![একটি সাংঘাতিক প্রেমের গল্প](uploads/2024/02/27/1709012544.rong-jabe-1.jpg)
সাংবাদিক হওয়ার ইচ্ছা কীভাবে হয়েছিল জানি না। তেমন কোনো যোগ্যতা না থাকার পরও একসময় আমিও সাংবাদিক হয়ে গেলাম। দায়িত্ব পড়ল বইমেলা কাভার করা। গলায় ক্যামেরা ঝুলিয়ে হাতে কলম আর নোটবুক নিয়ে বুকের ছাতি কয়েক ইঞ্চি ফুলিয়ে বইমেলায় প্রবেশ করা শুরু করলাম।
বাংলা একাডেমির ভেতর ছিল মিডিয়া ভবন। নতুন নতুন সাংবাদিক হলে যা হয়, আমারও তা-ই হলো। কোনো কাজ নেই তবুও বিকেল করে মেলায় গিয়ে মিডিয়া ভবনে ভাব নিয়ে বসে থাকতাম, নোটবুকে কিছু লেখার চেষ্টা করতাম। মিডিয়া ভবনের প্রতি মানুষ কোনো আগ্রহ দেখাত না তবে তাতে আমার আগ্রহ কিছুটা কমত না।
এরকম এক ফাগুনের বিকেলে ভাব নেওয়া শেষ করে মাত্র মিডিয়া ভবন থেকে বের হয়েছি ঠিক তখনই দুর্ঘটনাটা ঘটল! মিডিয়া ভবনের সামনেই একটা লিটল ম্যাগের স্টলে একটা মেয়ে বসেছিল, তার দিকে তাকানোটাই ছিল দুর্ঘটনা! মেয়েটাও আগ্রহ করে মিডিয়া ভবনের দিকে তাকিয়েছিল। চোখাচোখি হতেই আমি এই পৃথিবী থেকে ‘নাই’ হয়ে গেলাম। আমার বুকের মধ্যে হুহু করে ফাগুনের বাতাস বইতে লাগল, হাত-পা-চোখ-মুখ কাঁপতে লাগল।
মনে হলো এই মেয়ের সঙ্গে কথা বলতে না পারলে মরেই যাব! একজন তরুণ সাংবাদিকের এত তাড়াতাড়ি মরে যাওয়াটা ঠিক হবে না ভেবে জীবনের সবচেয়ে বড় ভুল সিদ্ধান্তটা নিয়ে ফেললাম। কথা বলার জন্য প্রয়োজনীয় সাহস সঞ্চয় করে স্টলের দিকে এগিয়ে গেলাম।
স্টলের সামনে অনেকগুলো বই-পত্রিকা সাজানো। মেয়েটা স্টলের দায়িত্বে। গিয়ে বই নাড়াচাড়া করতে লাগলাম আর কীভাবে কথা বলা যায় তাই ভাবতে লাগলাম। একবার সাহস করে তার মুখের দিকে তাকালাম সঙ্গে সঙ্গেই আবার বুকটা হুহু করে উঠল। ওই চোখের দিকে তাকিয়ে কথা বলা তো দূরের কথা জীবনে কোনো দিন কথা বলেছিলাম কি না, সেটাই মনে করতে পারলাম না। চলে যে আসব সেটাও পারছিলাম না।
এরকম একজন মেয়ের কাছ থেকে বই না কিনে চলে এলে মেয়েটা যদি কিছু ভাবে! তাই ১৫০ টাকা খরচ করে হাতের কাছে যে বই পেলাম সেটাই কিনে সেদিনের মতো চলে এলাম।
সাংবাদিকতা মাথায় উঠল! প্রতিদিন তার সামনে যেতাম, কিছু না বলে হাতে যে বইটা উঠত সেটাই কিনে চলে আসতাম। এভাবেই ২২ তারিখ পর্যন্ত গেল, মেলার আর ছয় দিন বাকি। এরই মধ্যে কথা বলতে না পারলে জীবনেও আর বলা হবে না। বাংলা সিনেমার গরিব নায়ক জসিমের কপালেও ৪০ লাখ টাকার লটারি ‘লাইগ্যা’ যায়, বিড়ালের ভাগ্যে শিকে ছেড়ে, আমার ভাগ্যেও কিছু একটা ছিঁড়ল। সেদিন তার স্টলের সামনে যেতেই তিনি নিজ থেকেই কথা বলে উঠলেন।
-ভালো আছেন? আমার নাম সাথী, আপনার সঙ্গে কিছু কথা ছিল। আপনার হাতে সময় হবে?
সময় হবে মানে! আমি আকাশ থেকে পড়লাম। বলে কী এই মেয়ে! যেদিন প্রথম দেখেছি সেদিন থেকে সময় বলতে আমি শুধু এই মুখটাকেই বুঝি। ঘণ্টা-দিন-মাস তার চোখে আটকে আছে, আর তিনি কিনা জানতে চাইছেন আমার সময় হবে কি না!
