। বিজ্ঞান, মানবিক, বাণিজ্য ইত্যাদি বিভাজন করেই আমরা শিক্ষার্থীদের আরেকটি জালের ভেতর ফেলে দিয়েছি। আজকে বিজ্ঞানের শিক্ষার্থীরা মানবিকে যায় না। মানবিকের শিক্ষার্থীরা বিজ্ঞানের ধারেকাছে যায় না। বিভাজনের তো কোনো দরকার নেই। সবাইকে ন্যূনতম কতগুলো বিষয়ে পড়ালেখা করতে হবে এবং স্ব স্ব শ্রেণিক্ষেত্রে পড়ালেখার পাশাপাশি দক্ষতা নিশ্চিত করতে হবে।

এখন যে চ্যালেঞ্জটি, সেটি হলো আগামীর। এরপর কী হচ্ছে? অসংখ্য জিপিএ থাকার কারণে তাদের মধ্যে এবং অভিভাবকদের মধ্যেও উৎসাহ এবং প্রত্যাশার সৃষ্টি হয়েছে। সবাই যেন নামিদামি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষা গ্রহণ করতে পারে। সেখানেই হয়তো একটি হোঁচট খাবে তারা। প্রধানমন্ত্রী বারবার যে কথাটি বলেছেন, সেটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তিনি বলেছেন, পরবর্তী পর্যায়ের জন্য প্রস্তুতি নেওয়া। একই সঙ্গে তিনি বলছেন, শিক্ষার্থীরা যেন সাধারণ শিক্ষায় না গিয়ে উদ্যোক্তা হওয়ার দিকে মনোনিবেশ করে। এখন সে পথেই আমাদের এগোতে হবে। তথ্যপ্রযুক্তির যুগে শুধু শিক্ষিত বেকার হয়ে লাভ নেই। আগামীতে সম্ভাবনাকে আরও ভালোভাবে নিয়ে আসতে হবে। আসনসংখ্যা কিন্তু এসব নামিদামি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সীমিত। কাজেই সেই চ্যালেঞ্জ তো সামনে থাকবেই। এসব কিছু মাথায় নিয়েই প্রস্তুতি নিতে হবে পরবর্তী পর্যায়ের জন্য। সে লক্ষ্যেই এগিয়ে যেতে হবে এবং কিছুতেই হতাশ হওয়া যাবে না।

লেখক: সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা 

মানবতার সম্মেলনে ড. ইউনূসের যোগদান নিয়ে প্রশ্ন

প্রকাশ: ১৭ মে ২০২৪, ১১:২৭ এএম
মানবতার সম্মেলনে ড. ইউনূসের যোগদান নিয়ে প্রশ্ন
ড. সুলতান মাহমুদ রানা

গত ৯ মে Fondazione Fratelli Tutti-এর আমন্ত্রণে দ্বিতীয় Meeting on Human Fraternity সম্মেলনে প্রধান বক্তা হিসেবে বক্তব্য দেওয়ার উদ্দেশ্যে অর্থনীতিবিদ ড. ইউনূস ঢাকা ছেড়েছেন। উল্লেখ্য, ১৭ মে প্যারিস থেকে এমিরেটস এয়ারলাইনসের একটি বিমানে তিনি দেশে ফিরবেন বলে জানা গেছে। নোবেল শান্তি পুরস্কারপ্রাপ্ত প্রায় ৩০ জনকে এই সভায় যোগ দিতে আমন্ত্রণ জানানো হয়। অনিশ্চয়তা ও ভয়ের এই সময়ে ভ্রাতৃত্বপূর্ণ সহাবস্থানের বিষয়ে ‘মানবতার সনদ’ প্রকাশ-সংক্রান্ত এই সভায় ড. ইউনূসের যোগদানের বিষয়টি নিয়ে খুব ন্যায্যভাবে কয়েকটি কারণে প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক।

