![একটি তেলাপোকার আত্মকথা](uploads/2024/02/27/1709013001.rongo-jabe.jpg)
আমি একটি বাদামি তেলাপোকা। জন্মের পর বাবা-মায়ের দেওয়া একটা নাম অবশ্য আছে, কিন্তু সে নামে আমাকে কেউ চেনে না। চেনে তেলাপোকা নামে। শুধু এখানেই আমার পরিচয়ের সমাপ্তি নয়, মানুষের দৃষ্টিভঙ্গিতেও আমার অবস্থান ভিন্ন। কেউ চেনে আমাকে বিভিন্ন সংক্রামক রোগের বাহক হিসেবে, আবার কারও চোখে আমি সাক্ষাৎ যম।
মায়ের কাছ থেকে শুনেছি, রহিম সাহেবের বাসভবনের দোতলার আলমারির এক অন্ধকার কোণে আমার জন্ম। বয়স যখন ১৭ দিন, তখন মা আমাদের পাঁচ ভাইয়ের জন্য খাবার আনতে গিয়ে আর ফেরেনি। সমগোত্রীয়দের কাছ শুনেছি, রহিম সাহেবের বিশালবপু দারোয়ানের পদতলে পিষ্ট হয়ে মা পটল তুলেছিলেন। মায়ের দুঃখে বাবা তেলাপোকার ওষুধ খেয়ে নেন। ভেজাল ওষুধ বলে তিনি মরেননি। তবে কঠিন ডায়রিয়ায় ভুগেছিলেন।
সেদিনের কথা, আমি খাবার আনতে গিয়েছিলাম রহিম সাহেবের বাড়ির দক্ষিণ দিকের কিচেনে। সেখানে গিয়ে মাত্র দাঁড়িয়েছি, অমনি কোথা থেকে রহিম সাহেবের কাজের বুয়া এসে শলার ঝাড়ু দিয়ে দিল এক বাড়ি। ভাগ্য ভালো ছিল তাই ফসকে বাড়িটা গায়ে লাগেনি। তবে মুখের একটা গোঁফ ছিঁড়ে গিয়েছিল। তা দেখে আমার সমগোত্রীয় তেলাপোকাদের সে কী হাসাহাসি! একজন তো বলেই ফেলল, ‘রহিম সাহেবের বুয়াটার বোধহয় তোমার গোঁফটা পছন্দ হয়েছিল, তাই নিয়ে নিয়েছে।’ সেদিন কান্নায় আমার বুকটা ভেঙে যাচ্ছিল। ইচ্ছা করছিল নিজের পাখনা নিজে ছিঁড়ি! কিন্তু হাত না থাকায় পারিনি।
মাঝে মাঝে আমার মনে হতো, আমার এ দুর্ভাগ্যের কথা কোন মানুষকে গিয়ে বলি! শুনে তারা আমাকে ভালোবাসতেও পারে! এক দিন বিকেলে রহিম সাহেবের ছেলের বান্ধবী এসেছিল। তারা যখন গল্প করছিল তখন আমি উড়ে গিয়ে মেয়েটার কাঁধের ওপর বসি। রহিম সাহেবের ছেলে ভূত দেখার মতো চমকে ছিটকে সরে গেল। মেয়েটা এমন চিৎকার দিল যে, আমার কানের পর্দা গেল ফেটে। সেই থেকে কানে কম শুনি। সরকারি নাক, কান ও গলা হাসপাতালে গিয়েছিলাম কিন্তু গিয়ে শুনলাম, তেলাপোকাদের চিকিৎসার কোনো ব্যবস্থা সেখানে নেই। হায়রে আমার তেলাপোকা জনম। খুব কান্না পাচ্ছিল। সেই গানটির কথা মনে পড়ছিল, ‘তেল গেলে ফুরাইয়া বাত্তি যায় নিভিয়া, কী হবে আর কান্দিয়া...’।
আজ সকালে বিছানায় শুয়ে আছি। হঠাৎ ‘ফস’ ‘ফস’ করে শব্দ হলো। আমার সিক্সথ সেন্স বলল, ‘বিপদ’। বুদ্ধি করে শব্দের উল্টোদিকে দৌড় দিলাম। কিছুক্ষণ পর সেখানেও একই শব্দ হলো। বুঝলাম তেলাপোকার স্প্রে দিচ্ছে। মাথাটা কেমন যেন ‘ভোঁ’ ‘ভোঁ’ করে উঠল। আমি আলমারির অন্ধকার থেকে বেরিয়ে আসতেই ‘সপাং’ ‘সপাং’ করে দুটো ঝাড়ুর বাড়ি আমার ক্ষুদ্র দেহের ওপর এসে পড়ল। তারপর আর কিছু মনে নেই।
আমি এখন পা উপর দিকে দিয়ে, উল্টো হয়ে দিব্যি শুয়ে আছি। কিছুক্ষণ পর হয়তো রহিম সাহেবের বুয়া আমাকে ময়লার ভাগাড়ে ফেলে আসবে। হোমলেস হয়ে যাব এক নিমিষেই। তেলাপোকাদের জীবনটাই বোধহয় এরকম। তোমরা ভালো থেকো। বিদায়।
কলি