বললাম, ‘আপনি চাইলে বিগ ব্যাং থেকে শুরু করে আগামী কয়েক লাখ বর্ষ সময় আমি বের করতে পারি। আর আপনি চাচ্ছেন মাত্র ১০ মিনিট।’ আমার কথা শুনে মেয়েটা হেসে ফেলল।
আমরা মেলার ক্যান্টিনে বসে দুই কাপ কফি অর্ডার করলাম। কফি আসার আগে তিনি মুখ খুললেন, আপনি কি আমার প্রেমে পড়েছেন?
ভীষণ লজ্জা করছিল, লজ্জার ঠেলায় হ্যাঁ বলতে গিয়ে বললাম, ‘আরে নাহ। প্রেমে পড়ব কেন? আজব তো।’
-না, মানে কেন যেন মনে হলো আপনি আমার প্রেমে পড়েছেন। গত ১৫ দিন ধরে আপনি আমার স্টলে আসছেন। তারপর প্রতিদিন ১৫০ টাকা দিয়ে বই কিনে নিয়ে যাচ্ছেন। এক দিনও বইয়ের দিকে তাকাননি। বাসায় গিয়েও মনে হয় প্যাকেটও খোলেননি। খুললে বুঝতেন আপনি প্রতিদিন আসলে একটি বই-ই কিনেছেন। বইয়ের নাম ‘পেটের সমস্যায় ঔষধি গাছ’। একই বই ১৫ দিন এসে কেনার পেছনে আমি আর কোনো কারণ খুঁজে পাচ্ছি না।
তার কথা শুনে মাথা নিচু হয়ে গেল। মনে হলো ধরণি দ্বিধা হোক বা না হোক, আমার এখনই মাটির তলে ঢুকে যাওয়া উচিত। তবে পিকচার তখনো কিছুটা বাকি ছিল। তিনি বললেন, ‘আসলে আমার প্রেমে পড়ে লাভ নেই। আমি বিবাহিত। আমার একটা বাচ্চা আছে। ক্লাস ওয়ানে পড়ে..’ এটুকু বলতেই ধপাস করে শব্দ হলো। আমি চেয়ার থেকে পড়ে গিয়ে জ্ঞান হারালাম নাকি জ্ঞান আমাকে হারাল ঠিক পরিষ্কার না। তবে ক্যান্টিনে ছোটাছুটি শুরু হয়ে গেল।
একসময় চোখ মেলে আবিষ্কার করলাম, আমি মাটিতে শুয়ে আছি। সাথী উপুড় হয়ে আমার মুখে পানির ছিটা মারছে। আগ্রহী লোকজন চিড়িয়াখানায় বাঁদর দেখার মতো করে আমাকে দেখছে। একসময় মানুষের বাঁদর দেখা শেষ হলো, যে যার মতো চলে গেল। আমি স্বাভাবিক হয়ে বসে আছি। সাথী বলল, ‘আমি খুবই দুঃখিত। আসলে আমার বিয়ে টিয়ে হয়নি। আপনার সঙ্গে একটু মজা করছিলাম। আপনি এরকম করে ফিট খাবেন জানলে কখনোই এমন করতাম না। সরি...’
অধিক শোকে মানুষ পাথর হয়, অধিক সুখে কী হয় জানি না। সম্ভবত পাগল হয়ে যায়। আমিও পাগল হয়ে গেলাম। কিছু না বুঝেই সাথীর হাত আমার হাতে নিয়ে বললাম, ‘সাথী প্লিজ, প্লিজ... আমাকে তুমি ভুল বোঝো না। আমি তোমার প্রেমে পাগল হয়ে গিয়েছি। তোমাকে ছাড়া আর কিছু ভাবতে পারি না, ভীষণ ভীষণ ভালোবাসি তোমাকে..’
কোথাও বোম ফুটল না, শঙ্খচিল উড়ল না, আকাশে বিজলি চমকালো না, পাখি গান গাইল না, কৃষ্ণচূড়া লাল হলো না.. শুধু মুচকি হেসে সাথী বলল, ‘সে তো আমি প্রথম দিন থেকেই জানি।’
মহাকাল আরও কিছু কাল অতিক্রম করল, পৃথিবী তার অক্ষের চারপাশে আরেকটু ঘুরে এল, বিভিন্ন স্টলে বেশ কিছু বই বিক্রি হলো, শাহবাগ মোড়ে তিনটি সিগন্যাল ছাড়ল, টিএসসিতে কয়েক শ কাপ চা বিক্রি হলো। সাথী তার হাত সরিয়ে নিল না।
কলি