গ্রামীণ ব্যাংক এবং যেসব প্রতিষ্ঠান গ্রামীণ ব্যাংকের টাকায় তৈরি করে তিনি চেয়ারম্যান হয়েছেন এবং তার বিরুদ্ধে বাংলাদেশের আদালতে চলমান তহবিল আত্মসাতের মামলার কারণে তিনি ইতোমধ্যেই একজন প্রশ্নবিদ্ধ এবং বিতর্কিত ব্যক্তি। এখানে খুব স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন ওঠে যে, মানবতার এবং ভ্রাতৃত্ব-সংক্রান্ত ইস্যুতে কীভাবে ড. ইউনূস আমন্ত্রিত হন। কোনোভাবেই ড. ইউনূসের এমন সভায় যোগদানের নৈতিকতা নেই। তিনি ফিলিস্তিনে গাজা অধিবাসীর ওপর নির্মম এবং বর্বর হামলার প্রতিবাদ কখনোই করেননি। বরং সব সময়ই তিনি যুক্তরাষ্ট্রের সাফাই গেয়ে চলেছেন। 

যুক্তরাষ্ট্র মানবতাবিরোধী অনেক কার্যক্রমের সঙ্গে সরাসরি সম্পৃক্ত থাকলেও ড. ইউনূসের অবস্থান তাদের পক্ষেই। এমন একজন বিতর্কিত ব্যক্তিকে মানবতাবিষয়ক গোলটেবিল সম্মেলনে প্রধান বক্তা হিসেবে আমন্ত্রণ জানানোর বিষয়টি নিয়ে সর্বমহলে প্রশ্ন ওঠাই স্বাভাবিক। 

শ্রম আইন লঙ্ঘনের দায়ে অভিযুক্ত ব্যক্তি কীভাবে শান্তি ও মানবতা সম্মেলনের প্রধান বক্তা হন? তার এযাবৎকালের কার্যক্রম প্রমাণ করে যে, তিনি কোনোভাবেই শান্তির পক্ষের ব্যক্তি নন। খুব স্বাভাবিকভাবেই উল্লিখিত সম্মেলনে ড. ইউনূসকে আমন্ত্রণ জানানোর আগে তার অবস্থান শান্তির পক্ষে কি না, সেটি ভেবে দেখা দরকার ছিল। শান্তিতে নোবেল পেয়েছেন কিন্তু বিশ্বের অবহেলিত, নির্যাতিত মানুষের পক্ষে তাকে কখনোই সোচ্চার হতে দেখা যায়নি। তিনি বরং গ্রামীণ ব্যাংক প্রতিষ্ঠার নামে গরিব মানুষকে শোষণ করেছেন।

তিনি অর্থনীতিবিদ হওয়া সত্ত্বেও গ্রামীণ ব্যাংক ও ক্ষুদ্রঋণের প্রবক্তা হিসেবে ২০০৬ সালে শান্তিতে নোবেল পুরস্কার লাভ করেছিলেন। নোবেল পুরস্কার পাওয়ার পরপরই ড. ইউনূস বাংলাদেশে মার্কিন এজেন্ডা বাস্তবায়নে মাঠে নেমেছিলেন। এমনকি তিনি কখনোই শান্তির পক্ষে ছিলেন না। প্রথমে রাজনৈতিক দল করে তিনি ক্ষমতায় যাওয়ার স্বপ্ন দেখেন। কিন্তু জনগণের ভোটে জেতা তার পক্ষে অসম্ভব বুঝতে পেরে তিনি পিছিয়ে যান। 

গত বছরের মার্চ মাসে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম ওয়াশিংটন পোস্টে বিজ্ঞাপন আকারেও প্রকাশিত হয় একটি খোলা চিঠি। সেখানে ড. ইউনূসের প্রতি ন্যায়বিচার করা হচ্ছে কি না, প্রশ্ন তুলে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে ৪০ বিশ্বনেতার লেখা ড. ইউনূসের পক্ষে এক পৃষ্ঠার পক্ষপাতমূলক সাফাই, যা নতুনভাবে তুমুল বিতর্কের জন্ম দেয়। ২০১১ সালে ড. ইউনূসকে যখন দেশের অবসর আইন অমান্য করে ব্যাংকের এমডি পদ থেকে পদত্যাগ করার অনুরোধ এবং ‘উপদেষ্টা ইমেরিটাস’ হিসেবে কাজ করার জন্য আমন্ত্রণ জানানো হয়, তিনি তা প্রত্যাখ্যান করেন এবং সরকারের বিরুদ্ধে মামলা করেন। আপিল বিভাগে আইনি লড়াইয়ে নিজেকে প্রমাণ করতে ব্যর্থ হন। প্রশ্ন হচ্ছে, এসব বিষয়ে কী বলবেন বিদেশি ৪০ নাগরিক?

ড. ইউনূসের বিরুদ্ধে অসংখ্য অভিযোগ রয়েছে। যেগুলো এই এক লেখায় ব্যাখ্যা করা সম্ভব নয়। তিনি এবং তার প্রতিষ্ঠিত অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে ওঠা দুর্নীতি ও আর্থিক অনিয়মের তদন্ত প্রথম করে নরওয়ের রাষ্ট্রীয় টেলিভিশন। তাদের অনুসন্ধানী প্রতিবেদন থেকে ডেনমার্কের চলচ্চিত্র নির্মাতা টম হাইনম্যান তৈরি করেন ‘ক্ষুদ্রঋণের ফাঁদে’ (Caught in Micro Debt) নামে এক প্রামাণ্য চলচিত্র। বিভিন্ন সময়ে দেশে-বিদেশে শান্তিতে নোবেল বিজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসের যে ইতিবাচক চিত্র মানুষের সামনে তুলে ধরা হয়েছিল, এই চলচ্চিত্রটি সম্পূর্ণ তার বিপরীত একটি চিত্র তুলে এনেছে। দারিদ্র্য দূরীকরণের জন্য ভর্তুকি হিসেবে গ্রামীণ ব্যাংককে ১৯৯৬ সালে ইউরোপের বেশ কয়েকটি দেশের (নরওয়ে, সুইডেন, নেদারল্যান্ডস ও জার্মানি) দেওয়া অর্থ থেকে ১০ কোটি ডলারেরও বেশি গ্রামীণ ব্যাংক থেকে গ্রামীণ কল্যাণ নামে নিজের অন্য এক প্রতিষ্ঠানে সরিয়ে নেন ইউনূস; যা নিয়মবহির্ভূত ও প্রকৃতপক্ষে গ্রামীণ ব্যাংকের অর্থ।

প্রামাণ্য চিত্রটি তৈরির সময়ে এর নির্মাতা ছয় মাস ঘুরে এ সম্পর্কে ড. ইউনূসের বক্তব্য নিতে পারেননি, উপরন্তু প্রতিবেদনটি প্রচার না করার জন্য চ্যানেল কর্তৃপক্ষকে চিঠি লেখেন ড. ইউনূস। গ্রামীণ ব্যাংক প্রতিষ্ঠার পর থেকেই দাতাগোষ্ঠী অনুদান এবং ঋণ দেয় গ্রামীণ ব্যাংককে। অনুদানের সব অর্থ রাষ্ট্র এবং জনগণের জন্য ব্যয় না করে গঠন করেন সোশ্যাল ভেনচার ক্যাপিটাল ফান্ড (এসভিসিএফ)। ১৯৯২ সালের ৭ অক্টোবর ওই ফান্ড দিয়ে আলাদা একটি প্রতিষ্ঠান গঠনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। ১৯৯৪ সালেই ‘গ্রামীণ ফান্ড’ নামের একটি লিমিটেড কোম্পানি গঠন করা হয়। তাতে ওই ফান্ডের ৪৯.১০ কোটি টাকা স্থানান্তর করা হয়। সুতরাং গ্রামীণ ব্যাংক দেখিয়ে বিদেশ থেকে টাকা এনে তা সরিয়ে ফেলার চেষ্টা ছিল শুরু থেকেই।

মজার ব্যাপার হলো, গ্রামীণ ব্যাংকের অর্থে এবং বোর্ডসভার সিদ্ধান্তের মাধ্যমে গ্রামীণ কল্যাণ এবং গ্রামীণ ফান্ড গঠিত হয়। এই দুটি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে যে প্রতিষ্ঠানগুলো গঠিত হয়েছে তা সবই আইনত গ্রামীণ ব্যাংকের অঙ্গপ্রতিষ্ঠান। কিন্তু ২০২০ সাল পর্যন্ত গ্রামীণ ফান্ড এবং গ্রামীণ কল্যাণের পরিচালনা পর্ষদে গ্রামীণ ব্যাংকের প্রতিনিধি থাকলেও ২০২১ সাল থেকে এই প্রতিষ্ঠান দুটিতে গ্রামীণ ব্যাংকের প্রতিনিধি নেই। গ্রামীণ ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী এ দুটি প্রতিষ্ঠানের চেয়ারম্যান হবেন গ্রামীণ ব্যাংকের মনোনীত ব্যক্তি। কিন্তু ড. ইউনূস এখনো গ্রামীণ কল্যাণ এবং গ্রামীণ ফান্ডের চেয়ারম্যান পদে বহাল আছেন।

নোবেল বিজয়ী বলে তাকে ধোয়া তুলসী পাতা ভাবা নিশ্চিতভাবে অযৌক্তিক। পাশের দেশ মায়ানমারের রাষ্ট্রীয় আদালত অং সান সু চিকে বিভিন্ন অপরাধের জন্য কারাদণ্ড দিয়ে প্রমাণ করেছেন নোবেল বিজয়ী হওয়া মানে বিচারের ঊর্ধ্বে চলে যাওয়া নয় এবং নোবেল বিজয়ী হলেই ধরে নেওয়া যাবে না যে তিনি অপরাধ করতে অক্ষম। আন্তর্জাতিক ফৌজদারি আদালতও সু চির বিরুদ্ধে গণহত্যার অভিযোগের তদন্তে নেমেছে। বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রের আদালতে সাবেক প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের বিচার হয়েছে এবং হচ্ছে। অতীতে সে দেশেই আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) প্রধান ডমিনিক স্ট্রস কানের বিরুদ্ধে ধর্ষণের অভিযোগে বিচার হয়েছে। সাবেক ফরাসি প্রেসিডেন্ট নিকোলাই সারকোজির বিচার প্রমাণ করছে যে, বড় মাপের মানুষ হলেই তিনি অপরাধমুক্ত হবেন বা বিচারের ঊর্ধ্বে থাকবেন, এমনটি হতে পারে না।

লেখক: অধ্যাপক, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়
[email protected] 

রাজস্ব আহরণ: স্ববিরোধিতার কয়েকটি দিক

প্রকাশ: ১৬ মে ২০২৪, ১১:৪১ এএম
রাজস্ব আহরণ: স্ববিরোধিতার কয়েকটি দিক
ড. মোহাম্মদ আবদুল মজিদ

কয়েক বছর ধরে বাংলাদেশের অর্থনীতি যে অবস্থায় তা থেকে বোঝা যায়, রাজস্ব আয় অর্জন একটা বড় ধরনের চ্যালেঞ্জ বা পুশ ফ্যাক্টরের মধ্যে আছে। অর্থাৎ রাজস্ব আহরণকে একটা কাঙ্ক্ষিত পরিমাণে উন্নীত করার জোর চেষ্টা চলছে। বিপুলসংখ্যক করদাতা এখনো করজালের আওতায় আসতে পারেনি, আনা যায়নি। অন্যদিকে কর ও শুল্কায়নযোগ্য যে খাতগুলো বাদ পড়ে গেছে বা বাইরে আছে, সেগুলোকে শুল্ক ও করের আওতায় আনার চেষ্টাও চলছে। তবে উভয় ক্ষেত্রেই পরিশীলিত দৃঢ়প্রত্যয়ী রাজনৈতিক প্রতিশ্রুতি উদ্ভূত কর্মপরিকল্পনা নিয়ে অগ্রসর হয়ে একটা করদাতাবান্ধব ও উৎসাহ প্রণোদনামূলক পদ্ধতি গড়ে তোলা বা চাপ প্রয়োগের প্রয়োজনীয়তা অনুভূত হচ্ছে। অর্থাৎ কর যারা দেয় না, তাদের উৎসাহিত করার পাশাপাশি কর প্রদানে যারা ফাঁকি দিচ্ছে বা এড়িয়ে যাচ্ছে, তাদের প্রতি কঠোর ও কঠিন মনোভাব পোষণ এবং সর্বোপরি কর প্রদান ও আহরণের সংস্কৃতিকে জাতীয় দায়িত্ববোধের চেতনায় উত্তরণ ঘটানো। কর দান ও আহরণের ক্ষেত্রে যেসব প্রতিবন্ধকতা বা জটিলতাসহ স্পর্শকাতরতা রয়েছে, তা দূর করে কার্যকর অবস্থায় নিয়ে আসতে সেই নব্বইয়ের দশক থেকেই চেষ্টা চলছে। নব্বইয়ের দশক পর্যন্ত আমদানি বাণিজ্যনির্ভর অর্থনীতির সময়ে নিজস্ব উৎপাদনব্যবস্থা তেমন ছিল না বলে তখন আমদানি শুল্ক ব্যতিরেকে কর ও ভ্যাট রাজস্ব আহরণের আবশ্যকতা দেখা দেয়নি। নব্বইয়ের দশকে বাংলাদেশের অর্থনীতি যখন ট্রেডিং-নির্ভরতা থেকে ম্যানুফ্যাকচারিংয়ের দিকে অগ্রসরমাণ হয়, তখন থেকেই শুল্কের চাইতে করের কলেবর বৃদ্ধি পেতে থাকে। রেমিট্যান্সের পাশাপাশি পোশাকশিল্পের হাত ধরে আমাদের রপ্তানি আয় ও উন্নয়ন বেড়ে গেলে এবং আমদানি ব্যয় হ্রাস পেতে থাকলে অভ্যন্তরীণ রাজস্ব সংগ্রহসংক্রান্ত বিষয়াদি নতুন করে জাতীয় ভাব-ভাবনার চৌহদ্দিতে চলে আসে। অন্যদিকে নব্বইয়ের দশকের শুরুতেই রুশ ফেডারেশনের পতনে বিশ্ব অর্থনীতিতে নতুন মেরূকরণ শুরু হয়। তখন উন্নয়নশীল দেশগুলোর আগের মতো বিদেশি ঋণ অনুদান প্রাপ্তির সুযোগ এবং সম্ভাবনা হ্রাস পায়। ফলে অনেকটা বাধ্য হয়েই বাংলাদেশের মতো অনুন্নত অথচ উন্নয়ন আগ্রহী দেশে নিজস্ব রাজস্ব আহরণের গুরুত্ব বেড়ে যায়।
 
এতদসত্ত্বেও রাজস্ব আহরণের প্রয়াস প্রচেষ্টা অব্যাহত রেখেও কর জিডিপির রেশিও কাঙ্ক্ষিত পর্যায়ে পৌঁছতে এখনো মনে হচ্ছে অনেক পথ বাকি। বাংলাদেশের ট্যাক্স জিডিপি রেশিও বরাবরই নিম্ন পর্যায়ের আশপাশেই ঘুরছে, যদিও সব সময় কর রাজস্ব আহরণের কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ ছিল বা আছে অনেক বেশি। অর্থাৎ লক্ষ্যমাত্রা বেশি ধরা হলেও তা পূরণে সফলতার গতি গজেন্দ্রগামী। এ ক্ষেত্রে পদ্ধতিগত, অবকাঠামোগত এবং বিবিধ সব ধরনের ত্রুটি দূর করে উপযুক্ত করদাতাদের মধ্য থেকে যত বেশিজনকে করের আওতায় আনা যায়, সে চেষ্টাই যেন শুধু চলছে। পাশাপাশি যেসব নিত্যনতুন আর্থিক খাত তৈরি হচ্ছে, সেগুলোকেও চটজলদি করের আওতায় আনার প্রয়াস চলছে। কিন্তু কর্মক্ষমতায় ও কর্মদক্ষতায় সে প্রয়াস কাঙ্ক্ষিত ফলাফল আনতে যথেষ্ট সময় নিচ্ছে। জিডিপি বাড়লে আহরণকৃত করের পরিমাণও বাড়বে, এটা স্বতঃসিদ্ধ নিয়ম। মোল্লা নাসির উদ্দীনের সেই গল্পের মতো বিড়াল মাংস খেয়ে ফেলেছে। বিড়ালের ওজন নিয়ে দেখা গেল মাংস ও বিড়ালের হিসাবে মেলানো কঠিন হচ্ছে। এই যদি বিড়ালের খাওয়া মাংস হয়, তাহলে বিড়াল কই। কিংবা এই যদি বিড়ালের ওজন হয়, তাহলে তার খাওয়া মাংস কোথায়। কর ফাঁকিবাজদের আড়াল করতে, ফাঁকি দিতে আয় অপ্রদর্শনকারীকে প্রশ্রয় দিতে মোটা অঙ্কে কর অব্যাহতি মওকুফ করে কর জিডিপি রেশিও বাড়ছে না- এটাকেও মানতে ভিন্নমত বা নারাজি হওয়াটাও কর জিডিপি রেশিওর উন্নতির পথে বাধা। 

বছর বছর ট্যাক্স রেট, কর রেয়াতের মাত্রা, অবকাশের হার ও ক্ষেত্রে নিত্যনতুন সংশোধন, সংস্কার প্রস্তাবনা যেন বেড়েই চলেছে। এ ক্ষেত্রে খেয়াল করতে হবে প্রতিবছরের অর্থ বিলে যদি এক একটা আইনের ধারা-উপধারা অতি পরিবর্তন-পরিবর্ধন ও সংশোধনের হিড়িক পড়ে, তখন সংশ্লিষ্ট সবার পক্ষে ওই সব পরিবর্তন ফলো করা কঠিন তো হয়ই, এসব প্রয়োগে জটিলতা আরও বাড়ে বৈ কমে না। ব্যবসা-বাণিজ্য বিনিয়োগে সিদ্ধান্ত নিতে বেশ দুশ্চিন্তায় পড়তে হয় করদাতাদের। আইনের সংশোধনসংক্রান্ত এসআরওর প্রয়োগ ন্যূনতম তিন বছর বা তার বেশি হলে ওই এআরওর কার্যকারিতা অনুসরণ, অনুধাবন যুক্তিযুক্ত পর্যায়ে পৌঁছায়। এদিকে আয়কর পরিপত্র-১ জারিতে বিলম্ব করেও তাতে কিছু কিছু বিষয়ে অস্পষ্টতা নিরসনে ব্যাখ্যার অবকাশ থেকে যায়। এসবই সঠিক পরিমাণে ন্যায্য কর আদায়ের ক্ষেত্রে বিলম্ব সৃষ্টি বা অন্তরায় হিসেবে কাজ করতে পারে। পরিপত্রে স্পষ্টীকরণ করতে গিয়ে যে দীর্ঘসূত্রতা তা থেকে উত্তরণ ঘটানো সম্ভব না হলে প্রাতিষ্ঠানিক ও প্রতিবেশগত নানা প্রভাব পুরো বিষয়টিকে ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করতে পারে, অনেক ক্ষেত্রেই উপযুক্ত কর আদায়ের জন্য অপারগ পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে পারে। বাংলাদেশের অর্থবছর শুরু থেকেই ঝড়বৃষ্টি ও প্রাকৃতিক দুর্যোগের পাশাপাশি আরও নানান উপলক্ষের সমস্যা থাকে, এর সুযোগ নিয়ে আয়কর দেওয়ার সময় বাড়িয়ে নিতে চেষ্টা করে সবাই। এ অবস্থা থেকে স্থায়ীভাবে বেরিয়ে আসতেই এবার আইনের মধ্যেই সময় নির্ধারণ করা হয়েছে, অর্থবছর শেষ হওয়ার তিন মাসের স্থলে পাঁচ মাস পর্যন্ত অর্থাৎ নভেম্বর মাস পর্যন্ত ব্যক্তি আয়কর দেওয়া যাবে। যেহেতু সবাই অপেক্ষা করে পরিপত্র জারির, তাই সেই কাঙ্ক্ষিত ব্যাখ্যার জন্য অপেক্ষায় কিংবা পরিপত্র জারির দেরি হওয়াকে হয়তো নভেম্বর নির্ধারণে প্রেরণা হিসেবে কাজ করে থাকতে পারে। কিন্তু আমরা যদি সবাইকে করের আওতায় আনতে চাই, তাহলে অর্থবছর শেষ হওয়ার পর পাঁচ মাস পর্যন্ত অপেক্ষার অবকাশ অর্থাৎ সময়ক্ষেপণের এ ধরনের অবস্থা থেকে বেরিয়ে এসে সবার জন্য যথাসময়ে কর দেওয়ার সহজ সুযোগ সৃষ্টি শ্রেয়তর বিবেচিত হতে পারে।
 
বাজেটে নতুন হারে করারোপের পর অর্থবছরের শুরু থেকেই কর কীভাবে দিতে হবে, কোন কোন পরিস্থিতিতে কী করণীয়, সেটা নিশ্চিত না করা গেলে সমস্যা সৃষ্টি হবে, এটাই স্বাভাবিক। এ ক্ষেত্রে নভেম্বর পর্যন্ত সময় বাড়িয়ে নেওয়ায় মূল সমস্যা যেটা হতে পারে সেটা হলো, কর প্রদান ও প্রাপ্তিতে দীর্ঘসূত্রতা বাড়বে। এ ক্ষেত্রে আগের তুলনায় দুই মাস পর কর আদায় হওয়ায় সামষ্টিক আর্থিক ব্যবস্থাপনায় বিড়ম্বনা ও ব্যাঘাত সৃষ্টি হবে। কেননা অর্থবছরের শুরু থেকে সরকারি অর্থ ব্যয় অব্যাহত থাকে, কিন্তু রাজস্ব আয় কত আসবে, সেটার অপেক্ষায় থাকতে হচ্ছে বেশ কিছুটা সময়। ফলে ব্যাংক বরোয়িং বাড়তে থাকে। অনেক সময় কাঙ্ক্ষিত কর না-ও আসতে পারে। একবারে তিন থেকে পাঁচ মাস টাইম বেড়ে যাওয়ায় সবাই যাতে যার যার মতো গা-ছাড়া ভাব বা বিলম্ব করার প্রবণতায় অর্জিতব্য রাজস্বের উপযোগিতা যাতে হ্রাস না পায়, সেদিকে সচেতন দৃষ্টিক্ষেপ প্রয়োজন হবে।
 
এ ক্ষেত্রে কর আহরণের প্রকৃতি এবং বাজেট প্রণয়ন ও ব্যবস্থাপনায় সংস্কার আনা প্রয়োজন। উল্লখ করা যেতে পারে, বেশ বিলম্ব করে শুরু হওয়া বাজেট-পূর্ব আলোচনাগুলোর কথা। বাজেট নিয়ে সবাই এমন একসময় নিজেদের দাবি ও সুপারিশ উত্থাপন শুরু করে তখন আর বাজেট প্রস্তাব সংশোধনের কোনো সুযোগ থাকে না। এ ক্ষেত্রে আলোচনা ও দাবিদাওয়া পেশ করার সময়ও পাওয়া যায় না ঠিকমতো। ফলে যে দাবি ও সুপারিশ আসছে তার বিবেচনায় কোনো ভিত্তি হয়ে ওঠে না, ফলে দাবিগুলো ও সুপারিশগুলো বাস্তবায়ন বা পূরণ করা সম্ভব হয় না ঠিকমতো। অর্থ আইনেই নতুন কর আরোপ, ব্যাখ্যা, রাজস্ব আহরণের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারিত হয়ে থাকে। এটি গ্রহণ, পরীক্ষা, পর্যালোচনা এবং রাষ্ট্রপতির অনুমোদনের জন্য সুপারিশ করার সাংবিধানিক এখতিয়ার বা কর্তৃত্ব এবং দায়দায়িত্ব সংসদের। অর্থ আইন পাস হওয়ার পর ওই আইন বা বিধিবিধান নিয়ে আদালতে যাওয়ার সুযোগ রাখা হয়নি এ জন্য যে, তাহলে কর আরোপে নিরঙ্কুশ অধিকার প্রতিষ্ঠা পাবে না। এই নিরিখে বাজেট তথা অর্থ আইন পাসে সংসদের মনোযোগ, সতর্কতা সর্বসম্মত অভিমত গঠন জরুরি। এই নিরিখে অর্থ আইন সংসদে পেশের আগে থেকেই এর প্রণয়ন-প্রক্রিয়ায় সংসদীয় কমিটিগুলোর অংশগ্রহণ অনিবার্য হয়ে ওঠে এ জন্য যে, আইন সংসদে পেশ হওয়ার পর এবং তা পাসের আগে চুলচেরা বিশ্লেষণের সময় পাওয়া যায় মাত্র কয়েকটা কার্যদিবস। অর্থ আইন পাসের পর বাস্তবায়ন পর্যায়ে গিয়ে যেসব প্রতিবন্ধকতা উপস্থিত হয়, তা সামাল দেওয়ার দায়িত্ব, তা পরিপালনের ব্যর্থতার জবাবদিহি চাওয়ার কর্তৃত্ব সংসদেরই। 

আরেকটা প্রসঙ্গে একটু বলা প্রয়োজন, সেটা হচ্ছে অর্থবছর সম্পর্কিত। যেখানে অনেক দিন থেকেই বলা হচ্ছে বা দেখা যাচ্ছে খুব স্পষ্টতই যে, বাংলাদেশের অর্থবছরের সময়সীমা বদল হওয়া দরকার। আমাদের এখানে ভরা বর্ষায় অর্থাৎ ১৬ আষাঢ় পয়লা জুলাই থেকে শুরু হয়ে ১৫ আষাঢ় পর্যন্ত (৩০ জুন তা শেষ হয়), উভয় দিকেই নানান প্রাকৃতিক সমস্যা থাকে। এটা যা-ই হোক, অন্তত কর আদায়ের জন্য অর্থবছর গণনার জন্য উপযুক্ত সময়কাল হতে পারে না। কারণ বন্যা থেকে শুরু করে নানা ধরনের ঝড়বৃষ্টি ও প্রাকৃতিক বিপর্যয় মোক্ষম মৌসুমে কর আদায় শ্লথ হয়ে পড়ে। আয়কর আহরণের ক্ষেত্রে বর্তমানে যে নভেম্বর মাস বলবৎ করা হয়েছে তার সুবিধা একটাই যে, তখন প্রকৃতিগত কোনো সমস্যা থাকে না। নানা কারণ মিলে একটা বিষয় নিশ্চিত করে বলা যায়, জুন-জুলাই যা-ই হোক অন্তত বাংলাদেশের জন্য অর্থবছর হিসেবে এপ্রিল-মার্চ কিংবা জানুয়ারি-ডিসেম্বর যুক্তিযুক্ত ও গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে ভাবনার অবকাশ থেকেই যাচ্ছে। 

লেখক: সাবেক সচিব এবং এনবিআরের
সাবেক চেয়ারম্যান
[email protected]